দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

বাৰ্লিন যুগ

বাৰ্লিন যুগ

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে (১৯২১ সারের ২২শে জুন হতে ১২ই জুলাই) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল যে ভারতীয় আন্দোলন সংক্রান্ত সব কিছু তাশকন্দ হতে গুটিয়ে আনতে হবে। ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির হেড্‌ কোয়ার্টার্স তাই তখনকার মতো মস্কোতেই উঠে আসল। ১৯২১ সালের ২১শে এপ্রিল তারিখে সোবিয়েৎ ইউনিয়নের “অল-রাশিয়ান সেট্রাল এক্‌জেকিউটিব কমিটি” মস্কোতে “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় (অপর নাম স্তালিন বিশ্ববিদ্যালয়)” স্থাপন করলেন। তাশখন্দ হতে আগত ভারতীয় ছাত্ররা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে লাগলেন। এম. এন. রায় ও তাঁর স্ত্রী এভেলিন রায় ও এখানে পড়াচ্ছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইতিহার (মানবেন্দ্রনাথ রায় ও অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত) আমদাবাদ কংগ্রেসে বিতরিত হয়েছিল (ডিসেম্বর, ১৯২১) কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসের পরে এম. এন. রায় এই দলীল মস্কোতেই রচনা করেছিলেন।

রায়ের “ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন” নামক ইংরেজি পুস্তকও এই সময়ে মস্কোতেই রচিত হয়েছিল। কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে মস্কো হতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সব দিকে বিচার করে এটাই তখন স্থির হলো যে বার্লিন হতে ভারতের সহিত সংযোগের সুযোগ অনেক বেশী।

১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে এম. এন. রায় ও এভেলিন রায় বার্লিনে গেলেন। তার মানে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হেড় কোয়াটার্স বার্লিনে স্থানান্তরিত হলো। সেখানে নির্বাসিত ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা ছিলেন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার বিরোধী। পারলে তাঁরা এম. এন. রায়কে বিশ বাঁও পানির তলায় ডুবিয়ে দেন এমন ছিল তাঁদের মানসিক অবস্থা। এর আগের অধ্যায়ে অবনী মুখার্জির কথা ও অন্যান্য কথা বলতে গিয়ে আমি এ সম্বন্ধে লিখেছি।

বার্লিনে ভারতীয় অনেকেই ছিলেন, ব্রিটিশ ইনটেজিন্সের রিপোর্ট অনুসারে প্রায় একশ; জন ছিলেন। কিন্তু এম. এন. রায়দের স্বামী-স্ত্রীকে প্রকৃত সাহায্য করার মতো কেউ ছিলেন না। লিখবার মতো লোক তো ছিলেনই না। ১৯১৫ সালে মানবেন্দ্রনাথ পেটে যে বিদ্যা নিয়ে ভারত ত্যাগ করেছিলেন তিনি শুধু সেই বিদ্যাতে সন্তুষ্ট হয়ে বিদেশে নির্বাসিত বিপ্লবীর জীবন-যাপন করেননি। তিনি কঠোর পরিশ্রম সহকারে অধ্যয়ন করে তাঁর ভিতরের প্রতিভাকে বিকশিত করে তুলেছিলেন। ইউরোপের বাশিন্দা ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের ভিতরে রায়ের পরম শত্রু ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত একদিন দুঃখ করে আমায় বলেছিলেন যে বিদেশে অবস্থিত ভারতীয় বিপ্লবীরা লেখাপড়ার চর্চা মোটেই করলেন না, একমাত্র মানবেন্দ্রনাথই তার ব্যতিক্রম।

আমেরিকায় নির্বাসিত ভারতীয় বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ কর জার্মানিতে এসে এম. এন. রায়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর আসার জন্যে রায় রাহা খরচের টাকা যে পাঠিয়েছিলেন একথারও উল্লেখ সেই সময়কার দলীলপত্রে পাওয়া যায়। এম. এন. রায় ও সুরেন্দ্রনাথ করের যুক্ত স্বাক্ষরে ইতিহারও হয়েছে। তারপরে সুরেন্দ্রনাথ কর কেন মৌলবী বারাকতুল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত “ইন্ডিয়ান” ইন্ডেপেন্ডেস পার্টিতে ও ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন সে সম্বন্ধে রায় কিংবা ডক্টর দত্ত কোনো কথা বলেননি। কানপুর কমিউনিস্ট (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা উপলক্ষে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে আমি যখন নলিনী গুপ্তের সঙ্গে দ্বিতীয়বার-অবশ্য কানপুর ডিসট্রিক্ট জেলে মিলিত হয়েছিলেম, (প্রথমবার আসার পরে ১৯২২ সালের মার্চ মাসে নলিনী ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন) তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন যে তিনি রায়ের সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ করের ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলেন। ঝগড়া বাধানোর ব্যাপারে নলিনী গুপ্ত বরাবরই একজন ওস্তাদ ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ কর অল্প দিনের ভিতরেই জার্মানীতে মারা যান। তিনি যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন।

সেই যুগে যাঁরা জার্মানী হতে দেশে ফিরতেন তাঁরা বলতেন যে এম. এন. রায়রা বার্লিনে বড় বড় ব্যয়সাধ্য হোটেলে বাস করতেন। সত্যই তাঁরা তাই করতেন কিনা সে খবর আমি কখনও নিইনি। সেই সময়ে মানবেন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী এভেলিন ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্যে যে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এটা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে পারি না। রায়ের ইংরেজি পুস্তক “ইন্ডিয়া ইন্‌ ট্রানজিশন” মস্কোতে রচিত হয়েছিল, বটে, কিন্তু তা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর বার্লিনে আসার পরে। ১৯২২ সালের ১৫ই তারিখে ইংরেজি পাক্ষিক THE VANGUARD OF INDIAN INDEPENDENCE (ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স অর্থাৎ ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্র সৈনিক) বার্লিন হতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপাত্র ছিল এই পত্রিকাখানি। মনে হয় বার্লিনে অবস্থিত ভারতের ইনটেলিজেন্সের কিংবা ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের লোকেরা এই পত্রিকা যে বার হবে সে খবর আগে হতে ভারতে পাঠাননি। কারণ, প্রথম, সংখ্যার কাগজ কলকাতায় আসার পরে কলকাতা পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন সাব-ইনস্পেকটর মুহম্মদ ইসমাইল, পরে খান বাহাদুর ও ডেপুটি কমিশনার, হন্তদন্ত হয়ে উত্তর কলকাতায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন যে কাগজখানি কোন্ প্রেসে গোপনে ছাপা হয়েছে। পুলিস তখন হয় তো কন্‌টনেন্‌টাল টাইপের চেহারা চিনতেন না। অবশ্য, কিছু কিছু জার্মান টাইপ তখনও কলকাতার বাজারে আসছিল। দ্বিতীয় সংখ্যার কাগজ যখন কলকাতায় এসে পৌঁছাল তখন পুলিস সবকিছু জেনে গেছেন। তাঁরা লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস হতে সব খবর পেয়েছেন। তাছাড়া, তাঁরা ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট সেসিল কে’র বার্লিনস্থ এজেন্টদের নিকট হতেও রিপোর্ট পেয়ে থাকবেন। কর্নেল কে’ বলেছিলেন তাঁর এজেন্টরা পৃথিবীর সব দেশে আছেন।

যতীন মিত্র বার্লিনে তেমন কোনো কাজে আসেননি। রায়ের পক্ষে তিনি ছিলেন একটি বোঝা।

“দি ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স” কিছুদিন পরে এভান্স গার্ড (THE ADVANCE GUARD অর্থাৎ অগ্রসর সেনা) হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় পুলিসের নজর অন্য দিকে ফেরানো। এক বছর পুরো হওয়ার পরে আবার শুধু ‘দি ভ্যানগার্ড” নাম হয়। সব শেষে নাম হয়েছিল দি মাসেজ্‌ অফ ইন্ডিয়া (THE MASSES OF INDIA) অর্থাৎ ভারতের জনগণ। ১৯২৫ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে “দি ভ্যানগার্ডের নাম পরিবর্তিত হয়ে “দি মাসেজ, অফ ইন্ডিয়া” হয়েছিল। বার্লিনে কাগজ চালানোর ব্যাপারে নলিনী গুপ্ত রায় দম্পতিকে কমই সাহায্য করতে পারতেন। কেননা তিনি ইংরেজি লেখাপড়া খুব কম জানতেন যতীন্দ্রনাথ মিত্রকে যে নলিনী গুপ্ত জার্মানী নিয়ে গিয়েছিলেন সে কথা আমি আগেই লিখেছি। তাঁর আইনসঙ্গত পাসপোর্ট ছিল। তাঁকে এম. এন. রায় বার্তাবহরূপে ভারতে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশে আসার জন্যে রওয়ানা হয়ে আবার বার্লিনে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল না। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির খরচে একটা কিছু শিখে আসতে চাইছিলেন। তাও যদি শিখতেন তিনি। তিনি নিজে কিংবা তাঁর হয়ে অন্য কেউ ব্রিটিশ ইন্‌টেলিজেন্সকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে যতীন্দ্রনাথ মিত্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশানলারের বার্তা নিয়ে ভারতে ফিরে যাচ্ছেন। তারপর লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে এক হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেল। সাবধান! সাবধান!! যতীন্দ্রনাথ মিত্র সেন ভারতে ঢুকতে না পান। আর যদি ঢুকে পড়েন তবে তাঁকে ধরে সঙ্গে সঙ্গেই যেন জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম আসতে লাগল ভাইসরয়ের নামে। ভারতের ন্যাশনাল আরকাইবসে রক্ষিত পুরানো দিনের গোপন কাগজপত্র পড়লে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আহা! বেচারা যতীন মিত্র আজ আর বেঁচে নেই। থাকলে এসব গোপন কাগজপত্র পড়ে খানিকটা আত্মশ্লাঘা বোধ করতে পারতেন। ১৯২৬ সালে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। তখন দেখা গেল যে তাঁর সম্বন্ধে ভারতের ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের আগেকার দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনা আর নেই। পুলিস তাঁর দিকে তেমন তাকিয়েও দেখছেন না। জার্মানী হতে ফেরার পথে কোথাও কোনো কজ পেলেন না। অন্ন চিন্তায় জর্জরিত হয়ে তিনি কোথায় ছিলেন আমি কিছুই জানতেম না। ১৯৫১ সারে জেল হতে বার হয়ে এসে আমি বহু বৎসর পরে তাঁর খবর পেলাম। বাতে ভুগছেন, কষ্টে আছেন। আমাদের পার্টির জন্যে তিনি কখনও কিছু করেননি, পার্টি তাঁকে চিনতেনও না। আমি অতি সামান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেম। আমার পার্টি এলাউন্স হতে কীই বা পাঠাতে পারতেম? শুনেছি বড় কষ্ট পেয়ে যতীন মিত্র মারা গেছেন।

এই যতীন মিত্রকে নিয়েও এম. এন. রায় মুশকিলে পড়েছিলেন। ১৯২৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বার্লিন হতে তিনি আমাকে লিখেছিলেন :

“It does not seen that Jatin Mitra will be of any particular use. It is another mistake of Kumar’s to have brought him.”

(মনে হচ্ছে না যে যতীন মিত্র বিশেষ কাজে আসবে। এটা কুমারের [নলিনী গুপ্তের নাম] আর একটি ভুল যে তিনি তাঁকে এনেছেন।)

ইংরেজি পত্রাংশ রায় লিখিত বাঙলার অনুবাদ। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, হাইকোর্টে আপিলের জন্যে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার অন্য ভাষায় লিখিত দলীলগুলি ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়েছিল ওপরের বাঙলা অনুবাদ আমার।

আমার মনে হয় যতীন মিত্র কোনো কাজেই লাগছিলেন না। অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এম. এন. রায় ১৯২৩ সালের ১৯শে মার্চ তারিখে আমায় আবার লিখলেন:

“Jatin Mitra helps in office work to some extent. He is an unasked for burden. The Kumar’s achievement. What to do with him? I am trying to utilize him at least ofn clerical work, but a downright ass. You shoudl have stopped his coming. A lot of money has been thrown into the water and is being thrown.”

(যতিন মিত্র অফিসের কাজে কিছু কিছু সাহায্য করছে। সে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বোঝা। কুমারের একটি মহান সাধন! তাকে নিয়ে কি করা যায়? আমি তাকে কমপক্ষে অফিসের কাজে লাগাতে চাইছি। [কিন্তু চাইলে কি হবে] লোকটি একটি আস্ত গাধা। আপনার উচিত ছিল তার আসা বন্ধ করা। তা রজন্যে বহু টাকা জলে ফেলা হয়েছে এবং ফেলা হচ্ছে।)

এই পত্রাংশও কানপুর মোকদ্দমার পেপার বুক হতে নেওয়া। এম. এন. রায়ের পত্র বাঙলায় লেখা ছিল। তার ইংরেজি অনুবাদ করেছে কুঞ্জবিহারী রায়। আমি এখানে অনুবাদের অনুবাদ করেছি।

যতীন মিত্রের মতো অকেজো লোককে নিয়েও রায় দম্পতি কঠোর পরিশ্রম করে কাগজ লিখেছেন ও ঠিক সময়ে তা বার করেছেন। কোনো দিন সামান্য বিলম্বও ঘটেনি। পুস্তক ও ইতিহার ইত্যাদিও এই বার্লিনে যুগে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, রায় দম্পতি বলতে আমি এখানে মানবেন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী এভেলিনের কথাই বলেছি।

১৯২২ সালের বার্লিনে যুগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি বিশিষ্ট কাজ হচ্ছে ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের বিবেচনার জন্যে একটি প্রোগ্রাম পাঠানো। এই সময়ে রায় অনেককে অনেক পত্র লিখেছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশকে লিখেছিলেন, তাঁর পুত্র চিত্তরঞ্জনকে লিখেছিলেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুকেও লিখেছিলেন।

এখানে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। নলিনী গুপ্ত মানবেন্দ্রনাথ রায়কে অনেক “হাইকোর্ট দেখিয়েছেন”। আশ্চর্য এই যে রায় বারে বারে নলিনীর মিথ্যার শিকারে পরিণত হয়েছেন। সম্ভবত ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস ছিল। নলিনী একদিন আমায় বললেন যে তিনি অধ্যাপক জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার জেলে গিয়ে দেখা করতে চান। এক সময়ে তাঁর সঙ্গে একই মেসে, অর্থাৎ সেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের মেসে থাকতেন নলিনী। দেখা করার কোনো অসুবিধা ছিল না। খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনের কল্যাণে কলকাতার আশলীপুর সেন্ট্রাল জেল লোকে লোকারণ্য ছিল। জেলের সব শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। বাইরে থেকে যে-কোনো লোক এসে ভিতরের যে-কোনো লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। নলিনী আর আমি একদিন আশলীপুর জেলের গেটে গিয়ে ভিতরে স্লিপ পাঠালাম। নলিনী পাঠালেন অধ্যাপক জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে, আর আমি পাঠালাম নোয়াখালীর হজী আবদুর রশীদ খানের নামে। ভিতরে গিয়ে আমরা জেইলারের আফিসের ভিতরের দিককার জানালায় দাঁড়িয়ে দু’জনে দু’জনের সঙ্গে দেখা করলাম। কারণ, আফিসের ভিতরে খুব ভিড় ছিল। বিশেষ করে ফরিদপুরের পীর বাদশা মিঞার সঙ্গে তাঁর নূতন জামাই (কার্তিকপুরের গিয়াসুদ্দিন আহ্মদ চৌধুরী) দেখা করতে এসেছিলেন। নলিনী নিজের কাজ (মিশন) সম্পর্কে অধ্যাপক ব্যানার্জিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কি বলেছিলেন তা জানিনে। তবে, ব্যানার্জি চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে চিত্তরঞ্জন দাশকে ডেকে এনে নলিনীর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে নিজে তাঁর ব্যারাকে ফিরে গেলেন। তিনি হয়তো রাজাবাজার বোমার মামলার আসামী অমৃতলাল হাজরার বিরুদ্ধে পুলিসের নিকটে দেওয়া নলিনীর বিবৃতির কথা জানতেন। তাঁর সঙ্গে একই মেসে থাকার সময়েই নলিনী এই কাজটি করেছিল। আমিও হাজী আবদুর রশীদ খানের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে গেটের বাইরে চলে গিয়ে নলিনীর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চিররঞ্জন নাকি নলিনীকে বলেছিলেন যে তিনি সুভাষচন্দ্র বসুসহ আমাদের প্রোগ্রাম মেনে কাজ করবেন। হয়তো বাপের মতও করাবেন একথাও বলে থাকবেন।

এর পরে নলিনী গুপ্ত বার্লিনে ফিরে গিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে আরও একবার “হাইকোর্ট দেখালেন”। তার ফলে আমরা দেখতে পেলাম যে রায়ের নিকট হতে লম্বা লম্বা চিঠি আসছে চিত্তরঞ্জন দাশের নামে, তাঁর পুত্র চিররঞ্জন দাশের নামে এবং সুভাষচন্দ্র বসুর নামেও। সুভাষ বসুর নামীয় পত্রখানি প্রথমে আমার নিকটে এসেছিল। আমি তা ভূপেন্দ্রকুমার দত্তকে দেখাই। দত্ত যখন সংস্কৃত কলেজে পড়ছিলেন তখন তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিলসফির অনার্স ক্লাসে যোগ দিতে হতো। এই ক্লাসে সুভাষ তার সহপাঠী ছিলেন। এই জন্যে উৎসাহভরে তিনি বললেন, “সুভাষের পত্রখানা আমিই তাকে পৌঁছিয়ে দেব”। কিন্তু ফিরে এসে তিনি আমায় জানালেন যে “সুভাষ পত্রখানি নিল না”। আমি পড়লাম মুশকিলে। এই পত্র নিয়ে সুভাষ বসুর সঙ্গে আমায় দেখা করতে বলা হয়েছিল। সুভাষ যখন তাঁর সহপাঠী ভূপেন দত্তের নিকট হতে পত্রখানি গ্ৰহণ করেনি তখন এটা নিশ্চিত ছিল যে আমার নিকট হতেও তিনি তা গ্রহণ করবেন না। আমার সঙ্গে আগে তাঁর কোনো পরিচয় ছিল না তবুও আমি একদিন সুভাষের নিকটে গেলাম। তিনি বললেন যাঁরা তাঁকে পত্র লিখতে চান তাঁরা যেন সোজাসুজি লেখেন। সিবিল সার্বিস পাস করে চাকরী গ্রহণ না করার অহঙ্কারে তাঁর তখন মাটিতে পা পড়ছিল না, তা ছাড়া হয়তো একথাও ভেবেছিলেন যে এর-ওর মারফতে চিঠিপত্র গ্রহণ করে কেন তিনি মিছামিছি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে যাবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *