হাওড়ায় মেথর-ঝাড়ুদার ধর্মঘট
আমরা যখন কলকাতায় মেথর-ঝাড়ুদারদের প্রথম ধর্মঘটের পরিচালনা করছিলেম সেই সময়ে কিংবা তার কিছুদিন আগে আমরা হাওড়ায় স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গলের শাখা স্থাপনের চেষ্টাও শুরু করি। এর প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় নামক একজন যুবক। এই শচীনন্দনের একটা ইতিহাস আছে। সে ১৯২১ সালে যশোহরের কোনো এক হাই স্কুলের ক্লাস সেভেন বা ক্লাস এইটের ছাত্র ছিল। এই সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সে স্কুল ছেড়ে দেয়। তখন দেশে মিটিং-এর বান ডেকেছিল। এই ছোট ছেলেটিও সেই সকল সভায় বক্তৃতা দিতে লাগল। ফলে কিছু দিনের ভিতরে দেখা গেল যে সে একজন সুবক্তা হয়ে উঠেছে। লোকে তাকে বাহবা দিতে লাগল। কলকাতার দৈনিক কাগজে তার ফটোও ছাপা হলো। তার নীচে লেখা হলো “যশোহরের বালক বীর”। কিছু দিনের ভিতরেই অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলো। তখন অন্য অনেক ছেলের মতো শচীনন্দন আর স্কুলে ফিরে গেল না। তার পিতা স্কুল মাস্টার ছিলেন। তিনি নিশ্চয় তাকে স্কুলে ফিরে যেতে অনেক চেষ্টা করে থাকবেন।
শচীনন্দনের বয়স যত বাড়ছিল ততই সে নানান রকমের রাজনীতিক আড্ডায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ১৯২৬ সালে হিন্দু-মুস্লিম দাঙ্গার আবহাওয়ায় “অগ্রদূত” নাম দিয়ে সে একখানি সাপ্তাহিক কাগজও বার করেছিল। কবি নজরুল ইস্লাম এই কাগজে লিখেছিল :
“চারদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েশির আখড়া দিয়ে
রে অগ্রদূত চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?”
১৯২৮ সালে আমরা যখন কলকাতায় মেথর-ঝাড়ুদারদের নিয়ে ব্যস্ত তখন শচীনন্দন এলো আমার নিকটে। বলল, “আপনার যদি অনুমিত দেন তবে আমি হাওড়ায় এই ইউনিয়নের একটি শাখা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি। সেখানে আমার কিছু চেনা লোক আছেন। তাঁদের সাহায্য আমি পাব।” আমি বললাম বেশ তো দেখ না চেষ্টা করে। যদি সেখানে আমাদের শাখা গঠন করতে পার ভালোই তো।” শচী তার চেনা লোকেদের মধ্যে তিনজনের নাম আমায় বলেছিল। তাঁরা হলেন শিবপুরের-জীবনকৃষ্ণ মাইতি, অগম দত্ত ও প্রমোদ বসু। খোলাখুলিভাবে তাঁরা কংগ্রেসের কর্মী ছিলেন, আর গোপনে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সহিত তাঁদের সংস্রব ছিল। এই তিনজনের দু’জনের সহিত আমরা পরিচিত হয়েছিলেম। জীবনকৃষ্ণ মাইতি ও অগম দত্ত ২/১, আবদুল হালীম লেনে (তখন নাম ছিল ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেন) আমাদের ওয়ার্কাস এন্ড পেজান্ট্স পার্টির আফিসে এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন যে সেই সময় হতে তাঁরা আমাদের পার্টির সহিত কাজ করবেন। শচীনন্দনকে তাঁরা বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। শচীন সঙ্গে গিয়ে প্রমোদ বসুর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। তিনি তখন প্রচুর উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।
হাওড়ায় স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গলের শাখা গঠিত হলো। আমরা তার একটি দু’টি মিটিংও হাওড়া ময়দানে করলাম। হাওড়ায় ঝাড়ুদারদের চেয়ে মেথরের সংখ্যা বেশী ছিল। সেখানকার সব পায়খানাই ছিল খাটা পায়খানা। মাটির তলায় কোনো ড্রেন তখন ছিল না। ১৯২৮ সালের তেতাল্লিশ বছর পরে আজ সবে মাত্র মাটির তলার ড্রেন প্রস্তুতের প্রচেষ্টা হাওড়ায় শুরু হয়েছে।
হাওড়া মিউনিসিপালিটির নিকটে ইউনিয়নের তরফ হতে নিম্নলিখিত দাবীগুলি পেশ করা হয়েছিল।
মেথর ও ঝাড়ুদারদের মাসিক দুই টাকা হিসাবে বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে।
বছরে সবেতনে ১৫ দিনের ক্যাজুয়েল ছুটি মঞ্জুর করতে হবে।
বছরে একমাস সবেতনে প্রিভিলেজ ছুটি দিতে হবে।
ঘুস নেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে।
কোনো মেথর বা ঝাড়ুদারকে বরখাস্ত করতে হলে এক মাস আগে নোটিস দিতে হবে।
মেথর ও ঝাড়ুদারদের সংগঠিত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে তারা নিজেদের ভিতরে কথা বলে হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিয়ে ইউনিয়ন আফিসে খবর দেন? কলকাতার প্রথম ধর্মঘটে তাই হয়েছিল। কলকাতার দ্বিতীয় ধর্মঘটে অবশ্য, কয়েকদিন আগে স্থির করে ধর্মঘট করা হয়েছিল।
হাওড়ার মেথর-ঝাড়ুদারেরাও হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিয়ে ইউনিয়ন আফিসে খবর পাঠালেন। ১৯২৮ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে তাঁরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আট নম্বর ওয়ার্ডের শানাপাড়ার মজুরেরা ধর্মঘট ঘোষণা না করেই ৬ই এপ্রিল হতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ৮ই এপ্রিল (১৯২৮) তারিখে ছয়, সাত, আট, নয় ও দশ নম্বর ওয়ার্ডের মেথর ও ঝাড়ুদারেরা ধর্মঘট করেছিলেন। পরের দিন বাকী ওয়ার্ডগুলির, অর্থাৎ এক হতে পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মজুরেরাও ধর্মঘটে যোগ দেন। তার মানে, হাওড়ার মোট তিন হাজার মেথর ও ঝাড়ু দারদের সকলেই ধর্মঘটে যোগ দিলেন।
প্রথম দিন ৮ই এপ্রিল তারিখে শিবপুর ট্রামওয়ে টার্মিনাসের নিকটবর্তী শীল বস্তীতে একটা বড় ঘটনা ঘটে যায়। পুলিশের এংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট্রা ওখানে গিয়ে জোর-জবরদস্তী করে মেথরদের দিয়ে কাজ করাবার চেষ্টা করে। তাতে উত্যক্ত হয়ে মেথরানীরা পায়খানার বালতি সার্জেদর গায়ে ঢেলে দেয়। সার্জেন্ট্রা ওখানেই তাদের পোশাক (ইউনিফর্ম) খুলে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বলতে বলতে গেল যে তাদের গুলি করার অনুমতি না দিলে তারা আর কখনও মেথরদের বস্তীতে যাবে না। খবর পেয়ে আমরা শীল বস্তীতে ছুটে গেলাম। দেখলাম পায়খানা মাখা পুলিস সার্জেদের ইউনিফর্মগুলি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করলাম।
এরপরে আমরা গেলাম প্রমোদ বসুর বাড়ীতে। গিয়ে দেখলাম তিনি মেথর ঝাড়ুদারদের ওপরে চটে লাল হয়ে আছেন। যে-প্রমোদ বসু ইউনিয়ন গঠন করার শুরুতে আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন এই প্রমোদ বসু তিনি নন। তাঁর পাল্টে যাওয়ার কারণ আছে। আমরা কাজ শুরু করার পরে হাওড়া মিউনিসিপালিটিতে নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল। তাতে কংগ্রেসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়েছিলেন। মিউনিসিপালিটির পরিচালনা কংগ্রেসের হাতেই এসেছিল। প্রমোদ বসু বললেন যে তাঁদের মাথায় অনেক বড় বড় প্লান ছিল। মেথর-ঝাড়ু দারগুলি তাঁদের কিছুই করতে দিল না। আমরা বুঝলাম প্রমোদ বসু আর আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু জীবন মাইতি আর অগম দত্তের সম্বন্ধে আমাদের সে-ধারণা হয়নি।
ধর্মঘটের পর হতে আমাদের কাজ হলো বস্তীতে বস্তীতে ঘোরা আর বিকাল বেলা হাওড়া ময়দানে মেথর-ঝাড়ুদারদের মিটিং করা। এই মিটিংগুলির কোনো কোনো মিটিং-এ বটুকেশ্বর দত্তও আসতেন এবং বক্তৃতা দিতেন। তিনি হয়তো সব মিটিংয়ে যোগ দিয়ে থাকবেন, তবে বক্তৃতা দিয়েছেন কোনো কোনো মিটিং- এ। কিছু দিন আগে বটুকেশ্বরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। কানপুরে মানুষ হয়েছিলেন বলে হিন্দী লেখাপড়া জানতেন। আমরা তাঁকে দিয়ে হিন্দী ট্রেড ইউনিয়ন ইতিহার লিখিয়েছি। তিনি তখন কলকাতা-বড়বাজারের একটি দর্জি স্কুলে টেলরিং ও কার্টি এর কাজ শিখতেন, থাকতেন হাওড়ার এক মেসে। এই বটুকেশ্বর দত্তই সেনট্রাল এসেীতে ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে ভগৎ সিং-এর সঙ্গে গিয়ে বোমা ছুঁড়েছিলেন।
১০ই এপ্রিল (১৯২৮) সকাল বেলা হাওড়া মিউনিসিপালিটি মেথর-ঝাড়ুদার ইউনিয়নের নেতাদের ডাকলেন। মিস্টার সি. এফ. এন্ড্রুজকেও ডাকলেন। কমিশনারদের মিটিংও ডাকলেন। আমাদের নিয়ে গিয়ে সেই মিটিং-এ বসালেন। আমাদের হাতে মিউনিসিপালিটির ছাপানো বাজেট দিলেন। যা বললেন তা স্তোক বাক্য, মেথর ঝাড়ুদারদের কোনো দাবী মেটানোর কথায় তাঁরা এলেন না। আমরা সভা থেকে বের হয়ে এলাম, কিন্তু চলে গেলাম না। আমাদের পরে এন্ড্রুজ সাহেব ডেকে নিলেন। তিনি কি বললেন, মজুরদের স্ট্রাইক ভেঙে দিতে বললেন কিনা তা জানিনা। তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করতেন বটে, তবে স্ট্রাইক ভঙ্গকারী বলে তাঁর দুর্নাম রটে যাচ্ছিল। তিনি তখন সতর্ক হচ্ছিলেন। যাওয়ার সময়ে তিনি আমাদের বলে গেলেন, “তোমরা খানিকটা শক্ত হয়ে থেকো”। হাওড়া টাউন হলটা মিউনিসিপালিটির বিল্ডিং ছিল। তার নীচের তলায় ছিল মিউনিসিপালিটির আফিস আর ওপরের হলে মিটিং হতো। ১০ই এপ্রিল (১৯২৮) তারিখে হাওড়া টাউন হলের হাতার ভিতরে বহু মেথর ও ঝাড়ুদার জড়ো হয়েছিলেন। হাওড়া মিউনিসিপালিটির সেক্রেটারি ছিলেন শ্রীযোগেশ দাশগুপ্ত। সম্ভবত ফরিদপুর জিলার লোক। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভ্য ছিলেন। অতএব কংগ্রেসের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আমিও তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির একজন সভ্য ছিলাম কিন্তু আমি যোগেশবাবুর মতো কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলাম না। কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির সভায় আমি তাঁর উলটো দিকে বসতাম। যোগেশবাবুই মিউনিসিপালিটির তরফ হতে এগিয়ে এসে সব কথা বলছিলেন, সব কিছু করতেন। এনড্রুজ সাহেব চলে যাওয়ার পরে যোগেশবাবু মোক্ষম দাওয়াই প্রয়োগ করলেন। জীবন মাইতি ও অগম দত্ত খোলাখুলিভাবে কংগ্রেসী-কর্মী ছিলেন। ইউনিয়ন গঠন করার শুরু হতেই তাঁরা তাতে ছিলেন। মেথর-ঝাড়ু দারেরা তাঁদের চিনতেন। কংগ্রেস শৃঙ্খলার কথা বলে তিনি তাঁদের হাওড়া টাউন হলের হাতার ভিতরে মজুরদের সামনে এনে হাজির করলেন। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে টাউন হলের গেটের ভিতরে ঢোকার সময় তিনি আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “এবারে মজুরদের আপন লোকেরা এসেছেন। তাঁদের কথায় তারা ধর্মঘট তুলে নেবে।” আমাদের সামনে দিয়ে জীবন মাইতি ও অগম দত্ত মাটির দিকে মুখ করে চলে গেলেন। তাঁরা বধ্যভূমিতে নীত হচ্ছেন এমন ছিল তাঁদের অবস্থা। তাঁদের দেখে সেদিন আমাদের রাগ হয়নি, মায়া হয়েছিল। আসল কথায় আসি। জীবন মাইতি ও অগম দত্তের কথায়ও সেদিন হাওড়ার মেথর ঝাড়ু দারেরা তাঁদের ধর্মঘট তুলে নেননি। যোগেশবাবুকে হার মানতে হয়েছিল। এই যোগেশ দাসগুপ্ত বৃদ্ধ বয়সে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সমর্থক হয়েছিলেন। তাঁর ছোট ভাই নরেশ দাসগুপ্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদীর) একজন বিশিষ্ট নেতা।
ধর্মঘট চলেছিল। মজুরদের জোট কেউ ভাঙতে পারেনি। বিকালবেলা রোজই হাওড়া ময়দানের মিটিং শেষ হওয়ার পরেও কিছু সংখ্যক মজুর দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমরা তাঁদের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে স্থান ত্যাগ করতাম। একদিন বিকালে মিটিং শেষ হওয়ার পরে আমি বড় ক্লান্তি বোধ করছিলেম। আমি ধরণীকান্ত গোস্বামীকে অনুরোধ করলেম যে তিনি যেন ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেকটি মজুরকে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে তার পরে চলে যান। আমি তাঁকে বলে গেলাম যে তেলকল ঘাট রোডে কিরণ মিত্রদের ফ্যাকটরি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন আফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে আমি বিশ্রাম গ্রহণ করব। আমার চলে যাওয়ার পরেও ওখানে পনেরো-কুড়িজন মজুর দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধরণী গোস্বামী তাঁদের চলে যেতে বলছিলেন। এমন সময়ে রোগা মতো একজন উকীল (তাঁর নাম মনে নেই) এসে মজুরদের সামনে বক্তৃতা দিতে লাগলেন। এই উকীল আবার মিউনিসিপপালিটির একজন কমিশনারও ছিলেন। তিনি প্রাণপণে আমাদের গালি দিয়ে যাচ্ছিলেন। ধরণী গোস্বামী সহ্য করতে না পেরে মজুরদের বললেন তোমরা এই লোকটিকে মার।” হুকুম পেয়েই মজুরেরা উকীলবাবুকে মারতে লাগলেন, তাঁকে তাঁরা মাটিতে ফেলে দিলেন। উকীলবাবু কোনো রকমে ছুটে কোর্টে চলে গেলেন। খুব নিকটে ছিল কোর্ট। সেখানেই কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে পেয়েছিলেন, না, ম্যাজিস্ট্রেটের বাসায় গিয়ে দরখাস্ত করেছিলেন তা জানিনে, ধরণীকান্ত গোস্বামীর বিরুদ্ধে গিরেস্তারী পরওয়ানা ইসু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়েই তিনি কলকাতা পালিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি ডক্টর প্রভাবতী দাসগুপ্তাকে খবর দিয়েছিলেন। তিনি ট্যাক্সী নিয়ে হাওড়ায় এলেন এবং আমাকে সেই ইউনিয়ন আফিস হতে খুঁজে বার করলেন। তাঁর কাছ থেকে সব খবর পেলাম। কি আর করব। পরদিন সকালে নয়টার সময় হাওড়ার ময়দানে উপস্থিত হলাম। পৌঁছানো মাত্রই ওখানকার কজন লোক আমায় খবর দিলেন যে শচীনন্দনকে কয়েকজন যুবক খুব মেরেছে। শচীনন্দন কোথায় গেল সে খবর তাঁরা দিতে পারলেন না। আমি নিজেকে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। কোথায় খুঁজে পাব এখন শচীনন্দনকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। এসেই বলল কালকের উকীল বাবুর ছোট ভাইরা তাকে রাস্তায় একা পেয়ে বেদম প্রহার করেছে।
তখন থেকে একটা নূতন খেলা আরম্ভ হলো। মেথর-ঝাড়ুদারদের দু’চারজনকে রাস্তায় পেলে হিন্দু ভদ্রলোকের ছেলেরা তাদের ঘেরাও করে মারধর আরম্ভ করেছিলেন। এই জন্যই আমরা মিটিং শেষ হওয়া মাত্রই তাদের বাড়ী পাঠিয়ে দিতে চাইতাম। ক্রমেই মারধরের মাত্রা বাড়তে লাগল। খাটা পায়খানায় শহরে নাগরিকদের দুর্গতির কোনো শেষ ছিল না। আমরা নাগরিকদের নিকটে আবেদন জানাই যে তাঁরা দলবদ্ধভাবে মিউনিসিপালিটির আফিসে গিয়ে বলুন তাঁদের দুর্গতির কথা। তাতে তাঁরা রাজী নন। এই সময়ে আমরা খবর পেলাম যে টিকাপাড়ার মুসলমানেরাও দলবদ্ধভাবে মেথর ও ঝাড়ুদারদের আক্রমণ করবেন। তার প্রস্তুতি চলেছে। আমরা টিকাপাড়ায় গিয়ে মুস্ইলম বাশিন্দাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করলাম। তাঁরা বললেন আমরা মিটিং ডেকে দিচ্ছি। আপনার সেই মিটিং-এর সামনে আপনাদের বক্তব্য বলুন। তাঁরা কথামতো মিটিং ডাকলেন। লোকও খুব জড়ো হয়েছিল সেই সভায়। সভাপতি হয়েছিলেন ওখানকার শরীফ সাহেব। তাঁর অল্প অল্প মদের নেশা হয়েছিল। তবে, কথাবার্তা ঠিকই বলছিলেন। টিকাপাড়ায় তখনকার দিনে এক ‘পাগল কোম্পানী’ ছিল। কেন যে তাঁদের পাগল কোম্পানী বলা হতো তা জানিনে। তাঁরা কয়েক ভাই ছিলেন, ব্যবসায় করতেন। বেশ কিছু সম্পত্তিরও মালিক ছিলেন তাঁরা। শরীফ সাহেব ছিলেন ভাইদের ভিতরে ছোট। বেশ লম্বা, সুপুরষ চেহারা। সভায় দাঁড়িয়ে আমিই প্রথম বললাম। বললাম, স্ট্রাইকের ফলে শত্রুরের বাশিন্দাদের চরম দুর্গতি হয়েছে। কিন্তু মেথর-ঝাড়ুদারদেরও স্ট্রাই ছাড়া প্রতিবাদ জানানোর অন্য কোনো উপায় নেই। তাঁদের সকলে ঘৃণা করেন, তাঁদের নালিশের কোনো প্রতিকার নেই। হাওড়া মিউনিসিপালিটি ইচ্ছা করলেই ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেই ধর্মঘট মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তান না করে তাঁরা ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টাই শুরু করেছেন। হাওড়ার বাশিন্দাদের নিকটে আমাদের একান্ত অনুরোধ ছিল যে তাঁরা দলবদ্ধভাবে মিউনিসিপালিটিতে যাবেন না। তাঁরা মারধর করে মেথরদের দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করাবেন। তা না করলে তাঁদের শিশু সন্তানেরা কলেরা ও অন্য ব্যাধিতে মরে যাবে।
মেথর ও ঝাড়ুদারেরাও বুঝেছিলেন যে স্ট্রাইক তাঁরা আর চালাতে পারবেন না। মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত নাগরিকেরা এটা সহজেই বুঝেছিলেন যে ট্যাক্স বাড়ালে তা তাঁদেরই বহন করতে হবে। তাঁদের বিচারে শ্রেণীস্বার্থই প্রবল হয়ে দেখা দিল। মেথরেরা আমাদের বললেন যে নাগরিকেরা তাঁদের ওপরে যে-ভাবে জুলুম আরম্ভ করেছেন তাতে ধর্মঘট ভেঙে যাবে। আপনাদের অনুরোধে নাগিরকদের একটি দলও মিউনিসিপাল আফিসে গেলেন না। তাঁরা ঠিক করেছেন আমাদের মারধর করে আমাদের দ্বারা কাজ করিয়ে নিবেন। এখন আপনারা যে-কোনো শর্তে ধর্মঘট মিটিয়ে নিন। আপনাদের সম্মানটা তবু বাঁচুক।
হাওড়ার মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষের সহিত আমাদের কথাবার্তা তো চলছিলই। ১৬ই এপ্রিল (১৯২৮) তারিখে হাওড়া ময়দানে মজুরদের নিয়ে বড় সভা করলাম। তাঁদের জানালাম কি কি পাওয়া যেতে পারে। তাঁরা আমাদের বললেন যে তাতেই আপনারা সমঝতা করে আসুন। ডক্টর মিস্ প্রভাবতী দাসগুপ্তা “স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গলের” প্রেসিডেন্ট্ ছিলেন। তাঁকেই মিউনিসিপাল আফিসে সই করার জন্যে পাঠালাম। আমি মজুরদের সঙ্গে নিয়ে হাওড়া ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হঠাৎ বৃষ্টি এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। তবুও আমরা ভিজা কাপড়েই দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাত প্রায় দশটার সময় প্রভাবতী ময়দানে ফিরে এসে মজুরদের নিকটে মিটমাটের নিম্নলিখিত শর্তগুলি পড়ে শোনালেন :
(১) জুন মাসের প্রথম হতে প্রত্যেক মজুরের মাসে আট আনা হিসাবে বেতন বাড়বে;
(২) ধর্মঘট করার জন্যে কোনো মজুরের চাকরী যাবে না;
(৩) যে-সময়টা মজুরেরা ধর্মঘট করে কাজ করেননি তাঁরা সেই সময়ের পুরো বেতন পাবেন;
(৪) ১৭ই এপ্রিল (১৯২৮) ভোর বেলা হতে সমস্ত মজুরকে কাজে যোগ দিতে হবে;
(৫) মজুরেরা যতটা সময় কাজ করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ আছে ততটা সময় তাদের কাজ করতে হবে;
(৬) মিউনিসিপালিটির তরফ হতে ডাক্তার পি. কে. ব্যানার্জি ও মিস্টার কে. এন. গাঙ্গলীকে এবং “স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গলের” তরফ হতে ডক্টর মিস্ প্রভাবতী দাসগুপ্তা ও মিস্টার মুজফফর আদকে নিয়ে একটি সালিসি বোর্ড গঠন করা হলো। এই বোর্ড মজুরদের বিরোধগুলি সম্বন্ধে বিবেচনা করবেন। বলা বাহুল্য হাওড়া মিউনিসিপালিটির ভদ্রলোকেরা এই বোর্ডের সভা কখনও ডাকেননি।
এইভাবে হাওড়ার মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটের সমাপ্তি ঘটেছিল। জীবনকৃষ্ণ মাইতি উনিশ শ ত্রিশের দশকে বিনা বিচারে বন্দী হয়েছিলেন। এই দশকের শেষ ভাগে মুক্তি পেয়েই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে পার্টি দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পরে তিনি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন। দুশমনের ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ফলে ১৯৭০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে তার মৃত্যু হয়েছে। শুনেছি অগম দত্তও আমাদের পার্টির সঙ্গে ছিলেন। তিনি আর বেঁচে নেই। আশার করি শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় আজও বেঁচে আছে। সে কখনও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়নি। দীর্ঘকাল হতে সে বোধ হয় কোনো রাজনীতিতেই নেই। যখন আমি চলাফেরা করতে পারতাম তখন দু’একবার তার সঙ্গে পথে দেখা হয়েছে। সারের ব্যবসায় করছিল। ডক্টর মিস্ প্রভাবতী দাসগুপ্তা হায়দরাবদের মির্জা বাকের আশলীকে বিয়ে করে হায়দরাবাদে থাকেন, বেঁচে আছেন।
আমরা যখন স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গল গঠন করেছিলেম তখন আমরা আশা করেছিলেম যে বাঙলা দেশের (যুক্ত বাঙলার) প্রত্যেক জিলা শহরে আমরা তার শাখাসমূহ গঠন করব। মেথর ও ঝাড়ুদারেরা অতি সহজে সংগঠিত হয়ে থাকেন, আর সংগ্রামে তাঁরা অটল। আমরা যদি বাঙলার প্রতি শহরে এই ইউনিয়নের শাখা গড়তে পারতাম তবে বাঙলার প্রতি শহরের সহিত আমাদের পার্টির, কমিউনিস্ট পার্টির পরিচয় ঘটে যেত। মেথর ও ঝাড়ুদারেরা এমন মজুর যাঁদের কাজে সহিত শহরের প্রতিটি লোকের যোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা যা চাইছিলাম তা আমরা করতে পারিনি। সারা বাঙলার ছোটাছুটি করার মতো লোক আমাদের ছিল না, আর অর্থও ছিল না। সেই কালে মেথর ও ঝাড়ুদারের নিকট হতে টাকা যে তুলব সে রকম অবস্থা তাঁদের ছিল না। আমি আবার ছিলাম পুলিসের সর্বক্ষণের দৃষ্টি-জর্জরিত। যখন যাঁদের নিকইে যেতাম তাঁরা আমাকে নিয়ে বিব্রত বোধ করবেন, এমন ছিল আমার অবস্থা।
চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়ার ধর্মঘট
১৯২৮ সালের কথা বলছি। তখন বাঙলা দেশের (যুক্ত বাঙলার) শিল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল চটকলের শিল্প। অন্য কোনো শিল্প তার কাছেও ঘেঁসতে পারত না। চটকলগুলিতে মজুরের সংখ্যা ছিল তখন তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার কলগুলি ছিল হুগলী নদীর দু’ধারে বিস্তৃত। কলকাতার পারে দক্ষিণে তার বিস্তার ছিল বজবজ পর্যন্ত। এখন তারও দক্ষিণে বিড়লাপুর পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে। উত্তর হালিশহরের হুকুমচাঁদ জুট মিলে তার বিস্তার শেষ হয়েছে। হুগলী নদীর হাওড়ার পারে চটকল শুরু হয়েছে দক্ষিণে ফুলেশ্বরে, আর উত্তরে শেষ হয়েছে শাগঞ্জ- বাঁশবাড়িয়ায়। গুগলী নদীর হাওড়ার পারের সব দক্ষিণের কলগুলির মধ্যে রয়েছে চেঙ্গাইল ও বা উড়িয়া। এ দু’টি জায়গা খুব কাছাকাছি। চেঙ্গাইলের কলটির নাম লাডলো জুট মিল। এর মালিকেরা একটি আমেরিকান কোম্পানী বাউড়িয়ায় রয়েছে একসঙ্গে তিনটি চটকল ও একটি সুতোকল। এগুলির মালিক ফোর্ট গ্লস্টার নামক একটি ব্রিটিশ কোম্পানি। নদীর অপর পারে গারুলিয়াও এই কোম্পানীর আরও চটকল ও সুতো কল ছিল।
বাঙলার চটকলগুলি এক শত টাকা মূলধনের ওপরে ছয় শ’ টাকা পর্যন্ত মুনাফা বিতরণ করেছে। কারণ, উৎপাদনের খরচ ছিল অত্যন্ত কম, মজুরদের খাওয়া-পরার মান ছিল যা পর নেই নীচু। এই কারণে স্কটল্যান্ডের ডাণ্ডিতে পরিচালিত চটকলগুলির অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। তাঁরা কিছুতে বাঙলার চটকলের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছিলেন না। তাই, ১৯২৫ সালে ডাণ্ডির চটকল মজুরদের দু’জন প্রতিনিধি এলেন বাঙলায়। তাঁদের নাম ছিল মিস্টার জনস্টোন ও মিস্টার সাইম। তাঁরা চটকলের মজুরদের ভিতরে ঘোরাঘুরি করে তাঁদের বোঝাতে চাইলেন যে “তোমরা যদি সমিতিতে জমায়েত হয়ে নিজেদের খাওয়া-পরার মান উঁচু করার জন্যে লড়াই না কর তবে ডাণ্ডিতে আমরা বাঁচতে পারব না।” সেদিনের মজুর নেত্রী মিসেস সন্তোষকুমারী গুপ্তার সহিত তাঁদের পরিচয় হয়েছিল। তিনি বার্মায় মানুষ হলেও তাঁর বাপের বাড়ী ছিল গড়িফায়,-এক রকম চটকল ইলাকার ভিতরেই তিনিই ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ কালিদাস ভট্টাচার্যের সহিত মিস্টার জনস্টোন ও মিস্টার সাইমের পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন। এক সময়ে কালিদাসের সহিত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কিছু যোগ থাকবলেও তিনি গৌরীপুর জুট মিলে কাজ করতেন। এই কারণে তাঁকে সামনে খাড়া করে বঙ্গীয় চটকল মজুর সমিতি (The Bengal Jute Worker’s Association) গঠিত হয়েছিল। কালিদাস বলেছিলেন জনস্টোন ও সাইম কিঞ্চিৎ গরম ‘ইউনিয়ন’ নামের চেয়ে নরম ‘এসোসিয়েশন’ নামটি বেশী পছন্দ করেছিলেন। ডাণ্ডিওয়ালারা কিছুকাল ধরে কিছু কিছু টাকা দিতেন। টাকাটা কালিদাস ভট্টাচার্যের হাতে আসত। সন্তোষকুমারী গুপ্তা চটকলের সংগঠন ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কাজে মেতে গিয়েছিলেন। ডাণ্ডির টাকা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘এসোসিয়েশন’-এর নাম ‘ইউনিয়ন’ হয়ে গিয়েছিল এবং বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের হেড আফিস ভাটপাড়া হতে উঠে কলকাতায় এসেছিল। তার পরের ইতিহাস দীর্ঘ।
১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কিংবা ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের আফিস অনেক ভোটাভুটির পরে মুকুন্দলাল সরকারদের হাত হতে (তাঁরাই প্রথমে এটা গড়েছিলেন) মৃণালকান্তি বসু ও কিশোরীলাল ঘোষদের হাতে আসে। এটা অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। বসু ও ঘোষ অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায় দু’জনই ছিলেন এম এ এল এল বি। মৃণালকান্তি বসু ছিলেন “অমৃতবাজার পত্রিকা”র সম্পাদক, বঙ্গবাসী কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর লেক্চারার। এ সব করার পরে তাঁর ট্রেড ইউনিয়নের কাজ ছিল। তিনি ট্রেড ইউনিয়নের ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন ইত্যাদি।
কিশোরীলাল ঘোষ ছিলেন “অমৃতবাজার পত্রিকা”র এসিস্টান্ট এডিটর; খেলাতচন্দ্র ঘোষ ইস্টের বাঁধা উকীল, প্রত্যেক দিন তাঁকে কোর্টে যেতে হতো। তিনি বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সেক্রেটারীও ছিলেন। ইন্দুভূষণ সরকারের মারফতে মৃণালকান্তি বসু ও কিশোরীলাল ঘোষ প্রেস কর্মচারী সমিতির সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন। এটাই ছিল তাঁদের নিজস্ব ইউনিয়ন। কিশোরীলাল ঘোষ অনর্গল কথা ব’লে যেতে পারতেন। তাতে তিনি কখনও ক্লান্তি বোধ করতেন না। আর এই কথা বলায় তাঁর দিনের একটা ভালো সময় খরচ হতো। তাঁর তুলনায় মৃণালকান্তি বসু অনেক কম কথা বলতেন।
অল ইনডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে মৃণালকান্তি বসু ও কিশোরীলাল ঘোষ এন এম জোশীয় পক্ষীয় লোক ছিলেন। অন্তত, কিশোরী ঘোষ আমাদের সেই কথাই বলতেন। এই জোশী চটকল মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্যে কিছু টাকা বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের হাতে, অর্থাৎ কিশোরীলাল ঘোষের হাতে দিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস মিস্টার জোশীও টাকাটা ডাণ্ডি হতেই পেয়েছিলেন। কিশোরীলাল এই কাজের জন্যে লোক খুঁজছিলেন। একদিন সকালে কোনো কাজের উপলক্ষে আমি বাগবাজারের কাঁটাপুকুর লেনে কিশোরীলাল ঘোষের বাড়ীতে গিয়েছিলেম। সেখানে তখন বঙ্গিমচন্দ্র মুখোপাদ্যায় ও রাধারমণ মিত্রও এলেন। সময়টা ১৯২৮ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিল মাস ছিল। সেই আমি প্রথম তাঁদের দেখলাম। তাঁরা কার মারফতে কিশোরীলালের নিকটে এসেছিলেন তা আমি জানিনে, তবে কথাবার্তায় বুঝেছিলেম বঙ্গিম মুখার্জি ও রাধারমণ মিত্র আগে কিশোরীলালে সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তিনজনেরই পরিচয় অধ্যাপক অরুণ সেনের (ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের পুত্র) সঙ্গে ছিল। তিনিই বঙ্গিম মুখার্জি ও রাধারমণ মিত্রকে কিশোরীলাল ঘোষের নিকটে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। রাধারমণ মিত্র ও বঙ্গিম মুখার্জি আমার সামনে কিশোরীলাল ঘোষকে বললেন যে তাঁদের দু’জনেই যুক্ত প্রদেশে (এখনকার উত্তর প্রদেশে) স্কুল মাস্টারী করেছেন, অসহযোগ আন্দোলন করেছেন ও সেই আন্দোলনে জেল খেটেছেন। তাঁরা এখন মজুর আন্দোলন করতে চান। তাঁরা হিন্দুস্তানীতে বক্তৃতা দিতে পারেন। কিন্তু রাধারমণ মিত্র তখন বললেন না যে তিনি গান্ধীর সবরমতী আশ্রমেও ছিলেন। আর, বঙ্গিম মুখার্জি তখন অবশ্য উত্তর কলকাতা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর, বঙ্গিম মুখার্জি তখন অবশ্য উত্তর কলকাতা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বি এস সি পাস করে অঙ্ক শাস্ত্রে এম এস সি পড়ার সময়ে কলেজ ছেড়েছিলেন। আর, রাধারমণ মিত্র সেন্ট পল্স কলেজ হতে বি এ পাস করেছিলেন। তিনি যখন মজুর আন্দোলন করার জন্যে কিশোরীলাল ঘোষের নিকটে এসেছিলেন তখন তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাইমারী স্কুলের হেড্ মাস্টার ছিলেন।
চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়া অঞ্চলের চটকলগুলিতে মজুরদের ওপরে জুলুমের কোনো অন্ত ছিল না। ওই অঞ্চলে আগে কখনও মজুর আন্দোলন হয়নি। ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে চেঙ্গাইল লাডলো জুট মিলের মজুরেরা হঠাৎ ধর্মঘট করে বসেন। তিন দিন পরেই সেই ধর্মঘট ভেঙে যায়। তাতে অনেকেই ছাঁটাই হয়। মহাদেব মজুরদের ভিতর হতে এই তিন দিনের ধর্মঘটের নেতা হয়েছিলেন। তিনিও কাজ হতে বরখাস্ত হলেন। মজুরদের ভিতরে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছিল। তাঁরাই বোধহয় কলকাতা গিয়ে প্রথমে বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিশোরীলাল ঘোষও এই রকম একটি যোগাযোগের জন্যে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। কারণ, এন এম জোশীর নিকট হতে এই বাবতে তিনি টাকা পেয়েছিলেন।
মোটের ওপরে, চেঙ্গাইলে চটকল মজুরদের একটি ইউনিয়ন গঠিত হলো লাডলো জুট মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। দশ হাজার মজুর কাজ করতেন এই করে। বঙ্কিমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম সেক্রেটারি। পাশেই বাউরিয়া। ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানী সতর্ক হলেন। তাঁদের ওখানে তাঁরা কিছুতেই ইউনিয়ন হতে দেবেন না, এই ছিল তাঁদের দৃঢ় পণ। ১৯২৮ সালের ২৩ শে এপ্রিল তারিখে কোম্পানীর ম্যানেজার মিস্টার ওয়াশিংটন মজুরদের জন্যে নানান রকম অসুবিধা সৃষ্টি করতে লাগলেন। কোম্পানীর ইলাকায় তিনি মজুরদের ইউনিয়ন আফিস করতে দিবেন না, কোম্পানীর হাটে মজুরদের বেচাকেনা করতে দিবেন না। এ হাট সাধারণের জন্য ছিল, নিকটে অন্য কোনো হাটও ছিল না। কোম্পানীর কোয়াটার্সেও তিনি মজুরদের থাকতে দিবেন না যদিও ঘরগুলি মজুরদের ভাড়াকরা। রেলওয়ে রাস্তার উল্টোদিকে গ্রামে মজুরদের মিটিং হতে লাগল। সেক্রেটারি বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় সেখানেই থাকতে লাগলেন। আমাদের পার্টি আফিস হতে ফিলিপ স্প্রাট গিয়ে সেখানেই প্রাইমারী স্কুলের বা মাদ্রাসার চার দিক খোলা খড়ের ঘরে পড়ে থাকলেন। তাঁর যে কত রকমের অসুবিধা হতে লাগল সে কথা কহতব্য নয়। ভাত-ডাল যেমনই জিনিস হোক না কেন, তা খাদ্য। কোনো রকমে পেটের ভিতরে পৌছিয়ে দিতে পারলে লোক মরবে না, কিন্তু পায়খানা? ইংরেজের ছেলের হাঁটু তো ভাঙে না যে বঙ্গিম মুখার্জির মতো মাঠে বসে পায়খানা করবেন।
হাঁ, একটি কথা আমি এখানে বলে রাখি। আমার বিরুদ্ধে কিছু মাস-মসলা জোগাড় করার উদ্দেশ্যে স্প্রাটের মৃত্যুর বোধ হয় দু’তিন মাস আগে কেউ তাঁকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ক’রে এক দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন। ফুলস্কেপ ফলিও সাইজের টাইপ করা বারো পৃষ্ঠায় তিনি তার উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্নকর্তা যে পুস্তুক রচনায় ব্যাপৃত আছেন তার জন্য প্রচুর মাল-মসলা তিনি পেয়েছেন কিনা তা আমি জানিনে। পত্র আসার খবর প্রাপক আমায় একদিন বলেছিলেন। তাই, যেদিন স্প্রাটের মৃত্যুর খবর কাগজে পড়লাম সেদিন আমি সে ভদ্রলোককে টেলিফোনে অনুরোধ করলাম যে তাঁর যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে তিনি যদি একবার স্প্রাটের পত্রখানি আমায় পড়ে শুনিয়ে যান তাতে আমি বাধিত হব। পরে ভেবেছি যে আমি ওই রকম অনুরোধ করে ভুল করেছি। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে বাদ দিয়ে পত্রের কিছু অংশ আমায় টাইপ করে দিয়ে গিয়েছিলেন, আবার তা ফেরৎ নিয়েও গেছেন। আমি তার কোনো কপি রাখিনি। পত্রে একটি ভুল সংবাদ আছে। স্প্রাট লিখেছেন বাউড়িয়ার স্ট্রাইক আগে হয়েছিল এবং চেঙ্গাইলের স্ট্রাইক তার পরে। প্রকৃতপক্ষে চেঙ্গাইলের স্ট্রাইকই প্রথম হয়েছিল বাউড়িয়ায় হয়েছিল পরে। স্প্রাটের এই ভুল তথ্য ভদ্রলোক হয়তো নিজের পুস্তকে ব্যবহার করতে পারেন সেই জন্যে আমি প্রকৃত কথা এখানে লিখে দিলাম। চেঙ্গাইলের উপলক্ষে কিশোরীলাল ঘোষ চেঙ্গাইলে যাতায়াত করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন এটা তাঁরই ব্যাপার। উত্তর কলকাতা কংগ্রেসের লোকেরা ভাবতেন স্ট্রাইকটা আসলে তাঁরাই চালাচ্ছেন। কেননা, তাঁদের কংগ্রেসের বঙ্গিম মুখার্জি ইউনিয়নের সেক্রেটারি ও স্ট্রাইকের নেতা। তাই, হেমন্ত বসু ও সুধীর ঘোষ হতে আরম্ভ করে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক দেবকুমার গুপ্ত পর্যন্ত সকলেই চেঙ্গাইলে যাতায়াত করছিলেন। আবার, আমাদের শুধু যে ফিলিপ স্প্রাট গিয়েই ওখানে থেকে গিয়েছিলেন তা নয়, আমাদের আফিসের সকলেই চেঙ্গাইলে যাওয়া-আসা করছিলেন। যেখানে মজুরেরা লড়াই করছিলেন সেখান হতে আমরা কি ক’রে দূরে থাকতে পারি?
মজুরদের কোনো অনমনীয় মনোভাব ছিল না। তাঁরা সব সময়ে সমঝতার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন। ওয়াশিংটন চাইছিলেন যে এই লড়াই-এর ভিতর দিয়ে মজুরদের কোমর চিরদিনের জন্যে ভেঙ্গে পড়ুক। তাঁরা আর যেন কখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন। কিন্তু মিস্টার ওয়াশিংটনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। উলুবেড়িয়া মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের মারফতে তাঁকে মজুর নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হয়েছিল। যে-সব দাবীর ভিত্তিতে কিশোরীলাল ঘোষ, বঙ্কিম মুখার্জি ও ফিলিপ স্প্রাট কোম্পানীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন সেই দাবীগুলিই কিশোরীলাল কাগজে প্রকাশ করেছিলেন। কাগজে সব হেডিং দেওয়া হয়েছিল যে Workers’ gain Substantial Concessions (মজুরেরা বাস্তব সুযোগ-সুবিধা পেলেন)। এই দাবীগুলি যে-ভাবে প্রচার করা হয়েছিল তা থেকে মনে হবে যে মজুরেরা অনেক কিছু পেয়েছিলেন। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় কিশোরীলাল ঘোষের স্বপক্ষে দাখিল করা দলীল ডি-১৭৪ (১) দ্রষ্টব্য।
আসলে ব্যাপার যা ঘটেছিল তা ছিল এই। ১৯২৮ সালের ২৩ শে এপ্রিল তারিখে চেঙ্গাইলের লাডলো জুট মিলের দশ হাজার মজুর ধর্মঘট করেছিলেন। সতের দিন ধর্মঘটের পরে ১৯২৮ সালের ১০ই মে তারিখে মজুরেরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কী যে তাঁরা পেয়েছিলেন তা বোঝার উপায় নেই। কোম্পানী কিছু দিবেন বলে কথা দিলেও সে কথা তাঁরা রাখেননি। কারণ, কিছুদিন যেতে না যেতেই মজুরেরা আবার কয়েক দিনের জন্যে ধর্মঘট করেছিলেন।
ব্রিটিশ ধনিকের মুখপত্র “দি স্টেটস্ম্যান” লিলুয়ার ধর্মঘটের সঙ্গে চেঙ্গাইলের চটকল মজুরদের ধর্মঘটকে একত্র করে হাওড়া জিলার ধর্মঘটরূপে দেখছিলেন। ১১ই মে ১৯২৮ তারিখের “দি স্টেট্সম্যান” লিখেছিল”
“The condition of the men’s return were settled at a meeting of their leaders and the mill authorities on Wednesday (i.e. 9th May, 1928). The terms were :
No increase in wages,
No strike pay,
No recognition of the union.”
অর্থাৎ “মজুর নেতাদের সঙ্গে কোম্পানী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তার ভিতর দিয়ে গত বুধবারে (৯ই মে, ১৯২৮) যে শর্তগুলি স্থির হয়েছিল সেগুলি ছিল এইঃ
মজুরী বাড়বে না,
মজুরেরা ধর্মঘটের সময়ের মজুরী পাবে না,
ইউনিয়নকে মেনে নেওয়া হবে না।”
এটা লেখার সময় ‘স্টেট্সম্যান’ বোধ হয় একটা মানসিক আরাম বোধ করছিল।
লাডলো জুট মিলের ১৯২৮ সালের ম্যানেজার ওয়াশিংটন আর এ দেশে নেই, কিশোরীলাল ঘোষ, বঙ্কিম মুখার্জি ও ফিলিপ স্প্রাট মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন, সে দিনের সে সব মজুরও আর নেই, কিন্তু চেঙ্গাইলে লাডলো জুট মিল আজও (১৯৭১ সাল) চলেছে। শোষণের অবসান যদিও হয়নি তবুও মজুরেরা শক্তিশালী ইউনিয়ন সেখানে গড়ে তুলেছে। আজকের মজুরদের সহিত মালিকেরা ১৯২৮ সালের ভাষায় আর কথা বলতে পারেন না। আজ মজুরদের অনেক সমীহ করে মালিকেরা কথা বলেন।
১৯২৮-২৯ সালের বাউড়িয়া চটকল মজুর ধর্মঘটের কথা এখন কিছু বলি। ফোর্ট গ্লস্টার কোথায় তা জানিনে, ভূগোল খুঁজে তার নাম পাওয়া গেল না। স্কটল্যান্ডের কোনো একটি ক্ষুদ্র দুর্গের নাম যদি ফোর্ট গ্লস্টার হয় তবে তা ভূগোলের নির্ঘন্টে পাওয়া যাওয়ার কথাও নয়। তবে, যে-সব কোম্পানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে হুগলী নদীর দু’তীরে জুটের (পাটের) রোমাঞ্চক কাহিনী রচনা করেছিল ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীও তার মধ্যে একটি। আগেই বলেছি যে বাউড়িয়া গ্রামে ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর তিনটি চটকল ও একটি সুতো কল ছিল বাউড়িয়া হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন হতে ষোল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এটা তখনকার দিনের বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের এবং এখানকার সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়ের একটা স্টেশন। ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানী যখন চটকল তৈয়ার করছিলেন তখন তাঁরা শুধু কল তৈয়ার করার প্রয়োজনীয় জমি কিনেননি, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আশে-পাশের প্রায় বিশখানি গ্রামের জমীদারীর প্রজাও তাঁরা ছিলেন। এই প্রজাদের মজুররূপে পেয়ে ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর দাপটের অন্ত ছিল না।
আগেই বলেছি ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর পণ ছিল যে তাঁরা কিছুতেই বাউড়িয়ায় মজুরদের ইউনিয়ন বানাতে দিবেন না। কিন্তু ইউনিয়ন না বানালে দুঃসহ অবস্থা হতে বের হয়ে আসার জন্যে মজুরেরা লড়াই করবেন কিসের ভিতর দিয়ে? ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর পেছনের গেট ছিল হুগলী নদীতে। তাঁদের অনেক নৌকাও ছিল। এতএব নৌকার মাঝিরাও ছিলেন। কোম্পানীর অনেক দারওয়ানও ছিল। এই দরওয়ান ও মাঝিদের একত্র করে সংখ্যা ছিল দু’শ। তারা যে কোনো সময়ে মারধর শুরু করে দিত। এত সব সত্ত্বেও ১৯২৮ সালের ১৫ই জুলাই তারিখে বাউড়িয়া চটকল মজুর ইউনিয়ন গঠিত হলো। ইউনিয়ন গঠিত হলো এই ঘোষণা করার জন্যে যে-মাঠে মিটিং ডাকা হয়েছিল (বরাবর এ মাঠেই মিটিং হতো) সে মাঠে মিটিং হতে কোম্পানী দিল না। অজুহাত ছিল যে মাঠটি কোম্পানীর। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট এসে মজুর নেতাদের ওপরে নোটিসও জারী করলেন। তবুও রাস্তায় ওপরে দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন গঠনের ঘোষণা হলো। আর, সঙ্গে সঙ্গে ১৬ই জুলাই (১৯২৮) তারিখে শুরু হয়ে গেল বাউড়িয়ায় চটকল মজুরদের ধর্মঘট। উলুবেড়িয়া মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে আমরা চেঙ্গাইলেও দেখেছি। সেখানেও লোক গিরেফ্ফার হয়েছেন, বঙ্কিম মুখার্জির নামে মোকদ্দমা চলেছে, তবুও মালিকেরা আমেরিকান হওয়ায়, অর্থাৎ ব্রিটিশ নাগরিক না হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট চাইতেন যে একটা মিটমাট হয়ে যাক। কিন্তু বাউড়িয়ায় এই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট একটি জঘন্য চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন। এখানে যে করেই হোক তাঁকে ব্রিটিশ মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে, এমন ভাব গ্রহণ করলেন তিনি।
১৯২৮ সালের ১৬ই জুলাই হতে ১৯২৯ সালের ১৬ই জানুয়ারী পর্যন্ত পুরো ছয় মাস মজুরেরা ধর্মঘট চালিয়েছিলেন। ধর্মঘটের প্রথম দিনেই মজুরদের ওপরে গুলি চলল। তাতে ২৮ জন মজুর আহত হলেন, তার মধ্যে পাঁচজনের আঘাত আশঙ্কাজনক ছিল। তবুও মজুরেরা ধর্মঘট চালিয়ে গেলেন। এত দীর্ঘকাল চটকল মজুরের ধর্মঘট চালানোর কোনো ইতিহাস নেই। শুধু সেই সময়ের কথা নয়, আজ পর্যন্ত চটকলের মজুরেরা এমন ইতিহাস কোথাও সৃষ্টি করতে পারেননি।
কোম্পানীর অনুরোধে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট বে-আইনীভাবে মজুরদের যখন তখন গিরেফ্ফার করে ফৌজদারী মোকদ্দমায় জড়িয়ে দিত এবং সে মোকদ্দমা চলতেই থাকত। মজুরদের ওপরে এটাই ছিল জঘন্যতম জুলুম।
কোম্পানী কোনো রকম আলোচনায় আসতে চাইত না। দু’শিটের জায়গায় এক শিফ্ট চালু করা নিয়ে যে বিরোধ আরম্ভ হয়েছিল তার বিষয়ে কোনো কথা বলতেও কোম্পানী রাজী হলো না। তাঁরা চেয়েছিলেন যে মজুরের মেরুদণ্ড তাঁরা ভেঙে দিবেন। এটা কখনও সম্ভব নয়। তাঁরা চেয়েছিলেন যে মজুরের মেরুদণ্ড তাঁরা ভেঙে দিবেন। এটা কখনও সম্ভব নয়। ধনিক কোম্পানীকে মুনাফা লুঠের জন্যে কারখানা চালাতে হবে। কারখানা চালানোর জন্যে মজুরের প্রয়োজন হবেই। ধর্মঘট ভাঙার জন্যে মালিকেরা যে সকল মজুর নিযুক্ত করেন সে সকল মজুরও পরে মালিকদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন এবং ধর্মঘটও করেন।
ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর ম্যানেজিং এজেন্সি কেটওয়েল বুলেন এন্ড কোম্পানী কেবলই ধর্মঘট ভঙ্গকারীদের ঢোকাবার চেষ্টা করতে থাকলেন, আর বাউড়িয়ার মজুরেরা বীরত্বের সহিত তার বিরুদ্ধে লড়াই করে চললেন। ছয় মাস পরে আলমবাজারের দু’জন লোক, যতটা মনে পড়ে তাদের নাম ছিল ধীরেন চট্টোপধ্যায় ও তুলসী ঘোষ, কোম্পানীর নিকট হতে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক বেকরার মজুর পেছনের দরজা দিয়ে বাউড়িয়ার কলে ঢুকিয়ে দিল। উপোসে কাহিল মজুরেরা তখনকার মতো আর বাধা দিতে পাররেন না। বাউড়িয়ার ধর্মঘট ১৯২৯ সালের ১৬ই জানুয়ারী তারিখে ভেঙে গেল।
বাউরিয়ার একটি ব্যাপার নিয়ে কিশোরীলাল ঘোষের সঙ্গে আমার কিছু মনোমালিন্য হয়েছিল। বোম্বের গিরনী কামগার ইউনিয়নের জেনেরেল সেক্রেটারি এস. এ. ডাঙ্গে আমাকে বাউড়িয়া স্ট্রাইকের জন্যে পাঁচ শ’ টাকা পাঠিয়েছিলেন। টাকা যখন পৌঁছেছিল তখন স্ট্রাইক ভেঙে গিয়েছিল। আমি ডাঙ্গেকে জানালাম যে বাউড়িয়ার স্ট্রাইক ভেঙে গেছে। বোম্বে হতে ডাঙ্গে যে টাকা পাঠিয়েছিল সে খবর এন. এম. জোশীর সহকারী বাখালে সঙ্গে সঙ্গেই কিশোরীলালকে জানিয়েছিরেন। আমাদের আফিস হতেও তিনি জেনেছিলেন। ডাঙ্গের উত্তর আসার আগেই আমি নলপুরের (হাওড়া স্টেশন হতে যেতে বাউড়িয়ার আগেকার স্টেশনে) এক সভায় গিয়ে একশ’ বা দেড়শ’ টাকা দেওয়ার জন্যে বা’র করা মাত্রই কিশোরীলাল টাকটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন। ফিরে আসার সময়ে রাধারমণ মিত্র (এখন বেঁচে আছেন) ও বঙ্কিম মুখার্জি আমার একান্তে বললেন যে আপনি কেন টাকাটা কিশোরীলাল ঘোষকে দিলেন? তিনি তো তা ট্যাকসি চড়েই খরচ ক’রে দিবেন।” তখনকার দিনে পুরনো হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে হ্যারিসন রেডে এসে ট্রাম ধরতে হতো। আমরা যখন ট্রামে চড়লাম তখন দেখলাম যে কিশোরীলাল ঘোষ ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর ট্যাক্সিতে যাওয়ায় ইচ্ছাই যখন ছিল তখন বঙ্কিম মুখার্জি ও রাধারমণ মিত্রকেও সঙ্গে ডাকতে পারতেন। তাঁরাও উত্তর কলকাতায় থাকতেন।
ডাঙ্গের নিকট হতে জওয়াব পেলাম। সে লিখেছে বাউড়িয়ার স্ট্রাইক ভেঙে যাওয়ার জন্য সে দুঃখিত। আমি যাতে ভালো মনে করি টাকাটা যেন তাতেই খরচ করি। তাই আমি করেছিলেম। সেই সময় আমাদের পার্টির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। স্প্রাটের পকেট হতে কিছু টাকা চুরি হওয়ায় বিপদ আরও বেড়েছিল। টাকাটা আমি আমাদের পার্টির কর্মীদের জন্যেই খরচ করেছিলেম। সেই কর্মীদের ভিতর স্প্রাটও ছিলেন। তখন আমার নিকটে তাই ভালো নে হয়েছিল।
কিশোরীলাল ঘোষ প্রত্যেক দিন দৈনিক কাগজের জন্যে লিখতেন। লেখ তাঁর সহজেই আসত। তিনি এই টাকার জন্যে আমায় যা তা লিখতে লাগলেন। একদিন আমি কড়া ভাষায় জওয়াব দিলাম। আমার নিকটে ডাঙ্গের পত্র ছিল। তাতে তিনি প্রায় খেপে গেলেন। তাঁর খেপে যাওয়ার অন্য কারণও ছিল। বাউড়িয়ার ছয় মাসের ধর্মঘটের পরে কিশোরীলাল খতিয়ে দেখেছিলেন যে তাঁর পায়ের তলায় কোনো মাটি নেই,-পায়ের তলায় মাটি ছিল রাধারমণ মিত্র ও বঙ্কিম মুখার্জির। তাঁদের দু’জনের একজনও ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টির সভ্য ছিলেন না। কাজেই, তিনি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স্ পার্টির ওপরে চটতে পারলেন না। ফিলিপ স্প্রাটের পায়ের তলায় কিছু মাটি ছিল বলে আমাদের পায়ের তলারও ছিল। কিন্তু স্প্রাটের ওপরে তিনি রাগ করতে পারতেন না। তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে রাধারমন মিত্র ও বঙ্কিম মুখার্জি কিশোরীলালকে টাকা দিতে আমায় বারণ করে থাকবেন। এ সন্দেহ যে অমূলক ছিল না তা তো আগেই বলেছি। স্প্রাট কিন্তু এ কথা জানতেন না।
গিরনী কামগার ইউনিয়নের টাকার শোক কিশোরীলাল ঘোষ মীরাটের আদালতে গিয়েও ভুলতে পারেননি। সেখানে গিয়ে যখন তিনি ডাঙ্গের আমাকে দেওয়া উপদেশ পড়লেন তখন তিনি ডাঙ্গের ওপরে চটে গেলেন। সে কেন টাকা মুজফফর আহমদকে পাঠাল? তার উচিত ছিল টাকাটা বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনকে, অর্থাৎ তাঁকে পাঠানো। কিন্তু গিরনী কামগার ইউনিয়ন তো অল-ইনডিয়া ট্রেড ইউনিংন কংগ্রেসের সহিত তখনও সংযুক্ত হয়নি। কেন তাঁরা টাকা পাঠাবেন কিশোরীলালকে? তা ছাড়া, এন. এম. জোশী তো ঠিকই করে রেখেছিলেন যে গিরনী কামগার ইউনিয়ন অল-ইনডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সহিত সংযুক্ত হওয়া মাত্রই তিনি আলাদা হয়ে অল-ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গঠন করবেন।
এ সব কথা এই পুস্তকে লেখার মতো নয়। কিন্তু কিশোরীলাল ঘোষ মীরাটের আদালতে এসব কথা রেকর্ডে ঢুকিয়ে জল ঘোলা করেছেন। কলকাতা হতে আরম্ভ করে মীরাটের আদালত পর্যন্ত জল ঘোলা করাই ছিল তাঁর কাজ।
বাউড়িয়ার ছয় মাস স্থায়ী ধর্মঘট শেষ হওয়ার পরে তেতাল্লিশ বছর কেটে গেছে। পুরনো নেতাদের ভিতরে বঙ্কিম মুখার্জি আমাদের পার্টিতে (কমিউনিস্ট পার্টিতে) যোগ দিয়েছিলেন। এখন বেঁচে নেই। ফিলিপ স্প্রাট আমাদের পার্টি ত্যাগ করেছিলেন। এখন তিনিও বেঁচে নেই। রাধারমণ মিত্র বেঁচে আছেন, কোনো রাজনীতিতে নেই। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে আছেন এবং মস্কো রেডিওতে চাকরী করেন।
বাউড়িয়ার কলগুলি আজও চলেছে। ফোর্ট গ্লস্টার কোম্পানীর ম্যানেজিং এজেন্সি কেটওয়েল বুলেন এন্ড কোম্পানী নিজেদের মাড়োয়ারী ফার্ম বাঙ্গুর ব্রাদার্সের নিকটে বিক্রয় করে দিয়ে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে তাঁদের স্বদেশ স্কটল্যান্ডে ফিরে গেলেন। পুরানো দিনের মজুরেরা আর নেই। স্থানীয় মজুরদের বংশধরেরা এখন কাজ করছেন। কথায় কথায় মজুরদের সহিত আগেকার মতো দুর্ব্যবহার করা হয় না। মজুরেরা আজকাল খুবই রাজনীতি-সচেতন। পুরো অঞ্চল এখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদীর) দ্বার প্রভাবিত। গত নির্বাচনে (ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১) ওই অঞ্চলের প্রাদেশিক আইন সভার আসগুলিতে ও লোকসভার আসনে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) জিতেছে। সমগ্র হাওড়া জিলায় লোকসভার দু’টি আসনের মধ্যে দু’টিতেই, প্রাদেশিক আইনসভার মোট ষোলটি আসনের মধ্যে তেরোটিতে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) জয়লাভ করেছে। একটি আসনে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে আর সি.পি.আই. জিতেছেন। বাউড়িয়ার কথা এখানে শেষ করি।
বোম্বে সুতাকল মজুরদের ধর্মঘট, ১৯২৮
১৯২৮ সালের বোম্বে সুতাকল মজুরদের ধর্মঘট সম্বন্ধে এখানে বিশেষভাবে কিছু বলা দরকার। এই বছর এবং এর আগের বছরেও ভারতের নানা স্থানে মজুরেরা ধর্মঘট করেছেন। সে বিষয়ে আমি আগে লিখেছি। কিন্তু বোম্বের সুতাকলে মজুরেরা ১৯২৮ সালে যে সাধারণ ধর্মঘট করেছেন, তার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সুতাকলের তাঁতী অর্জুন আত্মারাম আলবের সভানেতৃত্বে যে ইউনিয়ন ছিল, তার নাম ছিল “গিরনি কামগর মহামণ্ডল”। মহারাষ্ট্রে ছোট ছোট অনেক দেশীয় রাজা ছিল। তার মধ্যে একটির নাম সামন্তওয়াড়ি। অর্জুন আলবে একজন কৃষক ছিলেন। গ্রাম্য শোষণে সর্বস্বান্ত হয়ে বোম্বের শহরে সুতাকলে কাজ করতে আসেন। পরিবার হতে তিনি একাই আসেননি, তাঁর ভাই ও বোনও সুতাকলে কাজ করতে এসেছিলেন। লেখাপড়ার দিক থেকে তিনি মারাঠী ভাষা জানতেন, ইংরেজী জানতেন না। সেকালে ট্রেড ইউনিয়নগুলির দপ্তরের খাতাপত্র ও হিসাব ইত্যাদি ইংরেজীতে রক্ষিত হতো; আজও তাই হয়। মজুরদের এক ভাষা নয়। বোম্বেতে মারাঠা মজুরদের প্রাধান্য ছিল। তাদের ভাষা ছিল মারাঠী। যুক্তপ্রদেশে (এখনকার উত্তর প্রদেশ) হতে যে মজুররা এসেছিলেন, তাঁদের ভাষা ছিল উর্দু। তাছাড়া গুজরাতী-ভাষী মজুরও ছিলেন; তাঁরা সংখ্যায় কম ছিলেন। গিরনি কামগর মহামণ্ডলেও ইংরেজী জানা মায়েকারকে সেক্রেটারী করা হয়েছিল। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল। সেই থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত মায়েকারই ইউনিয়নের সেক্রেটারী ছিলেন। সেই থেকে তিনি হিসাব- নিকাশ যথাযথ রাখেননি। অনেক টাকারই কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। এটা যখন ধরা পড়ল, তখন মজুরেরা প্রস্তাব পাশ করে তাঁকে ইউনিয়ন হতে বার করে দেন। ইংরেজী জানা লোকের তো দরকার ছিলই। এই দিক থেকে আলবে যখন বিভিন্ন লোকের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন তখন তিনি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি-র পার্টির সভ্য কে এন জোগলেকরের সংস্রবে আসেন। জোগলেকরও ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করতেন। তাঁর মারফতে আলবে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টাস পার্টির ও কমিউনিস্ট পার্টির-ও সভ্যদের সঙ্গে পরিচিত হন।
এন এম জোশী “সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি”-র সভ্য ছিলেন। সেই হিসাবে মজুরদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছু কিছু খোঁজ খবর নিতেন। তার সঙ্গে ঐ সোসাইটিরই সভ্য রাখলে ও পারুলেকর প্রভৃতিও ছিলেন। ভারত গবর্নমেন্ট এই জন্যে জোশীকেই সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলীর সভ্য মনোনীত করতেন। তিনি ও তাঁর দলের লোকেরা আলবের গিরনি কামগার মহামণ্ডলে প্রবেশ করতে চাইছিলেন। কিন্তু মহামণ্ডল এত বেশি শিক্ষিত লোককে ইউনিয়নে নিতে চাননি। আলবের এই মত। জোশীরা “বোম্বে টেক্সটাইল লেবর ইউনিয়ন” নাম দিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করলেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন অনুসারে তা রেজেস্ট্রী করেও নিলেন। ১৯২৮ সালে যখন সাধারণ ধর্মঘট হয়েছিল, তখন এই ইউনিয়নই ছিল একমাত্র রেজিস্ট্রী করা ইউনিয়ন। কিন্তু তার সভ্য সংখ্যা নগণ্য ছিল।
এস. এচ. ঝাবওয়ালার মিল-ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন নামে একটি রেজিস্ট্রী না করা ইউনিয়ন ছিল। তারও মেম্বর সংখ্যা সামান্যই ছিল। তিনিও আমাদের সঙ্গে অর্থাৎ ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টি-র সভ্যদের সঙ্গে ও কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন আর, আলবে তো তখন আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি কাজই করছিলেন। তাঁকে নিয়েই তখন আমরা বোম্বে গিরনি কামগর ইউনিয়ন গঠন করি পরে এই নামের সঙ্গে (লাল বাওটা) [রক্ত পতাকা] নাম যোগ করা হয়েছিল। এই ইউনিয়নকেও রেজিস্ট্রী করা হয়েছিল। এন এমন জোশী প্রথমে সাধারণ ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরে তাঁকেও এই ধর্মঘটের পেছনে এসে দাঁড়াতে হয়। তখন সব দলের অর্থাৎ জোশীর, ঝাবওয়ালার ও আমাদের দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে খুব বেশী সংখ্যক মজুর ছিলেন। এবং আলবের মতো বুঝদার মজুরের সংখ্যাও কম ছিল না। এই ধর্মঘট ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। প্রতিদিন সকালবেলা নানা এলাকার ধর্মঘটী মজুরদের সভা হতো। এই সকল সভায় সব দলের লোকেরা বক্তৃতা দিতেন; মজুরেরাও বক্তৃতা দিতেন। কিন্তু বক্তৃতায় আমাদের দলের লোকেরাই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। আমাদের নিম্বকর, মিরাজকর, জোগলেকর, এস এ ডাঙ্গে ও বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাড্লি সুবক্তা ছিলেন। এই বক্তৃতা মজুরদের মনোরাজ্যে প্রবেশ করছিল। এই খানে কলকাতার আমাদের কমরেডদের সঙ্গে বোম্বের দারুণ পার্থক্য ছিল। বোম্বের মিলগুলো বোম্বের দ্বীপ সমষ্টির ভিতরে অবস্থিত ছিল। চার পয়সার একখানা ট্রামের টিকিট কিনে সমস্ত বোম্বে ঘুরে আসা যেতন। কিন্তু কলকাতাকে কেন্দ্র করে আমাদের কল-কারাখানাগুলি হুগলী নদীর দুই তীরে ৭০/৮০ মাইল বিস্তৃত ছিল। মজুরদের সঙ্গে বোম্বের মতো মেলামেশার সুযোগ আমাদের ছিল না। সর্বোপরি আমাদের বোম্বের কমরেডরা ছিলেন সত্যিকার বক্তা। কলকাতায় আমরা তা ছিলেম না। বঙ্কিমচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায় ও রাধারমণ মিত্র দুজনে ছিলেন বিখ্যাত বক্তা। কিন্তু তাঁরা আমাদের সঙ্গে কাজ করতেন বটে, তবে আমাদের কোন পার্টির সভ্য তাঁরা ১৯২৮ সালে ছিলেন না।
দীর্ঘ ধর্মঘটের ফলে প্রতিদিনের প্রচারের ভিতর দিয়ে বোম্বের সুতাকল মজুরেরা সত্যিই শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। বক্তৃতাগুলো রাজনীতিতে ভরা থাকত। আমি নিজের চোখে দেখেছি কত দৃঢ়তার সহিত মেয়ে মজুরেরা পিকেটিং করছিলেন। ধর্মঘটী মজুরদের জন্য বিভিন্ন দেশের মজুরেরা আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন। কখনো কখনো এই সাহায্য এন এম জোশীর নামে ও ঝাবওয়ালার ইউনিয়নের নামেও এসে যেত। কিন্তু সব টাকা জমা হতো স্ট্রাইক কমিটির নিকটে। স্ট্রাইক কমিটির মজুরদের ডোল বিতরণ করতেন। এইভাবে চলেছিল বোম্বের সুতাকল ধর্মঘট।
ধর্মঘটের মীমাংসা
“Several attempts were made by interested persons to try to end the strike, but it was not unitl October the 4th that representatives of the Joint Strike Committee met the representatives of the mill- owners, and at this meeting it was agreed that work should be resumed of the following terms :-
“(1) That a Committee of there members be appointed by the Government of Bombay, with terms of reference to cover the question of the 17 demands of the workers, the standardisation scheme of the owners and their standing orders.
“(2) Work to be resumed of the basis that for the period between the calling off of the strike and the publication of the report of the Committee of Enquirey, the rates and wages of march 1927 Should be paid provided that in those mills of the Sassoon group, the Findly group and the Kohinoor mil which now workde of the revised system, and rates and the wages of March 1928 shall be paid in the spinning department only, and in the following mills the rates of March 1928 be paid in the weaving department:
The machester, the Appollo and the mayer Sasson mills. The question of muster-rolls shall not arise. Certain scales of advance were given on the workers resuming work. Work to be resummed on Saturday, October the 6th of 1928. This was in brief, the terms of the resumtion of work and how one of the biggest strikes that Bombay City had ever seen came to an end.”
(From the statement given by B.F. Bradley in the Meerut Sessions Court.)
বঙ্গানুবাদ
“যারা কোন রকমে প্রয়োজন বোধ করেছেন এমন লোকেরা কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন যাতে ধর্মঘটের সমাপ্তি ঘটানো যায়। তবে ৪ঠা অক্টোবরের আগে যুক্ত স্ট্রাইক কমিটি ও মিলমালিকদের প্রতিনিধিরা এই সম্পর্কে কথাবার্তা বলার জন্য মিলিত হননি। ৪ঠা অক্টোবরের এই মিটিং-এ স্থির হয় যে :
“(১) বোম্বে গবর্নমেন্ট তিনজন সভ্যযুক্ত একটি কমিটি নিযুক্ত করবেন। এই কমিটি মজুরদের ১৭ দফা দাবী বিবেচনা করবে। মালিকদের স্টান্ডার্ডাইজেশান পরিকল্পনা এবং তাদের চালু ব্যবস্থাগুলিও এই কমিটির দ্বারা বিবেচিত হবে।
“(২) মজুরেরা কাজে যোগ দেবেন এবং যোগ দেওয়ার ভিত্তি হবে এই যে ধর্মঘট প্রত্যাহার ও ইকোয়ারী কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে ১৯২৭ সালের মার্চ মাসের মজুরী ও হার মজুরদের দেওয়া হবে। এরই সঙ্গে আরও শর্ত হলো এই যে স্যাসুন গ্রুপের মিলে, ফিনড়লে গ্রুপের মিলে এবং কোহিনুর মিলে, যেখানে পরিবর্তিত কায়দায় কাজ হচ্ছিল, সেখানে শুধু স্পিনিং ডিপার্টমেন্টে ১৯২৮ সালের মার্চের হার ও মজুরী মজুরদের দেওয়া হবে, এবং নিম্নলিখিত মিলগুলির উইভিং ডিপার্টমেন্টে ১৯২৮ সালের মার্চের হার দেওয়া হবে। :
ম্যাঞ্চেস্টার, অ্যাপোলো এবং মেয়ার স্যাসুন মিলগুলি। স্থির হলো হারিরা প্রশ্ন উঠবে না। কাজে যোগ দিলে মজুরদের বিশেষ হারে অগ্রিম দেওয়া হবে। ১৯২৮ সালের ৬ই অক্টোবর (শনিবার) মজুরেরা কাজে যোগ দেবেন, ঠিক হলো। মজুরদের কাজে যোগদানের শর্তাবলী এবং বোম্বে শহরে অনুষ্ঠিত অন্যতম বৃহত্তম ধর্মঘটের সমাপ্তি কি ভাবে হলো, তা সংক্ষেপে বলা হলো।
(বি. এফ. ব্রাডলির মিরাট দায়রা আদালতে দেওয়া বিবৃতি হতে উদ্ধৃত।)
১৯২৮ সালে বোম্বেতে সুতাকলে মজুরদের এই ধর্মঘট বোম্বের প্রাদেশিক সরকারী মহলে চাঞ্চল্য তো এনেছিলই, তাছাড়া দিল্লি ও সিমলাতে ভারত গবর্নমেন্টকেও কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত গবর্নমেন্টের তরফ হতেও নানাভাবে এই সাধারণ ধর্মঘটকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। ভারত গবর্নমেন্টের কমার্স ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী স্যার জর্জ রেনি ঐ গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী মিঃ এইচ. জি. হেজ-কে যে ডেমি- অফিসিয়াল পত্র লিখেছিলেন তাতে এক জায়গায় আছে :
“In several respects the strike itself had been remarkable. It was unprecedented in the length of time for which it lasted and in the discipline and cohesion of the strikes.”
(Home Dept. F.No. 18/XVI/1928-Pool & K.W.)
বঙ্গানুবাদ
“নানা বিষয়ে এই ধর্মঘটটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সময়ের দীর্ঘতা, ধর্মঘটীদের শৃঙ্খলা ও তাদের সংহতি ছিল অভূতপূর্ব।”
এই শৃঙ্খলাবোধের কথাটি বোম্বের পুলিস ভালোভাবে নেয়নি। মিলমালিকেরা তো এটা মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু দিল্লি-সিলা হতে এসে স্যার জর্জ রেনি-র পর্যক্ষেণে এটা ধরা পড়েছে। আমাদের মজুরেরা যে সুশৃঙ্খল সংগ্রাম চালিয়েছে এটা মস্ত বড় কথা।
যাঁর অধিনায়কত্বে কমিটি নিযুক্ত হয়েছিল, তিনি ছিলেন বোম্বে হাইকোর্টের মিস্টার জাস্টিস ফসেট। তাঁরই সেশনস আদালত হতে চায়না-ইনডিয়া মোকদ্দমায় জুরাররা ফিলিপ স্প্রাট, মিরাজকর ও আরও একজনকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার উদ্ভব
ভারত গবর্নমেন্টের দলিলপত্রে এই সম্বন্ধে তালাশ করতে গিয়ে আমরা চারটি ফাইলের সন্ধান পাচ্ছি। এই ফাইলগুলির নম্বর নীচে দিলাম :
Home Dept. F.No. 18/XVI/1928 Poll. & K.W.
Home Dept. Poll. & K.W.No. 18-XVI/28 of 1928.
File No. 10/ IV / 29 K. W. of 1929.
File No. 10/TV/29-Poll.
এই ফাইলগুলির অন্তর্ভুক্ত কাগজপত্রগুলো হচ্ছে বড়লাট ও সেক্রেটারী অব স্টেট অব ইন্ডিয়ার মধ্যে গোপন পত্রালাপ ও টেলিগ্রামে আলাপ; ভারত গবর্নমেন্টের দপ্তরের সহিত স্টেট সেক্রেটারী দপ্তরের আলোচনা; বোম্বে গবর্নমেন্ট দপ্তরের সহিত স্টেট সেক্রেটারী দপ্তরের আলোচনা; এবং ভারত গবর্নমেন্ট ও ভারতের প্রাদেশিক গবর্নমেন্টগুলির মধ্যে মত বিনিময়।
১৯২৪ সালের কানপুরে “বলশেভিক ষড়যন্ত্র” মোকদ্দমা দায়ের করার জন্য ১৯২৩ সাল হতে সেক্রেটারী অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া জিদ ধরেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতে “বলশেভিকদের” অঙ্কুরে বিনষ্ট করা। এই মোকদ্দমার আসামীদের মধ্যে কেউ কেউ ১৯২৩ সালের মে মাসেই ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলোশন অনুসারে বন্দী হয়েছিলেন। কিন্তু মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কথা মোকদ্দমা দায়ের করার কয়েক মাস আগে মাত্র উঠেছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ১৯২৮ সালের ২৪শে মে পর্যন্ত মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা সম্পর্কে ভারত গবর্নমেন্ট বা ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট কেউই কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। বড়লাট আরউইন সেক্রেটারী অব স্টেটকে এক পত্রে ঐ তারিখে জানালেন :
“I am in ful agreement with you that the line of proscribing such movements does not hold out much hope of success…”
(Home Dept. F. No. 18/XVI/1928-Poll. [K.W.])
বঙ্গানুবাদ
“এই রূপ আন্দোলনকে বে-আইনী ঘোষণা করে খুব বেশী সাফল্য লাভ করা যাবে না বলে আপনার (সেক্রেটারী অব স্টেট্-এর) সঙ্গে আমার (আরউইন) পূর্ণ মতৈক্য আছে।”
কিন্তু ভারত গবর্নমেন্ট চুপ করে বসে ছিলেন না। তাঁরা বিদেশের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। রাশিয়া হতে কিছু অর্থ সাহায্য বোম্বে মিল ধর্মঘটীদের জন্য এসেছিল। আর কিছু আর্থিক সাহায্য এসেছিল ইস্ট ইনডিয়ান রেলওয়ের শ্রমিকদের জন্য। যাতে এই রকম সাহায্য আসা এবং আরও অনেক কিছু বন্ধ হতে পারে তার জন্য ভারত গবর্নমেন্ট কেন্দ্রীয় আইন সভায় উত্থাপন করার জন্য একটি আইনের খসড়া রচনা করেছিলেন। বিদেশী লোকদের ভারত হতে বহিষ্কৃত করার আইন আগে হতেই ছিল। কিন্তু ভারত গবর্নমেন্ট চাইলেন যে ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজাদেরও ভারত হতে বহিষ্কৃত করার ক্ষমতা আইনে সংযোজিত হোক। অর্থাৎ তাঁরা ফিলিপ স্প্রাট ও বি.এফ. ব্রাডলির মতো লোকদেরও বহিষ্কার চেয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে (১৯২৮) ভারত গবর্নমেন্টের তরফ থেকে পাবলিক সেটি বিল কেন্দ্রীয় আইন সভায় (লেজিসলেটিব অ্যাসেমব্লিতে) উত্থাপিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।
এইভাবে আমাদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য ভারত গবর্নমেন্ট প্রস্তুতি চালাচ্ছিল। কিন্তু ২৭ শে জুলাই (১৯২৮) তারিখে বোম্বের গবর্নর এক তার পাঠিয়ে গোলমাল বাধালেন। তারে তাঁর বক্তব্য ছিল কমিউনিস্ট স্পর্শ-দুষ্ট যাবতীয় সভা সমিতিকে বেআইনী ঘোষণা করা হোক। এই তারের বক্তব্য পরে ভারত গবর্নমেন্টের হোম মেম্বর মিঃ ক্রেরার বড়লাটকে জানালেন যে “বোম্বের গবর্নরের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব নয় কেননা কমিউনিস্টরা আইনসম্মতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে তাঁরা আশ্রয় করেছেন। কিন্তু কোন ট্রেড ইউনিয়নকে বেআইনী বলে ঘোষণা করা চলতে পারে না।” ২৯ শে জুলাই (১৯২৮) তারিখে বোম্বের গবর্নর ভারত গবর্নমেন্টের নামে আর একটি তার ছাড়লেন। তাতে বললেন কমিউনিস্ট সমস্যার একটা কিছু হেস্তনেস্ত অবিলম্বে করা প্রয়োজন। বোম্বে গবর্নমেন্টের এই উত্তেজনার পেছনের কারণ ছিল বোম্বের পুলিস কমিশনরা মিঃ কেলি। বোম্বের সুতাকল ধর্মঘট তার ও তাঁর অধীন মাটুঙ্গার জি.আই. রেলওয়ে কারখানায় পনের হাজার মজুরের ধর্মঘট হতে যাচ্ছে। কে. এন. জোগলেকর একটা সভায় এই কথা বলেছিলেন। এর পরে ফিলিপ স্প্রাটের একখানি চিঠি ধরা পড়ে। তাতে ছিল এই যে ইস্ট ইনডিয়ান রেলওয়েরে ধর্মঘটের অবস্থা খারাব; এখন জি. আই. পি. রেলওয়েতে ধর্মঘট প্রসারিত হওয়া উচিত। বোম্বের গবর্নমেন্ট যখন এই কথা জানালেন, তখন তার উত্তরে ভারত গবর্নমেন্ট বললেন যে ব্রাড্লি আর ঝাবওয়ালা বলেছেন যে ধর্মঘট করার সময় এখন নয়, এখন সংগঠনকে জোরদার করে গড়তে হবে।
এইভাবে জোর লেখালেখি চলতে থাকলো-একপক্ষে বোম্বে-পুনা আর একপক্ষে দিল্লি-সিমলা। ভারত গবর্নমেন্ট কিঞ্চিৎ এগোলে বোম্বে গবর্নমেন্ট আবার কিঞ্চিৎ পিছিয়ে যায়। মীরাট মোকদ্দমায় কিন্তু ভারত গবর্নমেন্টেরও মনে জন্ম নিল।
ভারত গবর্নমেন্ট তাঁদের প্রতিনিধিকে এই ঘটনা উপলক্ষে নানান জায়গায় পাঠাতে আরম্ভ করলেন। ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর এফ. আইসেমঙ্গারকে (F. Isemonger) রিপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য প্রথমে বোম্বে-পুনাতে পাঠালেন; তারপরে পাঠালেন বেঙ্গলে। এই আইসেমঙ্গার যে প্রকৃতভাবে কে ছিলেন তা বুঝতে পারছি না। কারণ মিঃ ডেভিড পেট্রিই ছিলেন ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর। ১৯২৯ সালে মার্চ মাসে যখন মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালু হয়, তখনও তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রকৃত ডিরেক্টর। ১৯২৯ সালে মার্চ মাসে যখন মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালু হয়, তখনও তিনি ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর ছিলেন। আমার মনে হয় ডেভিড পেট্রি ছুটিতে যাওয়ায়, কিংবা অন্য কোন কারণে মিঃ এফ্ আইসেমঙ্গার অস্থায়ীভাবে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টরের কাজ করছিলেন। যাই হোক, পুনাতে তিনি বড় বড় অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করেছিলেন। অবশ্য সে মিটিং-এ বোম্বে পুলিস কমিশনার মিঃ কেলি ছিলেন না; কারণ পুনা তাঁর এলকার বাইরে। কলকাতায় মিঃ আইসেমঙ্গার অন্য অনেকের সঙ্গে ছাড়া গবর্নরের একজেকিউটিব কাউন্সিলের হোম মেম্বর মিঃ প্রেন্টিসের (Prentice) সঙ্গেও দেখা করছিলেন। মিঃ প্রেন্টিস তাঁকে অনেক তথ্য সরবরাহ করেছিলেন এবং তাতে তিনি আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি একথাও বলেছিলেন যে মজুরদের সত্যিকার অভিযোগ আছে। এই একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করছি যে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত সরকারী কর্মচারীরা স্বীকার করেন যে মজুরদের প্রকৃত নালিশ আছে। স্থানীয় নিম্নতর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজ কর্মচারীরা, পুলিসরা তো নয়ই, একথা মানেন না। যাক, মিঃ আইসেমঙ্গার ২৯ শে আগস্ট (১৯২৮) তারিখে সম্ভবত সিমলায় ভারত গবর্নমেন্টের নিকটে তাঁর রিপোর্ট দাখিল করেন। তাতে তিনি বলেছেন যে নানা রকম কাগজপত্র ও রিপোর্ট পরীক্ষা করে তিনি বুঝেছেন যে ভারতের নানা স্থানে কমিউনিস্টদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ প্রমাণিত হবে। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সাধারণ আইনে একটি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালানো সম্ভব। এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হোম সেক্রেটারী মিঃ হেগ মন্তব্য করেন :
“…the practical action to be taken at the moment is to conduct a thorough preliminary examination into the available evidence, with a view to seeing wheather there is sufficient material for Instituting a comprehensive conspiracy case against the principal Communist leaders throughtout India. We may request D.I.B. to push in with this action as rapidly as possible.”
(Home Dept. F.No. 18/XVI/1928-Poll & K.W.)
বঙ্গানুবাদ
“সারা ভারতের বড় বড় কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা দায়ের করার জন্য পর্যাপ্ত মাল-মসলা আছে কি না তা দেখার উদ্দেশ্যে, প্রাপ্ত দলিলপত্রের প্রাথমিক পরীক্ষা চালানোই এই মুহূর্তের আসল কাজ। আমরা এই কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালিয়ে যেতে ডি.আই.বি.-কে অনুরোধ করতে পারি।”
বড়লাট ৩রা সেপ্টেম্বর (১৯২৮) এই কাজে অনুমোদন জানালেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি ও লেবর ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী মিঃ এ. জি. ক্লো ( A. G. Clow) সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন কমিউনিস্ট নেতারা ধর্মঘটে যে জয়লাভ করেছেন, মোকদ্দমার ফলে সেটা মুছে যাবে না। মোকদ্দমা শুধু তাঁদের কর্মক্ষেত্র হতে কিছুকাল দূরে সরিয়ে রাখবে। ধর্মঘট অভিযুক্তদের বীরে পরিণত করেছে, মোকদ্দমার ফলে তাঁরা মার্টারে (শহীদে) পরিণত হবেন। অন্যদিক থেকে গবর্নমেন্টকে মনে করা হবে মজুরশ্রেণীর শত্রু।
একটি কথা এখানে বলা উচিত। ১৮ই আগস্ট (১৯২৮) তারিখে ভারত গবর্নমেন্ট প্রত্যেক প্রাদেশিক গবর্নমেন্টের নামে একটা সার্কুলার পাঠালেন তাতে তাঁরা জানতে চাইলেন, কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করা যায়। প্রথমেই বোম্বের কথাটা বলা উচিত। তাঁরাই প্রথমে কমিউনিস্ট স্পর্শ-দুষ্ট যাবতীয় সভা-সমিতিগুলিকে বেআইনী ঘোষণা করার জন্য বড়লাটকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। ভারত গবর্নমেন্ট তাতে রাজি হননি। তারপরে উভয় গবর্নমেন্টের মধ্যে অনেক কথাকাটি চলে। ৫ই সেপ্টেম্বর (১৯২৮) তারিখে ভারত গবর্নমেন্ট বোম্বে গবর্নমেন্টকে লিখেছিলেন যে মজুরদেরও যে অভিযোগ আছে সেদিকে বোম্বের গবর্নমেন্টর নজর দিচ্ছেন না। এতে বোম্বে গবর্নমেন্টের হৃদয় বড় আঘাত লাগে। এর উত্তরে ১৭ই সেপ্টেম্বর (১৯২৮) তারিখে বোম্বের গবর্নমেন্ট ভারত গবর্নমেন্টকে লিখলেন যে তাঁদের উপরে অবিচার করা হয়েছে। মজুরদের নালিশের ব্যাপারও তাঁরা উপলব্ধি করেন। তারপরে ভারত গবর্নমেন্ট ২৭ শে সেপ্টেম্বর তারিখে এক পত্র লিখে বোম্বে গবর্নমেন্টের বুকের ঘায়ের উপরে কিছু মলম প্রদান করলেন।
মোটের উপরে ভারত গবর্নমেন্টের ১৮ই আগস্টের (১৯২৮) সার্কুলারের জবাবে অনেক কিছু বলে বোম্বের গবর্নমেন্ট ১০ই সেপ্টেম্বর (১৯২৮) তারিখে ভারত গবর্নমেন্টকে লিখে জানালেন যে, ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালু করা হকো। এই কথা লেখার পরেও সেই পত্রেই বোম্বের গবর্নমেন্ট লিখলেন যে কমিউনিস্টদের দ্বারা রেজিস্ট্রি করা ইউনিয়নগুলির রেজিস্ট্রিকরণ বাতিল করে দেওয়া হোক।
(Letter from the Secretary to the Government of Bombay, Home Department, to the Secretary to the Government of India, Home Department [Political] No. S.D. – 1038 of 1928, dated the 10th September, 1928.)
ভারত গবর্নমেন্টের ১৮ই আগস্ট তারিখের (১৯২৮) সার্কুলারের জবাবে বেঙ্গল গবর্নমেন্ট অনেক কিছু বললেন। তাঁরা বললেন কমিউনিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে রেষারোষি রয়েছে। এই রেষারেষি আসলে মতবাদের। কমিউনিস্টরা যে মতবাদের উপর তাঁদের আন্দোলন খাড়া করেন, ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা তা করতে চান না। আবার ন্যাশনালিস্টদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরুর পরস্পরের ভিতরে একটা রেষারেষির ভাব আছে। কংগ্রেস অধিবেশনের সমকালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ছাত্রদের কনফারেন্স হয়েছিল। এই কনফারেন্সে সভাপতি হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু এবং কনফারেন্সের কাজ ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছিল। এটা সুভাষচন্দ্র বসু মনে, মনে পছন্দ করেননি। তাঁর মনোভাবটা ছিল এই যে ছাত্র কনফারেন্সের সভাপতি তাঁরই হওয়া উচিত ছিল। ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের ভিতরে যুগান্তর, অনুশীলনের কিছু লোক ও মাদারীপুর গ্রুপ পুরোপুরি গোপনে সুভাষ বসুকে সমর্থন করতেন। জওহরলালের পক্ষীয় লোকেরা জওহরলালের সৃষ্ট ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগকে সমর্থন করতেন।
ভারত গবর্নমেন্ট প্রাদেশিক গবর্নমেন্টের যে মতামত চেয়েছেন তাতে আইনের প্রয়োগের কথাও তাঁরা তুলেছেন। বেঙ্গল গবর্নমেন্ট এ সম্বন্ধেও কথা বলেছেন। তাঁরা আইনের প্রয়োগ সম্বন্ধে প্রচলিত আইনগুলিতে কিছু কিছু পরিবর্তনের কথাও বলেছেন। সে পরিবর্তন কি ধরনের হবে তারও মুসাবিদা করে দিয়েছেন। বিশেষ করে তাঁরা ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ১০৮ ধারার, ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১২৮-এ ধারার ও ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারার কথা বলেছেন। ১৯১০ সালের প্রেস অ্যাক্টকে আবার জীবিত করার সুপারিশও তাঁরা করেছেন। তাঁরা বলেছেন ১৯২৫ সালের বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুসারে (পাঁচ বছরের জন্য পাশ হয়েছিল) কমিউনিস্টদের বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা উচিত হবে না। মোটের উপরে বেঙ্গল গবর্নমেন্টও মোকদ্দমা করার বিরুদ্ধে মত দেননি।
মীরাট মোকদ্দমা দায়ের করার কিছুদিন আগে কলকাতায় গুজব রটেছিল যে ভারত গবর্নমেন্ট কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করা সম্বন্ধে প্রাদেশিক গবর্নমেন্টসমূহের মত জানতে চেয়েছেন। তার উত্তরে বেঙ্গল গবর্নমেন্ট মত দিয়েছে যে মোকদ্দমা করলে কমিউনিস্টদের অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। কমিউনিস্ট নেতাদের ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখলেই আন্দোলন থেকে যাবে। এখন অনেক দলিলপত্র হাতে পেয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই গুজবের কোন ভিত্তি ছিল না। বেঙ্গল গবর্নমেন্ট ও মোকদ্দমা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
১৯২৮-২৯ সালে বর্মা ভারতের একটি প্রদেশ ছিল। এই জন্যে বর্মার গবর্নমেন্টও মত দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন এই মুহূর্তে কমিউনিস্টদের তরফ হতে বর্মার কোন আশঙ্কা নাই। কিন্তু ভবিষ্যতে আশঙ্কার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে কমিউনিস্টদের খুব জোর বেড়েছে। সমস্ত বর্মায় প্রায় দেড় লক্ষ চীনা ছড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতে তারা বর্মাতেও অভ্যন্তরীণ কারণে কমিউনিজম মাথা তুলতে পারে। ভূমিব্যবস্থার পরিবর্তন আনার কথা উঠলে বৌদ্ধদের মনাস্ট্রির [মঠ] সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা উঠবে। তাতে বিপদ আছে।
মোট কথা এই, ভারতে যখন কমিউনিস্ট আন্দোলন চালুই রয়েছে, তখন তাকে দমন করার জন্যে আমাদের মনে হয় ইনডিয়ান পেনাল কোডের ৫০৫-বি ধারার প্রয়োগ করা উচিত।
ভারত গবর্নমেন্টের ১৮ই আগস্ট (১৯২৮) তারিখের সার্কুলারের জবাবে কোন প্রাদেশিক গবর্নমেন্টই এই মত দেননি যে কমিউনিস্টদের দমন করতে হবে না।
নানা প্রদেশ হতে মতামত আসার পর হোম মেম্বর মিঃ ক্রেরারের সঙ্গে আলোচনা করে হোম সেক্রেটারী মিঃ হেগ দীর্ঘ মন্তব্য (Notes) লিপিবদ্ধ করলেন। এই মন্তব্যগুলো বড়লাটের একজেকিউটিব কাউন্সিলের একটি সাব- কমিটিতে আলোচিত হলো। এই সাব-কমিটিতে ছিলেন (১) বড়লাট নিজে, (২) ভূপেন্দ্রনাথ মিত্র, (৩) ক্রেরার, (৪) ব্রজেন্দ্রলাল মিত্র। মিঃ রেনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি এক দীর্ঘ বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছিলেন। তাতে বলেছিলেন যে বোম্বে ও কলকাতার অবস্থা শোচনীয়, সরকারের পক্ষে হাত-পা গুটিয়ে আর বসে থাকা উচিত নয়। হোম ডিপার্টমেন্ট যে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাব-কমিটি দেশের সাধারণ অবস্থা বিবেচনা করে আরো অনুমোদন করলেন যে কেন্দ্রীয় আইন সভার আসন্ন অধিবেশনে পাবলিক সেটি বিল পুনরায় উপস্থিত করা হোক। [পূর্বে একবার বিলটি উত্থাপিত হলেও পাস হয়নি।] সেই বিলে বিদেশ থেকে টাকা আসা বন্ধ করার অধিকার দেওয়া হোক; তারপরে বিলটিকে পাঠানো হোক একটি সিলেক্ট কমিটিতে।
বোম্বে গবর্নমেন্টকে যেমন অনুরোধ করা হয়েছে যে পুনার যুব সম্মেলনে দেওয়া জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতার জন্যে তাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করা যায় কিনা সে সম্বন্ধে আইনগত মত যাচাই করা হোক, সেই রকম বেঙ্গল গবর্নমেন্টকেও লেখা হোক সুভাষচন্দ্র বসুকে কিংবা বেঙ্গলের অন্য কোন রাজনৈতিক নেতাকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় কিনা, আইনের দিক থেকে তা যাচাই করা হোক।
সাব-কমিটির সিদ্ধান্ত এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক ব্যাপার আলোচনা করে লর্ড আরউইন কাউন্সিলের নিম্নলিখিত হুকুমনামা ১২ই জানুয়ারী (১৯২৯) তারিখে স্বাক্ষর করলেন :
(১) কেন্দ্রীয় আইন সভার পরবর্তী অধিবেশনে পাবলিক সেফটি বিলকে তোলা হোক।
(২) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা দায়ের করার জন্যে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলি অনুমোদিত হলো।
(৩) পাবলিক সেটি বিল ব্যতীত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নতুন কোন আইনের খসড়া উপস্থিত করা যেন না হয়।
মোকদ্দমার প্রস্তুতি
একটি কথা আমরা লক্ষ্য করছি যে যখনই ভারত গবর্নমেন্ট এবং বোম্বে ও অন্যান্য প্রাদেশিক গবর্নমেন্টের মধ্যে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালাবার জন্যে ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন ইনটেলিজেন্স ব্যুরো মোকদ্দমার মালমসলা সংগ্রহ করা আরম্ভ করেছিলেন, তখনই সেখান থেকে যা কিছু মালপত্র হাতে আসে তাঁরা তা গুছিয়ে রাখছিলেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় যখন সারা ভারত ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজান্ট্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রদেশের ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজান্ট্স পার্টির প্রতিনিধিদের সম্মেলন চলছিল, তারই আগে হতে তাঁরা মালমসলা সংগ্রহের ব্যাপারে লেগেছিল। পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেণ্ডেণ্ট এবং তখন ডিরেক্টর, ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর বিশেষকর্মরত অফিসার মিঃ খয়রাত নবী আদালতে তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন যে কলকাতার কৃষক ও শ্রমিক কনফারেন্সের সময় তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল এই মোকদ্দমার জন্য প্রমাণপত্র সংগ্রহ করা।
মিঃ আর. এ. হরটন ভারতীয় পুলিস সার্ভিসের একজন সভ্য ছিলেন। তিনি সংযুক্ত প্রদেশের (এখন উত্তর প্রদেশ) পুলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁকে ভারত গবর্নমেন্টের হোম (ইনটেলিজেন্স) ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে ভবিষ্যৎ মীরাট মোকদ্দমার দলিলপত্র অধ্যয়ন করার ভার দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি ছিলেন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (অর্থাৎ বিশেষ কর্মরত অফিসার)। মিঃ তসদ্দোক হোসেনও ভারতীয় পুলিস সার্ভিসের লোক ছিলেন এবং ইউ.পি.-র সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁকেও ভারত গবর্নমেন্টের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর আফিসে বিশেষ কর্মরত অফিসার হিসাবে পাঠানোর হয়েছিল।
১৯২৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি তারিখ মিঃ হরটন তাঁর রিপোর্ট দাখিল কররেন। তাতে তিনি বললেন যে কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে খুব জোরালো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চালানো যাবে। তাঁর প্রথম রিপোর্টে তিনি নিম্নলিখিত ২২টি নাম উল্লেখ করেছিলেন :
Bengal :
1. Muzaffar Ahmad
2. D.K Goswami
3. Shib Nath Banerji
4. Shamsul Huda
5. S.N. Tagore
Bombay :
6. Phillip Spratt
7. B.F. Bradley
8. S.A. Dange
9. S. V. Ghate
10. S.H. Jhabvala
11. D.R. Thengadi
12. K.N. Joglekar
13. S.S. Mirajkar
14. R.S. Nimbkar
U. P.
15. Shaukat Usmani
16. Ayodhya Prashad
17. P.C. Joshi
18. Gouri Shankar
19. L. N. Kadam
20. Dr. V.N. Mukharji
Punjab :
21. Sohan Singh Josh
22. M.A. Majid
“নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ যাঁরা ভারতে করেন না, তবে আমার মতে ভারতীয় আইনানুসারে তাঁরা মূল ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে রয়েছে :
England :
23. R. Page Arnot
24. C. P. Dutt
25. S. Saklatvala
26. H. Pollitt
27. George Allison Alias D. Campbell
28. N.J. Upadhhyaya
29. Graham Pollard
“উপরের তালিকা কিছুতেই শেষ তালিকা নয়, আরো বিশিষ্ট ষড়যন্ত্রকারীরা আছেন যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা চালানো যায়।’
ডি.আই.বি.
স্বাঃ আর. এ. হরটন।
১৫-১-২৯
দিল্লি-লন্ডন মত বিনিময়
১৯২৯ সালের ১৯শে জানুয়ারী তারিখে বড়লাট ভারতের স্টেট্ সেক্রেটারীকে তারে জানালেন :
“We have recently considered carefully the replies of local Governments to our Home Department letter No. 1007 dated 18th August, 1928, copy forwarded to you with Home Dept. letter No. S. 138, dated 23rd idem, regarding possible action against Indian Communists. The conclusion we have definitely arrived at is that both on grounds of general policy and on practical considerations we should, in the first place, if convinced that there is a strong case, by the effect of a comprehensive conspiracy case against the leading Indian Comminists, before we consider taking any further legislative powers such as are suggested in Paragraph 8 of our Home Department letter referred to above. The existing organisations would be broken up and the more dangerous leaders removed ty success in such a case. It would expose, by means of a judicial pronouncement which would not be questioned, the real aims and methods of the Communists. Thereafter it would possibly enable us to proceed to proclaim certain Communist associations, such as the Workers’ and peasants `Parties, under the Criminal Law Amendment Act as unlawful associations on the authority of the findings of the Court. In Ourt view it would indeed deal the whole Comunist movement a moare serious blow than any that could be expected from the taking of new special powers.
“2. A Police Officer has been on special duty for several months collecting material for such a case, and he has now presented a report, suggesting that there in a good case against 22 leading Communists, among whom spratt and Bradley are included. The case as outlined by him, would be a continuation of the successful Cawnpore conspiracy case of 1924, which for a time put an end to the serious Communist activities in India.
“It would be sought to prove that a Communist conspiracy exists to deprive the King of the sovereignty of British India. The case Would start with the activities of the Communist International and the various agents and agencies through which it has workde against India, in particular in recent times the CPGB. It would further be sought to prove that this party has sent to India as agents Allison, Spratt and Bradley and that these have combined with a number of Indians to conduct the Communist Conspiracy against the sovereignty of the King.
“3. Steps are now about to be taken to obtain the best possible legal opinion on the material collected by the special Officer, which is very voluminous, and we do not anticipate that we shall have a final legal opinon till about the middle of March. If an assurance of success is given by this opinon, we should then proceed to launche of success is given by this Opinion, we should then proceed to launch the case as early as possible, probably about the beginning of April. The trial would take many months and would be costly; but in comparison with the advantages of success the time and money would be of little account. When once a case has been launched, the main activities of the Communists would, we think, be pralysed, for the number of Communist leadrs in India is not large, and all those of any account would be included in the case.
“4. If it is said that there is a good case against Spratt and Bradley, we should proceed against them and not make use of the powers of deprotion under the Public Safety Bill which we anticipate will become law about the end of March.
“5. It is hoped that if a case is instituted, we can depend on receiving all reasonable assistance from authorities in England, (see for instance DIB’s letter No. B.C.C. General dated 24th December 1928, addressed to I.P.I). It is not intended to indict anyone in England thourgh reference to the activities of Comunists in England will be important and inevitable.”
[Telegram P.No. P257-s. Dated the 19th January, 1929.
From: Viceroy (Home Dept.), Delhi.
To: Secretary of state for india, London.
বঙ্গানুবাদ
ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মতামত চেয়ে ১৯২৮ সালের ১৮ই আগস্ট তারিখে বিভিন্ন প্রাদেশিক গবর্নমেন্টের কাছে লেখা হোম ডিপার্টমেন্টের ১০০৭ নং পত্রের উত্তর আমরা সম্প্রতি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করেছি। এই পত্রের একটি কপি হোম ডিপার্টমেন্টের ১৩৮নং-এস পত্রের সঙ্গে ২৩ শে আগস্ট (১৯২৮) তারিখে আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে। আমরা যে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তা সাধারণ নীতি এবং বাস্তব বিবেচনার ভিত্তিতেই করেছি। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রথমে উপরে উল্লেখিত হোম ডিপার্টমেন্টের পত্রের ৮নং প্যারায় প্রস্তাবিত অধিক আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগের আগে, যদি শক্তিশালী ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কথা বোঝা যায়, তবে ভারতের প্রধান কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা করা হবে। এইরূপ মোকদ্দমার সাফল্যের দ্বারা বর্তমান সংগঠনগুলি ভেঙে পড়বে এবং বিপজ্জনক নেতাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে। যে বিচার-বিভাগীয় ঘোষণা সম্পর্কে সন্দেহ জাগবে না, তার আশ্রয়ে এই মোকদ্দমা কমিউনিস্টদের আসল উদ্দেশ্য ও কার্যপ্রণালী প্ৰকাশ করে দেবে। অতঃপর আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ল অ্যামেণ্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুসারে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টিসমূহের ন্যায় কমিউনিস্ট সংস্থাগুলিকে বে-আইনী ঘোষণা ক্ষমতা প্রয়োগের দ্বারা যা আশা করা যায়, এই মোকদ্দমা সমগ্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর তার চেয়েও মারাত্মক আঘাত হানবে।
২। এই মোকদ্দমার জন্য মালমসলা সংগ্রহের কাজে একজন পুলিশ অফিসার কয়েকমাস ধরে নিযুক্ত রয়েছেন। তিনি এখন একটি রিপোর্ট দাখিল করেছন : তাতে স্প্রাট এবং ব্রাড্লি সহ ২২ জন বিশিষ্ট কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে একটি ভাল মোকদ্দমার সুপারিশ করেছেন। তিনি মোকদ্দমার যে রূপরেখা রচনা করেছেন তাতে ১৯২৪ সালে সফল কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সঙ্গে এই মোকদ্দমাকে অবিচ্ছিন্ন করে দেখিয়েছেন। কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা কিছুকালের জন্য ভারতে বিপজ্জনক কমিউনিস্ট কার্যকলাপকে শেষ করে দিয়েছিল।
ব্রিটিশ-ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা হতে রাজাকে বঞ্চিত করার একটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র যে বর্তমান রয়েছে, তা এই মোকদ্দমায় প্রমাণের চেষ্টা হবে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং যে সকল দূত ও সংস্থা, বিশেষ করে বর্তমানে কালে সি. পি. জি. বি.-র মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভারতের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তাদের কার্যকলাপ দিয়ে মোকদ্দমা শুরু হবে। এই পার্টি ভারতে অ্যালিসন, স্প্রাট এবং ব্রাড্লিকে যে দূত করে পাঠিয়েছিলেন, তা প্রমানের চেষ্টা হবে। আরো প্রমান করার চেষ্টা হবে যে এঁরা কিছু সংখ্যক ভারতীয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজাকে সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল।
৩। স্পেশাল অফিসারদের দ্বারা সংগৃহীত মালমসলার উপর যথাসম্ভব ভাল আইনগত মতামত জানার চেষ্টা এখন করা হচ্ছে। এই মালমসলার পরিমাণ বিশাল এবং আমরা মার্চের মাঝামাঝির আগের চূড়ান্ত আইনগত মতামতের আশা করতে পারি না। এই মতামতের দ্বারা যদি সাফল্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাহলে আমরা যত তাড়াতাড়ি, সম্ভবত এপ্রিলের শুরুতে মোকদ্দমা আরম্ভ করতে পারি। বিচারে অনেক মাস কেটে যাবে এবং খরচণ্ড হবে অনেক; কিন্তু মোকদ্দমায় জেতার সুবিধার তুলনায় এই সময় এবং অর্থ সামান্যই ধর্তব্যের বিষয়। একবার এই মোকদ্দমা শুরু হলে, আমরা মনে করি, কমিউনিস্টদের প্রধান কার্যকলাপ অচল হয়ে পড়বে; কারণ ভারতে কমিউনিস্ট নেতার সংখ্যা খুব বেশী নয়, এবং যাঁরা কোন কাজের তাঁদের সকলকেই এই মোকদ্দমায় জড়ানো হবে।
৪। যদি এটা বলা হয় যে স্প্রাট এবং ব্রাড্লির বিরুদ্ধে ভাল মোকদ্দমা হবে, তাহলে পাবলিক সেফটি বিলের আশ্রয়ে বহিষ্কারের পরিবর্তে তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা মোকদ্দমা শুরু করবো। আমরা আশা করি মার্চের শেষাশেষিতে পাবলিক সেটি বিল আইনে পরিণত হবে।
৫। মোকদ্দমা শুরু হলে ইংল্যাণ্ডে কর্তৃপক্ষের সমস্ত যুক্তিসংগত সাহায্যের উপর আমরা নির্ভর করতে পারি বলে আশা করা যায়, (উদহারণস্বরূপ আই-পি আই-কে লেখা ডি-আই-বির ১৯২৮ সালের ২৪ শে ডিসেম্বরের পত্র নং B.C.C. General)। যদিও ইংল্যান্ডে কমিউনিস্ট কার্যকলাপের উল্লেখ করা বিশেষ দরকার এবং অপরিহার্য তবু সেখানে কাউকে অভিযুক্ত করা আমাদের লক্ষ্য নয়।
বড়লাটের এই টেলিগ্রামের জবাব স্টেট সেক্রেটারী ২১ শে ফেব্রুয়ারি (১৯২৯) তারিখে দিয়েছিলেন। তিনি বড়লাটের সঙ্গে একমত হয়েও কতকগুলি অসুবিধার কথা তুলেছিলেন। বলেছিলেন মোকদ্দমায় দেরী হলে বোম্বের অবস্থা খারাপের দিকে যাবে। আরও বলেছিলেন যে পাবলিক সেটি বিল পাশ হলে, দুজন ইংরেজ স্প্রাট ও ব্রাড্লিকে ভারত হতে বহিষ্কার করে দিয়ে মীরাটে শুধু ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালানো যেতে পারে। সেক্রেটারী অব স্টেট্ বলেছিলেন যে তাঁর পয়েন্টগুলি বিবেচনা করা হোক, কিন্তু প্ৰয়োজন বোধ করলে এসব বিবেচনা না করেই ভারত গবর্নমেন্ট তাঁদের প্রস্তাব মত কাজে এগিয়ে যেতে পারেন (টেলিগ্রাম পি নন ৬৪৮, তাং ২১শে [প্রাপ্ত ২২শে] ফেব্রুয়ারী ১৯২৯)।
মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য ব্যরিস্টার নিয়োগ
বড়লাট আগেই স্টেট, সেক্রেটারীকে জানিয়েছিলেন যে মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টের ব্যরিস্টার মিঃ ল্যাংফোর্ড জেম্স-এর পরামর্শ চেয়েছেন। মিঃ জেমসের একজন জুনিয়ার ফেব্রুয়ারী মাসের (১৯২৯) প্ৰথম সপ্তাহ হতে মোকদ্দমার কাগজপত্রগুলো অধ্যয়ন করছিলেন। কিন্তু ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপাৰ্টমেণ্ট চাইছিলেন না যে এই ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে যাক। এর জন্য অনেক গোপন দলিদপত্র পড়ার প্রয়োজন ছিল। সেইসব দলিদপত্র স্থানচ্যুত না করে হোম ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর তাঁর সহকারী খান বাহাদুর তসদ্দোক হোসেনকে দিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করিয়েছিলেন। তিনি ল্যাংফোর্ড জেমসের জুনিয়র মিস্টার যশোপ্রকাশ মিত্রকে গাজিয়াবাদ স্টেশন নামিয়ে নিয়ে প্রায় পর্দালেডির মত করে যে ঘরে ভারত গবর্নমেন্টের গোপন দলিলপত্র ছিল সেই ঘরের পেছনে দিককার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে তুলে নিয়েছিলেন। মিস্টার মিত্র দেখলেন সেখানে তাঁর থাকা, খাওয়া, স্নান ইত্যাদি সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে বসেই তিনি গোপন দলিলপত্র পড়লেন এবং নোট করে নিলেন। হোম ইনটেলিজেন্সের করা এই কাজটির কথা আগে কেউ জানতে পারেননি। এখন সকলে জেনেছেন। মিস্টার মিত্র বলছেন যে তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভেবে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং মনে বল সঞ্চয় করার জন্য কিছু হুইস্কি খেয়ে নিয়েছিলেন। ল্যাংফোর্ড জেমসেরও দিল্লি যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটেছিল সবার অজ্ঞাতে। তাঁকে ক’দিনের জন্য দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে কলকাতায় নেই, এই কথা কলকাতার কেউ জানতে পারেননি। তখন হাওয়াই জাহাজে যাত্রী বহন করার নিয়ম চালু হয়নি। আমার মনে হয় ভারত গবর্নমেন্ট মিঃ জেমসকে মোরযোগে দিল্লি নিয়ে গিয়ে থাকবেন। তিনি দিল্লিতে বসে কাগজপত্র কিছু কিছু পড়লেন এবং তাঁর জুনিয়র মিঃ যশোপ্রকাশ মিত্রের নিকট হতে রিপোর্টও নিলেন। তারপরে মত দিলেন যে ভাল ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চলবে।
মোটের উপরে ভারত গবর্নমেন্ট ও সেক্রেটারী অব স্টেট-এর মধ্যে বিস্তর লেখালেখির পরে ধার্য হলো যে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা মীরাটেই হবে। মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমসকে বাদীপক্ষের সিনিয়র কাউনসেল ও মিঃ যশোপ্রকাশ মিত্রকে জুনিয়র কাউনসেল নিযুক্ত করা হলো। মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমসের দৈনিক ফিস্ ধাৰ্য হ’ল কলকাতা হাইকোর্টের আশি গিনি। মিঃ যশোপ্রকাশ মিত্রের দৈনিক ফিস্ ধার্য হ’ল কলকাতা হাইকোর্টের পাঁচ গিনি। কলকাতা হাইকোর্টের প্রতি গিনির স্থায়ী মূল্য সতের টাকা। এ ছাড়া তাঁরা আরো অনেক সুখসুবিধা পাবেন স্থির হলো এবং সরকারী খরচে থাকার জায়গা তো পাবেনই। মোকদ্দমা হোক না হোক কিংবা ছুটি থাকুক, এই ফিস্ চলতেই থাকবে। ইউ-পি পুলিসের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ খয়রাত নবী ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোতে স্পেশাল ডিউটি-তে বদলি হয়েছিলেন। তাঁকেও মিঃ জেম্স ও মিঃ মিত্রের সঙ্গে মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত করা হলো। প্রচলিত আইন অনুসারে মিঃ খয়রতা নবীর সে অধিকার ছিল।
কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সময় বাঙলাদেশের এ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন ভারত গবর্নমেন্টেরও আইনের উপদেষ্টা। তখন তাঁর অনুমতির প্রয়োজন ছিল। কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার ফরিয়াদি পক্ষের আর্জিও তিনি মুসাবিদা করে দিয়েছিলেন। তখন অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন মিঃ এস আর দাস। কিন্তু মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সময়ে এই নিয়মের বোধ হয় কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। বাংলাদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেলের অনুমতির আর বোধ হয় প্রয়োজন ছিল না। আমরা তখন কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি যে মোকদ্দমার আর্জির মুসাবিদা মিঃ ল্যাংফোর্ড জেম্সই তৈয়ার করে দিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর আগে তিনি মিঃ এস আর দাসের মুসাবিদা পড়ে নিয়েছিলেন। মিঃ জেম্স তাঁর শেষ লিখিত অভিমত জানিয়েছিলেন ১৩ মার্চ (১৯২৯) তারিখে। স- কাউন্সিল বড়লাট ১৪ই মার্চ (১৯২৯) তারিখে ৩১ জনের বিরুদ্ধে মীরাটের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা রুজু করার জন্য ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত ইনটেলিজেন্স ব্যুরোতে বিশেষ কর্মরত আফিসার মিঃ আর এ হরটন-কে অনুমতি দিলেন। হোম সেক্রেটারি মিঃ এইচ জি হেগ ঐ তারিখেই স-কাউন্সিল বড়লাটের তরফ হতে ভারত গবর্নমেন্টের এই মঞ্জুরীতে স্বাক্ষর দিলেন। নিম্নলিখিত আর্জি; ১৯২৯ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে মীরাটের তদানীন্তন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ই এইচ এইচ এডি (E.H.H.EDYE)-র আদালতে গোপনে দাখিল করলেন। আসামীদের গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আগে হতে টাইপ হয়ে প্রস্তুত ছিল। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তখনই সেগুলোতে সই করলেন গোপনে। এবং এই সব নিয়ে গোপনে নানান লোক নানা প্রদেশে রওনা হলেন। তাঁরা স্থির করেছিলেন যে বিশে মার্চ (১৯২৯) তারিখে শেষ রাত্রে হঠাৎ হানা দিয়ে সব প্রদেশে সকলকে একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হবে।
সর্বত্র গ্রেপ্তার
পরিকল্পনা মত ১৯ শে মার্চ (১৯২৯) দিবাগত রাত্রি তিনটার সময় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ ভারতের নানা স্থানে হানা দিয়েছিল। সময়টা ইউরোপীয় গণনায় ২০ শে মার্চ (১৯২৯) পূর্বাহ্ণ তিনটা ছিল। এখানে আমি শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারবো। পূর্বাহ্ণ তিনটা ছিল। এখানে আমি শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বরতে পারবো। কলকাতার ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনে দোতলায় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি অব বেঙ্গলের অফিস ছিল। এটা তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট ছিল। তাতে অফিস তো ছিলই আমরা কয়েকজন সে বাড়িতে থাকতামও। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দরজা খুললেই একটা করিডর পাওয়া যেত। তার প্রথম ঘরটা ছিল বাথ-রুম। তারপরে এক নম্বর ঘরে ছিল অফিস। আফিসের চেয়ার সরিয়ে রাত্রে কমরেড আব্দুল হালীম সে ঘরেই শুতেন। দ্বিতীয় ঘরে সেদিন কমরেড শামসুল হুদা ও ধরণীকান্ত গোস্বামীর মামা নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুয়েছিলেন। তৃতীয় ঘরে সেদিন ফিলিপ স্প্রাট একখানি ক্যাম্পখাটে শুয়েছিলেন। তলায় মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়েছিলেম আমি ও অযোধ্যা প্রসাদ। দ্বিতীয় ঘরে আগে ধরণীকান্ত গোস্বামী ও তাঁর সঙ্গে আরো দু-একজন থাকতেন। গোস্বামী ইতোমধ্যে ওবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মামাকে রেখে গিয়েছিলেন। এই মামার থাকাটা আমাদের পক্ষে খুব সুখকর হয়নি। তিনি আমাদের পার্টির মেম্বারও ছিলেন না।
১৯শে মার্চ (১৯২৯), যতটা মনে পড়ে, আমি বাড়ির বাইরে কোথাও যাইনি। আমরা সকলে হোটেল হতে খেয়ে এসেছিলেম। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন অত্যন্ত খারাপ ছিল। বিকাল বেলা নাবিক ইউনিয়নের নেতা আফতাব আলি টেলিফোনে জানালেন যে তিনি ঢাকা হতে ফিরে এসেছে; তাঁর বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন। সেই সময় আফতাব আলি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সভ্য ছিলেন। তিনি বললেন তিনি একবার আমাদের আফিসে আসবেন। সন্ধ্যার সময় তিনি এসেওছিলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হলো। তিনি বিদায় নিয়ে চলেও গেলেন। তারপরে রাস্তা হতে তিনি আবার ফিরে এলেন এবং আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের কাছে কিছু টাকাকড়ি আছে কি না। আমি বললাম খুব খারাব অবস্থা যাচ্ছে। তখন তিনি দশটি টাকা আমাদের দিয়ে গেলেন। এইখানে আফতাব আলির যে দরদী মনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, তার কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারলাম না। এরপরে আফতাব আলি বিরুদ্ধ ক্যাম্পে চলে গিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশে আছেন এবং আশা করি বেঁচেই আছেন। ১৯৭২ সালের জুন মাসে আমি যখন ঢাকা গিয়েছিলেম, তখন তিনি আমাকে দেখতে আসেননি। আমাদের বিরুদ্ধে পক্ষের অনেক লোক আমাকে আব্দুল কাদিরের বাড়িতে এসে দেখে গেছেন। আফতাব আলি আবদুল কাদিরের পরিচিত লোক।
সন্ধ্যার পরে যখন খেতে বার হয়েছিলেম, তখন পথে দেখলেম এখানে ওখানে দু-তিনজন করে লোক দাঁড়িয়ে আছে। জেল হতে বেরোবার পরে ১৯২৬ সালের ২রা জানুয়ারী তারিখে যখন কলকাতায় ফিরে এসেছিলেম, তখন থেকেই পুলিশের লোকেরা আমাকে অনুসরণ করছিল। আমাদের অন্য কমরেডদের পেছনেও তারা লেগেছিল। এটা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় কিন্তু এই অনুসরণকারীদের সংখ্যা বেশি বেশি দেখতে পেয়ে মনে কেমন যেন একটা ভাব হয়েছিল। ফিলিপ স্থাপ বাইরে গিয়েছিলেন কিশোরীলাল ঘোষের বাড়িতে। তিনি ফিরে আসছেন না দেখে মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেম। ফিরে তিনি এসেছিলেন রাত এগারটার সময়। আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি দেখে তিনি একটু হাসলেন। তাঁরও মনে একটা কিছু অশুভ অনুভূতি জেগেছিল।
আমরা তো সকলে শুয়ে পড়লাম। রাত তিনটার সময় “টেলিগ্রাম”, “টেলিগ্রাম” ধ্বনি করতে করতে পুলিশের লোকেরা কড়া নাড়লেন। রাতে টেলিগ্রাম আসলে টেলিগ্রাম পিয়নের ঐ রকমই করতেন। আব্দুল হালীম প্রথম ঘরেই শুয়েছিলেন, তিনি উঠে দরজা খুলে দিতেই কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার বনবিহারী মুখার্জির নেতৃত্বে পুলিস দল ভিতরে ঢুকে পড়লেন এবং দ্রুত জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, মুজফফর আহমদ কোথায়? তখন সেই ঘর থেকেই আব্দুল হালীম চেঁচিয়ে বললেন, ‘মুজফফর আহমদ, আপনাকে গ্রেপ্তার করার জন্য জামা গায়ে দেওয়ার জন্য স্যুটকেসের নিকটে গেলাম। সেই মুহূর্তে বনবিহারী মুখার্জি ঘরে ঢুকে বললেন, “খবরদার, স্যুটকেস ইত্যাদি ইত্যাদি কিছু খুবলবেন না। বলুন এ ঘরে কে কে আছেন? ফিলিপ স্প্রাট-কে তিনি তো চিনলেনই, আমি অযোধ্যা প্রসাদের নাম বলে দিলাম। মাঝের ঘরটাতে শামসুল হুদা ও নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুয়েছিলেন, আর আফিস ঘরের আব্দুল হালীমকে তো তাঁরা চিনতেনই। স্প্রাট, অযোধ্যা প্রসাদ, শামসুল হুদা ও আমাকে পুলিস বললেন, “আপনারা গ্রেপ্তার হলেন। ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে আপনাদের বিরুদ্ধে মীরাটে মোকদ্দমা হবে।” অল্পক্ষণ পরেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার হ্যানসেন ও ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের একজন ইউরোপীয় সুপারিনটেডেন্ট (তাঁর নাম ভুলে গেছি) সে ঘরে এসে ঢুকলেন। তার কিছুক্ষণ পরে কলকাতার পুলিস কমিশনার মিঃ টেগার্টও এসে গেলেন। আমাদের টেবিলের উপরে একটি টেলিফোন রয়েছে দেখতে পেয়ে তাঁরা খুবই খুশী হলেন, ভাবলেন, ওখানে বসেই সব জায়গার খবরা-খবর নিতে পারবেন। আরম্ভ হলো জোর তল্লাশি। এক টুকরো কাগজও তাঁরা ছেড়ে দিচ্ছেন না। পুঁথি পুস্তক ও কাগজপত্র স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে বলে তাঁরা টেলিফোন করে আরও পুলিশ আনালেন। প্রত্যেক জিনিসে নম্বর দেওয়া, তা সার্চ লিস্টে লিখে নেওয়া, এবং তাতে সার্চ উইটনেসদের দস্তখত করিয়ে নেওয়া যে সে কথা নয়। মিঃ টেগার্ট, তখন তিনি স্যার চার্লস টেগার্ট হয়েছেন কিনা মনে করতে পারছিনে, বেগতিক দেখে চলে গেলেন, আবার এলেন অপরাহ্ণে। তালাশি চলছে তো চলছেই, শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মিঃ হ্যানসেন সব কিছুর চার্জে ছিলেন, তিনি অন্য কিছু খাওয়ানো তো দূরের কথা আমাদের এক কাপ চাও খাওয়ালেন না। নিজে শুধু বাড়ি থেকে আনিয়ে কিঞ্চিৎ চিকেন-সুপ গলাধঃকরণ করলেন। এই পুলিস অফিসারগুলো কৃপণের একশেষ হয়ে থাকেন। গোপন খরচের টাকা হাতে তাঁরা কত বাঁচাবেন, সেদিকেই তাঁদের দৃষ্টি। সারাদিন আমরা কিছু খেলাম না। পুলিশ অফিসারদেরও কিছু খেতে দেখলাম না, শুধু মিঃ হ্যানসেনের চিকেন সুপ ছাড়া।
সন্ধ্যার কিছু আগে ফিলিপ স্প্রাট-কে দিল্লি মেল ধরাবার জন্য পুলিশ নিয়ে গেল। দিনের বেলা আমাদের ফ্ল্যাটের রাস্তার দিককার বারান্দা হতে দেখেছিলেম যে, ইঞ্জিনিয়ার যতীন মুখার্জি তাঁর গাড়ি নিয়ে অনেকক্ষণ এবং বেশ দূরে ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের ভিতরে ছিলেন। তাঁর গাড়িতে সন্তোষকুমার মিত্রও ছিলেন। আমার মনে একটি দারুণ ভাবনা হয়েছিল কি করে আমি মীরাটে যাবো। মার্চ মাসের শেষার্ধে, আমি তুলো-মেশানো একটি উলের শার্ট পরছিলাম। একটি সুতী শার্ট কেনার পয়সা জোগাড় করতে পারিনি। এই শার্টের সঙ্গে আমি কোঁচা দেওয়া ধুতি পরতাম। অনেক ভাবলাম করতে পারিনি। এই শার্টের সঙ্গে আমি কোঁচা দেওয়া ধুতি পরতাম। অনেক ভাবলাম কি করে একটা রেডিমেড দোকান থেকে টুইলের সুতী শার্ট কেনা যায়। কিন্তু কোন উপায় করতে পারলাম না। কোঁচা দিয়ে ধুতি ও গরম শার্ট পরেই গরমের দিনে মীরাটে গেলাম। এরপরে ধুতি পরার কায়দা যে বদলেছে, সে সব আমি আর শিখতে পারিনি। তাই কতকাল আগে ধুতি পরা ছেড়ে দিয়েছি, তা আর এখন মনেই করতে পারছি না।
রাত্রে আটটার পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বনবিহারী মুখার্জি, সাব- ইন্সপেক্টর মুহম্মদ ইসমাইল ও সাব-ইন্সপেক্টর মুর্শেদী আমাদের সঙ্গে নিয়ে ১৪ নম্বর লর্ড সিংহ রোডে হাজির হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম সেই পুরানো ঝগড়া তখনো রয়েছে। সেখানে একজন মুসলিম হেড কনস্টেবল ছিলেন; তাঁর অভিযোগ এই ছিল যে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি হওয়ার পরে, তাঁকে তা করা হয়নি, অথচ করা উচিত ছিল। এই নালিশ আমি ১৯২৩ সালেও স্পেশাল ব্রাঞ্চের আফিসে গিয়ে শুনেছিলাম। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের আফিসে গিয়ে সেই একই নালিশ শুনলাম। তখনও তিনি সেখানেই ছিলেন। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর উপরই হুকুম হলো। অত রাত্রে তিনি কি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন! ভবানীপুরে কোথায়ে একটি মুসলিম হোটেল ছিল। বাইকে চড়ে সেই হোটেলে গিয়ে তিনি তন্দুরী রুটি ও গরুর মাংসের কাবাব নিয়ে এলেন। আর নিকটে কোথাও হতে তিনি চায়ের জলের ব্যবস্থাও করলেন। আমরা যা-ই পেলাম তাই খেলাম। অযোধ্যা প্রসাদও আমাদের সঙ্গে খেলেন। আমরা তিনজন লোক ছিলাম, আমি, শামসুল হুদা ও অযোধ্যা প্রসাদ। বৃদ্ধ ইস্পেক্টর কালীসদয় ঘোষাল এসে আমাকে বললেন, “আহমদ সাহেব, অযোধ্যা প্রসাদকে কলমাটি পড়িয়ে নেননি কেন?” খেয়ে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন রায়বাহাদুর নলিনী মজুমদার এলেন, বললেন, “আহম্দ সাহেব, এই হুদাটিকে কোথায় পেলেন?” আমি বললাম কুড়িয়ে পেয়েছি। লালবাজার লক-আপে যাওয়ার পথে স্পেশাল ব্রাঞ্চের গেটে দেখলাম কিশোরীলাল ঘোষ ও রাধারমণ মিত্র দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললাম, আপনারা এখানে? তাঁরা বললেন, “আমরাও তো এই মোকদ্দমার সংস্রবে গ্রেপ্তার হয়েছি। তারপরে আমরা একত্রে লালবাজারে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম লকআপের ঘরগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে ও ধোওয়া হয়েছে। এক এক ঘরে এক একজনকে থাকতে হবে। শুধু উপরতলার ঘর নয়, নিচের তলার ঘরও পরিষ্কার করা হয়েছে। আমি ওখানে পুরনো বাসকরা লোক; তাই ওদের চারজনকে চারটি ঘরে যখন ঢুকিয়ে দিলাম, তখন দেখলাম আমার জন্য স্থানাভাব। আমাকে সে রাত্রি নিচের ঘরে শুয়ে কাটাতে হ’ল। অন্য আসামী হলে যে জায়গায় পঞ্চাশজন লোক থাকত সে জায়গায় আমি একা থাকলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধোওয়ার পরে এ্যাংলো ইনন্ডিয়ান সার্জেন্টটি আমাদের চা ও টোস্ট খাইয়ে আমাদের পাঁচজনকে কিড স্ট্রীটে কলকাতা চীফ্ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রকস্বরার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেদিন সম্ভবত ছুটি ছিল। তাই তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি আমাদের ওয়ারেন্ট লিখলেন এবং মুখে বললেন যে তোমাদের বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য মীরাটে যেতে হবে। দুপুর বেলা আমাদের মাংস কারী ও ভাত খাওয়ানো হলো। তার পরে নিয়ে যাওয়া হলো হাওড়া স্টেশনে। সেটা কোন দূরগামী নামকরা ট্রেনের যাওয়ার সময় ছিল না। লখনৌ পর্যন্ত যাবে এমন একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে আমাদের চড়িয়ে দেওয়া হলো। আমরা থার্ড ক্লাসে যাচ্ছিলাম, একজন হাবিলদার আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল। হাওড়া স্টেশনে দেখলাম স্টেটসম্যানের চিফ রিপোর্টার। স্টেশনে একজন অল্পবয়স্ক রেলওয়ে কর্মচারী তাঁর নিজের পয়সায় আমাদের অনেকগুলো খবরের কাগজ কিনে দিলেন। ট্রেন যখন রওনা হলো তখন একমাত্র মিঃ ঘোষই দূরে থেকে হাত নাড়লেন, আর কেউ কোথাও ছিলেন না।
পরের দিন দুপুর বেলা আমরা লখনৌ স্টেশনে নামলাম। লখনৌয়ের নতুন স্টেশন বাড়িটি খুব চমৎকার হয়েছে। আমরা থার্ড ক্লাসের যাত্রী হলেও পুলিশ আমাদের ইনটার ক্লাসের (ক’বছর আগে পর্যন্তও ছিল) ওয়েটিং রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে সব ব্যবস্থা খুব ভাল ছিল। তার সঙ্গে লাগা স্নানের ঘর ছিল। আর এক পাশে ভাল খাওয়া-দাওয়ার রেস্তোরাও ছিল।
ওয়েটিং রুমে ঢোকা মাত্রই কিশোরীলাল ঘোষের মুখ খুলে গেল। তিনি বাংলা ও ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। কি যে সব অনর্গল বললেন। “আমাদের জবরদস্তি ধরে নিয়ে যাচ্ছে”, একথাও বললেন। যাত্রীরাও সকলে উচ্চকিত হলেন, খবরের কাগজে তাঁরা আমাদের গ্রেপ্তারের কথা পড়েছেন। সেখানে একজন বাঙালি ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁর বগলে একটি মদের বোতল ছিল। তিনি উঠে আমাদের খুব ভালভাবে গ্রহণ করলেন, আর বললেন রেস্তোরা-তে আমরা তাঁর অতিথি। পুলিশওয়ালারা খুশীই হলেন, কারণ তাঁদের সব পয়সা বেঁচে যাবে। এই বাঙালি ভদ্রলোক একজন রেলওয়ে কর্মচারী ছিলেন। আগে লখনৌতে পোস্টেড ছিলেন। এখন অনেক দূরে বদলি হয়েছেন-লাকসারে কিংবা দেরাদুনে। লখনৌতে কেউ তাঁর নামে পাওনা টাকার মোকদ্দমা করেছিল। তার মিটমাটের দিন ছিল লখনৌতে। সঙ্গে তিনি টাকাও এনেছিলেন এই ভেবে যে মোকদ্দমা মিটমাট হয়ে গেলে তিনি টাকাটা জমা দিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি বললেন তাঁর সৌভাগ্য যে টাকাটা তাঁকে সেদিন জমা দিতে হয়নি। সেই টাকা হতেই তিনি আমাদের খাওয়ালেন। পথে আর একবার কোথায় তিনি আমাদের খাইয়েছিলেন। মোরাদাবাদ স্টেশনে আমাদের গাড়ি বদলাতে হয়েছিল। সেখানে আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এমন দুর্ভাগ্য যে কতবার তো যুক্ত প্রদেশে গেলাম, তার সঙ্গে আর দেখা হলো না।
মোরাদাবাদ থেকে গাড়ি ছাড়ার পরে আমরা দিল্লির গাড়িতে চড়লাম। হাপুর জংশনে সেই গাড়ি থেকে নামলাম। সেখানে নিশ্চয় আমরা চা খেয়ে নিয়েছিলাম। পুলিশের সঙ্গে মীরাটের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় জে বি কৃপালানীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। আগেরবার যে মীরাটে গিয়েছিলাম, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি মীরাটেই থাকতেন, সেখানে অল- ইনডিয়া খদ্দর ডিপোর চার্জে ছিলেন। আমরা গাড়িতে চড়ার পর শ্রীকৃপালনী পুলিসকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি ঐ গাড়িতে চড়তে পারেন কিনা। পুলিস বলরেন, কেন পারবেন না! গাড়ি তো ফাঁকাই ছিল। তারপরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মীরাটে পৌছলাম। স্টেশনে কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম বোধহয়; ভাল করে মনে নেই।
সেদিন মার্চ মাসের ২৩ তারিখ (১৯২৯) ছিল।
জানি না কি কারণে কোর্ট বন্ধ ছিল। আমাদের সোজা ডিস্টিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হলো। জেলে গিয়েই শুরু হলো গোলমাল।
আমাদের মোকদ্দমাটি পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে ষড়যন্ত্রের মোকদ্দমা। এই মোকদ্দমায় শনাকরণের কোন প্রয়োজন নেই। এতে কারুর অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার কথাও ওঠে না। এটা ওঁরা বুঝলেন না, মিঃ হরটনও বুঝলেন না। জেলে আমাদের প্রত্যেককে এক একজন করে সেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইর। আসামীদের তরফ থেকে আপত্তি উঠল কেন তাঁরা আলাদাভাবে সেলে বন্ধ হবেন। এটা আসলে ইউ পি পুলিসের বিচারের ভুল ছিল। তাঁরা এ ধরনের কোনো মোকদ্দমা দেখেননি। আর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় সেলে বন্ধ করার কথাই ওঠেনি। মিঃ হরটন কাকোরী ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল ডাকাতির মামলা, শনাখৎকরণের দরকারও ছিল তাতে। হরটন মোকদ্দমার ফরিয়াদী ছিলেন বটে, কিন্তু মোকদ্দমার এদিকটা তিনি তখনও তলিয়ে বোঝেননি।
আমার বিপদ বাধালো অযোধ্যা প্রসাদ। আমাকে যখন সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন অযোধ্যা প্রসাদ আপত্তি করল, বলল, এঁর তো টিউবারকিউলোসিসের ইতিহাস আছে; এঁকে কি মনে করে সেলে ঢোকাতে চাচ্ছেন? সুপারিনটেনডেন্ট মীরট জেলের সিভিল সার্জনও ছিলেন। তিনি বললেন, আমরা মুজফফ্র আহমদকে হসপিটালে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাকি সকলকে সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। যাঁরা স্বেচ্ছায় গেলেন না, তাঁদের জোর করে ঢোকানো হলো।
আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি গিয়ে দেখলাম একটি চৌহদ্দির ভিতরে আলাদা করে ফিলিপ স্প্রাটকে রাখা হয়েছে। তিনি আমাদের আগে পৌঁছেছিলেন। তাঁর জন্য আলাদা রাঁধার ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু সে ব্যবস্থার চা পর্যন্ত বোঝা যায়, তার পরেরটা কিছুই বুঝতে পারা গেল না। আমি দেখলাম একজন কয়েদী ছোট ছোট আলু মসলাগোলা জলে সিদ্ধ করছে। আর বেচারা স্প্রাট কারুর কথা বোঝেন না, কয়েদীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, “লাল সাহেব, লাল বিবি কহাঁ”? সেখানে থেকেও আমার স্প্রাটের সঙ্গে কথা বলার হুকুম নাই।
হসপিটালের ঘরটা বড়। তার সামনে বড় ময়দানের মতো জায়গা, দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, তবে গেট আছে। আর দু’পাশে দু’টো বড় বড় সেল- ব্যারাকের পেছনের দিক। এই সেলগুলোর সামনে দিকটা দরজা দিয়ে বন্ধ আর মেঝে থেকে পেছনের দিক দিয়ে একটা ছোট জানলা বা বড় ভেন্টিলেটার আছে। কাজেই ওই সেলে যারা আবদ্ধ থাকেন, তাঁরা পেছনের দিক হতে অনেক কিছু দেখতে পান। আমাদের বন্ধুরা এই সেলগুলোতেই আবদ্ধ ছিলেন। আমার কাছাকাছি সেলে আবদ্ধ ছিলেন ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী ও শওকত উসমানী। তাঁদের সঙ্গে ইচ্ছে করলে আমি কথা বলতে পারতাম, তবে চারিদিকে নজর রেখে। প্রতিদিন অপরাহ্ণ চারটার সময় এই আবদধ বন্দীদের কিছুক্ষণের জন্য বার করা হতো। সেই সময় ইচ্ছা করলে চারদিকে নজর রেখে তাদের সঙ্গে কথাও বলে নেওয়া যেত। তখন ইউরোপীয় বন্দীদের জন্য ইউ পি-র জেল রুল অনুসারে খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা ছিল। তাঁদের পাউরুটি দেওয়া হতো, নিম্ন কোয়ালিটির মাখন (মারগারিন) দেওয়া হতো, মাছ, মাংস দেওয়া হতো। আর চা-দুধ তো দেওয়া হতোই। কিন্তু স্প্রাটের বেলায় দেখলাম অনেক কিছুই বাদ পড়ে যাচ্ছে। মাছ-মাংস কে রাঁধবে, কোথায় রাঁধবে? হসপিটালে যদি অন্তত মাংস রান্নার ব্যবস্থা থাকত, সেখানে হয়তো স্প্রাটের জন্যও মাংস রেঁধে দেওয়া যেত।
আমি হসপিটালে ছাড়া অবস্থায় থাকলাম। তার বিরাট চৌহদ্দির ভিতরে ঘোরাফেরা করতে পারতাম। কখনও কখনও ড. অধিকারী ও শওকত উসমানির সঙ্গে কথা বলা যেত। ফিলিপ স্প্রাট নিকটেই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলা সম্ভব ছিল, অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে। ১৯২৪ সালের কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা এই ধরনেরই মোকদ্দমা ছিল। ভারত গবর্নমেন্ট বলেছেন মীরাট মোকদ্দমা কানপুর মোকদ্দমারই আসামী হয়েছিলাম, আমাদের আসামীর অধিকার সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই ছিল না। ঐ মোকদ্দমা হতে আমাদের বাদ যে প্রচারিত হতে পারত সে সম্বন্ধে আমরা কিছু বুঝিনি। তা সত্ত্বেও মোকদ্দমায় দাখিল করা চিঠিপত্রগুলির অংশবিশেষ খবরের কাগজে মুদ্রিত হয়েছে। তাতে আমাদের মতবাদের কিঞ্চিৎ যে প্রচার হয়নি তা নয়। মোকদ্দমার ফরিয়াদি ছিলেন কর্নেল সি কে। তিনি পেশায় আর্মি অফিসার ছিলেন। তখন ছিলেন ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্গত ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর। তিনি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের বলে দিয়েছিলেন, আমাদের মোকদ্দমার নাম যেন “কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা (১৯২৪)” বলা হয়। তাই হয়েছিল। কর্নেল ভেবেছিলেন এদেশের লোকের নিকটে বলশেভিকরা ঘৃণ্য। কাজেই এই না থেকে সাধারণ মানুষের আমাদের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হবে। কিন্তু আমার মনে হয় এই ব্যবস্থার ভিতর দিয়েও আমাদের পক্ষে কিঞ্চিৎ প্রচার হয়েছিল। আমাদের পরে আফসোস হয়েছে যে আমরা কিছু প্রচার করতে পারিনি। আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনার কিছু উন্নতি হওয়ার পরে বুঝেছিলাম যে চেষ্টা করলেও আমাদের পক্ষে প্রচার করা সম্ভব হতো না। এই সম্বন্ধে এম এন রায় ১৯২৪ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের সম্বন্ধে কি মন্তব্য করেছিলেন তা স্যার ডেভিড পেট্রির পুস্তক (Communism in India : 1924-1927) পড়ার আগে আমি অন্তত জানতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন :
“The news about the result of the cawnpore case reached us yesterday. We had not expected any better, Poor fellows! If they could only have put up a better defence, for years in jail would have been worthwhile. We must have better Communist than this lot; and the defending Councils (Sic). By God, what fools!… With a better lot in the dock and less stupid heads at the Bar, the Cawnpore case could have been made an epoch making even in our political history ….”
বঙ্গানুবাদ
“গতকাল কানপুর মোকদ্দমার ফলাফল সম্পর্কিত সংবাদ আমদের কাছে এসে পৌঁছেছে। হতভাগ্যরা! তাঁদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করিনি। তারা যদি শুধু আরো ভালোভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতেন, তাহলে চার বছর জেল খাটা সার্থক হ’ত। এঁদের চেয়ে আরও ভালো কমিউনিস্ট এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনবিদ আমাদের দরকার। হায় ভগবান, কী বোকা এরা! …. আদালতের কাঠগড়ায় যদি আরও যোগ্য ব্যক্তিরা উঠতেন এবং আইনজীবীরা যদি আরও কম নির্বোধ হতেন তা হলে কানপুর মোকদ্দমাকে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা করে তোলা যেত। ….”
আদালতের প্রাচেরর প্রশ্ন
অবশ্য মীরাট জেলে প্রবেশ করার আগে আমি এম এন রায়ের এই পত্রাংশ পড়িনি। পত্র যে কাকে লেখা হয়েছিল তাও জানি না। সম্ভবত স্যার ডেভিড পেট্রির এজেন্ট জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টার সঙ্গে তাঁর তখন নতুন যোগাযোগ হয়েছিল। এই বাগেরহাট্টা সম্বন্ধে আগে আমরা কিছুই জানতমা না। ঘাটে বলেছেন যে, ১৯২৪ সারে বেলগাঁও কংগ্রেসে যাওয়ার সময় জানকীপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
ডঃ অধিকারীর সেল খুলে একদিন অপরাহ্ণে যখন তাঁকে বাইরে আনা হলো, তখন আমি তাঁকে বললাম যে, ভারত গবর্নমেন্টের যে রকম ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে যে আমরা দীর্ঘ দণ্ডে দণ্ডিত হব। তাই যদি হয় তবে আমরা আদালতের কাঠগড়াকে কেন আমাদের প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে যাব না? এই আদালত হতেই সরকারী খরচে আমাদের মতবাদ প্রচারিত হবে। তাতে আমাদের যা হবার তা হবে, কিন্তু কমিউনিস্ট মতবাদ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হবে। ডঃ অধিকারী বললেন, কথাটা ঠিকই। আমরা সকলে যখন একত্র হব তখন এই বিষয়ই প্রথম আলোচনা করব। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা (মীরাট বন্দীরা) দীর্ঘ ন’মাস যে বিবৃতি দিয়েছিলাম, ডঃ অধিকারীর সঙ্গে আমার কথার ভিতর দিয়ে তার সূত্রপাত হয়েছিল। আমরা যখন সেই বড় ব্যারাকে একত্র হয়েছিলাম, তখন আমরা এই বিবৃতি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, যদিও জানতাম এই বিবৃতি দিতে হবে সেশন্স আদালতে, ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে নয়। আমরা আলোচনা করেছিলাম, কিন্তু সে আলোচনার ভিতরে কোন শাঁস ছিল না; সকলেই বললেন যে তাঁরা বিবৃতি দেবেন এবং স্বীকার করবেন যে তাঁরা কমিউনিস্ট। কমিউনিজম তাঁদের জীবনের ব্রত এবং সারা জীবন তাঁরা কমিউনিজম প্রচার করে যাবেন। পরে অবশ্য এই ব্যাপারটি অন্য পথ নিয়েছিল। নানান লোক নানান ভাবে কথার জাল বুনে বিবৃতি তৈয়ার করেছিলেন। আমরা ১৯২৯ সালের কথা বলছি। সেশন্স আদালতে আমাদের বিবৃতি আরম্ভ হয়েছিল। ১৯৩১ সালের ১৮ই মার্চ তারিখে। প্রথশ বিবৃতি দিয়েছিলেন রাধারমন মিত্র।
মীরাট জেলে কলেরা
তখনও নব-নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আর মিলনার হোয়াইট আসেননি। তিনি মুজফফরনগরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মীরাট মোকদ্দমার প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ করার জন্যে গবর্নমেন্ট তাঁকেই নিযুক্ত করেছিলেন। আমাদের মোকদ্দমা শুরু করার আগে যখন ভারতের বড়লাট (লর্ড আরউইন) ও গ্রেট ব্রিটেনের স্টেট সেক্রেটারী ফর ইন্ডিয়া (লর্ড বার্কেনহেড)-র সঙ্গে আলাপ- আলোচনা চলছিল তখন ৮৩৯ নম্বর পার্সোন্যাল ও প্রাইভেট টেলিগ্রামে স্টেট সেক্রেটারী ভারতের বড়লাটকে বলেছিলেন, আশা করি তোমরা সেশনে সোপর্দ করার জন্য মনোমত ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও সেশনের বিচার করার জন্য মনোমত ইউরোপীয় জজ খুঁজে পেয়েছ ( Important 839, pp. dt London, the 7th March 1929)। ভারতীয় জজ ম্যাজিস্ট্রেটের উপরে তাঁদের বিশ্বাস ছিল না। কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায়ও তাঁরা এইরূপ করেছিলেন। দু’জন উচ্চপদস্থ ইংরেজ এই নিয়ে যে নির্লজ্জের মতো আলোচনা করলেন, তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।
যাক, ম্যাজিস্ট্রেট তখনও নিযুক্ত হয়ে আসেননি। ১৫ দিন পরে পরে মিঃ এডি এসে মোকদ্দমার তারিখ বদলে দিয়ে যান। একদিন ম্যাজিস্ট্রেট এই রকমই তারিখ বদলাতে জেলের ভিতরেই এসেছিলেন। আমরা জড়ো হয়েছিলাম সেই ব্যারাকের সামনে যে ব্যারাকে আমরা পরে থাকব। মিঃ এডি তারিখ বদলে দিয়ে আমাদের বললেন, আজ তোমরা দেরাদুনে যাচ্ছ। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, দেরাদুনে কেন? উনি বললেন মীরাট জেলে কলেরা হয়েছে। ভারত গবর্নমেন্ট তাতে বড় ঘাবড়ে গেছেন। তোমাদের কিছু হোক এটা তাঁরা কিছুতেই চান না। কাজেই নিরাপত্তার জন্যে তোমাদের পাঠানো হচ্ছে দেরাদুন জেলে। সেদিনই আমরা মোটর বাসে চড়ে দেরাদুনে গেলাম। দেরাদুনে পৌঁছতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল, পথের ধুলোয় আমরা একমন হয়ে গিয়েছিলাম যে আমরা পরস্পরকে চিনতে পারছিলাম না।
দেরাদুন জেল হতে আমরা দু’বার মীরাট ম্যজিস্ট্রেট কোর্টে ১৫ দিন পরের হাজিরা দিয়েছিলাম। সেই দু’বারই আমরা গার্ডেন হাউসে এসেছিলাম। সকলেই জানেন মীরাট একটি বড় সেনা-নিবাস। গার্ডেন হাউসটি ছিল ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান অফিসারের বাড়ী। তাতে ফুলের বাগান ছিল, আরো অনেক কিছু ছিল। গার্ডেন হাউসে কমান্ডারের বাড়ী ছাড়া একাধিক আউট-হাউসও ছিল। আমাদের কোর্টের জন্য এই বাড়ীটিই নেওয়া হয়েছিল। দেরাদুন হতে দু’বার আমরা এ বাড়ীতে এসেছিলাম। তখনও কোর্টের মঞ্চ ইত্যাদি নির্মিত হয়নি। ১৯২৯ সালের ১২ই জুন তারিখে আমরা কোর্টে এসেছিলাম মীরাট জেলের বড় ব্যারাক হতে। ১২ই জুন (১৯২৯) তারিখে আমরা উচ্চ রণধ্বনি তুলতে তুলতে কোর্টে প্রবেশ করেছিলাম।
Down with Imperilism
Up with Revolution
Onward Revolution
Labour’s Victory
Peasant’s Victory
প্রভৃতি রণধ্বনি দ্বারা আমরা কোর্টকে মুখর করে তুলেছিলাম। আগেও গার্ডেন হাউসে এলেই আমরা শ্লোগান দিয়েছি।
আমরা দেরাদুন ডিস্ট্রিট জেলে থাকার সময় একটি ব্যাপার ঘটেছিল। এলাহাবাদের দৈনিক পাইওনিয়ার (ব্রিটিশ মালিকের কাগজ) “Red Letters – A Deplorable Double Dumbness” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছেপেছিলেন। তার উত্তরে পণ্ডিত মোতিলাল নেহরু একটানা পত্র লেখেন। তাতে আমাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। আমরা সেই পত্রের উত্তরে পাইওনিয়ারকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেছিলাম (২৪শে মে ১৯২৯) যা ঐ কাগজের ৩০ মে ১৯২৯ তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল :
Mr. Motilal Nehru, in his letter Published in your issue of the 23rd instant, makes the following statment :
“The question whether there is in India a widespread secret movement to murder Government officials and those who help them, will soon come up for judicial decision in the Meerut conspiracy case.”
It appears to us that such remarks, especially from one who is both an eminent political leader and a legal authority, may seriously prejudice our defence.
We wish to make clear that we are not even charged with attempting or conspiring to assassinate Government officials or others. Our alleged crime is purely political.
Further, it should surely be known by this time to all who are concerned with Political matters that Communists are strongly opposed to individual terrorism, and never practise it. Mr. Nehru admits his doubts as to the authoriship of the “Red Letters.” The phrase “God and the Soviet” which occurs in one of them should be enough to make clear that whatever their orgin, it is not Communist.
Those propagandists and organs which are concerned to prejudice us with the public and before the court, have of course seized the opportunity provided by the bomb-cases and “Red- Letters” to impute these things to the Communists. But it should be the part of Congressmen, who know the real situation, to make the public mind clear on the matter.
P.Spratt, S.V. Ghate, Muzaffar Ahmad
K.N. Joglekar, Shaukat Usmani, S.S. Mirajkar, B.F. Bradley.
বঙ্গানুবাদ
মহাশয়,
আপনার গত ২৩ তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত এক পত্রে মিঃ মোতিলাল
নেহরু নিম্নলিখিত মন্তব্য করেছেনঃ
“ভারতে সরকারী কর্মচারী ও যাঁরা তাঁদের সাহায্য করেন তাঁদের হত্যা করবার জন্য বহুবিস্তৃত গোপন আন্দোলন আছে কিনা সে প্রশ্নটি বিচার-বিভাগীয় সিদ্ধান্তের জন্য শীঘ্রই মীরাট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় উঠবে।”
এই মন্তব্য এমন ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছে, যিনি একাধারে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা ও আইনবিশারদ; কাজেই তাঁর এই মন্তব্য আমাদের মোকদ্দমাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আমাদের মনে হয়।
আমরা একথা পরিষ্কার করে বলতে চাই যে কোন সরকারী কর্মচারী বা অপর কাউকে হত্যার চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়নি। আমাদের কথিত অপরাধ পুরোপুরি রাজনৈতিক
আরো, যাঁরাই রাজনীতিক বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন তাঁরা সকলে এতদিনে অবশ্যই জেনে গেছেন যে কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদের অত্যন্ত বিরোধী এবং কখনও তার চর্চা করেন না। সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব এবং “লাল পত্রগুলির” লেখক কে সে সম্পর্কে মিঃ নেহরু তাঁর সন্দেহের কথা স্বীকার করেছেন। “ঈশ্বর ও সোবিয়েত” কথাটি যে ঐ চিঠিগুলির মধ্যে একটিতে আছে তাই থেকে যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে যায় যে চিঠিগুলির উৎস আর যা-ই হোক, কমিউনিস্ট নয়।
যে প্রচারকরা এবং কাগজগুলি জনসাধারণের নিকট ও আদালতের সামনে আমাদের হেয় করতে চায়, তারাই বোমার মামলাগুলি ও “লাল পত্রগুলির” সুযোগ নিয়ে সেগুলিকে কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। কিন্তু যে কংগ্রেসীরা প্রকৃত অবস্থা জানেন, জনসাধারণের মন যাতে নিঃসংশয় হয়ে যায় সেজন্য তাঁদের তা দেখা উচিত।
পি. স্প্রাট
এস.ভি. ঘাটে
কে. এন. জোগলেকর
শওকত উসমানী
এস. এস. মিরাজকর
বি. এফ. ব্রাডলি
পাইওনিয়ার আমাদের পত্র ছেপেছিলেন। এর পরে এ বিষয় নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। দেরাদুন হইতে আমরা মীরাট জেলে ফিরে এসে সেই বড় ব্যারাকে বাস করতে থাকলাম। আমাদের বিশেষ ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট এসে গিয়েছিলেন। পাইপ মুখে নিয়ে তিনি কোর্টে এসে বসতেন। তাঁর পাশে বসতেন তাঁর স্ত্রী। মিঃ মিলনার-হোয়াইটকে দেখলে মনে হ’ত কেমন যেন লাজুক লোক। কিন্তু আসলে প্রভূদের হুকুম তামিল করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
আদালতে আমাদের রণধ্বনি
এই রণধ্বনির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। ১৯২৯ সালে ২৩শে মার্চ তারিখে আমরা জেলে এসেছিলাম। ৮ই এপ্রিল তারিখে কেন্দ্রীয় আইনসভার (লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির) দর্শক গ্যালারী হতে দু’জন যুবক দুটি বোমা নিক্ষেপ করলেন। বোমাতে একজন সামান্য আহত হয়েছিলেন, তেমন কিছু বড় ক্ষতি হয়নি। বোমা ফেলার সময় ট্রেড ডিসপিউট্স বিল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। দু’জন যুবকই গ্রেপ্তার হলেন তাঁদের ছবি যখন কাগজে বের হল, তখন দেখলাম যে তাঁরা আমার পূর্বপরিচিত লোক। প্রথম ব্যক্তি ছিলেন ভগৎ সিং আর দ্বিতীয় ব্যক্তি বটুকেশ্বর দত্ত। শিখের ছেলে হয়েও ভগৎ সিং গোঁপ-দাড়ি কামিয়েছিলেন। মাথার চুল ছোট করে কেটেছিলেন। দু’জনেই শার্ট ও শর্টস পরে ছিলেন; এবং তাঁদের মাথায় হ্যাটও ছিল। বোমা ফেলার সময় তাঁরা “Down Down with Imperialism”. Up Up with Revolution” ধ্বনি দিতে দিতে দু’টি বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক দিক থেকে অনেকে ধরে নিয়েছেন যে “Up Up with Revolution” যার ফরাসী অনুবাদ হয়েছে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ভগৎ সিংয়েরা প্রথম দিয়েছিলেন। আমি সবিনয়ে জানাতে চাই যে ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকে একথা সত্য নয়। ১৯২৯ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে কলকাতায় একটি সাইমন কমিশন-বিরোধী মিছিল বার হয়েছিল। এই মিছিলে কংগ্রেসের লোকেরা ছিলেন, আমরা ছিলাম এবং বহু মজুরশ্রেণীর লোকরাও ছিলেন, যাঁরা রাস্তার পাশ থেকে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল যে মিছিলে আমরা লিখিত রণধ্বনি প্রদর্শন করবো। তিনি তাতে আপত্তি করেননি, এর দুটি শ্লোগানে উত্তর কলকাতার পুলিসের ডেপুটি কমিশনার মিঃ গর্ডন আপত্তি তুলেছিলেন। এর প্রথম শ্লোগানটি হ’ল Long Live Revolution (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) দ্বিতীয় শ্লোগানটি ছিল Long live workers’ and Peasnats ‘ Soviet Republic (মজুর-কৃষক সোবিয়েত রিপাবলিক দীর্ঘজীবী হোক)। এই দ্বিতীয় শ্লোগানটি কিন্তু যেদিন আমাদের সারাভারত শ্রমিক ও কৃষক কনফারেন্স শেষ হয়েছিল, সেদিনও প্রদর্শন করেছিলাম। সেদিন কেউ কোন আপত্তি তোলেনি। খুব ভাল পোশাক পরে আফতাব আলি আগে আগে যাচ্ছিলেন। মিঃ গর্ডন নে করলেন তিনি মিছিলের পরিচালক। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল এই দুটি শ্লোগান নামিয়ে নিতে। আফতাব আলি সত্যই শ্লোগান দুটি নামিয়ে নিতে এসেছিলেন কিনা জানি না, তবে তিনি কিঞ্চিৎ পিছিয়ে এসে আমার হাত থেকে Long live Revolution শ্লোগানটি নিয়ে নিলেন। আর একজনের হাতে ছিল Long live worker’s and Peasants Soviet Republic; সেটাও তিনি নিয়ে নিলেন। তখন বোধ হয় আর নামিয়ে রাখতে তাঁর সাহসে কুলল না। তিনি দু’হাতে দুটি শ্লোগান ধরেই এগোতে লাগলেন। এর পরে নৃপেন মজুমদার আফতাব আলির হাত থেকে Long live Worker’s and Peasants Soviet Republic; শ্লোগানটি নিয়ে এগোতে লাগলেন। পুলিস এ দু’জনকেই রাস্তায় গ্রেপ্তার করলেন। চিফ্ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ইনডিয়ান পেনাল কোডের ১০৮ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা চলল। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন তাঁদের দু’জন এক বছরের জন্য মুচলেকা সই করবেন। না করলে, তাঁদের প্রত্যেকের এক বছরের জন্য বিনাশ্রম সাজা হবে। আফতাব আলি ও নৃপেন মজুমদার মুচলেকায় সই করেছিলেন। কাজেই Long live Revolution, যেটা পরে ইনকিলাব জিন্দাবাদ পরিণত হয়, প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতায়। ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে এটা আমি এখানে লিখে রাখলাম।
আর্জি – রাজা-সম্রাট
বনাম
১। ফিলিপ স্প্রাট, ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন, কলিকাতা।
২। বেনজামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি, বোম্বে।
৩। অযোধ্যা প্রসাদ, পিতা রাম প্রসাদ, মৌরানীপুর, ঝাঁসি, এবং ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন, কলিকাতা।
৪। শওকত উসমানী, পিতা গোলাম বাহাউদ্দীন, মহল্লা উস্তান, বিকানীর, এবং রুম নং ২, ৫-তলা, ব্লক নং ৪, আগাখান বিল্ডিং, হাইনেস রোড, জাউব -সার্কেলের নিটক, বোম্বে।
৫। পুরান চাঁদ জোশী, হল্যান্ড হল, এলাহাবাদ।
৬। গৌরী শংকর, আনন্দমঠ, মীরাট।
৭। এল. আর. কদম, গুডরি বাজার, ঝাঁসী।
৮। ভি.এন. মুখার্জী, পিতা ডাঃ হরিশচন্দ্র মুখার্জী, জাফরা বাজার, থানা কোতোয়ালী, জেলা গোরখপুর।
৯। চৌধুরী ধরমবীর সিং, এম.এল.সি. (সহ-সভাপতি, ওয়ার্কাস এন্ড পেজাস পার্টি), মীরাট।
১০। ধরনী গোস্বাী, পিতা রমণী মোহন, যশোদল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।
১১। শিবনাথ ব্যানার্জী, পিতা দ্বারকানাথ, রাঙদিয়া, খুলনা।
১২। মুজফফর আহমদ, পিতা মনসুর আশলী সরকার, মুসাপুর, থানা সন্দীপ, নোয়াখালী, এবং ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন, কলিকাতা।
১৩। গোপাল বসাক, পিতা বৃন্দাবন, নবাবপুর, ঢাকা
১৪। শ্যামসুল হুদা, ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন, কলিকাতা
১৫। কিশোরীলাল ঘোষ, পিতা মৃত নন্দলাল, ১ কাঁটাপুকুর লেন, কলিকাতা।
১৬। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী, পিতা হরেন্দ্রলাল, ওয়াড়ী, লৌহজং, ঢাকা।
১৭। রাধারমণ মিত্র, পিতা বিপিন বিহারী, বামনপুরা, বর্ধমান।
১৮। শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, মুলজী হরিদাস চাওল, ৪-তলা নগুসয়াজীর বাড়ী, পর্বদেবী রোড, বোম্বে।
১৯। সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে, ১৭ দ্বারকাদাস ম্যানসন, স্যান্ডহার্স্ট রোড, বোম্বে।
২০। এস. এইচ. ঝাবওয়ালা, খার, বান্দ্রা বোম্বে সুবাৰ্ধান জেলা।
২১। ধন্ডিরাজ থেংড়ি, পিতা গুণবন্ত ওরফে আর্কোবা থেংড়ি, ২২৯ নং সদাশিব পেট, পুনা সিটি।
২২। কেশব নীলকান্ত জোগলেকর, ১১৪ ফানাসবাড়ী বোম্বে।
২৩। শান্তারাম সালারাম মিরাজকর, ২/৩ নং খণ্ডকে বিলিডং, লেডি জামশেদজী রোড, দাদরা, বোম্বে।
২৪। রঘুনাথ শিবরাম নিম্বকর, কন্ট্রাক্টর বিল্ডিং নং ২,৩-তলা, চারনি রোড, প্রার্থনা সমাজের উল্টো দিকে, বোম্বে।
২৫। গঙ্গাধর মোরেশ্বর অধিকারী, ভীমরাও আত্মরামের বাড়ী, ব্লক নং ৩, ৪-তলা, ঠাকুরদ্বার রোড, বোম্বে।
২৬। মোতিরাম গজানন দেশাই, জারিওয়ালা বিল্ডিং, ৩-তলা, স্যান্ডহার্স্ট রোড, ডঃ পারেখের হসপিটালের নিকটে, বোম্বে।
২৭। অর্জুন আত্মারাম আলবে, শিবরাম অপ্রির চাওল, ২-তলা, এলফিনস্টোন মিলের পাশে, বোম্বে।
২৮। গোবিন্দ রামচন্দ্র কালে, বোম্বে উন্নয়ন ডিপার্টমেন্টের চাওল, ১- তলা, ডিলাইল রোড থানার নিকট, বোম্বে।
২৯। সোহন সিং জোশ, পিতা লাল সিং জাঠ, গ্রাম চেতনপুরা, থানা আজনালা, জেলা অমৃতসর, বাস ইসলামাবাদ, অমৃতসরের উপকণ্ঠে।
৩০। এম. এ. মজিদ ওরফে আব্দুল মজিদ পিতা মীর ফৈজদ বখ্শ কাশ্মীরী, ধল মহল্লা, মোচি গেটের ভিতরে, লাহোর সিটি।
৩১। কেদারনাথ সেগল, পিতা ভাগমল, কুচা মৈয়াসিয়ান পেপার মণ্ডি, লাহোর সিটি।
ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্গত ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টরের অধীন বিশেষ কর্মরত অফিসার মিঃ আর. এ. হরটনের নিবেদন এই যে :
১। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক নামে একটি সংগঠন আছে। সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে সারা বিশ্বে বর্তমান ধরনের সরকারগুলির উচ্ছেদ সাধন এবং তাদের জায়গায় মস্কোস্থিত কেন্দ্রীয় সোবিয়েত প্রশাসনের প্রতি অনুগত এবং তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সোবিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এই সংগঠনের লক্ষ্য।
২। উক্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কমিটি, শাখা এবং সংগঠনের মাধ্যমে তার কাজ ও প্রচার পরিচালনা করে। এই সংগঠনগুলি আবার কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অর্থাৎ তার একজেকিউটিব কমিটির (E.C.C.I) এবং একজেকিউটিব কমিটির বিভিন্ন সাব-কমিটির প্রতি অনুগত এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাচ্য ও ঔপনিবেশিক বিষয় সংক্রান্ত একটি সাব-কমিটি (ঔপনিবেশিক ব্যুরো), কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শাখা গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি (C.P.G.B) রেড ইনটারন্যাশনাল অব লেবার ইউনিয়নস্ (R.IL.U) প্যানপ্যাসিফিক ট্রেড ইউনিয়ন সেক্রেটারিয়েট, সাম্রাজবাদ বিরোধী লীগ, ইয়ং কমিউনিস্ট লীগ (Y.CL) এবং অন্যান্য নানা সংস্থা এর মধ্যে রয়েছে।
৩। সাধারণ ধর্মঘট এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রত্যেক দেশের (ভারতসহ) বর্তমান সরারগুলিকে সম্পূর্ণ অচল করা এবং উচ্ছেদ সাধন করা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করার উদ্দেশ্যে তা একটি কর্মসূচী ও প্রচার পরিকল্পনা রচনা করেছে। এই সকল নির্ধারিত পদ্ধতির মধ্যে আছে :
ক) মালিক ও মজুরের মধ্যে শত্রুতা জাগিয়ে তোলা;
খ) ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি, ইউথ লীগ, ইউনিয়নস ইত্যাদি গঠন; আপাতত এই ইউনিয়ন বা সংগঠন গড়াকে তার সদস্যদের পক্ষে কল্যাণকর মনে হলেও, আসলে তা করা হয় প্রচারের উদ্দেশ্যে। এই সকল সংগঠনে কমিউনিস্টদের প্রভুত্ব থাকায়, সংগঠনগুলি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের লক্ষ্য সমর্থন করতে প্রতিশ্রুত এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অধীনে একই নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়।
গ) বর্তমান ট্রেড ইউনিয়নগুলি জাতীয়তাবাদী সংস্থা এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য সংগঠনে কমিউনিস্টদের পূর্বোক্ত বে-আইনী উদ্দেশ্যের কোন অংশ বা বীজ চালু করা; এইরূপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ সংগঠনগুলিকে দখল করা অথবা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের স্বার্থে তাদের সমর্থন আদায় করা।
ঘ) ধর্মঘট, হরতাল এবং আন্দোলনে উৎসাহ দেওয়া।
ঙ) বক্তৃতা, সাহিত্য সংবাদপত্র, রুশ-বিপ্লব সংক্রান্ত বার্ষিকী উদ্যাপন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার চালানো।
চ) সরকার বিরোধী যে কোন আন্দোলনকে উৎসাহ দেওয়া এবং তাকে ব্যবহার করা।
৪। ১৯২১ সালে উক্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ব্রিটিশ ভারতে একটি শাখা সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত করে। অভিযুক্ত শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শওকত উসমানী এবং মুজফফর আহমদ আরো কয়েকজনের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে এইরূপ একটি শাখা সংগঠন গঠন করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রিটিশ ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা হতে রাজা সম্রাটকে বঞ্চিত করা।
৫। অতঃপর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক তার শাখা অথবা সংগঠনের মাধ্যমে ফিলিপ স্প্রাট এবং বেন্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি সহ নানা ব্যক্তিকে ভারতে পাঠিয়েছিল; তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের উদ্দেশ্যকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
৬। এই আর্জিতে যে সকল অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম করা হয়েছে, তাঁরা ব্রিটিশ-ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে বাস করছেন। ব্রিটিশ-ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে রাজা-সম্রাটকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে এবং ব্রিটিশ ভারতের ভিতরে ও বাইরে বহু পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে এবং ব্রিটিশ ভারতের ভিতরে ও বাইরে বহু পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের রচিত ও নির্ধারিত কর্মসূচী এবং প্রচার পরিকল্পনা ব্যবহারের ষড়যন্ত্রও তাঁরা করেছেন। বস্তুত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাহায্য ও আর্থিক সমর্থনের দ্বারা এই পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করেছেন এবং প্রচার অভিযান চালিয়েছেন।
৭। ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে এবং বাইরে পূর্বোক্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযুক্তরা মিলিত হয়েছেন এবং একত্রে ষড়যন্ত্র করেছেন। অন্যান্য জায়গার মধ্যে মীরাট পূর্বোক্ত ষড়যন্ত্র অনুসারে তাঁরা একটি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টি গঠন করেছেন এবং সেখানে তার একটি সম্মেলনও হয়েছিল।
৮। উপরোক্ত নামের অভিযুক্তরা এই আদালতের বিচারাধীন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১-এ ধারা মতে অপরাধ করেছেন।
সুতরাং এই প্রার্থনা করা হচ্ছে যে আদালত উপরোক্ত অপরাধ সম্পর্কে অনুসন্ধান করবেন।
স্বাক্ষর : আর. এ. হরটন
ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টরের অধীন
বিশেষ কর্মরত অফিসার,
হোম ডিপার্টমেন্ট, ভারত সরকার,
১৫ই মার্চ, ১৯২৯।
মিঃ আর. এ. হরটন এই অভিযোগ আজ দায়ের করেছেন এবং একে তিনি নির্ভুল বলে ঘোষণা করেছেন।
স্বাক্ষর : ই. এইচ. এইচ. এডি.
(E.H.H.Edye) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
মীরাট,
১৫-৩-২৯
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারী করা হোক।
স্বাঃ ই. এইচ. এইচ. এডি
১৫-৩-২৯
সমাপ্ত