অবনী মুখার্জির কথা এবং আরও কথা
১৯২৩-২৪ সাল হতে বাঙলা দেশে “বিপ্লবী অবনী মুখার্জি” নামটি প্রচলিত হয়েছে। আর, বর্তমান সময়ে যাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পুরানো দিনের কথা নিয়ে চর্চা করেন কিংবা চর্চা করার কিছু কিছু চেষ্টা করেন তাঁদের লেখায় মাঝে মাঝে “বিপ্লবী নলিনী গুপ্তে”র নামও পাওয়া যায়। নলিনী গুপ্তের কথা আমি কিছু কিছু বলেছি, কানপুর মোকদ্দমার সংস্রবে তাঁর বিষয়ে আরও অনেক কথা বলব। অবনী মুখার্জি ও নলিনী গুপ্তের নাম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে বিপ্লবী হিসাবে তাঁদের দু’জনই ভুঁইফোঁড়। আগে তাঁরা যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টিতে ছিলেন এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না। নলিনী গুপ্তের তবুও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির বহু সভ্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল, এমন কি ১৯১৪ সালে রাজাবাজার বোমার মামলার আসামী অমৃতলাল হাজরার বিরুদ্ধে পুলিসের নিকটে তিনি একটি বিবৃতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু অবনী মুখার্জির জমার খাতায় এমন কোনো কিছুও লেখা নেই। তাঁর ওই স্থানে শূন্য আছে বলা চলে।
অবনী মুখার্জি অল্প বয়সেই বখে গিয়েছিল। হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে সে তখনকার দিনের ফোর্থ ক্লাসের বেশী পড়তে পারেননি। এই কথা অবনী মুখার্জি নিজেই তাঁর সিঙ্গাপুরে স্বীকারোক্তিতে স্বীকার করেছেন। কোনো একটি শিক্ষিত পরিবারে এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও এই রকমটা ঘটতে খুব কমই দেখা গেছে।
আমি অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। তাতে এই জেনেছি যে ১৮৯২ সালের ১২ই জুন তারিখে জবলপুরে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর পিতা রায় সাহেব ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় জবলপুরে একজেকিউটিব ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন। ১৯০২ সালে তিনি চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করে কলকাতায় আসেন এবং পরের বছর ২৭ নম্বর সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়ী কেনেন।
অবনী মুখার্জির সিঙ্গাপুরের জবানবন্দী হতে জানা যায় যে তিনি আমদাবাদের কাপড়ের কলে তাঁতের কাজ শিখেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই তপতীনাথ মুখোপাধ্যায় আমার এক বন্ধুকে বলেছেন যে অবনী মুখার্জির আহমদাবাদ যাওয়ার ব্যাপারে সখারাম গণেশ দেউস্কর তাকে সাহায্য করেছিলেন। দেউস্কর নাকি অবনীদের বাড়ীর ভাড়াটে ছিলেন। তিনি বাঙলার বাশিন্দা মারাঠী। খুব জোরালো বাঙলা লিখতে পারতেন। এই শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের শক্তিশালী বাঙলা সাপ্তাহিক “হিতবাদী”র সম্পাদনাও তিনি করেছেন। তপতী মুখার্জি আমার বন্ধুকে আরও বলেছেন যে ‘ছাত্র জীবনেই অবনী মুখার্জি অনুশীল সমিতিতে যোগ দেন। ১৯০৫ সালে জিতেন চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে সার এনডুফ্রেজারকে (বাঙলার লেফটেন্যান্ট গবর্নর) গুলি করে মারার জন্যে নিয়োজিত দলে তিনি ছিলেন।’ ১৯০৫ সালে অবনীর বয়স মাত্র তেরো বছর ছিল। তাঁর সিঙ্গাপুরের স্বীকারোক্তিতে আছে যে ১৯০৪ কিংবা ১৯০৫ সালে অবনী স্কুল ছেড়েছিল। তাছাড়া, কলকাতা কলেজ স্ট্রীটের ওভারটুন হলে সার এনডুফ্রেজারকে গুলি করার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯০৮ সালের নভেম্বর মাসে, ১৯০৫ সালে নয়। চেষ্টাকারী জিতেন্দ্রনাথ চৌধুরী তখনই ধরা পড়েন, বিচারে তাঁর দশ বছরের সাজা হয়েছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে (১৯৬৭) তিনি মারা গিয়েছেন। একটি কথা মনে রাখা ভালো যে জিতেন চৌধুরীদের অনুশীলন সমিতি কিন্তু ঢাকার অনুশীলন সমিতি নয়। তাঁদের অনুশীলন সমিতি পরে ‘যুগান্তর দল’ নামে পরিচিত হয়েছে।
আমদাবাদে কাজ শিখে অবনী মুখার্জি নানান সূতাকলে ও চটকলে তাঁতীর কাজ করেছেন। ১৯১০ সালের জুলাই মাসে কাজে আরও দক্ষতা লাভের জন্যে অবনী মুখার্জি জাপানে যান। ১৯১১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে তিনি জার্মানীতে যান। ওই দেশে তিনি তেরো মাস ছিলেন। বার্লিনে লাইপ্জিগে ও প্রুশিয়ার নিদেরগোতে কারখানায় এপ্রেনটিস হয়ে কাজ শিখেছেন। ১৯১২ সালে অক্টোবর মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে এন্ডুইউল কোম্পানীতে একটি চাকরী পান। চার মাস সে কাজ করেছিলেন। ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে তিনি বৃন্দাবনের প্রেম মহাবিদ্যালয়ে ভাইসপ্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন এবং ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। এ সবই অবনী মুখার্জির সিঙ্গপুরের বিবৃতি হতে নেওয়া হয়েছে। আমি নিজে প্রেম মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে পত্র লিখেছিলেম। তিনি নিম্নলিখিত উত্তর দিয়েছেন :
Raja Mahendra Pratap
Aryan Peshwa
Master of Religion of Love
Founder of World Federation
Dear Mr. Muzzaffar Ahmad.
Kulri, Mussoorie
INDIA
23 Sept, 67
Your letter of the 20th inst. is received here today.
I am glad, you are interested in the doings of all those workers who did right or wrong in the service of the Country.
Exact dates can only be found in the old records of Prem Mahavidyalaya, Vrindaban but as far as I can recollect Mr. Abani Mukherjee was at P.M.V. in 1911-1912.
He was supposed to be the director of textile department, but the department could not be opened. He said he learned textile industry in Germanyh. Headmaster did not like him. I took him as my Secretary. He left me saying he was going to Tibet. I met him at Moscow in December, 1921 When he came with Mr. M. N. Roy to see me. I was sick and staying at Afghan Embassy.
Yours Sincerely
M. Pratap
বাংলা অনুবাদ
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ
আর্য পেশোয়া
প্রেম ধর্মের প্রধান
বিশ্ব ফেডারেশনের স্থাপয়িতা
কুলরি, মুসোরি
ভারত
২৩শে সেপ্টেম্বর, ‘৬৭
প্রিয় মিস্টার মুজফফর আহমদ,
আপনার এ মাসের ২০ শে তারিখের পত্রখানা আজ পৌঁছেছে। দেশের সেবায় যাঁরা ভালো কাজ বা মন্দ যা কিছুই করুন না কেন আপনাকে তাঁদের কাজ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহান্বিত দেখে আমি খুশী।
প্রেম মহাবিদ্যালয়ের পুরানো পরীক্ষা করলেই শুধু মিস্টার অবনী মুঝার্জির সেখানে আসার সঠিক তারিখ পাওয়া সম্ভব। আমি যতটা মনে করতে পারছি তাতে মিস্টার অবনী মুখার্জি ১৯১১-১৯১২ সালে প্রেম মহাবিদ্যালয়ে এসেছিলেন।[২৫]
[25. এ সম্বন্ধে অবনী মুখার্জি নিজে যে সময়ের কথা লিখেছেন আমি সেটাই ঠিক মনে করি। (লেখক)]
কথা হয়েছিল যে তিনি তাঁতের বিভাগটি পরিচালনা করবেন, কিন্তু বিভাগটি খুলতে পারা যায়নি। তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি জার্মানীতে তাঁতশিল্প শিখেছিলেন। আমাদের হেডমাস্টার তাঁকে পছন্দ করেননি। আমি তাঁকেআমার সেক্রেটারীর কাজ দিয়েছিলেম। তিনি তিব্বতে যাবেন বলে আমার নিকট হতে চলে যান। তারপরে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মস্কোতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি অসুস্থ অবস্থায় আগান দূতাবাসে ছিলাম। সেখানে তিনি মিস্টার এম. এন. রায়ের সঙ্গে আমায় দেখতে এসেছিলেন।
আপনার বিশ্বস্ত
এম. প্রতাপ
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের এই পত্র হতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে অবনী মুখার্জি বৃন্দাবনের প্রেম মহাবিদ্যালয়ের ভাইস প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হননি। সেই বিদ্যালয়ে প্রিন্সিপালের পদ ছিল না, ছিল হেডমাস্টারের পদ। ভাইস্ প্রিন্সিপাল তিনি কি করে হতে পারেন? মুলাকতের সময়ে তিনি এই হেডমাস্টারকেও বিশ্বাস করাতে পারেননি যে তাঁর পক্ষে বয়ন বিভাগ খোলা ও পরিচালনা করা সম্ভব। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ভদ্র ভাষায় লিখেছেন যে “আমাদের হেডমাস্টার তাঁকে পছন্দ করেননি”। একজন লোককে কাজ দেওয়ার জন্যে ডেকে আনা হলো, অথচ কাজ দিতে পারা গেল না, এই বোধ হতে রাজা তাঁকে সেক্রেটারী নিযুক্ত করলেন। কিন্তু সেক্রেটারীর কাজ চালাবার মতো ইংরেজি ভাষাজ্ঞানও কি অবনী মুখার্জির ছিল? দেখা গেল যে ক’দিন যেতে না যেতেই তিনি তিব্বতে যাওয়ার নাম করে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। অথচ তিব্বতে অবনী মুখার্জি কখনও যাননি। তার এগারো বছর পরেও আমরা অবনী মুখার্জিকে ইংরেজিতে লিখতে দেখছি-”…”is nothing more than an attempt to exploit them in a new way for certain vested interested.”[২৬] অবনী মুখার্জির সিঙ্গাপুরের বিবৃতি বা স্বীকারোক্তিতে আছে যে ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে তিনি বৃন্দাবনের প্রেম মহাবিদ্যালয়ে ভাইস্ প্রিন্সিপালরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি আগস্ট মাস হতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছিলেন।
নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি করে ও হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়েতে চাকরী করে অবনী মুখার্জির ১৯১৪ সাল কেটেছে। ১৯১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর কোনো কাজ ছিল না। এপ্রিল মাসে এইচ. এইচ. বিষ্ণুই এন্ড কোং অবনী মুখার্জিকে তাঁদের দূর প্রাচ্যের ও আমেরিকার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। জাপানী সাকে ও বীয়ারের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পাওয়ার চেষ্টা করার জন্যে বিষ্ণুইরা প্রথমেই অবনীকে জাপানে পাঠালেন। তিনি ১৯১৫ সালের ১৭ই মে তারিখে জাপানে পৌঁছেছিলেন এবং চারমাস জাপানে ছিলেন।
[26. ১৯২৪ সালের জুন মাসের ২৬ শে তারিখে বার্লিন হতে ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে দরখাস্ত অবনী মুখার্জি পাঠিয়েছিলেন তার সঙ্গে এই বিবৃতিও দাখিল করা হয়েছিল। (K 9624/218, National Archives of India.)]
অবনী মুখার্জি তাঁর সিঙ্গাপুরের স্বীকারোক্তিতে না বললেও, এমনকি জাপানে রাসবিহারী বসুকে যতীন মুখার্জির সঙ্গে তাঁর কোনো পরিচয় ছিল না একথা বলা সত্ত্বেও, আমাদের দেশে তাঁর চেষ্টায় একটি কথা রটিত হয়েছিল যে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্যে বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯১৫ সালে তাঁকে জাপানে পাঠিয়েছিলেন। ওই সময়ে আরও কয়েকজনকে অস্ত্রের সন্ধানে যতীন্দ্রনাথ দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ (দক্ষিণ হস্ত স্বরূপও বলা যায়) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পরে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় নামে খ্যাত হয়েছিলেন। ভূপতি মজুমদার ও আরও কয়েকজনও গিয়েছিলেন। তাঁদের সকলেই যতীন মুখার্জির সঙ্গে বিপ্লবী কাজে লিপ্ত বিশিষ্ট কর্মী ছিলেন। তাঁরা বিশেষভাবে জার্মান জাহাজ মাবারিকের খোঁজে গিয়েছিলেন। এই জাহাজের অস্ত্র নিয়ে আসার কথা ছিল। মোটের ওপরে, জার্মান অস্ত্রের প্রচেষ্টায় তাঁরা অকৃতকার্য হন। ভবিষ্যৎ মানবেন্দ্রনাথ রায় কোনো রকমে গিরেফতার হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়ে জাপানে ও পরে চীনে চলে যান। ভূপতি মজুমদারদের গিরেতার করে সিঙ্গাপুরের ফোর্ট ক্যানিং দুর্গে বন্দী করা হয়।
এখন জিজ্ঞাস্য হচ্ছে এই যে অবনী মুখার্জি যদি যতীন মুখার্জির দলের সভ্য হবেন এবং এমন ঘনিষ্ঠ সভ্য যে যাঁকে তিনি অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে জাপানে পাঠাতে পারেন তবে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অতুলকৃষ্ণ ঘোষ ও ভূপতি মজুমদার প্রভৃতির কেউ তাঁকে চিনতেন না কেন? এটা কি করে সম্ভব হতে পারে? ১৯২০ সালে যখন জার্মানীতে তিনি এম. এন. রায়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করেছিলেন তখন এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে আগে তাঁরা পরস্পর পরিচিত ছিলেন না। অবনী মুখার্জি রায়কে যে নিজের দীর্ঘ পরিচয় দিয়েছিলেন সেই সময়ে তিনি বলেননি যে যতীন মুখার্জি তাঁকে জাপানে অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। অবনী মুখার্জি যে আত্মপরিচয় রায়ের নিকটে দিয়েছিলেন তিনি তা তাঁর স্মৃতিকথায় প্রকাশ করেছেন। তা থেকে নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি এই পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় ছেপেছি। তাতে যতীন মুখার্জির কোনো নামোল্লেখ নেই। ওই নামের উল্লেখ এম. এন রায়ের নিকটে করলেই মুখার্জি ধরা পড়ে যেতেন। কিন্তু আত্মপ্রচারে অবনী মুখার্জির জুড়ি মেলা ভার। যতীন মুখার্জির তাঁকে অস্ত্র সংগ্রহে জাপানে পাঠিয়েছিলেন, এ কথার এত জোর প্রচার অবনী মুখার্জি নিজে করেছিলেন ও করিয়েছিলেন যে রওলাট কমিটির রিপোর্টে পর্যন্ত তা উল্লিখিত হয়েছে। “In the same month another Bengalee, Abani Mukherjee, sent by the conspirators to Japan, while the leader, Jatin Mukherji, went into hiding at Balasore owing to the police investigation in connection with the Garden Reach and Beliaghata dacoities.” (page 121 )
তর্জমা “ সেই একই মাসে (অর্থাৎ যে মাসে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য গিয়েছিলেন সেই মাসে) ষড়যন্ত্রকারীরা অবনী মুখার্জি নামক আর একজন বাঙালিকে জাপানে পাঠালেন। গার্ডেন রীট ও বেলিয়াঘাটা ডাকাইতির লোকদের অনুসন্ধানের কারণে তাঁদের নেতা যতীন মুখার্জি বালেশ্বরে গিয়ে গা ঢাকা দিলেন।” (১২১ পৃষ্ঠা)
অথচ, এই কমিটির সামনে মুখার্জির সিঙ্গাপুরের স্বীকারোক্তিও নিঃসন্দেহে ছিল। তাতে তিনি বলেননি যে যতীন মুখার্জি তাঁকে জাপানে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি সব রকমের তথ্য সরকারের আয়ত্তে থাকা সত্ত্বেও সরকারী রিপোর্ট ভ্রান্তিতে ভরা। সন-তারিখও তাঁরা ভুল লেখেন।
অবনী মুখার্জির নিজের বিবৃতি অনুসারে সে যাত্রা তিনি চার মাস জাপানে ছিলেন। সেই সময়ে ভগবান সিং ও রাসবিহারী বসুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। এইচ. এইচ. বিষ্ণুই এন্ড কোম্পানী অবনী মুখার্জিকে কোনো টাকা পাঠাচ্ছিলেন না। তাই তিনি খুবই অর্থ-কষ্টে ছিলেন। রাসবিহারী বসুর লোকেরা তাঁকে সাহায্য করছিলেন। এই সময়ে জাপানে লালা লাজপৎ রায়ের সঙ্গেও অবনী মুখার্জির পরিচয় হয়। তাঁর কিছু কাজ করে দিয়েও অবনী মুখার্জি কিছু টাকা পান।
রাসবিহারী বসুদের একজন লোককে দেশে পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। এস. কে. মজুমদার নামে একজন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁকেই প্রথমে দেশে পাঠানোর প্রস্তাব হয়। তিনি কিন্তু দেশে আসতে কিছুতেই রাজী হলেন না। তখন অবনী মুখার্জিকে বাজিয়ে দেখা শুরু হয়। রাসবিহারী বসু নিজেই অবনীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর নিকটে কোনো পরিচয়পত্র (Credentials) আছে কিনা। তারপরে জিজ্ঞাসা করলেন যতীন মুখার্জিকে তিনি চেনেন কিনা। দু’টি প্রশ্নের উত্তরেই অবনী ‘না’ বলেছিলেন। এইভাবে তাঁদের কথাবার্তা এগিয়ে যায়। শেষে অবনীকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে কিছু খবর নিয়ে তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেন কিনা। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে অবনী বললেন, তাই তো তিনি চান। এইসব কথাবার্তা হওয়ার পরে স্থির হলো যে অবনী মুখার্জিকে শাংহাইতে যেতে হবে। সেখানেই তিনি জানতে পাবেন কি বার্তা তাঁকে বহন করে ভারতবর্ষে নিয়ে যেতে হবে। তাঁকে জানানো হলে যে তাঁকে নাগাসাকি হতে ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে চিকুগো মারু জাহাজে রওয়ানা হতে হবে। তাঁকে আরও জানানো হলো যে ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে জাহাজ শাংহাই পৌঁছুবে। সেদিনই অপরাহ্ন পাঁচটার সময়ে শাংহাই পার্কে গেলে সাদা পোশাক পরিহিত, বেঁটে, সরু মতো ফরসা রং- এর একজন যুবকের সঙ্গে অবনী মুখার্জির দেখা হবে এবং সেই ফরসা যুবকই অবনীর পরের সব ব্যবস্থা করবেন। ১১ই সেপ্টেম্বর (১৯১৫) শাংহাই পার্কে গিয়ে যাঁর সঙ্গে অবনী মুখার্জির দেখা হয়েছিল তাঁর নাম ছিল অবিনাশচন্দ্র রায়, বাঙালি, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। পূর্ববঙ্গের লোক হলেও কলকাতায় আছেন দীর্ঘকাল, ইংরেজি বলেন শিক্ষিত লোকের মতো। অবিনাশচন্দ্র রায়ও নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অবনীর পরিচয় নিলেন। নানান রকম কথাও হলো তাঁর সঙ্গে। অবনীল দুটি স্বীকারোক্তি পড়ে যা বোঝা গেছে তা থেকে এটা বার হয়ে আসছে যে গাড়ীতে চড়ে অবনী (গাড়ী অবিনাশচন্দ্র রায়ই পাঠিয়েছিলেন) ৩২, ইয়াংসি পু’তে (32, Yangze Poo) অবিনাশচন্দ্র রায়ের বাড়ী গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অবিনাশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে রাসবিহারী বসুকে দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। জাপানে অবনী রাসবিহারী বসুর বাড়ী গিয়ে শুনেছিলেন যে তিনি কোনো কাজে ওসাকা গেছেন। যাই হোক, শাংহাইতে অবনী মুখার্জি সাত দিন ছিলেন। এই সময়ে রাসবিহারী বসু ও অবিনাশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ কথাবার্তা হয়। শেষে রায় তাঁকে নিম্নলিখিত বার্তা ও ‘ কোর্ডওয়ার্ড’ দিয়েছিলেন।
‘কোর্ডওয়ার্ড’টি ছিল :
“আমি রাম বাবুর নিকট হ’তে আসছি”।
বার্তাটি ছিল :
“সব খবর ভালো। এমন উপায় বা’র করুন যাতে অবিনাশচন্দ্র রায় নিরাপদে ভারতে ফিরতে পারেন”। (that “ everything is all right and that they must devise some means by which A.C. Roy could safely get to India.”)
যাঁদের নিকটে বার্তা পৌঁছাতে হবে পরে পরে তাঁদের নাম দেওয়া হয়েছিল। ব্যবস্থাটি এই রকম ছিল যে প্রথম ব্যক্তিকে না পেলেই শুধু দ্বিতীয় ব্যক্তির নিকটে যেতে হবে :
চন্দননগরে
(১) মতিলাল রায়
(২) মণীন্দ্র নায়েক
(৩) নলিনচন্দ্র দত্ত
(৪) জ্যোতিশচন্দ্র সিংহ ( গোরা ফাটক)
(৫) যতীন্দ্রমোহন রক্ষিত
(কলকাতার নিউ মার্কেটে স্ট্যাম্প ও স্টেশনারি স্টল ছিল)। চন্দনগরে ব্যর্থ হলে ঢাকা যেতে হবে।
ঢাকায়
ঢাকা পটুয়াটুলির অলকচন্দ্র হোমিওপ্যাথিক হলে গিয়ে ডাক্তার গৌরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের নিকটে গিরিজা বা চন্দ্রচূড়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাঁদের দু’জনের একজনকে পাওয়া গেলেও বার্তাটি পৌঁছিয়ে দিতে হবে। হোমিও হলে খবর না পাওয়া গেলে ডাক্তার এস. সি. দাশগুপ্তকেও গিরিজা ও চন্দ্রচূড়ের কথা জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে।
কুমিল্লায়
গিরিজা ও চন্দ্রচূড়ের খবর ঢাকায় না পাওয়া গেলে কুমিল্লায় যেতে হবে। সেখানে কান্দিরপাড়ে গগনচন্দ্র সেনের বাসায় গিরীনচন্দ্র সেনকে গিরিজা ও চন্দ্রচূড়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে হবে। যদি খোঁজ না পাওয়া যায় তবে ফিরে আসতে হবে।
কলকাতায়
কলকাতার ন্যাশনাল কলেজে গিয়ে খবরটি কুলচন্দ্র সিংহ রায়কে পৌঁছিয়ে দিতে হবে। এই খবরের সঙ্গে আরও জানিয়ে দিতে হবে যে অমর সিং (পুকোহ্ সায়ামের ডিভিশনাল ইঞ্জিনীয়ার) আমাদের লোক, অর্থাৎ অবিনাশচন্দ্র রায়ের পার্টির লোক।
সকলের মনের রাখার পক্ষে সুবিধা হবে বলে আমি আবার বলছি। অবনী মুখার্জি তাঁর প্রথম বিবৃতি দিয়েছিলেন ১৯১৫ সালের ১৩ই অক্টোবর তারিখে সিঙ্গাপুরে। এই বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেছিলেন এইচ. আর. কোঠাওয়ালা (H.R. Kothawala.) তাঁর পদের নাম হচ্ছে স্পেশাল সার্বিস অফিসার, জেনারেল স্টারে সঙ্গে সংযুক্ত (Special Service Officer, Attached General Staff, Straits Settlements)। এই দলীলের অবিকল নকল ইসু করছেন ডাডলে রিডাউট, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সৈন্যাধ্যক্ষ, স্ট্রেস্, সেটেলমেনট্স (Dudley Ridout, Brigadier-General Commanding the Troops, Straits Settlements.)
প্রথম বিবৃতি দেওয়ার কিছু কম এক বছর পরে, ১৯১৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে স্ট্রেস সেট্লমেন্টের হেড-কোয়ার্টার্স ফোর্ট ক্যানিং দুর্গে অবনী মুখার্জির তাঁর দ্বিতীয় বিবৃতি দিয়েছিলেন। এই বিবৃতিও আগেকার অফিসার এইচ. আর. কোঠাওয়ালা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই বিবৃতিতে আগেকার বিবৃতির কথাগুলিকে আরও খোলসা করেছেন। আগেকার বিবৃতিতে বলেননি এমন অনেক কথাও এই বিবৃতিতে তিনি বলেছেন।
সিঙ্গাপুরের ফোর্ট ক্যানিং-এ অবনী মুখার্জিকে মারধর করা হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই। জানা থাকা সম্ভব নয়। তবে, পেটের কথা বা’র করার জন্যে যে ধৃত বন্দীদের ওপরে কোনো কোনো সময়ে মারধরও হয় একথা আমাদের অজানা নয়। মারের ফলেই হোক, কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, তিনি সব কথা কোঠাওয়ালাকে বলে দিয়েছিলেন, ‘কোডওয়ার্ড’টিও বলে দিতে কসুর করেননি। রাসবিহারী বসু ও তাঁর সহকর্মীদের যে সব কথা তিনি বলতে শুনেছিলেন সে সব কথাও তিনি বলে দিয়েছিলেন কোঠাওয়ালাকে। অবনী মুখার্জি তাঁর জীবনে সর্বপ্রথম একটি বিপ্লবী কাজের ভার নিয়ে ভারতে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তিনি তাঁর পেটের সর্ব কথা উগরে দিলেন সিঙ্গাপুরের দুর্গে মিলিটারি অফিসারের নিকটে। কি বার্তা তিনি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তা বলে দিলেন, কি তার ‘ কোড্ওয়ার্ড’ ছিল তাও প্রকাশ করলেন এবং কার কার নিকটে তিনি যাচ্ছিলেন সে কথাও বলতে ভুললেন না। এই যদি স্বীকারোক্তি না হয় তবে স্বীকারোক্তি আর কাকে বলে? যে-বার্তা তিনি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন শুধু তার কথা বলে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। কথায় কথায় তিনি রাসবিহারী বসু ও অবিনাশচন্দ্র রায়ের নিকট হতে যা যা শুনেছিলেন সে সবও তিনি কোঠাওয়ালাকে বলে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি শুনেছিলেন যে জার্মানরা চান না যে রাসবিহারীর পক্ষে কি করে ভারতে যাওয়া সম্ভব? রাসবিহারী বসুর দলের লোকেরা বলে ফেলেছিলেন যে তিনি স্থলপথে ভারতে যাবেন। তার আগে জার্মানরা জাহাজ চার্টার করে তাঁকে সায়ামে পৌছিয়ে দিবেন। অবিনাশচন্দ্র রায় আফগান-ভারত সীমান্তে গিয়ে জার্মানদের সঙ্গে ও ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে যে ছটফট করছিলেন একথাও তিনি কোঠাওয়ালাকে বলেছিলেন। লালা লাজপৎ রায় নিউইয়র্কে মৌলবী বরকতুল্লার মুখে শুনে এসে জার্মান-ভারত ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে কি কি কথা বলেছেন এবং অবনী মুখার্জির শাংহাই ছাড়ার পূর্বক্ষণে জার্মানদের নিকট হতে অবিনাশচন্দ্র রায় ২০,০০০ ডলার পেয়েছেন এবং তা থেকে ৫০০ ডলার তিনি অবনী মুখার্জিকে দিয়েছেন, ইত্যাদি অনেক কথা কোঠাওয়ালাকে দিয়ে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন অবনী মুখার্জি।
ফোর্ট, ক্যানিং-এ আরও কয়েকজন ভারতীয় বন্দী ছিলেন, ভূপতি মজুমদারও ছিলেন। ভূপতি মজুমদার যে অবনী মুখার্জিকে চিনতেন না সেকথা আমি আগে লিখেছি। তাঁদের দু’জনের প্রথম পরিচয় হয় ফোর্ট ক্যানিং-এ। আমার যতটা মনে পড়ে ভূপতি মজুমদার আমায় একদিন বলেছিলেন যে চাবির গোছা ঘোরাতে ঘোরাতে একদিন অবনী এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “Excuse me” (আমায় ক্ষমা করবেন), আপনি কি বাঙালি? অবনী মুখার্জি তখন প্যারোলে (Parole) মুক্ত ছিলেন।
ভূপতি মজুমদারের সঙ্গে যখন ফোর্ট ক্যানিং-এ অবনী মুখার্জির পরিচয় হয়েছিল তখন অবনী মুখার্জি ও আরও দু’একজন তাঁদের জানা ও অজানা সবকথা কোঠাওয়ালাকে বলে দিয়ে বিশ্বস্ত ও বশংবদ বন্দী হয়েছেন। ভূপতি মজুমদার আমায় একদিন বলেছিলেন যে ফোর্ট ক্যানিং-এ অবনী মুখার্জি শ্রীমজুমদারকে পাম্প করে তাঁর পেটের কথা বার করে নিতে চেয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন।
সিঙ্গাপুরে যাঁরা আটকা পড়েছিলেন তাঁরা সিঙ্গাপুরেই থেকে গেলেন। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ক্রমশই বাড়ছিল। তার ফলে জাহাজে জায়গা পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। প্রথম স্বীকারোক্তির প্রায় এক বছর পরে অবনী দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি কেন করলেন? বোধ হয় ইতোমধ্যে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট ভারতে অনুসন্ধান করে জেনেছিলেন যে অবনী মুখার্জি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কেউ নন। অবনী নিজে বলেছেন যে ‘এনার্কিস্ট’ প্রভাস দে’র সঙ্গে একমাত্র তাঁর দেখা হয়েছিল। তিনি প্রভাস দে’র সঙ্গে কাজ করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু কাজ তিনি করেননি। বার্লিনে অবনী মুখার্জি এম. এন. রায়কে বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের মনে এ প্রত্যয় জন্মেছিল যে মুখার্জি কোনো বিপ্লবী দলের সভ্য নন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরলে তাঁর বিপদ কম ছিল না। সিঙ্গাপুরের বিবৃতির প্রতিশোধে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের উদ্যত খড়গ তাঁর মাথায় পড়তে পারত। তাই তিনি সিঙ্গাপুর হতে পালিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভারতে আসার জন্যে নয়। ১৯২৪ সালে অবনী মুখার্জি বার্লিন হতে ক্ষমা চেয়ে ভারতে ফেরার অনুমতি চেয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকটে যে আবেদন করেছিলেন সেই সম্বন্ধে মন্তব্য লিখতে গিয়ে ভারত গবর্নমেন্টের সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি.কে (C.Kaye) এক জায়গায় লিখেছেন।
“After Abani Mukherjee had made his statement at Singapur he was allowed out on parole-which seems to suggest that the local authorities did not care whether he ‘escaped’ (as he did) or not”.
C.Kaye
20.08.24
বঙ্গানুবাদ
সিঙ্গাপুরে অবনী মুখার্জি যখন বিবৃতি দিলেন তখন তাঁকে প্যারোলে বাইরে যেতে দেওয়া হলো। তার মানে এই মনে হচ্ছে যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মনে পরওয়াই ছিল না যে তিনি পালিয়ে যাবেন কি যাবেন না; আর, পালিয়েই তিনি গিয়েছিলেন।
সি.কে.
২০.৮.২৪
সি.কে.-র এই মন্তব্য হতে সকলে সহজে বুঝতে পারবেন যে অবনী মুখার্জির প্যারোলের তাৎপর্য কি ছিল। প্যারোলে মুক্ত হওয়ার কারণে অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে মিলিটারি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কমে গিয়েছিল। এটা মনে রাখতে হবে যে অবনী মুখার্জি বিচার বিভাগ বা শাসন বিভাগের হুকুমে সাধারণ জেলখানায় বন্দী ছিলেন না। তিনি মিলিটারির হুকুমে দুর্গে বন্দী ছিলেন। দু’জায়গায় রীতি-নীতি ও কায়দা-কানুন এক নয়। অবনীর দ্বিতীয় বিবৃতির পরে তাঁকে আটক করে রাখার কোনো মানে ছিল না। কিন্তু জাহাজে স্থান পাওয়া ছিল ।বড় দুষ্কর। আর, স্থান পেলেও মিলিটারি কর্তৃপক্ষ তো তাঁকে ভারতেই পৌঁছিয়ে দিতেন। অবনীর কিন্তু ভারতে ফেরার সাহস ছিল না। ডাচ্ অধিকৃত স্থানের ওপরেই তাঁর নজর পড়া স্বাভাবিক ছিল। যুদ্ধে ডাচ্া ছিলেন নিরপেক্ষ।
অবনী মুখার্জি সিঙ্গাপুর হতে পালিয়েছিলেন। কিন্তু কি করে পালালেন? তিনি যখন ধরা পড়েছিলেন তখন তাঁর নিকটে টাকা ছিল। জার্মানীর টাকা হওয়ার কারণে সেই টাকা জব্ৎ করা হয়েছিল কিনা তা জানিনে। যদি টাকা তাঁকে ফেরৎ দেওয়া হয়ে থাকে তবে তো সেই টাকাতেই তিনি পালানোর ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। লোকেদের দয়ার উদ্রেক করতেও তিনি পটু ছিলেন। প্যারোলে মুক্ত হওয়ার কারণে তিনি ঘুরে বেড়াতেন, লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। ব্যাপারটি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করে নিতে হবে এই ভেবে যে তিনি জেলখানার বন্দী ছিলেন না, জেলের ওয়ার্ডার বা পুলিসের কনস্টেবল তাঁর সঙ্গে থাকার কেনো কথাই উঠে না, –সর্বোপরি ফৌজী কিল্লা (কিলাহ্) হতে প্যারোলে মুক্ত ছিলেন তিনি।
সিঙ্গাপুর হতে পালানো সম্পর্কে অবনী মুখার্জি নানান জায়গায় নানান ধরনের বিবৃতি দিয়েছিলেন। এক জায়গায় বিবৃতির সঙ্গে অন্য জায়গার বিবৃতির কোনো মিল নেই। এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ খবর দিয়েছেন অবনী মুখার্জির বিধবা রুশ স্ত্রী রোজা ফিটিংগোফ। খবরটি তিনি বলেছেন ‘লিঙ্গ’ ও ‘প্যাট্রিয়েটে’র মস্কোস্থিত প্রতিনিধি পি. উন্নিকৃষ্ণানকে। লেখাটির নাম “সোবিয়েৎ ইউনিয়নে ভারতীয় বিপ্লবীগণ” (“Indian Revolutionaries in Soviet Union”) তিনি বলেছেন :
“he [Abani] stepped on the soil of the land of Socialism in 1920 after breaking a British Jail in Singapore where he had been incarcerated for his part in Bengal uprising. After the hairbreath escape from the Jail he had to swim for miles periliously close to the hull of a hospitable ship to escape being shot from the shore. He reached Afghanisthan, went on to Berlin, then refuge of political exiles, and finally to the Soviet Union.”[27]
[27. Link, August 30, 1964]
বঙ্গানুবাদ
“তিনি [অবনী] সিঙ্গাপুরের ব্রিটিশ জেল ভেঙে ১৯২০ সালে সোশ্যালিজমের দেশের ভূমিতে প্রথম পা রেখেছিলেন। বাঙলা দেশের অভ্যুত্থানে যোগ দেওয়ার কারণে তিনি সিঙ্গাপুরে কারাজীবন কাটাচ্ছিলেন। জেল ভেঙে পালাতে গিয়ে তিনি অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপরে সঙ্কটজনক অবস্থায় তাঁকে মাইলের পর মাইল সাঁতার কাটতে হয়েছে। একটি বন্ধুভাবাপন্ন জাহাজের খোলের গা ঘেঁসে তিনি সাঁতার কাটছিলেন যাতে তট হতে বর্ষিত গুলি তাঁর গায়ে না লাগে। তিনি আফগানিস্তান পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন বার্লিনে। সেখানে রাজনীতিক আশ্রিত ব্যক্তি ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছিলেন সোবিয়েৎ ভূমিতে। “
আমার বড় দুঃখ হয় রোজা ফিটিংগোফের জন্য। আশ্চর্য নয় যে অবনী মুখার্জির এই বীরত্বের কাহিনী শুনেই তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু এর একটি কথাও তো সত্য নয়!
দেশবিখ্যাত চিত্রশিল্পী শ্রীঅতুল বসুকে অবনী বলেছেন যে সাঁতার কাটতে কাটতে তিনি একটি ডাচ্ অধিকৃত মনুষ্য বসতিহীন দ্বীপে পৌঁছেছিলেন। সেখানে বানরেরা যে ফল খাচ্ছিল সেই ফল অবনী গাছ থেকে পেড়ে খেতেন।
বার্লিনে অবনী মুখার্জি মানবেন্দ্রনাথ রায়কে বলেছিলেন, সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের প্রত্যয় জন্মেছিল যে কোনো বিপ্লবী দলের সঙ্গে অবনী মুখার্জির কোনো সংস্রব নেই। তাই তাঁকে বাইরে বেড়াতে দেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি একখানি জেলে নৌকার সঙ্গে তাঁর বাইরে বেড়াতে দেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি একখানি জেলে নৌকার সঙ্গে তাঁর পলায়নের বন্দোবস্ত করেছিলেন। জেলে নৌকা তাঁকে একখানি চীনা জাহাজে তুলে দিয়েছিল, আর সেই চীনা জাহাজ তাঁকে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল জাবায়।
১৯২২ সালের শেষাশেষি হতে ১৯২৪ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত অবনী মুখার্জি ভারতে ছিলেন। সেই সময়ে “বিপ্লবী অবনী মুখার্জি” নামক একখানি পুস্তক প্রকাশিত হয়। লেখক ঢাকা-অনুশীলন সমিতির শ্রীরাখালচন্দ্র ঘোষ। অল্পসংখ্যক লোকের ধারণা এই যে পুস্তকখানি অবনী নিজে লিখে রাখাল ঘোষের নামে ছেপেছিলেন। কারণ, রাখাল ঘোষ নিজে লিখলে এই পুস্তকের লেখা আরও ভালো হতো। কত বছর আগে আমি এই বইখানি একবার মাত্র পড়েছিলেম, তা ভালো করে মনেও নেই। শুধু সিঙ্গাপুর হতে অবনীর পলায়নের কাহিনীটি আবছা মনে আছে। অবনী মুখার্জি সমুদ্রে স্নান করছিলেন। দেখলেন পাশ দিয়ে একখানি নৌকা ভেসে যাচ্ছে। তিনি দু’হাতে সেই নৌকার তলা চেপে ধরলেন এবং নৌকার সঙ্গে ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন! এই খবরটি যাচাই করার জন্যে আমি অধ্যাপক রাখালচন্দ্র বন্ধুকে৮ পাঠিয়েছিলেম। তিনি গিয়েই শুনলেন যে ক’দিন আগে শ্রীঘোষ হঠাৎ মারা গেছেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও আমি “বিপ্লবী অবনী মুখার্জি” বইখানি জোগাড় করতে পারিনি।
অবনী মুখার্জি অবলীলাক্রমে মিথ্যা কথা বলে যেতেন। মিথ্যা তাঁর জিহ্বার ডগায় এমন স্বাভাবিকভাবে এসে যেত যে তিনি হয়তো বুঝতেই পারতেন না যে তিনি মিথ্যা বলছেন। তাঁর বিষয়ে দেওয়া তথ্যগুলিই আমার এই মন্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
সিঙ্গাপুর হতে তাঁর পলায়নের কাহিনীর কিছু কিছু আমি উপরে উল্লেখ করেছি। তিনি বার্লিনে এম. এন. রায়কে বলেছিলেন যে বানারসের শিবপ্রসাদ গুপ্তকে রাসবিহারী বসু জাপানে ডেকে পাঠাচ্ছিলেন। এখানে গুপ্তকে জাপানে ডেকে পাঠানোর কথা একেবাইে সত্য নয়। রায়কে সন তারিখের কথা তিনি যা বলেছিলেন সে সবও মিথ্যা। শিবপ্রসাদ গুপ্ত ধনী লোক ছিলেন। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই তিনি বিশ্ব-ভ্রমণে বার হয়েছিলেন। যুক্ত প্রদেশের (উত্তর প্রদেশের) পণ্ডিত সুরেন্দ্রনারায়ণ শর্মাকে তাঁর বাড়ীর লোকেরা তাঁর সঙ্গে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারও তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা ইউরোপ ও আমেরিকার ভ্রমণ শেষ করে জাপানে এসেছিলেন। জাপানের পরে তাঁরা কোরিয়া ও চীন ভ্রমণ করেন। শাংহাইতে তাঁদের ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটে। বিনয়কুমার সরকার শাংহাইতেই থেকে গেলেন। অন্য ব্যক্তি আমেরিকা হতেই দেশে ফিরে এসেছিলেন। শিবপ্রসাদ গুপ্ত একাই দেশে ফিরছিলেন। পথে জাহাজে তাঁকে গিরেস্তার করে সিঙ্গাপুরের ফোর্ট ক্যানিং দুর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ ভারতে অনুসন্ধান করে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট না পেয়ে ১৯১৬ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে তাঁর ওপর হতে সমস্ত অর্ডার তুলে নিলেন। চার- পাঁচ দিনের ভিতরে তাঁকে জাহাজে স্থানও জোগাড় করে দেওয়া হয়। তিনি দেশে ফিরে আসেন। হিন্দীতে লেখা বিশ্ব-ভ্রমণ সম্বন্ধে তাঁর বিরাট গ্রন্থে এসব কথা লেখা আছে। গুপ্ত লিখেছেন ফোর্ট ক্যানিং-এ আরও ক’জন ভারতীয় বন্দীকে তিনি দেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। অবনী মুখার্জির নামোল্লেখ তাঁর গ্রন্থে নেই। সিঙ্গাপুরে তিনি তিন মাস বন্দী ছিলেন। জাপানে আড়াই মাস এবং কোরিয়া ও চীনে দুই মাস তিনি ভ্রমণ করেছিলেন।
[28. অধ্যাপক শান্তিময় রায়।]
অবনী মুখার্জি এম. এন. রায়কে বলেছিলেন যে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে তিনি জার্মানীতে পড়াশুনা করছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া মাত্রই তিনি ওই দেশ হতে পালিয়ে যান। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করতে করতে তিনি ১৯১৬ সালে জাপানে পৌঁছান। তার পরের বছরের (১৯১৭ সালের) মাঝামাঝি সময়ে রোসবিহারী বসুর সাহায্যে শিবপ্রসাদ গুপ্তের সঙ্গে তিনি দেশে ফিরছিলেন, পথে গিরেফতার হয়ে সিঙ্গাপুরে ফোর্ট ক্যানিং-এ বন্দী হন। অবনী মুখার্জির এ বিবৃতিও সত্য নয়। আমি যা যা ওপরে লিখেছি সে সবচ হতে প্রমাণ হয়ে যাবে যে কথাগুলি তিনি বানিয়ে বলেছেন। পি. উন্নিকৃষ্ণান সম্ভবত অবনীর স্ত্রীর নিকট শুনে লিখেছেন, অবনী তো কোনোদিন আমেরিকা যাননি। এটা এম. এন. রায়ের মনগড়া। কিন্তু অবনী আমেরিকা যাওয়ার কথা বহু লোককে বলেছেন। চিত্রশিল্পী শ্রীঅতুল বসুকে বলেছেন, তাঁর অগ্রজ পবিত্র বসুর সঙ্গে আমেরিকায় অবনীর পরিচয় ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা জার্মানীর দিকেই ছুটেছিলেন। আর, তিনি “বিপ্লবী অবনী মুখার্জি” হয়ে কিনা জার্মানী হতে পালিয়ে গেলেন! ১৯১৫ সালের ১৭ই মে তারিখে তিনি জাপানে পৌঁছেছিলেন। মাত্র চার মাস সেখানে ছিলেন। ১৯১৫ সালের ১ শে সেপ্টেম্বর তারিখে অবনী মুখার্জি ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাংহাই হতে সিঙ্গাপুর রওয়ানা হয়েছিলেন।
১৯১৫ সালের ১৩ই অক্টোবর তারিখে সিঙ্গাপুরের ফোর্ট ক্যানিং-এ কোঠাওয়ালার নিকটে তিনি প্রথম বিবৃতি দিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি ফোর্ট ক্যানিং-এ কোঠাওয়ালার নিকটে তাঁর দ্বিতীয় বিবৃতিও দিয়েছিলেন।
অবনীকে রায়ের প্রশ্রয়
১৯২০ সালে এম. এন. রায়ের সঙ্গে দেখা করার আগে অবনী মুখার্জি বার্লিনে পুরানো ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের নিকটে তিনি স্বীকার করেছেন যে সিঙ্গাপুরে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দিয়েছেন এই বিবৃতি না দিলে তাঁর ও শিবপ্রসাদ গুপ্তের ফাঁসি হয়ে যেত। কেন ফাঁসি হতো তা অবনী কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারেননি। যে-লোক ধরা পড়তে না পড়তেই সব কথা ফাঁস করে দেন তাঁর আবার ফাঁসি কেন হবে? আর, শিবপ্রসাদ গুপ্তের সঙ্গে অবনীর কিসের সম্পর্ক? তিনি অবনীর সহযাত্রী ছিলেন না। বার্লিনের ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা এম. এন. রায়কে অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলেন, একথাও তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে অবনী সিঙ্গাপুরে স্বীকারোক্তি দিয়ে এসেছেন। তা সত্ত্বেও রায় অবনীকে প্রশয় দিয়েছিলেন। এ প্রশ্রয় যদি তিনি না দিতেন তা হলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে অবনী কিছুতেই স্থান পেতেন না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে একটা দলাদলির মনোভাব হতেই তিনি অবনীকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।
অবনী মুখার্জি সিঙ্গাপুরে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দিয়ে এসেছেন একথা শোনার পরে তাঁর মনে কেন যে প্রশ্ন জাগল না তা বোঝা মুশকিল। যাঁদের বিরুদ্ধে অবনী বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁদের একজন, –ভগবান সিং-এর সঙ্গে এম. এন. রায়ের সেই সময়ে চীনে দেখা হয়েছিল। তিনি রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। রায় তাঁর সঙ্গে সাতদিন একত্রে জাহাজে ছিলেন। তিনি আশাভঙ্গ হয়ে আমেরিকা ফিরে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্য নয় যে এ আশাভঙ্গের কারণ ছিল অবনীর বিবৃতি। যে সব কথা রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন সে সব কথা হতেই তাঁর মনে অবনী সম্পর্কে প্রশ্ন উদয় হওয়া উচিত ছিল। এ সম্বন্ধে যে কৈফিয়ৎ তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় দিয়েছেন তা গণ্য করার মতো নয়।
হল্যান্ডের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার এ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রুটগের্সের নামে একখানি পত্র নিয়ে অবনী মুখার্জি ইন্দোনেশিয়া হতে পশ্চিম ইউরোপে এসেছিলেন। পত্রের লেখক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি না হলে তিনি কখনও রুটগের্সকে পত্র লিখতেন না। তিনি যে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তা এই থেকেও বোঝা যায় যে তিনি অবনী মুখার্জিকে একখানি ডাচ্ পাসপোর্টও পাইয়ে দিয়েছিলেন। এই পাসপোর্টে অবনীর নাম ছিল ডক্টর আর. শাহীর। হল্যান্ডে কমরেডরা নিশ্চয় অবনীর পাসপোর্টের কথা জানতেন। কিন্তু তিনি একথা মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অন্য সব ভারতীয়ের নিকট হতে গোপন রেখেছিলেন। তিনি ভারতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তিকে বলেছেন যে এক ভদ্রলোকের মালয় চাকর সেজে তিনি হল্যান্ডে এসেছেন। এম. এন. রায়কে তিনি বলেছেন যে জাহাজে স্টুয়ার্ডের চাকরী ক’রে তিনি হল্যান্ডে এসেছেন। কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে ‘ডক্টর’ কথাটা জোড়া আছে। ‘ডক্টর’ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী। ১৯২০ সালে ইন্দোনেশিয়ার কোনো ‘ডক্টর’ কি মালয় চাকরের কিংবা স্টুয়ার্ডের কাজ করতেন? এখানে নলিনী গুপ্তের সঙ্গ অবনী মুখার্জির চমৎকার মিল আছে। নলিনীর নিকটে ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল। সে পুলিসের নিকটে ছাড়া আর কারুর নিকটে তা ব্যক্ত করেনি। আশ্চর্য এই যে পুলিসের ইনটেলিজেন্স বিভাগ সত্ত্বেও লিখেছে যে নলিনী গুপ্ত জাহাজে চাকরি ক’রে ভারতে এসেছিল। আর, ডক্টর শাহীর তাঁর ডাচ্ পাসপোর্ট ব্যবহার করেই ১৯২২ সালে ভারতে এসেছিলেন। আবার এই ডাচ্ পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তিনি ১৯২৪ সালে জার্মানী ফিরে গিয়েছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি যে এশিয়ার সবচেয়ে পুরানো পার্টি একথা আমরা জানি। ১৯২০ সালের ২৩ শে মে তারিখে এই পার্টি স্থাপিত হয়েছিল। আরও আগে হতে তুর্কিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এবং তুর্কিস্তানও এশিয়ায় অবস্থিত। কিন্তু তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সোবিয়েৎ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির একটা সম্প্রসারণ মাত্র। তাই এশিয়ার প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি হওয়ার গৌরব ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিরই প্রাপ্য। শুধু কি তাই? সমগ্র এশিয়ার মধ্যে মার্কসবাদী আন্দোলনও সর্বপ্রথমে ইন্দোনেশিয়াতেই আরম্ভ হয়েছিল। এ ব্যাপারে পরোক্ষভাবেও এশিয়ার অন্য দেশের দাবী নেই। ওপরে আমি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা রুটগের্সের নাম করেছি। ইন্দোনেশিয়া ভারত মহাসাগরের বুকে কয়েক হাজার দ্বীপের সমষ্টি। এটা সাম্রাজ্যবাদী ডাচের উপনিবেশ ছিল। এই শতাব্দীর শুরুতে চাকরী নিয়ে রুটগের্স ইন্দোনেশিয়ায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও শাসনের কি ফল ইন্দোনেশিয়ার ফলেছে! তারই প্রভাবে দেশে ফিরে এসেই তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। তাঁর মুখে ইন্দোনেশিয়ার শোচনীয় বিবরণ শুনে ১৯১৩ সালে একটি ব্যবসায়িক সমিতির চাকরী নিয়ে আর একজন ডাচ্ হল্যান্ড হতে সে দেশে গেলেন। এই লোকটিই হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায় মার্কসবাদী আন্দোলনের জনক। ১৯১৩ সালে তিনিই সে দেশে প্রথম মার্কসবাদী আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর নাম এইচ. জে. এফ. এম. সীবলিয়েট। (H.J.F.M. Sneevliet)। তিনি ছিলেন ১৯০৯ সালে স্থাপিত ডাচ্ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিকলেবর পার্টির একজন সভ্য। ১৯১৮ সালে এই পার্টির নাম হয় হল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি (The Communist Party of Holland)। “ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিজম : এ হিস্টরি” নামক ইংরেজি পুস্তকের লেখক আনর্ল্ড সি.ব্যাকম্যান ( Arnold C. Brackman) লিখেছেন ১৯৩৫ সালে হল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির নাম পরিবর্তিত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি নেদারল্যান্ডস (The Communist Party of Netherlands) হয়েছিল। তিনি বলছেন ইন্দোনেশিয়াসহ সমস্ত ডাচ্ সাম্রাজ্যকে পার্টির ভিতরে আনার জন্যে নামের এই পরিবর্তন করা হয়েছিল।
১৯১৩ সালে স্নীলিয়েট উত্তর জাবার সেমারাং বন্দরে (পোর্টে) চাকরী নিয়ে এলেন। তাঁর উদ্দেশ্য তো মার্কসবাদী চিন্তাধারার প্রচার ছিলই, এসেই তিনি বুঝতে পারলেন না যে ইন্দোনেশিয়া তাঁর কাজের পক্ষে একটি উর্বর ক্ষেত্র। সেখানে তিনি কিছু সংখ্যক ডাচ্ বামপন্থী সোশ্যালিস্টদের পেলেন যাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় শোষণ ও শাসনের নগ্ন মূর্তি দেখে মার্কসবাদ প্রচারের জন্যে অধীর হয়ে উঠেছিলেন। শীবলিয়েট তাঁদের সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ শুরু করলেন। ১৯১৪ সালে তিনি জে. এ. ব্রানডস্টেডের[২৯] (J. A. Brandsteder). এইচ. ডব্লিউ. ডেকের (H. W. Dekker), ও পি. বেরমা (P. Bergsma) এবং অন্যান্য বামপন্থী সোশ্যালিস্টদের একটি সংগঠন তৈয়ার করলেন। তার নাম তাঁরা দিলেন ইন্দোনেশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক এসোসিয়েশন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটাই ছিল প্রথম মার্কসবাদী সংগঠন। ১৯১৪ সালে “মুক্ত দুনিয়া” (The Free World) নাম দিয়ে তাঁরা একখানা কাগজও বা’র করলেন। ১৯১৭ সালে সীবলিয়েট দু’জন ইন্দোনেশিয়াবাসীকে তাঁদের সংগঠনের ভিতরে আনলেন। তাঁদের মধ্যে সেমাউন ছিলেন শারেকাত ইস্লামের (শিরকাৎ-ই- ইস্লামের) সেমারাং অধ্যায়ের প্রধান নেতা। দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন উদীয়মান সাংবাদিক দর্শনো। শারেকাত ইস্লামের সভ্য থেকেও এই দু’জন ইন্দোনেশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক এসোসিয়েশনের সভ্য হলেন। পশ্চিমের বিপ্লবী মার্কসবাদের সঙ্গে ইন্দোনেশীয় জনগণের সংযোগের প্রথম সেতু হলে সেমাউন ও দর্শনো।
[29. ১৯২২-২৩ সালে Brandsteder আমস্টারডামে আমাদের পোস্টবক্স ছিলেন। তাঁর ঠিকানায় আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক চিঠিপত্রগুলি পাঠাতাম। তিনিও আমাদের পত্রাদি মাঝে মাঝে ডাকে দিতেন। আমার মনে পড়ে তখন আমরা AJ Brandster লিখতাম। হতে পারে জে. এ. গ্লান্ডস্টেডের ও এ. জে. গ্লান্ডসেন্টেডের এক ব্যক্তি নন। (লেখক)]
সীবলিয়েটের কর্মধারা উচ্চ হতে উচ্চতর স্তরে যখন পৌঁছাতে লাগল তখন তা ডাচ্ পলিটিকাল ইনটেলিজেন্স সার্বিসের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার ফলে ১৯১৮ সালে শীবলিয়েট ইন্দোনেশিয়া হতে বহিষ্কৃত করা হলো, আর ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সমস্ত ডাচ্ বামপন্থী সোশ্যালিস্টকে ইন্দোনেশিয়া ছাড়তে হলো। ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে গভীর গুরুত্বসহকারে সীবলিয়েট লেনিনের কলোনিয়েল থিসিসের আলোচনা করেছিলেন। কলোনি সম্বন্ধে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল এবং তাঁর আলোচনায় লেনিন নিজেকে উপকৃতও মনে করেছিলেন। খুব আশ্চর্য হওয়ার কথা এই যে এই শীবলিয়েটই পরে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ছেড়ে দিয়ে ট্রট্স্কিপন্থী হয়েছিলেন। তখন তিনি লেখায় তাঁর কল্পিত মারিং (Marring) নামটি ব্যবহার করতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিট্লার ফ্যাসিস্টরা যখন হল্যান্ড দখল করেছিল সেই সময়ে তারা সীবলিয়েটকে গুলি ক’রে হত্যা করে।
অবনী মুখার্জি রুটগের্সের নামে ইন্দোনেশিয়ার কোনো কমিউনিস্টের নিকট হতে যে পত্র নিয়ে এসেছিলেন সেই পত্রকে রুটগের্স অনেক বেশী মূল্য দিয়েছিলেন। কি কারণে তিনি এ পত্রের এত বেশী মূল্য দিলেন তা বোঝাবার জন্যে এখানে আমি ইন্দোনেশিয়ার আন্দোলন সম্বন্ধে এত কথা বললাম।
অবনী মুখার্জির কাজ কর্ম হতে আমরা বুঝতে পারি যে তাঁর লোক পটাবার বিশেষ ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ ক’রে তিনি বাটাভিয়ার (জাকার্তার) কমিউনিস্টদের নিকট হতে রুটগের্সের নামে শুধু একখানি পত্রই সংগ্রহ করেননি, তাঁদের মারফতে তিনি একখানি পাসপোর্টও জোগাড় করেছিলেন। ডক্টর আর শাহীর নামের এই পাসপোর্টে তাঁকে ১৯২৪ সালেও ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
১৯২০ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় চেকা অবনী মুখার্জিকে গিরেফতার করতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় বলে লেনিন তখন অবনী মুখার্জিকে গিরেফতার হতে দেননি। কিন্তু মুখার্জি যদি সেই দিনই চেকার পিটারের দ্বারা গিরেফতার হতেন তবে সম্ভবত দু’চার দিনের ভিতরেই তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে যেত। সিঙ্গাপুর হতে যে-ভীতি তাঁকে ভারতবর্ষে যাওয়ার চেষ্টা হ’তে বিরত করেছিল সেই ভীতিই আবার মস্কোতে জগদ্দল পাথর হয়ে তাঁর বুকের ভিতরটা চেপে ধরল। বিদেশ হতে পরিচয়পত্র এনে পেট্রোগাড ও মস্কোর কয়েকটি বিপ্লব ও সোবিয়েৎ-বিরোধী অভিজাত পরিবারের সঙ্গে অবনী মুখার্জি দেখা করেছিলেন। এর কি প্রয়োজন ছিল তা তিনি কাউকে বোঝাতে পারেননি। সে-যাত্রা তাঁর জীবন বেঁচে গিয়েছিল বটে, কিন্তু চেকার রিপোর্টটা তাঁর নামীয় ফাইলে শামিল হয়েই থাকল।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে অবনী মুখার্জিকে বাকুতে অধিষ্ঠিত প্রাচ্য দেশীয় জনগণের কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছিল। ১৯২০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হ’তে ৮ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলেছিল। বাকু হতে অবনী মুখার্জি তাশখন্দে এসে এম. এন. রায় ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে তাশখন্দে এম. এন. রায়ের উদ্যোগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল। অবনী মুখার্জি ও তাঁর রুশ স্ত্রী রোজা ফিটিংগোফ্ পার্টির সংস্থাপক সভ্যদের মধ্যে ছিলেন।
১৯২১ সালে তাশকন্দের সব কিছু তুলে দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা ও ভারতীয় ছাত্ররা মস্কো চলে আসেন এবং মস্কোই তখন তাঁদের হেড কোয়ার্টার্সে পরিণত হয়। ইতোমধ্যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় ন্যাশনলিস্ট বিপ্লবীদের একটি দল জার্মানী হতে মস্কো পৌঁছে গিয়েছিলেন। গুলাম আম্বিয়া খান লুহানী ছিলেন চট্টোপাধ্যায়ের প্রবক্তা। ১৯১৫-১৬ সালে সিঙ্গাপুরে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের নিকটে অবনী মুখার্জি যে স্বীকারোক্তি করেছিলেন সেকথা তিনি বার্লিনে এই ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের নিকটে স্বীকার করেছিলেন। আমার বিশ্বাস, তাঁরা স্বাধীনভাবেও এ খবরটি পেয়ে গিয়েছিলেন। মস্কোতে মানবেন্দ্রনাথই ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তাঁর আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে অবনী মুখার্জি যে মোড়লি শুরু করে দিয়েছিলেন সেটা ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের নিকটে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তাই তারা অবনী মুখার্জিকেই প্রথম আক্রমণের ভিতর দিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে আক্রমণ করেছিলেন। চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী আগ্নেশ স্মেডলিকে মুখার্জি কি একটা কুৎসিত আক্রমণ করেছিলেন। তাতে চট্টোপাধ্যায় মুখার্জিকে মারতে যান। অন্যরা কোন রকমে থামিয়ে দেন। ন্যাশনালিস্টরা বলেন যে অবনী মুখার্জির সিঙ্গাপুরের বিবৃতির ফলে ভারতে অনেকে জেলে গেছেন। অনেকের ফাঁসিও হয়েছে। ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের “অপ্রকাশিথ রাজনীতিক ইতিহাস” (নূতন সংস্করণ, ১৯৫৩) হতেই মোটামুটি এ খবরগুলি নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন :
“এই সময়ে অবনী মুখোপাধ্যায়ের উৎপাতে বার্লিনাগত দল অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। সে তাহাদের বদনাম করিয়া বেড়াইত এবং আরও নানা রকমের উৎপাত করিত। এইরূপ করিয়াই সে পার্টি পলিটিক্স চালাইত। শেষে উত্যক্ত হইয়া চট্টোপাধ্যায়, লোহানী প্রভৃতি ভে, চে, কার (Ve, Che, Ka) কর্মকর্তা মোগিলস্কিকে এক দরখাস্ত পাঠাতে চায় যে, অবনী মুখার্জি যে সকল কাজ করিতেছে, তাহাতে মনে হয় যেন সে একজন গোয়েন্দা (Acting as ifn an agent-provocateur) সেইজন্য তাহাকে মস্কো হইতে সরাইয়া দেওয়া হউক। লেখক চট্টোপাধ্যায়ের বাক্যজালে বাধ্য হইয়া সেই দরখাস্তে সহিত করেন। *** ব্যাপারটা পরে বুঝিলাম, মুখোপাধ্যায় বিদেশীয় ডেলিগেটদের কাছে বলিয়া বেড়াইতেন, বার্লিনের বৈপ্লবিকেরা জার্মান এজেন্ট। তাহারা জার্মান গবর্নমেন্টের পক্ষে কাজ করিত। তাহারা কমিউনিস্ট নহে—ইত্যাদি। ইহা ছাড়া, আর অনেক রকমের খুনশুড়ি করিত।” (পৃষ্ঠা ২৮৪ )
“দরখাস্ত পাঠাইতে চায়” নহে, সত্য সত্যই দরখাস্ত তাঁর পাঠিয়েছিলেন এবং ডক্টর দত্ত যে ভাষায় দরখাস্ত পাঠানোর কথা বলেছেন তার চেয়ে অনেক বেশী উগ্র ছিল তাঁদের ভাষা। এম. এন. রায় অবনীকে বাঁচিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন যে কড়া নজরের ভিতরে অবনীকে মস্কোতে রেখে দেওয়া হোক। কিন্তু এই সংক্রান্ত কাগজপত্র অবনী মুখার্জির নামে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মুহাফিজখানায় (আরকাইবসে) নথিভুক্ত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে আরকাইবসে অবনী মুখার্জির ফাইল হ’তে এই কাগজগুল এবং আরও অনেক এই ধরণের কাগজপত্র নিশ্চয়ই ঘুমন্ত অবস্থা হ’তে মাথা তুলে থাকবে। ১৯৩৭ সালেই সোবিয়েৎ ইউনিয়নে অবনী মুখার্জির মৃত্যুদণ্ড হয়।
একটি কথা মনে রাখতে হবে যে অবনী মুখার্জির সিঙ্গাপুর হতে পলায়ন মনকে চোখঠারা মাত্র। সিঙ্গাপুরের মিলিটারি কর্তৃপক্ষ তাতে কোনো বাধা দেননি। তিনি প্যারোলে মুক্ত ছিলেন। সেই অবস্থায় জাবায় পালিয়ে যান। যদি আর্মি কর্তৃপক্ষের সাহায্যে তিনি ভারতে আসতেন তবে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা তাঁর উপরে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এই ভয় তাঁর মনে ছিল।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানুষের চেহারা মনে রাখার অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি ছিল। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলামিশা করেছেন তাঁরা এই কথা ব’লে থাকেন। কিন্তু আমরা যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, অথচ মিলামিশা করিনি, আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে ঘটনা ঘটার সময় তিনি মনে রাখতে পারতেন না। এই বিষয়ে পাটীগণিতের ওপরে তাঁর খুব অবজ্ঞা ছিল। তাঁর স্মৃতিকথার ৪৭৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন : “I was surprised that Mukherjee had left Moscow just before the Third world Congress, and that he willingly agreed to stay away. I came to know the reason as soon I returned to Moscow” অর্থাৎ আমি শুনে স্তম্ভিত হলাম যে তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের আগেই মুখার্জি মস্কো ছেড়ে চলে গেছেন এবং তিনি ইচ্ছাপূর্বক সরে থাকতে রাজী হয়েছেন। মস্কো ফিরে আসা মাত্রই আমি কারণটা জেনেছিলাম। এর পর রায় বলতে চেয়েছেন যে জার্মানী হতে ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা এসে পড়াতেই অবনী মুখার্জি সরে পড়েছিলেন। রায় তাশকন্দ হতে মস্কো ফেরার আগে ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা মস্কো পৌঁছেছিলেন একথা সত্য, কিন্তু অবনী মস্কো ফিরেছিলেন রায়ের পরে। ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে অবনীর মস্কোতে দেখা হয়েছে। অবনীর ব্যবহারে উত্যক্ত হয়েই যে ন্যাশনালিস্টরা তাঁর বিরুদ্ধে চেকার নিকটে নালিশ করেছিলেন, একথা ভূপেন্দ্ৰনাথ দত্ত লিখেছেন। রায়ও তাঁর স্মৃতিকথার ৪৯০ পৃষ্ঠায় একথার উল্লেখ করেছেন।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশন ১৯২১ সালের ২২শে জুন হতে ১১ই জুলাই পর্যন্ত মস্কোতে বসেছিল। এর আগে কি ক’রে অবনী মস্কো হতে চলে যেতে পারেন? অবনীর নিকটে এই কংগ্রেসের ডেলিগেটের অনুজ্ঞা পত্র ছিল। তাতে লেখা ছিল যে অবনী এডভাইসরী ভোটের অধিকারী। এই অনুজ্ঞা পত্রে তারিখ দেওয়া ছিল ২১শে জুন, ১৯২১। ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেঃ কর্নেল কে’ (Lt. Col. C. Kaye) অবনীর বিষয়ে তাঁর ওপরওয়ালার নিকটে মন্তব্য পেশ করতে গিয়ে লিখেছেন যে এই ডেলিগেট কার্ডের ফটো কপি তাঁর নিকটে আছে। ১৯২২ সালের শেষভাগে ভারতে এসে রায় ও আমাদের বিরুদ্ধে অবনী তাঁর এই অনুজ্ঞাপত্র ব্যবহার করেছিলেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমদাবাদে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ষটত্রিংশত্তম অধিবেশন হয়েছিল। এই অধিবেশনের প্রতিনিধিগণের নামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইশতেহার বিতরিত হয়েছিল। তাতে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জির স্বাক্ষর ছিল। রায় লিখেছেন ইতিহারখানি মস্কোতে রচিত ও মুদ্রিত হয়েছিল। নিশ্চয় তা তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশনের আগে রচিত ও মুদ্রিত হয়নি। রায়ের কথানুসারে তাঁর ইংরেজী পুস্তক India in Transition (ইন্ডিয়া ইন্ ট্রানজিশন) মস্কোতে রচিত হয়েছিল। রায় লিখেছেন লেনিন তার পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। পুস্তকখানি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল পশ্চিম ইউরোপে। তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের পরেই পুস্তকখানি রচিত হয়েছিল। রায় বলেছেন সন্দেহের ছায়ায় বসে বসে (নিশ্চয় তৃতীয় কংগ্রেসের পরে মস্কোতে) অবনী মুখার্জির অলস দিনগুলি কাটছিল। রায় তাঁকে তাঁর পুস্তকের জন্যে পরিসংখ্যান ও তথ্য সংগ্রহ ক’রে দিতে বলেন। পরম উৎসাহের সহিত অবনী এই কাজটি করেছিলেন। রায় বলেছেন সম্পূর্ণরূপে অবনীর সংগৃহীত মাল-মসলার ওপরে ভিত্তি করেই তিনি তাঁর পুস্তকের প্রথম অধ্যায়, “The Rise of the Bourgeoisie” (ধনিক শ্রেণীর অভ্যুদয়) লিখেছিলেন। কিন্তু এই পরিসংখ্যান ও তথ্যগুলি কোথা হ’তে সংগ্রহ করা হয়েছে তার কোনো উল্লেখ পুস্তকে নেই। এদিকে পুস্তকের মলাটে লিখে দেওয়া হলো “by M.N. Roy with the collaboration of abani Mukherji” (অবনী মুখার্জির সহযোগিতায় এম. এন. রায় প্রণীত)। তিনি পরিসংখ্যান ও তথ্যের কোনো যাচাই না করেই বইখানি ছেপেছিলেন। পরে ধরা পড়ল যে অবনী মুখার্জির সংগৃহীত পরিসংখ্যান ও তথ্যগুলি ভুলে ভরা। “ইন্ডিয়া ইন্ ট্রানজিশনে’র ভূমিকার তারিখ দেওয়া হয়েছিল “মার্চ, ১৯২২”। যদি ধরেও নিই যে অবনী মুখার্জি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের ‘ডেলিগেট ম্যানডেট’ জাল করেছিলেন তবে তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের পরের ঘটনাগুলির (আমদাবাদ কংগ্রেসের ইতিহার প্রকাশ ও “ইন্ডিয়া ইন্ ট্রান্ইজিশনের”র লেখা ইত্যাদি। সম্বন্ধে আমরা কি বলব? এই ঘটনাগুলি তো সত্যই ঘটেছিল। আমরা আরও দেখেছি যে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এম. এন. রায় অবনী মুখার্জিকে সঙ্গে নিয়ে মস্কোর আফগান দূতাবাসে অসুস্থ রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে দেখতে গিয়েছিলেন।
১৯২৪ সালে ভারতবর্ষ হ’তে বার্লিনে ফিরে এসে অবনী মুখার্জি ব্রিটিশ লেবর গবর্নমেন্টের প্রাইম মিনিস্টার র্যামেজ ম্যাকডোনাল্ডের নিকটে অতীতে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা ক’রে স্ত্রী-পুত্রসহ ভারতে ফেরার অনুমতি চেয়ে একখানা দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, যে কোনো প্রকারের মুচলিকায় তিনি সই করতে রাজী আছেন। সেই সময়ে তিনি জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এম. বের্গেরের (M.Berger) নিকটে এক বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি অবনীর দরখাস্তের সহিত ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের দফতরে দাখিল করা হয়েছিল। ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তা ভারত গবর্নমেন্টের নিকটে পাঠিয়েছিলেন। এখন এই সব কিছুই ভারতের ন্যাশনাল আরকাইবসে সুরক্ষিত আছে। অবনীর সিঙ্গাপুরের স্বীকারোক্তি দু’টিও ন্যাশনাল আরকাইবসে রয়েছে। অবনীর এই বিবৃতিতে তিনি বলেছেন :
“… আমার লুকানো স্থান হতে ১৯২০ সালে আমি বা’র হয়ে আসি এবং রাশিয়ায় যাই। সেখানে আমি ভারতের প্রতিনিধিরূপে থার্ড ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দিই। আমি পুরো দু’বছর রাশিয়ায় বাস করেছি এবং সকল কংগ্রেস ও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছি।” (“I lived in Russia for full two years and took parts in all the congresses and conferences.”)
“কিন্তু ১৯২২ সালের প্রথম ভাগ হতে ইন্টারন্যাশনালের সহিত আমার নীতিগত পার্থক্য শুরু হয়। ক্রমে ক্রমে ইন্টারন্যাশনাল একটি উপদলের বিন্যস্ত স্বার্থের নিকটে আত্মসর্পণ করতে থাকে। নিজের মূল নীতি ত্যাগ ক’রে ইন্টারন্যাশনাল, এই উপদলের নীতিকেই নিজের নীতি করে নেয়। এর ফলে তার এই তথাকথিত নীতিকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় এবং নিজেদের বিক্রয় করতে রাজী না হওয়ায় আমি আলাদা হয়ে যাই। এই সময়ে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে আমি রাশিয়া ত্যাগ করি।” [“ But from the first part of 1922 I began to differ with international in principle as it more and more scumbed (succumbed?”) before the vested interested of a group rather Clik (Clique?) and replaced original principles for the interests of that body. Consequently due to my fefusal to accept that so called principle and to sell ourselves I was isolated ant I left Russia to proceed to India.”]
এভাবে অবনী মুখার্জি যখন বার্লিনে ফিরে গেলেন তখন বার্লিনের বাশিন্দা ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা আনন্দে বিহ্বল হয়ে তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন। এই অবনীকেই তাঁরা মস্কোতে চেকার হতে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে তো ছিল ১৯২১ সালের কথা। ১৯২২ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায় অবনী মুখার্জির শত্রুতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। আর, রায় যদি অবনীর শত্রু হন তবে তিনি তো ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের মিত্র না হয়েই পারেন না। রায়ই হচ্ছেন নির্বাসিত ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের পথের কাঁটা। তাঁকে ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে উৎখাত করতে না পারলে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হ’তে তাঁরা টাকা পেতে পারেন না। নির্বাসিত বিপ্লবীদের টাকা একান্তভাবে চাই। তাঁরাই হলেন আদি ও অকৃত্রিম বিপ্লবী। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়তে হয় তাঁরাই গড়বেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর পুস্তকের ৩০২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : “যাঁহারা মস্কোতে নিজেদের কম্যুনিস্ট মতাবলম্বী বলিয়াছিলেন, তাঁহারা একত্রিত হইয়া একটি কম্যুনিস্ট পার্টি স্থাপন করেন। ইহার সভ্য হইয়াছিলেন লেখক, শ্রীবীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, আবদুল ওয়াহেদ, সুরেন্দ্রনাথ কর এবং ডাঃ হেমেন্দ্রনাথ ঘোষ”। কেউ জানেন না বার্লিনের এই কমিউনিস্ট পার্টি কোথায় গেল এবং এই পার্টির সভ্যরা ভারতে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কি কাজ করেছিলেন।
১৯২২ সালের কোনো সময়ে বারাকতুল্লাহ বার্লিনে এলেন। তিনি নির্বাসিত বিপ্লবীদের নিয়ে একটি পার্টি গঠন করার চেষ্টা শুরু করলেন। এই সময়ে এম. এন. রায় বার্লিনে ছিলেন। আমরা ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট হতে জানতে পাই যে রায় বার্লিনে ছিলেন। আমরা ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট হতে জানতে পাই যে রায় এই সময়ে বারাকতুল্লার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিজের সঙ্গে আনতে পারলেন না। তিনি ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সহযোগে “ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টি” স্থাপিত হলো ব’লে ঘোষণা প্রকাশ করে দিলেন। তার মানে, আমাদের কাগজের নামের তিন ভাগের দু’ভাগ অংশ তাঁরা আত্মসাৎ ক’রে নিলেন। সকলেই জানেন আমাদের কাগজের নাম ছিল “ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্সেপেন্ডেন্স”। ভারতে পুলিসের নজর অন্যদিকে ফেরাবার জন্যে আমরা সাময়িকভাবে “এডভান্স গার্ড” নামটি তখন ব্যবহার করছিলেম। এই সুযোগ পেয়েই তারা ‘পাইরেসি’র (আত্মসাৎকরণের) কাজটা ক’রে নিলেন। বারাকতুল্লার সঙ্গে চিচারিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তিনি আশা করেছিলেন চিচারিনের মারফতে কাজের জন্য তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে কিছু টাকা আদায় ক’রে নিবেন। কিন্তু চিচারিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তিনি নাকি বলেছিলেন যে চট্টোপাধ্যায়কে পার্টি হতে বাদ দিলে তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এই তথ্যটিও ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের রিপোর্ট হতে নেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য মনে হওয়ায় এখানে উল্লেখ করলাম। চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দফতরের ফাইলটি ক্রমশই স্ফীত হচ্ছিল।
অবনী মুখার্জি বার্লিনে এসেই “ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টি” তে যোগ দিলেন। ভারতের ভিতরে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের যে-সব লোকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল তাঁদের সকলের ঠিকানা তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। বার্লিনে এসে তিনি সম্ভবত তাঁদের প্রত্যেককেই চিঠিপত্র লিখতে লাগলেন। আমি প্রতি ডাকেই (তখনকার দিনে সপ্তাহে একবার মাত্র বিদেশী ডাক আসত) কখনো বাঙলায় লেখা, কখনো বা ইংরাজিতে লেখা তাঁর পত্র পেতে লাগলাম। কিছু কিছু সাহিত্যেও, এমন কি এনার্কো সিন্ডিকালিস্টদের কাগজ পর্যন্ত তিনি পাঠাতেন। কোনো পত্রে এম. এন. রায়কে আক্রমণ করতেন না। আমি বুঝতে পারছিলেম না ব্যাপারটা কি? এই জন্যে পত্রগুলি নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করছিলেম। ইতোমধ্যে আমি এম. এন. রায়ের পত্র পেয়ে গেলাম। তিনি আমাদের অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছেন, লিখেছেন, অবনী মুখার্জি পার্টি হতে, অতএব কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ‘র্যাঙ্ক’ (Rank) হতে বহিষ্কৃত। অবনী আমাদের কাজ ভণ্ডুল করার জন্যে ভারতেও আসতে পারেন। এটা ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা।
অবনী মুখার্জির ভারতে আগমন
১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসের কোন এক রাত্রিবেলা আবদুর রজ্জাক খান যখন আমার নিকট হ’তে সে-রাত্রির জন্যে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তিনি আমায় জানালেন যে পরের রাত্রে আমায় একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। কে তিনি জানতে চাইলে খান সাহেব বললেন, তাঁর নাম অবনী মুখার্জি। সেই মুহূর্তেই আমি খান সাহেবকে জানিয়ে দিলাম যে অবনী মুখার্জির সঙ্গে আমি কিছুতেই দেখা করব না। আমি খবর পেয়েছি যে তিনি পার্টি হতে বহিষ্কৃত হয়েছেন। খান সাহেবকেও আমি অনুরোধ করলাম, আপনিও ওই লোকের সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবেন না। তিনি আমাদের আন্দোলনের ক্ষতি করতে এসেছেন। খান সাহেব আমাকে বললেন, তিনি অবনী মুখার্জিকে তাঁর মামাদের একটি খালি বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। যখন তিনি শুনলেন যে আমি আপনার সহকর্মী তখন উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি ব’লে উঠেছিলেন, ‘তবে তো আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি।” খান সাহেব আমায় বললেন, “এখন তো দেখছি তাঁকে হতাশই হতে হবে”।
পরের রাত্রে খান সাহেব অবনী মুখার্জিকে জানিয়ে দিলেন যে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব না। আমি খবর পেয়েছি যে তিনি পার্টি হতে বহিষ্কৃত। শোনা মাত্রই অবনী মুখার্জি ক্রোধ ও উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “আমি মুজফফর আহমদকে দেখে নেব”। এটা অবশ্য আমার আবদুর রজ্জাক খানের মুখে শোনা কথা।
আব্দুর রজ্জাক খানের সঙ্গে অবনী মুখার্জির সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল সন্তোষকুমার মিত্রের মারফতে।
খান সাহেবের মারফতে অবনী যে আমায় “দেখে নিবেন” ব’লে শাসিয়েছিলেন তার সঙ্গে সংসৃষ্ট একটি ঘটনার কথা এখন আমি বলছি।
১৯২২ সালের শেষ ভাগে এবং ১৯২৩ সালের শুরুর দিকে অর্থাভাবের জন্যে আমার কোনো ভাড়াকরা থাকার ঘর ছিল না। আবদুল হালীমেরও ওই অবস্থাই হয়েছিল। আমি তাই হালীমকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদনী ইলাকায় ৩, গুমঘর লেনে আমার ছাত্রদের বাড়ীর বসবার ঘরে রাত্রে শুতে যেতাম। সেখান থেকে একদিন খুব সকালে উঠে পায়ে হেঁটে আমি নারিকেলডাঙ্গা নর্থ রোডে আবদুর রজ্জাক খানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি তখনও ঘুমুচ্ছেন। আমি তাঁকে জাগালাম। চোখ খুলে আমায় তাঁর বিছানায় বসা দেখতে পেয়ে তিনি বালিসের তলা হতে কিছু কাগজ বার করে আমার হাতে দিলেন, আর বললেন, “ দেখুন তো সন্তোষ (সন্তোষকুমার মিত্র) কি দিয়ে গেল।” একথা বলেই তিনি মুখ ধুতে চলে গেলেন। তখন দিনের আলো খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি জানালার ধারে গিয়ে কাগটার ওপরে একবার চোখ বুলালাম। দেখলাম ইংরেজি ভাষায় পেন্সিলে লেখা একটি মুসাবিদা। আমাদের জবর কোষ্ঠীকাটা হয়েছে তাতে। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না যে অবনী মুখার্জি সত্যই আমায় দেখে নিচ্ছেন। এর মধ্যে খান সাহেব মুখ ধুয়ে ফিরে এসে বললেন, “চারটা কিংবা সাড়ে চারটার সময় সন্তোষ মিত্র এসে আমায় এই মুসাবিদা ও কিছু উপদেশ দিয়ে গেছে। বলেছে আমি যেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটির বেশ কয়েকখানা ছাপানো লেটার পেপার চুরি করি, ও পত্রের মুসাবিদাখানা তাতে টাইপ করাই এবং মুসাবিদায় দেওয়া বিদেশের বিভিন্ন ঠিকানায় চিঠিগুলি যেন আমি পাঠিয়েও দিই।” আমার সঙ্গে যে আব্দুর রজ্জাক খানের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা আছে কথা সন্তোষ মিত্র জানতেন। অন্তত, শিশির কুমার ঘোষের নিকট হতে তা শুনেছিলেন তিনি। আমি যে অবনী মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে রাজী হইনি একথাও তিনি শুনেছেন। কারণ, তিনি তো খান সাহেবের সঙ্গে অবনীর পরিচয় ছিল না। অবনী মুখার্জির সঙ্গে মিলিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে জালিয়াতির ষড়যন্ত্র তিনি অবাধে করতে পারতেন। মনে করেছিলেন তাতেই তাঁর লাভ বেশী হবে। কিন্তু কোন সাহসে এমন একটা জঘন্য জালিয়াতি কাজের সাথী আবদুর রজ্জাক খানকে করতে যাচ্ছিলেন তা আমি কখনও বুঝতে পারিনি। তাদের এই ষড়যন্ত্র তো ব্যক্তি মুজফফর আমদের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল আমরা যে ছোট্ট আন্দোলনটি গড়ছিলাম তার বিরুদ্ধেও। এবং আবদুর রজ্জাক খান ছিলেন আমাদের আন্দোলনের একজন সংগঠক। আমি খান সাহেবকে বললাম, পেন্সিলের লেখা ভালো করে পড়তে পারছিনে। এটা আমি এখন নিয়ে যাই, পাঠোদ্ধার করে আপনাকে ফেরৎ দেব। তিনি নিয়ে যেতে আপত্তি করেননি, আবার ফিরিয়ে দেওয়ার কথাতেও কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি। বলতে তো পারতেন আর ফেরৎ দিয়ে কি হবে? আমি কাগজটা ফেরৎ দেব বলেছিলেম বটে, কিন্তু আমার মনের ত্রিসীমানায়ও ফেরৎ দেওয়ার কোনও বাসনা ছিল না।
অবনী মুখার্জির মুসাবিদাটিও পকেটে নিয়ে আমি সেই জায়গায় গেলাম যে জায়গায় তাঁর আমাকে লিখিত পত্রগুলি আমি রেখেছিলাম। সেখান থেকে পত্রগুলি নিয়ে আমি আমার ছাত্রদের বাড়ির বৈঠকখানায় গেলাম সেখানে দিনের বেলায় কেউ থাকতেন না। আমি মুসাবিদার লেখা ও অবনীর আগেকার লেখা চিঠিগুলি লেখা মিলিয়ে দেখলাম। আমার মনে এতটুকুও সন্দেহ থাকল না যে সব লেখা একই হাতের। সেই মুহূর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে অবনীর নিজ হাতের মুসাবিদটি বিদেশে পাঠিয়ে দেব। সেই দিনই পাঠিয়েছিলাম কিনা আমার মনে নেই, ১৯২৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখে পাঠিয়েছিলাম। এই মুসাবিদার একই খামে পুরে আমি এম. এন. রায়কে বাঙলায় যে পত্র লিখেছিলেম তাতে তাতে তারিখ দেওয়া আছে “কলকাতা, ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩”। খুব সম্ভবত সেদিন বিদেশী ডাক পাঠানোর তারিখ ছিল। সপ্তাহে একদিন যেমন বিদেশের ডাক আসত, তেমনই বিদেশের ডাক যেতও সপ্তাহে একদিন। আমার পাঠানো খামটি বোম্বের ফরেন পোস্ট অফিসে খোলা হয়েছিল। তাঁরা আমার পত্রের ও অবনীর মুসাবিদার ফটোস্টাট কপি রেখে খামটি বন্ধ করে বিদেশে যেতে দিয়েছিলেন। সেই খাম জার্মানীতে এম. এন. রায়ের হাতে পৌঁছেছিল। ফটোস্টাট কপিগুলি কানপুর কমিউনিস্ট (ভারত কমিউনিস্ট (ভারত সরকারের ভাষায় “বলশেভিক”) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আসামীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হয়েছিল। আমার বাঙলা পত্রখানি ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন কলকাতার বেঙ্গলী ট্রানসেলেটারের অফিসের শ্রীকুঞ্জবিহারী রায়। এই মোকদ্দমার পেপার বুক হাতে নিয়ে আমি এই দুটি দলীল এখানে উদ্ধৃত করে দিলাম।
Ex. 18.
Letter Signed M.D. (Mahtab Deen)
Muzaffar to Roy
Calcutta
1st February, 1923
My dear Friend,
Perhaps you are aware that Mr. Abani Mukherjee has come to India and is at present staying in Calcutta. It seems from his activities that he has come here with the obvious object of making some mischiefs. He wants to discredit you in India and that is in a very mean and shameful way. Here is a draft letter in Mr. Mukherji’s own hanwriting. I have captured it somehow or other. This was given to a gentleman to have it typed on the printed letter paper of the Bengal Provincial Khailafat Committee without the knowledge of the authority. He may do many such mischiefs and it is not possible that every such case will come to my notice. As to the items of the letter most of them are known to you except that of Mr. Muhammad Daud, the general Secretary of the Indian Seamen’s Union, Calcutta, not the President of the Calcutta Seamen’s Union, as said by Mr. Mukerji, Mr. Daud comes of a rich family, His family is exploting the poor weavers of Shantipur. That I think his disqualification to be a member of our party. But to tell the truth he is not Government agent, Of course he may accept a big government post when offered as many a Indian leader of his class do.
Ex. 18A
(Enclosure of Muzaffar’s letter to M.N. Roy)
To
Comrade Zinowief [30]
Chairman, Executive Committee,
The III International,
Through Comrade Brandler, Girme…Berlin 2
[30. অবনী জিনোভিয়েফের বানান এখানে জার্মান ধরনে করেছেন।]
Dear Comrade,
The message of the III International has reached us here inspite of all isolations, It has brought a new peasants besides it has considerably strengthende the instincive feeling of solidarity of the labouring and hope amongst the conscious Circles of the Indian Labour and peasant masses who begins to feel that if they want to live they must organise themselves for the goal and that effect this international solidarity is absolutely necessary. The Shameless way in which N.C.O. and civil disobedience movements made us victim in the hands of our opponent classes have done at deal in opening our eyes. over all we have realized that T.U. as it has become a new means of oppression instead of safeguarding our economic interest. In all actuality it has become a concord of swindlers, spes and agents of Capitalists.
The situation being so we the labour and peasant bodies in the Khalifat and congress movements together with the good elements in the Trade Unions have decided to organise a mass party in the lines of the III International. Our foreign rulers being alert to this possibility, the work before us has become a difficult one, but all the same we are sure of success and hope to come before the world in a short period.
In the meantime we see that a certain number of unscruplous swindlers and Government agents anticipating the great deal of money could be had from your sources have gone and are going there with various forged documents as if they are representatives of organizations in reality which does not exist. This adventure is ruinous to our cause and as there are many spies amongst them we are afraid that if this is not stopped our attempts might get spoilded in the very start. To materialise this we send you herewith a list of men with a short sketch of what they are, request you to warm all concerned against them. We are on the move of collecting further documents about them and hope to send you with a proper delegation by the 5th Congress.
1. Nalini Gupta: He came here last with the very purpose of getting some persons to make a so called organisation that some money could he out of you. in our opinion he is a terrible mercinary.
2. Mozaffar ahmed: Nalini Gupta’s agent in Calcutta. A letter has come to Mozaffar that his presence is necessary in Europe to get that money and his passage money has been sent from there.
3. J. Mittra: He is going with various credentials; all are false but one that is from the calcutta Seamen’s Union. Mozaffar has no connection with this union, but as Mr. Daud Khan; President of the said Union is a party in the Swindle so he has managed to get it.
4. J.N. Mittra : A relative of compatriot of Gupta, he has already gone to berlin and it is a wonder to us how Mr. M.N.Roy and interests could trust such one.
5. Srihrith (Suhrit) Roy: The manager of all works undertaken by Mr. M.N.Roy. Subrith (Suhrit)…. After wards he has been sent to europe by the government to spy on our movents.
6. Bhattachariar (Ram Battacharya): He is a friend of Subrit (suhrit) and we have good reason for suspecting him as well to be a spy.
7. Daud Khan: President, Calcutta seamen’s Union. An agent of the Government to control the revolutionary seamen.
8. T.N.Roy: A master swindler, recently received a good sum of money from M.N.Roy. He poses as a peasant organizer but all of it is humbug. It is a fact that his brother did do some work among the Bengal Peasantry but on his death that organisation has been liquidated. At present he is also a party of the swindling concern that has been organized by Gupta.
We also want to bring one thing to your notice that it is questionable why Mr. M.N. Roy whom you have appointed to organize India, associates with these swindlers and spies and refuses to have anything to do with the revolutionaries that want to come in touch or work with him.
1. Letter address on the cover:-
H. Brandler,
Rosenthalin Strasse 38, Berlin inside enclose two copies one for Zinovief and the other written on the top copy for the German Party.
2. Address on the Cover :-
R. Tretbar
Reuter St. 84 IV
enclose two copies with a request to send them to Brandler.
3. Address on the Cover :-
W. Munzinber,
Unterden Linden II, Berlin
enclose like above 2 copies.
4. Com Krenyt.
Unterden Linden II, Berlin Enclose Like above 2 copies.
5. H. Khan
C/O Fritza Hansa ufer 8 Berlin
enclosed like above 2 copies.
ওপরে দেওয়া ঠিকানাগুলিতে অবনী মুখার্জি তাঁর জাল চিঠির প্রতিলিপি পাঠাবার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে তখনকার দিনে কংগ্রেস কমিটি ও খিলাফত কমিটি বহির্বিশ্বের নিকটে সমমর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
Copy
2, October, 1922
To
THE CENTRAL COMMITTEE OF THE BRITISH COMMUNIST PARTY
Dear Comrades,
It has been brought to the notice of the E.C.C.I. that abani Mukherji who was formerly working in the E.C.C.I and is now in Berlin, is engaged is spreading all sports of compromising stories against comrades M.N.Roy and Evelyn Roy. He is also, in the name of the Comintern, attempting to secure the aid of some other organizations to assist him to carry on Indian Work.
We hereby inform you that Mukherji has no connection with the comintern whatsoever. We have absolutely no confidence in him, and therefore we earnestly request you not to have any dealings with him. we refute his insinuations against Comrades Roy.
Com. M.N.Roy is the only persons authorised by the Commintern to Indian Work.
As the E.C.C.I. is now investigating the activities of Mukherji, we ask you, to send us all inforamtion you have in this matter.
This being a secret document, we request you to confide only in those comrades who are directly affected with this question.
With Communist greetings.
General Secretary
(Signed) KUUSINEN
Ex. 16.
[Letter warning members against abani Mukerji, signed “KOLAROV” on behalf of Communist International.]
(COPIE)
The Executive committee of Communist international hereby notifies all national sections as well as all other parties, groups and individuals concerned, that reports have been received to the effect that one Abani Mukherji who attended the II Congress of the Communist International and sometime workde as a member of the Indian Communist Group, has been in activities which make serious reflection upon his political honesty. in view of this fact it is quit Impossible for him to remain in the rans of the Communist International.
On October 2, 1922 [31] the Communist Parties of Great Britain, Germany and Italy were first waned of reprehensible activites of Abani Mukherji, More facts received since then obliged the Executive Committee to declare once again its lack of confidence in Mukerji, who has absolutely no connection with nor does he hold any mandate whatsoever either from the Communist Internatinal or from the red International of Labour Unions.
The Labour Unions, Political parties and other revolutionary groups in India are particularly warned against the activities of Mukerji, as the are the most directly concerned and are likely to be most injured.
The national sections are requested not to have any connection with Mukerji, to take this circular together with the previous one dated october 2,1922 as guidance in the matter and to confirm the receipt of the present.
(sd.) W. Colarov.
International
Comit
Enl. J. Jt.
Communiste
[31. Ex 34 B (Session Court) (Sd.) H. E. H. 23, 4, 24]
বাঙলা তর্জমা
একজিবিট ১৮
এম. ডি. (মাহ্তাব দীন) স্বাক্ষরিত
রায়কে লেখা মুজফফরের পত্র
কলকাতা
১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩
প্রিয় বন্ধু
হয়তো আপনি জানেন মিস্টার অবনী মুখার্জি ভারতে এসেছেন এবং এখন কলকাতায় আছেন। তাঁর কাজকর্ম হতে এটা মনে হচ্ছে যে তিনি খোলাখুলি কিছু কুমতলব নিয়েই এদেশে এসেছেন। তিনি নীচ ও নির্লজ্জভাবে আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান। এই সঙ্গে মিস্টার অবনী মুখার্জি নিজের হাতের লেখা একখানি পত্রের মুসাবিদা আপনাকে পাঠাচ্ছি। কোনো প্রকারে আমি একখানা হস্তগত করেছি। এই মুসাবিদা একজন ভদ্রলোককে এই উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল যে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটির ছাপানো চিঠির কাগজে তা টাইপ করাবেন এবং কমিটিকে না জানিয়েই তা করাবেন। তিনি এমন আরও অনেক অপকার্য করতে পারেন। এটা সম্ভব নয় যে সবটা আমার নজরে পড়বে। পত্রে যাঁদের কথা লেখা হয়েছে মিস্টার মুহম্মদ দাউদ ছাড়া আর সকলের বিষয় আপনি জানেন। তিনি ইন্ডিয়ান সিমেন্স ইউনিয়নের জেনেরেল সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট নন। মিস্টার দাউদ ধনী পরিবারের লোক। তাঁর পরিবার শান্তিপুরের তাঁতীদের শোষণ করেন। আমি মনে করি আমাদের পার্টি সভ্য হওয়ার পক্ষে এ জন্যে তিনি অযোগ্য। সত্য কথা বলতে গেলে তিনি সরকারের এজেন্ট নন। তবে, একটি বড় সরকারী চাকরী তাঁকে দিলে তিনি তা গ্রহণ করবেন, যেমন তাঁর শ্রেণীর অনেক ভারতীয় নেতাই তা করে থাকেন।
[আমার বাঙলায় লেখা মূলপত্রের ফটো কপিই শুধু আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের জজদের পড়ার জন্যে পেপারবুক শুধু ইংরেজিতেই ছাপা হয়েছে। এখানে আমি অনুবাদের অনুবাদ করেছি। অবনীর জালপত্রে একটি জেমিত্র নাম আছে। আমি রায়কে লিখেছি যে তিনি দাউদ সাহেবকে ছাড়া আর সকলের কথা জানেন। কিন্তু আশ্চর্য যে আমি জে. মিত্র কে তা এখন মনে করতে পারছিনে। যতীন মিত্র নামে এক ভদ্রলোক ট্রেড ইউনিয়নে ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো আমাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না।]
(এম. এন. রায়কে লেখা মুজফফরের পত্রের সংলগ্নিকা)
কমরেড জিনোভিয়েফ
চেয়ারম্যান, একজেকিউটিব কমিটি,
থার্ড ইন্টারন্যাশনাল,
কমরেড ব্রান্ডলেরের মারফতে,
জিরমে,…২
বার্লিন
প্রিয় কমরেড
আমাদের সর্বপ্রকার বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বাণী আমাদের এখানে পৌঁছেছে। এই বাণী নূতন নূতন কৃষকদের আমাদের দিকে আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া, এ বাণী শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বাভাবিক মনোভাবকে বাড়িয়েছে। কৃষকসাধারণের মনেও তা আশার সঞ্চার করেছে। তাঁরা অনুভব করতে আরম্ভ করেছেন যে বাঁচতে হলে তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে তাঁদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ঐক্যবদ্ধতা একান্ত প্রয়োজন। অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন যেরূপ নির্লজ্জভাবে বিরুদ্ধ শ্রেণীগুলির শিকারে আমাদের পরিণত করেছে তাতে আমাদের চোখ খুলে গেছে। তার ওপরে, আমরা বুঝেছি যে ট্রেড ইউনিয়ন যেভাবে গঠিত হয়েছে তাতে তা আমাদের আর্থিক স্বার্থের সংরক্ষণ না করে আমাদের ওপরে অত্যাচারের একটি উপায় স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে প্রবঞ্চক ও ধনিকগণের গুপ্তচর ও দালালে (agents) সমন্বয়।
অবস্থা যখন এই তখন খালিফাৎ [৩২] ও কংগ্রেস আন্দোলনের ভিতরে আমরা যেসব মজুর ও কৃষক সংগঠনগুলি রয়েছি, আর ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভিতরে যে- সব সৎ লোকেরা আছেন,-সবাই মিলে আমরা স্থির করেছি যে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুসরণে একটি জনগণের পার্টি গড়ে তুলব। এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমাদের বিদেশী শাসকেরা সজাগ। আমাদের কাজ করা অত্যন্ত কঠিন এসব সত্ত্বেও আমাদের সাফল্যলাভ সুনিশ্চিত। অল্প সময়ের ভিতরেই আমরা জগতের সামনে নিজেদের জাহির করব।
[32. খিলাফাত্ কমিটির তরফ হতে পত্র লেখা হচ্ছে অথচ খিলাফৎকে কিনা বলা হচ্ছে খালিফাৎ।]
ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু সংখ্যক অসৎ, প্রতারক ও গবর্নমেন্টের চর ভেবেছে যে আপনাদের উৎস হতে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে। এই ভেবেই তাদের কিছু লোক আপনাদের ওদেশে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরূপে পরিচয় দেওয়ার জন্যে তাঁরা জাল দলীল বানিয়ে নিয়ে গেছে। আসলে সে সব সংগঠনই নেই। এই দুঃসাহসিকতা আমাদের কাজের সর্বনাশ করবে। এদের ভিতরে গুপ্তচর রয়েছে। আমাদের ভয় হচ্ছে যে এটা এখনই বন্ধ না করলে আমাদের প্রচেষ্টা শুরুতেই ভণ্ডুল হয়ে যাবে। এই বন্ধ করাটা কাজে পরিণত করার জন্য আমরা এসব লোকের নামের একটি তালিকা তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি। আমাদের অনুরোধ, এদের সম্বন্ধে সকলকে সাবধান করে দিবেন। আমরা তাদের সম্বন্ধে আরও দলীল সংগ্রহের চেষ্টায় আছি। এবং আশা করি যে পঞ্চম কংগ্রেসের প্রকৃত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সে সব পাঠাতে পারব।
(১) নলিনী গুপ্ত : গতবারে সে এখানে কিছু লোক জড় করে একটি তথাকথিত সংগঠন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এসেছিল যাতে আপনাদের নিকট হতে কিছু টাকা বার করতে পারে। আমাদের মতে নলিনী গুপ্ত একজন বিপজ্জনক ভাড়ায় খাটার লোক।
(২) মোজাফ্ফর আহমদ : নলিনী গুপ্তের কলকাতার এজেন্ট। মোজাফ্ফরের নামে একখানা পত্র এসেছে যে টাকা আনার জন্যে ইউরোপে তার উপস্থিতি প্রয়োজন। তার রাহা খরচের বাবতে ইউরোপ হতে টাকা পাঠানো হয়েছে।
(৩) জে. মিত্র : সে কয়েকটি পরিচয়পত্র নিয়ে যাচ্ছে: কলকাতা সিমেন্স ইউনিয়নের পরিচয়পত্র ছাড়া আর সব ক’খানা পরিচয় পত্রই মিথ্যা। এই ইউনিয়নের সঙ্গে মোজাফ্ফরের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, এই ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিস্টার দাউদ খান প্রতারণার সহযোগী হওয়ার কারণে মোজাফ্ফর এই পরিচয় পত্রের ব্যবস্থা করতে পেরেছে।
(৪) জে. এন. মিত্র : গুপ্তের একজন দেশের লোকের আত্মীয়। সে আগেই বার্লিনে পৌঁছে গেছে। আমাদের নিকটে এটা খুবই আশ্চর্য ঠেকেছে যে কি করে মিস্টার এম. এন. রায় ও স্বার্থসমূহ (intersts) [33] এই রকম একজন লোকের ওপরে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন।
[33. এখানে অর্থ বোধগম্য নয়।]
(৫) সুহৃথ (সুহৃৎ) রায় : রায় যে সব কাজ গ্রহণ করেছেন সে সব কাজের ম্যানেজার। সুবৃথ (সুহৃৎ)…। আমাদের গতিবিধির ওপরে নজর রাখার জন্যে পরে গবর্নমেন্ট তাকে ইউরোপে পাঠিয়েছেন।
(৬) রাম ভট্টাচার্য : সে সুহৃদের বন্ধু এবং আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সেও একজন গুপ্তচর।
(৭) দাউদ খান : ক্যালকাটা সিমেন্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী নাবিকদিগকে আয়ত্তে রাখার জন্যে গবর্নমেন্টের একজন এজেন্ট।
(৮) টি. এন. রায় : মোড়ল প্রতারক। সম্প্রতি এম. এন. রায়ের নিকট হতে একটি মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছেন। তিনি নিজেকে একজন কৃষক সংগঠক মনে করেন। কিন্তু এসব তাঁর ছলনা। এটা সত্য যে তাঁর ভ্রাতা বাঙলা দেশের কৃষকদের ভিতরে কিছু সাংগঠনিক কাজ করেছিলেন, তবে মৃত্যুর পরে সে সংগঠন উঠে গেছে। গুপ্ত যে একটি প্রতারক সংস্থা গঠন করেছে টি. এন. রায়ও বর্তমানে তার অন্তর্ভুক্ত।
আপনাদের গোচরে আমরা আরও একটি কথা আনতে চাই। আপনারা এম. এন. রায়কে ভারতে সংগঠক নিযুক্ত করেছেন। এটা সন্দেহজনক ব্যাপার যে তিনি কিনা যোগাযোগ রাখছেন এই সকল প্রতারক ও গুপ্তচরদের সঙ্গে। যে সকল বিপ্লবী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ও কাজ করতে চান তিনি তাঁদের এড়িয়ে চলেন।
এখানে পাঁচটি ঠিকানা আছে ওপরে ইংরেজিতে ঠিকানাগুলি দেওয়া হয়েছে বলে বাঙলায় সেগুলি আর দেওয়া হলো না।
অবনী মুখার্জির ইংরেজি লেখা স্থানে স্থানে বোধগম্য নয়। এ জন্যে বাঙলা তর্জমা করা কঠিন। আশ্চর্য নয় যে তর্জমাও স্থানে স্থানে অবোধ্য হয়ে থাকবে।
একজিবিট ১৬
[অবনী মুখার্জির বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে সভ্যদের নামে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তরফ হতে ডব্লিউ কোলারবের স্বাক্ষরে একখানি সার্কুলার।
প্রতিলিপি
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটি তার বিভিন্ন দেশের জাতীয় অঙ্গগুলিকে (Sections) ও অন্য পার্টিগুলিকে এবং বিভিন্ন গ্রুপ আর সংসৃষ্ট ব্যক্তিদের এতদ্বারা জানাতে চান। তাঁদের নিকটে খবর পৌঁছেছে যে অবনী মুখার্জি নামক একজন ব্যক্তি, যিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনারের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং কিছুকাল ভারতীয় কমিউনিস্ট গ্রুপে সভ্য হিসাবে কাজ করেছেন, এখন এমন সব কাজে লিপ্ত হয়েছেন যা তাঁর রাজনীতিক সাধুতা সম্বন্ধে অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। এই কারণে তাঁর পক্ষে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্ভুক্ত থাকা অসম্ভব।
১৯২২ সালের ২রা অক্টোবর তারিখে অবনী মুখার্জির নিন্দনীয় কাজ-কর্ম সম্বন্ধে ‘প্রথমে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি, জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি ও ইটালীর কমিউনিস্ট পার্টিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। তারপরে আরও অনেক ঘটনা জানা গেছে। এই জন্যে একজেকিউটিব কমিটি আবার ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে যে অবনী মুখার্জির ওপরে কমিটির কোনো আস্থা নেই। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ও রেড ইন্টারন্যাশনাল অফ লেবর ইউনিয়নের সহিত একেবারেই তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি এই সংস্থাগুলির কোনো পরিচয়পত্রও (Mandate) ধারণ করেন না।
ভারতের লেবর ইউনিয়নসমূহের রাজনীতিক পার্টিসমূহ ও অন্য বিপ্লবী গ্রুপগুলিকেও মুখার্জির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, মুখার্জির কার্যকলাপ প্রত্যক্ষভাবে তাঁদেরই সহিত সংসৃষ্ট, আর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তাঁদেরই বেশী।
আমাদের বিভিন্ন দেশের জাতীয় অঙ্গগুলিকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে তাঁরা যেন অবনী মুখার্জির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখেন, তাঁরা যেন ওই সার্কুলার এবং ১৯২২ সালে সম্ভবত তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারিয়েট সভ্যও ছিলেন।]
বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটির রিপোর্ট হিসাবে অবনী মুখার্জি নিজের হাতে লেখা জিনোভিয়েকে সম্বোধিত দলীলটি আমার হাতেই যে প্রথম পড়েছিল তার বর্ণনা আমি ওপরে দিয়েছি। মুখার্জির এই জালিয়াতির খবর ঘুণাক্ষরেও বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটি কিছুই জানতেন না এবং কোনো দিন জেনেছেন বলেও আমার বিশ্বাস নেই। অবনীর নিজের হাতে পেন্সিলে লেখা এই দলীল মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দপ্তরে অবনী মুখার্জি নামীয় ফাইলে রক্ষিত ছিল। পেন্সিলের লেখা কতকাল পড়তে পারা যায় তা আমি জানিনে। যদি দলীলটি পড়বার মতো অবস্থায় থাকে তবে তা মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মুহাফিজখানায় (archives) আজও রক্ষিত আছে।
১৯২২ সালের কোন মাসে যে অবনী মুখার্জি মস্কো হতে জার্মানীতে গিয়েছিলেন তা আমি সঠিক বলতে পারব না। তার নির্দিষ্ট সময় সম্বন্ধে কোনো দলীল-পত্র আমার হাতে আসেনি। বার্লিনে ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা তখন মৌলবী বারাকতুল্লার ন্যাশনাল ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টিতে যোগ দিয়েছেন, – ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত হতে আরম্ভ করে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকেই। ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চয় তাঁদের কাম্য ছিল। কিন্তু বেঁচে থাকতে পারলে তবে তো স্বাধীনতার জন্য তাঁরা লড়াই করবেন, বেঁচে থাকার উপায় কি? প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তার ভিতর দিয়ে তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা লাভ করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধের পর সেই জার্মানী ডুবেছে, বিপ্লবের ভিতর দিয়ে নূতন করে ভেসে উঠেছে রাশিয়া। এই বিপ্লবী রাশিয়ায় ১৯২১ সালে গিয়ে ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা কোনো রকমের সুবিধা করতে পারেননি। বিশ্ববিপ্লবী সঙ্ঘ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল চট্টোপাধ্যায়ের রেভেলিউশনারী বোর্ড গঠন করার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। মানবেন্দ্রনাথ রায় জার্মান ষড়যন্ত্রের লোক হলেও বার্লিন কমিটিতে ছিলেন না। তিনি এসে কিন্তু মস্কোতে জাঁকিয়ে বসেছেন। সেখানে তিনি ভারতীয় মুহাজির (আত্মনির্বাসিত) যুবকদের নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছেন। বার্লিন কমিটির সভ্য না হলেও এম. এন. রায় তাঁদেরই দলের, অর্থাৎ জার্মান ষড়যন্ত্রের লোক ছিলেন। বার্লিন কমিটিওয়ালারা কিছুতেই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে রাজী হলেন না। তাঁর মনে কি ছিল আমি জানি না। ১৯২১ সালে তিনি একসঙ্গে কাজ করার জন্য বার্লিন কমিটিওয়ালাদের বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এম. এন. রায় আগে হতে মস্কোতে এসে জাঁকিয়ে বসে গেছেন তো বটেই, তিনি তাঁদের পুরানো মত ও পথ বর্জন করে কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন। মস্কোতে রায়ের প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করতে তাঁরই নেতৃত্ব মেনে নিতে হতো। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় হরদয়ালের নেতৃত্ব মানতে পারেননি এম. এন. রায়ের নেতৃত্ব কি করে মেনে নেবেন? দশ জন ফকীর অনায়াসেই একখানা চাদর পেতে তার ওপরে ঘুমোতে পারেন, কিন্তু দু’জন বাদশাহের জায়গা এক দেশে কি করে হতে পারে? অথচ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের টাকা তাঁদের চাই। অতএব দীর্ঘ নির্বাসনের পচা মনোবৃত্তি তাঁদের প্রেরণা জোগাল যে হটাতে হবে এম. এন. রায়কে।
যাক এসব কথা। এখন আমি আসল ঘটনায় আসছি। অবনী মুখার্জি বার্লিনে এসেই ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হতে, অতএব কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ‘র্যাঙ্ক’ হতেও তিনি বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টি স্থির করেছিলেন যে এবার তাঁরা শেষ লড়াই লড়বেন। যেমন করেই হোক এম. এন. রায়কে উৎখাত করতেই হবে। তাঁর পায়ের তলা হতে ভারতের মাটি সরিয়ে নিতেই হবে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্যে তাঁরা স্থির করলেন যে অবনী মুখার্জিকে ভারতে পাঠানো হবে। অবনী মুখার্জি ঠিক মতো কাজ করছেন কিনা তা তদারক করার জন্যে কিছুকাল পরে একজন পরিদর্শকও ভারতে পাঠাবেন।
কিন্তু এদিকে অবনী মুখার্জি যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে বহিষ্কৃত হয়ে আছেন। পরিচয়-পত্র ছাড়া ভারতের রাজনীতিক মহলে তিনি কি করে দাঁড়াবেন? এম. এন. রায়কে উৎখাত করতে হলে নিজেকে কমিউনিস্টরূপে পরিচয় দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অতএব স্থির হলো :
(১) কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্যে অবনী মুখার্জি যে অনুজ্ঞা পত্র (etadnam) পেয়েছিলেন সেটাই ভারতবর্ষে দেখানো হবে। তাতে প্রমাণিত হবে যে অবনী কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংসৃষ্ট।
(২) ভারতে পরিচিত হওয়ার জন্যে অবনী মুখার্জিকে এই বলে একখানি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল যে তিনি “ভারতীয়দের রুশ সাহায্য কমিটি’র সভ্য ও সহযোগী সম্পাদক (the member and joint Secretary of the Indian Committee for Russian relief)। বারাকতুল্লাহ্ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এই সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। স্বাক্ষরের তারিখ ১৩ই অক্টোবর, ১৯২২।
অনেক পরে কর্নেল কে’ এই সম্বন্ধে লিখেছেন যে :
“Abani Mukherji came to India, on his recent journey, as an emissary of the ‘anti-Ray’ Party of Indian revolutinaries in Europe. He carried with him ‘credentials’ of which I have photographed copies: his mandate, printed in Russian, I learn declaring him to be a ‘bonafide delegate of the third Congress of the Communist International with the right to an advisory vote’, and a certificate that he was `the member and joint Secretary of the Indian Committee for Russian Relief, Signed by Barakatullah and Bhupendra Nath Dutt. In addition to these two notorious revolutionaries, Abani Mukherji was in close contact with another, even more notorious, `Chotto’. The Certificate was dated October 13, 1922, and the `mandate’ June 21, 1921. The latter was cancelled by a circuler dated october 2, 1922, in which the communist International disowned abani and expressed their confidence in M.N.Roy, against whom abani Mukherji decided on working”.
sd. C. Kaye
20.8.24
(ছবি আগের মত পাতায়
THE INDIAN COMMITTEE FOR RUSSIAN FAMINE RELIEF
Indian Section International
Worker’s relief
telephone: 12790/12791
Committee for the starving
Russians
telephone : Zentrum 12790/12791
Berlin Linter den Linden 11
Berlin : 13th Oct. 1922
To
Whome it may concern
The bearer of this, comrade Abani Mukherji is the member and joint Secretary of the Indian Committee for russian relief which is the Indian Section of the International worker’s relief for the starving Russians. Comrade Mukherji is going to Russia and we the undersigned herewith request to all concerned to help him during his stay there.
Chariman: Mohammed Barakatullah
Secretary : Bhupendranath Dutta
রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ ত্রাণে ভারতীয় কমিটি
আন্তর্জাতিক শ্রমিক ত্রাণের ভারতীয়
শাখা
টেলিফোন : ১২৭৯০/১২৭৯১
অনশনক্লিষ্ট রাশিয়ানদের জন্য কমিটি
টেলিফোন : জেন্টরাম ১২৭৯০/১২৭৯১
বারলিন, লিনটার ডেন লিনডেন-১১
বারলিন ১৩ই অক্টোবর ১৯২২
সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য
অনশনক্লিষ্ট রাশিয়ানদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক ত্রাণের ভারতীয় অংশের রাশিয়ান ত্রানের জন্য ভারতীয় কমিটির সভ্য ও যুগ্ম সম্পাদক কমরেড অবনী মুখার্জি এই পত্রের বাহক। কমরেড মুখার্জি রাশিয়া যাচ্ছেন এবং আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীরা এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে তাঁর রাশিয়ায় থাকাকালীন সময়ে তাঁকে সাহায্য করতে অনুরোধ করছি।
সভাপতি : মহম্মদ বারাকতুল্লাহ্
সম্পাদক : ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
কর্নেল কে’র মন্তব্যের অনেক কথা আমি আগে বলেছি। তিনি আরও বলেছেন, ইউরোপে গঠিত ভারতীয় বিপ্লবীদের ‘রায়-বিরোধী’ পার্টির চর হিসাবে অবনী মুখার্জি ভারতে এসেছিলেন। এই পার্টির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বারাকতুল্লাহ, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের ‘ম্যানডেটে’র তারিখ ছিল ২১ শে জুন, ১৯২১। ১৯২২ সালের ২রা অক্টোবর তারিখের এক সার্কুলারের দ্বারা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এই অনুজ্ঞা পত্র খারিজ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন এম. এন. রায়ের ওপর তাঁদের পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে, আর অবনী মুখার্জি তাঁদের লোক নন। (মনে রাখতে হবে এটা অবনী মুখার্জির ইউরোপ ত্যাগ করার আগেকার কথা। বারাকতুল্লাহ্ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তরা জানতে পারেননি।) কর্নেল কে’ আরও বলেছেন যে অবনী মুখার্জির ‘ম্যানডেট’ ও সার্টিফিকেটের ফটো কপি তাঁর নিকটে আছে।
এখন কথা হচ্ছে অবনী মুখার্জি কি করে ভারতে এসেছিলেন। ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের রিপোর্টে কোনো কোনো জায়গায় উল্লেখ আছে যে জাহাজের চাকরী করে ভারতে এসেছিলেন। এই রকম বিবৃতি দেওয়া সেকালে ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। অবনীর জাহাজে চাকরী করে আসার কথা একেবারেই সত্য নয়। বেঙ্গল পুলিসের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের স্পেশাল সুপারিন্টেডেন্ট পি.সি. ব্যামফোর্ড লিখেছেন (২৩ শে আগস্ট, ১৯২৩), অবনী মুখার্জি হামবুর্গ হতে হাসা লাইনের “বার্টেনফেলস্” নামক জাহাজে মাদ্রাজ হয়ে কলিকাতা এসেছিলেন। এ জাহাজেই অবনী এসেছিলেন কিনা তা জানিনে, তবে তিনি প্যাসেঞ্জার হয়ে যে এসেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডক্টর আর. শাহীর নামে অবনীর ডাচ্ পাসপোর্ট ছিল। এই পাসপোর্ট নিয়েই তিনি ইন্দোনেশিয়া হতে ইউরোপ এসেছিলেন। এই পাসপোর্টেই তিনি ভারতেও এসেছিলেন এই কথা জোর করে বলছি এই জন্যে যে ইউরোপে ফেরার সময়ে তিনি এই পাসপোর্টেই ফিরেছিলেন। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে দেশ-বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শ্রীঅতুল বসু ইউরোপ যাওয়ার সময়ে কলম্বো হতে মার্সেই বন্দর পর্যন্ত জাহাজে অবনীর সহযাত্রী ছিলেন। অবনী শ্রীবসুর নিকটে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁকে বলেছিলেন যে আমেরিকায় তাঁর অগ্রজ পবিত্র বসুর ( কেমিস্ট) সঙ্গে তাঁর (অবনীর) পরিচয় ছিল। শ্রীবসু আমাকে বলেছেন যে জাহাজে অবনী মুখার্জির আর. শাহীর নামীয় পাসপোর্ট তিনি নেড়েচেড়ে দেখেছেন।
আমি আগেই বলেছি যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলের লোকদের সঙ্গে অবনী মুখার্জির কোনো পরিচয় ছিল না। জাপানে তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েই তাঁদেরই একটি বার্তা (তার জীবনের প্রথম বিপ্লবী কাজ) নিয়ে তিনি ভারতে ফিরছিলেন, সিঙ্গাপুরে গিরেফতার হয়ে ফোর্ট ক্যানিং-এ বন্দী হন। ভূপতি মজুমদারও ওখানে বন্দী হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে অবনীর প্রথম পরিচয় এই দূর্গে। অবনী তখন প্যারোলে মুক্ত। ভূপতি মজুমদার বলেছেন অবনী তাঁর পেটের কথা বার করার চেষ্টা করেছিলেন। এই জন্যে তিনি অবনীকে ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু কলকাতায় অবনীদের বাড়ী-ঘর ছিল, আত্মীয়স্বজন ছিল এবং এক সময়ে অরাজনৈতিক বন্ধুরাও ছিলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের ভিতরে তিনি শুধু ভূপতি মজুমদারকে চিনতেন। তাঁর কাছেই প্রথম গেলেন। ভূপতি মজুমদার. ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন গুপ্ত, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী ও অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতিকে এক জায়গায় জড় করে তাঁদের সঙ্গে অবনীর পরিচয় করিয়ে দেন। মনে রাখতে হবে যে ভূপতি মজুমদার ছাড়া আর সকলের সঙ্গেই অবনীর সেদিন জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। জানিনে তাঁদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল। ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’তে লিখেছেন, (৪৬৬ পৃষ্ঠা) “কর্তৃত্বপ্রিয়তা নিয়ে মানবেন্দ্ৰ ও অবনী মুখার্জির কলহ বাধে।” আশ্চর্য এই যে যাদুগোপালের মতো লোক অবনী মুখার্জিন সহিত রাজনীতিক আলোচনা করে একটুকু মাত্র বুঝতে পেরেছিলেন। অন্য একজন বিপ্লবী বললেন, এভেলিন (রায়ের স্ত্রী) ও রোজার (অবনীর স্ত্রী) মধ্যে ঝগড়া বাধার ফলেই ব্যাপারটা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে!!
এর পরে দেখতে পাওয়া গেল যে অবনী মুখার্জির সহিত সন্তোষকুমার মিত্রের পরিচয় হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী এই পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি শুনেছিলাম, সেই সময়ে বিপিন গাঙ্গুলীর সহিত সন্তোষ মিত্রের সদ্ভাব ছিল না। অসদ্ভাবের কারণ নাকি ছিল শিশিরকুমার ঘোষ, যাঁকে পুলিসের চর বলে লোকে সন্দেহ করতেন। সন্তোষ মিত্র নাকি কিছুতেই শিশিরকে ছাড়তে রাজী ছিলেন না। আমার ধারণা জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষই সন্তোষ মিত্রের সহিত অবনী মুখার্জির পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে থাকবেন। তাঁর “আশীর্বাদ’ মস্তকে বহন করেই সন্তোষ মিত্র সেই সময়ে কাজে এগুচ্ছিলেন।
আমাদের ছোট্ট কমিউনিস্ট আন্দোলনটিকে ঘায়েল করার প্রথম চেষ্টা অবনী মুখার্জি করেছিলেন কলকাতায়। এই কাজে তাঁর প্রধান সহকারী হয়েছিলেন সন্তোষকুমার মিত্র। এই ষড়যন্ত্রে অবনী কি করে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন তার বিবরণ আমি ওপরে দিয়েছি। ঘায়েল আমরা হলাম না, প্রথম উদ্যমেই ঘায়েল হলেন অবনী মুখার্জি নিজে।
আমি আশ্চর্য হলাম সন্তোষ মিত্রের ব্যবহারে। তিনি তখন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন না, কোনো দিন তিনি আমায় দেখেননি, তিনি কেন অবনী মুখার্জির গর্হিত কাজের সহযোগী হলেন? ‘ধুমকেতু’ কাগজের মারফতে ভূপতি মজুমদারের সহিত আমার পরিচয় হয়েছিল। তাছাড়া এম. এন. রায় আমার মারফতে তাঁকে চিঠিপত্র লিখেছেন। তাঁদের পুরনো দিনের পার্টি পরিচয়। আমি ভূপতি মজুমদারকে বললাম, “ দেখুন আপনাদের পার্টির কে কোন গ্রুপের নেতা তা আমার জানার কথা নয়। আমি জানতেও চাইনে। কিন্তু অবনী মুখার্জির সঙ্গে মিশে সন্তোষ মিত্র কেন আমার বিরুদ্ধে এই কাজটি করতে গেলেন? তিনি তো আমাকে চেনেন না। “
ভূপতি মজুমদার তখন একদিন সন্ধ্যার পরে সন্তোষ মিত্রকে ‘ধুমকেতু অফিসে ডেকে আনলেন। এটা নজরুল ইসলামের গিরেফতার হওয়ার অনেক পরের কথা। সন্তোষ মিত্র এলেন। আমার সামনেই ভূপতিবাবু তাঁর বক্তব্য শুনতে চাইলেন। কোনো কৈফিয়ৎই দিতে পারলেন না তিনি। অবনী মুখার্জি কিন্তু ইউরোপে ফিরে গিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিকটে রিপোর্ট করেছিলেন যে সন্তোষ মিত্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ডক্টর দত্ত তখন জানতেন না সন্তোষ মিত্র কে? ১৯২৫ সালে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর ফেরার কত দিন পরে তা জানিনে, সন্তোষ মিত্রের সঙ্গে তার প্রগাঢ় পরিচয় হয়েছিল। এই শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে তিনি তাঁর “অপ্রকাশিত রাজনীতিক ইতিহাসে”র নূতন সংস্করণে অবনীর সেই পত্রের ঘটনা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, “সন্তোষ তখন ১৬ বৎসরের বালক” (৩০৮ পৃষ্ঠা)। এই বালকটি সিক্সথ্ ইয়ার (এম. এ.) পড়ার সময়ে ১৯২১ সালে অসহযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন। ১৬ বছর বয়স না হলে তখনকার দিনে কেউ মেট্রিকুলেশন পাশ করতে পারতেন না। কাজেই ১৯২৩ সালের আরম্ভে সন্তোষ মিত্রের বয়স কমপক্ষে ২৪ বছর হয়েছিল। তিনি তখন একটি টেরোরিস্ট গ্রুপের দাদা (নেতা) ছিলেন।
অবনী মুখার্জি ও ঢাকার অনুশীলন সমিতি
অবনী মুখার্জিকে বারাকতুল্লাহ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যখন বার্লিনে সার্টিফিকেট দিচ্ছিলেন তার কয়েক দিন আগেই কুশিনিন তাঁর সার্কুলার ইস্যু করেছিলেন যে অবনী মুখার্জি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কেউ নয় এবং এম. এন. রায়ের ওপরে ইন্টারন্যাশনালের পরিপূর্ণ আস্থা আছে। এই সার্কুলারের কথা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির লোকেরা প্রথমে জানতেন না, পরে তাঁদের বহু সংখ্যক লোক জেনেছিলেন। আর, অবনী মুখার্জি নিজে তো জানতেনই। তার ওপরে তাঁর হাতে লেখা মুসাবিদা নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এসব সত্ত্বেও অবনী মুখার্জি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সামনে বুক ফুলিয়ে বললেন, “আমি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রকৃত প্রতিনিধি, মানবেন্দ্রনাথ রায় নয়”। রাক্ষসে ভাষায় “হাঁউ মাঁউ খাঁই, টাকার গন্ধ পাঁই”। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা ভাবলেন জার্মান ষড়যন্ত্রের সময়ে কেউ কেউ টাকা তো পেয়েছিলেন। আহা! কী ভালই না হয় এখন যদি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে কিছু টাকা পাওয়া যায়!! চললো আলওয়ান দিয়ে মাথা ঢেকে রাত্রে অবনীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ। উপন্দ্রেনাথ বন্দোপাধ্যায় ও প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো অবনীকে নিয়ে দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গেল। আশ্চর্য এই যে উপেন্দ্রনাথ আবার এম. এন. রায়কে চিঠিও লিখছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় আমাদের প্রচারের কিছু সুবিধাও করে দিয়েছেন এবং গয়া কংগ্রেসেরে সময়ে আমাদের প্রোগ্রাম প্রচারে বিশেষ সাহায্য করেছেন তিনি। তবুও প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে অবনীকে নিয়ে দড়ি টানাটানি করলেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত উপেন্দ্রনাথ অবশ্য সরে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় অবনী মুখার্জিকে নিয়ে গেলেন। ঢাকা গিয়ে অবনী মুখার্জির লাভ হয়েছিল। “বিপ্লবী অবনী মুখার্জি” নাম দিয়ে ঢাকা হতে তাঁর একখানা জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের নাম রাখালচন্দ্র ঘোষ। অনেকে বলেন বইখানি অবনী মুখার্জির নিজের লেখা। রাখালচন্দ্র ঘোষর রচনা হলে নাকি লেখা আরও অনেক ভালো হতো। অবনী মুখার্জি যে ঢাকা গেলেন তাতে কার কি লাভ হয়েছিল? বারাকতুল্লাহ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি যাঁরা অবনী মুখার্জিকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন অবনীর ঢাকা যাওয়ায় তাঁদের কিন্তু এক কানাকড়িও লাভ হয়নি। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এম. এন. রায়ের আসন তাতে এতটুকুও টলেনি। অনুশীলন সমিতি টাকাও পাননি। অবনী মুখার্জি নামকাটা সিপাহী ছিলেন, টাকা কোথায় পাবেন? কমিউনিস্ট পার্টির ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সংগঠন অনুশীলন সমিতিরা বুঝেছিলেন কিনা জানিনা। অবনী মুখার্জি পার্টি হতে বহিষ্কৃত ছিলেন, তিনি কি করে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত অনুশীলন সমিতির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটাতে পারতেন? বরঞ্চ তাঁদের নিকট হতে চিঠিপত্র নিয়ে গেলে অবনী মুখার্জি নিজে কিছু উপকৃত হলেও হতে পারতেন। তাও তো তিনি হননি। ১৯২৪ সালে অবনী মুখার্জি রাশিয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের শেষাশেষিতে কিংবা ১৯২৭ সালের শুরুতে ৩৭, হ্যারিসন রোডের ঠিকানায় আমাদের কাগজ “গণবাণী”র নামে অবনী মুখার্জির বাঙলায় লেখা একখানি পত্র আমরা পেয়েছিলাম। মস্কো হতে লেখা পত্র। তাতে তিনি লিখেছিলেন : “আমি এখন স্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে কাজ করছি। পার্টির সঙ্গে অর্থাৎ রায়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি বুখারিনের এ. বি. সি. অফ্ কমিউনিজ্ম্ বাঙলায় তর্জমা করেছি। আপনারা ইচ্ছা করলে তা ছাপাতে পারেন”। (স্মৃতি হতে উদ্ধৃত)। আমি এই পত্রের উত্তর দিইনি। খোলাখুলিভাবে “এ. বি. সি. অফ্ কমিউনিজম্” ছাপাবার অবস্থা তখনও দেশে সৃষ্টি হয়নি। আর, হলেও আমাদের ক্ষমতায় কুলাত না।
অবনী মুখার্জি যে দেশে ফিরেছিলেন ভারত গবর্নমেন্ট তা সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছিলেন। তাঁর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের থার্ড কংগ্রেসের ডেলিগেট ম্যানডেট আর বারাকতুল্লাহ্ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সার্টিফিকেটের ফটো কপি কর্নেল কে’র হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। কোন সূত্রে, কর্নেল কে’র হাতে এসব পৌছাল তা জানিনা। [৩৪] ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের লোকেরা ইউরোপের কোথায় না ছিলেন? বিশেষ করে যে যে স্থানে ভারতীয়রা ছিলেন সে সব জায়গায় ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের লোকেরাও ছিলেন। সকলের কথা জানিনে, কিন্তু সন্তোষকুমার মিত্রের সঙ্গে তো শিশিরকুমার ঘোষের নিবিড় যোগসূত্র ছিল। শিশির কি খবর দিত না পুলিসকে? অবনীর জাল চিঠির ব্যাপারে তিনি সন্তোষ মিত্রের ওপরে চটেছিলেন। কিন্তু শিশির ঘোষকে তিনি ত্যাগ করেননি।
[34. জাতীয় মুহাফিজখানার কাগজ পত্র পড়ে পরে জেনেছি যে সিঙ্গারাভেলুর সহকারী বেলায়ুধন এগুলি পুলিসকে ফটো কপি করতে দিয়েছিলেন।]
অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে ভারত গর্বমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের মিস্টার হেয়ার স্কটের বক্তব্য
অবনী মুখার্জি ভারতে এসে যে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন তাতে গবর্নমেন্ট খুবই খুশী ছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের ভারতীয় ব্যাপার সংক্রান্ত উজীরের (The Secretary of state for India) বড় বেশী বলশেভিক ভীতি ছিল। বলশেভিকবাদ ভারতে দানা বাঁধুক এটা ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট একেবারেই চাইতেন না। ‘ভারতবর্ষে বলশেভিকদের পেলেই টিপে মেরে দাও’ এই রকমেই প্রায় ছিল তাঁদের মনের অবস্থা। সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়ার এই ধরনের এক টেলিগ্রামের উত্তরে ভারত গবর্নমেন্টের একজন বড় অফিসার লিখেছিলেন (Home pol. Dept. F. No. 103/111/1923.) :
4. The Second Suggestion of the Secretary of State, making it an offence to be a Communist, appears to be a matter for legislation. I do not think the mere fact of being a communist can be made punishable under the ordinary law unless we are able to prove that every Communist is a member of an organisation, the aim and object of which is to overthrow British rule in India by violent means. In the Case of Roy we can, I think, prove that he is aiming at the destruction of the Government established by law in India by revolutionary methods, and this would apply to every member who can be proved to belong to his party, but I doubt if we could do the same as regards every person who is known or professes to be a communist. Take, for instance, the Case of Abani Mukherji who is now believed to be in India. He is a Communist, But is opposed to and working against Roy and his party. We know that he has been associating with bolsheviks in Berlin and Russia, but we have no proof that he has been engaged in revolutionary activites directed against India that would be accepted in any court of law. (Italics mine)
Home Department
H.V.B Hare Scott
14.2.23
বঙ্গানুবাদ
৪। কোনো লোকের কমিউনিস্ট হওয়াই অপরাধ, সেক্রেটারি অফ্ স্টেটের এই যে দ্বিতীয় প্রস্তাব, এটা মনে হয় আইন তৈয়ারকরণের প্রস্তাব। আমি মনে করি না যে কোনো লোক শুধু কমিউনিস্ট হলেই তাঁকে সাধারণ আইনে সাজা দেওয়া যায়, যতক্ষণ না এটা প্রমানিত হচ্ছে যে প্রত্যেক কমিউনিস্ট এমন একটি সংগঠনের সভ্য যে সংগঠনের উদ্দেশ্য ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে বল প্রয়োগ ক’রে উচ্ছেদ করা। আমি মনে করি, রায়ের ব্যাপারে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে বিপ্লবাত্মক প্রতিক্রিয়া প্রয়োগ ক’রে তিনি ভারতে আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠিত গবর্নমেন্টকে ধ্বংস করতে চান। তার পার্টির প্রত্যেক মেম্বরের বিরুদ্ধেও এটা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে যে, কমিউনিস্ট ব’লে পরিচিত কিংবা নিজেকে কমিউনিস্ট ব’লে প্রচার করেন এমন প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে ওপরে লিখিত ব্যক্তিদের মতো সাজা দেওয়া যায়। দৃষ্টান্ত হিসাবে অবনী মুখার্জির বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। আমাদের ধারণা, তিনি এখন ভারতে আছেন তিনি একজন কমিউনিস্ট। কিন্তু তিনি রায়ের বিরোধী এবং রায়ের পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করছেন। আমরা জানি যে বার্লিনে ও রাশিয়ায় তিনি বলশেভিকদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই, যা কোনো আদালতকে দিয়ে গ্রহণ করানো যায় যে অবনী মুখার্জি ভারতের বিরুদ্ধে কোনো বৈপ্লবিক কাজে নিযুক্ত আছেন।
হোম ডিপার্টমেন্ট
এইচ. ভি.বি. হেয়ার স্কট
১৪.২.২৩
অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে ভাইসরয়ের মন্তব্য
অবনী মুখার্জির ব্যাপার শুধু মিস্টার হেয়ার স্কট যে তাঁর বক্তব্য লিখেছেন তা নয়, সেক্রেটারি অফ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়ার টেলিগ্রামের বিষয়ে স্বয়ং ভাইস্য়ও তাঁর বক্তব্য পাঠিয়েছেন। এই বক্তব্যে তিনি অবনী মুখার্জিরও নামোল্লেখ করেছেন।
Telegram. P., no. 160 dated the 28th February, 1923 From- The Viceroy (Home Department)
To-The Secretary of State for India, London.
Sedition- Bolshevic menace and emissaries.
With regard to the mere fact of being Communist, We consider this no offence in itself under ordinary law, but it is an offence whenever it can be proved that the aim and object of organisation or individual is to over throw British rule in India by violent means, in which case we should prosecute at once. The difficulty, as stated in the above telegram dated the 5th February, is not in law, but in obtaining evidence. We deprecate ad hoc legislation which we should not without great difficulty be able to get through legislation. Besides, We have evidence of dissensions among the few agents in India. e.g Abani Mukheji is working hard to expose roy and his supporters as a set of swindlers. This enable us to exercizw a close watch over their movements and to retain threads in our hands which we would lose by more overt action against persons holding Communistic opinion. (Italics mine )
বঙ্গানুবাদ
টেলিগ্রাম পি, নম্বর ১৬০, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯২৩ ভাইয়ের (হোম ডিপার্টমেনটের) তরফ হতে, সেক্রেটারী অফ্ স্টেট্স ফর ইন্ডিয়া, লন্ডনের বরাবরে। রাজদ্রোহ। বলশেভিক আতঙ্ক ও বলশেভিক চরগণ।
কোনো লোকের শুধু কমিউনিস্ট হওয়াকে সাধারণ আইন অনুসারে আমরা কোনো অপরাধ মনে করি না, কিন্তু যখন কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে নির্মূল করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজে প্রবৃত্ত হয় তখনই আমরা তাদের আদালতে অভিযুক্ত করব। আমরা যেমন ৫ই ফেব্রুয়ারীর টেলিগ্রামে ব্যক্ত করেছি যে আসল অসুবিধা আইনের নয়, কষ্টকর ব্যাপার হচ্ছে সাক্ষ্য- প্রমাণ সংগ্রহ করা। আমরা বিশেষ আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে অনুরোধ জানাই। প্রচণ্ড বাধার ভিতর দিয়ে আইন সভায় তা পাস করাতে হবে। তাছাড়া, ভারতে অল্প সংখ্যক (বলশেভিক) এজেন্ট আছেন। তাঁদের ভিতরে যে বিবাদ-বিসংবাদ রয়েছে তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে একদল প্রতারকরূপে রায় ও তাঁর সমর্থকদের মুখোশ খোলার জন্যে অবনী মুখার্জি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। অবনী মুখার্জির এই কাজের দ্বারা তাদের গতিবিধির উপরে নিকট থেকে নজর রাখার পক্ষে আমাদের সুবিধা হয়েছে এবং গতিবিধির ডোরটাও আমরা অমাদের হাতে ধরে রাখতে পারছি। এই সুবিধাটা আমরা হারাব যদি আমরা যাঁরাই কমিউনিস্ট মত ধারণ করেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র প্রয়োগ করি ( মোটা হরফ আমার লেখক)।
অবনী মুখার্জি ভারতে এসে প্রায় অবাধে কাজ করতে পেরেছেন। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রচার করার জন্যে ভারতে আসেননি। এম. এন. রায় ও আমরা যারা তখন এম. এন. রায়ের সঙ্গে কাজ করছিলেম, আমাদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নেওয়ার জন্যেই তিনি এদেশে এসেছিলেন। উপরিউক্ত মিস্টার হেয়ার স্কট ও ভাইসরয়ের মন্তব্য হতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে অবনী মুখার্জিকে গিরোর করার বা গিরেফতার ক’রে তাঁকে আদালতে অভিযুক্ত করার কোনো ইচ্ছা ভারত গবর্নমেন্টের ছিল না। মিস্টার হেয়ার স্কট বলেছেন যে আদালত তাঁর মোকদ্দমা গ্রহণই করবে না। যে-ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টি (বারাকতুল্লাহ্, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি) তাঁকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন ভাইসরয়ের ভাষায় “কঠোর পরিশ্রম” করেও তিনি তাঁদের জন্যে কিছু করতে ও গড়তে পারেননি। অর্থাৎ সেদিনের ক্ষুদ্র কমিউনিস্ট পার্টিকে তিনি ধ্বংস করতে পারেননি।
বারাকতুল্লাহ্ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তরা সমস্ত ব্যাপারটিকে গভীরভাবে গ্রহণ করেছিলেন। অবনীর রওয়ানা হওয়ার আগেই তাঁরা একজনকে অবনী মুখার্জির কাজ তদারক করার জন্যে পাঠাবেন স্থির করেছিলেন। অবনী এই কথা মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের নিকটে উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, মুসলমান নামের একজন আসবেন। সিঙ্গারাভেলু আবার এই কথা নলিনী গুপ্তকে বলেছিলেন। পুলিসের নিকটে দেওয়া বিবৃতিতে নলিনী গুপ্ত তা ব্যক্ত করেছেন। সত্য সত্যই অবনীর কাজের তদারক করার জন্যে মুসলিম নামধারী একজন ইউরোপ হতে এসেছিলেন। তাঁর নাম সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদ। তিনি ইটালীর জাহাজে এসে সেই জাহাজেই ফিরে গিয়েছিলেন।
অবনী মুখার্জির অনুশীলন সমিতির সহিত যোগযোগের কথা আগেই বলেছি। তাঁর তাঁদের কি দেওয়ার ছিল এবং কি তাঁরা তাঁর নিকট হতে পেয়েছিলেন তা জানিনে। তবে অনুশীলন সমিতির বিশেষ বিশেষ লোককে ১৯৩৮ সালে বলতে শোনা গেছে যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত তাঁদের সোজাসুজি যোগাযোগ আছে-অবশ্য সে যোগাযোগ অবনী মুখার্জির মারফতে যোগাযোগ, যে অবনী মুখার্জি ছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে বহিষ্কৃত। আর, এই অবনী মুখার্জি ১৯৩৭ সালে মস্কোতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
১৯২৪ সালের জুন মাসে অবনীর আর একদফা স্বীকারোক্তি
অনেক দলীল পত্রে পাওয়া যাচ্ছে যে অবনী মুখার্জি গয়ার ব্যরিস্টার মণিলাল ডক্টরের (শাহ্) সহিত সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। মাদ্রাজের সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সহিত অবনীর সংযোগ ছিল আরও গভীর। অবনীর নিজের দাবী তাই। আমি ওপরে উল্লেখ করেছি যে ভারতবর্ষ হতে বার্লিনে ফিরে গিয়ে ১৯২৪ সালের ২৬ শে জুন তারিখে অবনী মুখার্জি ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার মিস্টার র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের নিকট ক্ষমা (Amnesty) চেয়ে একখানি দরখাস্ত জার্মানীর ব্রিটিশ দূতের (Ambassador) মারফতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর রুশ স্ত্রী ও তাঁর গর্ভজাত পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারতবর্ষে ফিরতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি জার্মান ট্রেড ইউনিয়নের নেতার নিকটে নিজের সম্বন্ধে একটি বিবৃতিও দিয়েছিরেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা যেন ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের মারফত এই বিবৃতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকটে পাঠিয়ে দেন। তাই করা হয়েছিল। তার জন্যেই আজ আমরা এই বিবৃতিটি পড়তে পেয়েছি।
অবনী মুখার্জির বার্লিনের এই বিবৃতিতে আছে যে মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারেরা যে “হিন্দুস্তান লেবর এন্ড পেজান্টস্ পার্টি” (দুর্ভাগ্যবশত এম. এন. রায়ের প্রস্তাবিত) গড়তে চেয়েছিলেন সেটা আসলে তিনিই গড়ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে এটা জনগণের একটি বৈধ সংগঠন হবে, এর স্লোগান হবে কোনো উপদ্রব নয়, “Non violence” নিরুপদ্রবই চাই; এর কাজ হবে পার্লামেন্টারি প্রথায় কাউন্সিলের ভিতরে, কাউন্সিলের বাইরে এই সংগঠন শ্রমজীবীদের স্বার্থের প্রতি নজর রাখবে; ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার পরে, অনুশীলন সমিতির পুরানো সভ্যদের যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের অবগতির জন্য আমি জানাচ্ছি যে এই বিবৃতিতেই অবনী মুখার্জি স্বীকার করেছেন যে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে বহিষ্কৃত। আর, এই ব্যাপারটি ঘটেছিল ১৯২২ সালে অবনী মুখার্জির ভারতবর্ষে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে।
ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের নিকট হতে ক্ষমা (Amnesty) চাওয়া ও পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করা অবনী মুখার্জির কি খেল ছিল তা বোঝা মুশকিল। কিসের ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি? তার বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমাই তো ভারতবর্ষে ছিল না। নির্বাসিতেরা তাঁদের বিরুদ্ধে বড় বড় মোকদ্দমা ঝুলছে মনের করতেন বটে, আসলে তা নয়। ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ক্ষমা চেয়ে ও পাসপোর্ট চেয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকটে দরখাস্ত করেছিলেন। তাঁকে যখন শর্তমূলক পাসপোর্ট মঞ্জুরের কথা জানানো হলো তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ক্ষমা মঞ্জুরের কিছু নেই। আর, অবনী মুখার্জি, যিনি দেশে কোনো রাজনীতিই কোনো দিন করলেন না তাঁর বিরুদ্ধে কিসের মোকদ্দমা থাকতে পারে? ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের কাজের ধরন। তার বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা যখন ছিল না তখন তিনি দেশে আসলেই তো পারতেন। এই অবস্থায় দেশে ফেরার পরে বার্লিন কমিটির সেক্রেটারি ডক্টর দত্তের কিছুই হয়নি। অবনী মুখার্জির কি হতো?
আজকাল পুরানো দিনের গোপন দলীল পত্র সরকারী মুহাফিজখানায় পড়তে পাওয়া যায়। এই বিষয়ে অবনী মুখার্জির কাগজ-পত্র পড়ার সুযোগ আমরা পেয়েছি। ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর কর্নেল সেসিল কে’র দীর্ঘ মন্তব্য আমরা পড়েছি। তাতে কোথাও লেখা হয়নি যে অবনী মুখার্জির বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা দায়ের থাকা অবস্থায় কিংবা জামিনে মুক্ত অবস্থায় তিনি পালিয়েছিলেন। কর্নেল কে’ অবনী মুখার্জির সিঙ্গাপুর হতে পালানোর কথাও লিখেছেন। ক্ষমা (amnesty) মঞ্জুরের কিছু না থাকা সত্ত্বেও লেখেননি যে ক্ষমা মঞ্জুরের কোনো কথাই উঠে না। আমাদের বিরুদ্ধে বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটির লেখা ব’লে যে চিঠিখানা অবনী মুখার্জি জাল করেছিলেন সেখানা দেখছি তাঁর বিরুদ্ধে জিনোভিয়েফকে পত্র লিখল কেন? হয়তো বাইরে সে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে বহিষ্কৃত এবং ভিতরে অন্য ব্যবস্থা করেছিল। ভারত গবর্নমেন্টের ধারণা ভিত্তিহীন ছিল। এর কোনো ভিত্তি থাকলে অবনী মুখার্জি কখনও তাঁর জাল পত্রের কপি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বিরোধী ব্রান্ডুলারকে পাঠাতে বলতেন না।
কিন্তু সত্যই কি অবনী মুখার্জি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন? দেশে এসে তিনি খেতেন কি? ২৭, সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়ীতে তাঁর ভাগের একখানা, দু’খানা কিংবা তিনখানা ঘর নিয়ে তিনি কি করে ইউরোপীয় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কাটাতেন? রুজি রোজগারের কি ব্যবস্থা তিনি করতে পারতেন? শিখেছিলেন শুধু তাঁতীর কাজ। তাও হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে সোবিয়েৎ দেশের একটি মেয়ে কি সোবিয়েৎ নাগরিক অধিকার ছেড়ে দিয়ে ভারতে আসতেন? নাগরিক অধিকার একবার ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলে আর তো তিনি তা কখনো ফিরিয়ে পেতেন না। ডক্টর অক্ষয় সাহার স্ত্রীর দুঃখের কথা কে না জানেন? অবনী মুখার্জি দেশে ফেরার জন্যে যদি এতই পাগল হয়েছিলেন তবে পাসকোর্ট মঞ্জুর হওয়া সত্ত্বেও দেশে তিনি এলেন না কেন? ১৯২৫ সালে কি ক’রে তিনি সোবিয়েৎ নাগরিক অধিকার নিলেন? আসলে অবনী মুখার্জির স্ত্রী-পুত্র সহ ভারতে ফেরার কোনও ইচ্ছা ছিল না, লেবর পার্টি গবর্নমেন্টে এসেছিলেন ব’লে সেই উপলক্ষে তিনি খনিকটা নিজেকে প্রচার ক’রে নিয়েছিলেন। এই কৌশলটা তিনি ভালোই জানতেন।
চট্টোপাধ্যায় অবশেষে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন।
দারুণভাবে আশাভঙ্গ হয়ে ১৯২৪ সালে অবনী মুখার্জি ভারতবর্ষ হতে বার্লিনে ফিরেছিলেন। যাঁরা তাঁকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন তাঁরাও হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁদের ভিতরে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯২৫ সালের প্রথম ভাগে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের অনুমতি ও পাসপোর্ট পেয়ে ভারতে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর প্রচুর সম্পত্তি ছিল। ইউরোপীয় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দেশে এসে বাস করার সংস্থা তাঁর ছিল। তবে স্ত্রী-পুত্রই তাঁর ছিল না। অবিবাহিত ছিলেন তিনি। মৌলবী বারারতুল্লাহ্ গদর পার্টির আমন্ত্রণে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯২৭ সালে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতাকামী লীগের (The League Against Imperialism and for National Independence) যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। এই লীগের হেড অফিস বার্লিনে ছিল। ১৯৩৩ সালে হিটলারের অভ্যুদয়ের পরে তিনি সোবিয়ে রাশিয়ায় চলে যান। তিনি রুশ নাগরিক অধিকার লাভ করেছিলেন। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে কমরেড ক্লেমেন্স পাম্ দত্ত আমায় ইংল্যান্ড হতে এক পত্রে লিখেছেন :
ক্লেমেন্স পাম্ দত্তের পত্রাংশ
“In 1936 or 1937, Chattopadhyaya had an academic post in the department of ethonology in Leningrad University. I Visited him at the Museum of Ethnology there which was apparently under his charge and about which he was very keen. My impression is that some one told me he died during the siege of Leningrad.”
(“১৯৩৬ কিংবা ১৯৩৭ সালে চট্টোপাধ্যায় লেনিনগ্রাড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষকতার একটি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সেখানে নৃতত্ত্বের মিউজিয়ামে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। দেখে যা বুঝেছিলাম তাতে মিউজিয়ামটি তাঁরই কর্তৃত্বাধীন ছিল এবং সেই সম্বন্ধে তাঁর প্রবল উৎসাহও ছিল। আমার ধারণা, কেউ আমায় বলেছিলেন যে লেনিনগ্রাডের অবরোধের সময়ে চট্টোপাধ্যঅয়ের মৃত্যু হয়েছিল।”)
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে মস্কোস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টকে বীরেন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা ক’রে নাকি জানতে পেরেছিলেন যে তিনি সোবিয়েৎ নাগরিক হয়েছিলেন এবং (Arteriosclerosis) রোগে মারা গেছেন। এই রোগে নাকি রক্তবাহী ধমনী শক্ত হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর সহিত ভারতের ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের একটা সমঝোতা হয়েছিল এই শর্তে যে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত করার জন্যে জার্মানী ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করবেন। কেননা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ পর্যুদস্ত হলে জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধ জয়ের পরম সুযোগ আসবে। শেষ পর্যন্ত জার্মানী ভারতীয় বিপ্লবীদের অর্থ-সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু অস্ত্র-সাহায্য করেননি। যে ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মানীর সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন চট্টোপাধ্যায় তাঁদের নেতৃস্থানে ছিলেন। জার্মানীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর মন ভরপুর ছিল। রুশ বিপ্লবের পেছনে যে ফিলসফি কাজ করেছিল সেটা বুঝতে তাঁর বছরের পর বছর সময় লেগেছিল। এই জন্যে শুরুতে তিনি সোবিয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন এবং লেনিনের বিরুদ্ধে প্রচার করেছন সর্বাপেক্ষা বেশী। লেনিনকে জার্মান অনুগৃহীত ব্যক্তি ইত্যাদি সব কিছু তিনি বলেছিলেন। এসব বিষয় দলীলপত্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মুহফিজখানায় নথিভুক্ত ছিল। এই কারণে সোবিয়েৎ দেশের কমিউনিস্ট নেতারা কখনও ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবী চট্টোপাধ্যায়কে ভালো চোখে দেখেননি। ওপরে আমি চিচারিনের কথা উল্লেখ করেছি। চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট ও সোবিয়েৎ নাগরিক হওয়ার পরেও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মুহাফিজখানায় রক্ষিত তাঁর নামীয় ফাইলটি তাঁর বিরুদ্ধে হয়তো গিয়ে থাকবে।
এখন আমি পি. উন্নিকৃষ্ণানের দিল্লীর ইংরেজি সাপ্তাহিক “লিঙ্ক”-এ মুদ্রিত (৩০ শে আগস্ট, ১৯৬৪) প্রবন্ধের বিষয়ে আরও কয়েকটি কথা বলব। অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে যত তথ্যের সমাবেশ তিনি তাঁর প্রবন্ধে করেছেন তার অধিকাংশই সত্য নয়। এই তথ্যগুলির সম্বন্ধে কিছু বলার আগে তিনি যে অবনীর নাম “অবনী ত্রিলোক মুখার্জি” (Abani Trilok Mukherjee) লিখেছেন সে সম্বন্ধে আমি জানাতে চাই যে বাঙালিদের ভিতরে এইরকম নাম লেখার রেওয়াজ একেবারেই নেই। অবনীর নাম অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়, আর তাঁর বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের নিকট হতে “রায়সাহেব” খেতাব পেয়েছিলেন। অবাঙালিদের বোঝার সুবিধার জন্যে আমি বলছি যে মুখোপাধ্যায়কে সংক্ষেপে মুখার্জিও বলা হয়। অবনী মুখার্জি নানা রকম চাল চালতেন। “অবনী ত্রিলোক মুখার্জি” নাম ধারণও তাঁর একটি চাল ছিল।
লেনিনগ্রাডের হস্তলেখা বিশারদদের ভুল জ্ঞানের পরিচয়
লেনিনগ্রাড হস্ত-লিখন বিশারদ এসে অবনীর একটা হাতের লেখা পরীক্ষা ক’রে বলেছেন যে লেখাটা অবনীর নয়, এম. এন. রায় তা জাল করেছেন। এই ব্যাপারটির সঙ্গে আমিও সংসৃষ্ট ছিলেম ব’লে এখানে আমারও কিছু বলা প্রয়োজন। ওপরে আমি জিনোভিয়েফকে সম্বোধন করা একখানা পত্র প্রকাশ করেছি। পেন্সিলে লেখা অবনী মুখার্জির এই পত্রের বিস্তৃত বিবরণও ছাপা হয়েছে। পত্রের এই মুসাবিদা একান্তভাবে অবনীলই হাতের লেখা। এম. এন. রায় তখন বার্লিনে ছিলেন। বার্লিনে হতে কলকাতায় এসে এম. এন. রায় এই পত্র কিছুতেই জাল করে যেতে পারেন না। এই পত্র আমি ডাকযোগে বার্লিনে এম. এন. রায়কে পাঠিয়েছিলেম। বোম্বের ফরেন পোস্ট অফিসে এই পত্রের ফটো কপি একজিবিটরূপে সরকার পক্ষ থেকে দাখিলও করা হয়েছিল। তারই প্রতিলিপি ওপরে মুদ্রিত হয়েছে। অবনীর মূল পেন্সিলে লেখা মুসাবিদা বার্লিনে এম. এন. রায়ের হাতে পৌঁছেছিল। হাইকোর্টের পেপার বুকে মানবেন্দ্র নাথের আ,ায় লেখা এক পত্রে আছে যে অবনীর সেই মুসাবিদা তখনও তিনি পাননি। আমার মনে আছে পরে তিনি তার প্রাপ্তি স্বীকার করেছিলেন। হাইকোর্টের পেপার বুকে তা নেই। তিনি তা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রেকর্ড রুমে অবনী মুখার্জি নামীয় ফাইলে রেখে দিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, আজও এই দলীল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মুহাফিজখানায় রক্ষিত আছে। অবশ্য আজ হয়তো পেন্সিলের লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
উন্নিকৃষ্ণানের লেখা হ’তে এটা বোঝা যাচ্ছে না যে অবনীর ব্যাপারে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কখন অনুসন্ধান করেছিলেন এবং কেন করেছিলেন? ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে অবনী মুখার্জি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হতে, কাজেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্ক হতেও বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকটে দাখিল করার জন্যে বার্লিনে নিজে নিজের যে বিবৃতি তৈয়ার করেছিলেন তাতে তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল হতে বহিষ্কৃত। আরও বলেছেন যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের পতন হয়েছে এবং তা স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের উপদলে পরিণত হয়েছে, ইত্যাদি। ১৯২৬ সালের শেষভাগে (কিংবা ১৯২৭ সালের শুরুও হতে পারে) অবনী আমাদের যে পত্র লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন যে পার্টির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কি সোবিয়েৎ নাগরিক অবনী ১৯২৭ সালে সোবিয়েৎ ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছিলেন? তা না হলে তাঁর সম্বন্ধে অনুসন্ধান কেন করানো হলো? লেনিনগ্রাড হতে হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টদের কেন ডাকা হলো? আর তাঁরা যদি এলেনই তবে তাঁরা কলকাতায় অবনী যে জাল মুসাবিদা তৈয়ার করেছিলেন সেটাই বা পড়লেন না কেন? ওই দলীল হতেই তো সব কথা উঠেছিল। সেটাও এম. এন. রায় জাল করেছিলেন বলে কি বিশারদরা মত দিয়েছিলেন? তবে কি এই বিশারদ ব্যাপারটাই আগাগোড়া একটা গোঁজামিল? আমি নিজে এই ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেম বলেই এটা আমার এত ক’রে বলতে হলো। জিনাভিয়েফকে সম্বোধিত অবনীর কলকাতার জাল পত্রখানাই তাঁকে সাজা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তবু মানবেন্দ্রনাথ অবনীর জীবনী কেন জাল করলেন? এত নির্বোধ ছিলেন তিনি? অবনী যে আমেরিকা গিয়েছেন তা তিনি বহু লোককে বলেছেন। তাঁর গুণগ্রাহীদের বলেছেন। আমি ওপরে এক জায়গায় তার নাম উল্লেখ করেছি।
আরও কয়েকটি তথ্য আমি দিচ্ছি।
ভারতবর্ষে অবনীকে গিরেস্তারের জন্যে কোনো পুরস্কার ঘোষিত হয়নি। তিনি যখন গোপনে ভারতে এসেছিলেন তখন ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের মিস্টার হেয়ার স্কট বলেছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা আদালতে প্রমাণিত হবে না। তাঁর গতিবিধির সব খবর গবর্নমেন্ট জানতেন। ভাইয় বলেছেন তাঁর গতিবিধির ডোর তাঁদের হাতে ধরা আছে।
সোবিয়েৎ ইউনিয়নে অবনী মুখার্জি তাঁর জীবনের শেষ ক’ বছর কোন্ বিষয়ে কতটা পাণ্ডিত্যলাভ করেছিলেন আমি তা জানিনে। তবে, “গ্রাম ভারত” (Rural India?) সম্বন্ধে অবনী মুখার্জি সোবিয়েৎ ইউনিয়নে যে পুস্তক লিখেছিলেন তা সে দেশে মুদ্রিত হয়েছিল। তার পরে দেখা গেল যে পুস্তকখানি ভুলে ভরা। তাই, সে পুস্তক আর প্রকাশিত হয়নি।
অবনী মুখার্জি কোনো দেশের কোনো ইউনিভার্সিটি হতে ‘ডক্টরেট’ পাননি। অবশ্য সোবিয়েৎ ইউনিয়নে তাঁকে ডক্টরেটে ভূষিত করা হয়েছিল কিনা সে খবর আমি নিতে পারিনি।
হাঁ, একটি কথা। ১৯২১ সালে ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা মস্কোতে অবনীর বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন যে অবনীর সিঙ্গাপুরের স্বীকারোক্তির ফলে ভারতে অনেক লোক ধরা পড়েছেন, তাঁদের ভিতরে কোনো কোনো লোকের ফাঁসিও হয়েছে। এই সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের বিশেষ চেষ্টা আমি করেছি। বাহান্ন- তিপান্ন বছর পরে তথ্য কি পাওয়া যায়? কুলচন্দ্র সিংহ রায় তখন কলকাতায় ন্যাশনাল কলেজে ছিলেন। অন্য কাউকে না পেলে শেষ তাঁর নিকটে বার্তা পৌছানোর কথা ছিল। তিনি বেঁচে আছেন, আশি বছরের ওপরে তাঁর বয়স। অবনী ধরা পড়ার আগেই তিনি গিরেফ্ফার হয়েছিলেন। কাজেই অবনীর স্বীকারোক্তির ফলে তিনি গিরেতার হননি। তিনি বলেন পিংলের স্বীকারোক্তির ফলেই তিনি গিরোর হয়েছিলেন। রাসবিহারী বসুর সঙ্গে তিনি বানারসে গিয়ে দেখা করেছিলেন। অবনীকে বার্তা ও টাকা দিয়েছিলেন অবিনাশচন্দ্র রায়। ১৯১৫ সালে তিনি শাংহাইতে ছিলেন। এই অবিনাশচন্দ্রের কথা কেউ কিছু বলতে পারছেন না। কুলচন্দ্র সিংহ রায়ও কিছু জানেন না। চন্দনগরের যে পাঁচ জনের সঙ্গে অবনীর পরে পরে দেখা করার কথা ছিল তাঁদের মধ্যে শুধু মণীন্দ্ৰ নায়েক বেঁচে আছেন, আশির ওপরে তাঁর বয়স। তিনি শুধু জানিয়েছেন যে অবিনাশচন্দ্র রায়কে মতিলাল রায় জানতেন। আর বেশী কিছু তিনি বোধহয় বলতে চাইলেন না। তাঁকে অবনীর স্বীকারোক্তি আমি পড়িয়েছি। এই স্বীকারোক্তির ফলে চন্দননরের ফরাসী প্রজাদের ধরা পড়ার কোনো কথাই উঠে না।
আমার মনে হয় অবনীর স্বীকারোক্তির ফলে ভারতের কারুর ফাঁসি তো দূরের কথা, কেউ কোথাও ধরাও পড়েননি। কুমিল্লার গিরীন্দ্র সেন গিরেফ্ফার হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা অবনী মুখার্জির জন্যে কিনা তা বলা শক্ত। অবনী সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের বাইরের লোক ছিলেন, ভিতরের কিছুই জানতেন না তিনি। অন্তত সেই যুগে অবনী একজন দুঃসাহসিক ভবঘুরে ছিলেন, তার বেশী কিছু নয়। তাঁর আর একটি বিশেষ গুণ ছিল এই যে তিনি ছিলেন একজন মিথ্যার সম্রাট। হাঁ, ধরা পড়ার সময়ে অবনীর নিকট একটি ডায়েরী ছিল। সেই ডায়েরীতে অনেক কিছু লেখা ছিল। তার জন্যে ভারতবর্ষে কারুর কিছু ক্ষতি হয়েছিল কিনা আমি বলতে পারব না।