দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইতিহার বণ্টন

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইতিহার বণ্টন

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইতিহার এই সময়ে বিতরিত হয়েছিল। গুজরাতের আমদাবাদ শহরে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ছত্রিশবারের (ষট্‌ত্রিংশতম) অধিবেশন তখন চলেছিল। তার প্রতিনিধিগণকে সম্বোধন করে আমাদের পার্টির প্রথম ইতিহারখানি (Manifesto to the Delegates of The XXXVI Indian National Congress) রচিত হয়েছিল এবং তাঁদের ভিতরে তা বিতরিতও হয়েছিল।

এই ইতিহার মস্কোতে রচিত ও মুদ্রিত হয়েছিল। রচয়িতা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে আন্তর্জাতিক পোস্টাল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্যে বরোদিন মাদ্রিদে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময়ে ইয়োরোপের বাজার হতে ভারতীয় সংবাদপত্রসমূহের একটি বিরাট বাণ্ডিল তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জন্যে নিয়ে আসেন। অনেক বছর পরে অনেক ভারতীয় সংবাদপত্র হাতে পেয়ে রোয় সে-সবের ভিতরে ডুবে গেলেন, তন্ন তন্ন করে সে সব পড়লেন এবং এ সবের পড়া হতে তাঁর মনে হলো যে কংগ্রেসের আমদাবাদ অধিবেশনের প্রতিনিধিদের সম্বোধন করে একখানি ইতিহার বা’র করা উচিত। তিনি এই প্রস্তাবটি লেনিন ও স্তালিনের নিকটে পেশ করলেন। তাঁরা পরম উৎসাহের সহিত এই প্রস্তাবের সমর্থন জানালেন। তারপরে রায় ইতিহারটি লিখে লেনিন ও স্তালিনের নিকট দাখিল করলেন। স্তালিন তাতে একটা সংশোধনের কথা তুললেন। রায় বলছেন স্তালিনের সংশোধনের কথায় ভারতীয় বাস্তবতা সম্বন্ধে তাঁর নিজের জ্ঞান সত্যই বেড়েছিল। রায় তাঁর প্রোগ্রামে লিখেছিলেন যে সুদখোরী প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হোক। কৃষক সাধারণের জীবনে এ প্রথা অভিশাপস্বরূপ। স্তালিন মন্তব্য প্রকাশ করলেন যে যদি সমস্ত সুদখোরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তা হলে চাষের সময় কৃষকদের যে টাকার প্রয়োজন হয় সে টাকা তাঁরা কোথায় পাবেন? তাঁরা তা কোনো রকমে অতি কষ্টে দিন গুজরান করেন। তাঁদের চাষের সময়ে কম সুদে টাকা ধার পাওয়া প্রয়োজন। সুদখোরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে কৃষির পক্ষেই ক্ষতিকর হবে। রায় বলছেন, “আমি ভেবেছিলাম যে সুদখোরী প্রথা তুলে দেওয়া হবে কৃষকদের পক্ষে একটা দারুণ বিপ্লবী কাজ। তা কৃষকদের উৎসাহিত করবে।” কিন্তু স্তালিনের মন্তব্য তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিল। স্তালিন বলেছিলেন, প্রোগ্রামে থাকা উচিত যে “সুদের প্রথাকে বাগে আনতে হবে; সুদের হার ৬ শতাংশে ধার্য করতে হবে।”

এম. এন. রায়ের লিখিত এই ইতিহারখানি লেনিন ও স্তালিনের দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পরে মস্কোতেই মুদ্রিত হয়েছিল। কোনো স্থানে উল্লেখ করা হয়নি যে তা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতে প্রচারিত। তলায় মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জির নাম মুদ্রিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি অন্তত ধরে নিয়েছিলেন যে এখানা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহার। ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :

“১৯২১ সালে আমেদাবাদ কংগ্রেসে গিয়ে দেখি কমিউনিস্ট প্রচারপত্র গুপ্তভাবে বিলি হচ্ছে। এম. এন. রায়ের পরিচালনায় এদেশে তাঁর গুপ্ত কর্মীরা মতবাদ ছড়াচ্ছিলেন।” (বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি, প্রথম সংস্করণ, ৪৮৩ পৃষ্ঠা)।

কমরেড রজনী পাম দত্ত এই ইতিহার হতে উদ্ধৃতি দিয়ে গিয়ে লিখেছেন “The Manifesto of the young Communist Party of India to the Ahmedbad Congress (1921) Declared :

“If the Congress would lead the revolution, which is shaking India to the very foundation, let it not put faith in mere demonstrations and temporary wild enthusiasm. Let it make the immediate demands of the Trade Unions its own demands; let it make the programme of the Kisan Sabhas (Peasant Unions) its own programme; and the time will soon come when the congress will not stop before any obstacle; it will be backed by the irresistable strength of the entire population consciously fightingh for their material interests.”[22] (INDIA TODAY: 2nd revised Indian edition, 1949, p 323).

[22. পুরো ইশতিহারটির বাঙলা অনুবাদ অন্যত্র দেওয়া হলো।]

নলিনী গুপ্তের দ্বিতীয় ধাপ্পা

ইতিহারটি ছাপা তো হয়ে গেল এখন কথা হলো কি করে তা ভারতবর্ষে পাঠানো যায়? মস্কো হতে ডাকে বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠালে পোস্ট আফিসের মোহর দেখেই তা আর প্রাপককে দেওয়া হবে না। ইউরোপের বিভিন্ন স্থান হতে বিভিন্ন নামে পাঠানো যায়। কিন্তু তা আঁধারে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কোথাও পৌঁছাবে, কোথাও পৌঁছাবে না। এমন সময় নলিনী গুপ্ত এগিয়ে এলো। বল সে-ই নিয়ে যাবে ইশতিহারের বাণ্ডিল ভারতবর্ষে। আহমদাবাদ কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশের সহিত তার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, (বৈদ্যের সঙ্গে বৈদ্যের পরিচয় থাকতেই হবে।) ইতিহারখানি একেবারে তাঁর হাতেই পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। এম. এন. রায় বলছেন, “নলিনী গুপ্তের যেই কথা সেই কাজ” (He was as good as his word)। আসলে স্মৃতিকথা লেখার সময়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্মৃতি-বিভ্রম ঘটেছিল। নলিনী গুপ্ত ইতিহারের বাণ্ডিল মস্কো হতে সঙ্গে নিয়েই আসেনি। আর, যদি এনেই থাকে তবে মার্সাই বন্দরে জাহাজে চড়ার সময়ে সে বাণ্ডিলটি সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল। সে যখন কলম্বো হতে ধানুষ্কোডি হয়ে কলকাতা পৌঁছেছিল তখন কংগ্রেসের আমদাবাদ অধিবেশন চলেছে। এই অধিবেশনের সময়ে তার সঙ্গে আমার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। কলকাতা হতে আমদাবাদে লোক পাঠানোর সময়ও টাকা হাতে ছিল না। বেশীর ভাগ রিপোর্টে আছে যে নলিনী ২০০ পাউণ্ড হাতে নিয়ে মস্কো ছেড়েছিল সে নিজেও পুলিসের নিকটে তাই বলেছে। একটি রিপোর্টে শুধু আছে যে সে ২৯০ পাউণ্ড পেয়েছিল। বার্লিনে লোভে পড়ে সে অবনমিত মূল্যের জার্মান মার্ক কিনে পাউণ্ড খুইয়েছিল। তাছাড়া পুলিসের নিকটে স্বীকারোক্তি করতে গিয়ে সে সব কথাই বলেছে, এই ইশতিহারখানির কথা সে কোথাও উল্লেখ করেনি। কলকাতার জন্য কমপক্ষে ৫০ খানি ইশতিহারও তো সে সঙ্গে আনতে পারত। কিন্তু একখানিও আনেনি।

মস্কোতে মুদ্রিত এবং মানবেন্দ্রনাথ রায় ও মুখার্জি স্বাক্ষরিত ইতিহার কিন্তু আমদাবাদ কংগ্রেসের অধিবেশনে গোপনে বিতরিত হয়েছিল। যাঁরা বিতরণ করেছিলেন তাঁরা ছিলেন আজমীঢ়ের লোক। নলিনী গুপ্ত যে ইশতিহারখানি ভারতে আনবেন বলেছিলেন সে কথা শুধু এম. এন. রায়ের মনে আছে। কাজে কিন্তু তিন প্রথমে যা ভেবেছিলেন তাই করেছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন স্থান হতে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ইশতিহারগুলি ডাকে পাঠানো হয়েছিল। আমি তখন কলকাতায় এই ইতিহার পাইনি। ৪৬ বছর পরে এই ইতিহারেরই একখানি এখন (১৯৬৭) কলকাতায় পেলাম। এখানে ডাকে এসেছিল। তারই বাঙলা তরজমা এখানে ছাপা হচ্ছে। আমদাবাদ কংগ্রেস হতে গয়া কংগ্রেস পর্যন্ত লেখা এম. এন. রায় ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী এভেলিন রায় লিখিত প্রবন্ধগুলি একখানি পুস্তকে মুদ্রিত হয়েছে। পুস্তকের নাম “অসহযোগের এক বছর-আমদাবাদ হতে গয়া” (One Year of Non-co-operation from Ahmedabad to Gaya, by Manasbendra Nath Roy and Evelyn Roy) এই পুস্তকে আমদাবাদ কংগ্রেসে বিতরিত ইশতিহারও আছে। কার মারফতে জানিনে, আজমীঢ়ে ইতিহারখানি বেশী সংখ্যায় পৌঁছেছিল।

১৯৬৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর তারিখে কুমারানন্দ রাজস্থানের বেওয়ার হতে আমায় লিখেছেন :

“আপনি যে বিষয়ের উত্তর চাহিয়াছেন তাহা লিখিতেছি।

“১। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি মৌলানা হৎ মোহানীর প্রস্তাব সমর্থন করিয়াছিলাম। আমার অন্য একটা প্রস্তাব ছিল। …..মহাত্মা গান্ধী ঐ প্রস্তাবটা যাহাতে আমি move না করি সেই জন্য আমাকে অনেক বোঝান। কিন্তু আমি তাঁহার কথায় রাজী না হওয়াতে সেই কংগ্রেসের Acting president হাকিম আজমল খাঁ ঐ প্রস্তাবটি move করিতে অনুমতি না দেওয়াতে আমি মৌলানা হৎ মোহানীর প্রস্তাব সমর্থন করি

২। “আমদাবাদ কংগ্রেসে M.N. Roy (এম. এন. রায়) এবং অবনী মুখার্জি দস্তখত সহ যে ইতিহার বিতরিত হইয়াছিল তাহার কয়েকখানা অনেকদিন আমার কাছে ছিল। কিন্তু বার বার পুলিসের তল্লাশীতে সেই ইতিহার পুলিসের হস্তগত হইয়াছে, ফিরাইয়া দেয় নাই। আজমীঢ়ের বাঙ্গালী কালীচরণ দত্ত (পরলোক) এবং গোপীনাথ (এখন স্বামী কৃষ্ণানন্দ, ৮৫ বৎসর) এই দুইজনে এবং আরও ৫/৭ জন লোক আমাকে টানিয়া লইয়া (গিয়া) ইতিহার বিতরণ করিয়াছিল। অবশ্য ইহাদের পিছনে অন্য আরও লোক ছিল যাহাদের আমি পূর্বে দেখি নাই। আমার, যতদূর মনে আছে আমীঢ়ের মহারাষ্ট্র নিবাসী পাণ্ডে [২৩] (Revolutionary, 1939-এ Underground অবস্থায় ওয়ার্সাতে মারা যান) নিজে দস্তখত করিয়া ঐ ইতিহার বিতরণ করিয়াছিলেন।

[23. দত্তাত্রেয় পরশুরাম পাণ্ডে।]

“১৯২১ সালে রাজস্থান সেবা সঙ্ঘের তরফ হইতে “রাজস্থান পত্রিকা” নামে এক Weekly paper কিছুদিন প্রকাশ হইয়াছিল। তাহাতেও M.N. Roy 3 অবনী মুখার্জির দস্তখতের ইতিহার ছাপা হইয়াছিল।…

“আশা করি আপনি ভাল আছেন। পত্র দুইখানা পাইয়া খুবই খুশি হইয়াছি। ক্রান্তিকারী অভিনন্দন সহ

কুমারানন্দ”

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের আমদাবাদে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ছত্রিশ বারের অধিবেশনে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত যে ইতিহার বিতরিত হয়েছিল তা ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রকাশিত ইতিহার। এই ইশতিহার যাঁরা সঙ্গোপনে আমদাবাদ কংগ্রেসে বিতরিত হতে দেখেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকে এখনও বেঁচে আছেন। বেওয়ারে বেঁচে আছেন কুমারানন্দ। তাঁর পত্র আমি এখানে ছেপে দিলাম। রাচিতে বেঁচে আছেন ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাদ্যায়, -এম. এন. রায়ের পুরনো পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা। ডাক্তার মুখোপাধ্যায়ের লেখাও আমি তুলে দিয়েছি। রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, দু’জন ব্যক্তি ইতিহারখানি নিজেদের নামে ছেপে বিতরণ করেছিলেন এবং কংগ্রেসের সভায় প্রস্তাব হিসাবে উত্থাপনও করেছিলেন। ইতিহারখানি প্রস্তাবরূপে উত্থাপন হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কুমারানন্দ বলেছেন যে দত্তাত্রেয় পরশুরাম পাণ্ডে নিজের নামে ইশতিহারখানি ছেপে বিতরণ করেছিলেন। তিনি মহারাষ্ট্রীয় ছিলেন, কিন্তু থাকতেন আজমীঢ়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *