দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

গয়া কংগ্রেসের নামে কমিউনিস্ট ইন্‌টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসের বাণী

গয়া কংগ্রেসের নামে কমিউনিস্ট ইন্‌টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসের বাণী

ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সমীপেষু,

গয়া, ভারতবর্ষ

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক চতুর্থ কংগ্রেস আপনাদের উদ্দেশে তাদের আন্তরিক অভিনন্দন পাঠাচ্ছে। ইংরেজ আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত হবার জন্য ভারতীয় জনগণের যে সংগ্রাম, আমরা প্রধানত সেই সম্পর্কেই আগ্রহী। এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ সমেত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত জনসমষ্টির পরিপূর্ণ সহানুভূতি এবং সমর্থন আপনাদের প্রতি রয়েছে।

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের লুন্ঠনকারী চরিত্র সম্পর্কে আমরা কমিউনিস্টরা পরিপূর্ণভাবে সচেতন। এই সাম্রাজ্যবাদ প্রাচ্যের জনগণের উপর অমানুষিক শোষণ চালাচ্ছে এবং সেই জনগণকে জবরদস্তি অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদ অবস্থায় রেখে দিয়েছে যাতে ধনতন্ত্রের সীমাহীন লোভকে পরিতৃপ্ত করা যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে উপায়ে ভারতীয় জনগণের জীবন-শোণিত শোষণ করে তা- সুবিদিত। তাকে কঠোরভাবে নিন্দা করবার কোন ভাষা নেই, আবার সাধারণ ভাবে নিন্দা করার মধ্যেও কোন কার্যকারিতা নেই। ভারতের ব্রিটিশ শাসন বলপ্রয়োগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বলের দ্বারাই তাকে বজায় রাখা হয়েছে, কাজেই একমাত্র সহিংস বিপ্লবের দ্বারাই সেই শাসনকে উৎখাত করা সম্ভব এবং করতেও হবে তাই। যদি সম্ভব হয় তবে আমরা হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করারই পক্ষে। আত্মরক্ষার জন্য ভারতীয় জনগণ অবশ্যই হিংসাত্মক পথ গ্রহণ করবে। হিংসার উপর নির্ভর করে যে বিদেশী আধিপত্য বেঁচে আছে তাকে হিংসাত্মক পথে ছাড়া খতম করা যাবে না। ভারতের জনগণ আজ এক মহান বৈপ্লবিক সংগ্রামে লিপ্ত। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সর্বান্তকরণে সেই জনগণের সঙ্গে রয়েছে।

বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের শেষ লক্ষ্য

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসবার উপরই নির্ভর করছে ভারতীয় জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্ৰগতি। বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের শেষ লক্ষ্য এই সাম্রাজ্যবাদী কবল থেকে বেরিয়ে আসা। আর যা করেই হোক, আলোচনার মাধ্যমে বা শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যে কোন রূপ সম্পর্ক রক্ষা করাই হোক না কেন, তার আদত অর্থই হলো ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীর স্বার্থে এবং তাদের দ্বারাই ভারতীয় জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হওয়া। খুব বেশী কিছু হলে দেশীয় উচ্চতর শ্রেণীগুলির সহযোগিতায় সেই নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হবে, কিন্তু ঐ নিয়ন্ত্রণ সেখানে বহাল থাকবে এবং জাতির স্বাধীনতাকে ব্যাহত করবে।

বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদ হলো বিপ্লবের রণধ্বনি

বিশ্ব ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির ভগ্নদশা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বঞ্চিত জনগণের জাগরণজনিত বিশ্বের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং এই দুটি বৈশিষ্ট্য সাম্রাজ্যবাদকে আজ তার পুরনো ধরনের শোষণ ব্যবস্থা বদলাতে বাধ্য করছে। সাম্রাজ্যবাদ আজ তাই চেষ্টা করছে কতকগুলি সুযোগ- সুবিধা দিয়ে সম্পত্তিশালী উচ্চ শ্রেণীগুলির সহযোগিতা লাভ করতে। ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তার শাসনব্যবস্থার শুরু থেকেই সমস্ত জমিদার শ্রেণীকে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসাবে পেয়েছে। এবং অধিকতর উন্নত ধরনের উৎপাদন যন্ত্রের বিকাশকে বাধা দিয়ে এই শ্রেণীর বিনাশকে ঠেকিয়ে রেখেছে। সামন্ততন্ত্র এবং তার অবশেষ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার দুর্গ, তার সামাজিক ভিত্তিকে ধ্বংস না করে জনগণের জাতীয় চেতনা উদ্রেককারী অর্থনৈতিক শক্তিগুলির বিকাশ সম্ভব নয়। এই কারণেই যে শক্তিগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে প্রতিকূল শক্তি সামন্ত প্ৰভু এবং আধুনিক সম্ভ্রান্ত ভূস্বামীদের পক্ষেও সেগুলি হলো বিপজ্জনক, আর এইজন্যে বিদেশী শাসকদের কাছে তাদের এই আনুগত্য। সম্পত্তিশালী উচ্চ শ্রেণীগুলির সাক্ষাৎ অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ভদ্রোচিত জীবিকার অধিকারী অথবা উচ্চ সরকারী পদগুলিতে অধিষ্ঠিত সৌভাগ্যশালী বৃদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে এত বেশী রকম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত যে তারা একটা বৈপ্লবিক রূপান্তর চাইতেই পারে না। সেইজন্যে তারা বিবর্তনবাদী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রচার করে, যার কর্মসূচী হলো সাম্রাজ্যবাদের আওতার মধ্যে থেকে স্বায়ত্তশাসন” এবং সেটা লাভ করতে হবে ক্রমে ক্রমে শান্তিপূর্ণ পথে এবং আইনানুগ উপায়ে।

স্বাধীনতা অথবা দাসত্ব-এর মধ্যে কোন মধ্যপথ নেই

যে উদারনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী নীতি ঘোষিত হলো ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কারের মধ্যে দিয়ে এবং তার উদ্বোধন ঘটল ১৯১৯ সালের ভারত সরকারের আইন প্রবর্তনার মধ্য দিয়ে সেটা শীঘ্রই হোক বা দেরিতেই হোক শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে হোম রুল অঘবা স্বায়ত্তশাসনের অধিকারে গিয়ে দাঁড়াবে। স্বাধীন আইরিশ রাষ্ট্র এবং ইজিপ্টের “স্বাধীনতা”র মতো ব্যর্থ তামাসার আর একটি পুনরাবৃত্তি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আশা করা যেতে পার। যারা এই রকম কোনো পরিণামকে জাতীয় প্রশ্নের সমাধান হিসাবে দেখে থাকে তাদের সাম্রাজ্যবাদের অনুচর বলে ধরতে হবে জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন অবশ্যই এই ধরনের সমস্ত ব্যক্তিদের সংস্রব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে এবং ব্রিটিশের পক্ষ থেকে “হৃদয়ের পরিবর্তন” জাতীয় কোন মোহ থেকে সেই আন্দোলনকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। ভারতবর্ষের জনগণ হয় স্বাধীনতা অর্জন করবে নতুবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিষ্পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করবে, এ ছাড়া অন্য কোন মধ্যবর্তী পথ নেই। ভারতীয় জনগণ রক্তাক্ত বৈপ্লবিক সংগ্রাম ছাড়া বর্তমান দাসত্ব থেকে কখনই নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না।

বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সামাজিক বনিয়াদ সকল শ্রেণীকে নিয়ে হতে পারে না, কারণ অর্থনৈতিক কারণ বশতঃই সমস্ত শ্ৰেণী এই আন্দোলনে অংশ নিতে এগিয়ে আসবে না। সেই কারণে আপনাদের আন্দোলনের মেরুদণ্ড হলো জনগণের সেই সমস্ত অংশ যাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোনরকম সাময়িক কৌশলগত ব্যবস্থায়ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনি। জনগণের এই অংশ হলো জাতির সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর অংশ, কারণ তাদের মধ্যে রয়েছে দেউলিয়া মধ্যবিত্ত, নিঃস্ব কৃষক এবং শোষিত মজুরশ্রেণী। যে পরিমাণে এই প্রকৃত বিপ্লবী জনগণকে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে দূরে নিয়ে আসা যাবে, এবং আত্মিক ও জাগতিক বিষয়ে সামন্ত প্রভু এবং পুঁজিবাদী উচ্চ শ্রেণীগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা দোলায়মান ও আপসকামী নেতৃত্ব থেকে মুক্ত করে আনা যাবে ঠিক সেই পরিমাণে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

গত দু’বৎসর ছিল ভারতবর্ষে শক্তিশালী বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সময়কাল। কৃষক এবং সর্বহারার জাগরণ ব্রিটিশের অন্তরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই রকম একটা গভীর বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে পরাধীন জাতিগুলির সংগ্রামকারীর সম্পর্ক

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে পরাধীন জাতিগুলির সংগ্রামকারীর সম্পর্ক বৈপ্লবিক আদর্শবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং পারস্পরিক স্বার্থের উপরই তার ভিত্তি। আমাদের সহানুভূতি এবং সমর্থন মিষ্টি কথার সঙ্গে জড়িয়ে ফাঁকা বুলির মধ্যে নিবদ্ধ নয়। আমরা ভারতীয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে অবশ্যই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াব এবং সেই জন্যেই আপনাদের সংগ্রামকে দুর্বল করবে এবং ভারতবর্ষের স্বধীনতার স্বার্থের ক্ষতি করবে এমন ভুলগুলোকে দেখিয়ে না দিলে আমরা আমাদের বিপ্লবী কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হব।

জাতীয় মুক্তির আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সর্বদাই নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।

১। সাম্রাজ্যবাদী প্রভৃত্বের সম্পূর্ণ ধ্বংসসাধন ভিন্ন জনগণের জীবনের স্বাভাবিক উন্নতির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

২। ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে কোন প্রকারের আপস-রফা জাতির বৃহত্তর অংশের অবস্থার কোন উন্নতি সাধন করবে না।

৩। হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে ছাড়া ব্রিটিশ প্রভৃত্বের উচ্ছেদ সাধন করা যাবে না।

৪। কেবলমাত্র মজুর এবং কৃষকেরাই বিপ্লবকে জয়ের পথে নিয়ে যেতে সক্ষম। [৩৮]

[38. অধ্যাপক কৃষ্ণ চক্রবর্তী অনুগ্রহ করে এই দলীলখানি বাঙলায় তর্জমা করে দিয়েছেন।]

বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের কর্মসূচী

সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চ শ্রেণীগুলির সর্বপ্রকার সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবার জন্যে জাতীয় কংগ্রেসকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে, গণতান্ত্রিক সাধরণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই তার রাজনৈতিক কর্মসূচী। জাতির বৃহত্তম অংশ অর্থাৎ শ্রমজীবী জনসমষ্টি এই কর্মসূচীর পক্ষে সমবেত হবে, তার কারণ প্রচলিত ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া তাদের বর্তমান অবস্থার কোন উন্নতিসাধন সম্ভব নয়। জাতীয় মুক্তির হেতুর সপক্ষে জনগণকে টেনে আনবার জন্যে অক্লান্ত এবং সাহসিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। বর্তমান স্বতঃস্ফূর্ত গণ- অভ্যুত্থানগুলি প্রচার কার্যের উপযোগী খুব উর্বর ক্ষেত্র প্রদান করছে। জনগণের বৈপ্লবিক চেতনা বৃদ্ধি করতে হলে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে তার রাজনৈতিক কর্মসূচী ছাড়াও একটা অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার। প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বিশ্বস্ত সামন্ত জমিদারশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী দরিদ্র কৃষকদের আন্দোলন পরিচালন করে কংগ্রেস একদিকে জনগণের মধ্যে তার শিকড়কে গভীরভাবে প্রোথিত করতে পারবে, অপরদিকে এই আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের একেবারে ভিত্তিমূলে আঘাত করবে। যে-দেশীয় সৈন্যবাহিনী ভারতবর্ষের বুকে ব্রিটিশ শাসনকে জিইয়ে রেখেছে দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে থেকেই তাঁদের সংগ্রহ করা হয়। এই কারণে কৃষি বিপ্লবের একটি কর্মসূচী দেশীয় সৈন্যদের জাতীয় স্বাধীনতার সপক্ষে টেনে আনতে পারবে।

উপসংহারে, জনগণের বিপ্লবী শক্তির দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসসাধনের আপনাদের চূড়ান্ত সাফল্যের প্রতি আমাদের দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করছি।

ভারতীয় জনগণের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি পৃথিবীর অগ্রসর সর্বহারা শ্রেণীর সমর্থন এবং সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আমরা আবার আপনাদের দিচ্ছি।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! ভারতের মুক্ত জনগণ দীর্ঘজীবী হোক!

ভ্রাত্রীয় অভিনন্দন
হামবার্ট ড্রোজ
সম্পাদক, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের
চতুর্থ কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলী

গোড়ায় গলৎ

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে কেন্দ্র করে আমরা ভারতে কাজ আরম্ভ করেছিলেম। কিন্তু তার গোড়াতেই গলৎ থেকে গিয়েছিল। আগেই আমি বলেছি যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তরফ হতে ভারতের কাজের চার্জে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনি থাকলেন কয়েক হাজার মাইল দূরে জার্মানীতে, আর আমরা থাকলাম উপমহাদেশ ভারতবর্ষের নানা স্থানে। না আছে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে, না আছে আমাদের দেশের ভিতরও একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়।

আমাদের পরস্পরের ব্যবধান পাঁচ-ছয় শত বা হাজার-বারো শ’ মাইল হতে শুরু ক’রে দেড় হাজার মাইল পর্যন্ত। যদি আমায় কলকাতা হতে কানপুর যেতে হয় দূরত্ব ছয় শত মাইলের বেশী। কিছু বেশী দেড় হাজার মাইল দূরের পেশোয়ারে যদি যেতে চাই তবে প্রচণ্ড খরচের ব্যাপার তো আছেই, তাছাড়া আটকের ওখানে সিন্ধু নদ পার হওয়ার সময়েই পুলিস জিজ্ঞাসা করবে “কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ?” কিতাবে লিখিতভাবে না হলেও নিষিদ্ধ দেশ ছিল উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। দেশের ভিতরেও আমাদের যোগাযোগ ছিল চিঠিপত্রের মারফতে।

মানবেন্দ্রনাথ রায় আন্তর্জাতিক ডাক বিভাগের ওপরে ভরোসা করেই তাঁর আন্তর্জাতিক কার্যকলাপ আরম্ভ ক’রে দিলেন। জার্মানীতে বসেই কিছু ঠিকানা তিনি নিজে জোগাড় ক’রে নিয়েছিলৈন, আর আমরাও তাঁকে অনেক ঠিকানা পাঠিয়েছিলেম। “ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেস” কাগজে দেওয় পোস্ট বক্সের ঠিকানাতেও বহু লোক পত্রাদি লিখলেন। ভারত হতে পত্র পেলেই রায় উৎফুল্ল হতেন, লেখন সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন তিনি মনে করতেন না।

ইম্পিরিয়েল পুলিস ইনটেলিজেন্সের ব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত। ভারতবর্ষেও পুলিস ইনটেলিজেন্সের ব্যবস্থা সুগঠিত ছিল। কমিউনিস্টের ব্যাপারে আবার তদারক করতেন ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত ইন্‌টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর। জার্মানীতেও এম এন রায়ের কার্যকলাপের ওপরে ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের ভারতীয় চরও জার্মানীতে অনেক ছিল।

তখনকার দিনে সপ্তাহের একটি বিশিষ্ট দিনেই শুধু বিদেশের ডাক আসত। আবার সপ্তাহের একটি বিশিষ্ট দিনেই বিদেশে ডাক যেত। ইউরোপের ডাক জাহাজ বোম্বেতে আসত এবং বোম্বের ফরেন পোস্ট অফিস হয়েই ভারতের ডাক যেত ইউরোপে। বিদেশ হতে আমাদের যাঁদের চিঠি লেখা হতো তাঁদের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। আমাদের পুস্তিকা ও কাগজ অবশ্য অপেক্ষাকৃত বেশী ঠিকানায় পাঠানো হতো। তার মধ্যে দু’একটি ঠিকানা হয়তো পুলিসের নজর এড়িয়ে যেত। কিন্তু চিঠিপত্রের বেলায় সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমাদের নাম ও ঠিকানার একটি তালিকা ইন্‌টেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা তৈয়ার ক’রে ফেলেছিলেন। বিদেশী ডাকের দিন বিদেশী ডাকের আলাদা ব্যাগ প্রত্যেক ডেলিভারি পোস্ট আফিসে আসত। তা থেকে আমাদের নামীয় জিনিসগুলি ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা অতি সহজে বার করে নিতে পারতেন। চিঠিপত্রগুলি খুঁজে পাওয়া আরও সহজ পদ্ধতি পুলিস আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন যে বিদেশের কোন্ কোন্ পোস্ট আফিসে সাধারণত আমাদের নামীয় পত্রগুলি পোস্ট করা হতো। এসব খবর ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স ভারতীয় এজন্টরাও হয়তো জোগাতেন। মোটের ওপরে, ওই সব পোস্ট আফিসের মোহর পড়েও এদেশের পুলিসেরা আমাদের পত্রগুলি বার করে ফেলতেন। আমাদের পত্রাদি বের হয়ে পড়লে সেগুলি পড়ে তাঁরা কিছু টুকে রেখে খাম বন্ধ ক’রে প্রাপকের নিকটে পাঠিয়ে দিতেন, কিংবা কেনো কোনো ক্ষেত্রে ফটো কপি রেখে পত্রগুলি ছেড়ে দিতেন। আবার এমনও হতো যে পত্রগুলি আমাদের নিকটে আর পাঠানোই হতো না। ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকদের হাত ফসকে দু’চারখানি পত্র যে আমাদের নিকটে পৌঁছায়নি তাও নয়।

একটি বিশ্ববিপ্লবী সংস্থার তরফ হতে আন্তর্জাতিক আন্দোলনের পরিচালনা, সেই আন্দোলন আবার বহুলাংশে গোপন, ডাক বিভাগের মারফতে চলতে পারে না। এই নিয়ে আমরা যে রায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসব তার কোনো উপায় ছিল না। তিনি ছিলেন সেই দেশে, আর আমরা এই দেশে। মধ্যখানে দুস্তর সাগর। চিঠিতে যদি আমরা আলোচনা করতাম তবে তার কথা সঙ্গে সঙ্গেই পুলিস জেনে যেতো। বিদেশেও তিনি সন্দিগ্ধ চরিত্রের লোকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছিলেন। মস্কোতে কিঞ্চিৎ জেরা করলেই নলিনী গুপ্ত ধরা পড়ে যেতেন। নলিনী গুপ্ত তাঁকে কি বলেছিলেন আমরা তা জানতাম না। অথচ এই নলিনী ১৯১৪ সাল হতে পুলিসের নিকটে বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন। রামচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সুহৃৎ রায় পুলিসের নিকটে স্বীকারোক্তি দিয়ে পুলিসের দ্বারা বিদেশে প্রেরিত, –এই কথা তাঁর সন্ত্রাসবাদী পার্টির বন্ধুরা বারে বারে জানিয়েছেন। তিনি তাতে কান দেননি।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কর্তব্য ছিল অন্য ব্যবস্থা করা,-বার্তাবহের আনাগোনা করানোর ব্যবস্থা। তাতে খরচ হতো প্রচুর, কিন্তু খরচ তো আর তিনি নিজের পকেট হতে করতেন না, খরচ করতেন বিশ্ববিপ্লবী সংস্থা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। তাঁদের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের জন্যে খরচ তাঁরা করতেনই। আর, মানবেন্দ্রনাথের হাত দিয়ে খরচ কি তাঁরা কিছু কম করেছিলেন?

বছরে তিন কিংবা চার বার বার্তাবহের আনাগোনার ব্যবস্থা করতে হয়তো সে খবরও কোনোদিনও জানাজানি হয়ে যেত পারত, কিন্তু আমরা আরও অনেক দিন পরে ধরা পড়তুম। সংগঠনের কাজ আরও অনেকখানি এগিয়ে যেতো। আর কিছু না হোক, সংগঠনের ভিত্তি কিছুটা মজবুত অন্তত হতো। আমি যতটা ভাবতে পারি ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজার ভিতর হতে অখ্যাতনামা, অথচ বিশ্বস্ত কোনো কমরেডকে বার্তাবহ হিসাবে বাছাই করলে এবং ইউরোপের সীমানায়ও বিশেষভাবে গোপণতা অবলম্বন করলে সুদীর্ঘকাল কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না। ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজার কথা আমি এই কারণে বলছি যে একবার কোনো ব্রিটিশ প্রজা ভারতে প্রবেশ করতে পারলে তাঁকে ভারত হতে বহিষ্কার করার কোনো আইন ছিল না, তাঁর নিকটে যদি কোনো পাসপোর্ট না থাকে তাহলেও। এই বার্তাবহ এম এন রায়ের মারফতে পাওয়া কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের লিখিত নির্দেশ ও উপদেশ আমাদের নিকটে বহন ক’রে আনতে পারতেন। আবার, ইউরোপে ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের নিকট হতে লিখিত রিপোর্টও তিনি নিয়ে যেতে পারতেন। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে ফরেন্ এক্সচেঞ্জের কোনো ঝামেলা ছিল না। বিদেশী যাত্রীরা মোটা-টাকা সঙ্গে বহন করতে পারতেন। কাজেই, আমাদের বার্তাবহ ভারতবর্ষের কাজ চালানোর জন্যে সঙ্গে অনেক টাকাও আনতে পারতেন

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল একটি একক ও অভূতপূর্ব বিশ্ববিপ্লবী সংস্থা ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত পৃথিবীতে তারা শাখা-প্রশাখা স্থাপন ও কাজের সীমানা বিস্তার। বিশ্বে আপন কাজের বিস্তার করার জন্যে এই বিপ্লবী সংগঠন নিশ্চয় টাকা খরচ করবেন এবং ভারতবর্ষের জন্যেও করবেন। এই খরচ তাঁরা গোপনে ও খোলাখুলিভাবে যেমন ইচ্ছা করতে পারতেন। এতে কার কি বলার ছিল? অবশ্য, সেই সময়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে স্বনামে এদেশে টাকা খরচ করা অসম্ভব ছিল। আমাদের শ্রেণী-শত্রুরা তবুও প্রচার করতেন যে কমিউনিস্টরা রাশিয়ার ‘এজেন্ট’ ছিল। হাঁ, আমাদের কেউ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হেড় কোয়ার্টার্স স্থাপনের অনুমতি দিতেন না। একথা সকলের বোঝা দরকার যে কমিউনিস্ট পার্টিই সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টকে পরিচালনা করতেন। সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে চালাতেন না।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ভারতের সন্ত্রাসবাদী ও ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর নিকট হতে মোটা টাকা গ্রহণ করেছিলেন এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতেও টাকা পাওয়ার জন্যে লালায়িত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে আমাদের শ্রেণী-শত্রুরা কোনো দিন একটি কথাও বলেননি।

যাক, আমি আবার মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কার্যকলাপের কথায় ফিরে আসছি। চিঠিপত্রের মারফতে তিনি ইউরোপ হতে বৈপ্লবিক কাজের পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু তিনি কাদের পত্র লিখছিলেন আর কারাই বা তাঁকে পত্র লিখছিলেন এ বিষয়ে যাচাই কে করলেন? তিনি যদি কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন তবে সেই বিপ্লবী ১৯২০ সালের রাজকীয় ক্ষমা প্রদর্শনের পর কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেটা তিনি কি ক’রে বুঝলেন? আমার কথাই ধরা যাক। আমাকে তবুও নলিনী গুপ্ত দেখে গিয়েছিলেন, আমি কে, কি করছি, আগে কি করতাম এ সব রিপোর্ট তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর সন্ত্রাসবাদী বন্ধুরা আমাকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের গ্রুপের লোক হিসাবে ধ’রে নিয়েছিলেন। জার্মানী হতে আমার বিষয়ে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরাও অনুসন্ধান করিয়েছিলেন। অমরেন্দ্রনাথ বসু (সিমলা ব্যায়াম সমিতির বিখ্যাত অমর বসু) কুত্সুদ্দীন আহ্মদ সাহেব এক সময়ে (এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে) মাওলানার ম্যানেজার ছিলেন এবং সেই সময়ে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা মাওলানার নিকটে যাতায়াত করতেন। মাওলানার গ্রুপের লোক হওয়া কিছু খারাপ কাজ নয়। আবদুর রজ্জাক খান তাই ছিলেন, কিন্তু আমি কখনও মাওলানার গ্রুপের লোক ছিলাম না। মুহম্মদ আলী (খুশী মুহম্মদ) তাঁর ছাত্র জীবনের বন্ধু অধ্যাপক গুলাম হুসয়নকে পেশোয়ার হতে কাবুলে ডেকে নিয়ে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে এনেছিলেন এবং সাংগঠকি কাজ করা জন্যে তাঁকে পাঞ্জাবে পাঠিয়েছিলেন। আর আর সব লোকই চিঠি-পত্রের মারফতেই এম এন রায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁদের পত্র পড়েই রায় বুঝে নিতেন কে উপযুক্ত লোক, কে নয়। এস এ ডাঙ্গে ও সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের যোগ্যতার পরিমাপ তিনি এইভাবেই করেছিলেন। যাঁর সঙ্গে একেবারেই চেনা নেই, যাঁর বিষয়ে কোনো দিন কিছু শুনিনি তাঁর কাছ থেকে একখানা পত্র পেলেই কি আমি আনন্দে নেচে উঠব? এম এন রায় কিন্তু তাই করতেন। কোনো বিপ্লবীর পক্ষে, বিশেষ করে যে বিপ্লবী একটা বিরাট দায়িত্ব নিয়ে গোপন কাজের চালনা করেন তাঁর পক্ষে, এটা গর্হিত কাজ। এম এন রায়ের হাতে প্রচুর টাকা ছিল। ভারতবর্ষ হতে ছয় বছর অনুপস্থিত থাকার ফলে তাঁর চেহারায় নিশ্চয় পরিবর্তন এসেছিল। আরও মোটা টাকা খরচ করে এবং ছদ্মবেশ ধারণ করে কোনও সওদাগরী জাহাজে নিশ্চয়ই তিনি ভারতবর্ষে অন্তত একবার আসতে পারতেন। তখন সব কিছু জেনেশুনে ও নিজের চোখে দেখে তিনি এই সওদাগরী জাহাজেই কিংবা অন্য কোনো জাহাজে ফিরে যেতে পারতেন। তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষ ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি অবনী মুখার্জির কাজ তদারক করার জন্যে সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদকে এইভাবে ভারতে পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি ফিরেও গিয়েছিলেন। এম এন রায় এরূপ কষ্ট স্বীকার করা উচিত মনে করেননি। আমার মনে আছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে ভারতে এসে তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন কিনা। আমার মনে হয় তিনি আসলে আমাদের মন বুঝতে চেয়েছিলেন। কথায় আছে বুড়ী সত্যই কি আর মরতে চান? তিনি শুধু নাতি-নাতনীর মন বুঝতে চান।

১৯২৩ সালের ২১ শে মার্চ তারিখে এম এন রায়কে লেখা আমার এক পত্রে (কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার এক্‌জিবিট নম্বর ১৫এ) শিশিরকুমার ঘোষ ও বৈদ্যনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে আমি বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেম।

শিশিরকুমার ঘোষ সম্বন্ধে আমি পুস্তকের ১২০ পৃষ্ঠা হতে ১২২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অনেক লিখেছি। পুলিসের প্ররোচক এই শিশিরের সব কথা আমি যথা সময়ে এম এন রায়কে জানিয়েও দিয়েছিলেম। তবুও যতীন মিত্র জার্মানীতে গিয়ে তখন এম এন রায়কে জানালেন যে মুজফফর আমদের সঙ্গে শিশিরের ব্যক্তিগত ঝগড়া আছে (কিসের ঝগড়া? আমি কি অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেম?) তখনই তিনি শিশিরের প্রতি সদয় হয়ে উঠলেন এবং তার পত্রোত্তর দিলেন। আমাকে রায় লিখলেন যে তিনি শিশিরের পত্রের উত্তর দিয়েছেন, আর শিশির ইউরোপে যেতে চাইলে আমি যেন তাকে পাঠাই। এর পরে রাগে ও ক্ষোভে আমি কি করব বুঝতে পারছিলেম না। যে যতীন মিত্রের মুখে রিপোর্ট পেয়ে তিনি শিশিরকুমার ঘোষ সম্বন্ধে প্রায় গদগদ হয়ে উঠেছিলেন সেই যতীন মিত্রকেই পরে আমায় লেখা এক পত্রে তিনি একটি “আস্ত গাধা” বলেছিলেন।

আমি যখন শিশির ঘোষের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেম তখন শিশির যতীন মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাঁর অনেক তোয়াজ করেন। তাঁকে মাঝে মাঝে খাইয়েছেন, হয়তো কিছু টাকাও দিয়েছেন। তাই, তিনি জার্মানীতে গিয়ে শিশির সম্বন্ধে ওই রিপোর্ট করেন।

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর গ্রুপের সভ্য বৈদ্যনাথ বিশ্বাস সম্বন্ধে দু’একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্ধু আমায় সাবধান করে দিয়েছিলেন, -বলেছিলেন লোকটি বিশ্বাস করার মতো নয়। তাঁদের হাতে কোনো দলীল ছিল না, আর তা থাকা তখন সম্ভবও ছিল না। মানবেন্দ্রনাথকে আমি একথা জানিয়েছিলেম। তবু তিনি আমায় জানালেন যে, বৈদ্যনাথকে তাঁর চাই। আমি যেন তাঁকে একখানি থার্ড ক্লাস টিকেট কিনে দিই, আর ১০ পাউন্ড হাত খরচ বাবতে দিই। মনে হয় বৈদ্যনাথের নিকটে পাসপোর্ট ছিল। এই ব্যাপার নিয়ে রায়ের সঙ্গে আমার পত্রের মারফতে ঝগড়া হয়ে যায়। আমার পত্রাংশ উইন্ডমিলার ও ওভার স্ট্রীট তাঁদের বিরাট গ্রন্থ ‘কমিউনিজম্ ইন ইন্ডিয়া’তে উদ্ধৃত করেছেন (৬১ পৃষ্ঠা)।

সেই সময়ে বৈদ্যনাথ বিশ্বাস বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের জেনেরেল সেক্রেটারি ছিলেন। মুকুন্দলাল সরকারের অনেক কাগুজে প্রতিষ্ঠানের এটাও একটি ছিল। একটি প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি ছিলেন বলেই বৈদ্যনাথ বিশ্বাস মানবেন্দ্রনাথের নিকটে আকর্ষণের বস্তু ছিলেন। ১৯১৫ সালে রায় যখন শেষবারের মতো বিদেশে যান তখন তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসের পরিচয় ছিল কিনা তা বলা আমার পক্ষে কঠিন। আমার ধারণা যে পরিচয় ছিল না। কারণ বিশ্বাসের সেদিনের কর্মক্ষেত্র ছিল দুমকা, কলকাতা নয়।

সেই সময়ে (১৯২০-এর দশকে) লোকে ভেবে আশ্চর্য হতেন যে বিশ্বাস বেতন কোথা হতে পান? তাঁর সংগঠনের কোনো টাকা ছিল না। ব্রিটিশের নিকট হতে রাজা খেতাব-পাওয়া বাঙলা দেশের একজন বড় জমিদার (পাইকপাড়ার রাজা মুণীন্দ্র সিংহ) তাঁদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর নামই শুধু ধার দিয়েছিলেন, টাকা দিতেন না। বৈদ্যনাথ বিশ্বাস বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের আফিসে চাটাই পেতে পড়েও থাকতেন না। তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। গুলাম হুসয়ন তাঁর স্বীকৃতিমূলক বিবৃতিতে বলেছেন, বিশ্বাস লাহোরে তাঁর বাড়ীতেও অতিথি হয়েছেন।

বিশ্বাসকে যে সন্দেহ করা হতো তার কিছু প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় কানপুরে একটি বড় তাঁবুর ভিতরে কমিউনিস্ট কনফারেন্স আরম্ভ হয়েছিল। একজন লোক আলোয়ান দিয়ে তাঁর সমস্ত শরীর ঢেকে, শুধু দু’টি চোখ বাইরে রেখে সভার মধ্যস্থলে বসেছিলেন। আমি কিছুই লক্ষ্য করিনি, কিন্তু লাহোরের শাসুদ্দীন হাসান আমায় দেখালেন যে ওই দুটি চোখ বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের। শাসুদ্দীনের সঙ্গে কানপুরেই সবেমাত্র আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনিই একজন ভলানটিয়ারকে ডেকে এনে সভা হতে বিশ্বাসকে বার করে দিলেন। আশ্চর্য এই যে এই শাসুদ্দীনের সঙ্গে আবার মুকুন্দলাল সরকারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি দীর্ঘকাল জেলে ছিলেম। বিশ্বাস সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলার সুযোগ পাইনি। শুনেছিলেম রায়ও তাঁকে আর ইউরোপে ডেকে নেননি। তবুও দেখলাম কমিউনিস্টদের ভিতরেও বিশ্বাসের প্রতি কারুর বিশ্বাস নেই।

১৯২২ সালে দু’একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্ধু বৈদ্যনাথ বিশ্বাস সম্বন্ধে কেন আমায় সতর্ক করেছিলেন তার কারণ এত বছর পরে আমি এখন বুঝেছি। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর “History of the Freedom Movement in India” নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ২৯৯-৩০০ পৃষ্ঠায় একটি সরকারী রিপোর্ট হতে একটি উদ্ধৃতি ছেপেছেন। এই রিপোর্টটির নাম “Connections with the Revolutionary organization in Bihar and Orissa, 1906-16, “ Compiled by W. Sealy marked “Strictly Secret”. This report is printed by the Bihar Government in 1917. ডক্টর মজুমদারের তুলে দেওয়া উদ্ধৃতিটি আমি নীচে দিলাম :

“Baidyanath Biswas eventually made a very detailed statement of his complicity in, and knowledge of various branches of the revolutionary conspiracy. He spoke of his connection with Bipin Ganguli’s gang, which its members committed; the pabna party under abinash Roy and Jatin Hui; the Barisal parties under Narendra Mohan Ghosh Choudhuri (transported for life in the Sibpur and concerned in the Jaipru dacoity); Jatin Mukherjee’s notorious gang; the Garden Reach, Beliaghata and Agarpara taxicab dacoities; his association with Phani Chakravarti and Atul Ghosh of the gun- running conspiracy; the handing over of 26 of the stolen pistols to Jadugopal Mukherjee, one of the most dangerous and active members of the conspiracy; and much else of which he had either personal or second-hand knowledge.” (He descirbed his first meeting with Bipin Ganguli Who used to train a number of young recruits to the revolutionary party, and the whole history of the theft of arms and ammunition from Rodda’s).”

বঙ্গানুবাদ

“কোনও একটি ঘটনার পরিণামে খুঁটিয়ে বিবৃতি দিতে গিয়ে বৈদ্যনাথ বিশ্বাস বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রের যে-সব শাখার সহিত নিজে লিপ্ত ছিলেন, আর যে-সব শাখার বিষয়ে তিনি পরিজ্ঞাত ছিলেন এইসব কিছুর কথাই তিনি বলে দেন। বিপিন গাঙ্গুলীর গ্যাং-এর সহিত তাঁর সম্পর্কের কথা তিনি বলেছিলেন; এই দলের সভ্যরা যে অস্ত্র চুরি করেছিলেন তাঁর কিছুদিন আগে হ’তে তাঁরা নজরে পড়ে গিয়েছিলেন; অবিনাশ রায় ও যতীন হুইয়ের পরিচালনাধীন পাবনা পার্টির কথা তিনি বলেছিলেন; তিনি বলেছিলেন নরেন্দ্রমোহন ঘোষ চৌধুরীর অধীন বরিশালে পার্টিগুলির কথাও (নরেন্দ্রমোহন ঘোষ চৌধুরী শিবপুর ডাকাতির সঙ্গে তাঁর সংস্রব ছিল); যতীন মুখার্জির কুখ্যাত দলের কথা তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন; তিনি বলে দিয়েছিলেন গার্ডেনরীচ, বেলিয়াঘাটা ও আগরপাড়ার ট্যাক্সি ডাকাতিগুলির বিবরণ; ফণী চক্রবর্তী ও অস্ত্রচালান ষড়যন্ত্রের অতুল ঘোষের সঙ্গে যে তার সংযোগ ছিল তাও তিনি বলেছিলেন; ষড়যন্ত্রের একজন বিপজ্জনক ও সদা কর্মলিপ্ত সভ্য যাদুগোপাল মুখার্জির হাতে যে ২৬টি চুরি করা পিস্তল তুলে দেওয়া হয়েছিল সে বিবৃতি দিতেও বৈদ্যনাথ বিশ্বাস ভোলেননি; এবং আরও অনেক এমন কথা তিনি বলেছিলেন যে-সব তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানতেন কিংবা অপরের মুখে শুনেছেন।” (তিনি বিপিন গাঙ্গুলীর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা বলেছিলেন। নূতন দলে আনা কিছু সংখ্যক বিপ্লবীকে বিপিন গাঙ্গুলী শিক্ষা দিতেন তাও বৈদ্যনাথ বলেছিলেন। রডার অস্ত্র ও অস্ত্রোপকরণ চুরির গোটা ইতিহাসটাই তিনি বলে দিয়েছিলেন)।

এ কথা মনে রাখা দরকার যে রায় কিন্তু আমাকে বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের থার্ড হ্রাস টিকেট কেনার টাকা ও হাত খরচের দশ পাউন্ড কখনও পাঠাননি।

এস এ ডাঙ্গের বিরুদ্ধে তার স্বহস্তলিখিত কিছু দলীলপত্র পাওয়া যাওয়ার জওয়াবে সে একনাগাড়ে চার দিন বক্তৃতা দিয়েছিল। তখন আমার বিরুদ্ধে কিছু মাল-মসলা বা’র হয় কিনা দেখার জন্যে সে “কমিউনিজম্ ইন্‌ ইন্ডিয়া” উল্টে- পাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ গ্রন্থের ৬১ পৃষ্ঠা তার চোখে পড়ে যায়। তা থেকে সে সভায় বলে যে মুজফফর বড় সন্দেহবাতিকগ্রস্ত লোক। তার প্রমাণস্বরূপ সে বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের কথা বলে। এমন জোর দিয়ে কথাটা সে বলেছিল যে যেন বৈদ্যনাথ বিশ্বাসকে ইউরোপ পাঠিয়েই দেওয়া হয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি আমার কথা ডাঙ্গে কেন উল্লেখ করেছিল? অপরাধ তো করেছিল সে। ক্ষমতা চেয়ে ও মুক্তি ভিক্ষা করে কানপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে একখানি পত্র ও ভাইয়ের নিকটে দুখানি দরখাস্ত তো সে-ই পাঠিয়েছিল। ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের গুপ্তচর হওয়ার ইচ্ছা তো সে-ই প্রকাশ করেছিল।

আমরা যারা কাজ আরম্ভ করেছিলেম

আমাদের কথা আমি আগেই কিছু কিছু বলেছি। যা কিছু বলার ছিল তার সব কথা বলিনি। এখন সে সব কথা বলি। আমি “স্মৃতিকথা” লিখছি। তাই ইতিহাসের মতো করে না লিখে কথার পিঠে কথা বসিয়ে যাচ্ছি মাত্র। ইতিহাস “লেখার জন্যে” আমি আমাদের পার্টির দ্বারা নিয়োজিতও হইনি। তবে, কবি যে গেয়েছেন, “শাসন-সংযত কণ্ঠে গাহিতে পারি না জননী!” আমার অবস্থা সেরকম নয়। ইচ্ছা করলেই আমি দলীল-পত্র সমন্বিত অনেক কিছু লিখে যেতে পারি। তাতে পুঁথি বেড়ে যাবে। সেই পুঁথি পড়বেন কে? তাছাড়া, আমার বয়স প্রতিদিন একদিন করে বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে জীবনেরও একদিন ক্ষয় হচ্ছে।

আগেই উল্লেখ করেছি যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সভ্যরা ১৯২০ ও ১৯২১ সালে তাশকন্দে আর মস্কোতে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকজন যখন পেশোয়ার জেলে বন্দী তখনই আমরা ১৯২২ সালে এ দেশে কাজ আরম্ভ করি।

শওকত উস্‌মানী

শওকতা উসমানী ১৯২১ সালে মস্কোতেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। আমরা যারা পেশোয়ারের বন্দী ছিলাম না, আমাদের ভিতরে উসমানীই ছিল অপেক্ষাকৃত পুরানো।

ভারতের বিকানীর রাজ্যের প্রজা ছিল উসমানী। তার পরিবার বর্ণে রাঠোর রাজপুত। অর্থাৎ, উসমানীদের পূর্ব পুরুষ ইস্লাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে হিন্দু ছিল।

উসমানীর প্রকৃত নাম মাওলা বখ্শ্। বিকানীরের ডুঙ্গর কলেজের (আসলে একটি হাই ইংলিশ স্কুল) রেজিস্টারে তার এই প্রকৃত নামটিই লেখা ছিল। উসমানীর সময়ে বানারসের কংগ্রেস নেতা সম্পূর্ণানন্দ ছিলেন ডুঙ্গর কলেজের হেড্‌ মাস্টার।

মাওলা বখ্শ্ নামের অর্থ ঈশ্বরের দান। মাওলা বখ্শের স্বকৃত দ্বিতীয় নামকরণ হচ্ছে শওকত উসমানী। এর অর্থ উসমানীর (Ottoman) মহিমা। তুর্কি সাম্রাজ্যকে উসমানীয় সাম্রাজ্যও বলা হতো। নিজের নামের পরিবর্তন ইত্যাদি হতে বোঝা যায় যে খিলাফৎ আন্দোলনের দ্বারা উসমানী অতি মাত্রায় প্রভাবিত হয়েছিল।

ইনটেলিজেন্স বিভাগের রিপোর্ট হতে জানা যায় যে, ১৯২০ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে উসমানী অকৃতকার্য হয়েছিল। এই ১৯২০ সালেই সে হিজরাৎ আন্দোলনের যোগ দিয়ে দেশত্যাগও করেছিল। কিসে সে ফেল করেছিল তা জানিনে। ইংরেজি সে খুব ভালো জানত। পারসী ভাষায়ও তার জ্ঞান ভালো দেখছি। মানবেন্দ্রনাথ তাঁর “স্মৃতিকথা”য় উসমানীকে কোনো ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেজুয়েট ব’লে উল্লেখ করেছেন।

উসমানীর চরিত্রে নানারকম জটিলতা ছিল। সে যেমন ছিল বদমেজাজী, তেমনিই ছিল অসহিষ্ণু। তার ওপরে সে আত্মকেন্দ্রিকও ছিল। তাশকন্দে ও মস্কোতে যখন ভারতের কমিউনিস্ট পাঠি গঠন করা হয়েছিল তখন প্ৰতিবাদী আচার্য প্রথমে তাতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে এম এন রায়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে আলাদা পার্টি গঠন করতে থাকেন। মস্কোতে মুহাজিরদের মুখে মুখে আবদুর রব ও আচার্য এই দু’টি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো।

ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়া সত্ত্বেও উসমানী তলে তলে আবদুর রব ও আচার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯২১ সালে সে-ই সর্বপ্রথম এম এন রায়ের নিকটে প্রস্তাব করেছিল যে সে দেশে ফিরে গিয়ে সেখানেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে ও বৈপ্লবিক কাজের পরিচালনা করতে চায়। তার গোপন পরিকল্পনা ছিল যে আবদুর রব ও আচার্যের পক্ষে সে বহুসংখ্যক বিপ্লবী কর্মীকে জড়ো করবে এবং এই কর্মীদের সাহায্যে এম এন রায়কে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনাল হতে উৎখাত করবে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল উসমানীর দেশে ফেরার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। স্থির হলো যে যাঁরা দেশে ফিরবেন তাঁরা একসঙ্গে দু’জন ক’রে রওয়ানা হবেন। রফীক আমদের বিবৃতি অনুসারে প্রত্যেককে একজন করে সাথী বেছে নিতে বলা হয়েছিল। শওকত উসমানী সাথী বেছেছিল সৈয়দ মসউদ আলী শাকে।

এখানে মসউদ আলী শাহের কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া দরকার। উত্তর প্রদেশের মীরাট জিলায় একটি তহসীলের নাম সাধানা। এখানে একটি অভিজাত আগান পরিবার বাস করতেন। সম্ভবত এখনও বাস করেন। কোনো যুদ্ধ- বিগ্রহের সময়ে এই পরিবারটি সাধানায় এসে বাস ইতিয়ার করেছিলেন কিংবা ইংরেজের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই পরিবারেই একটি শিক্ষিত ছেলের নাম সৈয়দ মসউদ আলী শাহ্। তার বয়সে বড় জেঠতুতো ভাই সৈয়দ ইকবাল আলী শাহ্ এক সময়ে নামকরা ইংরেজি জার্নালিস্ট ছিলেন। থাকতেন লন্ডনে এবং লিখতেন মিডল্ ঈস্ট সম্বন্ধে।

মসউদ আলী শাহ্ ১৯২০ সালে হিজরাৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তাশকন্দে আবদুল কাদির খান (একজন ব্রিটিশ চর) ও সে একত্রে নবগঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। মুহাজিরদের ভিতরে তখনও কেউ কেউ মসউদ আলী শাকে শত্রুর চর মনে করতেন। কিন্তু সে এম এন রায়ের ও এভেলিন রায়ের স্নেহ আকর্ষণ করেছিল। এতকাল পরে লিখতে বসে আজ দলীলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে মস্‌উদ আলী সত্যসত্যই ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের বৈদেশিক বিভাগের চর ছিল এবং ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের কর্নেল সেসিল কে’র মতো হোমরা চোমরার সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল।

শওকত ওসমানী ও মসউদ আলী শাহ ইরানের গবর্নমেন্টের পাসপোর্ট পেয়ে গিয়েছিল। এই পাসপোর্টেই তারা ইরানের ভিতর দিয়ে ভারতে পৌঁছেছিল। তারা করাচি পৌঁছেছিল, না, বোম্বে পৌঁছেছিল তার সঠিক বিবরণ আমি কোথাও পাইনি।

১৯২৩ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে শওকত উসমানী কলকাতা এসে আমার সঙ্গে দেখা ক’রেছিল। (এত সঠিক তারিখ মনে রাখা সম্ভব নয়। একটি দলীলে তারিখটি এখন পাওয়া গেছে।) বলল, সে সবে কলকাতায় ঘোরাঘুরি করে বানারস ফিরেছিল। সেখানে পৌঁছেই সে রায়ের চিঠি পায়। তাতে উপদেশ ছিল যে উসমানী যেন কলকাতায় গিয়ে মুজফফর আমদের সঙ্গে দেখা করে। “তাই আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি”, উসমানী বলল। সেই সময়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। সে তখন আমায় জানিয়েছিল যে ভারতে ফিরে এসে সে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের সঙ্গে, অর্থাৎ, এম এন রায়ের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছিল। এই কারণে সে আবার ইরানের শিরাজ শহরে ফিরে যায়। শিরাজ হতে সোবিয়েৎ কন্‌সাল তাম্পাকোফের সাহায্যে সে রায়কে একখানি সুদীর্ঘ পত্র লেখে এবং দেশে ফিরে গিয়ে কি কি সে দেখেছে তাও সেই পত্রে রায়কে সে জানায়। এইভাবে সংযোগ স্থাপন করে সে দেশে ফিরে আসে। মসউদ আলী শাহকে লাহোরে খুঁজতে গিয়ে পায়নি। বোধ হয় দেখা করার জন্যে তাদের উভয়ের নির্দিষ্ট স্থান ছিল লাহোর। কলকাতায় কিন্তু উস্‌মানী আমায় বলেনি যে মসউদ আলী শাহ্ আবার মস্কো ফিরে গেছে এবং সেখান থেকে গেছে বার্লিনে, যদিও বার্লিন হতে এম এন রায়ের পত্রের ভিতরে সে আমায় একখানি পত্র পাঠিয়েছিল। তাতে সে আমায় শিরাজি নামক একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেছিল।

উসমানী প্রথম বার ভারতে ফিরে যে আবার শিরাজে গিয়েছিল এ কথা আমাদের পার্টির ভিতরে কেউ কেউ জানতে পারেন, কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই তা জানেন না। কিন্তু ভারত গবর্নমেন্টের ইনটেলিজেন্স বিভাগ ব্যাপারটি জানতেন। গিরেস্তার হওয়ার পরে উসমানী পুলিসের নিকটে যে বিবৃতি দিয়েছে তা থেকে তাঁরা তো জেনেছেনই, কিন্তু তার আগেও তাঁরা জেনেছেন। মসউদ আলী শাহ্ তাঁদেরই লোক ছিল।

শওকত উস্‌মানী যে আচার্য ও আবদুর রবের হয়ে সাংগঠনিক কাজ করতে দেশে ফিরেছিল একথা এম এন রায় জেনে ফেলেছিলেন। এদিকে উসমানী সারা ভারতবর্ষ ঘুরেও আচার্য ও আবদুর রবের পক্ষে কিছুই করতে পারল না। কেউ সাড়া দিলেন না। হতাশ হয়ে সে শিরাজে ফিরে গেল এবং নিজের ত্রুটি, বিচ্যুতি ও অপরাধের জন্যে ক্ষমা চেয়ে তাম্পাকোফের সাহায্যে এম এন রায়ের নিকটে এক সুদীর্ঘ পত্র লিখল। এটাই ছিল উসমানীর শিরাজে যাওয়ার আসল কারণ।

পেশোয়ারের মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় কাগজপত্রে পাওয়া যাচ্ছে যে রায় ১৯২২ সালের ২১শে মে তারিখে বোম্বের ছোটানীর ঠিকানায় উসমানীকে একখানা পত্র লেখেন। তারপরে ১৯২২ সালের ২৭ শে জুন তারিখে উসমানীর গোপন ঠিকানায় আরও একখানা পত্র রায় তার নিকটে পাঠান। এই পত্রে মসউদ আলী শাহের খবর তিনি জানতে চেয়েছেন। তার মানে ১৯২২ সালের ২৭ শে জুন তারিখেও মসউদ আলী শাহ্ মস্কো বা বার্লিনে পৌঁছয়নি। তাতে উসমানীর লজ্জাকর ব্যবহারের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন যে তাঁকে তাঁরা আর একবার কাজের সুযোগ দিবেন।

(“Roy Wrote again on the 27th June, 1922, to a covering address and asked for news of Masood Ali Shah. He referred to disgraceful act of Usmani, but said that they were giving him another chance”) রায় ও মিসেস্ রায়ের পরম স্নেহের পাত্র মসউদ আলীকে তাঁরা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না।

কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফ

উসমানী তখনও কলকাতাতেই ছিল। হঠাৎ আমরা প্রমাণ পেয়ে গেলাম যে ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা তার আসার খবর পেয়ে গেছে এবং তাকে একান্তভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাফিজ মসউদ আহমদ (মসউদ আলী শাহ্ নয় নামক এক ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এসে জুটেছিল। তার বাড়ী চট্টগ্রাম জিলার চন্দ্রঘোনায়, আর সে শিক্ষালাভ করেছিল সাহারানপুর জিলার বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায়। ধার্মিক শিক্ষার ভিতর দিয়ে বিপ্লবী গড়ে তোলার একটি বিদ্যালয় ছিল দেওবন্দ। এটা ছিল হাফিজ মস্‌উদ আহমদকে সঙ্গে নেওয়ার একটি কারণ। কয়েকমাস হ’তে তার চাল-চলন আমাদের ভালো লাগছিল না। সে ছিল কুত্সুদ্দীন সাহেবেরও বন্ধু। একদিন কুত্সুদ্দীন সাহেবের বাড়ীতে (৭, মৌলবী লেন, কলকাতা ১৬) সে তার শিরওয়ানীটি খুলে হাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে পায়খানায় যায়। তখন আমি তার পকেটে হাত দিয়ে একটি ছোট্ট নোট বই বের করে ফেলি। দেখলাম তাতে পারসী ভাষায় উসমানীর হুলিয়া লেখা রয়েছে। আমি দারুণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার পেছনে তখন পুলিস পাহারা। অনেক কষ্টে তাদের এড়িয়ে উসমানী কিংবা অন্য কারুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তাকে বললাম যে তার হুলিয়া পুলিসের চরের ডায়েরীতে লেখা হয়ে গেছে, আমি নিজে চোখে দেখেছি। সে কলকাতায় গিরেফ্ফার হোক এটা আমি চাইনে। এই অবস্থায় তাকে অন্যত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম আমিই।

আশলীগড় কলেজের, পরে আশলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির আরবী ও পারসী ভাষায় অধ্যাপক খাজা আবদুল হাই তাঁর প্রিয় ছাত্র কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফকে সঙ্গে নিয়ে গয়া কংগ্রেস হ’তে সোজা আশলীগড়ে ফিরে না গিয়ে কলকাতায় তাঁর পুরানো বন্ধু কুত্সুদ্দীন সাহেবের বাড়ীতে এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আরও দু’জন ছিলেন- কেরালায় (কালীকটের?) গোপাল মেনন ও মহীদীন কয়া। সকলের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়। তবে খাজা আবদুল হাই ও কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফের সঙ্গে বেশী। খাজা সাহেব দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়েছেন, মৌলবী ওবায়দুল্লার প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। একজন বিপ্লবীও তিনি ছিলেন। ১৯১৫ সালে লাহোর গবর্নমেন্ট কলেজের ও মেডিকাল কলেজের ১৫ জন ছাত্রকে সীমান্তের বাইরে পাঠানোর পেছনে তাঁর প্রেরণা ছিল। লাহোর হতে ‘কিসান’ নাম দিয়ে একখানি উর্দু দৈনিক তিনি বার করেছিলেন। ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের সামরিক আইনের (Matrial law) যুগে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজাও হয়েছিল। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগেই খাজা সাহেব মানবেন্দ্রনাথ রায়ের “ইন্ডিয়া ইন্‌ ট্রানজিশান” ইত্যাদি পড়েছিলেন। পাঞ্জাবের ঘটনার পরে তিনি অধ্যাপক হিসাবে আশলীগড় কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে মাওলানা মুহম্মদ আলীর নেতৃত্বে আশলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও অধ্যাপকের বাইরে এসে ন্যাশনাল মুসলিম ইউনিভার্সিটি স্থাপন করেন। কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফ আর খাজা সাহেবও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। আশরাফ পড়াশুনায় নামকরা ছাত্র ছিলেন। রাজনীতিতে ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। তখন বোধহয় বি এ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন কিংবা সবে বি এ পাস করেছিলেন। ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন আশরাফ। তাঁদের দু’জনই যাওয়ার সময়ে ওয়াদা করে গেলেন যে আমাদের লাইনেই তারা রাজনীতি করবেন। পরে খাজা আবদুল হাই বেশী বয়সে বিয়ে করে সক্রিয় রাজনীতিতে আর থাকেননি, আর আশরাফ কখনও রাজনীতি ছাড়েননি। তিনি পরেকার খ্যাতনামা কমিউনিস্ট নেতা ডক্টর কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের পি. এইচ. ডি.। রাহুল সাংকৃত্যায়ণকে আশরাফ বলেছেন যে শুরু হতেই এম. এন. রায়ের ওপরে তাঁর ঘৃণা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে (১৯২২ সালের শুরুর দিকের) গোপন পুলিস রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই যে কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফ বি. এ. জার্মানীতে এম. এন. রায়ের নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

খাজা আবদুল সাহেবের নামে একখানি পত্র দিয়ে আমি উসমানীকে আশলীগড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেম। নতুন পরিচয় করার জন্যে উসমানীর পক্ষে খুবই ভালো জায়গা ছিল আশলীগড়। উসমানীর জন্যে সত্যই সুব্যবস্থা করা হয়েছিল। মনে হয় ব্যবস্থাটি আশরাফই করেছিলেন। আশরাফরা মালিকানা রাজপুত। ভারতবর্ষে একমাত্র মালিকানা রাজপুতদের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে হয়। এদিক থেকে তাঁরা খুবই উদার। মালিকানা রাজপুতদের ইলাকাতেই, আচনেরা ও কালানুরে উসমানীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু উসমানী হাতে বেশী সময় পায়নি। আমি ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের কথা বলছি। ওই বছরেরই মে মাসের ৯ই তারিখে কানপুরে উসমানী গিরোর হয়ে যায়। কানপুর কমিউনিস্ট (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সংস্রবে আবার আমি উসমানীর কথা বলব।

শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার

দেশের ভিতরে যাঁরা পার্টি গড়ার প্রথম যুগে কাজে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের ভিতরে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার দু’টি বিশেষ নাম। তাঁদের কথা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। তাঁদের বিষয়ে যা আমি আগে বলিনি তা এখন আমি এখানে বলব। আমি এখানে দু’টি নাম একত্রে উল্লেখ করলাম। তার কারণ, তাঁদের দু’জনই চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য সাধন করতে চেয়েছিলেন।

ডাঙ্গে আমায় নিজেই বলেছে যে তার “গান্ধী বনাম লেনিন” (Gandhi Versus Lenin) নামক ইংরেজি পুস্তক ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রীইন্দুলাল যাজ্ঞিক যে ইংরেজিতে রণছোড়দাস ভবন লোটবালার (Ranachoddas Bhavan Lotvala) ছোট্ট জীবনী লিখেছেন তাতেও এ কথা স্বীকৃত হয়েছে। আমি এই পুস্তকের প্রথম মুদ্রণে লিখেছি “গান্ধী বনাম লেনিন” কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের দৃষ্ট আকর্ষণ করেছিল। তাতেই মানবেন্দ্ৰ নাথ রায়ের মারফতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ডাঙ্গের সংযোগ স্থাপিত হয়। ডাঙ্গের সঙ্গে কথাবার্তার ভিতর দিয়ে আমি তাই বুঝেছিলেম। এখন অনেক দলীল-পত্র আমার হাতে এসেছে। সে সব হতে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে ১৯২১ সালের কিংবা ১৯২২ সালের প্রথম কয় মাস “গান্ধী বনাম লেনিন” কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।

ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর সেসিল কে’ লিখেছেন যে ১৯২২ সালের জুন মাসে “বোম্বে ক্রনিকল” নামক ইংরেজি দৈনিকে ডাঙ্গের “গান্ধী বনাম লেনিন”- এর সমালোচনা ছাপা হয়। তা থেকেই তিনি ডাঙ্গের নামের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। সমালোচনা ছাপা হয়। তা থেকেই তিনি ডাঙ্গের নামের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। এখন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে “গান্ধী বনাম লেনিন” ডাঙ্গেকে লোটবালার সঙ্গে পরিচিত করেছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তাকে এই পুস্তক পরিচিত করেনি। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত “সোস্যালিস্ট” পত্রিকাই ডাঙ্গেকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত করেছিল। সোবিয়েতের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান ও ইরানের সোবিয়েত দূতাবাসগুলিতে ডাঙ্গে তার “সোস্যালিস্ট” কাগজই পাঠাত। ১৯২২ সালের জুন মাসের পরে এবং সেপ্টেম্বর মাসের আগে কোনো এক সময়ে ডাঙ্গে ও সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার এম. এন. রায়ের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিলেন। সিঙ্গারাভেলু রায়কে পত্র লিখেছিলেন তিনি একজন জেলে, সমুদ্র-কূলে বাস করেন, আর মাছ ধরেন। নিঃসন্দেহে জেলে তিনি ছিলেন, পৃথিবীর একটি চমৎকার সমুদ্র-কূলে মাদ্রাজের ২২, সাউথ বীচে তিনি বাসও করতেন, কিন্তু মাছ তিনি ধরতেন না। তবে তাঁর ভাইয়ের মাদ্রাজের ইউরোপীয়ান ক্লাবে মাছ জোগান দেওয়ার কন্ট্রাক্ট ছিল।

“Shortly before Charles Ashilegh’s arrival in Bombay ( 18th or 19th September 1922 ) Roy Had obtained two important recruits in India-Dange in Bombay and Singaravelu in Madras.”

“S.A. Dange first came to notice when in June 1922, the ‘Bombay Chornicle’ Published a revies of a book written by him- ‘Gandi V. Lenin’”.

(Cecil Kaye : Communism in India, Page – 23 )

ডাঙ্গে ও সিঙ্গারাভেলুর সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের যোগাযোগ যে উল্লিখিত সময়ে হয়েছে তাতে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। “ইন্ডিয়া ইন্‌ ট্রানজিশন” পড়ে সিঙ্গারাভেলু রায়কে পত্র লিখেছিলেন, বলেছিলেন তামিল ভাষায় তিনি তাঁর তর্জমা করবেন— এই কথা রায় আমাকে লিখেছিলেন। কি বলে সিঙ্গারাভেলু রায়কে প্রথম পত্র লিখেছিলেন তার উল্লেখ আমি ওপরে করেছি। ডাঙ্গে তার ‘সোস্যালিস্ট’ প্রথম পত্র লিখেছিলেন তার উল্লেখ আমি ওপরে করেছি। ডাঙ্গে তার ‘সোস্যালিস্ট’ প্রথম সংখ্যা হতেই “অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি’র সভ্যদের নিকটে পাঠাচ্ছিলেন। কুত্সুদ্দিন আহ্‌মদ সাহেবের কাকা, অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নজমুদ্দীন আহ্মদ সাহেব অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভ্য ছিলেন। তাঁর ওখানেই প্রথম আমরা “সোস্যালিস্ট” দেখি। কে এই ডাঙ্গে এই কথা আমরা ভাবছিলেম এমন সময় এম. এন. রায়ের একখানি পত্র এলো। তিনি তাঁর পুরনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্ধুদের ওপরে বড় বেশী চটেছিলেন। লিখেছিলেন ওঁরা মেস্ ও বোডিং হাউসের তপোশের ওপরে শুয়ে শুয়ে বিপ্লবের স্বপ্নই দেখবেন, কিন্তু বিপ্লব কখনও করবেন না। আমাকে বলেছিলেন, আপনি বরঞ্চ বোম্বেতে গিয়ে ডাঙ্গের সহযোগে একটি দোকান গড়ে তুলুন যে দোকানে আমাদের সাহিত্য পৌঁছিয়ে দেওয়া যাবে। বুঝলাম ডাঙ্গে আমাদেরই লোক।

প্রায় একই সময়ে ডাঙ্গে আর সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারকে পেয়ে মানবেন্দ্রনাথের আনন্দের অন্ত ছিল না। ২রা নভেম্বর (১৯২২) তারিখে তিনি মস্কো হতে যে পত্র ডাঙ্গেকে লিখেছিলেন তার উল্লেখ আমি আগে করেছি। যোগাযোগ হতে না হতেই তেইশ বছরের ছেলে ডাঙ্গে সম্বন্ধে যে উচ্চ বিশেষণ তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই ডাঙ্গে ২৩শে ডিসেম্বর (১৯২২) তারিখে সোস্যালিস্ট কাগজে রায়ের প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে লিখল। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের সিঙ্গারাভেলুও কম গেলেন না। গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে আমাদের প্রোগ্রামকে সমর্থন করতে উঠে তিনি বললেন যে তিনি একজন কমিউনিস্ট। তারপর বললেন যে তিনি বলপ্রোয়োগ না করার পদ্ধতিতে (nov- violence) বিশ্বাসী। আরও বললেন :-

“Than method has been disputed by our fellow Communist abroad. I told them that we have adopted that method as a practical necessity, and that I believe in that method. Therefore they differ fundamentally as to method.’

(Overstreet and Windmiller : Communism in India, Page 57 ) (“বিদেশে আমার কমিউনিস্ট ভ্রাতৃগণ বলপ্রয়োগ না করার পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেন না। আমি তাঁদের বলেছি এর ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই আমরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। আমি এই পদ্ধতিতে বিশ্বাস করি। অতএব, এর সঙ্গে তাঁদের বিরোধ মৌলিক।”) আমি রায়কে লিখলাম, সিঙ্গারাভেলু কেন নিজেকে কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করলেন? তা না করেই তো তিনি বক্তৃতা দিতে পারতেন। আমার বলার ইচ্ছা ছিল যে সিঙ্গারাভেলূ নিরুপদ্রব অসহযোগ করে আদালত ছেড়েছেন কোনও বল প্রয়োগ না করাতেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া মজুরদের ভিতরে কাজ করার জন্যে অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির নিকট হতে ১৬ হাজার টাকা তিনি পেয়েছেন কিংবা পেতে যাচ্ছেন। (টাকাটা তিনি তখন বা পরে পেয়েছিলেন), এই অবস্থায় বলপ্রয়োগ করাতে বিশ্বাস তিনি করতেও পারতেন না। কিন্তু নিজেকে কমিউনিস্ট বলে পরিচয় না দেওয়াটা তাঁর ইচ্ছাধীন ছিল। রায় ধারণা করে নিয়েছিলেন যে সিঙ্গারাভেলুর এই সব কিছু কৌশল মাত্র ছিল। রায় আমায় পত্রোত্তরে জানালেন যে সিঙ্গারাভেলু সম্বন্ধে আপনি যা বলেছেন তা ভুল। তিনি যোগ্য ব্যক্তি ইত্যাদি। ডাঙ্গে ও সিঙ্গারাভেলু সম্বন্ধে পরে রায়ের ধারণায় পরিবর্তন এসেছিল। ভারতের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রান্সে একটি বৈঠকের কথা উঠেছিল। রায় লিখলেন যে ডাঙ্গে যোগ দিবে কিনা সে বিষয়ে তিনি সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছেন। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গারাভেলু সম্বন্ধে রায়ের মত ছিল “A person meaning well but stupid and humbug” (তাঁর সদিচ্ছা আছে, তবে তিনি নির্বোধ এবং ভান করেন)।

আমরা যতটা তখনকার দিনে দেখেছি (১৯২২-২৩ সালে) শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার নিজেদের কমিউনিস্ট বলতেন বটে কিন্তু মজুর শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতায় তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। তবে কার্যত ন্যাশনালিস্ট হয়েও আন্তর্জাতিক আর্থিক সাহায্য গ্রহণে তাঁরা সতত উৎকট বিশ্বাসী ছিলেন। সিঙ্গরাভেলু তো বলতেন আন্তর্জাতিক মজুর শ্রেণীর অর্থ সাহায্য না পেলে ভারতবর্ষে মজুর আন্দোলন চলতে পারে না।

“In January (1923) Dange and Singaravelu exchanged congratulations on their wisdom in declining Roy’s invitation to Europe.” (Home Deptt. Poll. File No. 103/IV. PP 3-30 National Archives of India)

From S.A Dange, Bombay to Singaravelu Chettiar, Madras: Dated 29.01.23

“You perhaps know that Roy wants to hold a conference of Indian Communists in Berlin. I think it is a mad venture for Indians to go hunting Communism in European conferences. Whatever has to be done, must be done in India. Moreover, there must be less talk of revolution than what Roy indulges in, even when the preliminary rights of labour are not obtained, it is a dream to talk of proletarian revolution. You might differ but that is my view.”

(Home/Poll./1924, F261, National Archives of India)

Singaravelu Chettiar to Dange, Dated 3.2.1923.

“….We shall go on as best as we can in propagating communism among the masses. Who are the Indian Commmunists, how many of them, who are prepared to go to Berlin when Germany is on the throes of Starvation? There is a good deal to be done here before one thinks of Starvaiton? There is a good deal to be done here before on thinks of a Congress. But let him go on if he has resources engough, but it is absolutely impossible to cross our shores at the present. You know the Official Secrets Bill with its provisions against foreign correspondence, however innocent. When that is the case why think of the Berlin Confercence.”

(Home/Poll/1924. F 261, National Archives of India)

মর্মার্থ,

“ডাঙ্গে ও সিঙ্গরাভেলু যে এম. এন. রায়ের ইউরোপ যাওয়ার নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করেছিলেন তার জন্যে তাঁরা ১৯২৩ সালের জানুয়ারী মাসে পরস্পরকে অভিনন্দিত করেছিলেন।”

২৯.১.১৯২৩ তারিখে ডাঙ্গে সিঙ্গারাভেলুকে লিখল : “রায় যে বার্লিনে ভারতীয় কমিউনিস্টদের সম্মেলন ডাকতে চাইছেন সেটা একটা পাগলামি ব্যাপার। ভারতীয়রা কমিউনিজমের সন্ধানে ইউরোপীয় সম্মেলনসমূহে যোগ দিতে যাবেন এটা পাগলামি ছাড়া আর কি? আমরা যা কিছু করব ভারতবর্ষেই করব। রায় যে কথায় কথায় বিপ্লবের কথা বলছেন তা কিছু কম করে বলা উচিত। যে দেশে মজুরদের প্রাথমিক দাবীগুলিও স্বীকৃত হয়নি সে দেশে মজুরশ্রেণীর বিপ্লবের কথা বলা স্বপ্ন মাত্র।” আপনার মতবিরোধ থাকতে পারে কিন্তু এটাই আমার অভিমত।

ডাঙ্গেকে লেখা সিঙ্গারাভেলুর পত্র হতে :

“…যত ভালো করে সম্ভব জনগণের নিকটে আমরা কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচার করতেই থাকব। ভারতীয় কমিউনিস্ট কারা? জার্মানী যখন উপবাসের ক্লেশে ক্লিষ্ট তখন তাঁদের মধ্য হতে কত জন বার্লিনে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে? [পার্টি] কংগ্রেসের কথা ভাবার আগে এদেশে অনেক কিছু করার আছে। তাঁর [রায়ের] যদি প্রচুর সঙ্গতি থাকে তিনি এগিয়ে যেতে পারেন কিন্তু আমাদের পক্ষে এখন এদেশের সীমানা ত্যাগ করা সম্ভব নয়। অফিসিয়েল সিট্সে বিলের কথা আপনি জানেন। এর বৈদেশিক পত্র লেখালেখি সম্পর্কিত ধারাগুলি যতই নির্দোষ দেখাক না কেন, এই সময়ে বার্লিন কন্ফারেন্সের কথা কেন ভাবতে যাওয়া?”

ডাঙ্গে আর সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার-কমিউনিস্ট আন্দোলনের সেই প্ৰাথমিক যুগে কিভাবে যে এই দুই চালাকের সংযোগ ঘটেছিল যা ভাবতে আরও আশ্চর্য ঠেকে।

রামচরণলাল শর্মা

১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুরে জয়ন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে রামচরণলাল শর্মার নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। সেখানেই প্রথম আমি জানতে পেলাম যে তিনিও কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার একজন আসামী। যেহেতু তিনি ফরাসী ভারতে (পন্ডিচেরীতে) রাজনীতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তার জন্যে তাঁকে আদালতে আমাদের সঙ্গে হাজির করানো যাবে না। ব্রিটিশ পুলিস নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে ফরাসী ভারতের ব্রিটিশ সীমানার দিকে তাঁকে আনার চেষ্টা করে সফল হননি।

পরে আমি রামচরণলাল সম্বন্ধে খবর নিয়ে জেনেছি যে তিনি সংযুক্ত প্রদেশের (উত্তর প্রদেশের) এটা জিলার লোক। সেসিল কে’ লিখেছেন যে রামচরণলাল স্বেচ্ছায় কলকাতার যুগান্তর প্রেসের মুদ্রাকার হয়েছিলেন। এ কথা সত্য কিনা তা যাচাই করতে পারিনি। সে যুগের প্রায় সকলেই মরে গেছেন। যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে সংসৃষ্ট অবিনাশচন্দ্র রায় বেঁচে আছেন শুনেছি। কিন্তু তাঁর নিকটে কোনো লোক এ ব্যাপারে যাচাই করার জন্যে পাঠাইনি। কারণ তাঁর বয়স এখন নাকি বিরাশি-তিরাশি বছর।

আমি যতটা খবর নিতে পেরেছি তাতে রামচরণলাল শর্মা “স্বরাজ” নাম দিয়ে ইলাহাবাদ হতে উর্দু ভাষায় একখানা কাগজ বার করেছিলেন। এই কাগজে রাজদ্রোহমূলক লেখা ছাপানোর অপরাধে ১৯০৯ সালে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২৪-এ ধারা অনুসারে শর্মা আদালতে অভিযুক্ত হন। কেউ কেউ ১২১-এ ধারার কথা লিখেছেন। কিন্তু আমার পাওয়া খবর অনুসারে তিনি ১২৪-এ ধারা অনুসারেই অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে মোকদ্দমার বিচার ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে না হয়ে সেশন্ত্ কোর্টে হয়েছিল। তাতে ১৯০৯ সালের দীর্ঘ দশ বছরের সশ্রম কারদণ্ডে তিনি দণ্ডিত হয়েছিলেন। এই কারাদণ্ডের একটি অংশ তিনি আন্দামানেও খেটেছেন। ১৯১৮ সালে শর্মা মুক্তি পান।

রোহতকে একটা রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে ১৯২০ সালের জুলাই মাসে আবার তাঁর বিরুদ্ধে ১২৪-এ ধারার গিরেতারি পরওয়ানা বা’র হয়। এই বারে ধরা না দিয়ে তিনি পণ্ডিচেরীতে পালিয়ে গেলেন।

দীর্ঘকাল কারদণ্ড ভোগ করার পরে রামচরণলালের স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল এবং তাঁর মনের বৈপ্লবিক দৃঢ়তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আরও একবার জেলে যেতে তিনি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর এই অবস্থার কথা সার সেসিল কে’ তাঁর “কমিউনিজ্‌ম্ ইন ইন্ডিয়া” নামক পুস্তকের ৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :

“In 1921 he sued for pardon, offering to turn police informer `as to movements of leading seditionists, among whom he moved freely’, or to be employed in Afghanistan ‘to report on the dissemination of Bolshevic propaganda’ in that country. As he was constitutionally incapable of playing straight, he was not employed; he is now deeply committed to M.N.Roy, but would doubtless sell him reasonably cheaply.”

অর্থাৎ “১৯২১ সালে যে ক্ষমা ভিক্ষা করল এবং বলল তার বিনিময়ে সে ‘নেতৃস্থানীয় রাজদ্রোহীদের গতিবিধি সম্বন্ধে খবর জোগাবে, যাঁদের ভিতরে তার অবাধ যাতায়াত আছে, ‘কিংবা তাকে আফগানিস্তানে নিযুক্ত করলে ‘ সে দেশে বলশেভিক প্রচার সম্বন্ধে সে রিপোর্ট করবে।’ সে সোজাসুজি কাজ করার পক্ষে চরিত্রগতভাবে অক্ষম বলে তাকে নিযুক্ত করা হয়নি; এখন সে গভীরভাবে এম. এন. রায়ের নিকটে আত্মসমর্পণ করেছ তবে নিঃসন্দেহে সে নিজেকে সস্তা দামে বিক্রয় করবে।”

রামচরণলাল শর্মা কি করে এম. এন. রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করল সেই কথাটা জানা দরকার। অযোধ্যাপ্রসাদ আমার নিকটে যা রিপোর্ট করেছিল আমি সেই কথাটিই এখানে বলব। অযোধ্যাপ্রসাদ যুক্ত প্রদেশের ঝান্সীর বাশিন্দা। ছেলেবেলায় সে গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে ছিল। তারপরে তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে সে পণ্ডিচেরী গিয়ে রামচরণলাল শর্মার সঙ্গে পরিচয় করে এবং তাঁর স্নেহভাজনও হয়ে পড়ে। যতটা আমি মনে করতে পারছি এই সূত্র ধরেই সে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। অযোধ্যাপ্রসাদ মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার একজন আসামীও ছিল। শর্মার সঙ্গে বাস করে আযোধ্যাপ্রসাদ মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার একজন আসামীও ছিল। শর্মার সঙ্গে বাস করে অযোধ্যাপ্রসাদ যে সঠিক তথ্য আবিষ্কার করেছিল তা হচ্ছে এই। শর্মা অত্যন্ত দুরবস্থার ভিতরে পণ্ডিচেরিতে তাঁর দিন কাটাচ্ছিলেন। তা দেখে একদিন এক গোয়েন্দা পুলিস অফিসার মর্শাকে এম. এন. রায়ের ঠিকানা এনে দেন। তাঁকে ওই ঠিকানায় পত্র লেখালেখি করতে বলেন। এই ভাবেই রামচরণলাল শর্মার সঙ্গে এম. এন. রায়ের সংযোগ স্থাপিত হয়। এই সংযোগকে এম. এন. রায় তাঁর একটি পরম সংযোগ মনে করেছিলেন।

যে-লোকটি পুলিসের সংবাদ সরবরাহকারী হতে চেয়েছিল, যার চরিত্রগত অক্ষমতার জন্যে পুলিস তাকে কাজে নিযুক্ত করেনি, তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পূর্বে রায়ের তাঁর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। আমাদের আন্দোলনের কী ক্ষতিই না তিনি করলেন তা তিনি বুঝতে চাইলেন না। পুলিসের কথায় এম. এন. রায়ের সঙ্গে শর্মা কি শুধু সংযোগই স্থাপন করেছিলেন? পুলিসকে কোনো খবর কি তিনি দিতেন না? এই লোকের নিকটেই রায় আবার মুহম্মদ আলী ওর্ফে সেপাসিকে পাঠিয়েছিলেন।

রামচরণলাল শর্মা ইংরেজি ভাষা কম জানতেন। মার্কসীয়, সাহিত্য, অধ্যয়ন করার সুযোগ তিনি পাননি। সন্ত্রাসবাদে তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। এ ছাড়া আর কিছু তিনি বুঝতেন না। তাঁর সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসেরও তেমনি কোনো ভিত্তি ছিল না। কারণ, তিনি তো নিজেকে ব্রিটিশের নিকটে বিক্রয় করতে প্রস্তুত ছিলেন।

আমার জেল হতে ফেরার পরে ১৯২৬ সালে রামচরণলাল তাঁর ছোট ভাই শিবচরণলালকে আমার নিকটে পাঠিয়েছিলেন। এই ছোট ভাইটি আমায় বললেন যে তাঁর অগ্রজ বৃদ্ধ ও ভগ্নস্বাস্থ্য। বহুমূত্র রোগেও তিনি ভুগছেন। এই সময়ে তিনি খানিকটা শান্তিতে থাকতে চান। কিন্তু পণ্ডিচেরীর পুলিস তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। অতএব কলকাতা হতে একজন যুবককে পণ্ডিচেরী পাঠানো হোক, যিনি কোনো একজন পুলিস অফিসারকে খুন করে কলকাতা চলে আসবেন। তাতে পুলিসেরা ভয় পেয়ে রামচরণলালকে আর বিরক্ত করবে না। তাঁর প্রস্তাবের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়েছিলেম। হয়তো তিনি পাগল হয়েছিলেন, কিংবা একটি আস্ত শয়তান ছিলেন তিনি। একজন পুলিস অফিসারকে যদি খুনই করতে হয় তবে সে কাজ তাঁর ছোট ভাই শিবচরণ করবেন না কেন? ঝাঁসীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ঝাঁসী হতে একজন যুবককে তিনি কেন এ কাজ করতে ডাকলেন না? বাঙলা দেশের একজন যুবককে কেন এমন কাজ করতে যেতে হবে? অথচ মানবেন্দ্রনাথ তাঁকে পত্রের মারফতে গভীরভাবে বোঝাতে চাইছিলেন যে ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদের পথ ভুল পথ।

না জেনে, না শুনে, কর্মী নির্বাচন করে রায় আমাদের আন্দোলনের অশেষ ক্ষতি করেছিলেন।

এ পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ মোটামুটি পড়ে পঁচাশি বছরের বিপ্লবী আমীর চাঁদ বোমওয়াল ২৪-১-১৯৭১ তারিখে দেরাদুন হতে আমায় একখানি পত্র লিখেছেন। উর্দু ভাষায় লিখিত এই পত্রে তিনি আমায় জানিয়েছেন যে ইলাহবাদ হতে ১৯০৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত উর্দু কাগজ ‘স্বরাজ্য’ (নাম ‘স্বরাজ’ নয়) রামচরণলাল শর্মা বার করেননি। কাগজখানির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শান্তিনারায়ণ ভাটনগর, যুক্ত প্রদেশের লোক। আমীর চাঁদ বোমওয়াল ছিলেন এই কাগজের শেষ সম্পাদক। ১৯১০ সালে নূতন প্রেস আইন পাস হওয়ার পর হতে এই কাগজকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কাগজে লেখার জন্যে পরে পরে আটজন গিরোর হয়েছিলেন।

‘স্বরাজ্যে’র সহিত রামচরণলালের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি রাস্তার মোড়ে ও বাজারে কিছু লোক জমা করে অনলবর্ষী বক্তৃতা দিতেন, কোনো কোনো বক্তৃতায় ‘স্বরাজ্যে’র প্রবন্ধও পড়তেন। তাঁর এই বক্তৃতার জন্যে তার বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক তিনটি রাজদ্রোহের মোকদ্দমা হয়। সেশন আদালতে এসব মোকদ্দমার বিচার হয়েছিল এবং তিনি দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। সাজা তিনি আন্দামানেও কাটিয়েছেন। আমীর চাঁদ পরিষ্কার করে কিছু লেখেননি, তনটি সাজাই বোধ হয় এক সঙ্গে চলেছিল।

কর্নেল কে’র ‘কমিউনিজম ইন্‌ ইন্ডিয়া’ হতে যে উদ্ধৃতি আমি দিয়েছি আমীর চাঁদ বোমওয়াল তা বিশ্বাস করতে চান না তাঁর মতে যে ব্যক্তি একবার আন্দামান ঘুরে এসেছেন তাঁর পক্ষে এ জাতীয় দুর্বলতা প্রকাশ কি করে সম্ভব? কেন সম্ভব নয়? জাতীয় মুহাফিজখানায় এ রকম দুর্বলতার অনেক দলীল পাওয়া যাবে। তাছাড়া ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকের নিকট হতে ঠিকানা নিয়ে তিনি এম. এন. রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ কি করে স্থাপন করলেন?

শর্মা যে ‘স্বরাজ্যে’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন এই ভুল খবর আমায় তাঁর লোকেরা দিয়েছিলেন। ১৯১৮ সালের সিডিশন কমিটির রিপোর্টে লিখেছে যে শান্ত যুক্ত প্রদেশে বিপ্লবী আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে ইলাহবাদের স্বরাজ্য পত্রিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *