কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে আমাদের প্রোগ্রাম পেশ
বাহাদুর চার্লস আশলী
১৯২২ সালের ৫ই নভেম্বর হতে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষার্ধে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট চার্লস্ আশলী (Charles Arshliegh) এম. এন. রায়ের নিকট হতে বার্তা ও প্রতিনিধিদের রাহা খরচের টাকা নিয়ে (মসউদ আলী শাহের মতে আটশ’ পাউন্ড) বোম্বেতে পৌঁছেই বিপদে পড়ে যান। তিনি যে আসছেন এ খবর আগেই ভারত গবর্নমেন্ট পেয়ে যান। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস হতে (সেক্রেটারি অফ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়ার অফিস হতে) ভারত গবর্নমেন্টের নামে নির্দেশ আসে যে আশলীর জাহাজ বোম্বে পঁহুছা মাত্রই তাঁর পাসপোর্ট হতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভ্রমনের ভিসা (Visa) যেন বাতিল করে দেওয়া হয়। তাই করা হয়েছিল। চার-পাঁচ দিনের আগে আশলীর ইউরোপে যাওয়ার কোনো জাহাজ ছিল না। এই সময়টা কড়া পুলিস পাহারার ভিতরে তাঁকে বোম্বের হোটেলে থাকতে দিতে বোম্বে পুলিস বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বাহাদুর বিপ্লবী ছিলেন চার্লস আশলী। ভারতের অন্য কোথাও না যেতে পারলেও বোম্বে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি এস. এ. ডাঙ্গের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন। তাঁকে তিনি কাগজপত্র, মৌখিক উপদেশ এবং প্রতিনিধিদের রাহা খরচের টাকা (ব্রিটিশ পাউন্ড নোট) দিয়ে গিয়েছিলেন। বোম্বেতে যা যা ঘটেছিল এই সবই চার্লস্ আশলী বার্লিনে পৌছে এভেলিন রায়ের নিকটে রিপোর্ট করেছিলেন। রায় তখন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসের উদ্যোগ- আয়োজন করার জন্যে মস্কো গিয়েছিলেন। এভেলিন সঙ্গে সঙ্গেই আশলীর সবিশেষ রিপোর্ট রায়কে মস্কোয় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আশলী সংক্রান্ত দুর্ঘটনার রিপোর্ট পাওয়ার পরে ২রা নভেম্বর (১৯২২) তারিখে রায় মস্কো হতে ডাঙ্গেকে একখানি পত্র লেখেন। এই পত্র হতে কিছু কিছু অংশ আমি এখানে তুলে দেব:
Moscow
November 2 [1922]
My dear Comrade Dange,
Our friend, who saw you at Bombay, has come back in time, and has related the whole affair. It is unfortunate that he met such a disaster. We counted much upon the success of his mission. But we believe he did the best that could be done under the circumstances, that is to transfer his charge to the best person availabele. And we look upon you as the most suitable for the purpose and trust that you have seen that some result is archieved. It is needless to say that presence of some delegates form India will lead to future selfare of our movement.
বঙ্গানুবাদ
মস্কো
নভেম্বর ২ [১৯২২]
প্রিয় কমরেড ডাঙ্গে,
আমাদের যে বন্ধু বোম্বেতে আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি যথাসময়ে ফিরে এসেছেন এবং সব কথা আমাদের জানিয়েছেন। এটা খুবই বেদনাদায়ক ব্যাপার যে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। যে কাজের ভার তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তার সফলতা প্রাপ্তির ওপরে আমাদের অনেক কিছু নির্ভর করছিল। কিন্তু একা আমরা বিশ্বাস করি, যে দুরবস্থার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন সে অবস্থায় সর্বোত্তম ব্যবস্থা যা করা যেত তা তিনি করেছেন, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির হাতে কাজের ভার তিনি ন্যস্ত করেছেন। এবং এই কাজের জন্য আমরা আপনাকেই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক মনে করি। আমরা বিশ্বাস করি, আপনি বুঝেছেন যে এই থেকে কিছু ফলোদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটা বলা বাহুল্য যে ভারতবর্ষ হতে কিছু সংখ্যক প্রতিনিধির আগমন খুবই সুস্বাগত হবে এবং তা আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পক্ষে মঙ্গলপ্রসূও হবে।..
তারপরে রায় এই পত্রে বলেছেন, ভারতে যে কমিউনিস্ট পার্টি অঙ্কুরিত হচ্ছে তার উচিত বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে (“for the revolutionary nationalist struggle”) একটি জনগণের পার্টির স্থাপনায় একান্তভাবে পরিশ্রম করা। তাতে রায় কয়েকটি পয়েন্টও দিয়েছেন। প্রথম পয়েন্টটি হচ্ছে :
“1. All the Left Wing nationalist elements are organised in orde to present a solid opposition at Gaya to those who went to the congress as a political organ.”
(১। যাঁরা কংগ্রেসকে রাজনীতিক সংগঠন হিসাবে ব্যবহার করার জন্যে গয়া যাবেন তাঁদের একযোগে বিরোধিতা করার জন্যে সমস্ত বাম মতাবলম্বী জাতীয়তাবদীদের সংগঠিত করে তুলতে হবে। )
তারপরে, জনগণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার প্রোগ্রামের কথা রায় বলেছেন। এই প্রোগ্রাম এমন হবে যার দ্বারা কংগ্রেসের ভিতরকার অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা, অর্থাৎ যাঁরা জাতীয়বাদী বিপ্লবী তাঁরা আমাদের দিকে আকৃষ্ট হবেন। কংগ্রেসকে যে আধ্যাত্মিকতার দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে তা থেকেও কংগ্রেস বেঁচে যাবে।
রায় বলেছেন :
(5. I will write this proposed programme along with lines repeatedly indicated in our Paper during the last half a year.)
(৫। এই প্রস্তাবিত প্রোগ্রাম আমিই রচনা করব এবং গত ছয় মাস আমাদের কাজের যে ধারার কথা আমরা বারে বারে আমাদের কাগজে ব্যক্ত করেছি সেই ধারাকে ভিত্তি করেই রচনা করব।)
কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের সামনে পেশ করার জন্যে মস্কোতেই এম. এন. রায় তাঁর এই প্রোগ্রামটি রচনা করেছিলেন। তাতে সুবিধা হয়েছিল এই যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কর্তৃপক্ষের দ্বারা তিনি তার অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তাছাড়া, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে ক’জন সভ্য মস্কোতে ছিলেন তাঁদেরও তিনি প্রোগ্রামের মুসাবিদা দেখিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এই প্রোগ্রামই ভারতের জন-সমক্ষে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় ইশতিহার। প্রথম ইতিহার আমদাবাদ কংগ্রেস (১৯২১) বিতরিত হয়েছিল।
মস্কো হতে বার্লিনে ফিরে এসে এম. এন. রায় তাঁর প্রোগ্রামটির প্রচারে মনোনিবেশ করলেন। ভারতের পুলিস আগে হতেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন যে এই রকম একটি প্রোগ্রাম আসবে। ২রা নভেম্বর (১৯২২) তারিখে ডাঙ্গেকে লেখা রায়ের পত্রে প্রোগ্রামের উল্লেখ ছিল। আরও অনেককে হয়তো রায় একথা জানিয়ে থাকবেন। পুলিস আটঘাট বেঁধে তৈয়ার হয়েছিলেন যে এই প্রোগ্রামের ভারতে প্রচার তাঁরা বন্ধ করবেনই। প্রায় তাঁরা সফলও হয়েছিলেন। সি. আর. দাশ হতে আরম্ভ করে অন্য বহু লোকের ডাক অনুসন্ধান করে তাঁরা প্রোগ্রামটি আটকিয়েছিলেন। কিন্তু অন্য দিক হতে তাঁরা মার খেয়ে গেলেন, যে কথা হয়তো তাঁরা আগে ভাবতেও পারেননি। বিশ্বদূত রয়টার এই প্রোগ্রামটি লন্ডন হতে ভারতে প্রচার করে দিলেন।
প্রোগ্রামটিকে বিশ্লেষণ করে এম. এন. রায় একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের কাগজ “এডভান্স গার্ডে” পুরো প্রোগ্রামটি সম্বন্ধে একটি বিবৃতি ছাপেন। শিরোনাম ও উপ-শিরোনাম রয়টারের, না, “অমৃতবাজার পত্রিকা”র তা জানিনে। তবে, আগেকার কালে সাধারণত পত্রিকাওয়ালারাই এ শিরোনামগুলি দিতেন।
ভারতে বলশেভিক লক্ষ্যসমূহ
স্বতন্ত্র হওয়ার অভিসন্ধি-খোলাখুলি বিপ্লব ঘটানোর দাবী-
বিস্ময়কর প্রোগ্রাম, লন্ডন, ডিসেম্বর ২০
ভারতীয় কমিউনিস্ট রায়, ওর্কে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, এখন বার্লিনের বাসিন্দা, রাশয়ান সোবিয়েতের অনুমোদনক্রমে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নিকটে পেশ করার জন্য যে প্রোগ্রাম তিনি রচনা করেছেন তার সবিশেষ বিবরণ জুরিখ হতে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে।
সংগঠিত বিপ্লবের ভিতর দিয়ে এই প্রোগ্রাম ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হতে বার করে নিতে চায়। সবকিছুর ওপরে এই প্রোগ্রাম স্থাপন করতে চায় একটি ন্যাশনাল এসেম্বলী প্রোগ্রাম জমীদারী প্রথাকে উচ্ছেদ করতে চায়, জমীদারী ইস্টেটগুলিকে বাজেয়াফ করে নিতে চায়, রেলওয়ে, ট্রাম প্রভৃতি সাধারণের ব্যবহারের যন্ত্রগুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে চায়, সর্বনিম্ন মজুরী ধার্য করতে চায়, আটঘণ্টা কাজের দিন করতে চায়, আর চায় মজুরদের কাউন্সিল গঠন করে মজুরদের অধিকার রক্ষা করতে।
লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে দেশময় কৃষক সমিতিসমূহ (ইউনিয়নস) গঠন করতে হবে, “ট্যাক্স বন্ধ করার দাবী মুখরিত” জনগণের মিছিলসমূহ বার করতে হবে, উচ্চ মূল্যের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ সৃষ্টি করার জন্যে ধর্মঘটসমূহকে সমর্থন জানাতে হবে ও ধর্মঘটসমূহ সংগঠন করতে হবে। তাছাড়া দেশময় জাতীয় ভলানটিয়ার বাহিনীসমূহ গঠন করতে হবে। আর, আইনসভাগুলিতে প্রবেশ করতে হবে সেগুলিকে ভাঙার জন্যে।
[অমৃতবাজার পত্রিকা, ২২ শে ডিসেম্বর (১৯২২) হতে উদ্ধৃত] -(কপি রাইট)
১৯২২ সালের ২১শে ডিসেম্বর তারিখে রয়টার লন্ডন হতে এম. এন. রায়ের (রায়ের প্রোগ্রাম নামে তা প্রচারিত হয়েছিল) প্রায় পুরো প্রোগ্রামটি ভারতে পাঠালেন। তার সঙ্গে রায়ের অতি সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয়ও দিয়েছিলেন। তাতে বলেছেন রায়ের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বাঙলা দেশে তিনি রাজনীতিক ডাকাত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাবায় জার্মানীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। ১৯১৭ সালে তিনি কালিফোর্নিয়া আশ্রয়-গ্রহণকারী ছিলেন। তারপরে মেকশিকোতে তিনি ছিলেন বলশেভিকদের প্রচারক। ১৯২০ সালে হতে তিনি বার্লিন, মস্কো ও তাশকন্দের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জীবিকার জন্যে তিনি তাঁর রাশিয়ার কমিউনিস্ট মনিবদের জন্যে সাহিত্য কর্মে ও রাজনীতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। “এডভান্স গার্ড” নামক কাগজও তিনি চালিয়ে থাকেন। ভারতে এই কাগজের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
১৯২২ সালের ডিসেম্বর তারিখে লন্ডন হতে রয়টার প্রেরিত এই প্রোগ্রাম সারা ভারতের দৈনিক পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত হয়, কেউ ছেপেছিলেন বেশী কেউ কম। কলকাতায় “অমৃতবাজার পত্রিকা” প্রোগ্রামটির বেশীর ভাগ ছেপেছিলে বললেও চলে। শুধু শেষ দিককার একটি ছোট অংশ তাঁরা ছাপেননি। আমি শুনেছি নিজের চোখে কখনও দেখিনি, বোম্বের “দি টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া” নামক ইংরেজি দৈনিক প্রোগ্রামটির খুব বেশী অংশ ছেপেছিলেন।
কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ রায়ের “শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি” (best person available) এস. এ. ডাঙ্গে একটা কাণ্ড করে বসল। ২২ শে ডিসেম্বর (১৯২২) তারিখে সমস্ত ভারতের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা আমাদের প্রোগ্রামের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করলেন, হয়তো বিরুদ্ধে মন্তব্যও লিখলেন। লিখবেনই তো তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এস. এ. ডাঙ্গেও তার “সোশ্যালিস্ট” নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের ২৩ শে ডিসেম্বর (১৯২২) সংখ্যায় প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখে বসল, আর তার শিরোনাম দিল “রয়টার বলশেভিকবাদ প্রচার করছে” (Reuter Spreading Bolshevism’)। ১৯২২ সালের কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন প্রদেশের মেম্বরদের কেউ কাউকে চিনতেন না, শুধু একে অন্যের নাম জানতেন। তা সত্ত্বেও আমি ডাঙ্গেকে একখানা পত্র লিখলাম। তাতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই মন্তব্য সে কেন লিখল, আর ওই রকম শিরোনামই বা সে কেন দিল? ডাঙ্গে একখানা পোস্ট কার্ডে আমার পত্রের উত্তর দিল,-লিখল আমার পত্র পেয়ে সে অতি আনন্দিত (“overjoyed”)। সে আশা করেছিল এই রকম শত শত পত্ৰ আসবে। [৩৫]
[35. ডাঙ্গেদের মারাঠী ভাষায় আমাদের বাঙলার মতো “আপনি” শব্দ নেই। পরে যখন আমরা হিন্দুস্তানীতে পরস্পর কথা বলছি তখন “তুম” শব্দ ব্যবহার করেছি। (লেখক)]
যাই হোক, নীচে আমি গয়া কংগ্রেসের নামে প্রচারিত পুরো প্রোগ্রামের বাঙলা অনুবাদ দিলাম :
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্যে একটি প্রোগ্রাম
আমাদের আন্দোলন এমন এক স্তরে এখন এসে পৌঁছেছে যখন জাতীয় মুক্তির এবং তৎসংক্রান্ত কার্যকলাপের একটি সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করার ব্যাপারকে আর ফেলে রাখা যায় না।
যাঁরা মাঝ পথে এসে থেমে থাকতে চান না, কিংবা উদারনৈতিকদের (Liberals) দ্বারা প্রচারিত তথাকথিত আপসপন্থী “বিবর্তনবাদী” পদ্ধতিতে অবিশ্বাসী, তাঁদের অবস্থা বিবৃত করার জন্যে জাতীয় মুক্তির একটি প্রোগ্রাম এখনই তৈয়ার করা আবশ্যক। স্বরাজ নামক অস্পষ্ট কথাটির নানান রকম ব্যাখ্যা করা যায়, বস্তুত আমাদের আন্দোলনে যে নানান পথের ও নানা স্বার্থের লোকেরা যোগ দিয়েছেন তাঁরা নিজ নিজ মতলব অনুযায়ী তা করেছেন। এত অনিশ্চিত উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারে না। পক্ষান্তরে, এইভাবে চালালে আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। কংগ্রেসের পতাকাতলে যথাসম্ভব বিপ্লবী শক্তিসমূহকে সমবেত করার জন্যে একটি সংগ্রামশীল কাজের প্রোগ্রাম তাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের জাতি এক ধরনের লোকের সমবায়ে গঠিত একটি জনসমষ্টি নয়। তা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। এ সকল শ্রেণীর স্বার্থ বিভিন্ন এবং প্রায় একের স্বার্থের সহিত অপরের স্বার্থের সংঘাত বাধে। এই সামাজিক শ্রেণীরা তাঁদের আপন আপন শ্রেণী স্বার্থের জন্যে লড়াই করেন। তাঁরা কিন্তু বিশ্বাস করেন যে জাতীয় মুক্তি সাধিত হলে তাঁদের কোনো নালিশ আর থাকবে না। এই কারণে ন্যাশনাল কংগ্রেস একটি সংহত রাজনৈতিক দল (পার্টি) নয়। এটা আগে হতে চলে আসা জাতীয় সংগ্রামের একটি সংগঠন মাত্র। অতএব ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রোগ্রাম কোনো একটি শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের প্রোগ্রাম হতে পারে না। ন্যাশনাল কংগ্রেস বিদেশী শাসক শ্রেণীর দ্বারা নির্যাতিত শক্তিসমূহের একটি সমবায় মাত্র। তার প্রোগ্রামকেও বিভিন্ন শ্রেণীর যুক্ত প্রোগ্রাম হতে হবে।
প্রথমেই আমাদের স্থির করতে হবে যে জাতির বেশীর ভাগ মানুষের সুখসুবিধার জন্যে আমরা কোন্ ধরনের জাতীয় স্বায়ত্তশাসন চাই; তারপরে এমন সংগ্রামের পদ্ধতি স্থির করতে হবে যার দ্বারা জাতীয় স্বায়ত্তশাসন করায়ত্ত হবে।
জাতীয় মুক্তির প্রোগ্রাম
একথা সকলেই জানেন যে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসন ভারতের জনসাধারণকে অর্থনীতিক ধ্বংসের পথে টেনে এনেছে, তাঁদের শিল্প-প্রসারের গতি করেছে রুদ্ধ, তাঁদের নামিয়ে এনেছে সামাজিক অধঃপতনের মুখে, আর তাঁদের মানসিক বিকাশের পথেও এই শাসন সৃষ্টি করেছে বাধা। ভারতের মানুষদের উপরে ব্রিটিশ শাসকদের বেদনাকর অপরিসীম শোষণ ও নিষ্ঠুর নির্যাতন ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে কলঙ্কিত করেছে। এই দাসত্ব হতে ভারতের মানুষদের মুক্ত করার প্রয়োজনই হচ্ছে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য। যতদিন রাজনীতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচালনা বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে থাকবে ততদিন জনগণের জন্যে কোনো অর্থনীতিক ও সামাজিক উন্নতি সম্ভব হবে না। এই কারণে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা জতীয় গবর্নমেন্টের পরিচালনা গ্রহণ। লিবারেল লীগের দলত্যাগী দেশপ্রেমিকদের ভাবনা অনুযায়ী এটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধোন্মাদদের অনুমোদনে ও পরহিতৈষণামূলক সংরক্ষণের ভিতরে লাভ হতে পারে না। কেননা, কোনো রকমের স্বায়ত্তশাসন বা হোম রুল বা স্বরাজ্য ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী নেতৃত্বে লাভ করার মানে কিছুই লাভ করা নয়। এই পথে অগ্রসর হওয়ার মানেই হবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা। এই সবই হবে ছদ্মাবরণ মাত্র। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতা হিসাবে সাহসের সহিত কংগ্রেসের এইরূপ পন্থা গ্রহণের বিরোধিতা অবশ্যই করা উচিত। কোনো রকমের ভুল ভ্রান্তির আশ্রয় না নিয়ে কংগ্রেসকে তার লক্ষ্য ঘোষণা করতে হবে। এই লক্ষ্য হবে পরিপূর্ণরূপে স্বাধীন জাতীয় গবর্নমেন্ট। তার ভিত্তি হবে বয়স্ক ব্যক্তি মাত্রেরই ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক নীতি।
সমান অংশীদার হওয়ার তত্ত্ব একটি কল্পনাবিলাস মাত্ৰ
“ব্রিটিশ সাধারণতন্ত্রের (Commonwealth) ভিতরে সমান মালিকানা”র তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদের সোনার পাথর বাটি (glided version) ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরই শুধু এর ভিতরে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারেন। কারণ, এর পেছনের মতলব হচ্ছে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশীয় জমীদার ও ধনিকদের শোষণ ব্যবস্থায় ব্রিটিশের জুনিয়ার অংশীদার করে নেওয়া। এই জাতীয় সুবিধা (concession) পেলে উচ্চ শ্রেণীসমাজের লোকেরা সীমাবদ্ধভাবে উপকৃত হবেন সন্দেহ নেই, কিন্তু জনসাধারণের বিশাল অংশের রাজনীতিক ও অর্থনীতিক দাসত্ব থেকেই যাবে। “শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক” পন্থাবলম্বনের যাঁরা প্রচারক তাঁর আসলে ভারতীয় জাতিকে ব্রিটিশের চিরদাসত্বে রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী। আমাদের “সুসভ্য” করে তোলার জন্যে ব্রিটিশ যে আমাদের দেশ জয় করেনি একথা বুঝিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দয়ালু ব্রিটিশ শাসনের পরিচালনায় থেকেই আমরা পরিপূর্ণ রাজনীতিক স্বাতন্ত্রলাভ করব এটা বিশ্বাস করা মনে একটা ভ্রান্তি পোষণ করা মাত্র। যাঁরা ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের সহিত সহযোগিতায় বিশ্বাসী তাঁরা নিরেট মাথাওয়ালা ব্যবসায়ী, যে কোনো ভ্রান্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন। যদি তাঁরা “শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক” পথের কথা প্রচার করেন তবে বুঝতে হবে যে রাজনীতিক পরিচালনায় হঠাৎ একটা বিরাট পরিবর্তন আসার চেয়ে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায় তাঁদের শ্রেণীর স্বার্থের পক্ষে অধিকতর উপযোগী।
আমাদের জমীদার ও ধনিক শ্রেণী
জমীদারেরা তাঁদের জমীদারীর নিরাপত্তা চাইবেন, আর চাইবেন তাঁদের সেই অধিকারের সংরক্ষণ যার দ্বারা তাঁরা অত্যধিক করের ও আরও বহু রকম আবওয়াবের চাপে কৃষককুলের রক্ত শোষণ করতে পারবেন। যে গবর্নমেন্ট তাঁদের এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন তারই বিশ্বস্ত সমর্থক হবেন তাঁরা। শাসকদের জাতীয়ত্ব কি তাতে তাঁদের কিছুই এসে যায় না। ধনী উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা তাঁদের শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রের বিস্তার চান। যে গবর্নমেন্ট এ ব্যাপারে তাঁদের বিস্তারের সুযোগ-সুবিধা দিবেন সেই গবর্নমেন্ট তাঁদের সমর্থন ও সহযোগিতা পাবেন। ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট যদি আমাদের দেশের শিল্প বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিবন্ধক সৃষ্টির পুরানো নীতি এখনও বজায় রাখতে চান তবে আমাদের ধনিক শ্রেণীরা তাঁদের বিরুদ্ধে গিয়ে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে যোগ দিবেন। কিন্তু শোষণের সুবিধার জন্যে আর বিশ্বযুদ্ধে যে সাংঘাতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে তাতে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে কিছু পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে জনগণের ভিতর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষে ব্রিটিশ শাসকদের এমন কিছু শক্তিশালী ভারতীয়দের সঙ্গে সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হতে বাধ্য করেছে যাঁরা শাসন ও শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখাকে ফলদায়ক ও লাভজনক মনে করেন। এই রকম সাহায্য করার জন্যে এই ভারতীয়দের ব্রিটিশ কিছু অর্থনীতিক ও রাজনীতিক সুযোগ-সুবিধা দেবে। এইভাবে জমীদার ও ধনিক শ্রেণীরা মনে করেন যে সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর ভিতরেই তাঁদের আশা-আকাঙক্ষা পূর্ণ হওয়া সম্ভব। তাঁরা মনে করেন
ব্রিটিশ শাসনের অধীনেরই তাঁদের সম্পত্তির অধিকার রক্ষিত হবে এবং তাঁদের অর্থনীতিক উন্নতির পথ খুলে যাবে। জমীদার ও ধনিক শ্রেণীদের ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের অর্থনীতিকে স্বার্থের খাতিরে তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থাই চান যে-শান্তিপূর্ণ অবস্থা সাম্রাজ্যবাদী দমননীতির দ্বারা স্থাপিত হয়েছে। জমীদার ও ধনিকেরা দেশের রাজনীতিক অবস্থাতে হঠাৎ পরিবর্তন আসাকে ভয়ের চোখে দেখেন। কারণ, সম্পত্তি, ব্যবসায় ও শিল্পের নিরাপত্তার জন্যে যে “শান্তিশৃঙ্খলা” অপরিহার্য দেশের হঠাৎ রাজনীতিক পরিবর্তন তাতে বিঘ্ন ঘটাবে। জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের ভয়কে বাদ দিয়ে জাতীয় মুক্তির সঠিক প্রোগ্রাম কার্যে পরিণত করা সম্ভব নয়। আর, জনগণ একবার রাজনীতিক ক্ষমতা দখল করলে তা দেশের উচ্চশ্রেণীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাঁরা আবার তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বের অবস্থায় ফিরে যেতে রাজী নাও হতে পারেন। এই সকল অস্বাগত সম্ভাবনাসমূহকে এড়াবার জন্যে জমীদার ও ধনিক শ্রেণীরা শান্তিপূর্ণ ও ধীর-লভ্য উন্নতি লাভেরই পক্ষপাতী। নিজেদের ওপরে কোনো বিপদ ডেকে না এনে যতটা পাওয়া সম্ভব ততটা পাওয়াকেই তাঁরা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন।
এই সতর্কতা ও আপস-নিষ্পত্তির নীতিতে ভারতীয় জনসাধারণের স্বার্থের কোনো স্থান নেই। সমাজের উচ্চস্তরের অল্প সংখ্যক লোকদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার দিকে নজর রেখেই এটা পরিকল্পিত হয়েছে। এই কারণ এটা বলা বাহুল্য ন্যাশনাল কংগ্রেসকে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে যে লিবারেল লীগের প্রোগ্রাম কিংবা মূলত ওই রকমের অন্য কোনো প্রোগ্রাম সমস্ত ভারতীয় জাতিকে মুক্তির ধারে কাছেও নিয়ে যাবে না। কারণ, “কমনওয়েলথের ভিতরে সমানাংশে”র “মালিক হওয়া”, কিংবা “ডোমিনিয়ন স্বায়ত্তশাসন” লাভ করা, কিংবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে “স্বশাসন” লাভ করা-এই সব কিছুতেই ভারতের জনসাধারণ ব্রিটিশ শাসনাধীনই থাকবেন, তবে এই শাসন ভারতের ধনিক শ্রেণীর সাহায্যে ও মৌন সম্মতিতে চালিত হবে।
অপরিবর্তিত হৃদয়
ব্রিটিশ শাসকেরা “হৃদয়ের পরিবর্তন করবেন” এই মত যাঁরা প্রচার করেন তাঁরা সেই সকল লোকের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ভুলে যান যাঁরা মাঝ পথে মিটমাট করে নিতে চান। এই মতাবলম্বীদের পক্ষে সম্ভাবনা আছে যে তাঁরা ভারতীয় জনসাধারণের স্বার্থকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে নিবেন। ফলে এই দাঁড়ায় যে “হৃদয় পরিবর্তনের” মতটি একটি বিপজ্জনক মত এবং কংগ্রেসকে অতি অবশ্য এই মতের হাত হতে মুক্ত হতে হবে। কংগ্রেসের ভিতরের এই দোমনা ভাব, তার উদ্দেশ্যের অনিশ্চয়তা, গত এক বছর তার কার্যক্রমকে দোদুল্যমানতা ও দুর্বলতার পথে টেনে এনেছে। ভারতীয় জনসাধারণের স্বাধীনতা লাভের জন্যে দৃঢ়পণ সংগ্রাম আবশ্যক। একটি সুপরিকল্পিত প্রোগ্রাম সামনে তুলে ধরার ওপরেই সংগ্রামের সাফল্য নির্ভর করবে। এই রকম প্রোগ্রামই শুধু জনগণকে জাতীয় সংগ্রামের মধ্য টেনে আনবে-এই রকম প্রোগ্রাম যা জনজীবনের মূল সমস্যাগুলিকে বিবেচনা করেছে। এই কারণে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নিম্নলিখিত প্রোগ্রাম ঘোষণা করছে :
জাতীয় মুক্তিসাধন ও পুনর্গঠনের প্রস্তাব
(১) পরিপূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা যা সর্বপ্রকারের সাম্রাজ্যবাদী সংস্রব হতে বিচ্ছিন্ন হবে এবং যা সর্বপ্রকার বৈদেশিক তত্ত্বাবধান হতে মুক্ত হবে।
(২) বয়স্ক ব্যক্তি মাত্রেই ভোটের দ্বারা একটি ন্যাশনাল এসেম্বলী নির্বাচিত হবে। জনগণের প্রভুত্ব (Sovereignty) ন্যস্ত হবে এ ন্যাশনাল এসেমলীই হবে সর্বোচ্চ অধিকার (Supreme authority)।
(৩) ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতন্ত্র (Federated Republic of India) স্থাপন।
মুক্ত জাতির অর্থনীতিক ও সামাজিক জীবন যে নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে তা হচ্ছে :
সামাজিক ও অর্থনীতিক প্রোগ্রাম
(১) জমীদারী প্রথার বিলোপ সাধন। কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই বড় বড় জমীদারী ইস্টেটগুলির বাজেয়াফৎকরণ। জমীর শেষ মালিকানা জাতীয় রাষ্ট্রের (National State) হাতে ন্যস্ত হবে। যাঁরা সত্য সত্য চাষ করেন তাঁদেরই শুধু জমী রাখতে দেওয়া হবে। জমী নিয়ে যাঁরা অন্যের নিকট হতে ট্যাক্স আদায় (Tax-farming) করবেন তাঁদের জমী দেওয়া হবে না।
(২) চাষীর আর্থিক অবস্থা উন্নত করার উদ্দেশ্যে জমীর খাজনার হার নিম্নতম ধার্য করা হবে। টাকা ধার দিয়ে কৃষককে সুদখোর মহাজনের ও ফটকাবাজ ব্যবসায়ীর মুঠো হতে মুক্ত করার জন্যে রাষ্ট্রীয় কৃষি কো-অপারেটিব ব্যাঙ্ক স্থাপিত হবে।
(৩) হাল আমলের কৃষি ব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্যে কৃষককে রাষ্ট্র হতে সাহায্য দেওয়া হবে। রাষ্ট্রীয় কো-আপারেটিবের মধ্যবর্তিতায় চাষ করার মেশিন কৃষকের নিকটে বিক্রয় করা হবে বা তাঁকে ধার দেওয়া হবে।
(৪) সকল রকম পরোক্ষ ট্যাক্স বাতিল ক’রে দেওয়া হবে এবং তার স্থলে ৫০০ টাকা আয় হতে শুরু ক’রে ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর ধার্য হবে।
(৫) জনসাধারণের নিত্য ব্যবহারের যন্ত্রগুলি (Public Utilities), খনিসমূহ, রেলপথগুলি, তারবার্তা পাঠাবার ব্যবস্থাগুলি (Telegraphs) এবং দেশের ভিতরকার জলপথগুলি,—এসবেরই মালিক হবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রই এসব বিভিন্ন কার্যকরী কমিটির মারফতে পরিচালনা করবে,-মুনাফা করার জন্য নয়, জাতির ব্যবহার ও উপকারের জন্যে।
(৬) রাষ্ট্রের সাহায্যে ও তত্ত্বাবধানে আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা হবে।
(৭) আইন প্রণয়ন ক’রে কল-কারখানার মজুরদের সর্বনিম্ন মজুরী ধার্য করা হবে।
(৮) বয়স্ক পুরুষ মজুরদের জন্যে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা কাজের দিন ও সাড়ে পাঁচ দিনের সপ্তাহ আইন ক’রে নির্ধারিত করতে হবে। নারী মজুরদের জন্যে এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক মজুরদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।
(৯) কারখানার মালিকেরা মজুরদের বাসস্থান, কাজের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রভৃতি ও অন্যান্য সুখ-সুবিধার একটা বিশেষ মান বজায় রাখতে আইনের দ্বারা বাধ্য থাকবেন।
(১০) মজুরদের বৃদ্ধ বয়সে জীবনধারণের সুব্যবস্থাকারী আইন প্ৰণয়ন করতে হবে। অসুস্থতা ও বেকারীর ইন্সিউরেন্স সম্বন্ধে প্রত্যেক শিল্পে আইন পাস করিয়ে নিতে হবে।
(১১) মজুর সংগঠনগুলিকে আইনের মর্যাদা দিতে হবে এবং মজুরদারদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে তাঁদের ধর্মঘট করার অধিকারকে মেনে নিতে হবে।
(১২) প্রত্যেক বড় কারখানার মজুরদের অধিকার রক্ষা করার জন্যে তাঁদের দ্বারা কাউন্সিল গঠিত হবে। কাউন্সিলগুলি তাঁদের কার্য পরিচালনায় রাষ্ট্রের সমর্থন পাবে।
(১৩) বড় বড় শিল্পে মজুরদের সঙ্গে, মুনাফার ভাগ বন্টনের রেওয়াজ চালু করতে হবে।
(১৪) অবৈতনিক ও আবশ্যিক শিক্ষা। বালক ও বালিকা উভয়ের জন্যেই শিক্ষা প্রাইমারী শিক্ষাস্তরে অবৈতনিক ও আবশ্যিক হবে। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে অবৈতনিক। টেনিকাল ও ব্যবসায়িক স্কুলসমূহ সরকারী সাহায্যে স্থাপিত হবে।
(১৫) সমস্ত ধর্মমত হতে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তবে আপন আপন বিশ্বাস মেনে চলার ও প্রত্যেকের পূজা-প্রার্থনা করার স্বাধীনতাকে গ্যারান্টি দেওয়া হবে।
(১৬) নারীরা পূর্ণ সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনীতিক অধিকার ভোগ করবেন।
(১৭) কোনো স্থায়ী সৈন্যদল (standing army) রাখা হবে না, কিন্তু জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দেশের মানুষকে অস্ত্রসজ্জিত করা হবে। একটি জাতীয় মিলিসিয়া (militia) অর্থাৎ, যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত নাগরিক বাহিনী গঠন করা হবে। একটা বিশিষ্ট সময় প্রত্যেক নাগরিককেই সামরিক শিক্ষা নিতে বাধ্য করা হবে।
কি করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে?
ভারতবর্ষের খুব বেশীর ভাগ লোকের উদ্দেশ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা যদি পূর্ণ হয় তবে জাতীয় স্বাধীনতা হতে উদ্ভুত উন্নতি ও সমৃদ্ধি সকল শ্রেণীর ধরা-ছোঁয়ার ভিতর এসে যাবে। এখন আমাদের সম্মুখের লক্ষ্য খুবই পরিষ্কার। প্রত্যেকেই জানেন তিনি কিসের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে-কোনো অর্থে ব্যাঘাত হতে পারে, স্বরাজ এখন আর সেই রকম অনিশ্চিত বিমূর্তন (abstraction) নয়, কিংবা এটা একটা “মানসিক অবস্থাও” নয়। স্বরাজ মানে জাতীয় স্বাধীনতা, এটা এখনও আমাদের প্রোগ্রামের সংক্ষিপ্তসার, তা থেকে জাতীয় জীবনের একটি পরিষ্কার ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যে জীবনে মুক্তির সুস্থ আবহাওয়ায় আমরা শ্বাস গ্রহণ করতে পারব। [৩৬]
[36. প্রোগ্রামের এতটা পর্যন্ত ২২শে ডিসেম্বর (১৯২২) তারিখের “অমৃতবাজার পত্রিকা”য় ছাপা হয়েছিল। এর পরের অংশটা খুব সম্ভব রয়টার টেলিগ্রাফ করেননি। কিংবা “অমৃতবাজার পত্রিকা”ই কি এই অংশটা বাদ দিয়েছিলেন? আমার মনে হয় রয়টারই ওই অংশটা টেলিগ্রাফ করেননি। ওটা তাঁদের হজম করার মতো নয়। ( লেখক)]
আমাদের লক্ষ্য যখন স্থির হয়ে গেল তখন আমাদের এখন উপায় বা’র করতে হবে কি করে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌছাব। এটা বলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না যে, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে একটি তিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী লড়াই আমাদের লড়তে হবে। ভারতবর্ষকে স্বাধীন সভ্য জাতির পদ-মর্যাদায় উন্নীত করার উদ্দেশ্যে ভারতের জনসাধারণ তাঁদের প্রোগ্রাম কার্যে পরিণত করার জন্যে যে চেষ্টা করবে তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পাশবিক বাধা হতেই তাদের “সভ্যতা সৃষ্টিকারী” চরিত্রের পরীক্ষা হয়ে যাবে। এই প্রোগ্রামের সঙ্গে লিবারেলরা কতটা নিজেদের মেশানেব তা থেকেই তাঁদের দেশপ্রেমের পরিমাপ হয়ে যাবে। এই প্রোগ্রাম তাঁদের কোনো আঘাত হানছে না। প্রোগ্রাম চায় যে প্রত্যেক অকপট ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সাহস ও দৃঢ়তার সহিত বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন। প্রোগ্রাম চায় না যে অল্প সংখ্যক লোকের অর্থনীতিক উন্নতি হোক এবং তারাই শুধু সুখী জীবন যাপন করুন। এই প্রোগ্রাম সকলের জন্যে স্বাধীনতা, উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। আমরা অবশ্য জানি যে উভয় পক্ষ হতে আমরা কি আশা করতে পারি; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কখনও তার “হৃদয়ের পরিবর্তন” করবে না, আর আমাদের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা বর্তমানে যে সুখী জীবন যাপন করছেন ও ভবিষ্যতে যে তাঁদের উন্নততর সুখী জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে তাকে বিপন্ন করে জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা তাঁরা চাইতেই পারেন না। অতএব, আমাদের এই মুহূর্তের করণীয় কার্য হচ্ছে যে তাঁদেরই শুধু সংগ্রামে টেনে আনা যাঁদের ভালোর জন্যে আমাদের এই প্রোগ্রামকে কার্যে পরিণত করা আবশ্যক।
আমাদের শক্তিসমূহের বিশ্লেষণ
এখন কথা হচ্ছে এই যে কোনো সংগ্রামে নামতে হলে পাওয়া-যেতে-পারে এমন বিশ্বস্ত শক্তিগুলির অপরিহার্যরূপে সঠিক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে এই শক্তিগুলিকে পরিচালনার জন্যেও মূল্যায়নের প্রয়োজন। জাতীয় ফৌজরূপে আমাদের বিপুল জনগণ সবেমাত্র জাগরণের মুখে এসেছেন। তাঁদের বোধশক্তি এখনও সীমাবদ্ধ এবং তাঁদের দৃষ্টি এখনও দূর প্রসারিত নয়। জাতীয় মুক্তির বিমূর্ত ধারণা তাঁদের সে সম্বন্ধে উদাসীন ক’রে রেখেছে। দূর ভবিষ্যতে তাঁরা যে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হবেন তার কোনো জোরাল আবেদন তাঁদের কল্পনায় মূর্তি পরিগ্রহ করেনি। তাঁদের জীবনের এই মুহূর্তের ব্যাপারগুলি, যে-ব্যাপারগুলি তাঁদের প্রতিদিনকার জীবনে আঘাত হানছে, –এ সব ব্যাপারই তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ধাপে ধাপে তাঁদের বৃহত্তর সংগ্রামের পথে পরিচালনা করার জন্যে তাঁদের এই মুহূর্তের সমস্যাগুলি নিয়েই আমাদের কাজ আরম্ভ করতে হবে। তবে এই সমস্যাগুলির কোনো সমাধানই হতে পারে না যদি আগাগোড়া একটা রাজনীতিক ও সামাজিক পরিবর্তন না আসে; কিন্তু জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যদি আমরা তাঁদের এই মহূর্তের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্যে সংগ্রাম করি তবে আমরা তাঁদের বিপ্লবী চেতনার বৃদ্ধিতে সাহায্য করব। এভাবেই আমরা তাঁদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারব যে প্রকৃত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কি ক’রে তাঁদের প্রতিদিনের জীবন সমস্ত জাতির ভাগ্যের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। এটা জানা কথাই যে অত্যধিক আর্থিক শোষণের ফলে ভারতীয় জনগণের ধৈর্য শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং তাঁদের মনে ঈশ্বরের আত্মসমর্পণ ক’রে বসে থাকার যে বংশপরম্পরাগত বিশ্বাস ছিল তাদের সে বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। গত ক’বছর তাঁরা যে সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত তাঁদের সে ইচ্ছা তাঁরা কাজে দেখিয়ে দিয়েছেন। জনগণের এই বিদ্রোহই হচ্ছে দৃঢ় ভিত্তি যার ওপরে দাঁড়িয়ে ন্যাশনাল কংগ্রেসের কার্য পরিচালনা করা উচিত
অসহনীয় অবস্থার বিরুদ্ধে এই স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়াই হবে জাতীয় সংগ্রামকে শক্তিশালী করা। বর্তমান শাসন ব্যবস্থাধীনে নির্যাতিত ও শোষিত শক্তিগুলিকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এবং তাঁদের জাতীয় মুক্তি লাভের সংগ্রামে পরিচালিত করার জন্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নিম্নলিখিত কার্যক্রম গ্রহণ করছেন :
কার্যোদ্ধারের প্রোগ্রাম
(১) জমিদারী প্রথার বাড়াবাড়ি অত্যাচারের ও উচ্চ হারের খাজনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকরণেচ্ছু গরীব কৃষকদিগকে পরিচালিত করা। সংগ্রামশীল কৃষকদের ইউনিয়ন তৈয়ার করলে এই কাজ সিদ্ধ হবে,-যে ইউনিয়ন (ক) ফিউডাল অধিকার ও প্রাপ্যগুলি বাতিল করে দেওয়ার দাবী জানাবে, দাবী জানাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ও তালুকদারী প্রথার বিলোপ সাধনের; (খ) বড় বড় ইস্টেটগুলিকে বাজেয়াফ্ করে নিতে হবে; (গ) বাজেয়াফ্ ইস্টেটগুলি কৃষকদের কাউন্সিলসমূহের দ্বারা চালিত হবে; (ঘ) জমির খাজনা, সেচের ট্যাক্স ও পথকর প্রভৃতি কমিয়ে দিয়ে হবে; (ঙ) স্থায়ী জোত জমি; (চ) উচ্ছেদ করা চলবে না; (ছ) পরোক্ষ ট্যাক্সের বাতিল; (জ) নিম্ন মূল্য ধার্য; (ঝ) সুদখোর মহাজনদের নিকটে রেহানে বন্ধকী দলীলগুলি নাকচ করে দিতে হবে।
(২) কৃষকদের দাবীগুলিকে জোরদার করার জন্য দেশময় গণ-মিছিল সমূহের সংগঠন করতে হবে এবং তা থেকে “খাজনা ও ট্যাক্স বন্ধ করার আওয়াজ তুলতে হবে”।
(৩) উচ্চ মূল্যের বিরুদ্ধে, রেলওয়ের ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং ডাক মাসুল ও লবণের ট্যাক্স বৃদ্ধির, আর পরোক্ষ ট্যাক্স সমূহের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
(৪) মজুর ইউনিয়নগুলিকে মেনে নেওয়ার জন্যে এবং তাঁদের দাবী আদায়ের জন্যে তাঁদের ধর্মঘট করার অধিকারকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সংগ্ৰাম।
(৫) কল-কারখানার মজুরদের জন্যে আট ঘণ্টার দিন, নিম্নতম মজুরী ও ভালো বাসস্থান আদায় করে নেওয়া।
(৬) এই সকল দাবীর সমর্থনে ধর্মঘট করা এবং সুবিধা পেলে এই ধর্মঘটকে সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত করা।
(৭) সমস্ত ধর্মঘটে রাজনীতিক সমর্থন জানানো এবং কংগ্রেসের তহবীল হতে আর্থিক সাহায্য দেওয়া।
(৮) প্রেস, মঞ্চ ও সমিতির স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করা।
(৯) নগরসমূহে উচ্চ বাড়ী ভাড়ার বিরুদ্ধে ভাড়াটেদের ধর্মঘটসমূহ গড়ে তোলা।
(১০) দেশব্যাপী ভলান্টিয়ার সংগঠন গড়ে তোলা।
(১১) গবর্নমেন্ট ও সওদাগরী অফিসসমূহের উচ্চতর বেতনের জন্যে ক্লার্ক ও কর্মচারীদের ধর্মঘট গড়ে তোলা।
(১২) ভাঙার উদ্দেশ্যে কাউন্সিলগুলিতে প্রবেশ করা।
(১৩) রাজনীতিক বন্দীদের মুক্তির দাবীতে গণসমাবেশসমূহ সংগঠন করা।
শেষ পদক্ষেপ
এই প্রোগ্রামের কার্যোদ্ধারকারী প্রতিটি দফা জনসাধারণের কোনো না কোনো অংশের স্বার্থের সহিত সংযুক্ত। তাকে কার্যে পরিণত করলে সমগ্র জাতির লড়াই করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে। যে কোনো সময়ে কাজে নামার জন্যে জাতীয় ফৌজ কুচকাও-য়াজ করতে থাকবে। প্রতি শ্রেণীই বুঝবে যে কংগ্রেস তার ভালোর জন্যে চেষ্টা করছে। এইভাবে সুবৃহৎ গণ-আন্দোলন গড়ে তুললে, যাতে জনসাধারণের বৃহৎ হতে বৃহত্তম অংশ যোগ দিবেন, গবর্নমেন্টের কর্তৃত্ব ভেঙ্গে পড়বে। সমাজের যে অংশ উৎপাদনের সহিত সংযুক্ত, তাঁদের অসহযোগের ফলে দেশের জীবন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এভাবে গবর্নমেন্টকে চরম আঘাত হানা হবে। দেশব্যাপী আইন অমান্যের আন্দোলন চালু করলে তা সংগ্রামের শেষ স্তরে আমাদের নিয়ে যাবে। তারই অপরিহার্য ফল হবে যে আমরা জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করব। এই স্বাধীনতার অবস্থায় ভারতবর্ষ সামাজিক, অর্থনীতিক ও মানসিক স্তরে উন্নীত করার সুযোগ পাবে। অবশ্য, আমরা আমাদের প্রোগ্রামে জাতীয় পুনর্গঠনের যে সকল নীতি ব্যক্ত করেছি সে সব কার্যে পরিণত করতে হবে। [৩৭]
[37. এই প্রোগ্রামের মূল ইংরেজী এই পুস্তকের পরিশিষ্টে মুদ্রিত হলো। এখানে অনুবাদ দেওয়া হয়েছে।]
জুরিখ
ডিসেম্বর, ১৯২২
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের নামে ওপরে মুদ্রিত প্রোগ্রামটি পাঠানো হয়েছিল। প্রোগ্রামটি যখন কংগ্রেসেরই বিবেচনার জন্যে পাঠানো হয়েছিল তখন উচিত ছিল কংগ্রেসের অধিবেশনে তার আলোচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করা। তার কিছুই করা হয়নি। ইউরোপে যে-সকল ভারতের কমিউনিস্ট ছিলেন তাঁরা নানা ঠিকানায় প্রোগ্রামটি কংগ্রেসকে পাঠিয়েছিলেন। তার বেশীর ভাগই হয়তো পোষ্ট অফিস হতে সরকারের ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা নিয়ে গেছেন, কিন্তু প্রোগ্রামের এক কপিও যে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের দফতরে পৌঁছায়নি একথা বিশ্বাস করা বড় কঠিন। তা ছাড়া, রয়টার তো প্রায় পুরো প্রোগ্রামটিই প্রচার করে দিয়েছিলেন। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ সহ বহু কাগজে তা ছাপাও হয়েছিল। তবুও ভীত সন্তস্ত কংগ্রেস নেতারা তা স্পর্শ করলেন না। অবশ্য কমিউনিস্টরা আশাও করেননি যে তাঁরা তা করবেন। আমরা আমাদের প্রচার করেছি।
গয়া অধিবেশনের সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশ আগে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। কিন্তু গয়ার অধিবেশনে বললেন, স্বরাজ? তার কি কোনো সংজ্ঞা দেওয়া চলে? এ তো নিজের ভিতরে উপলব্ধি করার বস্তু।
ইতিহাসের দিক হতে মনের রাখতে হবে যে গয়ায় পাঠানো প্রোগ্রামটিই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রোগ্রাম। ভারতের রাজনীতিতেও এই প্রোগ্রাম ছিল অভিনব। এমনভাবে জনগণের দাবীর কথা এই প্রথম ভারতে ঘোষিত হয়েছিল।
আগেই বলেছি যে ১৯২২ সালের ৫ই নভেম্বর হতে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। এই চতুর্থ কংগ্রেসের তরফ হতেও গয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সপ্তত্রিংশত্তম অধিবেশনের নামে একটি বাণী পাঠানো হয়েছিল। এর কপিও পোস্ট অফিস হতে গবর্নমেন্টের ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা নিয়ে গিয়ে থাকবেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা নানা স্থান হতে নানাভাবে এই জাতীয় দলীলপত্র পাঠাতে অভ্যস্ত ছিলেন। এর একটি কপিও যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সপ্তত্রিংশত্তম অধিবেশনের দপ্তরে পৌঁছায়নি তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। কংগ্রেস কিন্তু তার কোনো উল্লেখ কোথাও করেছেন বলে মনে পড়ে না। তবে ভারত গবর্নমেন্ট কানপুর কমিউনিস্ট [বলশেভিক] ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় (১৯২৪) আসামীদের বিরুদ্ধে এই দলীলটি প্রমাণ হিসাবে দাখিল করেছিলেন এবং এর বিশুদ্ধ কপিই দাখিল করেছিলেন। আমি এই দলীলটিও এখানে ছেপে দিচ্ছি। তা থেকে তখনকার দিনে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কি চাইতেন তা অনেকে বুঝে নিতে পারবেন।
কানপুর মোকদ্দমার দলীল-পত্র কোর্ট হতে ছাপা হয়েছিল। আমরা ন্যাশনাল আরকাইস্ হতে তার মাইক্রোফিল্ম নিয়েছি। সেই ফিল্মকে পরিস্ফুট করে দেখতে পাচ্ছি যে এই দলীলটি ছাপার ভুলে জর্জরিত। কোর্টে টাইপ করার সময়ে এই ভুলগুলি ঢুকেছে। লন্ডনে চেষ্টা করেও এর একটি বিশুদ্ধ কপি জোগাড় করতে পারিনি। কাজেই, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে দলীলটির ছাপার ভুল সংশোধন করে তার বাঙলা অনুবাদ করিয়ে এখানে ছাপালাম। মূল ইংরেজীও পুস্তকের পরিশিষ্টে ছাপা হলো।