দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

আন্তর্জাতিক অর্থ-সাহায্য

আন্তর্জাতিক অর্থ-সাহায্য

যাঁরা কমিউনিস্ট তাঁরা তো জানবেনই, কমিউনিস্ট যাঁরা নন তাঁরাও জানেন, কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। দেশে যে সকল ন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল সে সব একীভূত হয়েছিল বিশ্ব কমিউনিস্ট পার্টিতে। এই বিশ্ব কমিউনিস্ট পার্টিই ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’। একথা মনে রাখতে হবে যে আন্তর্জাতিকতায় অটুট বিশ্বাসী হয়েও কমিউনিস্টরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু, সঙ্কীর্ণমনা ন্যাশনালিস্ট তাঁরা কোনো অবস্থাতেই নন।

বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি কর্তব্য ছিল। দেশের অবস্থানুসারে কাজের ব্যবস্থা হতো। বিভিন্ন দেশে কাজের প্রসারের জন্যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে টাকাও খরচ করতে হতো। এই ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করা ছিল একান্তই স্বাভাবিক। তবে, আমাদের রাজনীতি ও মতবাদ গোপন ব্যাপার ছিল না। তা ছাপার অক্ষরে প্রচারিত হতো। আমাদের শত্রুরা আমাদের রাশিয়ার দালাল (agent) বলে প্রচার করত। অবশ্য, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ‘এজেন্ট’ হওয়াকে আমরা কখনও অগৌরবের কাজ বলে মনে করিনি। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে টাকা পাওয়ার জন্যে ভারতের ‘ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা ও লালায়িত ছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মান সাম্রাজ্যবাদের নিকট হতে টাকা গ্রহণ করে তাঁরা ধন্য হয়েছিলেন।

আগেই বলেছি মানবেন্দ্রনাথ রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তরফ হতে ভারতের কাজের চার্জে ছিলেন। প্রবাসে গঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিরও তিনি নেতা ছিলেন। কাজেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাজের জন্যে টাকাও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে তিনিই তুলতেন। এই কারণে, ভারতের কাজের জন্যে টাকা আমাদের তাঁর কাছেই চাইতে হতো। ব্যক্তিগতভাবে আমরা দু’পা দু’নৌকায় ছিল না। দৃঢ়তার সহিত টাকা চাইবার অধিকার তাই আমার ছিল। কিছু সংখ্যক লোক বলে বেড়ান যে “মুজফফর বড় টাকা টাকা করত”। এম. এন. রায়ের মোকদ্দমার সেশন্ত্ কোর্টের রায়েও এ ধরনের একটি কথা আছে।

এম. এন. রায়ের সহিত আমার সহকর্মিতার সময়ে, অর্থাৎ আমার ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন অনুসারে স্টেট্ প্রিজনার হওয়ার আগে পর্যন্ত [৩৯], আমি মোট কত টাকা পেয়েছিলেম তার একটি হিসাব আমি এখানে দিচ্ছি :

[39. এই উপলক্ষে আমি ১৭ই মে (১৯২৩) তারিখে প্রথম গিরেফ্ফার হয়েছিলেম।]

(১) আমি সর্বপ্রথম পেয়েছিলেম সুইস্ ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের লন্ডন শাখার নামে ৩১ পাউন্ডের একখানি চেক্। একথা সত্য যে চেখানি আমার নামেই এসেছিল, কিন্তু তা আমার জন্যে আসেনি। নলিনী গুপ্ত কলম্বো হতে ইউরোপের টিকেট কেনার জন্যে যে চারশ’ টাকা যতীন মিত্রের নিকট হতে ধার নিয়েছিলেন তা শোধ দেওয়ার জন্যেই টাকাটা এসেছিল। এই চেকের পেছনে আমি শুধু একটি দস্তখত করেছিলাম। বিখ্যাত ‘আমেরিকান ডেন্টারল সার্জন’ ডক্টর সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের থাকার স্পিঙ্ক কোম্পানীর ব্যাঙ্কে একটা হিসাব ছিল। সেই হিসাবে জমা দিয়ে লন্ডন হতে চেক্‌টা ভাঙিয়ে আনা হয়েছিল। ডক্টর সেনগুপ্ত নিজ হাতে টাকাটা যতীন মিত্রকে দিয়েছিলেন। যতীন মিত্র আরও একশ’ টাকা ফাউ নিয়েছিলেন। বর্ধমানের বিজয় বসু এই টাকাটা আমায় দিয়েছিলেন। এই পুস্তকের ১০১ পৃষ্ঠায়ও তাঁর নামোল্লেখ আছে। পুলিস রিপোর্টে আছে যে আমি ৪০০ টাকা নলিনী গুপ্তকে কলম্বোর ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেম। এ খবর একেবারেই ভুল। আমি তাঁকে কোন টাকাই পাঠাতে পারিনি।

(২) দ্বিতীয় দফায় রায় আমার পাঠিয়েছিলেন সুইস ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের লন্ডন শাখারই বরাবরে ৩ পাউন্ড ১৩ শিলিঙের একখানি চেক। চার পাউন্ড পুরো কেন হলো না, খুচরা ১৩ শিলিং কেন হলো, এর তাৎপর্য আমি কোনো দিন বুঝতে পারিনি। এই টাকায় রায় কিছু ভারতীয় বই পাঠাতে বলেছিলেন। আমি পুস্তকের তালিকা ও চেক একসঙ্গেই কলকাতা কলেজ স্কোয়ারের বুক কোম্পানী লিমিটেডের নিকটে জমা দিয়েছিলেম। লন্ডনের সঙ্গে তাঁদের কারবার ছিল। বইও তাঁরাই পাঠিয়েছিলেন। কিছু বেশী টাকারই পাঠিয়েছিলেন।

(৩) তৃতীয় দফায় কলকাতার একটি ডাচ ব্যাঙ্কের বরাবরে আমার নামে পঞ্চাশ পাউন্ডের একখানা ড্রাফট এসেছিল। প্রবোধের নামেও আর একখানা ড্রাফট্ ওই একই ব্যাঙ্কের বরাবরে এসেছিল। কিন্তু এই চেখানা ছিল একশত পাউন্ডের। এই দু’খানা ড্রাফটই একই খামের ভিতরে ভূপতি মজুমদারের কোনো ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল এবং নিরাপদে তাঁর হাতে পৌঁছেছিল। আমার নামীয় ড্রাফ্টখানা শ্রীমজুমদার আমায় দিয়েছিলেন। প্রবোধর নামীয় ড্রাফ্‌টও তিনি নিশ্চয় তাঁকে দিয়ে থাকবেন। প্রবোধ ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের একটি ছদ্মনাম। হতে পারে এ নামের আড়ালে অতুলকৃষ্ণ ঘোষও ছিলেন। রায়ের পুরানো পার্টির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই দু’খানা ড্রাফ্ট পাঠানোর সম্বন্ধে এম. এন. রায় আমায় লিখেছিলেন যে অন্য কোনো পথ না পেয়ে তিনি এই পথ অবলম্বন করেছেন। ভূপতি মজুমদার রায়ের পুরানো পার্টির একজন সহকর্মী।

আমি সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে রাখতে চাই যে এম. এন. রায় তাঁর কার্যকালে আমায় পঞ্চাশ পাউন্ডের (৭৫০ টাকার) বেশী দেননি। এই টাকা হতে আমি মাত্র দশটি টাকা খরচ করেছিলেম। বাকী টাকা আমার বন্ধু কুদ্দীন আমদের নিকটে জমা রেখে স্টেট্-প্রিজনার হয়ে আমি জেলে চলে যাই। কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চলাকালে এই টাকাতে মণিলাল ডক্টরকে ব্যারিস্টার নিযুক্ত করে কুদ্দীন সাহেব ও আবদুল হালীম কানপুরে পাঠিয়েছিলেন।

এ দেশে প্রেরিত টাকার একটি বড় হিসাব ইনটেলিজেন্স ব্যুরো দাখিল করেছেন। তাতে ভূপতি মজুমদারের নিকটে আসা ৫০+১০০ পাউন্ডের হিসাব নেই। এই বড় হিসাবের কোনো টাকাই আমি পাইনি। এই বড় হিসাবটির ফাইল নম্বর হচ্ছে 18-6/26/ Pol (Sec.)।

স্যার ডেভিড পেট্রি ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি “কমিউনিজম্ ইন ইন্ডিয়া ১৯২৪-২৭” নাম দিয়ে একখানি বই লিখেছেন। এ বইখানি গোপন পুস্তক, উচ্চস্তরের অফিসারদেরই শুধু তা পড়ার অধিকার ছিল। এতকাল পরে এ বছর (১৯৬৯) তার ওপর হতে গোপনীয়তার ছাপ উঠে গেছে। ন্যাশনাল আরকইট্স্ অফ্ ইন্ডিয়ায় পুস্তকখানি এখন সকলের জন্যে উন্মুক্ত। এই পুস্তকের একুশের পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে :

“….In the course of thw covering letter, Roy appointed Muzaffar Ahmad distributing centre for his pamphlets and The Vanguard on a monthly salary of Rs. 100/- “

(পত্রে লেখা হয়েছে রায় তার পুস্তিকাগুলি ও ‘ভ্যানগার্ড’ বিতরণের জন্যে মাসিক ১০০ টাকা বেতনে মুজফফর আহমদকে নিযুক্ত করেছিলেন)।

ডেভিড প্রেট্রির পুস্তক পড়ার আগে এ খবর আমমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। রায়ের কোনো পত্রে এমন একটি খবর আমি কখনও পড়িনি। এ আষাঢ়ে গল্প কোথায় কার দ্বারা রচিত হয়েছিল তা আমি জানিনে। সার ডেভিডের পুস্তকে খবরটিই শুধু ছাপা হয়েছে, কিন্তু পত্রখানা ছাপা হয়নি। তবে, সত্যই যদি সেই সময়ে আমার মাসিক একশ’ টাকা বেতন কোথাও হতে ধার্য হতো তবে বড়ই ভালো হতো। আমার মনে হয় তাহলে আমার টিউবারকিউলোসিসটা আর হতো না।

ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয় ইনটেলিজেন্স বিভাগও বিদেশ হতে টাকা পাওয়ার বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে অদ্ভুত প্রচার করেছে। তারা বলেছে, মুজফফ্র আদ যে বিদেশ হতে ভাতা পেত তার প্রমাণ হিসাবে দু’খানা চেকের ফটোস্টাট কপি তাদের নিকটে আছে। সেই ৩১ পাউন্ড ও তিন পাউন্ড ১৩ শিলিঙের চেক দু’খানা। সার সেসিল কে’ তাঁর পুস্তকে স্বীকার করেছেন যে ৩১ পাউন্ডের চেকখানা নলিনীর ধার নেওয়া টাকা শোধ দেওয়ার জন্যে এসেছিল। আশ্চর্য এই যে তিনিই ছিলেন কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ভারত গবর্নমেন্টের পক্ষের বাদী!

আমি কিন্তু এম. এন. রায়কে কিঞ্চিৎ সাহায্য করতাম। তিনি ভারতের বিষয়ে লিখছিলেন। ভারতের অনেক পত্র-পত্রিকা সুদূর বিদেশেও তিনি পেতেন। তবুও আমার চেষ্টা ছিল ভারত সম্পর্কে তাঁকে যত বেশী পরিজ্ঞাত রাখা যাবে ততই ভালো হবে। তাই, কিছু কিছু পত্র-পত্রিকা আর পুস্তিকা আমিও তাঁকে সংগ্রহ করে পাঠাতাম। তাতে কোনো কোনো ডাকের দিনে আমার দু’টাকাও খরচ হয়ে গেছে। বন্ধুদের নিকট হতে চেয়ে-চিন্তে এ টাকা আমি জোগাড় করেছি।

যোগাযোগ হওয়ার পর হতেই আমায় ইউরোপে ডেকেছেন। কিন্তু ডাকলেই তো আর যাওয়া যায় না। আমি সর্বক্ষণের কর্মীর মতো কাজ করেছি। বারে বারে তাঁকে আমি টাকার জন্যে পত্র লিখেছি। ১৯২২ সালে কোনো টাকাই আমি তাঁর নিকট হতে পাইনি। আমি নিজেকে অবহেলিত বোধ করেছি বটে, কিন্তু কাজ ছেড়ে দিইনি। সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। কেন না, কাজ আমি এম. এন. রায়ের জন্যে শুরু করিনি।

১৯২৩ সালে রায়ের মনোভাবে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসেন। টাকা আমার হাতে পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, এম. এন. রায় তাঁর নিজের পদ্ধতিতে টাকা আমায় পাঠাতে চেষ্টা করেছেন। কোনো ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক হতে তার কলকাতা শাখার বরাবরে ডিমান্ড ড্রাফ্‌ট পাঠাতে চাইলে তা খামের ভিতরে পুরে প্রাপকের কলকাতার ঠিকানায় পাঠাতে হতো। এই খাম পুলিসের হাতে পড়লে তারা তা আর প্রাপককে ডেলিভারি দিত না। ব্যাঙ্কের নিকটে পৃথক খবর আসত। ব্যাঙ্ক নিয়ম অনুসারে নব্বই দিন অপেক্ষা করত। তার ভিতরে কেউ ড্রাফট নিয়ে না এলে তাঁরা প্রেরকের হিসাবে টাকাটা ফেরৎ দিতেন। অতএব, টাকাটা শেষ পর্যন্ত রায়েরই হাতে থেকে যেতো।

এম. এন. রায়ের জার্মানীতে অবস্থিত এক বন্ধুর অগ্রজের নিকটে তিনি পঞ্চাশ পাউন্ড হিসাবে দু’খানা ড্রাফট আমার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। ড্রাফট, দুখানার প্রাপ্তি স্বীকারও তিনি ইউরোপে করেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও লিখেছিলেন যে মৌলবী লেনে (আমার কলকাতার ঠিকানা) গিয়ে তিনি জানতে পেয়েছিলেন যে মুজফফর আহমদ নামক কোনো ব্যক্তিকে ওখানকার কেউ চিনেন না। ডাহা মিথ্যা কথা। রায়ের নিকট হতে নাম ও ঠিকানা পেয়ে আমি নিজেও তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেম। তিনি বললেন, কোনো টাকা কেউ তাঁকে পাঠাননি। অর্থাৎ টাকাটা ভদ্রলোক মেরেই দিলেন,–তখনকার এক্সচেঞ্জের হিসাবে ১৫০০ টাকা।

ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত এম. এন রায়ের সঙ্গে পত্র লেখালেখি করতেন। রায়ের নিকট হতে টাকাও তিনি পেয়েছেন। ব্যামফোর্ড (পুলিসের বড় অফিসার) লিখিত রিপোর্টে আছে যে ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত কলকাতার বাইরে যাওয়ার সময়ে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়কে তিনটি কাজের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন :

(১) মুজফফর আমদের সঙ্গে (অতএব, এম. এন. রায়ের সঙ্গেও) সংযোগ রক্ষা করা;

(২) ভূপেন্দ্রকুমারের কলকাতার সংগঠনগুলির দেখাশুনা করা;

(৩) জীবনলালের বোম্বের পুরানো পরিচয়কে (ডাঙ্গের সঙ্গে পরিচয়ের জন্যে) আবার ঝালিয়ে নেওয়া।

জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সহিত আমার সংযোগ যে স্থাপিত হয়েছিল একথা আমি আগে বলেছি। স্যার সেসিল কে’ লিখেছেন :

“After Muzaffar Ahmad’s arrest, Roy appointed Jiban Lal Chatterji as Muzaffar Ahad’s successor,…”

(Communism in India, Page 92 )

অর্থাৎ, “মুজফফর আমদের ধরা পড়ার পরে রায় জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়কে মুজফফর আমদের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন।”

আমার এমন কোনো বিশেষ স্থান ছিল না যে রায় তাতে জীবনলালকে অভিষিক্ত করবেন। তবে তাঁর সঙ্গেও রায়ের সংযোগ ছিল।

এম. এন. রায়ের পরবর্তী ব্যবহার হতে এটা বোঝা গিয়েছিল যে তিনি আমার অভাবে যৎকিঞ্চিৎ অসুবিধা বোধ করেছিলেন। হয় তো আমার মতো চটপট উত্তর অন্যরা দিতেন না। আমার গিরেস্তারের পরে অন্যরা সাবধানও হয়ে গিয়ে থাকবেন।

আমার গিরেস্তারের পরে ১৯২৩ সালের জুলাই মাসের শেষার্ধে নলিনী গুপ্ত আবার কলকাতা এসেছিলেন। ১৯২৩ সালের আগস্ট মাসে এম. এন/ রায় বার্লিন হতে নলিনী গুপ্তকে এক পত্রে লিখলেন :

BERLIN

August, ‘23

“What is the news of “M” something should be done to rescue him. Some monetary help will be available, Pay a little attention to this direction. About this I have Written to a friend of his, but have had no reply.”

(Exhibit No. 54, Cawnpore Communist Conspiracy Case, 1924)

এই পত্রাংশও বাঙলার ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন আমাদের পূর্ব পরিচিত কুঞ্জবিহারী রায়। এখানে M-এর অর্থ মুজফফর আহমদ। তাকে জেল হতে কি করে উদ্ধার করা যায় সে কথা রায় নলিনীকে ভাবতে বলেছেন। বলেছেন, এই কাজের জন্যে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। রায়ের এ বিষয়ে লেখা পত্রগুলি জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় ও নলিনী গুপ্ত পেয়েছিলেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। পেলেও কোনও লোককে জেল হতে বা’র করে আনা এতই কি সহজ? আমাদের বাঙলা ভাষায় একটি কথা আছে :

থাকতে দিলে না ভাত-কাপড়।

মরলে করে দান-সাগর।

এম. এন. রায়ের প্রস্তাবটিও কতকটা এই ধরনের।

চার্লস্ আশলীর কথা

এটা একটা দীর্ঘ বিবরণ। অনেকের চরিত্র বোঝার পক্ষে এই বিবরণীটি মূল্যবান। তাই সংক্ষেপে তাঁর সম্বন্ধে আমি এখানে কিছু বলব।

মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে আসার জন্যে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নিকট হতে লোক চেয়েছিল। ব্রিটিশ পার্টি এই কাজের জন্যে চার্লস্ আশলীকে (Charles Ashleigh) নির্বাচিত করেন। ব্রিটিশ পার্টি আর এম. এন. রায়ের মনে কি ছিল তা জানিনে। আশলী কিন্তু শুধুমাত্র বার্তাবহ হওয়ার চেয়েও উচ্চস্তরের লোক ছিলেন। তাঁর বয়স ত্রিশের কোঠায় হলেও পৃথিবীর দু’টি মহাদেশে (আমেরিকা ও ইয়োরোপে) তিনি সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। মজুর সংগ্রাম চালাতে গিয়ে ১৯১৮ সালে তিনি আমেরিকায় দশ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ব্রিটিশের ইংরেজ প্রজা হওয়ার কারণে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাঁর খোঁজখবর নিতেন। এই কারণে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি জেল হতে ছাড়া পেলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা হতেও তিনি বহিষ্কৃত হলেন। এই চার্লস্ আশলী ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে আবার ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। প্রথমে বার্লিনে গিয়ে এম. এন. রায়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করলেন, তাঁর নিকট হতে উপদেশ নিলেন, চিঠিপত্র নিলেন এবং অনেক টাকাও নিলেন। ১৯২২ সালের ৫ই নভেম্বর হতে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পেট্রোগ্রাড ও মস্কোতে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের যে চতুর্থ কংগ্রেসের অধিবেশন হতে যাচ্ছে তাতে যোগদানকারী ভারতীয় প্রতিনিধিগণের রাহাখরচের টাকা। বার্লিনে আশলীর নলিনী গুপ্তের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। নলিনী গুপ্ত আশলীকে তিনখানি পরিচয় পত্র দিয়েছিলেন :

(১) বেম্বের টাটা এসিউরেন্স কোম্পানীর চীফ্ একাউন্টান্ট মিস্টার কিরণবিহারী রায়ের নামে। নলিনী ও কিরণবিহারী রায়ের বাড়ী বাকেরগঞ্জ জিলার একই অঞ্চলে ছিল। ছোটবেলা তাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ছিল। কিরণবিহারী রায় যখন গ্লাসগোতে ইনকরপোরেটেড একাউন্টান্টশিপ্ (চাটার্ড একাউন্টান্টশিপও হতে পারে) পড়ছিলেন নলিনী তখন সেখানে কারখানায় চাকরী করছিলেন। ইনটেলিজেন্স রিপোর্টে আছে, নলিনী গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে কিরণবিহারী রায়ের সহপাঠী ছিলেন। এটা একেবারেই সত্য কথা নয়। পুলিসের নিকটে বিবৃতি দিতে গিয়ে নলিনী বলেছন যে কীর্তিপাশা হাইস্কুলের ফোর্থ ক্লাসে (Class VII) পড়ার সময়ে ১৯১০ সালে আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাঁকে পড়া ছেড়ে দিয়ে হয়। এটাই সত্য খবর। নলিনী আরও একটি খবর আমাদের বলেছিলেন। তিনি বড় বেশী মিথ্যা কথা বলতেন। সে জন্যে আমরা তা বিশ্বাস করিনি। তিনি বলেছিলেন যে বাড়ীতে না বলে তাঁরই উৎসাহে কিরণবিহারী রায়ের বাবা শুনতে পেয়ে নিজেই টাকা পাঠাতে আরম্ভ করেন। এই কারণে কিরণবিহারী রায় নাকি নলিনীর নিকটে ঋণী ছিলেন।

(২) নলিনী দ্বিতীয় পত্র দিয়েছিলেন মুজফফর আমদের, অর্থাৎ আমার নামে, আর

(৩) তৃতীয় পত্র দিয়েছিলেন ডাক্তার টি. এন. রায়ের (তেজেন্দ্রনাথ রায়ের নামে। তিনি মিস্টার জে. এন. রায় ব্যরিস্টারের ছোট ভাই ছিলেন।

চার্লস্ আশলী বোম্বে পর্যন্ত এসেছিলেন, কলকাতায় আসতে পারেননি। তিনি ত্রিস্তে (Trieste) হতে পিল্সা (Pilsna) জাহাজে বোম্বেতে আসছিলেন। নলিনী গুপ্ত তাঁর জাহাজের নাম জেনে এসেছিলেন কিনা তা জানিনে। আশলীর সাংবাদিক বন্ধু জর্জ স্লোকম্বে তখন ‘ডেইলী হেরাল্ড’ প্যারিসের প্রতিনিধি ছিলেন। তিনিই আশলীর জাহাজে চড়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, আশলী নিজেও একজন সাংবাদিক ও সুলেখক ছিলেন। তিনি একাধিক ভাষাও জানতেন। রুশ উপন্যাস “সিমেন্ট”-এর ইংরেজী অনুবাদ তিনিই করেছেন। জাহাজ রওয়ানা হওয়া মাত্রই ব্রিটিশ ফরেন ডিপার্টমেন্ট খবর পেয়ে গেল যে আশলী ভারতে যাচ্ছেন। তখনই তাঁরা ভারত গবর্নমেন্টকে টেলিগ্রামে জানিয়ে দিলেন যে ‘পিলা’ জাহাজ বোম্বে পঁহুছা মাত্রই চার্লস্ আশলীর সাম্রাজ্য ভ্রমণের ‘ভিসা’ যেন নাকচ করে দেওয়া হয়। ‘পিলা’ বোম্বেতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই বোম্বে পুলিস এই অর্ডার তামিল করল। কিন্তু চার্লস্ আশলী কূলেই নামতে পারতেন না যদি একটা অদ্ভুত যোগাযোগ না ঘটে যেত। ‘পিল্গা’ ১৮ই সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখে বোম্বে পৌঁছেছিল। পৌঁছামাত্রই তাকে ডকে যেতে হয়। আর ২ শে সেপ্টেম্বরের (১৯২২) আগে অন্য কোনো ইউরোপে যাওয়ার জাহাজ ছিল না। কাজেই আশলীকে কূলে নামতে দিতে এবং এই ক’দিন হোটেলে থাকতে দিতে পুলিস বাধ্য হয়েছিল। আসার সময়ে জাহাজে একজন সহযাত্রী মেজরের সহিত আশলীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। যতটা অনুমান করা যায় আশলী তাঁর চিঠিপত্রগুলি ও অতিরিক্ত টাকাকড়ি এই মেজরের নিকটে রেখে দিয়েছিলেন। জাহাজ হতে নেমেইে মেজর সোজা ম্যাজেস্টিক হোটেলে চলে যান। মনে হয় সেখানে তাঁর স্থান রক্ষিত ছিল। ‘ভিসা’ নাকচ ইত্যাদি ব্যাপারে আশলীর যেতে দেরী হয়। পুলিস রিপোর্টে আছে যে আশলীকে প্রথমে ম্যাজেস্টিক হোটেলে যেতে দেখা যায়। সেখানে গিয়ে তিনি মেজরের সঙ্গে দেখা করনে। তারপর এসে ঘর নিলেন তাজমহল হোটেলে। সাদা পোশাকওয়ালা পুলিস দূর থেকে হোটেলের মেইন গেটের ওপরে নজর রাখছিল।

চার্লস্ আশলী হোটেলের ঘরে বসে থাকলেন না। তিনি পেছনের গেট দিয়ে বার হয়ে গেলেন এবং ট্যাক্সিতে চেপে প্রথমে গেলেন নলিনী গুপ্তের বন্ধু কিরণবিহারী রায়ের সন্ধানে। তিনি কিন্তু ভয়ে চার্লস্ আশলীর সঙ্গে দেখাই করলেন না। এখানে বিফল মনোরথ হয়ে তিনি চলে গেলেন ইংরেজি দৈনিক বোম্বে ক্রনিকলের আফিসে। এই কাগজের ইংরেজ সম্পাদক মিস্টার মার্মাডিউক পিলের (Marmaduke Pickthall) সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। হয়তো আগে হতে পিকথলের সঙ্গে আশলীর পরিচয় ছিল কিংবা তাঁর নামে আশলী কোনো পরিচয়পত্র এনে থাকবেন। ডাঙ্গের সঙ্গে তাঁর দেখা করার দরকার ছিল। ইনটেলিজেন্স বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে এর অল্প দিন আগে মাত্র এম. এন. রায়ের সঙ্গে এস. এ. ডাঙ্গের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। যাই হোক, মিস্টার পিকথল সঙ্গে সঙ্গেই লোক পাঠিয়ে ডাঙ্গেকে “বোম্বে ক্রনিকলে’র আফিসে আনিয়ে নিলেন। দেখা হলো চার্লস্ আশলীর সঙ্গে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের। এম. এন. রায় যে যে বিষয়ে আশলীকে ডাঙ্গে ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেছিলেন সে সবই তিনি ডাঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপরে তিনি ডাঙ্গের হাতে দিলেন চিঠিপত্রগুলি এবং চতুর্থ কংগ্রেসের প্রতিনিধিগণের রাহাখরচের টাকা। এই টাকার পরিমাণ কত ছিল তা আমি জানিনে। তবে, ব্রিটিশ স্পাই মসউদ আলী শাহের মতে আটশত পাউন্ড। পাউন্ড নোটেই এই অর্থ ডাঙ্গেকে দেওয়া হয়েছিল।

বোম্বে পুলিস ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে এস. এ. ডাঙ্গের সঙ্গে চার্লস আশলীর দেখা হয়েছিল। শুধু কি তাই? কলকাতা হতে একজন এসেও আশলীর সঙ্গে গোপনে দেখা করে গিয়েছিলেন। পরে ডাঙ্গে নিজেই প্রচার করেছিল যে তার সঙ্গে আশলীর দেখা হয়েছিল। কারণ, সে যে পাউন্ড নোট ভাঙাচ্ছিল সেটা অন্যরা জেনে গিয়েছিলেন। চতুর্থ কংগ্রেসে কোনো প্রতিনিধি সে পাঠাবার চেষ্টাও করেনি। টাকাটা নিজেই সে পরিপাক করেছিল। আমি আগেই লিখেছি আন্তর্জাতিকতায় এস. এ. ডাঙ্গে বিশ্বাস করত না, কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ ভক্ষণে তার কোন অরুচি তখনও ছিল না, এখনও নেই। আর, কলকাতা হতে একজন যে আশলীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এ খবর বোম্বে ইনটেলিজেন্স বিভাগ মাঝ পথে চিঠি খোলাখুলি হতে পরে জানতে পেরেছিলেন। ভারত গবর্নমেন্ট অবশ্য আগেই জেনেছিলেন।

চার্লস, আশলীর ব্যাপার নিয়ে বোম্বে পুলিস ভারত গবর্নমেন্টের নিকটে অপদস্থের একশেষ হয়েছিল।

এখন কথা হচ্ছে এই যে কলকাতা হতে কে গিয়ে আশলীর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন? আশলীর জাহাজ কখন এসেছিল, কখন তাঁর সাম্রাজ্য ভ্রমণের ‘ভিসা’ নাকচ করা হয়েছিল, তার কিছুই আমি জানতেম না। আমার নিকটে রায় লিখেছিলেন যে নন্দলাল নামে একজন কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমাকেই স্থির করতে হবে রায়ের পুরানো পার্টির বন্ধুদের মধ্য হতে কার কার সঙ্গে তাঁকে দেখা করিয়ে দিতে হবে। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে ডাঙ্গের মুখেই আমি শুনি যে নন্দলাল আসলে ছিলেন চার্লস্ আশলী। তাঁর সম্বন্ধে আমি ওপরে যা যা লিখেছি সে সব কথাই সে আমাদের বলে, শুধু টাকা গ্রহণের কথাটি ছাড়া।

কলকাতার লোক যাওয়ার কথাটা অনেক পরে আমি সরকারী রেকর্ড হতে জানতে পেরেছিলেম। একবার আমার মনে এলো জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় কি গিয়েছিলেন? তাই তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম ১৯২২ সালের ১৮ই হতে ২০শে সেপ্টেম্বরের ভিতরে তিনি বোম্বে গিয়েছিলেন কিনা। তিনি আমায় বলেছেন যে ১৯২২ সালের ভিতরে কখনও তিনি বোম্বে যাননি। অন্য ঘটনার দ্বারা তাঁর কথা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ডাঙ্গে যখন গয়া কংগ্রেসে যাচ্ছিল তখন এস. এস. মিরাজকরের নিকট হতে সে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের নামে একখানি পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে যে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করার জন্যে ডাঙ্গে উদগ্রীব ছিল। ১৯২০ সালে বাঙলার দুটি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলের লোকেরা সকলেই জেল হতে মুক্তি পান। তখন এই দু’দলের লোকেরা বাঙলার নারায়ণগঞ্জে প্রস্তুত ঝিনুকের বোতাম (ওখানে বিস্তৃত কটেজ ইন্ডাস্ট্রি) নিয়ে বোম্বেতে ব্যবসায় করতে যান। আসলে উদ্দেশ্য ছিল নূতন ছেলে রিক্রুট করা। এ কাজে তাঁরা বিফল মনোরথ হয়েছিলেন। ওই সময়ে ‘যুগান্তর’ দলের জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সহিত এস. এস. মিরাজকরের পরিচয় হয়। চার্লস্ আশলী যে এসে ফিরে চলে গেছেন, একথা ডাঙ্গে নিশ্চয় জীবনলালকে বলে থাকবে। তিনি কিন্তু গয়া হতে কলকাতায় ফিরে এসে আমায় সে কথা জানাননি। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত তখন ডেত্রী-অন-শোনে তাঁর যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত বন্ধু চারুচন্দ্র ঘোষকে সেবা করছিলেন। ভূপেন্দ্রকুমারের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে জীবনলাল ডাঙ্গেকে সেখানে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। একথাই জীবনলাল আমায় বলেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালে এক বক্তৃতায় ডাঙ্গে বলেছে যে “মুজফফর মনে করেছে আমি ডেহরী-অন-শোনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। না, বেড়াতে যাইনি। আমরা সেখানে মিটিং করেছিলাম।” হাঁ, তাঁরা গোপন মিটিং করেছিলেন। তাই, আমায় কিছু জানাননি।

ইনটেলিজেন্স বিভাগের একটি রিপোর্টে খবরটি পাওয়ার পর আমি কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছিলেম না যে কলকাতা হতে কে গিয়ে আশলীর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। আমি এই সকল আবল-তাবল লিখছি। সেই জন্যে আমার জানার আগ্রহের কোনো শেষ ছিল না। সম্প্রতি “ন্যাশনাল আরকাইবস্ অফ্ ইন্ডিয়া” হতে সার সেসিল কে’ লিখিত “কমিউনিজম ইন ইন্ডিয়া”র ফটো কপি আনিয়ে পড়ার পরে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। সার সেসিল তাঁর পুস্তিকার ২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ

“It may be mentioned here that Muzaffar Ahmad, in Calcutta Had been warned by Roy of Ashleigh’s impending arrival and had sent Jotin Mitter to Bombay, to escort him to Calcutta. Jotin Mitter saw Ashleigh, who expressing his regret that he could not remain in India, told Jotin Mitter that he would send Nalini Gupta in his Place.”

মর্মার্থ

“এখানে উল্লেখ করা চলে যে রায় কলকাতায় মুজফফর আদকে আশলীর আসার কথা জানিয়েছিলেন। আশলীকে সঙ্গে করে কলকাতায় আনার জন্যে মুজফফর আহ্মদ তাই যতীন মিত্রকে বোম্বে পাঠান। সেখানে মিত্র আশলীর সঙ্গে দেখা করেন। আশলী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তিনি ভারতে থাকতে পাবেন না, তবে তিনি যতীন মিত্রকে এই আশ্বাস দেন যে তিনি নলিনী গুপ্তকে পাঠাবেন।”

যতীন মিত্র সম্বন্ধে আমি আগে অনেক বলেছি। তাঁর সম্বন্ধে এম. এন. রায়ের ধারণাও আমি এই পুস্তকে তুলে দিয়েছি। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে আশলীকে সঙ্গে আনার জন্যে আমি যতীন মিত্রকে বোম্বে পাঠাতে পারি? তাঁকে আমি বিশ্বাসই করতাম না। তিনি শিশিরকুমার ঘোষের সঙ্গে মাখামাখি করতেন। তাছাড়া আমি তো জানতামই না যে কোন্ তারিখে ও কোনো জাহাজে আশলী বোম্বে পৌঁছুবেন? যতীন তার জার্মানী যাওয়ার টাকা আসার জন্যে কলকাতায় অপেক্ষা করছিলেন। ৩১ পাউন্ড পাওয়া মাত্রই তিনি কলম্বোর পথে রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ওই পথে খরচ কম ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আমি এখানে মনে করতে পারছি না কোন্ মাসে তিনি টাকাটা পেয়েছিলেন? তবে এটা ঠিক কথা যে সেপ্টেম্বর মাসে (১৯২২) তৃতীয় সপ্তাহেও তিনি ইউরোপের পথে রওনা হননি। যতীন মিত্র প্রথম জার্মানী পৌঁছেছিলেন ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে, কিংবা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেও হতে পারে।

যতীন মিত্রকে কে বোম্বে পাঠিয়েছিলেন এবং কেন পাঠিয়েছিলেন? আমার নাম করে চার্লস্ আশলীকে কলকাতা নিয়ে এলে কার কি উদ্দেশ্য সাধিত হতো? যতীন মিত্রের বোম্বে যাওয়ার পেছনে নলিনী গুপ্তের প্রেরণার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বার্লিনে আশলীর নলিনী গুপ্তের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে নলিনী গুপ্তের পক্ষে জাহাজের নাম জেনে নেওয়া মোটেই অসম্ভব ছিল না। আর, জাহাজের নাম জানা থাকলে সে জাহাজ কখন বোম্বো পৌছুবে তা অতি সহজে জানা যায়। এম. এন. রায়কে ধোঁকা দেওয়াই ছিল নলিনী গুপ্তের একটা বিশেষ কাজ। ভারতে আসার জন্যে তিনি বার্লিন হতে জেনোয়া গেলেন। ক’দিন পরে বার্লিনে ফিরে এসে রায়কে তিনি জানালেন যে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারা গেল না। কিন্তু কেন, একথা রায় আর জানতে চাইলেন না। নলিনীর হাতে বৈধ পাসপোর্ট ছিল। এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি একবার ইউরোপ হতে কলম্বো হয়ে ভারতে এসেছিলেন এবং ভারত হতে কলম্বো হয়ে আবার ইউরোপে ফিরেছিলেন। সেই পাসপোর্ট তাঁর ছিল, পকেটে টাকাও ছিল। জেনোয়াতে টিকেট কেন তিনি কিনতে পারলেন না? এম. এন. রায়কে কেন মস্কো ও ইরানের পথে তাঁর ভারতে আসার ব্যবস্থা করতে হলো? এটা নিশ্চিতরূপে ধরে নেওয়া যায় যে নলিনী গুপ্ত এম. এন. রায়কে বলেছিলেন যে তাঁর কোন পাসপোর্ট নেই। নলিনী পুলিসের নিকটে বিবৃতিতে বলেছে যে ব্রিটিশ কন্‌সাল তাকে ভিসা দেয়নি। তিনি ভারতে আসছিলেন, আর ইউরোপে ফিরে যেতে পারবেন কিনা কে জানে,- তাই সোবিয়েৎ রাশিয়া ও ইরান ঘুরে যেতে চেয়েছিলেন। এর গূঢ় অর্থ ই ছিল যে প্রয়োজন হলে পুলিসকে কিছু খবর দিতে পারবেন। যতীন মিত্র একান্তভাবে তাঁরই লোক ছিলেন। তাঁকে দিয়ে হয়তো চার্লস্ আশলীর নিকট হতে রাহাখরচের টাকাটা হাত করতে চেয়েছিলেন। কারণ, নলিনী গুপ্তও ভারতে আসছিলেন। কিন্তু আমার মনে একটি সন্দেহ এই আছে যে নলিনী তার পরিকল্পনার কথা যতীন মিত্রকে কি ভাবে জানালেন? ডাকে জানালে শতকরা নিরানব্বই ভাগ সম্ভাবনা ছিল যে তা পুলিসের হাতে পড়বে। তাছাড়া, নলিনীর এসে পৌঁছানো পর্যন্ত যতীন ভারতে থাকতে পারত না।

যতীন মিত্রের বোম্বে যাওয়া সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় সন্দেহ ছিল শিশিরকুমার ঘোষের ওপরে। আগেই বলেছি শিশিরের সঙ্গে যতীন মিত্রের খুব মাখামাখি হয়েছিল। যতীনের বোম্বের যাওয়ার পরিকল্পনা শিশিরের পক্ষে করাও সম্ভব। শিশির পুলিসের নিয়োজিত লোক ছিল। চার্লস্ আশলীর ভারতে আসার খবরটা ইউরোপেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। কোন্ জাহাজে আশলী আসছিলেন কোন্ তারিখে তিনি বোম্বে পৌঁছুবেন এর সব কিছু পুলিস জানত। পুলিসের নিকট হতে খবর পেয়েই শিশিরকুমার ঘোষ সম্ভবত যতীনকে নিয়ে ফাঁদ পেতেছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাহাখরচের টাকাটা হাত করা। আশলী আমাকে চিনতেন না, আমার ফটোও তিনি কোনো দিন দেখেননি, কাজেই তাঁকে যে কোনো লোকের কাছে নিয়ে গিয়েই বলতে পারা যেতো যে “ইনিই মুজফফর আহমদ”। যার সঙ্গেই হোক না কেন, যতীন মিত্রের চক্রান্ত কার্যকরী হয়নি।

১৯৬৪ সালে নিজের সম্বন্ধে ৪ দিনব্যাপী যে বক্তৃতা শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ন্যশনাল কাউন্সিলের সভায় দিয়েছিল তাতে সে কানপুর জেলে চার্লস্ আশলীর আগমন সম্বন্ধে আমাদের যা যা বলেছিল সে-সব কথা একেবারেই উল্টে দেয়। ছাপার অক্ষরে এ সব কথা পড়ে আমারও মনে সন্দেহ হতে থাকে যে হয়তো আমি ভুল শুনেছিলেম। ‘এখন ডাঙ্গে যা বলছে তাই হয়তো সত্য’। ডাঙ্গে বলল, মার্মাডিউক পিকথল আশলীর সঙ্গে ডাঙ্গের সাক্ষাৎ করিয়ে দেননি। এই কাজটি করিয়েছিলেন ‘বোম্বে ক্রনিকলে’র এসিস্টান্ট এডিটর শ্রী আর. কে. প্রভু। শ্রীপ্রভুকে এ কাজ করার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ্ ব্রেলভী। তিনি ‘বোম্বে ক্রনিকলে’র জয়েন্ট এডিটর ছিলেন এবং তাজমহল হোটেলে থাকতেন। অশীতিবর্ষ বয়স্ক শ্রীপ্রভুকে দিয়ে এই বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছিল।

ডাঙ্গে দ্বিতীয় মিথ্যার অবতারণা এই করেছিল যে আশলী আমেরিকার নাগরিক ছিলেন। অবাঞ্ছিত বিদেশী নাগরিকরূপে তাঁকে দেশ হতে বহিষ্কার করার জন্য কোর্টের একটা হুকুমের প্রয়োজন ছিল। তারই জন্যে তাঁকে কয়েক দিন তাজমহল হোটেলে থাকতে দিতে হয়েছিল। অথচ অবাঞ্ছিত ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার কারণে চার্লস্ আশলী ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমেরিকা হতে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তাঁর নিকটে ব্রিটিশ নাগরিকের পাসপোর্ট ছিল। তা থকে তাঁর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভ্রমণের ভিসা নাকচ করা হয়েছিল। তাঁর জাহাজ হতে নামার মুখে যদি পুলিস তাঁর সাম্রাজ্য ভ্রমণের ভিসা বাতিল না করতে পারতেন তবে পাসপোর্ট ছাড়াও তিনি এদেশে থেকে যেতে পারতেন। কেউ তাঁকে স্পর্শ করতে পারতেন না।

চার্লস আশলী ১৮ই সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখে প্রথম বোম্বে পৌঁছেছিলেন। তাঁর বোম্বে ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রথম জাহাজ ছিল ২২ শে সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখের “কাইসার-ই-হিন্দ”। এই জাহাজেই তিনি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ সাংবাদিক জর্জ স্লোকম্বে (George Slocombe) গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন কিনা তা আমি জানিনে। তবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যে ছিলেন তাতে এতটুকুও সন্দেহ নেই। তিনি ‘ডেইলি হেরাল্ডে’র প্রতিনিধি ছিলেন। ভারতে আসার সময়ে তিনি আশলীর জাহাজে চড়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি করেছিলেন। ‘কাইসার-ই-হিন্দ’ মার্সাইতে পৌঁছার পরেও প্যারিসে স্লোকম্বের সঙ্গে আশলীর আবার দেখা হয়। তখন তিনি ভারতবর্ষে কি কি ঘটেছিল তার সব কথাই স্লোকম্বেকে জানান। এই থেকে আমার মনে হয় যে স্লোকম্বে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। আশলী স্লোকম্বেকে বলেছিলেন, একজন ইংরেজ সম্পাদক তাঁর সঙ্গে এস. এ. ডাঙ্গের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, ডাঙ্গের হাতে তিনি চিঠিপত্র ও রাহাখরচের টাকা ইত্যাদি দিয়ে এসেছে ইত্যাদি। স্লোকম্বে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ইম্পিরিয়েল পুলিস ইনটেলিজেন্সের (I.P.I) নিকটে সব কথা বলে দেন।

Source H. R His address in Paris is 19 Rue Dantin

15.11.22

Indian Communist Party

2. George Slocombe, the representative of Daily Herald in Paris, whose connection with M.N. Roy and Charles Ashleigh was mentioned on Page 4 of last note of this series, has been located in Paris. According to Slocombe, Ashleigh Arrived in Paris towards the end of October, and left for Berlin, where he saw Mrs. Evelyn Roy. Slocombe says Ashleigh is at the present moment in Humburg, he is expecting him back shortly in Paris. From Ashleigh Slocombe Learnt the following details regarding his activites in Bmobay. In Bombay Ashleigh met and Englishmen, the editor of a paper, Slocombe cannot remember the name of this man, Which Ashleigh gave him, but said it was a long name. Through this Englishman, Ashleigh met a certain Indian with whom the editor was in touch, and handed over to this Indian Passage money for delegates, who were invited to join roy, and the invitation issued by Roy. Slocombe added that the English editor was himself a Communist.”

(Home dept. Folitical File no. 956 of 1922. Page 11, Extract From IPI)

সংক্ষিপ্তসার

চার্লস্ আশলীর ব্যাপারটি শুরু হতেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। আশলীর রওয়ানা হওয়ার খবরটাও হয়তো স্লোকম্বের মারফতেই ইম্পিরিয়েল পুলিস ইনটেলিজেন্স পেয়ে গিয়েছিল এবং তা থেকেই ব্রিটিশ ফরেন, ডিপার্টমেন্টের নির্দেশে বোম্বে পৌঁছা মাত্রই তাঁর সাম্রাজ্য ভ্রমণের ভিসা বাতিল হয়ে যায়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আশলী প্যারিসে ফিরে গেলেন। স্লোকম্বেকে তিনি বললেন বোম্বেতে কি কি ঘটেছে। স্লোকম্বে ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকদের বললেন যে বোম্বেতে একখানি ইংরেজি দৈনিকের ইংরেজ সম্পাদকের সাহায্যে আশলীর একজন ভারতীয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এই ভারতীয়ের সঙ্গে আগে হতে ইংরেজ সম্পাদকের যোগাযোগ ছিল। ইংরেজ সম্পাদকের নামটি বড় লম্বা। এই জন্যে স্লোকম্বে তা মনে রাখতে পারেননি। (এখানে মার্জিনে ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা লিখে রেখেছেন Marmaduke Pickthall.) ভারতীয়টির হাতে আশলীর প্রতিনিধিদের রাহাখরচের টাকা, এম. এন রায়ের নিমন্ত্রণ পত্র ইত্যাদি দিয়ে এসেছিলেন। (নিমন্ত্রণ পত্রের মানে এই হচ্ছে যে রায় বার্লিনে একটি কন্ফারেন্স ডেকেছিলেন) স্লোকম্বে বলেছেন এই ইংরেজ সম্পাদক একজন কমিউনিস্ট।

শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে তার ১৯৬৪ সালের দীর্ঘ বক্তৃতায়, অর্থাৎ ঘটনা ঘটার বিয়াল্লিশ বছর পরে কতকগুলি জঘন্য মিথ্যার অবতারণা করেছে। সে বলেছে মার্মাডিউক পিল তাকে চার্লস আশলীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেননি, দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন বোম্বে ক্রনিকলের জয়েন্ট এডিটর সৈয়দ আবদুল্লাহ্ ব্রেলভীর অনুরোধে ওই কাগজের এসিস্ট্যান্ট এডিটর শ্রী আর কে প্রভু। এ বিষয়ে আশি বছরের বৃদ্ধ শ্রীপ্রভুকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছে। ডাঙ্গের হয়ে যিনি এই জালিয়াতির জাল বিস্তার করেছেন তাঁর নাম মোতিরাম গজানন দেশাই। তিনি আমাদের সঙ্গে মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামী ছিলেন। যদিও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না, তবুও তাঁর ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ ছিলাম। জেলে ডাঙ্গের প্রতি তিনি বিতৃষ্ণ ছিলেন। হঠাৎ বৃদ্ধ বয়সে কেন তাঁর এই অধঃপতন ঘটল, ডাঙ্গের জন্যে কেন যে তিনি শ্রীপ্রভুকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ালেন, আর ডাঙ্গের তাতে কি উপকার হলো তার কিছুই আমরা বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া, কি কারণে আশলীকে ডাঙ্গে আমেরিকার নাগরিক রূপে দাঁড় করাতে চাইল তাও বোঝা গেল না।

আশলী ভারতবর্ষ হতে পারিসে ফিরে গিয়েই ব্রিটিশ সাংবাদিক জর্জ স্লোকম্বেকে সব কথা বলেছিলেন। আর, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্লোকম্বে এই সব কথা ব্রিটিশের ইম্পিরিয়েল পুলিস ইনটেলিজেন্সের নিকটে এক বিবৃতিতে বলে দেন। ন্যাশনাল আরকাইস্ অফ্ ইন্ডিয়ায় তার প্রমাণ রক্ষিত আছে। একথা ডাঙ্গে হয়তো জানত না, কিন্তু তার হঠাৎ পক্ষাবলম্বনকারী মোতিরাম গজানন দেশাই তো জানতেন যে চার্লস আশ্লী তখনও (১৯৬৮) বেঁচে আছেন। আমি খবর পেয়েছিলেম যে ১৯৬৬ সালের শেষার্ধেও তিনি ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে জীবিত ছিলেন। তার পরে আমি আর কোনো খবর নিইনি। আমার বিশ্বাস যে কমরেড চার্লস্ আশলী আজও (এপ্রিল, ১৯৬৯) জীবিত আছেন। তিনি যে ইংরেজ, মার্মাডিউক পিকথল যে তাঁকে ডাঙ্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি যে ডাঙ্গের হাতে অনেক চিঠিপত্র ও টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ আমাদের জাতীয় মুহাফিজখানায় রক্ষিত আছে। আমি ওপরে এ প্রমাণের কিছু কিছু উল্লেখ করেছি।

কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা, ১৯২৪ মোকদ্দমার আগে

শওকতা উসমানীকে আশলীগড় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় ভালোই করেছিলেম। ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের তখন শেষ। আগেই বলেছি এই সময়ে আমার কোনো থাকার জায়গা ছিল না। তাই আবদুল হালীমকে, তারও কোনো জায়গা ছিল না, সঙ্গে নিয়ে চাঁদনী ইলাকায় তিন নম্বর গুমঘর লেনে আমার ছাত্রদের বাড়ির বৈঠকখানায় প্রতি রাত্রে ঘুমাই। একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে সবে উঠেছি, দেখলাম কলকাতা পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব-ইন্সপেক্টর মুহম্মদ ইসমাইল ওই গলি দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর পুলিসে ঢোকার আগেও তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল। যদিও আলোয়ান দিয়ে মাথাটা ঢেকে রেখেছিলেন তবুও তাঁর কপাল দেখে তাঁকে চিনলাম। আমি নাম ধরে তাঁকে ডাকলাম এবং বললাম এত ভোরে এদিকে কেন? বললেন, তাঁর একটি চাকরানী পালিয়েছে, শুনেছেন চাঁদনীতে কোনো বাড়ীতে কাজে লেগেছে। আসলে তিনি দেখতে এসেছিলেন কোন্ কোন্ পয়েন্টে পুলিসের ওয়াচাররা দাঁড়াবে।

একসঙ্গে চারজন, না, ছয়জন ওয়াচারের এক দঙ্গল আজ তা আমার ভালো মনে নেই, আমার পেছনে পেছনে ঘুরতে লাগল। ক’দিন যেতে না যেতে দেখলাম এই ওয়াচারদের সঙ্গে একজন সাবইন্সপেক্টরও থাকছেন। একেবারে খোলাখুলি ওয়াচ চলতে লাগল। এই রকমটা অন্য কারুর বেলায় হয়েছে বলে শুনিনি। পরে শুনেছিলেম কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার মিস্টার কীড় নাকি বলে দিয়েছিলেন যে মুজফফর আর্মদের ওপরে খোলাখুলি ওয়াচ চলুক। এই এক দঙ্গল লোক নিয়ে কোথাও আমার যাওয়ার উপায় থাকল না। ভাবলাম ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে দেখি। তাঁর নিকটে একজন লোক পাঠালাম। তিনি বলে পাঠালেন অনেক আগে হতে গিয়ে “সারভ্যান্ট” (ইংরেজী দৈনিক) অফিসের দোতালায় থাকবেন। আমি যেন ওয়াচারদের সঙ্গে নিয়েই যাই এবং সোজা দোতলায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ওয়াচাররা রাস্তাতেই থেকে যাবে। সেইভাবেই ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে দেখা করেছিলেম। তিনি কিছু কাল গ্রামে বাস করে আসতে বললেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে আমার গ্রামে যাওয়ার উপায় ছিল না। তার ওপরে আমি ছিলাম একেবারেই নিঃসম্বল। ভূপতি মজুমদারের মারফতে পঞ্চাশ পাউন্ডের ড্রাফটখানি পেলেও সেটা তখনও ক্যাশ করানো হয়নি। এই সময়ে জীবনলাল চট্টোপধ্যায়ও বলে পাঠিয়েছিলেন যে তিনি মুনসীগঞ্জের (ঢাকা) ওদিকে গ্রামে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।

এদিকে আর একটা কাণ্ড ঘটে গেল। এই ওয়াচারদের দল নিয়েই আমার দিন কাটছিল। একদিন বিকাল বেলা বেড়াতে বা’র হয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ঘাসের ওপরে কিছুক্ষণ বসেছিলেম। ওয়াচাররাও কিছু দূরত্ব বজায় রেখে ঘাসের ওপরে বসে পড়েছিল। হঠাৎ আমার মাথায় একটা খেয়াল চাপল। সেন্‌ট্রাল কলকাতা গলিঘুঁজিতে ভরা। ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখা যাক ওয়াচারদের এড়িয়ে বার হয়ে যাওয়া যায় কিনা। অনেক আগে আমি সে সব চিনে রেখেছিলেম। আমি উঠেই হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে হাঁটার গতি যথাসাধ্য বাড়িয়ে দিলাম। এখানকার গলিঘুঁজি ওয়াচারদের চেনা ছিল না। তারা প্রায় সবাই পেছনে পড়ে গেল। মির্জাপুর (এখনকার সূর্য সেন) স্ট্রীট যখন পার হচ্ছিলাম তখন পেছনে ফিরে দেখলাম ফরিদপুর জিলার সেই টিকিটওয়ালা ব্রাহ্মণটি আমার পেছু ছাড়েনি। আমাদের বাঙলা দেশে কেউ মাথায় টিকি রাখেন না, কিন্তু এই ব্রাহ্মণটির মাথায় মোটা টিকি ছিল। আমার খুব রাগ হলো লোকটির ওপর-ভাবলাম ওকে আজ রাত্রে স্নান করিয়ে ছেড়ে দেব। বৈঠকখানার মুসলিম ইলাকার সরু সরু পথগুলি (রাস্তা নয়) ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম। সেই সব পথে লোকে বাসন ধোয়া জলও ফেলে। তখনও বাঙলা দেশে চপ্পল পড়ার রেওয়াজ হয়নি, লোকেরা শু পরতেন। তা না হলে এই লোকটির পা বাসন ধোওয়া জলে ভিজে যেতো। আমি নিজে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেম। কলেজ স্কোয়ারে এসে অনেক্ষণ বসে থাকলেম। তারপরে খুব ধীরে ধীরে স্কোয়ারের ভিতরে বেড়াচিছলেম। গেট বন্ধ হওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটি খেপা কুকুর এলো। গায়ে লম্বা লম্বা লোমওয়ালা যে ছোট্ট কুকুরগুলি হয় তার একটি। প্রথমে কুকুরটি পুলিসের লোকটিকে কামড়াতে গিয়েছিল। সে এমন জেরের সঙ্গে হইচই করতে লাগল যে কুকুরটি লাফিয়ে উঠে আমার হাঁটুর নীচে কামড়ে দিল এবং আমার পরনের কাপড়ে তার দাঁত আটকে গিয়ে ঝুলতে লাগল। আমি জোরে ঝেড়ে ফেলে দিলাম কুকুরটিকে। তারপরে সে আরও কয়েকজনকে কামড়ে দিল। এই সবকিছু এক মিনিটের কম সময়ের ভিতরে ঘটে গিয়েছিল। মির্জাপুর স্ট্রীটের একটি দোকানে গিয়ে আলোতে ঘাটা দেখছিলাম, একজন ভদ্রলোক বললেন এখনই মেডিক্যাল কলেজের এমারজেন্সীতে চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার পরিচিত একজন সিনিয়র ছাত্র ডিউটি দিচ্ছে। তিনি ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করে নাইট্রিক এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। আমার ঠিকানা ইত্যাদিও লিখে নিলেন। সে যুগে পাস্তর ইনস্টিটিউট ছিল শিলঙ্গ পাহাড়ে। কলকাতায় না ছিল কোনো হিমঘর, না ছিল কোনো রেফ্রজারেটর। শিলঙে আমায় যেতেই হবে। তবুও আমি ডাক্তার তেজেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে বললাম আপনি এখানেই একটি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আমার শিলঙে যাওয়া বন্ধ করুন। তিনি আমায় বোঝালেন যে এখানে চিকিৎসা করার মাল-মসলা নেই। একটি পুস্তক আমায় পড়ে শোনালেন যে কুকুরে কামড়াবার আঠারো বছর পরেও জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। বাধ্য হয়ে আমায় শিলঙ যেতে হলো।

কেন শিলঙে যেতে চাইনি?

এন্টির‍্যাবিক চিকিৎসার জন্যে কেন আমি শিলঙে যেতে চাইনি তার একটি ক্ষুদ্র ইতিহাস আছে। ১৯২২ সালের মে মাস হতে এম এন রায়ের সঙ্গে আমার পত্র লেখালেখি আরম্ভ হয়েছিল। প্রায় তখন থেকেই তিনি আমায় ধারণা ইউরোপে ডাকছিলেন। বলছিলেন অনেক কিছু আলোচনা আছে। আমার ধারণা হয়েছিল আমার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি অনেক কিছু আমায় বোঝাতে চান এবং আমার নিকট হতেও দেশের অনেক অবস্থা বুঝতে চান। আমারও বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ডাঙ্গের মতো কমিউনিজমের সন্ধানে ইউরোপে যেতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু রায় আমায় ইউরোপে ডাকেন বটে, রাহাখরচের টাকা পাঠান না। পুলিসের নজরে যখন পড়ে গেছি তখন পাসপোর্ট পাওয়ার কোনো আশা ছিল না। গেলে জাহাজে চাকরী করে যেতে হবে। এম এন রায়ের আমাকে লেখা বেশীর ভাগ পত্রই পুলিস পড়ছিল। কাজেই তাদের নজর এদিকেও থাকবে। আমাদের মতো লোকের স্যালুন বিভাগে কাজ নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকায় এই বিভাগের ওপরে পুলিসের নজর থাকবে সবচেয়ে বেশী। তার পরে থাকবে ডেকের ওপরে। কিন্তু আমার মতো একজন দুর্বল লোক কয়লাওয়ালা যে হতে পারে, মনে হয়েছিল এটা পুলিস বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই আমি এদিকেই চেষ্টা করলাম। জাফর আশলী সাহেব নাবিক নেতা আফতাব তখন আমেরিকায় ছিলেন। জাফর আশলী সাহেব কথা দিলেন যে তিনি সর্বপ্রকারে সাহায্য করবেন। খিদিরপুরে কালীবাবুর বাজারে তাঁর জাহাজীদের ইউনিফর্মের দোকান ছিল। তাঁর কারবার ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে। তিনি বললেন এমন সেরাঙের সঙ্গে তিনি ব্যবস্থা করে দিবেন যিনি আমাকে দিয়ে কোনো কাজই করাবেন না। মুশকিল হয়েছিল এই যে অপরিষ্কার- অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্যে আমার গায়ের কোনো কোনো জায়গায় তখন খোস হয়েছিল। খোসওয়ালা লোকের জাহাজে চড়া বারণ। তাই এই খোস ভালো করতে বহুদিন লেগে গেল। তার পরে জাফর আশলী সাহেবের সঙ্গে ইউরোপে যাওয়া সম্বন্ধে আবার কথা বলছি, এমন সময়ে আমায় কামড়াল খেপা কুকুরে। শিলঙ গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেল। সেখানে থেকে ফিরে এসে এক ভোরের খবরের কাগজে পড়লাম কানপুরে একজন ‘বলশেভিক চর’ গিরেফতার হয়েছেন। এই ‘বলশেভিক চর’টি ছিল শওকত উসমানী। সেদিন ১০ই মে (১৯২৩)। তার মানে শওকত উস্‌মানী গিরেফতার হয়েছিল ৯ই মে (১৯২৩) তারিখে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝেছিলেম যে এবারে আমার পালা। কোথাও সরে থেকে যে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করব তার উপায় ছিল না। কুত্সুদ্দীন সাহেব কুস্টিয়ার নিকটবর্তী সাঁওতা নামক একটি গ্রামে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেই ড্রাফটখানা তখনও ভাঙানো হয়নি। কুত্সুদ্দীন সাহেবকে তা রাখতে দিয়েছিলেম। তিনি এমন এক জায়গায় ড্রাফটখানা রেখে গেছেন যে সেখান থেকে তা নিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার মানে যাঁর নিকটে রাখা আছে তিনি তা আমায় দেবেন না। সৌভাগ্য যে হঠাৎ লোক পেয়ে কুত্সুদ্দীনকে খবর পাঠালাম। লিখে দিলাম যে “আপনার-বাড়ী যে কোনো দিন পুলিস তালাশি করবে। পত্র পাওয়া মাত্র চলে আসুন।” তিনি এলেন ১৬ই মে (১৯২৩) রাত্রে। আমি তখন কুত্সুদ্দীন সাহেবের বাড়ীগুলির মধ্যে ৫, মৌলবী লেনে থাকি। সব শুনে তিনি বললেন “ড্রাফট ভাঙানোর জন্যে অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাল আমি আপনাকে কিছু টাকা দেব। আপনি আপাতত কোথাও সরে পড়ুন”। খুব ভোরে আমরা তখনও ঘুমিয়ে আছি। জুতোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম মিস্টার কীড় মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। সাব-ইনস্পেক্টর বজলে মুরশেদী বলছেন, “Sir, he is Muzaffar Ahmad” (“সার, ইনিই মুজফফর আদ”)

দু’টি পাশাপাশি বাড়ী। ১৩ নম্বর ইলিশিয়াম রো ও ১৪ নম্বর ইলিশিয়াম রো, এখন নাম লর্ড সিংহ রোড। তের নম্বরের বাড়ীটি বেঙ্গল পুলিসের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের, আর চৌদ্দ নম্বরেরটি হলো কলকাতা পুলিসের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের। মধ্যখানে প্রাচীর আছে, আবার এ-বাড়ী হ’তে ও-বাড়ীতে যাতায়াতের দরওয়াজাও আছে।

আমাকে নিয়ে গিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের বাড়ীর আউট হাউসে প্রথমে বসানো হলো। এই দুই বাড়ীর লোকদের মধ্য নিয়ম আছে যে কোনো নূতন লোক ধরা পড়ে এলে দু’বাড়ীর ছোট-বড় অফিসাররা ও ওয়াচাররা একবার করে তাঁকে দেখে যান। আমাকেও সকলে একবার দেখে গেলেন। অর্থাৎ যাঁরা আগে আমায় কখনও দেখেননি, তাঁরা চিনে নিলেন আমাকে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসিস্টান্ট সব- ইনস্পেক্টর ও ওয়াচাররা জোরে জোরে প্রতিবাদ করতে লাগল যে রোদে দাঁড়িয়ে ওয়াচ করলাম আমরা, আর এখন ট্রাভেলিং এলাউন্স ও ভাতা মারবে আই বি’র লোকেরা”। এটা ছিল এস বি আর আই বি’র পুরানো ঝগড়া। কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে হলে আই বি’র লোকেরাই যেতো। আমি মনে মনে নিশ্চিত হলাম যে যেজন্যেই হোক পেশোয়ারে যাচ্ছি। অফিসাররা খুব খুশী যে তাঁরা মোটা এলাউন্স মারবেন।

সন্ধ্যার সময় মিস্টার কীড় আমায় বললেন “তোমায় ক্রিমিন্যাল প্রসেডিওর কোডের চুয়ান্ন ধারা অনুসারে গিরেফতার করা হলো”। তখনকার দিনে কলকাতা পুলিসের কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ছিল। তাঁরা যে কোনো লোককে গিরেফ্ফার করে ১৫ দিন পুলিস হাজতে রেখে দিতে পারতেন। আমাকে লালবাজার পুলিস লক্-আপে পাঠানো হলো। আমি নিজে জনতাম না চুয়ান্ন ধারা কি? আমার তখনকার বন্ধুরাও জানতেন না। আমার গিরেতার হওয়ার নবম দিবসে বন্ধুরা মিস্টার এ কে ফজলুল হককে খবর দিলেন। তখনই তিনি ইলিশিয়াম রোতে গিয়ে আমার জামিন চাইলেন এবং বললেন, সঙ্গে সঙ্গে জামিন মঞ্জুর না করলে পরেরদিন তিনি হাইকোর্টে দরখাস্ত করবেন।

ফজলুল হক সাহেব স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস হতে বা’র হয়ে যাওয়া মাত্রই কীড় সাহেব আমায় ৫০০ টাকার জামিনে মুক্তি দেওয়ার অর্ডার দিলেন ক্রিমিনাল প্রসেডিওর কোডের ৫৪ ধারা অনুসারে গিরেস্তার হওয়া আসামীর জামিন চাওয়া মাত্রই মঞ্জুর করতে হয়। বাইরে আসার পরে সর্বস্তরের লোকেরা বলতে লাগলেন যে কোনো মোকদ্দমা নেই। সত্যিকার মোকদ্দমা থাকলে কি পুলিস কখনও ৫০০ টাকার জামিনে ছেড়ে দেয়? সকলের কথায় আমি বোকা বনে গেলাম! পুরো ব্যাপারটাই ভুল বুঝলাম। ইচ্ছা করলেই আমি সেই সময়ে সরে যেতে পারতাম। চাই কি ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম। ড্রাফট ভাঙিয়ে ৭৫০ টাকা হাতে এসেছিল। আমি শুধু মোকদ্দমার কথাই ভেবেছিলাম। ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বিনা বিচারে বন্দী হওয়ার কথা আমার মনেই আসেনি। কোনো বন্ধুও আমার এই সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেননি। উচ্চপর্যায়ে সরকারী মহলে কি হতে যাচ্ছে তা আমি কি করে জানব?

গিরেফতার হয়ে হাজতে থাকার সময়ে আমায় প্রতিদিনই লালবাজার হতে ইলিশিয়াম রো’তে নিয়ে গিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল। পুলিস কতটা কি জানে তা বুঝবার জন্যে আমি ক’দিন কিছুই বললাম না তার পরে একদিন চিঠি পত্রের বাণ্ডিল খুলে আমায় দেখানো হলো। তাতে দেখলাম আমাদের দু’পক্ষের পত্রের অনেক ফটো কপি। তখন ভাবলাম আমাকে কৌশল বদলাতে হবে। বললাম এম এন রায়কে আমি চিঠি পত্র লিখি, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকেও মানি। নলিনী গুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথাও বললাম। এও বললাম যে নলিনী গুপ্ত কমিউনিস্ট নন। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দিকে তাঁর মনের টান আছে। [অনেক পরে খুব ভালো ক’রে অনুসন্ধানের পরে জেনেছি যে নলিনী যুগান্তর বা অনুশীলন এই দু’পার্টির কোন পার্টিরই সভ্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সুঃসাহসিক ভবঘুরে]। আমি যে বিবৃতি দিয়েছিলেম তার কপি এখন ভারতের জাতীয় মুহাফিজখানা হ’তে পাওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্ৰদেশ হ’তে আরম্ভ ক’রে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে সকল কমিউনিস্ট ছিলেন। (মস্কো ষড়যন্ত্রে মোকদ্দমার আসামীদের যোগ করে বলছি) আমি তাঁদের চিনতাম না, তাঁদের অতীত সম্বন্ধেও আমার কিছু জানা ছিল না। একমাত্র শওকত উসমানীকে চিনতাম। সে আমার আগে ধরা পড়েছিল। সেও বিবৃতি দিয়েছিল। অবশ্য তার বিবৃতি আমি পড়িনি, তার কপিও নিইনি। প্রথম তিনজন স্টেট প্রিজনারের মধ্যে আমি গিরেতার হয়েছিলেম সকলের পরে।

বাঙলা দেশে ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সংযোগ ছিল। তাঁদের বিষয়ে আমি কোনো বিবৃতি দিইনি, একটি কথাও বলিনি পুলিসকে।

পুলিস আবদুল হাফিজের বিবৃতির সঙ্গে আমার বিবৃতি কিঞ্চিত ঘুরিয়ে দিয়েছে। নলিনীর সঙ্গে আবদুল হাফিজের সাক্ষাৎ হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রীটে, আমার সঙ্গে নয়।

ব্রিটেনের ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের চোখে আমরা ছিলাম ‘বলশেভিক’। সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়ার মতে আমরা কেউ জেলের বাইরে থাকার উপযুক্ত লোক নয়। তাই তিনি চাইতেন, হয় আমাদের দণ্ডিত কয়েদীরূপে কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক, নতুবা আমাদের করা হোক ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের বন্দী। সেই সময়ে এই সব কথা ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারিনি। এখন পুরানো সরকারী রেকর্ড হাতে এসেছে ব’লে সব কথা অনর্গল বলে যাচ্ছি। ‘বলশেভিকবাদ’ ভারতবর্ষে ঢুকে পড়লে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বনাশ হবে এই মনোভাব হতে স্টেট সেক্রেটারি খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভারত গবর্নমন্টের ভিতরে একটা ইতস্তত ভাব ছিল। কারণ, অবস্থাটা ঠিক ‘ধর’ আর ‘মার’র মতো ছিল না।

মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা পেশোয়ারে আরম্ভ হওয়ার আগেও অনেক জল্পনা- কল্পনা হয়েছিল। কেউ কেউ বললেন আসামীরা সবে বিদেশ হতে এসে দেশে ঢুকেছেন। তাতে মোকদ্দমা কি ক’রে চলতে পারে? গবর্নর জেনারেলের একজেকিউটিব কাউন্সিলের হোম মেম্বর (মালকম হেইলি) বললেন মস্কোতে কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়লে সেটা কি ক’রে অপরাধ হতে পারে? আসামীদের ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বন্দী করে রাখা হোক! কেউ কেউ বললেন শওকত উসমানী মস্কো হতে ফিরে এসে ভারতময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে ধ’রে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় জুড়ে দিলে মোকদ্দমাটির জোর হয়। উৎসাহের বশে সীমান্ত প্রদেশের সরকার পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা করার উদ্দেশ্যে শওকত উসমানীর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও ইসু করে দিয়েছিল। এই ওয়ারেন্ট ছিল বলেই কানপুরে ধরা পড়ার পরে উসমানীকে পেশোয়ারে পাঠানো হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ কমিশনার সার জন মাফে বললেন তাঁর ইচ্ছা আসামীদের ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বন্দী করে রাখা। তবে, তাঁদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমাও চলতে পারে। কর্নেলকে বললেন মোকদ্দমা চলতে পারে তো মোকদ্দমাই চলুক। মোকদ্দমা কিন্তু পেশোয়ারেই চালাতে হবে। তখনই তাঁর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল যে পেশোয়ারের জুডিশিয়েল কমিশনার মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমায় যে রায় দিয়েছিল সেই রায় ওলটাতে পারবেন না। একই জুডিশিয়েল কমিশনার তখনও ছিলেন।

কিন্তু শওকত উসমানীকে গিরেস্তার করে যখন পেশোয়ারে পাঠানো হলো তখন মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা দায়রা আদালতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মাঝ পথে কোনো আসামীকে যোগ করলে মোকদমা আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। তাছাড়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ কমিশনার সার জন মাফে (Sir John Maffey) ভারত গবর্নমেন্টকে লিখলেন :

“3. There is now no conspiracy case pending in this province, though, owing to an inaccurate message issued to the Press from Cawnpore, the Criminal Investigation Department of the United Provinces and Bengal appear to have acted on the assumption that there is, The United Provinces’ Criminal. Investigation Department have informed the intelligence Branch, Peshwar, that the government of the United Provinces are not prepared to institute a case against Usmani in those provinces, while the Bengal Criminal Investigation Department have arrested associate of Usmani named Muzaffar Ahmad, and have suggested that the should be included in the case with the former in Peshwarl.

“4. While the trial of Usmani in Peshwar might Possibly he argued to be legal, if evidence of his activities outside India were strong (Which it is not), neither her nor Muzaffar Ahmad, Who has never Appartenly left India, Can be tried in Peshawar for their actions in furtherence of the revolutionary conspiracy committed in India; for these actions, though they are connected with individuals and movements in the Punjab, United Provinces, Bengal, Bombay and Possibly, other Provinces, do not, so far as the available evidence shows, deffinitely link up with a single individual or act in the North West Fronier Province.” (No. 487.P.C.N, dated the 29th May, 1923)

সংক্ষিপ্ত অনুবাদ

“(৩) কোনো অনিষ্পন্ন ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা এখন পেশোয়ারে নেই। কানপুর হতে সংবাদ সরবরাহকারীদের যে ভুল খবর দেওয়া হয়েছে তাতে সংযুক্ত প্ৰদেশ ও বাংলার সি আই ডি ধরে বসে আছে এইরকম মোকদ্দমা পেশোয়ারে রয়েছে। সংযুক্ত প্রদেশের সি আই ডি তাই পেশোয়ারের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে লিখল যে তাদের প্রদেশের গবর্নমেন্ট শওকত উসমানীর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে রাজী নয়। বাঙলার সি আই ডি পেশোয়ার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে লিখল যে তারা শওকত উসমানীর সাথী মুজফফর আহমদকে গিরেস্তার করেছে। তাদের প্রস্তাব এই যে পেশোয়ারে শওকত উসমানীর মোকদ্দমায় মুজফফর আহমদকেও জুড়ে দেওয়া হোক।

“(৪) যদি প্রামণ পাওয়া যায় যে ভারতের বাইরে উসমানী খুব জোরদার কাজ করেছে, তবে পেশোয়ারে উসমানী জোরদার কাজ করেনি। এটা পরিষ্কার ব্যাপার যে মুজফফর আহমদ কখনও ভারতের বাইরে যায়নি। অতএব ভারতের ভিতরে বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে শওকত উস্‌মানী বা মুজফফর আর্মদের বিরুদ্ধে পেশোয়ারে মোকদ্দমা চলতে পারে না; কেননা, যদিও এই সকল কাজকর্মের যোগ পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বাংলাদেশ, বোম্বে ও সম্ভবত অন্যান্য প্রদেশের ব্যক্তি ও আন্দোলনের সঙ্গে থাকলেও যতটা প্ৰমাণ পাওয়া যাচ্ছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোনো ব্যক্তি বা কাজের সঙ্গে তার যোগ নেই।” (নম্বর ৪৮৭-পি সি এন ২৯ শে মে, ১৯২৩)।

বাঙলার সি আই ডি (ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্ট) যদিও পেশোয়ারে শওকত উসমানীর মোকদ্দমার সঙ্গে আমার মোকদ্দমা জড়িয়ে দিয়ে ‘যা শত্রু পরে পরে’ করতে চেয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে মোটা ভাতা মারার চক্রান্ত করেছিল সার জন মাফের পত্রের পরে তাদের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। পেশোয়ারে উসমানীর মোকদ্দমা আর হলো না, কাজে কাজেই আমারও নয়। কিন্তু কম্বলি কি ছাড়তে চায়? ভারত সরকার ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের আশ্রয় নিলেন।

Order in Council
Action to be taken against

1. Shuakat Usmani. 2. Ghulam Hussain. 3. Muzaffar Ahmad, Under Regulation III and their Cases then to be more fully examined with a view to prosecution under the ordinary law. The Cases against ( 4 ) Dange and (5) Singaravelu Should be similarly examined with a view to presecution.

Reading 8.6.23

বঙ্গানুবাদ
গবর্নর জেনেরেল ইন কাউন্সিলের হুকুমনামা

১। শওকত উস্‌মানী ২। গুলাম হুসয়ন ও ৩। মুজফফর আমদের ওপর তিন নম্বর রেগুলেশন প্রয়োগ করা হোক এবং তার পরে সাধারণ আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করা যায় কিনা সেই বিষয়টি পরিপূর্ণরূপে পরীক্ষা করা হোক।

এইভাবে (৪) ডাঙ্গে ও (৫) সিঙ্গারাভেলুর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করার ব্যাপারগুলিও পরিপূর্ণরূপে পরীক্ষা করা হোক।

রেডিং ৮.৬.২৩

১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের আসল নাম ছিল “দি বেঙ্গল স্টেট প্রিজনার্স এক্ট ১৮১৮” (The Bengal State Prisoners Act of 1818)। এই কারণে এই আইনের বন্দীদের স্টেট প্রিজনার্স বলা হতো।

ভারত গবর্নমেন্টের হোম সেক্রেটারীর স্বাক্ষরে স্টেট প্রিজনারদের নামে যে ওয়ারেন্ট ইসু হতো তাতে বন্দী হয়ে থাকার স্থানের নাম দেওয়া অপরিহার্য ছিল।

ভারত গবর্নমেন্ট তাঁদের ৯ই জুন (১৯২৩) তারিখের পথ পরিষ্কারক টেলিগ্রামের পর ১২ই জুন (১৯২৩) তারিখে বার্মা গবর্নমেন্টকে নিম্নলিখিত টেলিগ্রাম পাঠালেন :

Telegram P., No 1309 dated Simla, the 12th June, 1923.

From the Secretary to the Government of India, Home Department.

To the Chief Secratary to the Government of Burma, Mymyo.

Please refer to my clear the line telegram No. 1309 – D, Dated 9th instant. There are ovious reasons including the Conditions of incarceration prescribed by the regulation, that place of confinement of these men should be as far as possible remobed from the scene of

their recent activities and connections. If so, arrangements for their transfer will be made in due course.

মর্মানুবাদ

টেলিগ্রাম পি, নম্বর ১৩০৯

সিমলা, ১২ই জুন, ১৯২৩ প্রেরক-ভারত গবর্নমেন্টের সেক্রেটারি

হোম ডিপার্টমেন্টে

বরাবরে বার্মা গবর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারি, মাইমিও

অনুগ্রহ ক’রে আমার এ মাসের ৯ই তারিখে পাঠানো ১৩০৯-ডি নম্বর পথ পরিষ্কারক টেলিগ্রাম পড়ে দেখুন। রেগুলেশনের নির্দিষ্ট বন্দী জীবনের ব্যবস্থাসহ আরও কতকগুলি স্পষ্ট কারণ আছে যে এ সকল ব্যক্তির আটক থাকার জায়গা তাদের সাম্প্রতিক কাজ-কর্মের ও সংযোগের জায়গা হতে যথাসম্ভব দূরে হওয়া আবশ্যক। এরকম ব্যবস্থা হলে যথাসময়ে তাদের বদলীর ব্যবস্থা করা হবে।

আমাদের নিয়ে কি করা হবে সেই বিষয়ে ভারত গবর্নমেন্ট মাথা ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় জুড়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু সীমান্ত প্রদেশের চীফ কমিশনারের আপত্তিতে তা হতে পারল না। তার পরে মুজফফর আহমদ, শওকত উসমানী ও গুলাম হুসয়নকে ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার হুকুম হলো। আমাদের নির্বাসনের স্থান নির্দিষ্ট হলো বার্মায়। যদিও বার্মা সেই সময়ে ভারতের একটি প্রদেশ ছিল তবুও প্রকৃতপক্ষে বার্মা ছিল আমাদের নিকটে সাগর পারের একটি বিদেশ। বার্মা গবর্নমেন্টকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে আমরা যেন আমাদের কর্মস্থান ও সংযোগস্থান হতে যথাসম্ভব দূরে নির্বাসিত হই। বার্মার ভিতরে আমাদের না ছিল কোনো কর্মস্থল, আর না ছিল কোনো যোগাযোগের জায়গা। টেলিগ্রামের ভাষা বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের পৃথক পৃথক রাখতে বলা হয়নি। স্থান (Place) কথা আছে, স্থানগুলি (Places) কথা নেই।

২০শে জুন (১৯২৩) তারিখে বার্মা গবর্নমেন্ট ভারত গবর্নমেন্টকে জানালেন যে (Telegram P., No. 529 C, dated the 20th June, 1923 ) গুলাম হুসয়নকে থায়েটমিও (Thayetmyo) জেলে, শওকত উসমানীকে মিংগিয়ান (Myingyan) জেলে এবং মুজফফর আহমদকে মান্দালয় (Mandalay) জেলে বন্দী করে রাখা স্থির হয়েছে। তাঁদের রেঙ্গুন পৌছবার সম্ভাব্য তারিখ জানান।

তলে তলে এত কিছু যে হয়েছে তার কিছুই আমরা জানতাম না। পুরানো কাগজপত্রে এ সব পড়ে এই আশি বছর বয়স চলাকালেও মনে মনে কিঞ্চিৎ উত্তেজনা বোধ করছি। আর, বেশ ভালো লাগছে এই ভেবে যে আমার আবাসের জন্যে মান্দালয় জেল স্থির হয়েছিল। জীবনে কোনোদিন বার্মায় যাইনি। তবুও নামের উচ্চারণ হতে কেন যেন মনে হচ্ছে যে থায়েটমিও ও মিংগিয়ান জায়গা ভালো নয়।

একটি কথা বড় আশ্চর্য মনে হচ্ছে। স-কাউন্সিল গবর্নর-জেনেরেলের অর্ডারে ছিল যে মোকদ্দমা করার উদ্দেশ্যে আমাদের কাগজপত্র সবিশেষ পরীক্ষা করার জন্যই আমাদের তিন জনকে সাময়িকভাবে স্টেট প্রিজনার করে রাখা হলো। এই-ই যখন ব্যাপার ছিল তখন আমাদের বার্মায় পাঠানোর চেষ্টা কেন হলো? অবশ্য, শেষ পর্যন্ত আমাদের বার্মায় পাঠানো হয়নি।

আমরা তিনজন মাত্র স্টেট প্রিজনার হলাম, কিন্তু ময়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ও শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে প্রভৃতি কেউ তা হলেন না। আমাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করার কথা সরকার গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন।

সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া ও ভারত গবর্নমেন্টের মধ্যে বলশেভিকদের, অর্থাৎ আমাদের বিষয়ে যে সকল টেলিগ্রাম বিনিময় হয়েছিল সেগুলিকে একত্রে ছাপালে একখানি বড় গ্রন্থ হয়ে যাবে।

ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার উদ্যোগ আয়োজন

ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্গত ইনটেলিজেন্স ব্যুরো মোকদ্দমার উদ্যোগ-আয়োজনে লেগে গিয়েছিলেন। তাঁদের সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরো নামটি পরিবর্তিত হয়ে তখন এই নামটি হয়েছে। ডিরেক্টর ছিলেন লেফটেন্যান্ট- কর্নেল সেসিল কে’। এই ভদ্রলোক ইন্ডিয়ান পুলিস সার্বিস কিংবা ইন্ডিয়ান সিবিল সার্বিসের অফিসার ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার। তাঁর তত্ত্বাবধানে যেমন দলীল পত্র সংগৃহীত হচ্ছিল, তেমনই সেই সকল লোকের নামও স্থির করা হচ্ছিল যাঁদের এই মোকদ্দমার আসামী করা হবে।

প্রথমে ১৫৫ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই তালিকায় সেই সব লোকের নামও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাঁদের ঠিকানায় আমাদের সাহিত্য ও চিঠিপত্র ইত্যাদি আসত। পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়ে আমি এত গভীরে প্রবেশ করিনি যাতে এই ১৫৫ জনের তালিকাটি পাওয়া যায়। আমি এটাকে হাস্যকর তালিকা মনে করি। শেষ পর্যন্ত ইনটেলিজেন্স ব্যুরো তেরো জনের একটি তালিকা তৈয়ার ক’রে তাঁদের পূর্ণ বিবরণ সহ কৌসুলীর নিকটে বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই তেরো জন হচ্ছেন :

(১) মানবেন্দ্রনাথ রায় (২) মুজফফর আদ

(৩) শওকত উসমানী

(৪) গুলাম হুসয়ন

(৫) শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে

(৬) মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার

(৭) রামচরণলাল শৰ্মা

(৮) নলিনী গুপ্ত (নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত)

(৯) শ্যামসুদ্দীন হাস্সান

(১০) এম পি টি বেলায়ুধন

(১১) মণিলাল ডক্টর (শাহ্)

(১২) সম্পূর্ণানন্দ

(১৩) সত্যভক্ত

কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার রেকর্ডে সর্বত্র শ্রীপাট অমৃত ডাগে লেখা হয়েছে, কোথাও শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে লেখা হয়নি।

এম পি টি বেলায়ুধন (Velayudhan) সিঙ্গারাভেলু (Singaravelu ) চেট্টিয়ারের সহকর্মী ছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কাজ হ’তে বহিষ্কৃত হয়ে যখন অবনী মুখার্জি ভারতের বিভিন্ন স্থানের কমিউনিস্টদের পত্র লিখলেন তখন অনেকেই তাঁর পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করেননি, কিন্তু বেলায়ূধন করেছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন যে অবনী মুখার্জিকে তিনি সাহায্য করবেন। ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও মৌলবী বারাকতুল্লাহ্ অবনীকে যে পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে প্রবেশলাভের যে অনুজ্ঞাপত্র অবনী পেয়েছিলেন এই দু’টি জিনিসই তিনি ইউরোপে ফেরার সময়ে বেলায়ূধনের নিকটে রেখে গিয়েছিলেন। কথা ছিল অবনীর ইউরোপে পৌছানোর পর তাঁকে বেলায়ূধন জিনিস দুটি পাঠিয়ে দিবেন। হয়তো তাঁকে পাঠিয়েও দেওয়া হয়ে থাকবে। কিন্তু মধ্য পথে বেলায়ূধন কিঞ্চিৎ বাণিজ্য ক’রে নিতে ভোলেননি। তিনি দু’টি জিনিসই পুলিসের ইনেটেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে ফটো কপি করে নিতে দিয়েছিলেন। তার একটি আমি এখানে ছেপে দিলাম। এই ফটোকপি ন্যাশনাল আরকইস্‌ অফ ইন্ডিয়া হ’তে সংগ্রহ করা হয়েছে।

বিকানীরের ডুঙ্গর কলেজে সম্পূর্ণানন্দ শওকত উস্‌মানীর হেড্‌ মাস্টার ছিলেন। তিনিই বানারসের বিখ্যাত ডক্টর সম্পূর্ণানন্দ। পরে চীফ্ মিনিস্টার ও গবর্নর হয়েছিলেন।

মণিলাল ডক্টরের কথা আমি অন্য জায়গায় লিখব।

সত্যভক্ত ভরতপুর রাজ্যের লোক। তাঁর আসল নাম চিকনলাল (চকনলাল), বাঙলার বৈষ্ণবদেব ‘চিকন কালা’র চিকন। তাঁর রাজনীতিক জীবনের শুরুতে তিনি গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে ছিলেন। আমার মনে হয় সেখানেই তিনি ‘সত্যভক্ত’ হয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তাঁর মাথাতেই সম্ভবত নেতাদের ফটো ছাপিয়ে বিক্রয় করার খেয়াল প্রথম আসে। ইলাহাবাদে তিনি এই ব্যবসায় আরম্ভ করেন। গান্ধী ও আশলী ভ্রাতৃদ্বয়ের লক্ষ লক্ষ ফটো তিনি বিক্রয় ক’রে থাকবেন। অন্য নেতাদেরও কত হাজার করে ফটো তিনি বিক্রয় করেছিলেন তা কে জানে। মোটের ওপরে সত্যভক্ত ভালো ব্যবসায় করেছিলেন। এর পরে আমরা দেখতে পাই যে নাগপুর হ’তে তিনি ‘প্রনবীর’ নাম দিয়ে হিন্দী কাগজ বা’র করছেন। কোথাও কোথাও ‘প্রাণবীণা’ নামেও উল্লেখ দেখেছি। ডাঙ্গে যখন ‘সোশালিস্ট’ নাম দিয়ে কাগজ বার করেছিলেন তখন পত্র লেখালেখি ক’রে তার সঙ্গে সত্যভক্ত পরিচিত হন।

এটা আশ্চর্য যোগাযোগ। পরে আমরা দেখেছি দু’জনই ভারতীয় কমিউনিজম চান,

–আন্তর্জাতিক নয়।

কৌসূলীরা কাগজপত্র পড়ে আসামীর তালিকা হতে পাঁচ জনের, অর্থাৎ (১) শামসুদ্দীন হাসান (২) এম. পি. টি. বেলায়ুধন (৩) মণিলাল ডক্টর (৪) সম্পূর্ণানন্দ ও (৫) সত্যভক্তের নাম বাদ দিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী তারিখে স-কাউন্সিল ভারতের গবর্নর জেনেরেল নীচের আটজনের

বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের (ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের) ১২১-এর ধারা অনুসারে মোকদ্দমা করার মঞ্জুরী দিলেন :

(১) মানবেন্দ্রনাথ রায়

(২) মাওলাবখ্শ্ ওর্কে শওকত উসমানী

(৩) মুজফফর আহমদ

(৪) গুলাম হুসয়ন

(৫) নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত

(৬) রামচরণলাল শৰ্মা

(৭) শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে

(৮) মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার

১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রেসিডিওর কোডের ১৯৬ ধারা অনুসারে স- কাউন্সিল গবর্নর জেনেরেল ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্গত ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট-কর্নেল সি. কে’কে নির্দেশ দিলেন যে তিনি কানপুরের ডিসট্রিক্টের আদালতে উপরিউক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করুন।

কোনো ইংরেজ জজের টেবিলে রাজনীতিক মোকদ্দমার কাগজপত্র রেখে দিলে আসামীর সাজা হওয়াই ছিল নিয়ম, কচ্চিৎ তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। মিস্টার সি, রস্ অলস্টন যখন কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা পরিচালনার ভার নিলেন, অর্থাৎ ব্যরিস্টার হিসেবে তার ব্রীফ গ্রহণ করলেন তখন তিনিও ভারত সরকারের বড় অফিসারদের বলে দিলেন, সংযুক্ত প্রদেশের গবর্নমেন্টকে বলে দিন যে তাঁরা যেন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের কাজে কানপুরে একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে পোস্ট করেন।

কিন্তু আট জনের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা দায়ের করার মঞ্জুরী যে স-কাউন্সিল গবর্নর জেনেরেল দিলেন তার জন্যেও হোম ডিপার্টমেন্টকেও অনেক বাধার বেড়া পার হতে হয়েছে। এই মোকদ্দমাটি শুধু দায়ের করলেই হবে না, তাতে আসামীদের দণ্ডবিধান বিষয়েও সুনিশ্চিত হতে হবে। ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্গত ইনটেলিজেন্স ব্যুরো অনেক চেষ্টা ও কষ্ট ক’রে বিরাট সংখ্যক দলিলপত্র জড়ো করলেন। কিন্তু এত পড়বে কে? তাই আবার এ সকল দলীলের সংক্ষিপ্তসার তৈয়ার করে উকীল- ব্যরিস্টারদের পড়তে দিলেন। প্রথমেই পড়তে দিলেন সার মুহম্মদ শফীকে। তিনি ছিলেন গবর্নর জেনেরেলের একজেকিউটিব কাউন্সিলের আইন বিষয়ক সভ্য। শফী সাহেব পড়লেন এবং পড়ে মত দিলেন যে পেশোয়ার ষড়যন্ত্র (মস্কো ষড়যন্ত্র) মোকদ্দমার রায়সহ যে সব দলীল আমায় পড়তে দেওয়া হয়েছে সে সব থেকে আমি বুঝেছি, রায়ের মূল পত্র না পাওয়া গেলে এবং দস্তখৎ প্ৰমাণিত না হলে বোম্বে, মাদ্রাজ, কলকাতা, লখনউ বা লাহোরের কোনো বিচারালয় হতে

এই সকল ব্যক্তিদের দণ্ডবিধানের আশা করা নৈরাশ্যব্যঞ্জক হবে।

“To my mind, it is perfectly obvious that if, for any reason, the originals of Roy’s letters to his various correspondents in India mentioned in the general Statement regarding Roy’s previous history history and activities as well as in the particular Statements regarding each of the five accused persons now under arrest cannot be produced in court, or grounds of admissibility of Secondary evidence definitely established and Roy’s Signatuare proved, it is hopeless to expect conviction of these persons from any Court of law at Bombay, Madras, Calcutta, Lucknow or Lahore where, of course, naturally the contemplated trial will have to take place.” (6.6.23.261/1924&K.W)

একজেকিউটিভ কাউন্সিলের অন্য সভ্যরাও কম-বেশী সার মুহম্মদ শফীর মতোই কথা বললেন।

তখনকার দিনে বাঙলা দেশের এডভোকেট জেনেরেল ছিলেন ভারত গবর্নমেন্টের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা (legal Adviser)। তাঁর সম্মতি না পেলে ভারত গবর্নমেন্ট এই রকম কোনো মোকদ্দমা রুজু করতে পারেন না। মিস্টার এস আর দাশ (সতীশরঞ্জন দাশ) তখন ছিলেন বাঙলার এড্‌ ভোকেট জেনেরেল। ভারত গবর্নমেন্টের সলিসিটর কিছু দলীলপত্র সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে মিস্টার এস আর দাশের সঙ্গে দেখা করলেন। কাগজগুলি পড়ে তিনি বললেন এসব প্রমাণের বলে আসামীদের সাজা দেওয়ানো সম্ভব হবে না। বড় মুশকিল। সাজা যে দেওয়াতেই হবে। এর পরে তিনটি বড় পোর্টমেন্টো ভর্তি কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে ভারত গবর্নমেন্টের তিনজন বড় বড় ইংরেজ অফিসার (লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি কে তাঁদের মধ্যে ছিলেন) মিস্টার এস আর দাশের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করলেন। কর্নেল কে’ তাঁকে দলীলপত্রগুলি বোঝালেন। মিস্টার দাশ তখন বুঝেছিলেন যে ভারত গবর্নমেন্টকে এই মোকদ্দমাটি করতেই হবে। কথা হলো যে মোকদ্দমার আরজিটির মুসাবিদা তাঁকেই করে দিতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে ১৯২৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখেও ভারত গবর্নমেন্ট মিস্টার দাশের নিকট হতে আরজির মুসাবিদা পাননি।

তখন এই ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৯২৪) তারিখে ভারত গবর্নমেন্টের হোম মেম্বর সার মালকম হেইলী (Sir Malcolm Hailey) মিস্টার এস আর দাশকে একখানি ডেমি অফিসিয়েল পত্র লিখলেন। তাতে তিনি বললেন :

“…বহু মাস হতে আমরা এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে বিবেচনা করছি। আমরা এই লোকগুলিকে রেগুলেশন, ‘থ্রি’তে আবদ্ধ করে রেখেছি; এবং এটা বাঞ্ছনীয় যে তাদের বিরুদ্ধে যদি আমাদের নালিশ থাকে তবে তা যথাসম্ভব সত্বর সর্বসমক্ষে উপস্থিত করা উচিত। আমি অবশ্য কোনো ব্যক্তিকেই আদালতে হাজির করব না যদি তার সম্বন্ধে সঠিক আইন বিষয়ক উপদেশ না পাই; কিন্তু আপনি জানেন যে আলোচ্য মোকদ্দমায় আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য আসামীদের কঠোর দণ্ড দেওয়ানো নয়, আমরা ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দিতে চাই, আর বোঝাতে চাই যে তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে আসামীদের আটক করে রেখে আমরা অন্যায় কাজ কিছু করিনি।”

(“…Our consideration of the case has been going on for many months. We are dtaining these people under Regulation III; and it is always desirable that if we have a case against such men it should be brought forward as soon as possible. I would not of course put any mant through the course unless I received legal advice that there was a sound case against him such as would justify such action; but as you know in the present case our main object is less to obtain a heavy sentence against the accused than to thoroughly expose the whole conspiracy and to justify our action in using Regulations III.”)

এর পরে অবশ্য মিস্টার এস. আর. দাশ আমাদের বিরুদ্ধে আরজির মুসাবিদা তৈয়ার করে দিয়েছিলেন। এই আরজিই লেফটেন্যান্ট-কর্নেল সি.কে. বাদী হয়ে কানপুরের ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটে মিস্টার জে. ডব্লিউ, ক্লের (J.W.Clay) কোর্টে ১৯২৪ সালের ১লা মার্চ তারিখে দাখিল করেছিলেন। শুরু হলো কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা, ভারত গবর্নমেন্টের ভাষায় কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা, যদিও ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে প্রকৃত অনুসন্ধানের কাজ ১৭ই মার্চের ১৯২৪) আগে আরম্ভ হয়নি।

ডাঙ্গের একটি ব্যাপার

বোম্বে গবর্নমেন্ট চাইছিলেন যে এস. এ. ডাঙ্গেকে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামী করা হোক। এ বিষয়ে স-কাউন্সিল বোম্বের গবর্নরের সিদ্ধান্তের অংশ বিশেষ নীচে দেওয়া হলো।

From Demi-official letter from A. Montgomerie, Esq.. I.C.S Secretary to the government of Bombay, Home Department. (Special)

To the Hon’ble J. Crerar, C.S.I., C.I.E., Secretary to the government of India, Home Department (Politices), No,. S.D.1243, dated Poona, the 16th July, 1923.

6. In view of the above considerations. His Excellency the Governor in Council is strongly of opinon That is would be more politic to continue to keep a close watch on Dange and his activites. He is our most fruitful source of information as to Bolshevist activities and he is not himself at present particularly prominent Bolshevist. He has had failure in the Propaganda efforts, he has been in bad health and has been shouldered out oh his leading position by Singaravelu of Madras. If he remainst quiescent, he will provide us with regular and useful information. If he becomes more dangerous and develops a more practical propaganda of sedition, it will probably be possible to prosecute him under section 124-A, Indian Penal Code. in any case, His Excellency in Council consider that delay for present would not materially afeect the situation, in view particularly of the recent reports of the probable restrictions in future of bolshevist propaganda in the East as a result of negotionations over the trading regulations between Russia and Great Britain.

(Emphasis mine)

সংক্ষিপ্তসার

বোম্বে গবর্নমেন্টের হোম সেক্রেটারী মিস্টার এ. মন্টগোমারি স-কাউন্সিল বোম্বের গবর্নরের সিদ্ধান্ত ভারত গবর্নমেন্টকে জানালেন যে বোম্বে গবর্নমেন্ট এস. এ. ডাঙ্গেকে কানপুর মোকদ্দমার আসামী করার বিরুদ্ধে। কারণ, বোম্বে গবর্নমেন্টের মতে ডাঙ্গের ওপরে আরও বেশী করে নজর রাখাই হবে রাজনীতিক বিচক্ষণতার পরিচয়। সে বলশেভিকদের কাজকর্ম সম্বন্ধে বোম্বে গবর্নমেন্টের খবরের উৎস। এ সময়ে সে একজন নাম করা বলশেভিক নয়। সিঙ্গরাভেলু তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। যদি সে শান্ত-নিস্তব্ধ থাকে তবে সে আমাদের প্রয়োজনীয় খবর জোগাতে থাকবে। আর, যদি সে রাজদ্রোহ প্রচারের দ্বারা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তাকে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের (ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের) ১২৪-এ ধারা অনুসারে আদালতে অভিযুক্ত করা সম্ভব হবে। গবর্নর বিবেচনা করছেন যে বিলম্বে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। রাশিয়া আর গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে যে বাণিজ্যিক আলোচনা চলছে তাতে অবস্থার পরিবর্তন আসতে পারে। (বড় হরফ আমার-লেখক)।

ভারত গবর্নমেন্ট স্থির করলেন যে ডাঙ্গেকে মোকদ্দমা হতে বাদ দিতে হবে। এমন কি কর্নেল কে’ ডাঙ্গের প্রতি অজস্র গালি বর্ষণ করেও (ওটা তাঁর একটা কৌশল ছিল) ডাঙ্গেকে মোকদ্দমা হতে বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে ভারত বিষয়ক মন্ত্রী (সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া) কোনো কথাই শুনলেন না। এস. এ. ডাঙ্গেকেও কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় জড়াতে হলো।

শেষ পর্যন্ত যে আট জনকে মোকদ্দমায় আসামী করা হলো তাঁদের মধ্যে দু’জনকে যে আদালতে হাজির করানো যাবে না সেটা আগেই জানা ছিল। তাঁরা ছিলেন (১) মানবেন্দ্রনাথ রায় ও (২) রামচরণলাল শর্মা। রায় ইউরোপের কটিনেটে ছিলেন আর রামচরণলাল শর্মা ভারতের ভিতরে ফরাসী ইলাকা পন্ডিচেরিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী ছিলেন। মায়ালামপুরম সিঙ্গরাভেলু চেট্টিয়ারের টাইফয়েড হয়েছিল। তারপর যখন তিনি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টিত ছিলেন তখন তাঁকে কানপুর মোকদ্দমার সংস্রবে ওয়ারেন্ট নিয়ে পুলিস গিরেফ্ফার করতে আসেন। বড় বড় ডাক্তারেরা, তাঁদের মধ্যে ইংরেজ ডাক্তারও ছিলেন, সার্টিফিকেট দিলেন যে রোগীকে এখনও বিছানায় থাকতে হবে। তখন তাঁকে জামিন মঞ্জুর করে মাদ্রাজের ২২ নম্বর সাউথ বীচে নিজের বাড়ীতে থাকতে দেওয়া হলো।

নলিনী গুপ্ত ভারতে আসার জন্যে ১৬ই ডিসেম্বর (১৯২২) তারিখে মস্কো হতে রওয়ানা হয়েছিলেন। ইরানের ভিতর দিয়ে তিনি করাচি পৌঁছেছিলেন ১৯২৩ সালের ১২ই জুন তারিখে। করাচি হতে তিনি বোম্বে যান। আর বোম্বে হতে যান মাদ্রাজে। সেখানে মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের বাড়ীতে কদিন থাকেন। মাদ্রাজ হতে কলকাতা আসেন জুলাই মাসের (১৯২৩) শেষার্ধে। হাওড়া স্টেশন হতে তিনি সোজা ৩৯ নম্বর হ্যারিসন রোডে, রমেশচন্দ্র দাশগুপ্তের মেসে যান এবং রমেশকে সেখানে পেয়েও যান। ১৯২২ সালে নলিনীর রমেশকে বললেন, “আমাকে মুজফফরের নিকটে নিয়ে চল।” রমেশ উত্তর দিলেন, “তিনি তো জেলে রয়েছেন।” আশ্চর্য এই যে ডাঙ্গে কিংবা সিঙ্গারাভেলু নলিনীকে আমার গিরেস্তারের খবর দেননি। কানপুর জেলে এই কথাগুলি অর্থাৎ হাওড়া স্টেশন হতে নলিনী সোজা রমেশের মেসে গিয়েছিলেন, এবং রমেশের মুখেই প্রথম শুনেছিলেন যে আমি গিরোর হয়েছি ইত্যাদি,-নলিনী আমায় বলেছিলেন। আমার জেলের বাইরে আসার পরে রমেশ দাশগুপ্তও তাই বলেছিলেন। কেউ কেউ অন্য কথা বলেছেন।

১৯২৩ সালের ২০ শে ডিসেম্বর তারিখে নলিনী কলকাতায় গিরেতার হয়েছিলেন। তখন তিনি কাঁকুড়গাছিতে গোপনে বাস করতেন। ধরা পড়ার পরে তিনি পুলিসের নিকটে আরব্য উপন্যাসের কায়দায় সত্য ও মিথ্যা মিশিয়ে সুদীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন। এক দিনের বিবৃতি শেষ হওয়ার পরে তিনি বলেছেন, “আরও অনেক কথা বলার রয়েছে, কাল বলব।”

এম. এন. রায় তাঁর সন্ত্রাসবাদী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে প্রথমবারে (১৯২১ সালে) নলিনী গুপ্তকে দেশে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর “স্মৃতিকথা”য় এর উল্লেখ আছে। তাছাড়া, কোনো সন্ত্রাসবাদী বন্ধুকে লেখা এক পত্রে তিনি লিখেছেন, “তোমাদের সংবাদ পাওয়ার জন্যে আমি নলিনীকে দেশে পাঠিয়েছিলেম।”

মস্কোর প্রাচ্য জনগণের কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-সংগ্রহ করার জন্যে ১৯২৩ সালে নলিনী গুপ্তকে দ্বিতীয়বার দেশে পাঠানো হয়েছিল। এই গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজটি করার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সে কাজ তিনি করতেও পারেননি। একজন মাত্র ছাত্র, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে, তিনি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ব্যাপারেও বিপর্যয় ঘটেছিল। সে কথা আমি পরে বলব।

নলিনীর দ্বিতীয়বারে কলকাতায় আসার পরে যা যা ঘটেছিল সে সম্বন্ধে তিনি আমায় কানপুর জেলে এক দীর্ঘ বিবরণ শুনিয়েছিলেন। সেই বিবরণটি ছিল এই রকম:

কলকাতায় এসে তিনি আমায় পেলেন না। থাকার স্থান কোথাও না পেয়ে তিনি ডক্টর মেঘনাথ সাহার নিকটে গেলেন। বার্লিনের হস্পিটালে তাঁর সঙ্গে নলিনীর পরিচয় হয়েছিল। পুলিসের নিকটে বিবৃতিতে নলিনী বলেছেন যে তাঁর সঙ্গে ডক্টর সাহার পরিচয় লন্ডনে হয়েছিল। যাই হোক, নলিনী আমায় বলেছিলেন যে ডক্টর সাহা নলিনীর কথা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি নলিনীকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর নিকটে গেলেন এবং নলিনীর আশ্রয়ের কথা বললেন। সুভাষ বসু সেই সময়ে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টিদের বড় দুই তরফকে এক করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি যুগান্তর পার্টির উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও অনুশীল পার্টির রমেশ চৌধুরীকে ডেকে আনলেন এবং নলিনীকে আশ্রয় দিতে বলে দিলেন। নলিনীর স্বভাব ছিল যে কারুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আধ থেকে এক ঘণ্টার ভিতরে তিনি বলে দিতেন যে তিনি বিস্ফোরক (explosive) তৈয়ার করতে জানেন। এ খবর পেয়ে রমেশ চৌধুরী আনন্দিত হলেন এবং উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে দিলেন যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা তিনিই করে দিবেন। উপেনবাবু খুশী মনে চলে গেলেন। তিনি নলিনীর বিরুদ্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন।

রমেশ চৌধুরী কিন্তু আনন্দিত হয়ে নলিনী গুপ্তকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি কিছু সংখ্যক যুবককে শেখাতে লাগলেন কি করে বিস্ফোরক প্রস্তুত করতে হয়। এই সময়ে অবনী মুখার্জিও ঢাকায় ছিলেন। নলিনী যখন এই কথা শুনলেন তখন তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন যে, “আমি ওকে খুন করব।” এই খুন করার কথাটি কিন্তু নলিনী আমায় বলেননি, বলেছিলেন অন্য একজন। নেতা প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় অবনী মুখার্জিকে অনেক বেশী মূল্য দিতেন। নলিনীকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল। অনুশীলন পার্টির একজন আমায় বলেছিলেন যে এই সময়ে চট্টগ্রামের চারুবিকাশ দত্ত এসে নলিনীকে নিয়ে যান। তার পরে তাঁরা খুলনায় কোথায় ছিলেন।

কাঁকুড়গাছিতে নলিনীর সঙ্গে অখিল নামক একজন থাকতেন। নলিনী আমায় বলেছিলেন যে এই অখিল ছিলেন অনুশীলন পার্টির নেতা রমেশ আচার্য। নলিনী অজস্র মিথ্যা কথা বলতেন। তাঁর কোন্ কথা মিথ্যা আর কোন্ কথা সত্য তা আমার পক্ষে বোঝা মুশকিল ছিল।

ধরা পড়ার পরে (২০ শে ডিসেম্বর, ১৯২৩) নলিনী দিনের পর দিন পুলিসের নিকট বিবৃতি দিয়েছেন। প্রথম পর্যায়ের বিবৃতি শেষ হলে পুলিস গবর্নমেন্টের নিকটে রিপোর্ট পাঠাল যে আদালতে অভিযুক্ত হওয়ার মতো কোনো কিছু নলিনীর বিরুদ্ধে নেই। তাঁর নামে ১৮১৮ সালের ৩নং রেগুলেশনের ওয়ারেন্ট পাঠিয়ে দিন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারী মাসের কোনো এক তারিখে নলিনী গুপ্তকে স্টেট্ প্রিজনার করা হয়েছিল।

গুলাম হুসয়ন পেশোয়ারের এড্‌ওয়ার্ডস মিশন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। সেখান থেকে কাবুলে তাঁর ছাত্র জীবনের প্রিয়তম বন্ধু মুহম্মদ আলীর (খুশী মুহম্মদের) সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তার পরে তিনি কাবুলে একটি অস্থায়ী চাকুরী গ্রহণ করে সেখানে গিয়ে কিছু দিন বন্ধু মুহম্মদ আলীর সঙ্গে কাটিয়ে আসেন। মুহম্মদ আলীর জিম্মায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাজের বিস্তারের জন্যে বহু টাকা ছিল। সেই টাকা হতে অনেক টাকা তিনি গুলাম হুসয়নের হাতে দেন। তাঁর স্বীকৃতিমূলক বিবৃতি হতে বোঝা যায় যে তিনি প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি মিশন কলেজের চাকরী ছেড়ে দিয়ে লাহোরে চলে এলেন। কিছু কিছু সাংগঠনিক কাজ যে তিনি করেননি এমন নয়, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে লাহোরে এক খণ্ড জমি কিনে নিজের জন্যে একটা পাকা বাড়ীও তিনি উঠিয়ে নিলেন। অসাধুতার ভিতর দিয়েই তাঁর তথাকথিত পার্টি-জীবন আরম্ভ হয়েছিল। কষ্ট সইবার শক্তি তাঁর একেবারেই ছিল না। বৈপ্লবিক রাজনীতিতে যাঁরা শামিল হন তাঁদের দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপনের জন্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু গুলাম হুসয়ন ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে যখন স্টেট প্রিজনার হলেন তখন তিনি শুরুতেই ভেঙ্গে পড়লেন। অথচ, কলেজে পড়াতেন বলে তাঁর নিজের একটা মর্যাদা ছিল। তাঁর পরিবারের আলাদা মর্যাদা ছিল। সরকারী চাকুরী হতে অবসর গ্রহণকারী তাঁর পিতামহ ডাক্তার আল্লাদিত্তা বিখ্যাত আই সার্জেন (চক্ষুতে অস্ত্রোপচারকারী) ছিলেন। সার ম্যালকম হেইলী তাঁকে চিনতেন। এই কারণে তাঁর জন্যে ও তাঁর পরিবারের জন্যে নানান রকম ভাতা মঞ্জুর হয়েছিল। এ সব সত্ত্বেও জেলের চার দেওয়ালের ভিতরে আটকে থাকা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। তিনি বিবৃতি দেওয়া আরম্ভ করলেন। এই বিবৃতি দিতে দিতে যখন তিনি শুনলেন যে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হবে আর তিনিও হবেন সেই মোকদ্দমার আসামী, তখন তো তিনি একপ্রকার কাঁদাকাটি আরম্ভ করে দিলেন। তাঁর বিবৃতি হয়ে উঠল একখানি আস্ত মহাভারত। সেই সময়ে মুহম্মদ শফীকের বিরুদ্ধে পেশোয়ারে পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে ষড়যন্ত্রের মোকদ্দমা চলছিল (সেশন্ত্ কেস্ নম্বর ২৬, ১৯২৪ সাল; হোম ডিপার্টমেন্ট তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বললেন যে, তাঁকে মুহম্মদ শফীকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হবে। সেই সাক্ষ্যও তিনি দিলেন।

১৯২৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী তারিখে গুলাম হুসয়ন ভারতের স-কাউন্সিল গবর্নর জেনারেলের নিকটে যে আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলেন তার শেষ কয়েকটি ছত্র এখানে তুলে দিলাম :

“In case there be any circumstances casting any suspicion or doubt on the integrity of what I have submitted most respectfully. I am prepared to explain it withouty any reservaton. Deeply as I have erred, my sufferings have been no less deep. I acknowledge my mistake. It was a crime. Fatality alone dragged me into these circumstances, otherwise all this ill-accords with my calibre. I was engaged in a conspiracy against the Bolshevics. The little amount of political work that i did, a blind to secure a part of their illgotten gold, and there I am in prison broken and annihilated, In spite of my sins I hope your Excellency’s Government will mercifully take a lenient view of my faults. I will not ever attempt a similar experience. So help me God!”

বাঙলা অনুবাদ

“পরম শ্রদ্ধার সহিত আমি যা হুজুরের নিকটে দাখিল করেছি তাতে, অর্থাৎ আমার সত্যবাদিতায় যদি এতটুকুও সন্দেহ হয় তবে কোনো গোপনতার আশ্রয় না নিয়ে সব কিছু আবার বলতে প্রস্তুত আছি। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমার ভুল যত গভীর, তা থেকে আমি যে দুঃখ-বেদনা পেয়েছি তা কম নয়। আমার ভুল হচ্ছে আসলে অপরাধ। দুরদৃষ্ট আমার এ সব কাজে টেনে নিয়েছে। তা না হলে আমার পদের একজন লোক কি করে যত সব মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ল। আমি বলশেভিক বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেম। আমি যে সামান্য রাজনীতিক কাজ করেছি, তা তাদের অন্যায়ভাবে পাওয়া অর্থে ভাগ বসানোর জন্যেই করেছি এবং এই জন্যেই আমি আজ কারাগারে, আমার মন ভেঙে গেছে, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। অপরাধ আমি অনেক করেছি, সে সব সত্ত্বেও আমি আশা করছি যে হুজুরের সরকার দয়ার্দ্র চিত্তে আমার দোষগুলির বিচার করবেন। আমি আর কখনও এমন কাজ করব না। হে ঈশ্বর আমায় সাহায্য কর!”

গুলাম হুসয়নের ওপর হতেও মোকদ্দমা তুলে নেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত আমরা চারজন আসামী থাকলাম।

(১) শওকত উসমানী

(২) নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত

(৩) মুজফফর আহমদ

(৪) শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে।

১৯২৪ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে কানপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডব্লিউ ক্রিস্টির (W.Christie) আদালতে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার অনুসন্ধানের কাজ আরম্ভ হলো। তার একদিন কিংবা দু’দিন আগে গুলাম হুসয়ন শপথ নিয়ে লাহোরের এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার মুনীর হুসয়নের নিকটে যে তাঁর শেষ স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা শেষ হয়েছিল।

কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আসামীদের তরফ হতে কোনো উকীল ব্যারিস্টার ছিলেন না। আগেই বলেছি, মোকদ্দমার প্রস্তুতি পর্বেই ইলাহবাদ হাইকোর্টের ব্যারিস্টার মিস্টার সি. রস অলস্টনকে দৈনিক এক হাজার টাকা ফিস দিয়ে সরকার পক্ষে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মোকদ্দমার আরজির মুসাবিদা করে দিয়েছিলেন বাঙলা দেশের এডভোকেট জেনারেল মিস্টার এস. আর দাশ (সতীশরঞ্জন দাশ)। দায়রা আদালতে সোপর্দ করা পর্যন্ত মোকদ্দমার অনুসন্ধানের কাজ চালাবার জন্যে সি. রস অলস্টন একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট দাবী করেছিলেন; মিস্টার ডব্লিউ ক্রিস্ট ছিলেন সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট।

এই জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টেই দর্শকদের আসনে আমি প্রথম সত্যভক্তকে দেখি। ইউরোপীয় পোশাক পরিহিত, মাথায় পাগড়ি ছিল, সেটা টিকি ঢাকার জন্যেও হতে পারে। তিনিই পরে “ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি” গঠন করতে চেয়েছিলেন।

ডাঙ্গের প্রাইভেট সেক্রেটারি

শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গের এক নবলব্ধ বন্ধুর নাম ছিল বাসুদেব হরি জোশী। ডাঙ্গেকে গিরেস্তার করে কানপুরে আনার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কানপুরে আসেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে দর্শকদের আসনে তিনিও বসতেন। একদিন কোর্ট চলাকালে তিনি বসে বসে কে জানে কিসের নোট নিচেছলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন উদ্ধত স্বভাবের নবযুবক। জোশীর ওপরে নজর পড়তেই তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন :

“কে তুমি ওখানে বসে আমার বিনাঅনুমতিতে নোট নিচ্ছ?”

২৪ বছর বয়স্ক, বেঁটে ডাঙ্গে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল এবং সেই মুহূর্তেই বলল :

“মাননীয় মহাশয়, ইনি হচ্ছে মিস্টার ভি এইচ জোশী, আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি। আমি তাঁকে নোট নিতে বলেছি।”

ম্যাজিস্ট্রেট নরম হয়ে বললেন, “আমার অনুমতি কেন নিলে না।”

বাসুদেব হরি জোশী এই ব্যাপারে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করলেন এবং সেই দিন থেকে তিনি নিজেই প্রচার করতে লাগলেন যে তিনি এস. এ. ডাঙ্গের প্রাইভেট সেক্রেটারী। এই ভাবে তিনি বহু বৎসর ডাঙ্গের প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ে থাকলেন। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চলাকালে ডাঙ্গের হয়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকটে ওকালতি করার জন্যে গোপনে তিনি মস্কো যেতে চেয়েছিলেন। বোম্বের ডক ইলাকায় ধরা পড়ে যান। বহু বৎসর পরে শুনেছি ডাঙ্গের সঙ্গে বাসুদেব জোশীর ঝগড়া হয়ে গেছে। আরও পরে শুনেছি বাসুদেব জোশী আর বেঁচে নেই।

ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। আমি আগেই বলেছি, নিম্ন আদালতে আমাদের কোনো উকীল-ব্যারিস্টার ছিলেন না, ডাঙ্গেরও নয়। ইতোমধ্যে বাসুদেব জোশী কানপুরের মারাঠী বাশিন্দাদের ভিতরে (সংখ্যায় তাঁরা খুব বেশী ছিলেন না) ডাঙ্গেকে অবয়বে ছোট হলেও বিরাট ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ডাঙ্গের একজন উকীল থাকলেও পারত। পেনাল কোডের ১২১-এ ধারার মোকদ্দমার বিচার দায়রা আদালতেই ( সেশনন্স কোর্টে) শুধু হতে পারে। আমরা ভাবলাম নিম্ন আদালতে আমরা মিছিমিছি মুখ খুলতে যাই কেন?

নিম্ন আদালতে ডাঙ্গের বিবৃতি

১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ৩৬৪ ধারা অনুযায়ী এই জাতীয় মোকদ্দমায় আসামীকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় ডেকে এনে অনুসন্ধানরত ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আসামীর উত্তর সাক্ষ্য নয়। কারণ, তিনি শপথ গ্রহণ করেন না। ডাঙ্গেকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং “হাঁ” বা “না”র মামুলী উত্তরও দিয়েছিল। তাকে শেষ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলো :

Q. – Have you any more to say?

A.- My studies in economy had convinced me that as India was being industrializied a working class would be created in India. The industrialization of the country was being carried on by British capital with the help of native capital. That native capital was struggling to get the hold of the monopoly to exploit Indian wealth. That this struggle was expressed in the movement called the nationalists’ movement. That that native capital wanted to use the working class towards its own ends. I wanted the working class to fight for its economic betterment, and as I thought that capitalism is western product, the working class also must fight on western lines and that socilalism was the expression of that movement. I started to spread the doctrine of socialism even before Mr. M.N.Roy was heard in India to be working on behalf of the Communist International. I wrote a book and started a paper: the book and the paper were sent to press in Europe as well as in India. That perhaps attracted the attention of Mr. M.N. Roy and the convention. What the sessions of the convention were bing held in 1922 and individual was sent to me, he meet me in Bombay, he represented himself to be coming to me under a mandate from the convention. He did not show me any document and asked me if i Could attend the sessions of the Convention. Mr. Ashley was the name of the gentleman. In one of the Exhibits he is referred to as Mr. Nanda Lal (see Ex.6). I asked him about the intention and the policy of Mr. M.N.Roy and the convention. When I was given to understand that it meant the breaking away of India from the Brithis Empire I told him that I could not join the convention or attend the sessions. After that as I was given the address of Mr. M.N.Roy by Mr. Ashley I addressed him on the subject. Mean while I was going on with my work of socialist propaganda. As it was a necessity for me as an editor to have complete knowledge of the European movement I maintained connections with Roy in order to get the required information. Reuter telegraphed Roy’s programme to India, programme to India, I disapproved of his programme through my paper. As regards the visit of Mr. Ashley and my connections with Roy I issued statement in the vernacular press on 5-7-23 stating the facts as they were. I am not a member of the conspiracy to deprive the King-Emperor of his soverignty of Brithis India by violent revolution; neither have I assisted the furtherance of any such conspiracy and if it lies within the powers of this Ct. I beg to be acquitted.

(Sd/.) R.A.W. CHRISTIE

(Sd/.) S.A.DANGE

The above is a full and true record of the statement given by Dange accused and it was recorde by me and read over to accused.

(Sd/.) W. CHRISTIE

28.3.24.

বাঙলা অনুবাদ

প্রশ্ন : তোমার কি আর কিছু বলার আছে?

উত্তর : অর্থনীতির অধ্যয়ন হতে আমি নিশ্চিত হয়েছি যেহেতু ভারতে কল- কারখানা প্রসারিত হচ্ছে সেই কারণে ভারতে একটি মজুর শ্রেণীরও সৃষ্টি হবে। ভারতীয় মূলধনের সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ মূলধনই দেশকে শিল্পায়িত করে তুলছে। ভারতীয় ধনৈশ্বর্যকে শোষণ করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় মূলধন একচেটিয়া অধিকার লাভের জন্যে সংগ্রাম চালাচ্ছে। জাতীয় আন্দোলনের ভিতর দিয়ে এই সংগ্রাম চলেছে। ভারতীয় ধনপতিরা তাঁদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে মজুর শ্রেণীকে ব্যবহার করতে চাইছে। আমি চাইছি যে মজুর শ্রেণী তাঁদের আর্থিক উন্নয়নের জন্যে লড়াই করুন, এবং আমি ভেবেছি যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন পশ্চিমের জিনিস তখন পশ্চিমের পথেই মজুরশ্রেণী তাদের সংগ্রামের পরিচালনা করবেন। এই আন্দোলনের মোদ্দা কথা হবে সোস্যালিজম

মিস্টার এম. এন. রায় যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হয়ে কাজ করছেন একথা ভারতে কেউ শোনার আগে হতেই আমি ভারতে সোস্যালিস্ট মতবাদ প্রচার করছি। আমি একখানি পুস্তক লিখেছি এবং একখানি কাগজও বা’র করেছি। আমার পুস্তক ও কাগজ ইউরোপের ও ভারতের সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছিল। তাই বোধ হয় এম. এন. রায় ও কনভেনশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যখন ১৯২২ সালে কনভেনশনের অধিবেশন হচ্ছিল তখন বোম্বেতে আমার নিকটে এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছিল। বোম্বেতেই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমায় তিনি বলেছিলেন যে কনভেনশনের অনুজ্ঞাপত্র নিয়ে তিনি এসেছে। এই দলীল তিনি আমায় দেখাননি। আমায় তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমি কনভেনশনে যোগ দিতে পারি কিনা। এই ভদ্রলোকের নাম ছিল আশলী। একটি এক্‌জিবিটে তাঁর নাম লেখা হয়েছে। মিস্টার নন্দলাল (এক্‌জিবিট নম্বর ৬)। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেম যে মিস্টার এম. এন. রায় ও কনভেনশনের উদ্দেশ্য ও নীতি কি? আমায় যখন জানানো হলো যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হতে বা’র হয়ে আসাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য ও নীতি তখন জানিয়েছিলেম যে কনভেনশনে ও তার অধিবেশনে আমি যোগ দিতে পারি না। এর পরে মিস্টার আশলী আমায় মিস্টার এম. এন. রায়ের ঠিকানা দিয়েছিলেন। এই বিষয়ে আমি রায়কে পত্র লিখেছি। ইতোমধ্যে আমি আমার সোস্যালিজমের প্রচার করেই চলেছিলাম। কাগজের সম্পাদক হওয়ার কারণ ইউরোপীয় আন্দোলন সম্বন্ধে আমার ওয়াকিফহাল থাকা প্রয়োজন। এই জন্যেই আমি রায়ের সঙ্গে সংস্রব রক্ষা করছি। রয়টার রায়ের প্রোগ্রাম টেলিগ্রাম যোগে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। আমি তার বিরুদ্ধে লিখেছি। মিস্টার আশলীর সহিত সাক্ষাতের ও এম. এন. রায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্বন্ধে আমি ৫.৭.’২৩ তারিখে সমস্ত ঘটনা উল্লেখ ক’রে বিবৃতি দিয়েছি। রাজসম্রাটকে ব্রিটিশ-ভারতের রাজ্যাধিকার হতে বিপ্লবের পথে বলপূর্বক বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রের সহিত আমি লিপ্ত নেই। আমি এইরকম কোনো ষড়যন্ত্রকে সাহায্য করিনি। যদি এই কোর্টের ক্ষমতায় থাকে তবে প্রার্থনা করি যে আমার মুক্তি দেওয়া হোক।

(স্বাক্ষর) আর. এ. ডব্লিউ ক্রিস্টি

(স্বাক্ষর) এস.এ. ডাঙ্গে

ওপরে আসামী ডাঙ্গের দেওয়া পূর্ণ ও সত্য বিবৃতি রেকর্ড করা হয়েছে এবং আমাকেই তা রেকর্ড করতে হয়েছে। আমি তা আসামীকে পড়ে শুনিয়েছি।

(স্বাক্ষর) ডব্লিউ ক্রিস্টি

২৮.৩.’২৪

ডাঙ্গে যে নিম্ন আদালতে এই রকম একটি বিবৃতি দিবে সে কথা সে ঘুণাক্ষরেও আমাদের কিছু জানায়নি। চার্লস আশলী সম্বন্ধে আমি ওপরে অনেক কথা বলেছি। তার সঙ্গে মিলিয়ে আমি এই বিবৃতি সকলকে পড়তে অনুরোধ করছি। তা হলে সকলে বুঝতে পারবেন কত অসঙ্গতিতে এই বিবৃতি ভরা। চার্লস্ আশলী ১৯২২ সালের ১৮ই এপ্রিল হতে ২২ শে এপ্রিল পর্যন্ত বোম্বেতে ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসে ভারতবর্ষের যে সকল ডেলিগেট যোগ দিবেন তাদের রাহাখরচের টাকা নিয়ে এসেছিলেন। কংগ্রেসের অধিবেশন ৫ই নভেম্বর হতে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসকে ডাঙ্গে কেন কনভেনশন বলেছে তা সে-ই জানে।

ডাঙ্গেকে নিয়ে কানপুর জেলে আমরা অনেক জ্বালায় জ্বলেছি। তার চরিত্র জটিলতায় ভরা। সে ভাবত এই বুঝি আমি অন্যদের চেয়ে ছোট হয়ে গেলাম। অথচ তার ছোট হওয়ার কোনো কথাই ছিল না। তার বাহন বাসুদেব জোশী রাত দিন তার সম্বন্ধে প্রচার করে বেড়াতেন। মারাঠী বাসিন্দাদের ভিতরে তিনি ডাঙ্গেকে তিলকের সমপর্যায়ে না হলেও তার নিকটতম স্থানে তুলে দিয়েছিলেন।

চারজনের আসামীর ভিতরে তিনজন (১) শওকত উস্‌মানী (২) মুজফফর আদ ও (৩) নলিনী গুপ্ত ছিলেন স্টেট্ প্রিজনার। অর্থাৎ ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনের বন্দী। তাঁদের ওপর হতে এই ওয়ারেন্ট তুলে না নিয়েই তাঁদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়েছিল। আমি যতটা বুঝেছিলেম এটা বে-আইনী ছিল। কিন্তু আপত্তি তুলবে কে? উকিলেরা তো কিছুই বুঝতেন না। সে যাই হোক, আমাদের তিনজনের উপর হতে ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনের ওয়ারেন্ট যখন তুলে নেওয়া হয়নি তখন সেই অনুযায়ী আমাদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা তো ইনটেলিজেন্স ব্যুরোকে করতে হবে। স্বয়ং ডিরেক্টর ওখানে হাজির আছেন। কিন্তু ডাঙ্গের তাতে ঘোর আপত্তি। সে বলল, এখানে আবার তিন নম্বর রেগুলেশন কেন? তখন আমরা বললাম, জাহান্নামে যাক তিন নম্বর রেগুলেশন, আমরা সাধারণ বিচারধীন বন্দী হয়ে থাকব। ডাঙ্গের সঙ্গে আমরা ঝগড়া করতে চাইনি।

নিম্ন আদালতে প্রথম শুনানি আরম্ভ হয়েছিল ১৭ মার্চ (১৯২৪) তারিখে। পেশোয়ারের মোকদ্দমাগুলিতে বিশেষ ক’রে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কোনো প্রচার হয়নি। কিন্তু কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার ভারত গবর্নমেন্টই প্রচারের সমস্ত ব্যবস্থা করলেন। তাঁদের অনুরোধেই এসোসিয়েটড্ প্রেস ও রয়টারের প্রতিনিধি সব সময় কোর্টে উপস্থিত থাকলেন এবং ভারত গবর্নমেন্টের তরফ হতেই প্রেসের প্রতিনিধিদের বলে দেওয়া হলো যে মোকদ্দমার শিরোনাম যেন দেওয়া হয় “কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা”। ভারতে যে বলশেভিকদের অনুপ্রবেশ ঘটছে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার দ্বারা ব্রিটেনের ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট জগতের নিকটে এই প্রচারকার্যই চালাতে চেয়েছিলেন।

অনুসন্ধানকারী ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডব্লিউ ক্রিস্টি ১লা এপ্রিল (১৯২৪) তারিখে তাঁর লিখিত কমিটাল অর্ডারে দস্তখত করলেন। চারজন আসামীই দায়রার সোপর্দ হলেন।

দায়রায় বিচার হবে সারা ভারতে, সারা বিশ্বেও বলা যায়, কুখ্যাত একদায়রা জজের আদালতে। তাঁর নাম এইচ ই হোম (H.E. Holme)। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জিলার চৌরি চৌরায় একটি ছোট কৃষক অভ্যুত্থান হয়। কৃষকেরা অত্যাচারী পুলিসের থানা আক্রমণ করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। পুলিসের মোট একুশ জন লোক থানায় ছিল, সকলেই পুড়ে মারা যায়। দায়রা আদালতে এই মোকদ্দমার বিচার করেছিলেন জজ্ হোম (Holme)। বিরাট সংখ্যক লোকেদের ভিতর হতে কি করে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া গেল, কি করেই বা জজ তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন জানি না। সমস্ত ব্যাপারটাই অসম্ভব ছিল। কিন্তু মিস্টার হোমের মন বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহায় ভরপুর ছিল। তিনি একই মোকদ্দমায় একই সঙ্গে ১৭২ জনের ওপরে ফাঁসির হুকুম শুনিয়ে দিলেন। সেদিন ভারতে অবস্থিত ইংরেজদেরও মাথা হেঁট হয়েছিল। ইলাহাবাদ হাইকোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই কাগজ-পত্র চেয়ে নিলেন। তাঁরা দশ-বারোজনের ওপরে মাত্র ফাঁসির হুকুম বহাল রাখলেন।

এহেন জজ্ দায়রা আদালতে আমাদের বিচার করবেন। নানান রকম বন্দোবস্ত করতে সময় লেগেছিল। ২২শে এপ্রিলের (১৯২৪) আগে সেশন্স কোর্ট বসতে পারেনি। ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দেখেছিলেন, এখানেও দেখলাম, কোর্টের বাইরে লুইস গান বসানো হয়েছে। কানপুরের দায়রা বিচারের ঘরটায় ব্যবস্থা অদ্ভুত মনে হলো। একটা দেয়ালের গা ঘেঁষে জজের মঞ্চ (ইজ্‌লাস) তৈয়ার হয়েছে। তার নিচে মেজের ওপরে উকীল ব্যারিস্টারদের চেয়ার। দর্শকদের ব্যবস্থাও তাঁদের সঙ্গেই। তাঁদের পেছনে আসামীদের কাঠগড়া। বাইরে থেকে এসে কোর্ট রুমে ঢুকলেই প্রথমেই আসামীদের পাওয়া যেতো। এই রকম ব্যবস্থা আমাদের পক্ষে ভালোই হয়েছিল। ইচ্ছা করলে আমরা দু’চারটির কথা বাইরের লোকেদের সঙ্গে বলে নিতে পারতাম। বাইরে লোকেদের সঙ্গে কথা যে বলিনি তাও নয়। এ ভাবেই কানপুরের বাঙালি বাসিন্দা রাজকুমার সিংহের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হতে আই এস সি পরীক্ষা দিতে তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরও কেউ কেউ আসতেন। গান্ধী টুপি মাথায় পরে যোগেশ চট্টোপাধ্যায় আসতেন। পরে কাকোরি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় রাজকুমার সিংহ ও যোগেশ চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ মেয়াদের সাজা হয়েছিল। অহঙ্কার-মত্ত লোক ছিলেন চট্টোপাধ্যায়। কিসের এত অহঙ্কার কে জানে? ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে গয়ায় সারা ভারত কৃষক কনফারেন্স যখন হচ্ছিল তখন তিনি সেখানে নিজেদের একমাত্র বিপ্লবী বলে পরিচয় দিতে গিয়ে অধ্যাপক রঙ্গের নিকট জোর ধমক খেয়েছিলেন। রঙ্গ বলেছিলেন যে কথার মানে বোঝেন না সে কথা ব্যবহার করেন কেন? চট্টোপাধ্যায় চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।

আগেই বলেছি নিম্ন আদালতে আমাদের কোনো উকীল-ব্যারিস্টার ছিলেন না। দায়রা আদালতের জন্যে দেখলাম একজন ব্যরিস্টার একজন উকীল নিযুক্ত হয়েছেন। ডাঙ্গের বন্ধু ও তথাকথিত প্রাইভেট সেক্রেটারি বাসুদেব জোশীর কথা আগে বলেছি। তিনি ডাঙ্গের একজন একনিষ্ঠ প্রচারক ছিলেন। এই প্রচারের প্রভাবে জি জি জোগ বিশেষভাবে এগিয়ে আসেন। তিনি কানপুরের বাসিন্দা একজন মহারাষ্ট্রীয় ছিলেন। কমলা টাওয়ারে, অর্থাৎ জুগগিলাল কমলপতের ফার্মে ভালো চাকরি করতেন। কানপুরে তিনি কংগ্রেসেরও একজন নেতা ছিলেন। তাঁকে নিয়ে এবং আরও কাকে নিয়ে বাসুদেব যোশী একটি ডিফেন্স কমিটি করেছিলেন। এই সব কিছুর সংস্রব ডাঙ্গের সঙ্গে ছিল। খুব সম্ভবত গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীও এই কমিটির সভ্য ছিলেন। তবে জোরের সঙ্গে কিছু বলতে পারব না। এই কমিটি একজন উকীলকে ইলাহাবাদ হতে নিযুক্ত করে আনলেন। তাঁর নাম ছিল পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয়। তিনি পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। কংগ্রেসের লোক হওয়ার কারণে, বা অন্য কোনো কারণে কিনা তা ঠিক বলতে পারব না, জোগদের সঙ্গে কপিলদেবের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁরা একান্তভাব চাইতেন যে কপিলদেব আইনের ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করুন। জোগ সাহেব খোলাখুলি বলতেন, এই মোকদ্দমায় সাজা অবধারিত। যদি এর ভিতর দিয়ে কপিলদেব কিছু খ্যাতি অর্জন করেন তাতে কার কি ক্ষতি?

আমাদের উকীল-ব্যারিস্টার

এতক্ষণ উকীলের কথা বললাম। এবার ব্যারিস্টারের কথা কিছু বলি। মিস্টার মণিলাল ডক্টর (শাহ্) একজন ব্যরিস্টার। ‘ডক্টর’ তাঁদের পারিবারিক পদবী। আসল পদবী শাহ্।। তিনি গুজরাতের, সম্ভবত বরোদা রাজ্যের লোক, অন্তত, বরোদায় বিদ্যাভ্যাস করেছিলেন। অরবিন্দ ঘোষ শিক্ষাবিভাগে চাকরি দিলেন না বলেই তাঁকে আইনের ব্যবসায়ে প্রবেশ করতে হয়েছিল। এই জন্য অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সারা জীবন তাঁর ক্ষোভ ছিল। এম এ এল এল বি পাস করার পরে ভারতের একটি কোর্টে নাম লিখিয়ে ব্যারিস্টারী পাস করার জন্যে তিনি লন্ডনে যান। সেখানে তিনজন ভারতীয় বিপ্লবী নেতা সাভারকর, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কাশীপ্রসাদ জয়সওয়ালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তিনি বলতেন তাঁদের হিন্দুরাজ্য স্থাপনের রাজনীতি তিনি মেনে নিতে পারেননি। গান্ধীজীর পরামর্শে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। সেখানে তিনি ভালোই ছিলেন, কিন্তু ব্রহ্মচর্যের প্রশ্ন নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়ে যায়। তিনি বলরেন অনেকগুলি সন্তান পয়দা করার পরে গান্ধীজীর ব্রহ্মচর্যে মতি হয়েছে। আর তিনি তো সবে বিয়ে করেছন, কিংবা বিয়ে করবেন সে করাতে আবদ্ধ আছেন (আমার ভালো মনে নেই), তিনি কি করে ব্রহ্মচারী হতে পারেন? মণিলাল গান্ধীজীর আশ্রম হতে বার হয়ে আসেন। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশসমূহ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাঁকে তিষ্ঠতে দিলেন না। শেষে তিনি ছিলেন ফিজি দ্বীপে। সেখানে থেকেও ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাঁকে বার করে দিলেন। তার পরে তিনি ভারতবর্ষে ফিরে এলেন। কানপুরে আমাদের মোকদ্দমা যখন চলছিল তখন তিনি ছিলেন বিহারের গয়াতে। আমি জানতাম ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে তাঁর আকর্ষণ ছিল। কিন্তু অবনী মুখার্জি যে তাঁর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে একত্রে ইশতেহার প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন, আমার গিরেফতারের সময় পর্যন্ত (১৭ই মে, ১৯২৩) এসবের কিছুই আমি জানতাম না। জীবনে আইনের ব্যবসায় করতে গিয়ে তিনি যেমন অকৃতকার্য হয়েছিলেন তেমনই রাজনীতি করতে গিয়েও তিনি অত্যন্ত ঘোলাটে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সোজা মানুষ ছিলেন মণিলাল ডক্টর। কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোক্‌দমা পরিচালনা করার মতো ব্যারিস্টার তিনি ছিলেন না। পণ্ডিত কপিলদের মালবীয়ের যোগ্যতা যে বেশি ছিল তাও নয়।

আগেই বলেছি যে কুদ্দীন আমদের নিকটে আমি ৭৪০ টাকা রেখে গিয়েছিলেম। আমাদের মোকদ্দমায় আসামী পক্ষের সমর্থনে তিনি সেই টাকাটা খরচ করলেন। মণিলালকে নিযুক্ত করার জন্যে তিনিই আবদুল হালীমকে গয়ায় পাঠালেন। এই ভাবেই নিযুক্ত হলেন মণিলাল ডক্টর। শুধু দায়রা আদালতে মোকদ্দমা চালাবার জন্যেই তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পাঁচ শ’ টাকায়, না ছ’শ টাকায় তাঁর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তা আমার মনে নেই, তবে তিনি চারজন আসামীর জন্যেই নিযুক্ত হয়েছিলেন। কানপুরের বন্ধুরা (জি জি জোগ ও বাসুদেব যোশী প্রভৃতি) যে কপিলদেবকে নিযুক্ত করেছিলেন সে কথার উল্লেখ আগে করেছি।

লন্ডনে পড়ার সময়ে লাহোরের ব্যারিস্টার মিস্টার জীবনলাল কাপুর (পরবর্তীকালে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি) আমাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনিও সেশন্স কোর্টে আমাদের পক্ষ সমর্থনের ইচ্ছা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে মণিলাল ডক্টরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

মিস্টার জিন্নাহকে ব্রীফ দেওয়ার চেষ্টায় অসফল

আমাদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক। তাই দেশের বাইরে, লন্ডনেও একটি ডিফেন্স কমিটি গঠিত হয়েছিল। চার্লস আশলী হয়েছিলেন এই কমিটির সম্পাদক। চার্লস আশলীর কথা আমি আগে বলেছি। জর্জ ল্যান্সবারিও আমাদের ডিফেন্সের ব্যাপারে আগ্রহশীল ছিলেন। লন্ডন হতে বন্ধুরা, মিস্টার মার্মাডিউক পিকথলের মারফতে কিনা তা জানিনে, কিংবা লন্ডনের কোনো সলিসিটর ফার্মের মারফতেও হতে পারে, এই মোকদ্দমায় আসামীদের তরফের ব্রীফ নেওয়ার জন্যে মিস্টার এম এ জিন্নাকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি ব্রীফ নিতে অস্বীকার করেননি, কিন্তু ফিস দাবি করেছিলেন দু’হাজার টাকা। এই হিসাবে জিন্নাহ্ ফিস কিছু বেশি দাবী করেননি। তবে রাজনীতিক মোকদ্দমায় আসামী পক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে উকীল-ব্যারিস্টাররা সে সহানুভূতি দেখিয়ে থাকেন কমিউনিস্ট বন্দীদের ব্যাপারে তা দেখাতে মিস্টার জিন্নাহ্ প্রস্তুত ছিলেন না। এ ব্যাপারে তিনি শ্রেণী-সচেতন ব্যক্তি ছিলেন।

মিস্টার আই বি সেনকে এম এন রায়ের ব্রীফ দেওয়ার চেষ্টা

মানবেন্দ্রনাথ রায় আবার আর এক কাণ্ড করেছিলেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার মিস্টার আই বি সেনকে (ইন্দুভূষণ সেন) খবর পাঠিয়েছিলেন যে মিস্টার সেন যেন তাঁর পক্ষে কানপুরের আদালতে উপস্থিত থাকেন। মানবেন্দ্রনাথ যখন দেশে ছিলেন তখন বোধহয় আই বি সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। থাকলে কখনও তিনি তাঁকে ফৌজদারী (Criminal) মোকদ্দমায় আদালতে উপস্থিত হতে বলতেন না। মিস্টার আই বি সেন কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়ানী বিভাগে (Civil Side-এ) প্রাকটিস করতেন। জিহ্বায় কিঞ্চিৎ জড়তা ছিল বলে তিনি কখনও কোর্টে দাঁড়িয়ে মোকদ্দমার সওয়াল-জওয়াব করতেন না। কিন্তু মোকদ্দমার আরজির মুসাবিদা তৈয়ার করার ও আরজির জওয়াব লেখার কাজে তিনি অত্যন্ত সুদক্ষ ছিলেন। এই জন্যেই কলকাতা হাইকোর্টে তাঁর নাম ছিল। মোট কথা, রায়ের পক্ষে দাঁড়াবার জন্যে মিস্টার আই বি সেন কানপুরে আসেননি।

জেলখানায় আমাদের মতি এক ছিল না। ডাঙ্গের ধারণা ছিল যে আমরা তাকে সন্দেহ করি। সে আমাদের সঙ্গে বিনা বিচারে বন্দী হয়নি, সে রয়টারের টেলিগ্রাম করা আমাদের প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে তার কাগজে লিখেছিল, এসব আমার ভালো লাগেনি। সে চতুর্থ কংগ্রেসের ডেলিগেটদের রাহাখরচের টাকা পেয়েও কাউকে পাঠাবার চেষ্টা করেননি। মোটা টাকা নিজে হজম করেছে, বোম্বে গবর্নমেন্ট তার বিরুদ্ধে কিছুতেই মোকদ্দমা করতে চাননি, বলেছেন, বাইরে থাকলে সে তাঁদের খবরের উৎস হবে। এ সব ডাঙ্গে জানত এবং ভাবত আমরাও বুঝি সব কিছু জানি। আমরা তাকে সন্দেহ করছি ভেবে সে মনে মনে সর্বদা পীড়া বোধ করত। কিন্তু ডেলিগেটদের রাহাখরচের টাকা নিয়ে সে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আর বোম্বে গবর্নমেন্ট যে তাকে জেলের বাইরে রাখার জন্যে বিশেষ চেষ্টা করেও সফল হয়নি, সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া যে কোনো কথাই শুনতে চাননি, এসবের আমরা কিছুই জানতেম না।

একের সঙ্গে অন্যের ঝগড়া লাগাবার কাজে নলিনী গুপ্ত ছিলেন দক্ষ শিল্পী। আমরা তাঁর নিকটে এই জন্যে ঋণী যে তিনি আমাদের চারজনের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া বাধিয়ে আমাদের জীবন বিষময় করে তোলেননি। কোথায় কোথায় কিভাবে কার সঙ্গে কার ঝগড়া তিনি বাধিয়েছেন সে সকল গল্প তিনি আমাদের নিকটে করতেন। সেই সময়ে তিনি এই কথাও আমাদের বলেছিলেন যে তিনিই এম এন রায়ের সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ করের ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে এম এন রায়কে ছেড়ে সুরেন কর ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তদের দলে চলে গেলেন।

জেলে আমাদের মতিগতি

শওকত উসমানী ১৯২১ সালে প্রথমবার ভারতে ফেরার সময়ে গোপনে আবদুর রব ও আচার্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এসেছিল। তাঁদের সঙ্গে সে ওয়াদা করে এসেছিল যে তাঁদের হয়েই সে ভারতে সাংগঠনিক কাজ করবে। জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে উসমানী রায়ের নিকটে ক্ষমা চায়। নলিনী গুপ্ত এসব কথা তুলে উসমানীকে খোঁচাতেন। শুয়ে পড়ে ঘুমের ঘোরে কথা বলার ভান করে উসমানী বলত, “বড় ঘরে গিয়ে একবার দেখে নেব”। ‘বড় ঘর’ মানে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনাল।

আমার নিজের কথা নিজে আমি কেমন করে বলব? তবে মনে হয় কোনো অশোভন ব্যবহার আমি করিনি।

আসামী ভাগাভাগি

আগেই বলেছি, মণিলাল ডক্টর ও কপিলদের মালবীয় আমাদের পক্ষের আইনজীবী নিযুক্ত হলেন। আসামী ভাগাভাগি না হলে কোর্টের নিয়মানুসারে মণিলাল ডক্টর হতেন সিনিয়র আইনজীবী, আর কপিলদের জুনিয়র। ডাঙ্গের সঙ্গে পরামর্শ করে জি জি জোগ দু’জন আইনজীবীকে স্ব স্ব প্রধান করে দিলেন। তাতে আমার অন্তত কোনো আপত্তি ছিল না কিন্তু যে ভাবে আসামী তাঁরা ভাগ করলেন তাতে উসমানী আর আমার মাথা কাটা গেল। আমরা দু’জন পড়লাম মণিলাল ডক্টরের ভাগে, আর নলিনী গুপ্ত ও ডাঙ্গে পড়ল পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয়ের ভাগে। অন্য ভাবে ধরলে হিন্দু নামধারী কলকাতার নলিনী গুপ্ত ও বোম্বের শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে পড়ল এক ভাগে, আর মুসলিম নামধারী কলকাতার মুজফফর আহমদ ও কানপুরের শওকত উসমানী পড়ল অপর ভাগে। ডাঙ্গেই তার বন্ধু বাসুদেব হরি যোশী ও জি জি জোগকে দিয়ে এই বিভাগটি করিয়েছিলেন। হঠাৎ জেলখানায় ডাঙ্গে আর নলিনীর ভিতরে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। শুধু হিন্দু নাম হওয়ার কারণে কলকাতার একজন আসামী ও বোম্বের একজন আসামী এক ভাগে পড়ল। মুসলমান নামধারী হওয়ায় কলকাতার একজন ও কানপুরের একজন পড়ল অপর ভাগে। [৪০] অনয়াসে কলকাতার দু’জন একই ভাগে পড়তে পারত, অন্য দু’জন অন্যভাগে পড়লে কিছুই ক্ষতি হতো না, তাতে কারুর সাজা কম বা বেশি হতো না। কিন্তু আমাদের সকলের মুখ রক্ষা পেত। এই ব্যবস্থা করে জোগেরা পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয়কে যত খুশি ওপরে ঠেলে তুলতে পারতেন। তবে কপিলদেব নিতান্ত জুনিয়র উকীল ছিলেন। হাইকোর্টে প্রাক্টিস করার অধিকারও তখন তাঁর ছিল না। যাই হোক এভাবেই দায়রা আদালতে আমাদের মোকদ্দমা শুরু হলো।

[[40. কানপুরে ডিসস্ট্রিক্ট জেলে আমরা (নলিনী, ডাঙ্গে, উসমানী ও আমি) যখন একত্র হয়েছিলেম তখন নলিনী আর ডাঙ্গে আমাদের বুঝতে দিয়েছিল যে যে ১৯২৩ সালে বোম্বেতে তাদের দেখা হয়নি। অনেক পরে ১৯৬৪ সালে পুলিসের নিকটে দেওয়া নলিনীর বিবৃতি পড়ে বুঝেছি যে ডাঙ্গের সঙ্গে বোম্বেতে ১৯২৩ সালে নলিনীর দেখা হয়েছিল। ডাঙ্গের এম এন রায়কে লেখা পত্র হতেও তা বোঝা যায়। আবার ১৯৬৪ সালে ফলাও করে ডাঙ্গে যে বক্তৃতা দিয়েছে তাতে সে বলেছে সে তো নলিনীকে বাঁচিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল কিন্তু মুজফফরের রক্ষণাবেক্ষণে থেকে কলকাতাতেই নলিনী গিরেফতার হলো। মিথ্যাবাদীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল। ডাঙ্গে জানত নলিনীর কলকাতায় আসার অনেক আগে হতেই মুজফফর জেলে ছিল।]

এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও আমি কয়েকটি কথা এখানেই বলে রাখতে চাই। যখন আমি স্টেট, প্রিজনার ছিলেম তখন বাইরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমই ছিল। আবদুল হালীম কলকাতায় আছে কিনা তাও জানতেম না। তাই কানপুর যাওয়ার দু’চার দিন আগে কলকাতা প্রেসিডেন্সী জেল হতে কীর্ণাহারে তার বাড়ির ঠিকানায় পত্র লিখেছিলেম। মণিলাল ডক্টর আমাদের ব্রী গ্রহণ করার পর কানপুর জেলে এসে প্রথম যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন তখন তাঁর মুখে শুনলাম যে আবদুল হালীম তাঁকে মোকদ্দমার ব্রী দেওয়ার জন্যে গয়া গিয়েছিল। শুনে খুবই আনন্দিত হয়েছিলেম যে অশেষ দুঃখ-কষ্টের ভিতরে থেকেও সে ভেঙে পড়েনি। তার পরে আমাদের মোকদ্দমা চলার সময়ে দু’বার কানপুরে গিয়ে আবদুল হালীম আমাদের সঙ্গে দেখাও করেছিল।

আমি যখন স্টেট প্রিজনার ছিলেম তখন সব চেয়ে বেশি দিন ছিলেম ঢাকা সেন্‌ট্রাল জেলে। এই ঢাকায় হঠাৎ একদিন একটা ইয়ার্কি শুরু হলো। লেপটেন্যান্ট কর্নেল টমসন নামে এক ব্যক্তি বাঙলা দেশের কারাসমূহের ইন্সপেক্টর জেনেরেল ছিলেন। তাঁর জেলে থাকা ছাড়া তাঁর সঙ্গে ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের বন্দীদের অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের জন্যে সব দায়-দায়িত্ব জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টের ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের। খাওয়া-পরার ও অন্য সব খরচ বহন করবেন ভারত গবর্নমেন্ট। বাঙলা দেশের গবর্নমেন্ট কিন্তু ভারত গবর্নমেন্টকে জানিয়ে দিলেন যে সব খরচ তাঁরাই বহন করবেন। এর পেছনে টমসনের ইয়ার্কি ছিল।

১৯২৩ সালের ৮ই জুন তারিখে তিন জনকে (মুজফফর আহমদ, শওকত উসমানী ও গুলাম হুসয়নকে) ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বন্দী করে রাখার ‘অর্ডার ইন কাউন্সিল’ লর্ড রেডিং দস্তখত যে করেছিলেন একথা আমি আগে বলেছি। তখন আমি কলকাতা পুলিসের লালবাজার লক আপে ছিলেম। সেখান থেকে আমাকে লালবাজার পুলিস অফিসে নিয়ে এসে ভারত গবর্নমেন্টের হোম সেক্রেটারি মিস্টার জে. ক্রেরারের দ্বারা স্বাক্ষরিত এই অর্ডারটি ১৯২৩ সালের ১৬ই জুন তারিখে আমার উপরে জারী করা হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল যে আমাকে কলকাতার আশলীপুর নিউ সেনট্রাল জেলে বন্দী হয়ে থাকতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে আশলীপুর নিউ সেন্‌ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আশলীপুর জেলে তখন আন্দামান ফেরত ১৫/১৬ জন দীর্ঘমেয়াদী বন্দী ছিলেন। জেলে তাঁরা বিশেষ ব্যবহার পেতেন। তাঁদের জন্যে পৃথক রান্নাঘরও ছিল। আমার খাওয়া সেখান থেকে আসতে লাগল। তেমন খারাব খাওয়া নয়, মাছ-মাংস থাকত। ২৪ পরগনার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার লজ আমায় বললেন, তোমার জন্যে তোমার ওয়ার্ডে রান্নাঘর তৈয়ার করে দেওয়া হবে, এখানেই হবে তোমার রান্নাবান্না, ওখানকার ওঁদের খাওয়ায় তোমার চলবে কেন? আমি বললাম, ওই খাওয়াতেই আমার চলবে। আমি দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতিক কয়েদীদের সহিত সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্যুত হতে চাইনি। কৰ্তৃপক্ষ আমার কথা মেনে নিলেন বটে, কিন্তু ভারত গবর্নমেন্টকে জানিয়ে দিলেন যে মুজফফর আমদের জন্যে তেমন কোনো খরচ নেই,-তার বিল উঠেছে (সম্ভবত ১৬ই জুন হতে ৩০ শে জুন পর্যন্ত) মাত্র উনিশ টাকা দু’আনা। যাই হোক, এই ভাবে আশলীপুর জেলে আমার তিন মাস নয় দিন কেটে গেল। এই সময়টা সারা বাঙলায় আমিই ছিলেম একমাত্র স্টেট্ প্রিজনার।

আমার তিন মাস কেটে যাওয়ার পর দশম দিবসে, ১৯২৩ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে আরও কয়েকজন স্টেট্ প্রিজনার কলকাতার আশলীপুর নিউ সেন্ট্রাল জেলে এলেন। তাঁদের ভিতরে ছিলেন ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক জ্যোতিষ ঘোষ, ভূপতি মজুমদার, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, মনোরঞ্জন গুপ্ত, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহন ভট্টাচার্য, রবি সেন, অমৃতলাল সরকার ও রমেশ চৌধুরী। যতটা মনে পড়ে এ’দের মধ্য থেকে কয়েকজন সেদিনই বা তার পরের দিন মেদিনীপুর সেন্‌ট্রাল জেলে বদলী হয়ে গেলেন। আমি বদলী হলাম ঢাকা সেন্‌ট্রাল জেলে।

বাইরের জগতের সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই, এমনভাবেই আমার দিনগুলি কাটছিল সেন্ট্রাল জেলে। এখানেও একা আমি রয়েছি স্টেট প্রিজনার। তবে, সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী এসেছিলেন অনেক পরে।

কাজী ইমদাদুল হকের ভালোবাসার পরিচয়

এখানে একদিন সকাল বেলা (সতীশ বাবু আসার অনেক আগে) জেলা কর্তৃপক্ষ আমায় জানালেন যে তাঁরা গবর্নমেন্ট হতে একটি নির্দেশ পেয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে যে স্টেট প্রিজনারদের জেলের খাওয়ার দেওয়া হবে। কিন্তু প্রিজনার যদি ইচ্ছা করেন তিনি বাইরে থেকে খাওয়ার ও অন্যান্য জিনিস আনাতে পারেন। কারাসমূহের ইন্‌পেক্টর জেনেরেল কর্নেল টমসন বেঙ্গল হোম ডিপার্টমেন্টের কোনো তরুণ ইংরেজ অফিসারের সই নিয়ে এই কাজ করেছিলেন। একা আমি কি করব বুঝতে পারছিলেম না। ভরোসা এই ছিল যে অন্যান্য জেলে অন্য স্টেট প্রিজনাররা রয়েছেন। তাঁরা নিশ্চয় লড়বেন। সেদিন আমি কিছুই খেলাম না। সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপটেন বি জি মালিয়া বলেন, তাঁর বিশ্বাস যে এই অর্ডারটি শীঘ্রই তুলে নেওয়া হবে। তুমি অসুস্থ। তোমার খাওয়া আমরা হস্পিটার থেকে পাঠাব। বাইরে যদি তোমার চেনা কেউ থাকেন, চা-এর ব্যবস্থাটা তুমি বাইরে থেকে করে নাও। তোমার পত্র আমরা স্পেশাল মেসেঞ্জারের মারফতে পাঠিয়ে দেব। ১৯২৩ সালে ঢাকার সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় ছিল না। সরকারী চাকরে নন, এমন কোনো লোকের নাম মনেও করতে পারছিলেম না। কোনো ছোট চাকুরিয়াকে লিখলে তিনি হয়তো বিপদে পড়বেন। সেকেন্ডারী এন্ড হায়ার সেকেন্ডারী বোর্ড অব এডুকেশনের সেক্রেটারি খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হক্‌কে একখানি পত্র লিখে দিলাম। ভাবলাম আর যাই হোক তাঁর বড় চাকরীটি যাবে না। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। তখন তিনি কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের (নর্মাল স্কুলের) হেড মাস্টার ছিলেন। তাঁর বাসায় আমাদের যাতায়াত ছিল। তাঁর বড় ছেলেকে (ডাক নাম আফজল ছিল) অনেক কোলেও করেছি। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই কাজী সাহেব এক টিন লিপটনের চা, বড় এক টিন হান্টলি পামারের ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট, এক সের চিনি ও দুধের টিন পাঠিয়ে দিলেন। পুলিসের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে অনেক বিরূপ মন্তব্য লিখে রাখতে পারেন এই ভাবনাকে তিনি সেদিন অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাঁর এই ভালবাসার স্মৃতি কোনো দিন আমি ভুলতে পারিনি। একথা মনে পড়লেই আমি আজও অভিভূত হয়ে পড়ি।

অল্প কয়েক দিনের ভিতরেই উল্লিখিত অর্ডার উঠে গিয়েছিল। আমাদের খাওয়ার বাবতে গবর্নমেন্ট দৈনিক একটাকা চার আনা হিসাবে বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন।

দায়রা আদালতের সুদীর্ঘ বিবরণ আমি এখানে দিতে চাই না। মোকদ্দমার বাদী কর্নেল কে’ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার জবানবন্দী দিয়েছিলেন এবং বিবাদী পক্ষ হতে তাঁর জেরাও (Cross Examination) করা হয়েছিল। তখন তাঁর একটি উক্তিতে কিঞ্চিৎ খটকা বেধে যায়। তিনি বললেন মাদ্রাজ পুলিস হতে তিনি যে রিপোর্ট পেয়েছিলেন তাতে নলিনী গুপ্ত ১৯২১ সালের ২৪ শে নভেম্বর তারিখে ধানুষ্কোডি অতিক্রম করেছিলেন। নলিনী বলেছিলেন ২৪ শে নভেম্বর নয়, ২৪ শে ডিসেম্বর। বিদেশ হতে কলম্বো হয়ে যাঁরা ভারতে আসেন তখন তাঁদের ভারতের যে স্থানে প্রথম প্রবেশ করতে হয় তার নাম ধানুষ্কোডি। এখানে যাত্রীদের নাম রেজিস্টারে তোলা হয়, তাঁদের পাসপোর্ট ভালো করে দেখা হয়, আর শুল্ক বিভাগও তখন যাত্রীদের মাল পরীক্ষা করেন।

১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে গিরেফ্ফার হওয়ার পরে সেই মাসেরই ২২শে তারিখে নলিনী পুলিসের নিকটে বলেছেন যে তিনি ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ভারতে আসার জন্যে বার্লিন হতে ট্রেনে মার্সাই যান। সেখানে ব্রিটিশ কন্‌সুলেটে গিয়ে তিনি প্রথমে তাঁর ব্রিটিশ পাসপোর্টখানি নতুন (Renewed) করে নিলেন। তার পরে ফরাসী যাত্রী জাহাজ আউকরের (Aukor) যাত্রী হয়ে তিনি কলম্বো যাত্রা করেন। কোন্ তারিখে Aukor মার্সাই ছেড়েছিল একথা নলিনীর বিবৃতিতে নেই। তবে তখনকার দিনে মার্সাই হতে এগারো দিনে ফরাসী যাত্রী জাহাজ কলম্বো পৌঁছাতো। যে তারিখেই তিনি মার্সাই ছাড়ুন না কেন জাহাজ কলম্বো পৌঁছাবার আগে নলিনীর এপনডিক্সের বেদনা আরম্ভ হয়। কাজেই জাহাজ জেটিতে ভেড়া মাত্রই নলিনীকে কলম্বো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর অপারেশন হয় এবং ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে তিনি ছাড়া পান। এই সব কিছু হিসাব করে ১৯২১ সালের ২৪শে নভেম্বর তারিখে নলিনীর পক্ষে ধানুষ্কোডিতে পৌঁছা সম্ভব ছিল।

এ নিয়ে আমার এত হিসাব করার কারণ আছে। আমারও ধারণা ছিল, ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে নলিনী কলকাতা পৌঁছেছিলেন। আমি কোনো কোনো জায়গায় তা লিখেওছি। কিন্তু পুলিসের নিকটে দেওয়া নলিনীর বিবৃতি পড়ে আমার সব ধারণায় ওলট-পালট হয়ে যায়। আমায় ধরে নিতে হলো যে নলিনী ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় পৌছেছিলেন, নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে নয়। কিন্তু আমি যদি সেপ্টেম্বর মাসকে হিসাবে নাও ধরি তাহলেও অক্টোবর (১৯২১) মাসের শেষ তিন সপ্তাহ ও নভেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহ কলম্বো মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে থাকার পরে নলিনী অনায়াসে ২৪ শে নভেম্বর (১৯২১) তারিখে ধানুষ্কোডিতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তা না হলে ২৪ শে ডিসেম্বরের (১৯২১) আগেকার দিনগুলিতে তিনি কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন? কলম্বো হতে মাদ্রাজ পৌঁছাতে লাগে মাত্র একদিন।

মোটের ওপরে দায়রা আদালতে মোকদ্দমার শুনানির দিনগুলি একে একে শেষ হয়ে গেল। তারপরে সেশন্স জজ্ হোম তার রায় লেখার জন্য কয়েক দিন সময় নিলেন। প্রথমে তিনি ১৬ই মে রায় শোনাবার দিন ধার্য করেছিলেন। তারপরে সেই তারিখটি পালটে দিয়ে তিনি ২০ শে মে (১৯২৪) তারিখে রায় শোনানোর দিন স্থির করলেন। এই ২০ শে তারিখে কোর্টে গিয়ে আমরা দেখলাম আসামীদের যাতে ‘লু’ না মারতে পারে তার জন্যে যে খস্থসের বেড়া দুয়ারে দেওয়া হয়েছিল তা আর নেই, কোর্টের ঘর শূন্য। শুধু জ, তার পেশকার, আর্দালি ও দু’চার জন পুলিস রয়েছেন। উকীল-ব্যরিস্টার কেউ কোথাও নেই, সম্ভবত কোর্ট ইনস্পেক্টর ছিলেন। ডাঙ্গের বন্ধুরাও এসে পৌঁছাতে পারেননি।

মিস্টার হোম (Holme) তাড়াতাড়ি তাঁর রায় শুনিয়ে দিলেন যে শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে, মুজফফর আহমদ, শওকত উসমানী ও নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত এই চার জনের প্রত্যেককে চার বছর কারাগারে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। এই দণ্ডাজ্ঞা দ্রুত উচ্চারণ করেই তিনি পুলিসের লোকদের বললেন, “আসামীদের এখনই জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”

সেই সময়কার কানপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলের জেলর, খান সাহেব আমানতুল্লাহ্ শুনেছি ইলাহাবাদ জিলার নাইনীর লোক ছিলেন। ওয়ার্ডারদের মুখে শুনেছি, ওয়ার্ডাররূপেই তিনি প্রথমে জেলের চাকরীতে ঢুকেছিলেন। তার পরে কাজ করতে করতে জেলার হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজি লেখাপড়াও শিখেছিলেন। উনিশ শ’ ত্রিশের যুগে কারাসমূহে যখন প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীপ্রথা প্রবর্তিত হয় তখন যুক্ত প্রদেশে (উত্তর প্রদেশে) ফয়জাবাদ ডিসট্রিক্ট জেলকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বন্দীদের জন্যে নির্দিষ্ট বিশেষ জেলে পরিণত করা হয়। খান সাহেব আমানতুল্লাহ্ তার আগেই খান বাহাদুর হয়েছিলেন এবং তিনি হয়েছিলেন ফয়জাবাদ স্পেশাল জেলের প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট।

যাক, এখন আমাদের কথা বলি। কোর্ট হতে ফেরা মাত্রই খান সাহেব আমানতুল্লাহ্ আমাদের ইউ.পি. জেলের সাধারণ কয়েদীদের খাটো জাঙ্গিয়া ও খাটো কুর্তা পরিয়ে দিলেন। গলায় লোহার হাঁসুলি ও পায়ে লোহার কড়া পরানো তখনও বাকী রাখলেন। সকলে বুঝতে পারছেন যে দায়রা জজ্ জেলে আমাদের প্রতি বিশেষ ব্যবহারের কোনো সুপারিশ করেননি। তিনি যে আমাদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেননি এটাই ছিল আমাদের সৌভাগ্য। পরে খান সাহেব আমাদের কাগজপত্র নিয়ে তাঁর সুপারিন্টেন্ডেন্টের বাড়ী হয়ে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে গেলেন। ম্যাজিস্ট্রেট লিখে দিলেন যে গবর্নমেন্টের মঞ্জুরী সাপেক্ষভাবে আমাদের চারজন কয়েদী জেলে First Class Misdemeanant (ফাস্ট ক্লাস মিস্‌ডিমিন্যান্ট) রূপে গণ্য হবেন। আমি কখনও খবর নিইনি। হয়তো ব্রিটেনের জেলে এই রকম একটি নিয়ম প্রবর্তিত আছে। খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনের যুগেও বোধ হয় মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতি এই রকম ব্যবহার করা হতো। উনিশ শ’ বিশের দশকে জেলে শ্রেণী-বিভাগের প্রবর্তন হয়নি। যাঁরা কোনো ঘৃণিত অপরাধ (felony) করেননি তাঁদেরই মিডিমিন্যান্ট বলা হয়। যে ক’দিন আমরা কানপুর জেলে মিস্‌ডিমিন্যান্ট ছিলাম সেই ক’দিন আমরা নিজেদের পোশাক পরতাম এবং আমাদের খাওয়া-দাওয়াও অপেক্ষাকৃত ভালো দেওয়া হতো।

এই ব্যবস্থা অল্পদিন চলেছিল। শেষ পর্যন্ত গবর্নমেন্ট হতে খবর এলো যে ‘বলশেভিক কয়েদী’রা (আমাদের ‘বলশেভিক কয়েদী’ই বলা হতো) জেলখানায় কোনো বিশেষ ব্যবহার পাবে না। তারা সাধারণ কয়েদীদের (Convicts) পর্যায়ে অবনমিত হবে। এবার আমরা গলায় লোহার হাঁসুলি, এক পায়ে লোহার কড়া, খাটো কুর্তা ও খাটো জাঙ্গিয়া পরে সত্য সত্যই সাধারণ কয়েদী হলাম। কিন্তু হলে কি হবে, আমাদের সাধারণ কয়েদীদের মধ্যে ভিড়িয়ে দেওয়া হলো না।

আমরা জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বললাম, বিশেষ ব্যবহার সম্বন্ধে আমরা নিজেরা গবর্নমেন্টকে কোনো দরখাস্ত পাঠাইনি। এবারে আমরা নিজেরা দরখাস্ত পাঠাব। আমাদের লেখার সরঞ্জাম দেওয়া হোক। সুপারিন্টেন্ডেন্ট বললেন এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। দরখাস্ত আর পাঠাতে দেওয়া হবে না। এর প্রতিবাদে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। আগে হতেই আমাদের চারজনকে চার বিভিন্ন জেলে বদলী হলাম। মুজফফর আহমদ রায়বেরেলি ডিস্ইট্রক্ট জেলে ও নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত গোরপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী হলেন। কানপুর জেল ছাড়ার আগে ডাঙ্গে ও নলিনী খেয়ে নিয়েছিল। উসমানী আর আমি না খেয়েই রওয়ানা হলাম। কিন্তু আমাদের হিস্টরি টিকিটে লেখা হলো না যে আমরা না খেয়ে আছি। রায়বেরিলি জেলে পৌঁছে আমি আরও দু’দিন না খেয়ে থাকলেম। তারপর সেখানকার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমায় গবর্নমেন্টের নিকটে বিশেষ ব্যবহার পাওয়ার দাবী ক’রে দরখাস্ত পাঠানোর অনুমতি দেওয়ায় আমি অনশন ত্যাগ করলাম। আমার এই দরখাস্তখানা ন্যাশনাল আরকইস্ অফ ইন্ডিয়াতে আছে। বলা বাহুল্য, আমাদের বিশেষ কয়েদী হিসাবে আর ব্যবহার করা হয়নি।

দণ্ডিত হওয়ার পরে আমরা যে ক’দিন কানপুর জেলে ছিলাম তখনকার ব্যবস্থা সম্বন্ধে দু’চার কথা বলি।

ডাঙ্গে বলল, সে এম. এন. রায়কে চারখানা মানপত্র লিখেছে। তার জন্যে একেবারে চার বছরের কারাদণ্ড! ডাঙ্গে আরও বলল নলিনীর পক্ষে চার বছরের দণ্ডভোগ সার্থক হবে। তিনি দেশ-বিদেশ দেখেছেন, মস্কো গেছেন এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসকও দেখেছেন। ডাঙ্গে আরও বলল, সে রায়ের নিকট হতে মাত্র পঞ্চাশ পাউন্ড পেয়েছিল। কেন পাঠালেন রায় এই টাকা? সে তো কোনো টাকা কোনোদিন চায়নি। তাকে হাজার হাজার টাক দেওয়ার লোক রয়েছেন। অর্থাৎ, রণছোড় দাস ভবন লোটবালার কথা বলছিল ডাঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে ডাঙ্গ চারখানির অনেক বেশী পত্র লিখেছিল এবং পঞ্চাশ পাউন্ডের অনেক বেশী টাকাও পেয়েছিল। সে সব এখন রেকর্ডে পাওয়া যায়।

অন্য একদিন রাত্রে ডাঙ্গে বলল, এই চার বছর সাজার জন্যে আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি (I have lost my wife)। আমরা সকলে আহা হা করে উঠলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, কবে ঘটল এ দুর্ঘটনা? ডাঙ্গে বলল, না মরেনি। একটি মেয়ে আমার বাগদত্তা ছিল, সে কি আর চার বছর অপেক্ষা করবে?

আমরা বললাম, করবে।

সে মেয়েটি সত্যই অপেক্ষা করেছিলেন। ঊষাবাঈ তাঁর নাম, বিধবা মেয়ে। হয়তো বাল বিধবা।

নলিনী গুপ্ত বলল, আমার শরীরে নানা ব্যধি। দুবছরের সাজা হলে বেঁচে থাকলেও থাকতে পারতেম। চার বছর বেঁচে থাকা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

ডাঙ্গে আর নলিনীর মধ্যে বন্ধুত্ব তো বাড়ছিলই, এই ক’দিনে তা দানা বেঁধে উঠল।

হাইকোর্টে আপীল

দায়রা আদালতে আমাদের বিচার ও সাজা হয়ে গেল, এখন হাইকোর্টে আপীল করার পালা। কিন্তু কে করবেন আপীল, কোথায় পাওয়া যাবে টাকা, আর কে হবেন আমাদের তরফের উকীল-ব্যারিস্টার? এই মোকদ্দমার আপীলে সাজা কমে যাবার সম্ভাবনা ছিল। ব্রিটিশ বৈদেশিক মন্ত্রী লর্ড কর্জনের প্রেরণায় মোকদ্দমাটি হয়েছিল। রুশরা ভারতে বলশেভিকবাদ প্রচার করছেন এটা ব্রিটিশ সমস্ত জগতের নিকটে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। গবর্নর জেনেরেলের একজেকিউটিব কাউন্সিলের হোম মেম্বর সার মালকম হেইলী বাঙলার এড্‌ ভোকেট জেনেরেল মিস্টার এস. আর. দাশকে লিখেছিলেন যে এই মোকদ্দমায় তাঁরা আসামীদের সাজা চান, কিন্তু কঠোর সাজা চান না। তাঁরা পৃথিবীকে দেখাতে চান যে বলশেভিকবাদ ভারতে অনুপ্রবেশ করছে এবং আরও প্রমাণ করতে চান যে ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের প্রয়োগ ক’রে তাঁরা কোনো অন্যায় কাজ করেননি। সার মালকম হেইলীর পত্রের এই উক্তি ছাড়াও আমরা দেখেছি যে পেশোয়ারের মতো নিষিদ্ধ স্থানে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় বেশীর ভাগ আসামীর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল, দু’জন আসামীর মাত্র হয়েছিল দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

হাইকোর্ট আপীলের ব্যাপারে আমাদের একান্ত ইচ্ছা ছিল এই যে একজন ভালো উকীল বা ব্যরিস্টারকে নিযুক্ত করা হোক। কপিলদেব মালবীয় হাইকোর্টের উকীল ছিলেন না। কাজেই হাইকোর্টেও তিনিই নিযুক্ত হবেন একথা তখন উঠেইনি। মণিলাল ডক্টর ছিলেন ব্যরিস্টার। যে কোনো কোর্টে তাঁর দাঁড়াবার অধিকার ছিল। আমরা চাইনি যে হাইকোর্টে তিনিই আপীলের তদবীর করুন।

আমাদের মনের এই অবস্থায় একদিন নলিনী গুপ্ত আমায় অনুরোধ করলেন যে আমি যেন তাঁর তরফ হতে কলকাতার ব্যরিস্টার মিস্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে একখানি পত্র লিখে দিই। তাঁকে অনুরোধ করা হোক যে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে এসে তিনি যেন কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আপীলের তদবীর করেন। ডাঙ্গের বন্ধুদের মনে যে অন্য কথা ছিল তখন আমি অন্তত তা বুঝিনি। আমি প্রতিবাদ করলাম। বললাম, তাঁর ফিস দিতে হবে, তাঁর ইলাহাবাদ যাতায়াতের খরচ দিতে হবে এবং হোটেলে থাকার খরচও দিতে হবে। তিনি যদি ফিস নাও নেন, (কমিউনিস্টদের নিকট হতে ফিস না নেওয়ার কোনও কারণ ছিল না) তবুও মোটা টাকা খরচ হবে। সেই খরচ কে দেবেন? নলিনী বললেন, “আপনি ভাববেন না,-মিস্টার সেনগুপ্ত আমাদের আত্মীয়, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” বাঙলাদেশে হিন্দুদের ভিতরে বৈদ্যরা সংখ্যাল্প বর্ণ (Case)। তাঁদের ভিতরে নাকি প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের আত্মীয়তা। মিস্টার সেনগুপ্তকে পত্র লেখা হয়েছিল। নলিনী ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি আসবেন। কমরেড আবদুল হালীম যখন দেখা করতে এসেছিল তখন তাঁকেও তিনি বলে দিয়েছিলেন যে মিস্টার জে. এম. সেনগুপ্ত ইলাহাবাদ হাইকোর্টে আমাদের আপীলের তদবীর করতে আসছেন। শুনেছি কলকাতায় এ খবর রটেও গিয়েছিল।

আমরা কানপুর জেলে থাকতেই একদিন সকালে একখানি ওকালতনামা সই করার জন্যে জেলের ভিতরে আমাদের নিকটে পাঠানো হলো। ডাঙ্গের বন্ধুদের উদ্যোগে গঠিত ডিফেন্স কমিটি নিশ্চয় এই ওকালতনামা পাঠিয়ে দিয়ে থাকবেন। ওকালতনামায় ইলাহাবাদের বিখ্যাত এডভোকেট মিস্টার প্যারীলাল ব্যানার্জির নাম লেখা ছিল। আমরা এই ওকালতনামা সই করে দিয়েছিলেম। ৭ই জুলাই (১৯২৪) তারিখে আমাদের চারজনকে যে চার বিভিন্ন জেলে বদলী করে দেওয়া হলো এটা ছিল আইন বিরুদ্ধ কাজ। আপীল শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কয়েদীকে অন্য জেলে বদলী করা নিয়ম বিরুদ্ধ। অবশ্য, যে শহরে আপীল আদালত অবস্থিত সেই শহরে বদলী করা যায়। কিন্তু আমাদের পাঠানো হলো দূরে দূরের চারটি জেলে। কলকাতার জেলে আমি বদলী হতে চেয়েছিলেমই, দ্বিতীয় দরখাস্তে বললাম আপীলের জন্যেও আমার কলকাতায় যাওয়া দরকার। সেখানকার বার হতেই আমায় আইনজীবী নিযুক্ত করতে হবে এবং কলকাতার অবস্থাপন্ন বন্ধুদের সাঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে টাকাও সংগ্রহ করতে হবে। একথাও আমি লিখেছিলেম যে আমার আপীলের নিষ্পত্তির জন্যে যদি আমার যুক্ত প্রদেশের জেলে থাকা দরকার তবে তো আমায় কানপুর হতে রায়বেরেলি ডিস্ট্রিক্ট জেলে না পাঠিয়ে ইলাহাবাদের কোনো একটি জেলে পাঠানো উচিত ছিল। আমার এই দরখাস্ত গবর্নমেন্ট অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাঁরা বললেন আপীলের তদবীর করার জন্যে প্রাদেশিক বারেই বহু আইনজ্ঞ আছেন।

কোনো দিক হতে কোনো খবর পেলাম না। ৭ই জুলাই (১৯২৪) পর্যন্ত আমরা চারজনই একত্রে কানপুর জেলে ছিলেম। সেদিন পর্যন্ত নলিনীর পত্রের জওয়াবে তাঁর ‘আত্মীয়’ মিস্টার জে. এম. সেনগুপ্ত কোনো সাড়া দেননি। নলিনীর মনে মাঝে মাঝে তাঁর সহজাত দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হতো। সেই বুদ্ধি হতে তিনি মিস্টার সেনগুপ্তকে পত্র লিখেছিলেন কিনা কে জানে? হয়তো তাই।

ডাঙ্গে ও নলিনীর তখনকার মনের অবস্থা ছিল এই রকম যে আপীল দায়ের করলেও চলে, না করলেও কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, তাঁরা ক্ষমা ভিক্ষা ক’রে গবর্নমেন্টের নিকটে আবেদন করেছিলেন। তাঁদের মনে ধারণা হয়েছিল যে তাঁদের মুক্তি সুনিশ্চিত। এই সম্বন্ধে আমি অন্যত্র বিস্তৃতভাবে লিখব।

রায়বেরেলিতে আমার অবস্থা ছিল শোচনীয়। আমি আমার বন্ধু কাজী নজরুল ইস্লামকে (বাঙলার প্রসিদ্ধ কবি) গোপনে একখানি পত্র লিখেছিলাম। এই পত্রখানি কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ে যায়। তার জন্যে যুক্ত প্রদেশের কারাসমূহের ইনস্পেক্টর জেনেরেল আমায় কঠোর সাজা দেন। অর্থাৎ (১) আমি এক বছর জেলের কোনো ‘রেমিশন’ পাব না; (২) এক বছর বাইরের কাউকে কোনো পত্র লিখতে পাব না; (৩) এক বছর বাইরে থেকে কোনো পত্র গ্রহণ করতে পারব না; (৪) এক বছর কারুর সঙ্গে মূলাকাত ( Interview) করতে পারব না। এই প্রতিবন্ধকটি আমায় একটি অসহায় অবস্থার মধ্যে টেনে নিয়েছিল। তবে, আমার এই সাজাগুলি মোকদ্দমার আপীলের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল না। এ ব্যাপারে উকীল-ব্যারিস্টাররা আমার সঙ্গে দেখা করে আমার বক্তব্য শুনে যেতে পারতেন। প্রয়োজন হলে আমাকে দিয়ে ওকালতনামাও সই করানো যেতো। কিন্তু কেউ কোনোদিন আমার নিকটে আসেননি। কানপুরের ডিফেন্স কমিটি আপীলের ব্যাপারটিও দেখাশুনা করছিলেন। কিন্তু আমায় তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে দিয়েছিলেন। কানপুরে থাকার সময়ে আমরা যে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের বিখ্যাত এডভোকেট মিস্টার প্যারীলাল ব্যানার্জির বরাবরে ওকালতনামা সই করে দিয়েছিলেম তাতে আমার মনের আশার সঞ্চার হয়েছিল। মনে হয়েছিল, তিনি যখন আমাদের ওকালতনামা গ্রহণ করেছেন তখন আমাদের হয়ে তিনি কোর্টেও দাঁড়াবেন।

কানপুরে শ্রী জোগ ও তাঁর বন্ধুদের চিন্তা-ভাবনা সব কিছু তাঁদের তরুণ বন্ধু কপিলদেব মালবীয়কে ঘিরেই জমাট বাঁধছিল, তিনি হাইকোর্টের উকীল না হওয়া সত্ত্বেও। আমাদের সঙ্গে, অন্তত আমার সঙ্গে তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ হতো না। তাই, কথাবার্তার ভিতর দিয়ে তাঁদের মনের গহনে আমি প্রবেশ করতে পারিনি। একজন নিম্ন আদালতের উকীলকে যে তাঁরা হাইকোর্টেও দাঁড়া করাতে চাইবেন এটা বোঝা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। কপিলদেব ইলাহাবাদে প্রাকটিস করতেন। সে হিসাবে তিনি আমাদের এডভোকেটকে দয়া করা সাহায্য করবেন, এটাই ছিল আমার ধারণা।

হাইকোর্টে আপীলের মেমোরান্ডাম মিস্টার প্যারীলাল ব্যানার্জি দস্তখ‍ করেছিলেন। তবে, তাঁর জুনিয়র বা ক্লার্ক আপীলটি ফাইল (দাখিল) করেছিলে কিনা আমি তা জানিনে। আপীলের মেমোরানড্যামে দু’টি মাত্র অজুহাত (ground) দেওয়া হয়েছিল। এত কম অজুহাত দেওয়ার জন্যে তাই কোর্টের জজেরা সমালোচনা করেছিলেন। অজুহাত দু’টি ছিল

Grounds

1. Because the Conviction Under Section 121-A I.P.C is not Justified as no offence is made out.

2. Because the judge has relied on inadmissible evidence.

বঙ্গানুবাদ

(১) ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে দণ্ডবিধান ন্যায়সঙ্গত হয়নি, যেহেতু অপরাধ প্রমাণিত হয়নি।

(২) যেহেতু বিচারক অগ্রহণীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপরে নির্ভর করেছেন।

এই আপীরের (ক্রিমিনাল আপীল নম্বর ৫৮৮, ১৯২৪ সাল) বিচার করার জন্যে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে

(১) মাননীয় সাব গ্রিমউড মিয়ার্স, নাইট, প্রধান বিচারপতি ও

(২) মাননীয় সার থিও’ডোর কারো পিগোট, নাইট, বিচারপতিকে নিয়ে [৪১] একটি বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল।

[41. 1. Hon’bel Sir Grimood Mears, Knight, Chief Justice. 2. Hon’ble Sir Theodore Cargo Piggot, Knight….Judge.]

কানপুরের ডিফেন্স কমিটির ওপরে আমাদের যে আপীলের জন্যে নির্ভর করতে হয়েছিল তা আমি আগে বলেছি। একথাও বলেছি যে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের খ্যাতনামা এডভোকেট মিস্টার প্যারীলাল ব্যানার্জি আমাদের ওকালতনামা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরই নামে আমাদের আপীল ইলাহাবাদ হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছিল। নলিনী গুপ্তের মিস্টার জে. এম. সেনগুপ্তকে পত্র লেখা হতে একটি রব উঠেছিল যে আমাদের আপীলের তদবীর করার জন্যে তিনি ইলাহাবাদে আসবেন। নলিনী নিজে এই রটনায় সাহায্য করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সব কথা হাওয়ায় ভাসছিল। কেউ মিস্টার সেনগুপ্তকে নিযুক্ত করেননি। করলে তো তিনি ইলাহাবাদ হইকোর্টকে লিখতেন। সেনগুপ্ত যে আসবেন একথা মিস্টার প্যারীলার ব্যানার্জিরও কানে গিয়েছিল। তিনি নিশ্চয় মনে মনে ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। আপীলের শুনানি আরম্ভ হাওয়ার তারিখের “গত পরশু দিন” আমাদের কানপুরের ডিফেন্স কমিটি মিস্টার ব্যানার্জিকে জানালেন যে কলকাতা হতে কেউ আসছেন না। অতএব তাঁকেই হাইকোর্টে আপীলের সওয়াল-জওয়াব করতে হবে। তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। ইচ্ছা করলে তিনি আমাদের ডিফেন্স কমিটির লোকদের গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে পারতেন। আমি কোর্টের নিয়ম-কানুন ভালো জানিনে, মিস্টার ব্যানার্জি আমাদের ওকালতনামা গ্রহণ করেছিলেন, কোনো কিছু না করলে হাইকোর্টের জজেরা হয়তো তাঁকে ধরতেন। তাই তিনি জজেদের সব কথা জানিয়ে দিলেন এবং বললেন তাঁর প্রস্তুতি হয়নি। তাঁকে অন্য একটি তারিখ দেওয়া হোক। জজেরা অন্য তারিখ দিতে অস্বীকার করলেন, বললেন আগস্ট মাসে শুনানি হওয়ার কথা ছিল। পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিম্ন আদালতে তিনি কয়েদীদের পক্ষে ছিলেন ব’লে তাঁকেই হাইকোর্টে আপীলের সওয়াল-জওয়াব করার বিশেষ অনুমতি দেওয়া হলো। [পাইওনীয়ার, ইলাহাবাদ, ১২ই নভেম্বর, (১৯২৪)]।

এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। বারের একজন খ্যাতনামা এডভোকেট কারণ দেখিয়ে অন্য একটি তারিখ চেয়েছিলেন, তাঁকে তা মঞ্জুর করা হলো না, এমন কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয় আগে হতেই স্পেশাল অনুমতির জন্যে দরখাস্ত ক’রে রেখেছিলেন, না, মিস্টার প্যারীলাল ব্যানার্জির অনুরোধ নামঞ্জুর হওয়ার পরে দরখাস্ত করেছিলেন তা পুরানো খবরের কাগজে খুঁজে পাওয়া গেল না। মোটের ওপরে, ব্যাপারটি এই দাঁড়িয়েছিল যে হাইকোর্টের জজেরা মিস্টার ব্যানার্জিকে একটি নূতন তারিখ দিলেন না, কিন্তু হাইকোর্টের উকীল নন এমন একজন জুনিয়র উকীলকে বিশেষ অধিকার দিলেন। তাঁরা আগস্ট মাসের কথা কেন বলেছিলেন তা জানিনে। কারাগারে বন্দী কয়েদীদের জন্যে তো তাঁদের তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়নি। গবর্নমেন্টই প্রস্তুত হতে পারেননি। শরৎকালীন ছুটিও এসে গিয়েছিল। ছুটির সময়ের জজ ছিলেন ডক্টর শাহ্ মুহম্মদ সুলায়মান ও মিস্টার লালগোপাল মুখার্জি। এই দু’জন জজের কোর্টে আমাদের আপীলের শুনানি হোক এটা সরকার পক্ষের ব্যরিস্টার মিস্টার রস অলস্টন কিছুতেই চাননি। গ্রিমউড্ মিয়ার্স ইংল্যান্ডে ছুটিতে ছিলেন। তিনি ফিরে আসুন এটাই তিনি চাইছিলেন। এ ব্যাপারে রস অলস্টন ও ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের মধ্যে অনেক পত্র বিনিময় হয়েছে। পত্রগুলি রেকর্ডে আছে।

শেষ পর্যন্ত কপিলদেবই আপীলের সওয়াল-জওয়াব করেছিলেন। সম্ভবত ভালো বক্তৃতাই দিয়ে থাকবেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের মোকদ্দমা কিভাবে চালাতে হয় তা তিনি জানতেন না। আমাদের উকীল নিজে যে মতই পোষণ করুন না কেন, আদালতে তাঁকে আমাদের লোক হয়ে যেতে হবে। আদালতে যে-সব দলীল আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসাবে সরকার পক্ষ হতে দাখিল করা হয়েছিল সে সব ভালো করে পড়লে তিনি বুঝতে পারতেন যে আমরা কি চাই। তিনি সেদিকটাতেও যাননি। গেলে হাইকোর্টে বলতে পারতেন যে আমাদের কাজ-কর্ম ঘৃণার চোখে (“Contempt”) দেখা উচিত ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করার ও আমাদের সাজা দেওয়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটাই কি দেশের সামনে আমাদের বক্তব্য ছিল? এই কথা বলে তিনি আমাদের ছাড়াতে তো পারেনইনি, আমাদের দণ্ডকালও কমাতে পারেননি। জজেরা বলেছেন এতে তাঁদের মনে কোনো দাগ কাটেনি (“The plea does not impress us”) তিনি আমাদের কাজের প্রতি “ঘৃণা” প্রকাশ না করে পেশোয়ারের মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কথা তুলে ধরতে পারতেন। সেই মোকদ্দমার এক বৎসরের দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত বন্দীরা দণ্ডকাল উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তখন বাইরে এসেছিলেন। শওকতা উসমানীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি সব খবর জানতে পারতেন। কর্নেল কে’র নিকটে পেশোয়ারের রায়ের (Judgement) নকল ও ছিল।

১৯২৪ সালের ৩রা নভেম্বর তারিখে হাইকোর্টে আপীলের শুনানি আরম্ভ হয়েছিল। ৬ই নভেম্বর তারিখ শুনানি শেষ হয়ে যায়। ১০ই নভেম্বর (১৯২৪) তারিখে ইলাহাবাদ হইকোর্ট কানপুর কমিউনিস্ট (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আপীল নাকচ (ডিমিস্) করে দিলেন।

কানপুর কমিউনিস্ট (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার যবনিকার পতন এখানেই হয়ে গেল অবশ্য অনেক কথা এখনও বলার বাকী থাকল।

কানপুরে গঠিত ডিফেন্স কমিটির মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ হলো। হাইকোর্টের আপীলেও তাঁদের বন্ধু পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয় দাঁড়িয়েছিলেন। এটাই তাঁরা চেয়েছিলেন।

ভুল অনুবাদ হতে ভুল ধারণা

দায়রা আদালতে মোকদ্দমা যখন চলছিল তখন সরকার পক্ষ থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখিত বহু পত্র আমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণস্বরূপ আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। এই সকল পত্রের মধ্যে বাঙলায় লেখা দু’খানা পত্রের ইংরেজি অনুবাদের অংশবিশেষ আমি এখানে তুলে দিচ্ছি, মূল পত্রগুলি পাওয়ার আর কোন উপায় নেই। এই পত্রাংশগুলি অবনী মুখার্জি সম্বন্ধে সবিস্তর আলোচনা করেছি।

প্রথম পত্রখানি হচ্ছে একজিবিট নম্বর ১০, বার্লিন হতে ১৯২৩ সারের ৩১শে জানুয়ারী তারিখে আমাকে লেখা। অবনী দেশে ফিরে এসে আমরা যে ছোট আন্দোলনটি গড়ে তুলেছিলাম তা ধ্বংস করার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। তাতেই এম. এন. রায় বলেছেন।

“Abani Mukherji is a dangerous man. I brought him up like a Snake on milk and plantain. Then all the worthies here wanted to put him up in jail as a British spy, it was only through me that his life was saved. Today he is a leader of this party. So dreadful was arrogance. Any way I cannot pardon him any more. So he is done for in the Universal Revolutionary Society.”

(কুঞ্জবিহারী রায়ের দ্বারা বাঙলা হতে ইংরেজি অনুবাদ।)

অনুবাদের অনুবাদ

“অবনী মুখার্জি একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি। আমি দুধ-কলা খাইয়ে সাপ পুষেছিলাম। সেই সময়ে এখানকার মাননীয় ব্যক্তিরা (রায় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের কথা বলছেন) ব্রিটিশ চররূপে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন। আমার কল্যাণেই তখন তার জীবন রক্ষা পেয়েছিল। আজ সে এই পর্টির (ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স পার্টির) একজন নেতা। কী ভয়ানক ঔদ্ধত্য! যাই হোক, আমি তাকে আর ক্ষমা করতে পারি না। বিশ্ব বিপ্লবী সংস্থায় তাকে শেষ ক’রে দেওয়া হয়েছে।” (অবনী মুখার্জি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সব কাজ হতে হবিষ্কৃত হয়েছিল।)

দ্বিতীয় পত্রখানি ১৯২৩ সালের আগস্ট মাসে মানবেন্দ্র রায় বার্লিন হতে নলিনী গুপ্তকে লিখেছিলেন। এখানা কানপুর মোকদ্দমার এক্‌জিবিট নম্বর ৫৪। এই পত্রে আছে :

“Where is that vagabond gone? Is he still in the country? If he comes here. I shall perform his Sradh, I Shall not make any mistake this time.”

(বাঙলা হতে কুঞ্জবিহারী রায়ের ইংরেজি অনুবাদ। )

অনুবাদের অনুবাদ। “সেই ভবঘুরেটি (অবনী মুখার্জি) কোথায় গেল? সে কি এখনও দেশে আছে? যদি সে এখানে আসে আমি তার শ্রাদ্ধ করব। এবার আমি আর কোনো ভুল করব না।”

শ্রীকুঞ্জবিহারী রায়ের আক্ষরিক অনুবাদ পড়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। বিদেশী লেখকরা হয়েছেন বেশী বিভ্রান্ত। শ্রীকুঞ্জবিহারী রায়কে আমি চিনি। তিনি সুশিক্ষিত ব্যক্তি। ১৯১৮ সালে আমি অল্পদিন বঙ্গীয় সরকারের বাঙলা অনুবাদকের অফিসে তাঁর সঙ্গে (তাঁর অধীনে বালাই যথাযথ প্রয়োগ হবে) কাজ করেছি। সারা চাকুরী জীবন তিনি এই অনুবাদের কাজ করেছেন। আমার বিশ্বাস পুলিসের অনুরোধেই তিনি এভাবে আক্ষরিক অনুবাদ করে থাকবেন। “আমি তার শ্রাদ্ধ করব” একটি বাঙলা বাগধারা (Idiom)। তার অর্থ হচ্ছে “আমি তাকে উচিত শিক্ষা দেব”। অবনী মুখার্জিকে ‘খুন করব’ এই অর্থ এই বাগধারার নয়। আমাকে লেখা পত্রখানি। (এক্‌জিবিট নম্বর ১০) ১৯২৩ সালের ৩১ শে জানুয়ারী তারিখে লেখা। তখনও অবনীর জাল করা পত্রগুলি রায়ের হাতে পৌছায়নি। ওই বছরের আগস্ট মাসে নলিনীকে রায় যখন পত্র লিখেছিলেন তার অনেক আগে তিনি অবনীর জাল করা পত্রগুলি পেয়েছিলেন। নলিনী গুপ্তকে পত্রাংশে (নং ৫৪) সহিত আমাকে লেখা পত্রাংশ (একজিবিট নম্বর ১০) আমি সকলকে একবার মিলিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি।

যে বাঙলা বাগধারার আক্ষরিক অনুবাদ হয় না সম্ভবত পুলিসের অনুরোধে তার আক্ষরিক অনুবাদ করে শ্রীকুঞ্জবিহারী রায় একটি বিভ্রাট বাধিয়েছেন। বিদেশের লোকেরা এই থেকে ধরে নিয়েছেন যে মানবেন্দ্রনাথ রায় অবনী মুখার্জিকে খুন করতে চেয়েছিলেন।

“But they (the British) also knew that he was working against Roy, and it therefore seems likely that they felt it would be more damaging to the Communist movement to allow him sto remain free to cause trouble for Roy. According to British intelligence Mukherjee was enough of a nuisance to provoke Roy into expressing his determination to have Mukherji murdered if he should ever return to Berlin. (Gene D.Overstreet and Marshal, Windmiller : Communism in India, Page 67 )

বঙ্গানুবাদ

কিন্তু তাঁরা (ব্রিটিশ) একথাও জানতেন যে সে (অবনী মুখার্জি) রায়ের বিরুদ্ধে কাজ করছেন এবং এই কারণে এটা সম্ভব মনে হচ্ছে যে ব্রিটিশ উপলব্ধি করেছে রায়কে বিব্রত রাখার জন্যে অবনী মুখার্জিকে মুক্ত রাখলে তা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মতে অবনী মুখার্জি এমন বিরুক্তিকর হয়ে উঠেছিল যে সে বার্লিনে ফিরে আসলে তাকে হত্যা করা হবে একথা রায়ের মুখ হতে বা’র হয়ে পড়েছিল।” (জেনে ডি. ওভালস্ট্রীট ও মার্শাল উইন্ডমিলার : “কমিউনিজম্ ইন্‌ ইন্ডিয়া পৃষ্ঠা ৬৭)

শ্রীকুঞ্জবিহারী রায় যদি নলিনীকে লেখা রায়ের পত্রের আক্ষরিক অনুবাদ না করতেন তবে এত কথা উঠত না। ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর পরে শ্রাদ্ধ হয়। রায় যখন অবনী মুখার্জির শ্রাদ্ধ করবেন বলেছেন তখন তাঁকে হত্যা না ক’রে শ্রাদ্ধ কিভাবে হতে পারে? তাই হত্যা করার কথাটা ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও বিদেশী লেখকদের মনে এসেছে।

ভারতবর্ষে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ব্যক্তির শ্রাদ্ধ করতে পারেন না। শ্রাদ্ধ করার অধিকার থাকা চাই। এম. এন. রায়ের সে অধিকার ছিল না তাছাড়া, কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে, তিনি শ্রাদ্ধ করতেন কি করে? ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে অবনী মুখার্জি বার্লিনে ফিরে গিয়েছিলেন। এম. এন. রায়ও তখন বার্লিনে ছিলেন। কই মুখার্জি তো তখন নিহত হননি।

সোবিয়েৎ দেশে অবনী মুখার্জির সোবিয়েৎ নাগরিক স্ত্রী ছিলেন। তাঁর পুত্র সোবিয়েৎ নাগরিকরূপেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই উপলক্ষে অবনী সোবিয়েৎ নাগরিক অধিকার পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯২৫ সালে সে অধিকার তিনি পেয়েওছিলেন। আশ্চর্য এই যে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার মিস্টার ম্যাকডোনাল্ডকে লেখা পত্রে অবনী কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে জঘন্য উক্তি করলেও তাঁর সোবিয়েৎ অধিকার পাওয়ার পথে কোনও বাধার সৃষ্টি হয়নি। বলা বাহুল্য, তাঁর ভারতে আসার পাসপোর্টও ভারত গবর্নমেন্ট মঞ্জুর করেছিলেন। শুধু বলা হয়েছিল যে তাঁকে নিজের দায়িত্বে আসতে হবে। দেশে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় তাঁকে আসামী করা হয়নি। তাঁর নাম আসামীদের তালিকায় ভুক্ত করা সত্ত্বেও সে নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। দেশে ফেরার পক্ষে তাঁর পথে কোনো বাধা ছিল না।

কানপুরের ডিফেন্স কমিটি টাকা তুলেছিলেন। দায়রা আদালতে মোকদ্দমার শুনানি শেষ হওয়ার পরে জজ হোম (Holme) যখন রায় লিখছিলেন তখন শওকত উসমানীর এক কাকা বিকানীর হতে তাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি কিছু টাকাও সঙ্গে এনেছিলেন। টাকার অঙ্কটা ২৫০ ছিল, না ৩৫০ তা এখন মনে করতে পারছিনে। তবে, ২৫০ টাকার কম কিছুতেই ছিল না। পুলিসের রেকর্ডে ৩৫০ টাকার কথা উল্লেখ আছে। হাইকোর্টে আপীলের জন্যে টাকাটা ডিফেন্স কমিটির হাতে দিয়ে যাওয়ার জন্য শওকত উসমানী কাকাকে বলেছিল। তিনি তাই করেছিলেন। নাগপুর হতে মিস্টার রুইকরও কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন। শ্রীজোগেরা তো জানতেনই যে যেমন করেই হোক তাঁরা হাইকোর্টেও পণ্ডিত কপিলদেবকে দাঁড় করিয়ে দিবেন। তবে তাঁরা লন্ডন হতে কেন টাকা আনালেন? লন্ডনেও একটি ডিফেন্স কমিটি স্থাপিত হয়েছিল। জর্জ ল্যান্সবারী এম. পি. সেই কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আবার পণ্ডিত মোতিলাল নেহরুর পরিচয় ছিল। কমরেড চার্লস আশলীর কথা আমি আগে বলেছি। তিনিই ছিলেন লন্ডনে গঠিত ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি। শ্রীজোগেরা পণ্ডিত মোতিলাল নেহরুকে ধরে তাঁকে দিয়ে জর্জ ল্যান্সবারীকে টাকার জন্যে টেলিগ্রাম করলেন। দু’তিন কিস্তিতে তাঁরা ৪৭ পাউন্ড (৭০৫ টাকা) পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয়ের হাইকোর্টে সওয়াল-জওয়াব (argument) ব্রিটিশ সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছিল। লন্ডনের ডিফেন্স কমিটি এর বিরুদ্ধে পণ্ডিত মোতিলালের নিকটে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

পণ্ডিত কপিলদেব মালবীয় ইলাহাবাদের স্থানীয় লোক ছিলেন। সেখানকার নিম্ন আদালতে তিনি প্রাক্‌টিস করতেন। তাঁকে দৈনিক ৫০ টাকা ফিস দিলেও শ্রীজোগেদের নিকটে যথেষ্ট টাকা ছিল। লন্ডন হতে টাকা আনবার কোনো প্রয়োজন তাঁদের ছিল না।

ডাঙ্গে ও নলিনীকে নিয়ে শ্রীজোগ মত্ত ছিলেন। তাঁদের দু’জনই অনুতপ্ত হয়ে গবর্নমেন্টের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। হাইকোর্টে আপীলের সওয়াল- জওয়াব কপিলদেব করেছিলেন, আপীল ডিমিস হয়ে গেছে, এ খবরগুলিও তিনি আমায় দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। আমার সংবাদপত্র পড়ার অধিকার ছিল না। সরকারীভাবে আপীল ডিমিস হওয়ার খবর আমার নিকটে পৌঁছাতে দু’মাস সময় লাগত। কারণ, কোনো আসামী মুক্তি পাননি। ডাক্তার ডি.কে. মুখার্জি অবশ্য খবরটি আমায় বোধ হয় পরের দিনই জানিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রায়বেরেলি জিলার সিবিল সার্জন এবং রায়বেরিলি ডিস্টিক্ট জেলের সুপারিন্টেডেন্ট। বাঙালি হলেও তিনি কোনোদিন আমার সঙ্গে বাঙ্গলায় একটিও কথা বলেননি। তিনি তাঁর অধীন কর্মচারীদেরও ভয়ের চোখে দেখতেন। আমার সঙ্গে বাঙলায় কথা বললে তাঁরা না তাঁকে সন্দেহ করে বসেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *