কথা শুরুর আগে
এক
কিভাবে আমার রাজনীতিক জীবন আরম্ভ হয়েছিল, আরও খোলাসা করে বললে কি করেই বা আমি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলেম সেই সম্বন্ধে আমার স্মৃতিকথা লেখার উদ্দেশ্যে আমি কলম হাতে নিয়েছি। কিন্তু আমি মানুষটি কোথা হতে ও কি পরিবেশের ভিতর দিয়ে সর্বস্ব পণ করে একদিন রাজনীতিক জীবনে প্রবেশ করেছিলেম খুব সংক্ষেপে সে সম্বন্ধেও কিছু বলবার দরকার আছে বলে আমি মনে করি।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র একত্র হয়ে নিজ নিজ নাম বর্জন করে পদ্মা নাম নিয়েছে। এই পদ্মা আবার কত কত নদীকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে পূর্ববঙ্গের চাঁদপুরের কাছাকাছি সমুদ্র বিশেষে পরিণত হয়ে নিয়েছে মেঘনা নাম। মেঘনা পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। চট্রগ্রাম হতে বরিশাল পর্যন্ত মেঘনার মোহনা বিস্তৃত। এই মোহনায় সাগরে ভাসমান একটি ছোট্ট দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। হাজার বছর আগে এই দ্বীপে মানুষের বসতি ছিল। সন্দ্বীপ বাদশাহী আমলের একটি পরগনা। নোয়াখালী জেলার স্থলভাগের বামনী প্রভৃতি জায়গা সন্দ্বীপ পরগনায় অবস্থিত। প্রশাসনিক ব্যাপারে দ্বীপটি আগে নোয়াখালী জিলায় ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার ক’বছর পরে তা চট্টগ্রাম জিলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোনও এক সোমবারে আমি এই দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে জন্মেছি। খুব দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় আমার কখনও জন্মবার্ষিকী পালিত হয়নি। তাই আমার জন্মের সঠিক তারিখ আমার জানা নেই। মায়ের মুখে শুনে যতটা মনে আছে ততটাই শুধু আমি এখানে লিখলাম। তবে, পুরানো দিনের গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা হতে আমি জানতে পেরেছি যে বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭, ১৪ই, ২১ শে ও ২৮ শে তারিখ সোমবার ছিল। খ্রীষ্টীয় সালের হিসাবে এই তারিখগুলি ছিল ১৮৮৯ সালের ২২ শে জুলাই, ২৯ শে জুলাই, ৫ই আগস্ট ও ১২ই আগস্ট। এই চারটি তারিখের ভিতরে কোন তারিখটি যে আমার প্রকৃত জন্মদিন তা জানার আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু এই চারটি তারিখের কোনো একটি তারিখ যে আমার প্রকৃত জন্মদিন সে বিষয়ে এতটুকুও সন্দেহ নেই। আমি স্থির করেছি, ১৮৮৯ সারের ৫ই আগস্টকে আমি আমার জন্মদিন বলব। হয়তো কিঞ্চিৎ ভুল থেকে গেল। কিন্তু তাতে কী এমন আসে যায়?
আমার পিতার নাম মনসুর আলি, আর মায়ের নাম চুনাবিবী। আমার পিতামহের নাম মুহম্মদ কায়েম, আর মাতামহরে নাম ইরশাদ আশলী ঠাকুর। এই নামটি ইশাদ আশলী ছিল, না, আরশাদ আশলী, তাই নিয়ে আমার মনে একটা খটকা বেধেছে। একই আরবী শব্দের উচ্চারণ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মানে হয়। মাতামহকে কোনোদিন চোখে দেখেনি। আমার জন্মের অনেক বছর আগে তিনি মারা গিয়েছিলেন। সন্দ্বীপে চট্টগ্রামে এবং সম্ভবত আরাকানেও মুসলমানদের ভিতরে ঠাকুর পদবীর চলন আছে। আলওলের (আল্ আউয়াল?) কাব্যে সৈয়দ মাগন ঠাকুরের নামোল্লেখ আছে। মুসলিমদের ভিতরে ঠাকুর পদবী খানিকটা আভিজাত্যের চিহ্ন। মতামহের পরিবারে কিঞ্চিৎ আভিজাত্যের দাবি ছিল। আমাদের সন্দ্বীপের মতো ছোট জায়গায় কোনো পরিবারের নামে একটি কিংবা দুটি তৌজি থাকলেই সে-পরিবার অভিজাত বলে গণ্য হতেন।
১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে (১২৩৪ বঙ্গাব্দ) আমার বাবা জন্মেছিলেন। সন্দ্বীপে সেই সময় কোনো ইংরেজি স্কুল তো থাকতেই পারে না, বাংলা স্কুলও ছিল না। বাবা এ’র ও’র নিকটে বাঙলা পড়েছিলেন, আর কিছু পারসী ভাষাও তিনি শিখেছিলেন। তবে, বাংলায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি মুক্তারী পাস করেছিলেন। সন্দ্বীপের আদালতেই তিনি আইনের ব্যবসায় করতেন। আমি মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। আমার শিশু বয়সে বার্ধক্যের কারণে বাবা আদালতে যাওয়া এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। তাঁর সমব্যবসায়ের লোকদের প্রায় প্রত্যেকেই ভালো ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কেন জানিনে, বাবা তা হতে পারেননি। তাই আমার শিশু বয়সে পরিবারের দারিদ্র ছিল অবর্ণনীয়।
আমাদের ওই অঞ্চলে মুসলিম শিশুদের প্রথম পাঠ শুরু হতো আরবীতে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে দিয়েও কুরআনের একটি বাক্য উচ্চারণ করিয়ে আমার পড়া শুরু করানো হয়েছিল। কিন্তু আরবী অক্ষর পরিচয় করিয়ে কেবলমাত্র স্বরচিহ্নের সাহায্যে শিশুদের কুরআন পড়ানোর যে রীতি ছিল আমার বেলায় তা পালিত হয়নি। কাজেই অন্য শিশুদের মতো আমার বিপুল সময় নষ্ট হতে পায়নি। কুরআনের বাক্যটি আমাকে দিয়ে একবার মাত্র উচ্চারণ করানোর পরেই আমার বাবা বাজার হতে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশু শিক্ষার প্রথম ভাগ একখানা কিনে এনে নিজেই আমাকে অ-আ-ক-খ পড়িয়েছিলেন। আজ বুঝতে পারছি এদিক থেকে আমার বাবা খানিকটা প্রগতিশীল ব্যক্তি ছিলেন। আমি যখন সন্দ্বীপ মধ্য ইংরেজি স্কুলে (১৯০২ সালে এই স্কুলের নাম সন্দ্বীপ কাৰ্গিল হাই স্কুল হয়েছে) বাঙলা উচ্চ প্রাথমিক শ্রেণীতে পড়ছিলেম তখন আমায় পড়া ছেড়ে দিতে হয়। আমি ছিলেম শিশু আর স্কুল ছিল আমাদের বাড়ী হতে অনেক দূর। তা ছাড়া, স্কুলের সামান্য বেতন জোগানোর সামর্থ্যও আমার বাবার ছিল না। আমি যে পড়া ছেড়ে দিলেম তার জন্য বাড়ীতে কেউ তেমন কোনো হায় আসোস করলেন না। বাড়ীতে বসে বসে আমার দিন বৃথা কেটে যাচ্ছিল। সেই সময়ে পরিবারে কোনো চাষবাসও হতো না যে তার কাজে আমি লেগে যাব।
ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার বাসনা
মুসলিম প্রধান সন্দ্বীপে মোল্লা-মৌলবীর অভাব নেই। গ্রামে গ্রামে পার্সী-আরবী পড়ানোর ছোট ছোট মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় পড়ার খরচও আবার খুব কম। আমি বাল্যের সীমা ছাড়িয়ে কৈশোরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলেম। এই সময়ে অন্যদের দেখাদেখি আমি একরম নিজে হতেই মাদ্রাসায় পড়া শুরু করে দিলাম। ইরানের কবি সাআদীর ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ অনেকখানি পড়েছিলেম, কবি জামীর কাব্য ‘ইউসফ ও জুলায়খা’ সবে পড়া আরম্ভ করেছিলেম, আর পড়েছিলেম কিছু আরবী ব্যাকরণ। এটা ১৯০৫ সালের কথা। অশক্ত হয়ে, পড় কষ্ট পেয়ে ৭৮ বছর বয়সে এই বছর আমার বাবা মারা গেলেন। বঙ্গভঙ্গের জন্যে দেশে তখন প্রবল আন্দোলন। আমার মতে তখন জোর বাসনা জন্মালো যে মাদ্রাসার পড়া ছেড়ে দিয়ে আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ব। আমার অগ্রজেরা ছিলেন তিন জন-মহব্বত আশলী, মকবুল আহমদ ও খুরশীদ আলম। পেশায় তাঁরা ছিলেন যথাক্রমে উকীলে ক্লার্ক, শিক্ষক ও জমীদারী ইস্টেটের কর্মচারী। কলকাতা মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মকবুল আহমদ সাহেব খুলনা জিলার মোরেলগঞ্জ থানার এক গ্রামে শিক্ষকতা করতেন। তিনিই মাঝে মাঝে আমায় সামান্য অর্থ সাহায্য করতেন। তাঁকেই জানালেম আমার বাসনার কথা, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন আমি নোয়াখালী জিলার স্থলভাগে বামনীর আত্তারীয় মাদ্রাসায় পড়ছিলেম। কাউকে কিছু না জানিয়ে সেখান থেকে একদিন আমি বাকেরগঞ্জ জিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মনে পড়ে পাতার হাট স্টীমার স্টেশনে একটি পয়সা কম পড়ে যাওয়ায় আমি বরিশালের টিকেট কিনতে পারছিলেম না। তখন একজন আদালতের হিন্দু চাপরাশি দয়াপরবশ হয়ে আমায় একটি পয়সা দিয়েছিলেন। মনে আছে পিরোজপুর (ফিরোজপুর) মহকুমার বামনা নামক স্থানে আমি গিয়েছিলেম। তার পর পায়ে হেঁটে আরও কত কত জায়গায় ঘুরেছিলেম। বরগুনার কথা মনে আছে। শেষে পৌঁছেছিলেম আমতলী থানার অধীন বুড়ীরচর নামক গ্রামে। এসব জায়গায় ঘোরার সময়ে একটি খুব ভালো ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইলাকাটি নদীময়। লোকেরা ছোট-বড় নৌকায়, বেশীর ভাগ নিজেদের নৌকায় যাতায়াত করতেন। নদী পার হওয়ার দরকার হলেই এই রকম পথিক নৌকাদের ডেকে অনুরোধ করলেই তারা পয়সা না নিয়েই নদী পার করে দিতেন। ষাট বছর আগেকার কথা। আজ ১৯৬৬ সালে এই ক’ছত্র লিখতে গিয়ে ভাবছি আজও কি ওই অঞ্চলে এই চমৎকার ব্যবস্থাটির চলন আছে।
বুড়ীরচর গ্রামে এক লোকের বাড়ীতে থেকে আমি ছোট-বড় ছেলেদের অ- আ-ক-খ পড়ানো শুরু করে দিলাম। আলিফ গাজী নীল গাজী দুই ভাইয়ের নামে লোকে বাড়ীটিকে আলিফ-নীল গাজীর বাড়ী বলতেন। তারা কৃষক পরিবার।
বাকেরগঞ্জ জিলার নিরক্ষর গ্রামগুলিতে নোয়াখালী জিলা হতে অল্প শিক্ষিত লোকেরা এসে সেই সময়ে এইভাবে বিদ্যা ও অবিদ্যা দান করতেন। আমার ইচ্ছা ছিল এই কাজ করে কিছু পয়সা রোজগার হলে বাকেরগঞ্জ জিলারই কোনো হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যাব। আমি এখানে একরকম অজ্ঞাতবাসে ছিলেম। আমার অগ্রজ মৌলবী মকবুল আহমদ নানান সূত্রে খুঁজে খুঁজে একদিন ওই বুড়ীরচর গ্রামে আলিফ-নীল গাজীর বাড়ীতে উপস্থিত। বললেন, “বাড়ী চল, হাউ স্কুলেই তোমায় পড়তে দেব।”
১৯০৬ সালে সন্দ্বীপ কার্গিল হাই স্কুলের নীচের ক্লাসে ভর্তি
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে সন্দ্বীপ কার্গিল হাই স্কুলের নীচের ক্লাসে ভর্তি হলাম। আমার বয়স তখন ষোল সতেরো বছর হওয়া সত্ত্বেও স্কুল কর্তৃপক্ষ আমায় নীচের ক্লাসে ভর্তি করে নিলেন। আরও সৌভাগ্যের বিষয় এই হলো যে বাচ্চা ছেলেরা আমায় তাদের ক্লাসে বসতে দিল এবং আমার মাথায় চাটি মেরে তাদের ক্লাস হতে বা’র করে দিল না। আমি বাঙলা তাদের চেয়ে অনেক ভালো জানতেম বলে তারা নিজেদের মধ্যে আমায় গ্রহণ করে নিয়েছিল। মাদ্রাসায় পড়ার সময়ে আমি বাঙলার চর্চা কখনও ছেড়ে দিইনি। তার মানে, বাঙলা বই পেলে আমি পড়তাম বাঙলা মাসিক বা সাপ্তাহিক কাগজ পেলে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত না পড়ে ছেড়ে দিতেম না। মাসিক কাগজে নানান রকম প্রবন্ধ পড়া হতেই আমার মনে ইংরেজি পড়ার ঝোঁক চেপেছিল। আমি তখন বিশেষ ভাবে পড়তে চাইতাম মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস। ইংরেজিতে তা পড়ার সুবিধা বেশী। আমাদের দ্বীপের এস এম আব্দুল আহাদ তখন কলকাতায় এফ এ (পরেকার আই এ) পড়েন। বয়সে আমার চেয়ে তিন চার বছরের বড় হবেন। তিনি নানান বিষয়ে পড়াশুনা করতেন এবং বাঙলা মাসিকে তাঁর লেখা ছাপা হতো। আমার হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে তিনি একদিন আমায় বললেন, “কমপক্ষে এতটা ইংরেজি ভাষা তো আয়ত্ত করুন যাতে সৈয়দ আমীল আশলীর এ শট হিস্টরি অব দি সারসিন্স[১] এবং ‘দি স্পিরিট অব ইসলাম’[২] পড়ে অনায়াসে বুঝতে পারেন”। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে কলঙ্কিত বলে আমি কিছুতেই পড়তে চাইতাম না। আমার এই বন্ধুই আমাকে দিয়ে উপন্যাসগুলি পড়িয়ে ছেড়েছিলেন। দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে তিনি অকালে মারা গেছেন।
[1. A Short History of the saracens
2. The Sprit of Islam ( A History of the Evolution and the Ideals of Islam with a Life of the Prophet) by Syed Ameer Ali. ]
১৯১০ সালে আমি সন্দ্বীপ কার্গিল হাই স্কুল হতে নোয়াখালী জিলা স্কুলে চলে যাই। বাঙলা দেশে জিলার সদরে অবস্থিত গবর্নমেন্ট স্কুলকে জিলা স্কুল বলা হতো, এখনও হয়তো তাই বলা হয়। ১৯১৩ সালে এই স্কুল হতে পরীক্ষা দিয়ে আমি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করি।
আমার নোয়াখালী জিলা স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে গোপনে কে কোন্ আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন তা জানিনে, তবে অবিনাশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের সংস্রবে গিরেফ্ফার হয়ে ডেটেনিউ (পরে স্টেট প্রিজনার) হয়েছিলেন, অবশ্য তাঁর কলেজে পড়ার সময়ে। আমাদের শ্রেণীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র ছিলেন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি আর রাজনীতিতে যোগ দেননি। পরে শুনেছিলাম ওকালতি করার জন্যে বর্মায় গিয়েছিলেন। খুরশীদ আলাম প্রথমে সাব ডেপুটি, পরে প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। খবীরউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বন্ধু হিসাবে আমার ঘনিষ্ঠতা খুবই বেশী ছিল। বি এ পাস করার পরে তিনি স্কুল সব ইনস্পেক্টরের চাকরী নিয়েছিলেন। আরও বড় চাকরী পাওয়ার মতো মুরুব্বি তাঁর ছিল না। কিন্তু এই চাকরীতেই ক্রমশঃ পদোন্নতি করে তিনি রিজিওনাল ইনস্পেক্টর অফ স্কুলস্ পর্যন্ত হয়েছিলেন। দক্ষিণ হাতিয়া দ্বীপের লোক হলেও শুনেছি চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি কুমিল্লা শহরেই স্থায়ী বাসা বেঁধেছেন। আমার রাজনীতি সরকারী চাকুরে বন্ধুদের সঙ্গে আমার পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল। তবুও শুনেছি খবীরউদ্দীনের অধীনে চাকরী করতে গিয়ে আমার আত্মীয় স্বজনেরা স্বজনের মতো ব্যবহার পেয়েছে। আমার মেয়ে যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিল তখন খবীর তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন সব সময়ে। এসব হতে বোঝা যায় যে বিচ্ছেদ ঘটলেও খবীর আমায় ভোলেননি।
১৯১৩ সালে আমি প্রথমে হুগলী মোসিন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেম। তখন কিন্তু কলেজটি পুরনো মোর্সিন কলেজ (মহাত্মা মোর্সিনের বিদ্যালয়) নামটি বর্জন করে শুধু হুগলী কলেজ হয়েছিল। সেখানে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই বছরেই আমি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে চলে আসি। সেই থেকে আমি কলকাতার একজন স্থায়ী বাশিন্দা। একটি কথা কিন্তু আমার বলা হয়নি। সেই যে আমি অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলেম তার শাস্তিস্বরূপ ১৯০৭ সালে মুরব্বিরা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বিয়ে কোনো দিন আমায় ঘর-সংসারে বাঁধতে পারেনি।
আই. এ. পরীক্ষায় ফেল করে আমি পড়া ছেড়ে দিলেম। বিদ্যার্জন তেমন কিছু হলো না। তবুও একবার খতিয়ে দেখলেম আমি কতটা কি শিখেছি। দেখলাম বাঙলাটা আমি মোটামুটি লিখতে পারি, তবে তেমন উঁচু দরের কিছুই নয়। ইংরেজি বই ও খবরের কাগজ পড়লে একরকম বুঝে নিতে পারি। উর্দু বই পড়লে যদিও তা বোঝা যায়, কিন্তু পড়তে বড় বেশী সময় লাগে। অনেক চেষ্টায় ক্লাসিকাল পার্সী ভাষা আমি কিছু কিছু বুঝতে পারতেম। চর্চার অভাবে আমার সেই জ্ঞানটুকু আজ ভোঁতা হয়ে গেছে। স্কুলে ও কলেজে আমার দ্বিতীয় ভাষা আরবী ছিল। কিন্তু আমার ভিতরের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে আরবী আমি কিছুই শিখিনি।
১৯০৬ সালে মার্চ মাসে আমার ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই (১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তারিখে) ভারতের তখনকার গবর্নর জেনেরেল লর্ড কর্জনের হঠকারিতায় বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, তিনি গ্রেট ব্রিটেনের সেক্রটারী অফ স্টেট ফর্ ইন্ডিয়ার সম্মতি নিয়েই কাজটি করেছিলেন। এই দেশ বিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের সব কয়টি জিলা, দার্জিলিং জিলাকে বাদ দিয়ে সমস্ত উত্তরবঙ্গ এবং চীফ কমিশনার শাসিত আসামকে নিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়েছিল। আর, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ছোট নাগপুর ও ওড়িশাকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল বঙ্গদেশ। আসাম প্রদেশ যখন বহুপূর্বে গঠিত হচ্ছিল তখন তার লোকসংখ্যা বড় কম ছিল বলে বাঙলা দেশ হতে বাঙলাভাষী সীলেট, কাছাড় এবং রংপুর জিলার একটি অংশ কেটে নিয়ে আসামে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে যে-বঙ্গদেশ থেকে গেল তাতে বঙ্গভাষী লোকেরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়লেন। বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ কার্যত : হয়ে দাঁড়াল বঙ্গ সাংস্কৃতিরও ব্যবচ্ছেদ। তাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এমন প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হয়ে গেল যে তাতে সমস্ত ভারতবর্ষ কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনও জারদার হয়ে উঠল উভয় বাঙলায়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেন। পূর্ববঙ্গে তাঁরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে পড়েছিলেন। চাকরীও তাঁরা বেশী বেশী পেতে লাগলেন। যুক্তবঙ্গে এত সব সুবিধা তাঁরা পেতেন না। অবশ্য, এসব সুযোগ- সুবিধার ভাগ যে পূর্ববঙ্গের বাশিন্দা হিন্দুরাও কিছু কিছু পাচ্ছিলেন না তা নয়। কিন্তু, আন্দোলনের একটা মস্ত বড় কারণ সে সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদ ও বঙ্গদেশে বঙ্গভাষীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া ছিল তাতে সন্দেহ নেই। পূর্ববঙ্গের বড় বড় হিন্দু জমীদাররা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধ-আন্দোলনে প্রচুর সাহায্য করছিলেন। আন্দোলন জোরদার হওয়ার এটাও একটি কারণ ছিল। জমীদাররা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, মুসলিম কৃষক-প্রজা প্রধান পূর্ববঙ্গে না জমিদারী প্রথা বিলোপ হয়ে যায়।
উত্তরবঙ্গের অল্প সংখ্যক মুসলমানও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে-আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্যরিস্টার মিস্টার আবদুর রসুল, মিস্টার আব্দুল হালীম গজনবী, পরে সার আব্দুল হালীম গজনবী, মৌলবী মনীরুজ্জামান ইসলাম আবাদী, মৌলবী কাজিম আশলী (চট্টগ্রামে তিনি কাজিম আশলী মাস্টার নামে খ্যাত ছিলেন), সিরাজগঞ্জের সৈয়দ ইসমাইল হুসয়ন সিরাজী, বর্ধমানের মৌলবী আবুল কাসিম, মৌলবী মুজীবুর রহমান (“দি মুসলমান” নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের সম্পাদক), মৌলবী মুহম্মদ আকরম খান (বহু পরে পাকিস্তানের প্রবক্তা এবং এখন [৩] ঢাকার ‘দৈনিক আজাদ’ নামক বাঙলা দৈনিকের মালিক), ডাক্তার আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পাটনার সৈয়দ আশলী ইমাম ও সৈয়দ হাসান ইমাম (ব্যারিস্টার ভ্রাতৃদ্বয়), মিস্টার মুজাহারুল হক, প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার (পরে পাটনার বিখ্যাত সদাকত আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা) ও মৌলবী লিয়াকত হুসয়ন প্রভৃতি।
[৩. এ পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে আকরাম খান সাহেব মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।]
আমি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনো আন্দোলনে যোগ দিইনি। কোনো পক্ষে যোগ দিলে তা মোটেই বেমানান হতো না। আমার মতো ষোল- সতেরো বছরের ছেলেরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সাম্প্রদায়িক কোনো ব্যাপারে আমি একেবারেই থাকিনি একথা বললে অপলাপ করা হবে। মুসলমানদের বিশেষ দাবী-দাওয়ায় সভা-সমিতিতে আমি তখন যোগ দিয়েছি। আমি সেই সময় ধার্মিক মুসলামানও ছিলেম। দিনে পাঁচবার নামাজ না পড়লেও রমজানের পুরো মাসটি দিনের বেলা উপোস করে কাটাতাম।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের আন্দোলনও চলেছিল। এই আন্দোলন এতই প্রবল হয়েছিল যে উভয় বাঙলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন সহ রাজনীতিক আন্দোলনের নামই হয়ে গিয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন। এই নামটি এখনও যে অচল হয়ে গেছে, তা নয়। তবে, নামটির সঙ্গে আগেকার দিনের সেই ঝাঁজ আর নেই। ১৯২৪ সালে আমরা সংযুক্ত প্রদেশের (এখনকার উত্তর প্রদেশের) জেলে গিয়ে দেখেছিলেম যে সাধারণ কয়েদীরা ও জেলের ওয়ার্ডারা তো বটেই এবং জেল অফিসের কর্মচারীরাও রাজনীতিক বন্দীদের বলেন ‘খিলাফৎওয়ালা’। ক’বছর আগেকার খিলাফৎ অসহযোগ আন্দোলন এ ভাবে তার স্বাক্ষর রেখ গিয়েছিল।
আমি আসল কথা হতে সরে যাচ্ছি। তবুও এখানে একটি কথা বলা অপ্রসাঙ্গিক হবে না যে স্বদেশী যুগের গোড়ায় বাঙলা দেশে (উভয় বাঙলায় জাপানী পণ্যও স্বদেশী পণ্যরূপে পরিগণিত ছিল। সেই সময় আমি নোয়াখালীতে নিজের চোখে দেখেছি যে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের জন্য ছাত্ররা যে সকল ছাপানো ইতিহার দেওয়ালে মেরে দিতেন সে-সকল ইশতিহারে জাপানী দ্রব্যকেও স্বদেশী দ্রব্যরূপে গণ্য করার অনুরোধ থাকত। ইউরোপ হতে আমদানি করা দিয়াশলাই ব্রিটিশ পণ্য ছিল না। তবুও জাপানের হাতী মার্কা দিয়াশলায়ের পক্ষে জোর প্রচার চলত, যদিও এই দিয়াশলাই একেবারেই জ্বলতে চাইত না। প্রচারের ফলে অনেকে তা কিনতেন এবং পরম নিষ্ঠার সহিত তা জ্বালাবার চেষ্টাও করতেন। ১৯০৪ সনে রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের বিজয়লাভ ভারতের, বিশেষ করে বাঙলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত লোকদের বিমুগ্ধ করেছিল। জাপানের দূতেরা কৃষ্টি দূতরূপে আগে হতেই ভারতে আনাগোনা শুরু করে দিয়েছিলেন তারা আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ওপরে প্রভাব বিস্তারে সমর্থও হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের ওপরে জাপানের নজর পড়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যে ভারত আক্রমণ করতে এসেছিল তা সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে হঠাৎ স্থিরকরা একটি বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মোটেই ছিল না। বহু বছর আগে হতে তার প্রস্তুতি আরম্ভ হয়েছিল। আমাদের ওপরে জাপানের বোমা যখন পড়েছিল তখনও আমাদের বহু দেশবাসী জাপানের বন্ধুরূপে গণ্য করেছেন।
সাপ্তাহিক ‘হিতবাদীর সম্পাদক কালী প্রসন্ন কাব্যবিশারদ শুধু স্বদেশী যুগের একজন বড় নেতা যে ছিলেন তা নয়, একজন সাহসী নেতাও তিনি ছিলেন। মাওলানা মুহম্মদ আকরম খানের মুখের শুনেছি, ১৯০৬ সালের বরিশাল প্রাদেশিক কনফারেন্সের সময় ওখানকার ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট নিজের বাংলোয় ডেকে নিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসতে না বলে যখন অপমানিত করেছিলেন তখন কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ একখানা চেয়ার টেনে জোর করে তাঁকে (সুরেন্দ্রনাথকে) বসিয়ে দিয়েছিলেন। কালীপ্রসন্ন সেই অল্পসংখ্যক রাজনীতিক নেতাদের একজন ছিলেন, যাঁরা ভারতে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা চাইতেন। ১৯৬০ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর তারিখে আমি কালী প্রসন্ন কাব্যবিশারদের হিতবাদীর সহকর্মী শ্রীকেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত দেখা করেছিলেন। আমার ইচ্ছা ছিল যে কাব্যবিশারদের জাপানে যাওয়ার কারণ সম্বন্ধে তাঁর নিকট হতে কিছু জেনে নেব। ৯৭ বছরে পা বাড়ালেও শ্রীকেশবচন্দ্রের স্মৃতি তখনও প্রখর ছিল। কথাও তিনি বলছিলেন পরিষ্কার ভাষায়। এতটুকুও জড়তা তাতে আসেনি। তিনি আমায় জানালেন যে ১৯০৭ সালে কাব্যবিশারদের সহমতের বন্ধুরা তাঁকে জাপানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল যে কাব্য বিশারদ জাপানে গিয়ে ভারতের মুক্তিদূত হিসাবে কাজ করবেন। তাঁর কাজ হবে জাপান ভারতে মুক্তি-সংগ্রামে কি ভাবে কতটা সাহায্য করতে পারবেন তা জেনে আসা। কাব্যবিশারদ সত্য সত্যই অসুস্থও ছিলেন। তিনি কিডনীর পীড়ায় ( Bright s disease) ভুগছিলেন। ভেবেছিলেন সমুদ্র ভ্রমণে উপকার হবে। যাক, জাপানে পৌছে কাব্যবিশারদ অনেক পদস্থ জাপানীর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তা থেকে তিনি বুঝেছিলেন যে ভারতের মুক্তি-সংগ্রামে কোনো সাহায্যই জাপান ভারতকে করবে না। উপরন্তু, ইংরেজের দুর্বলতার সুযোগ বুঝে জাপান একদিন ভারতকে নিজ কবলে আনার প্রত্যাশী। কাব্যবিশারদ দারুণ হতাশ হন। তাঁর মনে সন্দেহ জেগেছিল যে তিনি হয়তো অসুস্থতার কারণে দেশে আর পৌঁছতে নাও পারেন। সত্যই ফেরার পথে জাহাজে মারাও যান তিনি। তিনি তাঁর জাপানে লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা একখানা পত্রে লিখে দেশের কোনো বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পত্র পৌঁছেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে পত্রখানার একটি বাক্য “জাপান ভারতের বন্ধু নহে”-বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল।
সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভ্যূদয়
আমি অত্যন্ত গরীব ছাত্র ছিলেম। যথাসাধ্য স্বদেশী দ্রব্য আমিও ব্যবহার করতাম। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের (বিখ্যাত উকীল কুমুদিনীকান্ত মুখোপাদ্যায়ের ছেলে) নোয়াখালী বাজারস্থ “স্বদেশী স্টোর্স” (?) হতে মিলের তৈয়ারী ধূতি কিনে আমিও পরতাম।
বাঙলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভ্যূদয় একটি স্মরণীয় ঘটনা। এটা ছিল একটি গোপন আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের আগেই তাঁদের দল গড়ে উঠেছিল। অবশ্য, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাঁদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছিল। এটা বিশেষ লক্ষণীয় যে বাঙলা দেশেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিশেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। বাঙলার শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের ভিতরই ছিল তার উর্বর ক্ষেত্র। বাঙলার বাহিরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কর্মপ্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু বাঙলার মতো দীর্ঘস্থায়ী তা কোথাও হয়নি। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমার মনের যে অবস্থা ছিল, আর যে-রোমাঞ্চ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ছিল তাতে আমার পক্ষে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তার পথে দুস্তর বাধা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দ মঠ” হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূল মন্ত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ গান। তাতে আছে
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বংহি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী ইত্যাদি।
একেশ্বরবাদী কোনো মুসলিম ছেলে কি করে এই মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারত? ওই কথাটা কোনো হিন্দু কংগ্রেস নেতাও কোনো দিন বুঝতে পারেননি। বাঙলা দেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বারীন্দ্রকুমার ঘোষও আন্দামান হতে ফেরার পরে এই কথাই লিখেছিলেন। তাঁর সেই পুস্তকখানি এখন দুষ্প্রাপ্য। উনিশ শ’ বিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে ধারণার পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। তবুও আমি ১৯২৩-২৪ সালে তাঁদের একজন বড় নেতাকে দেখেছি, যে-বিকালে তিনি জেলে এলেন তার পরের সকালেই জেল অফিসে একটি সম্ভ্রমাকর্ষক কালীর ছবির জন্য (an imposing picture of Goddess Kali) অর্ডার পাঠালেন। উনিশ শ’ ত্রিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা জেলখানায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পড়েছিলেন এবং তাঁদের ভিতর হতে বহু সংখ্যক লোক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।
আমি কিন্তু ধর্মানুশাসিত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনকে দোষ দিই না এই কারণে যে তার আগে মুসলমানরাও তো এই রকমই করেছিলেন। তাঁরাও চেয়েছিলেন মুসলিম রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। মুসলিম আন্দোলন আরও বেশী প্রসারিত ছিল। তাঁরা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন শিখ রাজত্ব ও ইংরেজের বিরুদ্ধে এবং কৃষকেরাও যোগ দিয়েছিলেন তাতে। তাঁদের বলিদানও ছিল আরও অনেক বেশী।
বাঙলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কর্মপদ্ধতিকে আমরা সমালোচনা করি। কিন্তু তাঁদেরও বড় অবদান আছে। সেই অবদানকে ও তাঁদের বলিদানকে কে না শ্রদ্ধা ক’রে পারেন?
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন নিষ্ফল হয়নি। ইংল্যান্ডের রাজা ও ভারতের সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাঁর অভিষেক উপলক্ষে ভারতে এসেছিলেন। ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে দিল্লীর দরবার হতে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিহার ও ওড়িশা প্রদেশও সৃষ্টি করলেন। নতুন ব্যবস্থায় পূর্ববঙ্গ, দার্জিলিংসহ উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ প্রেসিডেন্সী আর বর্ধমান বিভাগ) বঙ্গ প্রদেশে পরিণত হলো। বিহার, ছোটনাগপুর ও ওড়িশাকে নিয়ে হলো বিহার ও ওড়িশা প্রদেশ। বঙ্গভঙ্গের আগে ওড়িশা, বিহার ছোটনাগপুর সহ) ও বাঙলা একত্রে ছিল বঙ্গদেশ। আসাম আবারও চী কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত হলো। এই রাজকীয় ঘোষণায় কলকাতা হতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত করা হলো দিল্লীতে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকাতে। পূর্ববঙ্গকে, সম্ভবত যাঁর বিশাল ভূসম্পত্তির ওপরে নতুন প্রাদেশিক রাজধানী নির্মিত হয়েছিল সেই নওয়াব খাজা সলীমুল্লাকেও, সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ঘোষিত হলো যে ঢাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে।
নতুন বাঁটোয়ারায় বঙ্গভাষী সীলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়ায় একটি অংশ তো আসামে থেকে গেলই, বড় তাড়াহুড়ার ভিতর দিয়েই এই কাজটি হওয়ায় বিহার ও ছোটনাগপুরেও বাঙলাভাষী অঞ্চল রয়ে গেল। তবুও বাঙলাভাষীদের বিপুল সংখ্যাধিক্যে নতুন বঙ্গদেশ গঠিত হয়েছিল।
১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। মুসলিম সাম্রাজ্য তুর্কি ইংরেজের বিরুদ্ধ পক্ষে অর্থাৎ জার্মানদের পক্ষে যোগ দেওয়া ভারতের মুসলমানরা অন্ততঃ মনে মনে ইংরেজের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু কাজের বেলায় ইংরেজের মুলিম সৈন্যরা তো যুদ্ধে গেলেনই, হাজার হাজার অসামরিক মুসমানও যুদ্ধের নানান ধরনের কাজ নিয়ে ইরাক প্রভৃতি স্থানে গেলেন। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা ইংরেজের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম বন্ধ করলেন না। তাঁদের তো ছিল ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদী জার্মানীর সহিত যোগ দিয়ে অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহ করে ভারতে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাও তাঁদের ছিল। কিন্তু ইংরেজের কানে এ খবর পৌঁছে যাওয়ায় তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
ভারতে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাস করে ভারতময় হাজার হাজার লোককে বিনাবিচারে বন্দী করলেন। যুদ্ধের শেষ দিকে ১৯১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনও প্রযুক্ত হয়।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস কিন্তু যুদ্ধের প্রতি তাঁদের সমর্থন ও আনুগত্য জানালেন। যে-চার বছর যুদ্ধ চলেছিল তার প্রতি বছরই কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের মঞ্চ হতে যুদ্ধের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ঘোষিত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে দিল্লিতে ১৯১৮ সালে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হলো তাতে রাজানুগত্যের প্রস্তাব তো পাস হলোই, যুদ্ধের সফল সমাপ্তি হওয়ায় ব্রিটিশ গবর্নমেন্টকে অভিনন্দন জানাতেও ভুল হলো না। কংগ্রেস যে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন তার প্রতিদানে কংগ্রেসকে সম্মানিত করার উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে মাদ্রাজের গবর্নর লর্ড পেন্টল্যান্ড যোগ দিলেন। ১৯১৫ সালে মিলিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে বোম্বের গবর্নর লর্ড উইলিংডন যোগ দিয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে লখনৌতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন যুক্ত প্রদেশের (উত্তর প্রদেশ) গবর্নর সার জেম্স্ মেস্টন। তাঁর মণ্ডপে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ই কংগ্রেসের সমস্ত প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালে দেশে নানান রকম আন্দোলন শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তা খুবই প্রবল হয়ে উঠেছিল। ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে এখন যেখানে মহাজাতি সদন নির্মিত হয়েছে সে জায়গায় কিংবা তারই সংলগ্ন কোনো জায়গায় একটি বিরাট বন্দীমুক্তির সভা হয়েছিল। মুশী সরুদ্দীন লেনের একটি ইলাকার বস্তী ও পাকা বাড়ীঘর ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ভেঙে ফেলেছিল। এই খালি জায়গাতেই সভাটা হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ ও বিপিনচন্দ্র পাল এই সভায় বক্তৃতা করেছিলেন। আমি এই সভায় উপস্থিত ছিলেম। ভারতে সম্রাজ্ঞী হয়ে রানী ভিক্টোরিয়া যে ঘোষণা প্রচার করেছিলেন দাশ সাহেব সেই ঘোষণাই হাতে নিয়েই বক্তৃতা করেছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকার সময়ে মুহম্মদ আলীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় হয়েছিল। সেইজন্য বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে বন্দীদের মধ্যে মুহম্মদ আলীর নাম তিনি বারে বারে উল্লেখ করছিলেন। তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর পুরো বক্তৃতা পরের দিন ‘স্টেট্সম্যান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলেন, চিত্তরঞ্জন দাশ নূতন করে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। তাঁর বড় মেয়ে অর্পণা দেবী বলেছেন এই মিটিংটি ১৯১৬ সালের ২রা অক্টোবর তারিখে হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক খিলাফৎ আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯১১ সালে। কিন্তু ১৯১৭ সালে ভারতে এই আন্দোলন বিশেষ হয়ে উঠেছিল এবং তা প্রবল রূপ ধারণ করেছিল ১৯২০ সালে। নিরুপদ্রব প্রতিরোধের কথাও ১৯১৭ সাল হতে হাওয়ায় ভাসতে থাকে। সভা-সমিতির অধিবেশনের সংখ্যাও এই বছরে খুব বেড়ে যায়। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝতার ফলে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই সকল সভায় যোগ দিচ্ছিলেন। ১৯১৬ সাল হতেই আমি সকল প্রকার রাজনীতির সভা ও মিছিলে যোগ দিতে আরম্ভ করি। ১৯১৭ সালে কলকাতায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশন হয়। সেবারেই আমি প্রথম কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশনে দর্শকরূপে যোগদান করি। এই দুটি সংগঠনেরই তখন যে কায়দাকানুন ছিল তাতে ইচ্ছা করলেই আমি প্রতিনিধি হতে পারতাম, কিন্তু দর্শকরূপে যোগদান করাই আমি শ্রেয়স্কর মনে করেছিলেম।
১৯১৭ সালের ২০শে আগস্ট তারিখে ইংল্যান্ডে ভারতের সেক্রেটারি অফ্ স্টেট, অর্থাৎ ব্রিটিশ মন্ত্রীদের ভিতরে ভারতের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, মিস্টার মণ্টেণ্ড, ঘোষণা করলেন যে ভারতবাসীকে দায়িত্বপূর্ণ শাসন ক্ষমতা দেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে নিরুপদ্রব প্রতিরোধের যে সব কথাবার্তা চলছিল তা থেমে যায়। ১৯১৭-১৮ সালে মিস্টার মন্টেগু ও ভারতের বড় লাট চেফোর্ড ভারতে সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ভারতীয়দের মতামত সংগ্রহ করেন। তাঁদের যুক্ত রিপোর্ট লিখিত প্রস্তাব মেনে নিতে চাইলেন এবং অপরাংশ বললেন, প্রস্তাব মোটেই আশানুরূপ নয়। এই নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯১৮ সালের ২১শে আগস্ট তারিখে বোম্বেতে সৈয়দ হাসান ইমামের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশন হয়। মাহ্মুদাবাদের মহারাজের সভাপতিত্বে একই সময় বোম্বেতে মুসলিম লীগের এক অধিওবেশন বসে। উভয় অধিবেশনের সিদ্ধান্ত একই রকম হয়েছিল। তার মোদ্দা কথা এই ছিল যে মন্টেগু চেম্ফোর্ড রিপোর্টের প্রস্তাবগুলি নৈরাশ্যব্যঞ্জক ও অসন্তোষকর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে স্ব-শাসন ছাড়া অন্য কোন প্রস্তাবই গ্রহণীয় হতে পারে না, ইত্যাদি।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ায় যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয় তাতে জারের পতন ঘটে। তার পাঁচ মাসের ভিতরে যে মন্টেগু ভারতকে দায়িত্বপূর্ণ শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন তার পেছনে এই বিপ্লবেরও কিছু প্রভাব নিশ্চয় ছিল। ১৯১৭ সালের নবেম্বর মাসে রাশিয়ায় সর্বহারা বিপ্লব সফল হয় এবং তার ফলে মজুর শ্রেণীর পার্টি-কমিউনিস্ট পার্টির অধিনায়কত্বে মেহনতী জনগণের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট চেঁচাতে লাগল যে যুদ্ধ ফ্রন্টে রাশিয়ার ভাঙন ধরল। রাশিয়ার সর্বহারা বিপ্লবের প্রকৃত খবর যেন ভারতে আসতে না পায় তার জন্যে ভারতের ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট খুব কড়াকড়ি ব্যবস্থা করল। সেই সঙ্গে লেনিনের বিরুদ্ধে ও সোবিয়েত নেতাদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের কুৎসরাও প্রচার হতে থাকল। ইউরোপে তো যেতেন শুধু ভারতের ধনী লোকেরা কিংবা তাদের অনুগৃহীত লোকেরা। তাঁরা রুশ বিপ্লবের ওপরে সদয় ছিলেন না। তা সত্ত্বেও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধ খবরগুলির ভিতর হতেও ভালো খবর বের হয়ে পড়ত। তাছাড়া ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের তরফ হতে যা কিছু মন্দ বলে প্রচারিত হতো দেশের সাধারণ মানুষ ধরে নিতেন যে তার ভিতরে নিশ্চয় কিছু ভালো আছে। আগেই বলেছি, ১৯১৮ সালে আমাদের দেশের মজুরদের ভিতরেও চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ওই সালের ১১ই নবেম্বর তারিখে প্রথম মহাযুদ্ধের বিরতি ঘোষিত হয়। এই সময় নানাস্থানের মজুরদের ধর্মঘটও শুরু হয়ে যায়। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে তা বেড়েই চলল। রুশ বিপ্লব আমাদের দেশের মজুরদের সামনেও আশার আলো তুলে ধরেছিল। মজুর সংগ্রামের ভিতর দিয়েই ১৯২০ সালে সারা ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধের সময় ডিফেন্স অফ্ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট যে পাস হয়েছিল সেকথা আগে বলেছি। এই আইনের মিয়াদ ছিল যুদ্ধবিরতির পরে ছয় মাস। ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট বুঝতে পেরেছিল যে যুদ্ধের শেষে ভারতে আন্দোলন বাড়বে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার জন্যে ১৯১৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর তারিখে ভারত সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করল। এই কমিটির মেম্বর ছিলেন পাঁচজন।
(১) মিস্টার জাস্টিট এস. এ. টি. রওলাট (Mister Justics S.A.T Rowlatt. King’s Bench Division of His Majesty’s High Court of Justice) সভাপতি;
(২) সার ব্যাসিল স্কট (Sir Basil Scott, Chiet Justice of Bombay);
(৩) দিওয়ান বাহাদূর সি. ভি. কুমারস্বামী শাস্ত্রী ( Diwan Bahadur C.V.Kumaraswami Sastri, Judge, High Court of Madras );
(৪) সার ভের্মি লোভেট (Sir Verney Lovett, Member, Board of Revenue, United Provinces ) এবং
(৫) মিস্টার প্রভাসচন্দ্র মিত্র’, কলকাতা হাইকোর্টের উকীল (Vakil)। এই কমিটির নাম ছিল সিডিশন কমিটি। কিন্তু সভাপতির নাম অনুসারে তা রওলাট কমিটি নামে খ্যাত হয়েছিল।
উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনগুলির সহিত সংসৃষ্ট অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রসমূহের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা এবং এইসব দমনের জন্যে কোন্ দমনকারী আইন প্রণয়ন করা যায় সেই বিষয়ে সুপারিশ করা। ১৯১৯ সালের ২৯ শে জানুয়ারি তারিখে রওলাট কমিটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী দুটি আইনের খসড়া ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই তৈয়ার হয়ে যায়। সাধারণ ভাবে খসড়া দুটি রাওলাট বিল নামে খ্যাত হয়েছিল। আসলে খসড়া দুটির নাম (১) দি ইন্ডিয়ান ক্রিমিনাল ল এমেন্ডমেন্ট বিল নম্বর, ১, ১৯১৯; (২) দি ক্রিমিনাল ল এমার্জেন্সি পাওয়ার্স বিল নম্বর ২, ১৯১৯। ১৯১৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আইনের এই খসড়া দুটি কেন্দ্রীয় আইন সভায় (সেন্ট্রাল লেজিসলেটিব এসেম্বরি) উপস্থিত করা হয়। দ্বিতীয় খসড়াটি শেষ পর্যন্ত পাস করানো হয়নি, তবে প্রথম খসড়াটি ১৯১৯ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আইনে পরিণত হয়ে গেল। শুরু হতেই গান্ধীজী প্রস্তাব করলেন যে এই আইনকে প্রতিরোধ করতেই হবে। দেশের নানা স্থান হতে সাড়াও তিনি পেলেন। প্রথমে এর প্রতিবাদে ৩০ শে মার্চ তারিখে দেশময় হড়তাল ঘোষিত হয়। পরে এই তারিখ পরিবর্তন করে ৬ই এপ্রিল করা হয়েছিল। কেন জানিনে, দিল্লীতে এই তারিখ পরিবর্তনের খবর পৌঁছয়নি। সেখানে ৩০ শে মার্চ তারিখেই হড়তাল হয়। এই মিছিলের ওপর গবর্নমেন্ট সেদিন গুলি চালাল। দেশের অন্য সব জায়গায় ৬ই এপ্রিল তারিখে হড়তাল পালিত হলো। কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ সরকার গোলযোগ সৃষ্টি করল অমৃতসরে। ডক্টর সয়ফুদ্দীন কিচলু ও ডাক্তার সত্যপাল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনের আয়োজনে ব্যাপৃত ছিলেন। ১০ই এপ্রিল তারিখে অমৃতসরের জিলা ম্যাজিস্ট্রেট (পাঞ্জাবে ডেপুটি কমিশনার বলা হতো) তাঁদের দুজনকে নিজের বাড়ীতে ডেকে নিলেন। তারপরে তাঁদের কি করা হলো, কোথায় পাঠানো হলো তার কিছুই জনসাধারণকে জানতে দেওয়া হলো না। হতাশা ও ক্রোধে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। গুলি চলল অমৃতসরেও। এবারে জনসাধারণে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তাঁরা ক’জন ইংরেজকে খুন করলেন। এবং একটি ব্রিটিশ ব্যাঙ্কের বাড়ী পুড়িয়ে দিলেন
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল নববর্ষের দিন ( বৈশাখী) ছিল। এই দিনে হাজার হাজার লোক অমৃতসরে জড়ো হয়ে থাকেন। বিশ হাজার লোক জড়ো হয়েছিলেন ওখানকার জালিয়ানওয়ালা বাগে। সেখানে বক্তৃতা চলছিল। অমৃতসরে সামরিক আইন জারি হওয়ার কোনো ঘোষণা তখনও ছিল না। এই বাগের চার দিকে পাকা প্রাচীর। যাতায়াতের পথ মাত্র একটি। হঠাৎ ব্রিটিশ সামরিক অফিসার জেনারেল ডায়ারের পরিচালনায় ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যরা সমবেত জনমণ্ডলীর ওপরে গুলি চালাতে লাগল। ষোলো শ’ রাউন্ড গুলি চালানোর পরে গুলি ফুরিয়ে যায়। জেনারেল ডায়ার বুক ফুলিয়ে বলল, গুলি না ফুরিয়ে গেলে আরও গুলি চালানো হতো। লোকেদের বেরুবার কোনো পথ ছিল না। প্রায় চার শ’ লোক হত হলেন, আর আহত হলেন বারো শ’ লোক। এটা সরকারী হিসাব। আসলে আরো অনেক বেশী লোক হাতাহত হয়েছিল। পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারী হলো। অত্যাচার-অপমানের স্রোত বয়ে চলল অমৃতসর, লাহোর (লাহোরেই সর্বাপেক্ষা বেশী), শেখুপুরা, গুজরানওয়ালা, গুজরাত ও কসুর প্রভৃতি স্থানের ওপর দিয়ে। বহুলোক প্রাণ হারালেন, বহুলোক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন, আর জেলের বাইরে যাঁরা থাকলেন তাঁরা যে-ভাবে নির্যাতিত ও অপমানিত হতে লাগলেন তা ভাষায় অবর্ণনীয়। পাঞ্জাবের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তবু কিছু কিছু খবর বাইরে পৌঁছাল। পাঞ্জাবের লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের প্রতিবাদে নানা স্থানে মিছিল বার হলো। আবার এই প্রতিবাদ মিছিলগুলির ওপরেও গুলি চলল। কলকাতায়ও গুলি চলেছিল। নিহত হয়েছিলেন ছয় জন, আর আহত বারো জন। ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা পাঞ্জাবের এই লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ রাজার দেওয়া নাইট খেতাব বর্জন করলেন। আমাদের মানবতার অবমাননায় কবির হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। সে-সময়ে যে-পত্র তিনি ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয়কে লিখেছিলেন তার ভাষা অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের খেতাব বর্জনে বিশ্বে যে-চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। তা এই থেকে বোঝা গিয়েছিল যে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট বছরের পর বছর কবির খেতাব বর্জন মেনে নিলেন না। ইংরাজেরা কবিকে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই লিখে চললেন। পাঞ্জাবের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে গবর্নর জেনারেলের এক্সেকিউটিভ কাউন্সিলের সভ্য স্যার শঙ্করণ নায়ার তাঁর বার্ষিক চৌষট্টি হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু ব্রিটিশ রাজার দেওয়া নাইট খেতাবটি ছাড়তে পারলেন না।
পাঞ্জাবে যা যা ঘটেছিল গান্ধীজী তাতে মনে দুঃখ পাননি এ কথা কেমন করে বলব? কিন্তু তিনি ঘোষণা করলেন যে সত্যাগ্রহের কথা বলে তিনি হিমালয়- প্রমাণ ভুল করেছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর প্রস্তাবের ফলেই মন্দ লোকেরা স্থায়ী বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পেরেছে। তিনি তাঁর সত্যাগ্রহের প্রস্তাব তুলে নিলেন। পাঞ্জাবে কি ঘটে গেল, আর গান্ধীজী কি বললেন! তিনি জনসাধারণকে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলেন।
সব কিছুর শেষ আছে। পাঞ্জাবের লাঞ্ছনারও একদিন শেষ হলো। যারা জীবন বলি না দিয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, এমন কি সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেও দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলে মুক্তি পেলেন। কলকাতার জনসাধারণ পাঞ্জাবের নেতৃবৃন্দকে যে বিপুল সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন সে রকম সম্বর্ধনা আমি কম দেখেছি।
অনেক আগে নির্ধারিত হয়েছিল যে, কংগ্রেসের ১৯১৯ সালের বার্ষিক অধিবেশন অমৃতসরে হবে। পাঞ্জাবে যা কিছু ঘটেছিল তার পরেও অমৃতসরে কংগ্রেসের অধিবেশন হওয়া উচিত, কি উচিত নয়, এই নিয়ে কথা উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তই বহাল থাকল। পণ্ডিত মোতিলাল নেহরু সভাপতি নির্বাচিত হলেন। ইতোমধ্যে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারত সংস্কার আইন পাস হয়ে গিয়েছিল। একটি রাজকীয় ক্ষমা ঘোষণার ফলে বিনাবিচারে আটক রাজবন্দীরা এবং অনেক দণ্ডিত বন্দীও ছাড়া পেলেন। অনেকে বললেন, প্রদেশে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা কার্যে প্রয়োগ সম্ভব হবে না। আবার গান্ধীজীসহ অন্যরা ভাবলেন যতটুকু অধিকার পাওয়া গেছে ততটুকুই কাজে লাগাতে হবে। দ্বৈত শাসনের মণ্ডাটি খাওয়ার জন্য অনেক নেতারই মুখ দিয়ে লালা ঝরতে লাগল।
এই আবহাওয়ায় অমৃতসরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন আরম্ভ হলো। বাল গঙ্গাধর তিলক ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেখানে তিনি কথা দিয়ে এসেছিলেন, সংস্কার আইনের মারফতে যা কিছু পাওয়া গেছে সেটুকুই তিনি কাজে লাগাবার চেষ্টা করবেন এবং আরো বেশী পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করতে থাকবেন। দেশের মাটিতে পা দিয়ে ভিন্ন রকম আবহাওয়া দেখে তিনি বলতে বাধ্য হলেন যে সংস্কার আইন মোটেই সন্তোষজনক নয়। কিন্তু অমৃতসর কংগ্রেসে যাওয়ার পথে তিনি এক কাণ্ড করে বসলেন। গঙ্গাপুর নামক রেলওয় স্টেশন হতে ভারত সংস্কার আইন পাস করার জন্যে অভিনন্দন জানিয়ে ব্রিটিশ রাজা বা মন্ত্রিসভাকে একটি টেলিগ্রাম তিনি পাঠিয়ে দিলেন। এই আত্মম্ভরী নেতার অমৃতসর পৌছানোর তরও সইল না। টেলিগ্রামে তিনি একথাও জুড়ে দিলেন যে অভিনন্দন তিনি ভারতের জনসাধারণের তরফ হতেই পাঠাচ্ছেন। জানিনে কোন্ জনসাধারণ তাঁকে এই অধিকার দিয়েছিলেন। টেলিগ্রামে একথারও উল্লেখ ছিল যে ব্রিটিশের তরফ হতে যতটা সাড়া পাওয়া যাবে ততটা সাড়া ভারতীয়েরাও দেবেন। এটাও ছিল তিলকের উদ্ভাবিত বিখ্যাত Responsive Co-operation বা পারস্পরিক সহযোগিতার প্রস্তাব।
এতকাল পরে আজও মনে হচ্ছে যে পাঞ্জাবের সামরিক আইনের লাঞ্ছনার পরে অমৃতসরে কংগ্রেসের যে-অধিবেশন হয়েছিল তা নিয়ে কোনোদিন কোনো ভারতবাসী আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করতে পারবেন না। এই অধিবেশন ভারতের মাথা বিশ্বের দরবারে হেঁট করে দিয়েছিল। পাঞ্জাবের বাইরে কোথাও কংগ্রেসের এই অধিবেশন হলে ভালো হতো। কিছু গরম বক্তৃতা যে কংগ্রেসে হয়নি তা নয়, কিন্তু আসল ব্যাপার ছিল ১৯১৯ সালের সংস্কার আইনকে কি করে কাজে লাগানো যায় তার প্রচেষ্টা। মিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশের (তখনো তিনি “দেশবন্ধু” হননি) পূর্ণ দায়িত্বসম্পন্ন গবর্নমেন্ট স্থাপনের প্রস্তাব, যাতে সংস্কার আইনকে নৈরাশ্যব্যঞ্জক ও অসন্তোষকর বলা হয়েছিল, সবজেক্ট কমিটিতে পাস হলেও প্রকাশ্য অধিবেশনে তাতে গান্ধীজীর সংশোধনী প্রস্তাব যোগ হয়ে প্রস্তবটি আরো বেশী জলো হয়ে গেল। সংশোধনীর দ্বারা প্রস্তাবে যা যোগ হলো তাতে এই দাঁড়ালো যে, পূর্ণ দায়িত্বসম্পন্ন সরকার স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ত্বরান্বিত করার জন্যে জনসাধারণ সংস্কার আইনকে কাজে প্রয়োগ করবে।
কংগ্রেসের এই অধিবেশনে চাকরি ত্যাগ করার জন্যে স্যার শঙ্করণ নায়ারকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হলো। কিন্তু নাইট খেতাব ত্যাগ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে নন্দিত করে যে প্রস্তাব পেশ হয়েছিল তা কংগ্রেসে তুলতেই দেওয়া হলো না। এটা ছিল কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনের আর একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। কংগ্রেস তখনো ব্রিটিশের দেওয়া খেতাবের নেশায় বিভোর ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ নন্দিত হলেন না।
কথা শুরুর আগে – দুই
আমার “কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা” নামক পুস্তকের বিভিন্ন জায়গায় আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র কথা অনেক বলেছি। এই পুস্তুকে সে সম্বন্ধে আবার কিছু বললে আগে বলা কথাগুলির পুনরাবৃত্তি যে হবে তাতে সন্দেহ নেই। তবুও “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি” সম্বন্ধে এখানে কিছু না বললেও নয়। কারণ, এ পুস্তক যাঁরা পড়বেন তাঁরা “কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা” নাও পড়ে থাকতে পারেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই সমিতির প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে বলেছেন :-
“আমরা কয়েকজন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভ্য ছিলাম। সেখানে হিন্দু মুসলমান কোন ভেদ না থাকলেও আমরা বড়লোকের ঘরে গরীব আত্মীয়ের মতন মন-মরা হয়ে তার সভায় যোগদান করতাম। আমাদের মনে হলো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে সম্বন্ধ বিলোপ না করেও আমাদের একটি নিজস্ব সাহিত্য-সমিতি থাকা উচিত। এই উদ্দেশ্যে কলকাতার ৯নং আন্তনিবাগান লেনে মৌলবী আবদুর রহমান খানের বাড়ীতে ১৯১১ সনের ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে এক সভা আহূত হয়।…আমি সর্বসম্মতিক্রমে সম্পাদক হই।”
(ডক্টর সুকুমার সে কৃত “বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস”, চতুর্থ খণ্ড, ২১৭ পৃষ্ঠা)
এইভাবে ১৯১১ সালে “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু ১৯১৩ সালে আমি যখন প্রথম কলকাতায় আসি তখন তার প্রাণের কোনো স্পন্দন ছিল না বললেও চলে। আমরা কয়েকজন সমিতিকে পুনর্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করি। এই প্রচেষ্টাতেও প্রথম প্রতিষ্ঠাতারা যেমন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেব, ভোলার মুহম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেব প্রভৃতি ছিলেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্ ও সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক সাহেব তখন কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। তিনি বিশেষভাবে সাহায্য করছিলেন। “দি মুসলমান” নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের সম্পাদক মুজীবুর রহমান সাহেব, সাপ্তাহিক “মোহাম্মদী”র সম্পাদক মৌলবী মুহম্মদ আকরম খান সাহেব (তখনও তিনি মওলানা নামে অভিহিত হননি) এবং আরও অনেকে সাহায্য করতেন। অনেকের নিকট হতে মাসিক অর্থ সাহায্য পাওয়া যেত। তাতেই সমিতির খরচ চলত। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলসমূহের ইনস্পেক্টর মৌলবী আবদুল করীম সাহেব (আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদ নন) ছিলেন সমিতির সভাপতি। তাঁরই জিদের বশে সমিতির ত্রৈমাসিক মুখপত্রের নাম “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা” করা হয়। আমরা বেশীরভাগ সভ্যরা শুধু “সাহিত্য পত্রিকা” নাম করতে চেয়েছিলেম। আবদুল করীম সাহেবের যুক্তি ছিল এই যে কাগজখানা হিন্দুরা কিনবেন না এবং পড়বেনও না। কাজেই, মুসলমান শব্দটি নামের সঙ্গে থাকা ভালো আমরা বহুমতের দ্বারা তাঁকে এমন চটাতে চাইনি যাতে তিনি পদত্যাগ করে বসতে পারেন। কিছু কিছু মুসলমানের মনে এরকম ধারণা বদ্ধমূল ছিল। মিস্টার এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ” বার বার করতে গিয়ে শুরুতে এইরকম একটি কথার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলেম। তবে, সেটা আমরা কাটিয়ে উঠেছিলেম।
সমিতির আফিস ছিল ছাত্রদের কোনো না কোনো মেসে। ৪৭/১, মির্জাপুর স্ট্রীটের নীচের তলায় একখানা কামরা ভাড়া নিয়ে আমরা সর্বপ্রথম সমিতির আফিস স্থাপন করি। ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের দোতলার সামনে দিককার অংশে আমরা এখান হতেই উঠে যাই। চট্টগ্রামের লুঙ্গি মার্চেন্ট সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী এই বাড়ী নেওয়ার সময়ে আমাদের পক্ষে জামিন হয়েছিলেন। আমীর হুসয়ন খান সাহেব একখানা লম্বা টেবিল কিনে দেওয়ায় এবং আরও কয়েকজন কয়েকটি আলমারী কিনে দেওয়ায় আমরা ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের বাড়ীতে এসে লাইব্রেরী ও রিডিং রুম স্থাপন করি। তখন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীট শুধু যে একটি সাহিত্যিক আড্ডায় পরিণত হয়ে উঠেছিল তা নয়, এটি একটি রাজনীতিক আড্ডাতেও পরিণত হয়েছিল। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ নম্বর বেঙ্গলী রেজিমেন্ট পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার পরে যখন হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র বাড়ীতে এসে উঠল তখন এখানকার সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আড্ডা আরও বেশী জমজমাট হয়ে উঠেছিল।
“বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির” নামটি সাম্প্রদায়িক হলেও আসলে তা সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানও তা ছিল না। আমি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সভ্য ছিলেম। হয়তো একবার তার কার্যনির্বাহক কমিটিরও সভ্য হয়েছিলেম। এখন ভালো মনে পড়ছে না। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মারফতে বাঙালিদের সামনে বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের সামনে মুসলিম সভ্যতার নানান দিক বাঙলা ভাষায় তুলে ধরা হবে, এটাই ছিল সমিতির একটা বিশেষ উদ্দেশ্য। মুসলমানদের নিকট হতে অনেক বাঙালি হিন্দু তাই চাইতেন। সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা মুসলিম সভ্যতা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতেন না। বাঙালি মুসলমানরাও যে খুব বেশী কিছু জানতেন তাও নয়। বাঙলার মুসলমান পরিবারগুলির বিশেষ রীতিনীতি ও চালচলন সম্বন্ধে প্রতিবেশী হিন্দুদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত ছিল। ডক্টর সার্ দেবপ্রসাদা সর্বাধিকারী একদিন আমার নিকটে একথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম লেখকরা এমন সব উপন্যাস রচনা করুন যে-সবের ভিতর দিয়ে মুসলমান পরিবারগুলির ছবি সকলের চোখের সামনে ফুটে উঠবে। কাজী ইমদাদুল হক “আবদুল্লাহ” নাম দিয়ে এমনই একখানা উপন্যাসের রচনায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তা শেষ করে যেতে পারেননি।
“বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা”য় হিন্দু লেখকদের লেখাও ছাপা হত। সাহিত্য সমিতির সভায় হিন্দু কবি ও লেখকরাও যোগ দিতেন। কবি শশাঙ্কমোহন সেন ও “হিতবাদী”র সম্পাদক যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (ডাক্তার হীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা) এবং আরো অনেকে সমিতির সভায় বক্তৃতা দিতেন। হিন্দু গ্রন্থকাররা সমিতির লাইব্রেরিতে তাঁদের বই দান করতেন। নীতি হিসাবে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখা বই কোনো লাইব্রেরিতে তিনিও তাঁর সমস্ত পুস্তক দান করেছিলেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর “সাহিত্য” নামক মাসিক পত্রিকায় “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা”য় প্রকাশিত লেখাগুলির সমালোচনা খুব আগ্রহ সহকারে করতেন।
আমি বাৎসরাধিক কাল নানান জায়গায় চাকরীও করেছিলেম। সবচেয়ে বেশীদিন কাজ করেছিলেম বাঙলা সরকারের ছাপাখানায়। ছাপাখানাটি তখন রাইটার্স বিল্ডিং এ ছিল। এখানে কাগজের গুদামে আমি কেরানীর কাজ করতাম। মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। বেঙ্গল গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন বেঙ্গলি ট্রানসেলেটারের আফিসেও মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে একমাস কাজ করেছিলেম। উর্দু হতে বাংলায় তরজমার কাজ। প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুলসমূহের ইনস্পেক্টরের আফিসেও কাজ করেছিলেম একমাস। এরপরে আমার চাকরীর জীবন শেষ হয়। কলেজে পড়ার সময়ে গরমের ছুটিতে একমাস খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছিলেম। আর এক গরমের ছুটিতে একমাস কাজ করেছিলেম কলকাতা কর্পোরেশনের ট্যাংরা স্লন্টার হাউসে। এখানে আমায় পশুবধ করতে হ’ত না। তবে পশুবধের টিকেট আমি ইসু করতাম।
১৯০৬ সাল হতে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আমি কোনো না কোনো লোকের বাড়ীতে থেকে গৃহশিক্ষকের কাজ করেছি। মাঝে মাঝে দু’চার মাস অবশ্য বাদ গিয়েছে। কলকাতার মুনশী আশলীমুদ্দীন স্ট্রীটের নামকরণ (এখন শুধু আশলীমুদ্দীন স্ট্রীট) যাঁর নামে হয়েছে চাঁদনীর ৩নং গুমঘর লেনে তাঁর বাড়ীতে এক সঙ্গে তিন বছর থেকেছি। মুনশী আশলীমুদ্দীন তখন জীবিত ছিলেন না। তাঁর দুই নাতি- পৌত্র) মুনশী ফখরুদ্দীন ও মুশী কমরুদ্দীন জীবিত ছিলেন। এ বাড়ীতে যে সদ্ব্যব্যবহার পেয়েছি তা কখনো ভুলবার নয়।
আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সহকারী সম্পাদক ছিলেম। “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা” আমাকেই বার করতে হ’ত। যদিও শহীদুল্লাহ্ সাহেব ও মুহম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেব পত্রিকার যুগ্মসম্পাদক ছিলেন তবুও কাগজের জন্যে খুব বেশী কাজ তাঁরা করতেন না। পত্রিকার লেখা সংগ্রহ, তা ছাপানো ও ডাকে দেওয়া ইত্যাদি সবই কাজ আমায় করতেন হ’ত। এই সময়ে একটি কাজের কথা আজও মনে পড়লে আমার বড় অনুতাপ হয়। কবি কায়কোবাদের “মহাশ্মশান কাব্যের” সমালোচনায় (আসলে অপ-সমালোচনায় দুটি প্রবন্ধ আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা”য় ছেপেছিলেম। আমি ইচ্ছা করলেই এই সমালোচনা বন্ধ করতে পারতাম। সমালোচক ছিলেন সৈয়দ এমদাদ আশলী। একসময়ে “নবনূর” নামক মাসিক পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন, পরে পুলিসে চাকরী গ্রহণ করেন। সমালোচনা যখন তিনি লিখেছিলেন তখন তিনি বেঙ্গল পুলিসের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ইনস্পেক্টর ছিলেন। তাঁর সঙ্গে জীবনে কোনো দিন আমার দেখা হয়নি। লোক মারফতে কিংবা ডাকে তিনি লেখা দুটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। লেখক হিসাবে তাঁর নাম ছিল বলে আমি তাঁর লেখা দুটি ছাপিয়ে দিই। পরে বুঝেছিলেম অন্যায় করেছি। সৈয়দ এমদাদ আশলী “মহাশ্মশান কাব্যে”র কাব্যগুণ সম্বন্ধে এতটুকুও আলোচনা করেননি। সমালোচকের তা করাই উচিত। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কোথায় এবং কিসে ইস্লাম ও মুসলিমের অবমাননা হলো।
“বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”কে গড়ে তোলার জন্যে আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। এখন আমাদের কমরেডরা কমিউনিস্ট পার্টির সব-সময়ের কর্মী হন। তাঁরা শুনে আজ আশ্চর্য হবেন যে ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হয়েছিলেম। পুরো ১৯১৯ সাল এবং ১৯২০ সালেরও মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত সমিতির সব-সময়ের কর্মী আমি ছিলেম। তারপরে “নবযুগ” কাগজ পরিচালনা করার সময়েও আমি সবসময়ের কর্মীর মতোই কাজ করেছি, যদিও কোনও রাজনীতিক পার্টির সভ্য আমি তখন ছিলেম না। ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমার যে সব-সময়ের কর্মীর জীবন আরম্ভ হয়েছিল সেই জীবন আমার আজও, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে এই কয় ছত্র লেখার সময়েও, চলেছে।
আমার জীবনের পেশা কি হবে,-সাহিত্য, না, রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে, আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল। কবি আমি ছিলেম না। গল্প লেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনোদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনো দিন আমার আয়ত্তে ছিল না। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও, অর্থাৎ রাজনীতিক জীবনে তা হওয়ার পথে কোনো প্ৰতিবন্ধক ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবুও আমি প্রবন্ধকারও হতে পারিনি, যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি।
আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির। একটা কিছুতে নিজেকে যে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলেম। সেইজন্যই তো আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হতে পেরেছিলেম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতিই হবে আমার জীবনের পেশা। আমি রাজনীতিক সভা- সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলেম তো ১৯১৬ সাল হতে।