6 of 8

ধারদেনা

ধারদেনা

মহাগুরু শিবরাম শতবর্ষে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করছি।

আমাদের এবারের বিষয় ধারদেনা। ধার সকলেই করে থাকে। যে বড়লোক প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিলিতি গাড়ি চড়ে, যখন-তখন দিল্লি-হিল্লি-লন্ডন-নিউইয়র্ক যায়, বাজারে তার ধার কোটি কোটি টাকা। ব্যাঙ্কের কাছে, সরকারের কাছে এমনকী কোম্পানির নামে শেয়ার বেচে আপামর জনতার কাছে।

হিসেব নিলে দেখা যাবে এদের নিজের অর্থ মোটেই নেই সবই অন্যের পরস্মৈপদী।

এর তুলনায় সাধারণ গৃহস্থ মোটামুটি ভাল। তার হয়তো ব্যাঙ্কের কাছে বাড়ি তৈরির ঋণ—তার হয়তো আত্মীয়-বন্ধুর কাছে মেয়ের বিয়ের সময়, পিতৃশ্রাদ্ধের সময় কিছু ঋণ আছে।

কিন্তু তার সামান্য আয় থেকে সে শোধ দেওয়ার চেষ্টা করছে, এটাই মধ্যবিত্ত মানসিকতা।

বড়লোকেরা এই সব ঋণশোধ নিয়ে মাথা ঘামানোর চেষ্টা করেন না। তাঁদের আমোদ-প্রমোদ বিলাসিতা সবই ঋণের টাকা থেকে।

আমাদের এই দেশে হাজার-হাজার কোটি-কোটি টাকা ব্যাঙ্কে ঋণ রয়েছে—এইসব লোকেদের।

আবার যে ভিখারি পাশের ভিখারির কাছ থেকে একটা বিড়ি, বা দু’ মুঠো চাল ধার করে— সেটাও কিন্তু সে শোধ দেয়। নিম্নমধ্যবিত্তরাও ব্যাঙ্ক থেকে না পেলেও প্রয়োজনে আত্মীয়- বন্ধু-সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার নেয় এবং যথাকালে শোধ দেওয়ার চেষ্টা করে।

গরিবের সমাজে যথাকালে ঋণ শোধ না দেওয়া অসম্মান বলে পরিগণিত হয়।

বড়লোকেদের “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” এই চাণক্য শ্লোকে আস্থা নেই।

সে যাহোক শিবরাম চক্রবর্তীকে স্মরণ করার পরে এতসব বড় বড় কথা না বলাই ভাল। বরং শিবরামের ধার শোধ করার সহজ পদ্ধতিটি বলি—যতদূর মনে পড়ছে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের কাহিনী। শিবরাম কোনও এক সপ্তাহের গোড়ায় হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে শ-পাঁচেক টাকা ধার করেছেন।

তারপর সপ্তাহের মাঝামাঝি গোবর্ধনের কাছ থেকে টাকা-ধার নিয়ে ওই টাকা শোধ করেছেন। এইভাবে কয়েক সপ্তাহ চলল তারপর একদিন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন দু’-ভাইকে একত্রে পেয়ে—

শিবরাম বললেন দেখ আমি তোমাদের দু’জনের মধ্যে থাকতে চাই না। প্রত্যেক সপ্তাহে প্রথমে হর্ষবর্ধন গোবর্ধনকে টাকা দেবে আবার সপ্তাহের মাঝখানে সেই টাকা গোবর্ধন হর্ষবর্ধনকে দেবে ।

এইভাবে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, গোবর্ধন-হর্ষবর্ধন—সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলবে। ঋণ গ্রহীতার আর ঋণশোধের প্রয়োজন কী?

কেউ কোনও উপকার করলে তাকে ‘চিরঋণী থাকব’ বলে এক ধরনের ভদ্রতা আছে।

কিন্তু সত্যিই যদি কারওর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তাকে যদি বলি চিরঋণী থাকব—তাহলে সে বোধহয় আঁতকে উঠবে।

অবশ্য শিবরাম যে কৌশলে ওপরের গল্পে ঋণশোধ করেছেন তারপরে চিরঋণী থাকার প্রশ্ন আসে না। এখানে ঋণ নিয়মিত শোধ হয়ে যাচ্ছে।

কিছুদিন আগে রবিবাসরীয় সংবাদপত্রে একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। মনে রাখার মতো গল্প।

গল্প লেখক একদিন সকালবেলা খবরের কাগজে দেখতে পেলেন লটারিতে তাঁর নম্বর উঠেছে, দশ বিশ টাকা নয়—প্রথম পুরস্কার দশ লক্ষ টাকা।

এই টাকা পেয়েও তাঁর মাথা কিন্তু ঠিক রইল। তিনি বুঝতে পারলেন লটারির টিকিটের খবর গোপন করা যাবে না—সবাই জেনে যাবে এবং নানা অছিলায় টাকা চাইতে থাকবে।

মনে মনে এই রকম ব্যক্তিদের সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে তিনি একের পর এক ফোন করতে লাগলেন, “ভাই বড় বিপদে পড়েছি—হাজার দশেক টাকা দেবে?” সবাই নানা অজুহাতে তাঁকে এড়িয়ে গেল। এবার গল্প লেখক নিশ্চিত তাঁর কাছে আর কেউ টাকা চাইতে আসবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *