দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

আবার নলিনী গুপ্তের কথা

আবার নলিনী গুপ্তের কথা

গোরখপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বাঙলার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা এসে নলিনী গুপ্তের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদেরই অনুরোধে নলিনী গুপ্তকে যুক্ত প্রদেশের গোরখপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল হতে বাঙলার খুলনা ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী করা হয়েছিল। নীচে আমি যে পত্রখানি উদ্ধৃত করছি তা থেকে এই কথাগুলি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

Intelleigence Branch, C.I.D

13, Elysium Row

Calcutta 27th June, 1925

No. “73

Secret

From

J.E. Armstrong, Esq., O.B.E. Deputy Inspector-General of Police, Intelligence Branch, C.I.D., Bengal

To

The Chief Secretary to the Government of Bengal.

Sir,

I have the honour to address you on the subject of moving the Government of India to suspend the sentence of imprisonment which Convict Nalini Bhusan Gupta is at present undergoing.

This man, Nalini was convicted and sentenced in May 1924 to four years’s R.I. in connection whith the cawnpore (Bolshevik) Conspiracy Case. At our request he was transferred from the Gorakapur jail to the Khulna Jail at the end of 1924 and thereafter to the Alipore Central Jail, as it was found that he was suffering form appendix trouble and gall stones and that an operation would have to performed. He was admitted into the Prince of Wales Hospital for treatment in December last and has only just returned to the Alipore Cental Jail.

In spite of two operations his condition is distinctly bad and he is too weak and emaciated to stand,. Major Sandes, the Superintendent of the Medical College, writes as follows:

“I Myself have personally seen the case and it strikes one as that of a man being seriously but not at hte moment dangerously ill. His mental condition is one of marked depression, and release undoubtedly would improve the latter condition.” On the 10th June, Major Sandes again wrote:

“He (colonel Connor, the Surgeon in charge of Nalini’s case) is definitely of option that the convict is not progressing and that he is likely to go steadily downhill. His mental outlook has an important bearing on his malady. If it is within bounds possibility to give him his liberty. even for a time, it might do much towards saving his life. In this opinion I Concur.”

Prior to his conviction Nalini made a statement to the Police, but subsequently stated that through fear he had not disclosed all he knew. Since his conviction he has been interviewed on several

occasions and has readily given information within his knowledge. It has not, however, been possible to obtain from his a detailed statement owing to his state of health.

In his present condition, if set at liberty, he is physically incapable of mischief and in view of the medical opinion quoted above that such a course may be the means of saving his life, I recommend that his sentence be temporaily suspended and that he be handed over to some relative, if this step is approved his relatives will be communicated with and suitable arrangements made.

I have etc..

Sd/-J.E. Armstrong,

Deputy Inspector-General

of Police., I.B.

I submit these papers, for Home Member’s Information as D. I. B’s letters shows there was no doubt that the man should be released and I therefore telegraphed in reply to Bengal Government agreeing to release. I will show to H. E. to-morrow if H.M. returns the papers.

Sd. Illegible
30.6.25

I have shown H.E. Post Copy of telegram should be sent by mail to Bengal.

Sd. Illegible

1.7.25

বঙ্গানুবাদ

গোপনীয়

জে. ই. আর্মস্ট্রং ও.বি.ই. পুলিসের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনেরেল, আই. বি. সি. আই. ডি. বেঙ্গলের নিকট হতে।

বাঙলা দেশের চীফ, সেক্রেটারীর বরাবরে

মহাশয়,

কয়েদী নলিনীভূষণ যে এখন সাজা খাটছে তার সাজা স্থগিত রাখার কথা ভারত গবর্নমেন্টকে জানানোর জন্যে আমি এই পত্র আপনাকে লিখছি। নলিনী নামক এই লোকটি কানপুর (বলশেভিক) ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। আমাদের অনুরোধে তাকে গোরখপুর জেল হতে ১৯২৪ সালের শেষ দিকে খুলনা জেলে বদলী করা হয়েছিল। তারপরে দেখা গেল যে সে এপেনডিক্স ও গল্ স্টোনের বেদনায় ভুগছে। তখন অপারেশনের জন্যে তাকে আরীপুর সেন্‌ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। আশলীপুর সেন্ট্রাল জেল হতে চিকিৎসার জন্যে তাকে গত ডিসেম্বর মাসে প্রিন্স অফ্ ওয়েল্স্ হসপিটালে ভর্তি করানো হয় এবং সেখান থেকে সবেমাত্র সে আশলীপুর জেলে ফিরে এসেছে।

দু’দুবার অপারেশন করা সত্ত্বেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে তার অবস্থা খারাপ। সে এত বেশী দুর্বল ও মাংসহীন হয়ে পড়েছে যে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। মেডিকেল কলেজের সুপারিন্টেডেন্ট মেজর সার্ভেস বলছেন :

“আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে পীড়াগ্রস্ত, কিন্তু এই মুহূর্তে বিপজ্জনকরূপে নয়। এটা বোঝা যায়, সে মনের বল হারিয়ে ফেলেছে। তাকে মুক্ত করে দিলে নিঃসন্দেহে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।” ১০ই জুন তারিখে মেজর স্যান্ডেস্ আবার লিখেছেন :

“তিনি (কর্নেল কোনোর, নলিনীর কেসের ভারপ্রাপ্ত সার্জেন) এই মত ধারণ করেন যে কয়েদীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এটাই সম্ভব যে তার অবস্থার অবনতি ঘটবে। তার মনের অবস্থা তার ব্যাধির ওপরে ছায়াপাত করছে। তাকে মুক্তি দেওয়া, কিছুদিনের জন্যে হলেও, যদি সম্ভব হয় তবে তার জীবন রক্ষা পেতে পারে। এই প্রস্তাবে, (মেজর স্যান্ডেস বলছেন) আমি একমত।”

নলিনীর সাজা হওয়ার আগে সে পুলিসের নিকটে বিবৃতি দিয়েছিল, কিন্তু পরে সে বলছে যে সে যা জানে তার সব কথা সে ভয়ে বলেনি। তার সাজা হওয়ার পরে তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে। যখনই দেখা করা হয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই সে যা জানে তা বিনা ওজরে পুলিসকে বলেছে। তার অসুস্থতার কারণে তার নিকট সুবিস্তৃত বিবৃতি নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

তার বর্তমান অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিলে, তার এমন শারীরিক শক্তি নেই যে সে কোনো নষ্টামি করতে পারে। ওপরে যে চিকিৎসকের মতে উদ্ধৃত করা হয়েছে তাতে তাকে ছেড়ে দেওয়াটা তার জীবন রক্ষারও উপায় হতে পারে। আমি সুপারিশ করছি যে তার দণ্ডাদেশ আপাতত অস্থায়ীভাবে স্থগিত রাখা হোক এবং তাকে তার কোনো আত্মীয়ের হাতে সমর্পণ করা হোক। এইভাবে অগ্রসর হওয়াটা যদি অনুমোদিত হয় তবে তার আত্মীয়-স্বজনদের জানাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত করা হবে।

সম্মানপূর্বক ইত্যাদি

স্বাক্ষর : জে. ই. আর্মস্ট্রং

পুলিসের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনেরেল, আই, বি,

হোম মেম্বারের জানার জন্যে আমি এই কাগজপত্র দাখিল করছি।

ডি.আই. বি.’র চিঠি হতে বোঝা যাচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই যে এই লোকটিকে ছাড়তে হবে। এই কারণে আমি উত্তরে বেঙ্গলকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি যে এই লোকটিকে মুক্তি দিতে গবর্নমেন্ট রাজী হয়েছে। যদি হোম মেম্বার কাগজপত্র ফেরৎ দেন তবে আমি আগামীকাল হিজ একসেলেন্সিকে (গবর্নর জেনেরেলকে) সব কিছু দেখাব।

স্বাক্ষর : অস্পষ্ট

৩০.৬.২৫

আমি হিজ একসেলেন্সিকে কাগজপত্র দেখিয়েছি। টেলিগ্রামের নকল ডাকযোগে বেঙ্গলকে পাঠানো হোক।

স্বাক্ষর : অস্পষ্ট

১.৭.২৫

মিস্টার আর্মস্ট্রং বলেছেন, ১৯২৪-২৫ সালে নলিনীর এপেনন্ডিক্স ও গলস্টোনের জন্যে অপারেশন হয়েছিল। আমার মনে হয় তিনি ঠিক বলেননি। ১৯২১ সালে কলম্বো মেডিকাল কলেজ হস্পিটালে নলিনীর এপেন্ডিক্সের জন্যে অপারেশন হয়েছিল। গলস্টোনের কথা আমি তখন কিছু শুনিনি। কলকাতা মেডিকাল কলেজের প্রিন্স অফ ওয়েল্স হস্পিটালে নলিনীর দু’বার অপারেশন হয়েছিল একথা ঠিক। কলকাতার সুবিখ্যাত যক্ষ্মা চিকিৎসক ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী সেই সময়ে প্রিন্স অফ ওয়েল্স হস্পিটালে (এই হস্পিটালে শুধু অপারেশন হয়) হাউস সার্জন ছিলেন। ১৯২৬ সালে আমি তাঁর নিকট হতে ব্যারামটা কি তা বুঝতে চেয়েছিলাম। তিনি সোজা করে বলেছিলেন যে ব্যারামটা ছিল ইন্‌টেটিনাল টিউবারকিউলোসিস অর্থাৎ অন্ত্রের যক্ষ্মা রোগ। মোটের ওপরে নলিনীর কঠোর ব্যাধি হয়েছিল। দু’বার অপারেশন হয়েছিল।

আগে কিছুই জানতেম না, এখন নলিনী সম্বন্ধে বিস্তর কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ১৯১৪ সালে রাজাবাজার বোমার মামলার আসামী অমৃতলাল হাজরার বিরুদ্ধে তার দেওয়া বিবৃতি (এই বিবৃতি দিয়েই সে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল) ও ১৯২৩ সালের শেষাশেষিতে ধরা পড়ে দিনের দিন আরব্য উপন্যাসের শাহিরজাদীর ধরনে যে-সব বিবৃতি সে দিয়েছে সে সব আমরা পড়েছি। ভারত গবর্নমেন্টের মুহাফিজখানায় এ সব রক্ষিত আছে। মিস্টার আর্মস্ট্রং তার সাজা হওয়ার পরেকার বিবৃতিগুলির কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি এখনও আমরা পাইনি। তবে, মনে হয় ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে পুলিস নলিনীকে গোপেনের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। তাতে তিনি বলেছিলেন যে সুবোধ নামক একজন বিপ্লবীকে আমার নিকটে উপস্থিত করা হয়েছিল। আমি তাকে পত্র দিয়ে এম. এন. রায়ের নিকটে পাঠিয়েছিলেম। (Col. C. Kaye : Communism in India, Page 134) মোটের ওপরে নলিনী গুপ্ত ভবঘুরে বৃত্তির লোক ছিল। রাজনীতিতে সে ভুঁইফোড়। ১৯২৬-২৭ সালে সে আমাদের সঙ্গে কলকাতার ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডে ছিল। সেই সময়ে সে আমাদের কম জ্বালয়নি। তার উপদলীয়তায় আমরা উত্যক্ত হয়েছিলেম। তবুও কংগ্রেস অফিস হতে ও “ফরওয়ার্ড” কাগজের তরফ হতে যখন তাকে পুলিসের লোক বলে রটনা করা হচ্ছিল তখন আমরা তার হয়ে সে প্রচারের প্রতিরোধ করেছি।

১৯২৭ সালে যে যখন আবার জার্মানিতে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল তখন তার ১৯২১ সালে মার্সাইতে নূতন করে করা ব্রিটিশ পাসপোর্টের মিয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। সে পাসপোর্ট সে আবার নূতন করে করতে পেরেছিল কিনা তা তখন সে আমায় কিছু বলেনি। কিন্তু আমি খবর পাচ্ছিলেম সে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করছে। সে একদিন অন্তত টেগার্টের (কলকাতার পুলিস কমিশনার) সঙ্গে যে দেখা করেছিল একথা জানি। ব্যাপারটি আমি জেনেছিলেম এইভাবে। নলিনী একদিন যখন লালবাজার পুলিস অফিসে মিস্টার টেগার্টের সঙ্গে মূলাকাত করেছিল তখন অন্য একটি মূলাকাতের জন্যে স্লিপ এলো। স্লিপ পাঠিয়েছিলেন এম. এন. রায়ের সহকর্মী ও যতীন মুখোপাধ্যায়ের দলের নেতা অতুলকৃষ্ণ ঘোষ। তিনি তাঁর বন্দী ছোট ভাই অমরকৃষ্ণ সম্বন্ধে তদবীর করতে গিয়েছিলেন। মিস্টার টেগার্ট নলিনীকে সামনে বসিয়ে রেখেই অতুলকৃষ্ণ ঘোষকে ডেকে পাঠালেন। অতুলকৃষ্ণ টেগার্টের অফিসে ঢোকার আগেই শুনতে পেলেন যে তিনি বড় জোরে জোরে চেঁচাচ্ছেন। নলিনীকে তিনি বলেছিলেন, “কি পেয়েছ তুমি? ভেবেছ মুজফফর হবে লেনিন, আর তুমি হবে ট্রটস্কি? তা হবার নয়।” আমার মনে হয়েছিল যে এটা ছিল টেগার্ট সাহেবের একটি অভিনয়। শুনেছি টেগার্ট সাহেব নাকি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন পুলিস অফিসার। অথচ তিনি জানতেন না ১৯২৭ সালের সোবিয়েৎ ইউনিয়নে ট্রটস্কি কত বেশী সমালোচিত। অতুলকৃষ্ণ ঘোষের নিকট হতে আমি এ খবর পরের দিন পেয়েছিলেম। কিন্তু নলিনী আমায় কিছু জানাল না। কেন গিয়েছিল সে টেগার্টের নিকটে? পাসপোর্টের জন্যে যাওয়া তার পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল। কারণ, সেকালে কলকাতার পুলিস কমিশনার এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরাও ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারতেন। যাওয়ার আগে নলিনী আমার নিকট হতে দূরে দূরে থাকছিল। শেষে একদিন এলো। আমার সঙ্গে দেখা না করে গেলে বোম্বেতে তার অসুবিধা হবে। বলছিল টাকা নেই, পাসপোর্ট নেই। আমি বললাম, পাসপোর্টের জন্যে টেগার্টের সঙ্গে দেখা করলেন না কেন। জওয়াব দিলেন, “করেছিলাম, কিছু হলো না।” কিন্তু হয়তো তার পাসপোর্ট হয়েছিল, হয়তো টেগার্টের সঙ্গে আরও গভীর ব্যবস্থাও হয়েছিল। নলিনী গভীর জলের মাছ ছিল। হ্যাঁ, টাকার কথাও আমি তাকে বলেছিলেম। নলিনীর জন্যে আসা ২৫ পাউণ্ড পুলিস কিরণবিহারী রায়েল নিকট হতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই টাকা আমাদের মোকদ্দমার সময়ে কানপুর কোর্টে জমা হয়েছিল। এতকাল পরে সেই টাকাটা তোলার জন্যে নলিনী কানপুরের এক উকীলকে অথরিটি দিয়েছিল। টাকাটা আসার সময় হয়েছিল। আমি তাকে আরও ক’দিন থেকে ওই টাকাটা নিয়ে যেতে বলেছিলেম। কিন্তু সে রাজী হলো না।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে টেগার্টের দেওয়া পাসপোর্ট তার নিকটে ছিল। তবুও সে বোম্বেতে গিয়ে পাসপোর্টের কথা বলে। কমরেড শান্তারাম মিরাজকর একটা ব্যবস্থা করেও দিয়েছিল।

নলিনীর কথা আর বলতে চাইনে। ১৯২৭ সালে সে যখন ইউরোপে ফিরে গিয়েছিল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে সে তখন ব্রিটিশ চর রূপেই গিয়েছিল। সে জার্মানীতে একটি রেস্তোরাঁ চালাত। এই রেস্তোরাঁটি ভারতীয়দের আড্ডা ছিল। সব রকমের আলোচনা হতো নলিনী গুপ্তের রেস্তোরাঁয়। খুব সহজেই সে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টকে ভারতীয়দের খবর দিতে পারত। ১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতা দখলের পরেও যুদ্ধ ঘোষণার সময় পর্যন্ত নলিনী বার্লিনে তার রেস্তোরাঁ চালিয়ে যাচ্ছিলো। যে সকল বিদেশীর গায়ে এতটুকুও কমিউনিজমের গন্ধ ছিল তাদের হিটলার জার্মানীতে থাকতে দেয়নি। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলেই জার্মানী ছেড়ে পালিয়েছিলেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিটলারের দ্বারা গিরেতার হয়েছিলেন। শুনেছি তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠাগ্রজের পৌত্র ছিলেন বলে সে যাত্রা বেঁচে যান। যদিও প্রকৃতপক্ষে নলিনী গুপ্ত কমিউনিস্ট ছিল না, তবুও তার গায়ে প্রচুর কমিউনিজমের গন্ধ মাখানো ছিল। সে বেশ কয়েকবার মস্কো যাতায়াত করেছে। ভারতবর্ষে সে একটি ‘বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায়’ আসামী ছিল। সেই নলিনী হিটলারের ক্ষমতা দখলের ওপরেও কি করে বার্লিনে রেস্তোরাঁ চালিয়ে গেল?

বিভিন্ন দেশের উচ্চস্তরে গবর্নমেন্ট আর গবর্নমেন্টের মধ্যে একটি ব্যবস্থা থাকে। এই ব্যবস্থায় এক দেশের গবর্নমেন্ট আরেক দেশের এজেন্টকে নিজের দেশে থাকতে দেয়। যেমন নলিনীকে হিটলার বার্লিনে থাকতে দিয়েছিল। সে বার্লিনের ভারতীয় বাশিন্দাদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টকে রিপোর্ট পাঠাত। এই ব্যবস্থায় আবার হিটলারের এজেন্টও লন্ডনে ছিল। সেই দেশের জার্মান বাশিন্দাদের সম্বন্ধে সে নিজ দেশে রিপোর্ট পাঠাত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে নলিনীকে ভারতে চলে আসতে হয়। দেশে ফিরে সে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগযোগ করেনি। তার হুকুমে তার ছোট ভাইপো সুনীলের (তার খুড়তুত বা জেঠতুতো ভাইয়ের ছেলে) আবদুল হালীমের নিকটে আসা বারণ ছিল। নলিনী দিল্লিতে টমাস কুকের অফিসে কিছুদিন চাকরিও করেছিল। কি করে সে চাকরি পেল?

নলিনীর কথা আমি এখানেই শেষ করব। পুলিসের নিকটে তার বিবৃতির পর বিবৃতি দেওয়ার কথা যদিও আমরা কিছু জানতেম না তবুও ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তাকে আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল। সে আমার সঙ্গে ১৯২৭ সালে অনেক দুর্ব্যবহারও করেছিল। তবুও তার সম্বন্ধে একখানা পত্র আমি বিদেশে লিখেছিলাম। ডক্টর গঙ্গাধর অধিকারী জার্মানী হতে দেশে ফিরে আসার পর (১৯২৮) কলকাতায় আসেন। তখন তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করেন নলিনী গুপ্তকে বিদেশে অনেকে স্পাই (গুপ্তচর) মনে করেন। আমার তার সম্বন্ধে কি মত? আমি বলেছিলেম সে যে স্পাই এ প্রমাণ পাইনি। ডক্টর অধিকারী বললেন কথাটি তবে জার্মানিতে জানিয়ে দিন। আমি তাই করেছিলেম। আজ আমি এ সম্বন্ধে অনুতপ্ত। নলিনীর সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ যে ছিল না এমন কথা তো নয়। তার স্পাই হওয়া সম্বন্ধে আজকের মতো প্রমাণ যে পাইনি এ কথা যেমন সত্য, আবার মনে সন্দেহ যে ছিল একথাও সত্য। সেই কথা তো আমি লিখতে পারতাম। নলিনীর উপদলীয়তায় আমি ত্যক্ত ও বিরক্ত ছিলেম। তবুও তার সম্বন্ধে আমি দুর্বলতা প্রকাশ করেছি। এ কথা মনে পড়লেই আমি অনুতপ্ত হই।

মিয়াদ পুরো হওয়ার আগে আমার কারামুক্তি

পুরো ১৯২২ সাল ও ১৯২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমার শরীরের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার টিউবারকিউলোসিস এই কারণে হয়েছিল। ১৯২৩-২৪ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন বি.জি. মালিয়া আই. এস এস. আমার অসুখ টের পেয়েছিলেন। সেই জন্যে তিনি সেল (Six cells) হতে বার করে আমায় অনেকগুলি দরওয়াজাওয়ালা একটি ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন। আমার অসুখের কথা তিনি আমায় কিছু বলেননি। কিন্তু জেলের বাইরে তাঁর সঙ্গে আমার যখন একবার দেখা হয়েছিল তখন তিনি আমায় বলেছিলেন যে ঢাকা জেলে আমার রোগ তাঁর নিকটে ধরা পড়েছিল।

১৯২৪ সালের জুলাই মাসের এক রাত্রিতে রায়-বেরেলি জেলে আমাকে একা একটি বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল শুধু একজন কয়েদী। নিকটে কোথাও একজন জেলের ওয়ার্ডার ছিল। আমার সামান্য কাশি হলো, তারপরে আমার মুখ দিয়ে অনেক রক্ত পড়ল। থুথু ফেলার কোনো পাত্র ছিল না, সব রক্ত আমি মেঝেয় ফেললাম। যুক্ত প্রদেশে (উত্তর প্রদেশ) জেলের মেঝে কাঁচা অৰ্থাৎ মাটির। সকালে জেলের ডাক্তার (সাব অ্যাসিস্টান্ট সার্জেন) এসে মাটি চেঁছে সব কিছু ফেলে দিলেন। বেলা হতে জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ডাক্তার ডি.কে. মুখার্জি এলেন। তিনি আবার রায়-বেরিলি জেলার সিবিল সার্জেন। পাইওরিয়ার জন্যে আমার মাঢ়ী খুব খারাব ছিল। তিনি বললেন, রক্ত মাঢ়ী থেকে এসেছে। আমার দিক থেকে আর কিছু করার ছিল না, তবে ডাক্তার মুখার্জি আমার খবর নিতেন ও মাঝে মাঝে আমায় পরীক্ষাও করতেন! এর মধ্যে তিনি কোথায় কি কি রিপোর্ট পাঠাতেন তা আমি জানতে পেতাম না। একদিন তিনি এসে আমায় বললেন যে আমায় আলমোড়া ডিসট্রিক্ট জেলে পাঠানো হবে। আরও বললেন লোকে আলমোড়ার মতো হিল স্টেশনে চেষ্টা করেও খরচের জন্যে যেতে পায় না, আর তুমি স্টেটের খরচে যাচ্ছ। যত পার খাওয়ার চেষ্টা করবে।

আমি যেদিন আলমোড়া গেলাম সেদিনই প্রথম আমার হিস্ট্রির টিকিটে লিখে দেওয়া হলো Incipient Tuberculosis (প্রাথমিক যক্ষ্মা রোগ)। আলমোড়া জেল উঁচু পাহাড়ের উপরে ছিল। সিপাহীরা আমায় ধরে ধরে সেই উঁচুতে তুলেছিল। যেদিন আমি ওই জেলে পৌঁছেছিলেম তার পরের দিন সকালে গবর্নমেন্টের নিকট হতে চিঠি এলো যে ভারত গবর্নমেন্ট স্বাস্থ্যের কারণে আমায় বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছেন। যতটা মনে পড়ে তারিখটি ছিল ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৫।

আমাকে নিয়ে সরকারী মহলে কি লেখালেখি হয়েছিল তা আগে কোনো দিন জানতে পাইনি। হাল আমলে জাতীয় মুহাফিজখানায় দলীলগুলি সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত হওয়ায় কিছু কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। নীচে সেগুলি উদ্ধৃত করলাম :

Jail Form No. 61.

(To be submitted in Duplicate)

Statement of [?] prisoner recommended for release on account of bodily infirmity, from the district Jail at Rae-Bareli.

1. Name of Prisoner-Muzaffar Ahmad

No. 6575 (Bolshevik Prisoner)

2. Sex-Male, Age 31 Years

3. Caste And profession-Bengali (Muslim) Journalist.

4. Crime 121-A, I.P.C.

5. Sentence and date-4 Years R.I. On 20.5.1924

6. By What authority passed-Sessions Judge, Cawnpore.

7. Unexpired Perion-2 Years 9 Months 12 days.

8. Nature of Complaint in Consequence of which release is recommended, and a brief history of the disease. -Incipient Tuberculosis.

Since His admission into the jail on 5.7.1924 [৪২] he has been slowly losing health and for the last two months the decline has been rather rapid. For the last fortnihgt he has been getting and irregular type of fever: his weight when he came in was 95 ibs. [43] Which has gone down to 81 ibs. and he has been reduced all most to bone skin. I am of opinion that he has been suffering from Incipient Tuberculosis.

9. Declaration of the Surgeon: Certified that-

(a) the disease is likely to prove fatal if the prisoner remains in prison;

(b) there is reasonable chance of recovery if the prisoner is released;

(c) the disease has not been produced or aggravated by any wilful act on the part of the prisoner.

Sd. D.K. Mukherji

Officewr in Medical Charge of Jail

[42. Race-Bareli Jail on 8th July, 1924. (M.A)

43. My weight was 112 ibs when I was admitted into cawnpore Jail, (M.A)]

10. Opinion and remarks by officer in Charge of Jail.

No. 1153

Dated 7th August, 1925

Released recommended and submitted to the Inspector General of Prisons, United Provinces of Agra and Oudh, For necessary action.

The Medical Officer Recommends the release and certifies to conditions (a), (b), and (c)

1. Yes, he has relatives to look after him if released.

Sd. D.K.Mukherji,
Superintendent of Jail.

11. Remarks and recommendation by Inspector General of Prisons.

No. 1868/E38

Dated Lucknow 8.8.1925.

Reference this office D.O.No. 1518/31.7.25

Submitted to the Deputy Secretary to Government, United Provinces of Agra and Oudh, Judicial (Criminal) Department, with the remark that the prisoner may be released, his weight has fallen greatly and the Superintendent reports that he is losing health rapidly.

Sd. Illegible

Lt. Col. I.M.S.

Offg. Inspector General of

Prisons, United provinces of Agra and Oudh.

No. 5097

From

J.R.W. BENNETT, Esqur. I.C.S

Deputy Secretary to the Government of India

Home Department (political)

Dated Nainital, August 31, 1925.

Subject: Proposed release on medical grounds of Prisoner Muzaffar Ahmad of the Bolshevik Conspiracy Case. Judicial (Criminal) Department

Sir,

I am directed to refer to the correspondence ending with the Home department letter No. D-1613/25-Poll., dated July 13,1925, and to forward for the orders of the Government of India the roll of prisoner Muzaffar Ahmad No. 6575 Convicted in the Bolshevik Consipiracy CAse who is at present confined at the District Jail at Rae-Bareli.

2. It will be observed that the prisoner is suffering from incipient tuberculosis and has been slowly losing weight since his admission into the Rae-Bareli on July 5 [44] 1924. During the last two months his decline is reported to have been rather rapid. His weight which on admission was 95 Ibs. is now only 81 Ibs. and he has lately been suffering from irregular attacks of fever.

[44. July 8. 1924 (M.A)]

3. As consumption of this type is often fatal and the patient way sink rapidly the Governor in Council recommends that the Government of India may be moved to sanction the release of Muzaffar Ahmad as early as possible. Pending the receipt of the orders of the Government of India the Governor in Council has directed the transfer of the prisoner from the Rae-Bareli to the Almora District Jail.

I have the honour to be,

Sir,

Your most obedient servant,

Sd. J.R.W. Bennett

Deputy Secretary

Telegrams/Express

No. 1-278/25.

Political Branch: Dated 5th September, 1925.

To

UPAO,

NAINITAL

Your letter 5097 dated 31st August. Government of India agree to release Muzaffar Ahmad.

I should like the Home Department to see Ps 2, 7 and 10 of the file in regard to the recent activities of Muzaffar Ahmad, one of the convicts in the cawnpore Conspiracy Case, Who was released last year on medical grounds of ill health.

From the U.P. letter (P.U.C.) it appears that Muzaffar Ahmad was released unconditionally, and presumably therefore, he violated no undertaking by again taking a prominent part in communist activities. At the same time, the fact that a man like Muzaffar Ahmad Can with impunity resume his old ways almost immediately on the top his release cannot but leave an unfortunate impression on the public mind. The judgement in the Cawnpore Conspiracy Case- especially that of the Allahhabad High Court was of the greatest service to the Government in that it convinced those members of the public who were open to conviction of the reality and of the potentian danger of Bolshevik intrigues in India. Now, however, they see that Muzaffar Ahmad is again out of the jail, and although it was only a short time ago that he was wentenced, is againg openly flaunting himself as an active Communist. Under these circumstances, the public can hardly be blamed if they make up their minds that the Government do not take a serious view of activities of the kind that earnde Muzaffar Ahmad and his fellow plotters their punishment. If any such impressio were to arise, it would be in every way unfortunate. If it is a fact that Muzaffar Ahmad was released absolutely unconditionally, his speedy return to his old courses points the moral that men o his kidney should never be released except on strictest condions of continued good behaviour. If Muzaffar Ahmad is sufficiently resorted to health to be able to do what he is reported to be doing, proper place for him is in jail, and it is unfortunate that the conditions of his release preclude us from sending him back there.

Sd. D. Petri

Let me see our papers about muzaffar Ahmad’s release.

20.1.26

Sd. J.Crerar

21.1.26.

In their dated the 31st August, 1925 the U.P. Government recommended the release fo Muzaffar Ahmad in view of the state of his health caused by incipient tuberculosis and Government of India merely conveyed by telegram their sanction to the proposal.

Sd. J.Mc.D.

22.1.26

D.I.B Should see the pp. I regret they were not shown to him at the time. In such cases in future the alternative of conditional suspension or remision should be examined. The difficulty of course is that the conditions must under the law be accepted by the prisoner. In the present case there was little chance of this and the medical reports indicated that he should be released at once.

Sd. J. Crerar.

25.126

As a matter of fact, I was shown the home Department papers about the actual release of Muzaffar Ahmad, but I was not aware whether it was conditional or unconditional. It is of Course, correct that any condtions of release must be accepted by the prisoner, but I would strongly recommend that in such future cases the alternative of Conditional suspension or remission be examined, as is proposed in Secretarty’s note, I fancy we should have more acceptance than refusals.

In this particular case Muzaffar Ahmad has mad us look rather Foolish. What is more, he seems to be back in the movement agin “With both feet”.

Sd. D. Petrie

27.1.26

জেল ফর্ম নম্বর ৬১

(দু’খানা দাখিল করতে হবে)

শারীরিক অশক্ততার জন্যে রায়-বেরিলি ডিস্ট্রিক্ট জেল হতে মুক্তির জন্যে সুপারিশ করা বন্দীর বিষয়ে বর্ণনা।

(১) কয়েদীর নাম—মুজফফর আদ (বলশেভিক কয়েদী),

(২) পুরুষ বা স্ত্রী-পুরুষ, বয়স ৩১ বৎসর;

(৩) জাতি ও পেশা-বাঙ্গালী (মুসলমান), সাংবাদিক;

(৪) অপরাধ-১২১-এ ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন;

(৫) দণ্ড ও দণ্ড প্রাপ্তির তারিখ চার বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড,  ২০.৫.১৯৯৪;

(৬) কে সাজা দিয়েছেন-দায়রা জজ্, কানপুর

(৭) যে সাজা দিয়েছেন-দায়রা জজ্, কানপুর

(৭) যে সাজা এখনও খাটতে বাকী আছে-২ বৎসর ৯ মাস ১২ দিন

(৮) যে রোগের জন্যে মুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে এবং রোগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-প্রাথমিক যক্ষ্মা রোগ। ৫.৭.২৪ [৪৫] তারিখে কয়েদীর এই জেলে ভর্তির তারিখ হতে ধীরে ধীরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে এবং গত দু’মাস দ্রুত স্বাস্থ্যবান ঘটছে। গত এক পক্ষকাল তার অনিয়মিত জ্বর হচ্ছে। এ জেলে ভর্তি হওয়ার সময়ে তার শরীরের ওজন ছিল ৯৫ পাউন্ড। সেই ওজন কমে এখন ৮১ পাউন্ডে নেমেছে। [৪৬] সে এখন প্রায় অস্থিচর্মসার হয়ে পড়েছে। আমার মত এই যে সে এখন প্রাথমিক যক্ষ্মা রোগে ভুগছে।

[45. ৮ই জুলাই, ১৯২৪ (মু. আ.)

46. ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুর জেলে ভর্তি হওয়ার সময়ে আমার ওজন ১১২ পাউন্ড ছিল। (মু. আ.)]

(৯) সার্জনের ঘোষণা।

আমি নিশ্চিতরূপে জানাচ্ছি যে-

ক) কয়েদী যদি জেলে থেকে যায় তবে এই রোগ তার মৃত্যু ঘটাতে পারে;

(খ) কয়েদীকে মুক্তি দিলে একটা সঙ্গত সম্ভাবনা আছে যে সে আরোগ্য লাভ করতে পারে;

(গ) কয়েদী নিজে এই রোগের সৃষ্টি করেনি এবং ইচ্ছাপূর্বক তাকে বাড়ায়ওনি।

স্বাক্ষর, ডি. কে. মুখার্জি

জেলে চিকিৎসার ভারপ্রাপ্ত অফিসার

(১০) জেলের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের মত ও মন্তব্যঃ

নম্বর ১১৫৩

৭ই আগস্ট, ১৯২৫

মুক্তির জন্যে সুপারিশ করা হলো। আগ্রা ও অযোধ্যা সংযুক্ত প্রদেশের কারাসমূহের ইনস্পেক্টর জেনেরেলের নিকটে বিহিত ব্যবস্থার জন্যে পাঠানো হলো।

(ক), (খ) ও (গ) শর্তে মেডিকাল অফিসার সুপারিশ করেছেন এবং সার্টিফিকেটও দিয়েছেন।

(১) কয়েদীকে দেখা-শুনা করার জন্যে তার আত্মীয়-স্বজনরা আছেন।

স্বাক্ষর, ডি.কে.মুখার্জি

জেলের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট

(১১) কারাসমূহের ইনস্পেক্টর জেনেরেলের সুপারিশ ও মন্তব্য :

নম্বর ১৮৬৮১/ই ৩৮

লখনউ

৮ই আগস্ট, ১৯২৫

রেফারেন্স : এই অফিসের ডি.ও.নম্বর ২৫১৮/৩১-৭-২৫

যুক্ত প্রদেশের জুডিসিয়েল (ক্রিমিনাল) বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারির নিকট পাঠানো হলো এবং তার সঙ্গে এই মন্তব্য যোগ করা হলো যে কয়েদীকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। তার ওজন অনেক কমেছে এবং সুপারিন্টেণ্ডেন্ট রিপোর্ট করছেন যে কয়েদীর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটছে।

স্বাক্ষর (অস্পষ্ট)

লেফটেন্যান্ট কর্নেল, আই. এম. এস.

কারাসমূহের অস্থায়ী ইনস্পেক্টর জেনেরেল, যুক্ত প্ৰদেশ

নম্বর ৫০৯৭

প্রেরক

আর. ডব্লিউ বেনেট এস্কোয়ার, আই. সি.এস. যুক্ত প্রদেশের গবর্নমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি

ভারত গবর্নমেন্টের সেক্রেটারি হোম ডিপার্টমেণ্ট (পলিটিকাল) বরাবরে নাইনিতাল

৩১ শে আগস্ট, ১৯২৫

বিষয় : কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কয়েদী মুজফফর আহমদকে স্বাস্থ্যবনতির অজুহাতে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব

জুডিসিয়েল (ক্রিমিনাল) ডিপার্টমেন্ট

মহাশয়,

আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে হোম ডিপার্টমেন্টের নম্বর ডি ১৬১৩/২৫ পলিটিকাল, ১৩ই জুলাই ১৯২৫, পত্রে যে লেখালেখি শেষ হয়েছে তার উল্লেখ করে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় দণ্ডিত ৬৫৭৫ নম্বর কয়েদী মুজফফর আমদের নাম যেন ভারত গবর্নমেন্টের হুকুমের জন্যে পাঠিয়ে দিই। মুজফফর আহমদ এখন রায়-বেরেলি ডিস্ট্রিক্ট জেলে আবদ্ধ আছে।

(২) এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে বন্দী প্রাথমিক টিউবার-কিউলোসিস্ রোগে ভুগছে এবং ১৯২৪ সালের ৫ই জুলাই তারিখে রায়-বেরেলি জেলে ভর্তির সময় থেকে ধীরে ধীরে তার ওজন কমে যাচ্ছে। গত দুমাস হতে দ্রুত বেগে তার স্বাস্থ্যবনতি ঘটছে। ভর্তির সময়ে তার শরীরের ওজন ৯৫ পাউণ্ড ছিল। এখন তা কমে ৮১ পাউণ্ড হয়েছে। কিছুদিন আগে হতে তার অনিয়মিত জ্বর হচ্ছে।

(৩) এই ধরনের ক্ষয়রোগ প্রায়ই মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে। রোগী দ্রুত অবসন্ন হয়ে পড়তে পারে। স-পরিষদ গবর্নর সুপারিশ করছেন যে ভারত গবর্নমেন্টের নিকটে আবেদন করা হোক যে তাঁরা যেন যত শীঘ্র সম্ভব মুজফফর আমদের মুক্তি মঞ্জুর করেন। ভারত গবর্নমেন্টের নিকট হতে মুক্তির নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স-পরিষদ গবর্নর কয়েদীকে রায়-বেরেলি জেল হতে আলমোড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমি আপনার বিশ্বস্ত ভৃত্য
স্বাক্ষর, জে. আর. ডব্লিও বেনেট
ডেপুটি সেক্রেটারি

টেলিগ্রাম/ এক্সপ্রেস
নং ১-২৭৮/২৫ পলিটিকাল ব্রাঞ্চ : ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৫

উপাও, নাইনিতাল

আপনাদের ৩১শে আগস্ট তারিখের ৫০৯৭ নম্বর পত্রের জওয়াবে ভারত গবর্নমেন্ট মুজফফর আহমদকে মুক্তি দিতে রাজী হয়েছেন।

এই ফাইলটি, ২.৭ এবং ১০ পৃষ্ঠাগুলির ওপরে হোম ডিপার্টমেন্টর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই পৃষ্ঠাগুলিতে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কয়েদী মুজফফর আমদের সাম্প্রতিক কর্ম-চাঞ্চল্যের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। গত বছর তাকে অসুস্থতা ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সংক্ত প্রদেশের (P.U.C) পত্র হতে বোঝা যাচ্ছে যে কোনো শর্তে আবদ্ধ না করেই মুজফফর আহমদকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই কারণে শর্তে আবদ্ধ না করেই মুজফফর আহমদকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই কারণে এটা বলা যেতে পারে যে কমিউনিস্ট কার্যকলাপে আবার বিশেষরূপে যোগ দিয়ে সে কোনো শর্ত ভঙ্গ করেনি। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা তো এই ঘটল যে মুজফফর আমদের মতো একজন লোক মুক্তি পাওয়া মাত্রই যে সে তার পুরানো পথ ধরল তাতে জনসাধারণের মনে কি দাগ কাটবে? কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার রায়, বিশেষ করে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় গবর্নমেন্টকে খুব বড় করবে সাহায্য করেছে। এই রায় জনসাধারণের সেই অংশের মনে বিশ্বাস জন্মিয়েছে, যাঁরা বলশেভিক ষড়যন্ত্রের কথা বিশ্বাস করতে পারতেন না, যাঁরা ভাবতে পারতেন না যে এর পিছনে বিপদ লুকিয়ে আছে এখন তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন যে অল্পকাল আগে দণ্ডিত হলেও মুজফফর আবার জেলের বাইরে এসেছে এবং কর্মব্যস্ত কমিউনিস্ট হিসাবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় সাধারণকে কোনো দোষই দেওয়া যায় না যদি তাঁরা মনে স্থির করে নেন যে গবর্নমেন্ট সে-সব কাজকে এখনও গভীরভাবে গ্রহণ করেন না, যে-সব কাজের জন্য মুজফফর আহমদ ও তার সঙ্গের ষড়যন্ত্রকারীরা সাজা পেয়েছিল। এরূপ ধারণা যদি সাধারণের মনে জন্মায় তবে তা সব দিক হতেই দুঃখজনক হবে। যদি এই ঘটনা সত্য হয় যে মুজফফর আদ কোনো রকম শর্তের বন্ধন ছাড়াই মুক্তি পেয়েছে তবে তার পুরানো কাজে তার দ্রুত আগমন হতে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে তার মতো স্বভাবের লোককে শর্তের কঠোরতম বন্ধনে না বেঁধে কখনও মুক্তি দেওয়া উচিত নয়। মুজফফর আহমদ যদি প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্য ফিরে পেয়ে থাকে তবে তার যে রকম কাজকর্মের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাতে তার স্থান হওয়া উচিত কারাগারে। দুর্ভাগ্যবশত তাকে যে-ভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে তা আমাদের তাকে আবার জেলে পাঠানোতে বাধা দিচ্ছে।

স্বাক্ষর, ডি. পেট্রি
২০.১.২৬

মুজফফর আমদের মুক্তি সম্বন্ধে আমাদের যে কাগজপত্র আছে আমায় তা দেখানো হোক।

স্বাক্ষর, জে. ক্রেরার
২১.১.২৬

ইউ.পি গবর্নমেন্ট তাদের ৩১শে আগস্ট ১৯২৫, তারিখে মুজফফর আহমদকে তার প্রাথমিক যক্ষারোগ হওয়ার কারণে তার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হওয়ায় মুক্তি দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। ভারত গবর্নমেন্ট শুধু টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাদের মঞ্জুরী জ্ঞাপন করেছিলেন।

Sd. J.Mc.D

ডি.আই.বি (ডিরেক্টর ইনটেলিজেন্স ব্যুরো) এই পৃষ্ঠাগুলি দেখুন। আমি দুঃখিত যে সেই সময়ে তাঁকে এসব দেখানো হয়নি। ভবিষ্যতে এই জাতীয় ব্যাপারে শর্তমূলকভাবে কয়েদ স্থগিত রাখার বা রেমিশন দেওয়ার পাল্টা ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখা হোক। এতে অসুবিধা এই আছে যে শর্তসমূহ আইন অনুসারে বন্দীকেই সই করতে হয়। বর্তমান ব্যাপারে তা পাওয়ার কোনো আশাই ছিল না। কিন্তু মেডিকাল রিপোর্ট নির্দেশ দিচ্ছিল যে রোগীকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিতে হবে।

স্বাক্ষর, জে. ক্রেরার

25.1.26

প্রকৃত ঘটনা বলতে গেলে মুজফফর আর্মদের বাস্তবিক মুক্তি সম্পর্কে হোম ডিপার্টমেন্টের কাগজগুলি আমায় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না মুক্তির নির্দেশ শর্তমূলক ছিল না, বিনা শর্তে। একথা সত্য যে মুক্তির শর্তে বন্দীকেই সই দিতে হবে। তবে, আমি খুব জোরের সঙ্গে সুপারিশ করব যে ভবিষ্যতে এই রকম ব্যাপারে শর্তের বন্ধনে মুক্তি বা রেমিশনের পরীক্ষা যেন করা হয়। সেক্রেটারি তাই করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে এই রকম প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ার চেয়ে গ্রাহ্যই বেশী হবে।

এই বিশেষ ব্যাপারে মুজফফর আহমদ আমাদের বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। তারও বেশী এই হলো যে মনে হচ্ছে, সে আবার আন্দোলনের ফিরে এলো এবং ফিরে এলো “দুপায়ে হেটে” (‘With both feet’)

স্বাক্ষর, ডি. পেট্রি

২৭.১.২৬

ডেভিড পেট্রি কি চেয়েছিলে? তিনি কি চেয়েছিলেন যে জেল হতে মুক্তি পাওয়ার পরে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাই? আমি তাঁকে খুশী করতে পারিনি। মানুষের জন্ম শুধু একবারই হয়। কাজেই পৃথিবীতে কে না বেঁচে থাকতে চান? আজ যে আমার আশি বছর বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে, আমার বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ফুরিয়ে যায়নি। সার ডেভিড পেট্রি বোধ হয় এ পৃথিবীতে আর নেই।

আমি আলমোড়ায় জেল হতে মুক্তি পেয়ে সেখানে তিন মাসের বেশী কাল ছিলেম। স্বাস্থ্য কিছু ভালো হয়েছিল। আলমোড়া হতে দেরাদুন (উসমানীকে দেখতে গিয়েছিলেম) ও কানপুর হয়ে ১৯২৬ সালের ২রা জানুয়ারী তারিখে কলকাতা ফিরেছিলেম। এখানে ফিরেই ৩৭, হ্যারিসন রোডের দোতালায় ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজান্টস পার্টির (তখন নাম ছিল লেবর স্বরাজ পার্টি) অফিসে মেঝেয়বিছানা পেতেছিলেম। ২০ শে জানুয়ারী তারিখে ডি. পেট্রি ভারত গবর্নমেন্টের হোম সেক্রেটারি মিস্টার ক্রেরারের নিকটে আমার কর্মচাঞ্চল্য সম্বন্ধে একটা রিপোর্ট দাখিল করেছিলেন। এখন এসব পুরানো রিপোর্ট পড়ে আমি আশ্চর্য হয়েছি যে দু’সপ্তাহের ভিতরে আমি এমন কি কাজ করেছিলেম যার জন্য পেট্রি এত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন? এই ফাইলটি আমি দেখতে চেয়েছিলেম যার জন্য পেট্রি এত বিচলিত হয়ে পড়েছিলে? এই ফাইলটি আমি দেখতে চেয়েছিলেম কিন্তু আমার বন্ধুরা তা খুঁজে পাননি। ১৯২৬ সালে তা আমি প্রায়ই অসুস্থ থাকতাম। তা ছাড়া, পেট্রিরা আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখে (Surveillance) আমার সারা রাজনীতিক জীবনকে বিষময় করে রেখেছিলেন। ডেভিড পেট্রির নিযুক্ত-করা লোক জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টা তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি পর্যন্ত হয়েছিল। পরে সে আমাদের নিকটে ধরা পড়ে যায়। হালে শুনেছি এই লোকটি মারা গেছে।

কানপুর কমিউনিস্ট কনফারেন্স

কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আসামী করার জন্যে সরকার পক্ষ তেরটি নামের একটি তালিকা তাঁদের কৌসুলীদের নিকটে দাখিল করেছিলেন। সেই তালিকায় শেষ নামটি ছিল সত্যভক্তের। গবর্নমেন্টের কৌসুলিরা সত্যভক্তের নাম সহ পাঁচটি নাম কেটে দেন। আগেই বলেছি যে নাগপুর হতে ‘প্রনবীর’ নামে একখানি হিন্দী সাপ্তাহিক তিনি বার করতেন। পুলিস রিপোর্ট হতে আমরা জানতে পারছি যে ডাঙ্গের ‘সোশ্যালিস্ট’ বার হওয়ার পরে তিনি ডাঙ্গের সঙ্গে পত্র লেখালেখি করতেন এবং কি কি বই পড়বেন তা জানতে চাইতেন। আমাদের মোকদ্দমা শুরু হওয়ার আগে কোনো সময়ে তিনি কানপুরে উঠে এসেছিলেন এবং ওই শহরের পটকাপুরে একটি পুস্তকের দোকান খুলেছিলেন। পুস্তক সে দোকানে কি পরিমাণে ছিল তা জানিনে, তবে তাঁর ‘সোশ্যালিস্ট বুক শপে’র বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো।

ইনটেলিজেন্স বিভাগের লোকেরা যে কানপুর মোকদ্দমার আসামীর তালিকায় সত্যভক্তের নামও ভুক্ত করেছিলেন, আর ভারত গবর্নমেন্টের কৌসুলিরা সে নাম কেটে দিয়েছিলেন, এ খবর কি তিনি জানতেন? আমার মনে হয় তিনি তা জানতেন না। আমরা হাল আমলে জাতীয় মুহাফিজখানায় দলীলপত্র পড়েই শুধু এ খবর জেনেছি। খবরটি সত্যভক্তের জানা থাকলে তিনি কানপুরে তাঁর ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’র গঠনে কিছুতেই এগিয়ে আসতেন না। বড় ভীরু ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা হতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে, তাঁর প্রেরণার উৎস যদি আর কোথাও থাকে সেটা আলাদা কথা।

কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার হাই কোর্টের আপীল ডিমিস্ হয়েছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখে। সত্যভক্ত তার জন্যে অপেক্ষা করেননি। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে ( কেউ কেউ ১০ তারিখও বলেছেন) তিনি কানপুরে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ (The Indian Communist Party) গঠিত হওয়ার কথা ঘোষণা করে দিলেন। সেই সময়ে কলকাতার একখানি সংবাদপত্রে তিনি লিখলেন যে “In the Cawnpore Bolshevik Conspiracy Case it has been settled that to have faith in Communism in itself is no offence. Thus the fear of the law against Communism has been removed. “[47]

[47. Quoted by Col. C. Kaye in his “Communism in India”, Page 143]

[“কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় এটা স্থির হয়ে গেছে যে কমিউনিস্ট মতবাদে বিশ্বাস করা কোনো অপরাধ নয়। অতএব কমিউনিস্ট মতবাদের বিরুদ্ধে যে আইনের ভীতি আছে তা দূরীভূত হয়েছে।”] (কর্নেল সি.কে. লিখিত ‘কমিউনিজম্ ইন্‌ ইন্ডিয়া’ নামক পুস্তকের ১৪৩ পৃষ্ঠা।)

সত্যভক্ত প্রচারিত দুটি ইংরেজি বিজ্ঞপ্তি আমরা দেখেছি। প্রথম বিজ্ঞপ্তি প্রচারের তারিখ ১৮ই জুন, ১৯২৫। তার শিরোনাম হচ্ছে ‘The Future Programme of the Indian Communist Party’ (ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্য-কর্ম পদ্ধতি)। দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তির শিরোনাম ‘The First Indian Communist Conference’ (প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট কন্ফারেন্স)। আগেকার বিজ্ঞপ্তির মতো এ বিজ্ঞপ্তিও কানপুর হতে প্রচারিত, তারিখ, ১২ই অক্টোবর, ১৯২৫। আমার এই পুস্তকে ক্রমশই স্থানাভাব ঘটছে। পুস্তকের এই খণ্ডটিতে যদি আমি এই দু’খানি দলীল তুলে দিতে পারতাম তবে তথ্যানুসন্ধাকারীদের পক্ষে সুবিধা হতো। কিন্তু দিতে পারা গেল না।

প্রথম দলীলখানার নাম ‘প্রোগাম’ হলেও তাতে কোনো প্রোগ্রাম নেই। তাতে ‘ফ্রিডম’ (মুক্তি) ও ‘স্বরাজ’ এই দু’টি কথা আছে। অন্য কিছু তো দূরের কথা তাতে ‘পরিপূর্ণ স্বাধীনতা’র কথা পর্যন্ত নেই। মাওলানা হৎ মোহানী, যিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আমদাবাদ অধিবেশনে (১৯২১) সর্বপ্রথম পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি কি করে কানপুরে সত্যভক্তের বাচালতা সহ্য করলেন তা বুঝি না। কানপুর কমিউনিস্ট কন্ফারেন্স অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান হিসাবে যে বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন তা প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। সত্যভক্তেরই মত তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ার আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্যে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু আন্তর্জাতিকতার তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পরে তিনি অত্যন্ত কাপুরুষতা প্রদর্শন করেছিলেন। মোকদ্দমায় আমাদের সাজা হয়ে যাওয়ার ব্রিটিশ ও ভারত গবর্নমেন্টের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। ভারতে যে বলশেভিকবাদের প্রবেশ ঘটছে সেটা প্রমাণিত হয়েছিল। সেজন্য ভারত গবর্নমেণ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে একক সিঙ্গারাভেলুর বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা চালানোর আর প্রয়োজন হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা তুলে নেওয়ার কাজ অগ্রসরই হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর আর তর সইল না। তিনি পুলিসের নিকটে “Unqualified apology” (নির্জলা মার্জনা ভিক্ষা) চেয়ে বসলেন। [৪৮]

[48. The Government, having accepted and unqualified apology tendered by Singaravelu Chettiar of Madras,…Passed orders for withdrawl of the Charge Against him. (Extract from the “Pioneer” 30.6.24) Home Deptt. Foll. File NO. 261.1924.]

ক্রমে আমাদের চোখের সামনে পুরানো কাগজপত্র বের হয়ে পড়েছে। আমরা সে সব পড়ছি আর স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। কী ক্ষতিই না এ সব লোক আমাদের পার্টির করেছেন!

খুব সুখের বিষয় যে সেই সময়ের কমিউনিস্টরা সত্যভক্তের মতের সমর্থন করেননি। সত্যভক্ত শেষ পর্যন্ত কন্ফারেন্সে থাকলেন না। একটি খদ্দরের ঝোলার ভিতরে তাঁর কাগজপত্র ভরে নিয়ে তিনি সেই যে চলে গেলেন তারপরে তাঁর সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। সম্প্রতি খবর পেলাম যে তিনি বেঁচে আছেন এবং বৃন্দাবনে বাস করছেন। তুলসীমালা কণ্ঠে ধারণ করছেন কিনা সে খবর পাইনি।

কনফারেন্স হতে চলে যাওয়ার পর তিনি আর একটি “National Communist Party” (জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি) গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন। কাগজে লেখালেখিও করেছিলেন, কিন্তু সফলকাম হননি। চলে যাওয়ার সময়ে সত্যভক্ত তাঁর পার্টির কাগজপত্র, সভ্যদের নামের তালিকা ও হিসাব ইত্যাদি দিয়ে যাননি। আমরা হসরৎ মোহানী সাহেবকে ছাড়া আর কিছুই পেলাম না, তাঁকেও আমাদের ছাড়তে হয়েছিল।

সত্যভক্ত কেন সাত তাড়াতাড়ি কমিউনিস্ট পার্টির গঠিত হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, কেন তিনি হাইকোর্টের ফয়সালা কি হবে তা জানার জন্যে কয়েকটি দিনও অপেক্ষা করলেন না, কী তাঁর এই কাজের গূঢ় অর্থ ছিল তা বোঝা মুশকিল। তিনি না করলে কি এই কাজটি অন্য কেউ করতেন? তার বিজ্ঞাপিত কমিউনিস্ট পার্টিতে কিন্তু কমিউনিস্ট মতবাদের একটুকু গন্ধও মাখানো ছিল না।

আমি আগেই বলেছি যে আলামোড়া জেলে মাত্র একরাত্রি বাসের পরে আমি জেল হতে মুক্তি পাই। সেখানেই স্বাস্থ্যোদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেম। সত্যভক্তের নিকট হতে পত্র পেলাম যে কানপুরে কমিউনিস্ট কনফারেন্স হচ্ছে। আমি কেন অবশ্যই যোগ দিই। মনি-অর্ডার যোগে ত্রিশটি টাকাও তিনি আমায় পাঠিয়েছিলেন।

কানপুরে এসে যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তাঁরা ছিলেন লাহোরের শামসুদ্দীন হাস্সান, বোম্বের এস.ভি.ঘাটে, কে. এন. জোগলেকর, আর, এস, নিম্বকর, বিকানীরের জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টা, ঝান্সীর আযোধ্যাপ্রসাদ ও মাদ্রাজের সি, কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার। অযোধ্যাপ্রসাদ আমায় বলেছিল সে কৃষ্ণস্বামী রাজগোপালচারীর ভ্রাতুষ্পুত্র। পরে কৃষ্ণস্বামী নিজেও তা আমায় বলেছিলেন মাওলানা হৎ মোহানী ও মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সঙ্গে দেখা তো হয়েছিলই। আর্জুনলাল শেঠী ও কুমারানন্দের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। আরও একজন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁর নাম রাধামোহন গোকুলজী। হিন্দী লেখকদের মধ্যে সম্মানিত ও হিন্দী সাহিত্য সম্মেলনে একজন নেতা ছিলেন তিনি। নেপালে গিয়ে তিনি নির্বাসিত মহেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে দেখাও করে এসেছিলেন। এটাও ছিল তাঁর একটি ‘বিপ্লবী’ পরিচয়। শামসুদ্দীন হাসানের নামের উল্লেখ বারে বারে আমাদের মোকদ্দমায় হয়েছে। ডাঙ্গের সংস্রবে জোগলেকর ও টি.ভি. পার্বতের নামেরও আমাদের মামলায় উল্লেখ হয়েছে। কানপুরে পার্বতে আসেননি। নলিনী ও ডাঙ্গের কথাবার্তার ভিতর দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ লজ্ ও ঘানের নাম এসেছে। নলিনী বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ লজের টেবিলে তিনি আমাদের সাহিত্য ছড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। মুলসীপেটা সত্যাগ্রহের সংস্রবে ডাঙ্গে তার ‘বন্ধু’ নিম্বকরের নাম বলেছিল। তাঁদের কারুর সঙ্গে আমার আগে কখনও ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। আমি কানপুর মোকদ্দমার আসামী ছিলাম বলে তাঁরা আমার নাম জেনেছিলেন। অনেকে লিখেছেন কানপুর কনফারেন্সের কাজে জোগলেকর বড় বেশী খেটেছে। আমার চোখে কিন্তু তা পড়েনি। আমি ঘাটেকেই বেশী খাটতে দেখেছি। টাইপ ইত্যাদি করে দিত। থাকত কনফারেন্সের ছোট তাঁবুতে। জোগলেকর ও নিম্নকর অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভ্য ছিল। জোগলেকর সে বছর অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে প্রথম নির্বাচিত হয়। সে আমায় বলেছিল নির্বাচনে সে কিছু পয়সাও খরচ করেছে। তার কংগ্রেস ক্যাম্পে থাকত। অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভ্য হওয়ার গরমটাই ছিল তাদের ভিতরে বেশী। জানকীপ্রসাদও অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভ্য ছিল। কিন্তু সে কমিউনিস্ট কনফারেন্সের ছোট্ট তাঁবুতে আমাদের সঙ্গে থাকত।

মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামী (পরের মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমারও আসামী) লাহোরের মীর আব্দুল মজীদ কানপুর কমিউনিস্ট কনফারেন্সে যোগ দেয়নি। কিছু কিছু রিপোর্ট এবং কোনো কোনো পুস্তকেও, ভুলক্রমে ছাপা হয়েছে যে আবদুল মজীদ কানপুরে কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিল। একথা সত্য যে আবদুল মজীদ তার অনুপস্থিতিতে পার্টির একজেকিউটিব কমিটির সভ্য নির্বাচিত হয়েছিল। মজীদ প্রবাসে গঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিল। এই পার্টিই তৃতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গীভূত (Section) হয়েছিল।

আর একটি কথা বলা প্রয়োজন। শাপুরজি সালাতওয়ালা ভারতীয়। কিন্তু তিনি ইংল্যান্ডে বাস করতেন। টাটাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। রতন টাটার ভাগিনেয় ও জামশেদপুরের কারখানার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি ছিলেন। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের তিনি সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কারণে তিনি টাটাদের আফিস হতে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সত্যভক্ত সালাতওয়ালার সঙ্গে লেখালেখি ক’রে তাঁকে কানপুর কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট হতে অনুরোধ করেন। আশ্চর্য এই যে সাকলাতওয়ালা কোনো দিক হতে কোনো খবর না নিয়েই তাতে রাজী হয়ে যান। এই খবরটি সারা ভারতে প্রচারিত হয় কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি সাকলাতওয়ালাকে এক অজ্ঞাত কুলশীল কমিউনিস্ট পার্টির কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট পার্টি সালাতওয়ালাকে এক অজ্ঞাত কুলশীল কমিউনিস্ট পার্টির কন্ফারেন্সে প্রেসিডেন্ট হতে বারণ করে দিলেন। ভালোই হলো। তারপর সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। তিনি মতের দিক হতে সত্যভক্তের পক্ষে নিরাপদ ব্যক্তি ছিলেন।

সমস্ত কন্ফারেন্সটি ছিল একটি ছেলেখেলার ব্যাপার। একটি তাঁবুর ভিতরে কে ঢুকছিলেন, কে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছুই বোঝা যাচিছল না। ২৬ শে ডিসেম্বর (১৯২৫) তারিখে, কন্ফারেন্সের অধিবেশনের সময় সত্যভক্তকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সিঙ্গারাভেলুর বক্তৃতায় তরজমা করতে গিয়ে একজন বারে বারে ভুল করছিলেন। জালিব সাহেব কনফারেন্সের ভিতরে বসেছিলেন। তিনি লখনউর বিখ্যাত উর্দু দৈনিক ‘হাম্দমে’র বিখ্যাত সম্পাদক ছিলৈন। তিনি দাঁড়িয়ে উঠে সমস্ত বক্তৃতা উর্দুতে তরজমা করে দিলেন। “বুর্জুআজি”কে (ছাপানো হয়েছিল) আগাগোড়া তিনি ‘বরগিজ’ উচ্চারণ করে গেলেন। দিগ্‌গজ ব্যক্তি ছিলেন ব’লে কেউ কিছু বললেন না।

এস.ভি. ঘাটে ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৬) তারিখে ‘নিউ এজ’ (New Age ) নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকে লিখেছে যে কানপুরের কমিউনিস্ট কন্ফারেন্স গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থীর আশীর্বাদপুত ছিল। সত্যই কি তাই? তাই যদি হবে, তবে বিরাট কংগ্রেস নগরের চৌহুদ্দীর ভিতরের তাঁবু খাটাবার জন্যে একখণ্ড জমি কেন তিনি কমিউনিস্ট কন্ফারেন্সকে দিলেন না? অন্য কত কত সংগঠনকে তো তিনি জমি দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কানপুর কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়েছিল তার অভ্যর্থনা সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থী। এ সব ব্যাপারে তাঁর পরিপূর্ণ ক্ষমতা ছিল। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আমি এখানে বলব না। কিতাব বড় হয়ে যাচ্ছে। কানপুর কমিউনিস্ট কন্ফারেন্সের অধিবেশন হয়েছিল কংগ্রেস নগরের বাইরে রাস্তার অপর পারে কৃষকদের একখণ্ড জমির ওপরে। সাকলাতওয়ালা কানপুর কনফারেন্সে বাণী পাঠিয়েছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু এম. এন. রায় বাণী কখনও পাঠাননি। তিনি এইসব ব্যাপারের কঠোর সমালোচনা ক’রে ঘাটে ও জানকী প্রসাদকে একাধিক দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম কখন স্থাপিত হয়েছিল এবং তা যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গীভূত ছিল প্রমাণসহ তার উল্লেখ আমি অন্য করেছি। সেটাই তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সময়। এই প্রতিষ্ঠার সময় নিরূপণ করার জন্য দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কানপুরের দিকে কেন ছুটলেন? কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কি তাঁদের চোখর বালি ছিল? সহজেই বোঝা যায় ডাঙ্গের প্রভাবে এই ব্যাপারটি ঘটেছে। সত্যভক্তের মতো ডাঙ্গে ও ‘ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টিওয়ালা ছিল। ১৯২৭ সালে ডাঙ্গে জেল হতে মুক্তি পাওয়ার পরে মহারাষ্ট্রের কোনও জায়গা হতে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ সম্বন্ধে সে যা বলেছিল তাতে দেশে-বিদেশে সকলে বুঝেছিলেন যে সে আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাস করে না। এই জন্যে আমাদের ইউরোপ হতে প্রকাশিত ‘The masses of India’ (ভারতের জনগণ) নামক কাগজে ডাঙ্গের অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা হয়েছিল। তারপর হতে ডাঙ্গে এ বিষয়ে চুপ মেরে গেছে। আমার ‘প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন’ (The Communist Party of India and its Formation Abroad) নামক পুস্তক বা’র হওয়ার পরে সে আমাকে দীর্ঘ পত্র লিখেছিল। তাতে মোদ্দা কথা এই ছিল যে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গীভূত হওয়ার কথায় তার সন্দেহ আছে। এই পত্র পাওয়ার পরে কলকাতায় আমাদের পার্টি অফিসে ডাঙ্গের সঙ্গে আমার দেখা এবং কথা হয়েছিল। কমরেড জ্যোতি বসু তখন উপস্থিত ছিলেন, এখানেও সে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সংযুক্তিকরণ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। সে আমায় বলেছিল “ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্বন্ধে যে-ভাষা তুমি ব্যবহার করেছ তা খুব সংযত।” বলা বাহুল্য ডাঙ্গে আমার মূল বাঙলাও পড়েছিল। আশ্চর্য এই যে আমাকে যখন ডাঙ্গের গালি দেওয়ার প্রয়োজন হলো তখন সে বলে বসল যে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতো একজন বৃদ্ধ লোকের প্রতি আমি অসংযত ভাষা ব্যবহার করেছি! যাক, কানপুরের কমিউনিস্ট কন্ফারেন্সকে আমি একটি লজ্জাকর ব্যাপার মনে করি। এর আগে পেশোয়ারে তিনটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হয়ে গেল, কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হলো, আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হলো কিনা সত্যভক্তের তামাসা হতে? আমরা কয়েকজন লোক কানপুরে একটি কমিটি গঠন করেছিলেম। আমরা তা করতে বাধ্য হয়েছিলেম। সত্যভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নামটিকে কলঙ্কিত করছিল। সত্যভক্ত এই ব্যাপার না ঘটালে কমিউনিস্ট পার্টি তো গোপন (Underground) পার্টি হতো, ডাঙ্গে হয়তো সে পার্টিতে থাকত না। কানপুর মোকদ্দমার আগে ডাঙ্গে তার চিঠিপত্রে কখনও লিখত যে সে গোপনতায় বিশ্বাসী নয়। তেমন চিঠি মামলার এক্‌জিবিটে আছে। আবার তার গোপনে লেখা পত্রাদিও এক্‌জিবিটে আছে। যাঁদের সঙ্গে সে পত্রালাপ করছে তাঁদের জানতে না দিয়ে সে নিজের বাড়ীর সর্বজনবিদিত ঠিকানায় গোপন পত্রাদি গ্রহণ ক’রে কমরেডদের ঠিকানা ও পরিচয় পুলিসের নিকটে ফাঁস করে দিত

ওয়ার্কার্স এন্ড পেজানটস পার্টি

প্রথম দেওয়া নামটি দু’তিনবার বদল হয়ে নাম দাঁড়িয়েছিল “ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি”।

স্থাপনার তারিখ ছিল পয়লা নভেম্বর, ১৯২৫। স্থাপনার স্থান বাঙলা দেশের কলকাতা। প্রথমে এই পার্টির ইংরেজি নাম ছিল দি লেবর-স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত শ্রমজীবী স্বরাজ পার্টি)। এই থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠাতারা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে একটি রাজনীতিক দলরূপে গণ্য না করে তাকে একটি রাজনীতিক মঞ্চ হিসাবে দেখেছিলেন। তখন পার্টির বাঙলায় নাম ছিল “ভারতীয় জাতীয়-মহাসাতির শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল”। কিন্তু ইংরেজি নামটিই ছিল আসল নাম। কারণ দেশের অন্যত্র ও বিদেশে এই নামটিই প্রচারিত হয়েছিল। আমরা দেখেছি আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের দৃষ্টিও লেবর- স্বরাজ পার্টি আকর্ষণ করেছিল। ঝেনিয়া জুকফ ইউদিন ও রবার্ট সি নর্থ (Xenia

Jukoff Eudin and Rober C. North, Stanford Universty) Soviet Russia and the East ( সোভিয়েত রাশিয়া এন্ড দি ইস্ট) নামক পুস্তকের ঘটনা তালিকায় (Chronology) ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর তারিখে কলকাতায় “লেবর-স্বরাজ পার্টি” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।

এই পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে আমি আলমোড়ায় ছিলেম। প্রধান উদ্যোগ গ্রহণকারীদের ভিতরে চারজন বিশেষভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের নাম : (১) কুত্সুদ্দিন আহ্‌মদ (Qutbuddin Ahmad) (২) হেমন্তকুমার সরকার (৩) কাজী নজরুল ইস্লাম (Qazi Nazrul Islam) এবং (৪) শামসুদ্দীন হুসয়ন (আবদুল হালীমের জ্যেষ্ঠ সহোদর)। আবদুল হালীমও উদ্যোগীদের ভিতরে ছিল। কিন্তু তার জ্যেষ্ঠাগ্রজ পার্টি গঠনের কাজে থাকায় তার নামটি প্রথম চারজনের মধ্যে ধরা হয়নি। একথা কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আবদুল হালীমকে তার জ্যেষ্ঠাগ্রজ রাজনীতিতে আনেননি। অনুজের অনুসরণ করেই অগ্রজ আমাদের সঙ্গে রাজনীতিতে এসে পড়েছিলেন। কমরেড আবদুল হালীম ভারতের ভিতরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ। তার কার্যারম্ভকাল ১৯২২ সালে, এস এ ডাঙ্গের কিছু আগে বা একই সময়ে। কুদ্দিন আহ্‌মদ সাহেব ১৯২২ সাল হতেই কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন। যদি নজরুল ইসলাম ও আমার খবরের কাগজের কোম্পানী করাকে রাজনীতিক কাজ হিসাবে ধরা যায় তবে বলতে হবে ১৯২১ সাল হতেই তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন।

১৯২০ সাল হতে খবরের কাগজ চালানোর ভিতর দিয়ে নজরুল ইস্লাম আর আমি রাজনীতি করেছি। ১৯২১ সালের শেষাশেষিতে আমরা মার্কসবারে পড়াশুনা করব বলে স্থির করেছিলেম। কিছু পুঁথিপুস্তকও সেই সময়ে কিনেছিলেম। একথা আগে উল্লেখ করেছি।

হেমন্তকুমার সরকার ভাষাতত্ত্বের বিখ্যাত ছাত্র ও স্বর্ণপদকধারী। ভিতরে ভিতরে কোনো ধরনের বৈপ্লবিক রাজনীতিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কিনা তা আমি জানিনে। তবে ডাক্তার সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত কি একটি পার্টিতে সুভাষ বসু ও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। শুনেছি ওটা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টি ছিল না। সুভাষ বসুর সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। পরে দু’জন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টি ছিল না। সুভাষ বসুর সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। পরে দু’জন সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন, কিন্তু কিছুকাল পরে আবার গৃহে ফিরে আসেন। হেমন্তকুমার সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের গবেষণা যখন করেছিলেন তখন হঠাৎ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন যোগ দিয়েছিলেন এবং কয়েক মাস জেলও তিনি খেটেছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গালার কথা’র সহকারী সম্পাদকও তিনি খেটেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরে হেমন্তকুমার কৃষক আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এই সময়ে তাঁর ভূমির মালিক বন্ধুরা তাঁদের শ্রেণীস্বার্থের প্রেরণায় রটিয়ে দিলেন যে তিনি একজন পুলিসের চর।

কলকাতা ৩৭, হ্যারিসন রোডের (একটি বোডিং হাউসের বাড়ী) দোতলায় দু’খানি ঘর ভাড়া নিয়ে এই পার্টির প্রথম অফিস স্থাপিত হয়েছিল।

লেবর-স্বরাজ পার্টির প্রথম গঠন-প্রণালী, প্রোগ্রাম ও পলিসি ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর তারিখেই ৩৭, হ্যারিসন রোড (এখন নাম মহাত্মা গান্ধী রোড) হতে কাজী নজরুল ইস্লামের স্বাক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘লাঙল’-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় (৩১ শে ডিসেম্বর ১৯২৫) এই দলীলগুলি ছাপা হয়েছিল। এই দলীলগুলি আবার ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা’র (১৯২৯-৩৩) পি ৫৪৬ (১৩) নম্বর এক্‌জিবিট।

১৯২৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখে লেবর-স্বরাজ পার্টির (শ্রমিক-প্রজা- স্বরাজ দলের) মুখপত্ররূপে একখানি বাঙলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। তার নাম ছিল ‘লাঙল’। এ পত্রিকার কভারের পৃষ্ঠায় ‘লাঙল’ নামের পরে লেখা থাকত :

প্রধান পরিচালক
নজরুল ইস্‌লাম
সম্পাদক মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়
নগদ মূল্য এক আনা : বার্ষিক তিন টাকা

সম্পাদক হিসাবে মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম ছাপা হতো সত্য, কিন্তু সম্পাদনার কাজ তিনি করতেন না, কিছুই করতেন না। তিনি এক সময় নজরুল ইস্লামের সঙ্গে বাঙ্গালি পল্টনের সৈনিক ছিলেন। তরপরে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে গার্ডের কিংবা তার তলাকার কোনো চাকরী নেন। সেই চাকরী চলে যাওয়ার পরে তিনি নজরুল ইস্লামের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন, আর গান গাইতেন। কৃষ্ণনগরের প্রাদেশিক কন্ফারেন্সে নজরুলের ‘দুর্গম গিরি-কান্তার- মরু’ গান যাঁরা কোরাসে গেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। বহু বৎসর পরে দেখেছিলেম যে তিনি গেরুয়া পরে স্বামী বিরূপাক্ষানন্দ হয়েছেন। এখন বেঁচে নেই। সম্পাদকরূপে তাঁর নাম রাখায় আমাদের কিঞ্চিৎ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখন তার জায়গায় আমাদের একজন বন্ধু, গঙ্গাধর বিশ্বাস সম্পাদক হয়েছিলেন।

১৯২৬ সালের ১২ই আগস্ট হতে ‘লাঙল’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘গণবাণী করা হয়। কাগজের কভারের ওপরে লিখে দেওয়া হয়েছিল (এর সাথে ‘লাঙল’ একীভূত হয়েছে)। নাম পরিবর্তনের কারণ ছিল এই। ‘লাঙল’ নাম হতে বহুলোক মনে করতেন যে ‘লাঙল’ শুধু কৃষকদেরই কাগজ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের কাগজ ছিল শ্রমজীবী জনগণের কাগজ। এবারে নুতন ডিক্লারেশন আমি নিজের নামে নিলাম। ধীরে ধীরে কাগজের ভার আমার ঘাড়ে চেপেছিল। আমি ভাবলাম মিছামিছি ঝুঁকিটা কেন অপর এক ব্যক্তির ওপরে চাপিয়ে রাখি। ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আঘাত আমাদের ওপরেও লাগে। মুলিম নামধারী সম্পাদকের, অর্থাৎ আমার সম্পাদিত ‘গণবাণী’ হিন্দুরা কেনা কমিয়ে দিলেন। তখন আমার সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক রূপে প্যারীমোহন দাশের নাম ছাপা হতে থাকে। তিনি কোনো কাজ করতেন না। পরে কালীকুমার সেনের নামও যুগ্ম সম্পাদকরূপে ছাপা হয়েছে। তিনি কিছু কাজ করতেন।

লেবর-স্বরাজ পার্টির নাম পরিবর্তন

লেবর-স্বরাজ পার্টি নামকরণের সঙ্গে আমার কোনো সংস্রব ছিল না। আগেই বলেছি যখন এ পার্টি গঠিত হলো আমি তখন আলমোড়ায়। পার্টি গঠনের যে চারজন উদ্যোক্তার নামোল্লেখ আমি করেছি তাঁরা নিশ্চয়ই এম এন রায়ের লেখায় ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি’ ও ‘পিপল্স পার্টির নাম পড়ে থাকবেন। কিন্তু এই পার্টি গড়ার সময়ে তাঁদের যে এমন এন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তা আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ, রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে পার্টির নাম হয়তো লেবর স্বরাজ পার্টি হতো না। তা ছাড়া,

“যেহেতু শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ যেমন বলিয়াছেন যে শ্রেণীগত স্বার্থত্যাগী ভদ্ৰ যুবক, শ্রমিক ও কৃষকদের সংযোগ না হলেই ভারতের মুক্তি আসবে না।” এই কথাটা এম এন রায় কখনও পার্টি প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করতে বলতে পারতেন না। কোনো মার্কসবাদী শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের শিক্ষার কথা তুলতেই পারেন না।

এদিকে হেমন্তকুমার সরকার নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশন কৃষ্ণনগরে ডেকেছিলেন। তার প্রথম অধিবেশন ১৯২৫ সালের ৭ই ও ৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বগুড়া শহরে হয়েছিল। ১৯২৬ সালের ৬ই ও ৭ই ফেব্রুয়ারী তারিখে নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশন হেমন্তকুমার সরকারের অহ্বানে কৃষ্ণনগরে হয়েছিল। প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল

১) কৃষক-শ্রমিক দল গঠন

২) বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন

৩) কাউন্সিল নির্বাচন।

এই কনফারেন্সের অভ্যর্থনা সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন হেমন্ত সরকার, আর সভাপতি ছিলেন শাসুদ্দীন আহ্মদ সাহেব, তখন ওখানকার জজ কোর্টের একজন উকীল। ছাত্র জীবন হতে রাজনীতিক আন্দোলনে ছিলেন, পরে বাঙলা দেশের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বাঙলা দেশের বিভিন্ন স্থানে যাঁরা প্রজা ও কৃষক আন্দোলন করতেন তাঁদের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত এডভোকেট ও বাঙলা ভাষার বিখ্যাত লেখক ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত এম এ ডি এল এবং অপর একজন বিখ্যাত এডভোকেট অতুলচন্দ্র গুপ্ত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ডক্টর সেনগুপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে অতুলচন্দ্র গুপ্ত অগ্রসর চিন্তার ধারক ছিলেন। তিনি জমিদারী প্রথার বিরোধী ছিলেন, তখনকার দিনের মতো দেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে তাঁর মত ঘোলাটে ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতাকেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ মনে করতেন।

সম্মিলনের আলোচনায় স্থির হলো যে ‘লেবর-স্বরাজ পার্টির নাম ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’ হবে। ইংরেজীতে হবে ‘The Bengal Peasants’ and Workers Party.’ শ্রেণী হিসাবে মজুরের নামটি আগে আসা উচিত এই তর্ক আমরা ক’জন কৃষ্ণনগরের সম্মিলনে করিনি। প্রজা ও কৃষক প্রতিনিধিদের সামনে এই যুক্তি তুলে বিশেষ লাভ হতো না। আমরা বললাম ইংরেজী শব্দ ব্যবহারের রীতির দিক হতে Workers (ওয়ার্কার্স) শব্দটিকে আগে বসানো উচিত। কারণ, তাতে অক্ষরের সংখ্যা কম। বললাম বাঙলাতেও তো প্রায়ই আমরা এই রকমই করি। আমাদের যুক্তি খুব বেশি সংখ্যক প্রতিনিধিই গ্রহণ করলেন না। কাজেই আমরা ‘The Bengal Peasants’ and Workers Party. (দি বেঙ্গল প্ৰেজাস এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি) নামটি নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম। বাঙলা নামটি ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলই হয়েছিল। কলকাতায় এসে সাইন বোর্ড লেখানো ও লেটারহেড ছাপানোর সময়ে আমি। ইংরেজী নামটিকে ‘The Peasants’ and Workers Party of Bengal. (দি পেজান্ট্স এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি অফ্ বেঙ্গল) করে দিলাম। তাতে কেউ কোনো আপত্তি করেননি। আমাদের কষ্টের জীবন শুরু হলো।

আগেই উল্লেখ করেছি যে ১৯২৫ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে আমি কুমায়ুন পাহাড়ের আলমোড়া ডিসট্রিক্ট জেল হতে মুক্তি পেয়েছিলেম। ক্ষয় রোগাক্রান্ত হয়ে স্বস্থ্যের কারণে হলেও মুক্তির সময় আসর বহু পূর্বে আমার এই মুক্তির ব্যাপারটি ঘটেছিল বলে যাঁরা তখন আলমোড়ায় ছিলেন না তাঁদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। স্থানীয় তরুণ উকীল লাল চিরঞ্জীলালের একান্ত অনুরোধে ও প্রাথমিক সাহায্যে আমি আলমোড়ায় থেকে গেলাম। তিনি বললেন, কত দূর দূর হতে যক্ষ্মারোগীরা আলমোড়ায় স্বাস্থ্যোযেদ্ধার করতে আসেন। আর আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন এ জায়গা ছেড়ে চলে যাবেন কেন?

আমি আলমোড়ায় থেকে গেলাম। কিন্তু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত কোনও প্রকারের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলাম না। তাঁদের মনে সন্দেহের উদ্রেক নিশ্চয় হতে পারে। আমি ভাবলাম তাঁরা যদি আমার বিষয়ে খবর নিয়ে সন্তুষ্ট হন তবে তাঁরাই আমার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবেন। আমি এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ সভ্য, আমার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর তাঁরা অবশ্যই নিবেন।

মুক্তির সাড়ে তিন মাস পরে কানপুরে এসে জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টার সঙ্গে জীবনে আমার প্রথম দেখা হলো। সে একজন বড় কমিউনিস্ট এম এন রায়ের সঙ্গে তাঁর সোজাসুজি যোগাযোগ, এভেলিনের সঙ্গেও ছিল। সে আমায় বলেছিল যে আমার মুক্তির সংবাদ পেয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রথমে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল। পারে তাঁরা খবর নিজে জেনেছেন যে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। আমার মনে হয় শেষের খবরটি জানকীপ্রসাদই দিয়ে থাকবে। প্রকৃত মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে আমায় ‘মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কিনা এ খবর তারই পক্ষে জানার সুযোগ ছিল সব চেয়ে বেশি। কানপুরে জানকীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার এক বছরের ভিতরে আমার গভীর সন্দেহ হয়েছিল, আমি আবিষ্কার করেছিলেমও বলা চলে, জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টা ডেভিড পেট্রির একজন খবরের উৎস। মীরাট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা চলার সময়ে অনেক কাগজপত্রের ভিতরে আমরা এ বিষয়ে জানকীপ্রসাদের স্বহস্ত লিখিত দলীলও পেয়েছিলেম।

ওয়ার্কাস এন্ড পেজান্ট্স পার্টি প্রথমে বাঙলা দেশে (১লা নভেম্বর, ১৯২৫) গঠিত হয়েছিল।

বাঙলা দেশের পরে এই পার্টি বোম্বেতে গঠিত হয়। গঠন করার তারিখ ছিল ৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯২৭। প্রথম সেক্রেটারি এস এস মিরাজকর ও সভাপতি ঢুণ্ডিরাজ ঠেংদী।

বোমের পরে ‘কিরতি-কিসান পার্টি’ নাম দিয়ে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টি’ পাঞ্জাবে গঠিত হয়েছিল। পার্টি গড়ার তারিখ ছিল ১২ই এপ্রিল, ১৯২৮। এটা অবশ্য রেকর্ডে লিখিত তারিখ। ভাগ সিং কানাডিয়ান ও সোহন সিং জোশ কানপুরে ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে (নভম্বর ১৯২৭) এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং স্থির করে যান যে পাঞ্জাবে তাঁরাও মজুর ও কৃষক দল (কিরতি কিসান পার্টি) গঠন করবেন। ডিসেম্বরের (১৯২৭) শেষ সপ্তাহে মাদ্রাজে ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশনে সোহন সিং জোশ আসেনি, ভাগ সিং কানাডিয়ান এসেছিলেন। তিনি রিপোর্ট করে গেলেন যে ডিসেম্বর মাসে (১৯২৭) পাঞ্জাবেও কিরতি কিসান পার্টি গঠিত হয়েছে। আমরা তাঁর কথা বুঝব না ভেবে তিনি মাস্টার তারা সিংকে ডেকে এনে আমাদের ইংরেজীতে বুঝিয়ে দিলেন।

পাঞ্জাবের পরে সংযুক্ত প্রদেশের (উত্তর প্রদেশের) মীরাটে মিলিত একটি কনফারেন্সে ১৯২৮ সালের ১৪ই অক্টোবর তারিখে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টি’ ইউ পি গঠিত হয়েছিল।

আগেই আমরা স্থির করেছিলেম যে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে ডিসেম্বর মাসের (১৯২৮) শেষাশেষিতে কলকাতায় একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন হবে এবং এই কনফারেন্সের সব ক’টি পার্টিকে একীভূত করে একটি সারা-ভারত পার্টির রূপ দেওয়া হবে।

আবার পেছনের কথায় ফিরে যাচ্ছি। বলে রাখা বলো যে কৃষ্ণনগরের কনফারেন্সে বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের (The Peasant’s and Workers’ Party of Bengal) যুক্ত সেক্রেটারি হলেন কুদ্দীন আহ্মদ ও হেমন্তকুমার সরকার। ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রেসিডেন্ট ও অতুলচন্দ্র গুপ্ত ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

বাঙলা দেশে নানা অসুবিধা

কৃষ্ণনগর কনফারেন্সের পরে আমরা সবে ‘বাঙ্গালী কৃষ্ণ ও শ্রমিক দল’ হয়ে ৩৭, হ্যারিসন রোডে বসেছি, এই সময়ে আবদুল হালীম একদিন ধরণীকান্ত গোস্বামীকে সঙ্গে এনে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। হুগলী বিদ্যামন্দিরে তাঁর সঙ্গে আবদুল হালীমের পরিচয়। সে সেখানে মাঝে মাঝে যেত। ভূপতি মজুমদার হতে শুরু করে হামীদুল হক, সিরাজুল হক এবং আরও অনেকের সঙ্গে হালীমের পরিচয় ছিল। প্রথম পরিচয়ের পর হতে ধরণীকান্ত মাঝে মাঝে আসতেন। তিনি বুঝতে চাইতেন এটা কিসের পার্টি। আমরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেম যে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’ ছদ্মাবরণে কমিউনিস্ট পার্টি নয়। কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা রয়েছে। তখন বুঝতে পারিনি, এখন দুষ্প্রাপ্য কাগজপত্র ও পুলিস রিপোর্ট পড়ে বুঝতে পারছি যে ধরণীকান্ত গোস্বামীরা এই জিনিসটিই আমার নিকট হতে ভালোভাবে জানতে চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের কয়েক জন তখন একটি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার জন্যে উদ্যোগ- আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। আমার এই লেখা হতে সকলেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে তখনও ধরণীকান্ত গোস্বামী ও তাঁর বন্ধুরা ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে” (The Peasants’ and Workers’ Party of Bengal) যোগদান করেননি।

গোস্বামী ও তাঁর বন্ধুরা কেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে চেয়েছিলেন তার কারণ এখন খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পুস্তকের লেখা শেষ করার জন্যে আমার মন এখন লেখা সংক্ষেপ করার দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু এখানে খুব সংক্ষেপে বলে গেলে অনেকেরই বোঝার অসুবিধা হবে। তাই কিছুটা খোলাসা করে লেখা প্রয়োজন।

দু’জন ব্যক্তি আগে পরে বার্লিন ও মস্কো গিয়েছিলেন। তাঁদের নাম যথাক্রমে যতীন্দ্রনাথ মিত্র ও গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী। এই দু’জনই নলিনী গুপ্তের অবদান। মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁকে দু’বার ভারতবর্ষে পাঠিয়েছিলেন। প্রথম বার পাঠিয়েছিলেন ১৯২১ সালের শেষাশেষিতে। উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। পরে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর এক পুরানো বিপ্লবী বন্ধুকে লিখেছিলেন যে তাঁদের খবর পাওয়ার জন্যেই তিনি নলিনীকে দেশে পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার “প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ছাত্র সংগ্রহ করে মস্কো পাঠানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে দেশে পাঠানো হয়েছিল। ইরানের ভিতর দিয়েই ছাত্রদের পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। তাদের আগ বাড়িয়ে নেওয়ার জন্যে ইরানের বু’শহরে একজন বিশিষ্ট কমরেডকে বসানো হয়েছিল। আমার সঙ্গে জেলে দেখা হওয়া মাত্রই নলিনী একথা আমায় বলেছিলেন, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমাকে তিনি সত্য কথাই বলেছিলেন। কেননা, তিনি জানতেন না এম এন রায় আমায় এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছেন কিনা এবং জানালে কতটা জানিয়েছেন। যতীন্দ্রনাথ মিত্রের কথা আমি আগে অনেক লিখেছি। এম এন রায় তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন সে কথাও বলেছি। লোকটির ভিতরে কোনো রাজনীতিক প্রেরণা ছিল না। অনুশীলন সমিতির সভ্যও তিনি কোনো দিন ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টির ঘাড়ে চেপে, তার খরচে শুধু জার্মানী হতে কিছু একটা শিখে আসতে চেয়েছিলেন। বোম্বের একটি ঘৃণিত চক্রান্তে অকৃতকার্য হয়ে [৪৯] যতীন্দ্র মিত্রের দেখা হয়নি। নলিনী পুলিসের নিকটে বলেছিলেন, তিনি মস্কোতে জানতে পেরেছিলেন যে যতীন মিত্র বার্লিনে পৌঁছেছেন। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে হামবুর্গ পৌঁছছিলেন। তার পরে নয় মাস তিনি মস্কোতে ছিলেন। ১৯২৫ সালের জুন মাসে তিন ভারতে ফিরেছিলেন।

[49. এ পুস্তকের ২৭৬-২৭৭ পৃষ্ঠায় দেখুন।]

১৯২৩ সালের গিরোরের পরে আমি ১৯২৬ সালের ২রা জানুয়ারী তারিখ কলকাতা ফিরেছিলেম। তার এক-দু’মাস পরে যতীন মিত্র আমার সঙ্গে দেখা করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা করে গেলেন। ৩৭, হ্যারিসন রোডে আমাদের আফিসে মাদুর পাতা ছিল। ট্রাউজার পরা অবস্থায় তাঁর সেখানে বসার অসুবিধা ছিল। বললেন তাড়াতাড়ি আমার নিকট হতে একটি ঠিকানা নিয়ে নিন। পারিসের একটি ঠিকানা। ঠিকানাটি যথাসম্ভব সাবধানে ব্যবহার করতে বলে দিলেন।

বলেছি ধরণীকান্ত গোস্বামী আমার নিকট হতে ক’বার বুঝতে চেয়েছেন “বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল” কমিউনিস্ট পার্টি কি না। বুক কোম্পানী লিমেটেড আমার যাতায়াত ছিল। ধরণী গোস্বামীর সহকর্মী নীরদকান্ত চক্রবর্তী সেখানে হিসাব রক্ষক ছিলেন। তিনিও একবার দু’বার আমায় কমিউনিস্ট পার্টির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি আশ্চর্য হতাম, ব্যাপারটি কি? এখন পুলিস রিপোর্টে, ইত্যাদিতে পড়ছি যে ১৯২৬ সালের ১৬ই এপ্রিল হতে ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতায় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার কনফারেন্স হয়ে গেছে। ধরণী গোস্বামী ও গোপনে চক্রবর্তীদের কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কনফারেন্সটা খুব বাঁধাবাধি ধরনের ছিল না। মনে হচ্ছে পুলিস এটাকে আমাদের কনফারেন্স মনে করেছিল। এই কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সত্যভক্তের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখা হবে না। যাঁরা কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন তারা এম এন রায় যে টাকা পাঠাচ্ছেন না তার জন্যে অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করেন। যতীন্দ্রনাথ মিত্র খুব কড়া ভাষায় মুহম্মদ আলীকে একখানি পত্র লিখেন। তিনজন সভ্য নিয়ে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির একটি ফরেন ব্যুরো ছিল। তাঁরা ছিলেন : (১) মানবেন্দ্রনাথ রায় (২) সি পি দত্ত ও (৩) মুহম্মদ আলী। এই পত্র হতে মিস্টার ডি পেট্রির সম্পাদিত “কমিউনিজম ইন ইন্ডিয়া” কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি করে দেওয়া হয়েছে। আমি সেই অংশটুকু এখানে তুলে দিলাম :

“You People do not realise our difficulties here…..the boss ( Roy) and family are living as princes…and the boys here-real, sincere workers- are starving. You hypocrites mean no business; you are simply exploiters. Your behaviour has created such a bad atmosphere against you that now, except a few of us, all in the Punjab, U. P, Bombay and bengal are losing confidence in you.” (page 107 )

অনুবাদ

“আপনারা উপলব্ধিই করতে পারছেন না যে এখানে আমাদের কি কষ্টের ভিতরে দিন কাটাতে হচ্ছে। ….কর্তা (রায়) ও তাঁর পরিবার তো সেখানে রাজার হালে আছেন, আর এখানে ছেলেরা, তাদের সকলেই সরল ও বিশ্বস্ত কর্মী, উপোস করে মরছে। হে কপটচারীর দল, আপনারা কোনো কাজের কাজ চান না। আপনারা নিছক শোষণকারীর দল ছাড়া আর কিছুই নন। আপনাদের বিরুদ্ধে এমন আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে যে (ধরণীকান্ত গোস্বামী ও গোপেন্দ্ৰ কৃষ্ণ চক্রবর্তীর দলের) আমরা ক’জন ছাড়া, পাঞ্জাব, ইউ পি, বোম্বে এবং বাঙলার সকলেই আপনাদের ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।” (পৃষ্ঠা ১০৭)

যতীন মিত্র তো কোনো দিন আমাদের সঙ্গে কনফারেন্সে বসতেই পারেন না। তিনি ইউরোপ যাওয়ার আগে পুলিসের চরের সঙ্গে দহরমমহরম করেছেন, জার্মানীতে গিয়ে এম এন রায়ের নিকটে সেই চরের হয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছিলেন। আমার নাম করে, যদিও আমি তার ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতাম না, বোম্বেতে গিয়ে চার্লস আশলীকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন। এই লোকের সঙ্গে আমরা কি করে কনফারেন্সে বসতে পারতাম?

নলিনী গুপ্ত যে কাজের জন্যে দ্বিতীয় বার ভারতে এসেছিলেন, সে কাজের কথা অর্থাৎ “প্রাচ্য দেশের শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে” পাঠানোর জন্যে ছাত্র রিক্রুট করার কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তবুও ঢাকায় একজনকে তিনি রিক্রুট করেছিলেন। তাঁর নাম গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী। তিনি ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেন। বয়সেও খুব তরুণ ছিলেন না। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়েও তিনি বন্দীজীবন যাপন করেছিলেন। উনিশ শ’ বিশের দশকে তিনি বিবাহিত ছিলেন। এই অবস্থায় নলিনী গুপ্ত ছাত্র হিসাবেই তাঁকে পাঠাবার ছাড়পত্র দিলেন। তার মানে এম এন রায়ের নামে একখানি পত্র তিনি গোপেন্দ্রকৃষ্ণকে লিখে দিলেন। অনুশীলন সমিতির কোনো পরিচয়পত্র তাঁকে দিলেন না।

ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি গোপেন্দ্র চক্রবর্তীকে কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য বার্লিন হতে মস্কো পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু দারুণ পরিতাপের বিষয়ই বলতে হবে,-যেদিন তিনি মস্কো পৌঁছলেন সেদিনই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দপ্তরে ঢাকা অনুশীলন সমিতির একখানি পত্ৰও পৌঁছাল। তাতে লেখা ছিল যে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী বিশ্বস্ত লোক নয়, অনুশীলন সমিতির নামে তাঁকে যেন কোনো সুখ-সুবিধা না দেওয়া হয়। এর পরে তাঁকে আর “প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে” ভর্তি করা হলো না। তাঁকে নাইডু পদবীধারী দক্ষিণ ভারতীয় পরিচয় দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়। ১৯২৪ সালে বোধ হয় মস্কোতে দক্ষিণ ভারতীয় ছিলেন না, কিংবা কম ছিলেন। সব কিছু হতে আলাদা হয়ে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী মস্কোতে নয় মাস মাত্র ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি তাঁর অনুবাদকারিণীকে (Interpreter) বিয়ে করেন। তাঁর সেখানে কোনো কাজ ছিল না। নয় মাস পরে তাকে দেশে ফেরৎ পাঠানো হয়। তখন তাঁর রুশীয় পত্নী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্বভাবতই তিনি কটিনেন্টাল ইউরোপ হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। পারিসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন-ব্যুরোতে তখন মুহম্মদ আলী ছিলেন। এটা খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে মুহম্মদ আলীর সঙ্গে দেখা করার সময়ে গোপেন্দ্র চক্রবর্তী গভীর মনঃকষ্টে ভেঙে পড়েছিলেন। কি নিয়ে ফিরবেন তিনি দেশে? মুহম্মদ আলী তাঁকে বলে দিয়েছিলেন যে দেশে ফিরে এসে তিনি কিছু সংগঠন গড়ে তুলে যেন ফরেন ব্যুরোর নিকটে রিপোর্ট পাঠান। তখন ব্যুরো ভেবে দেখবেন কি করা যায়।

আমি জেলে ছিলেম। গোপনে চক্রবর্তীর কি হয়েছে, না হয়েছে তার কিছুই জানতেম না। ১৯২৬ সালের জানুয়ারী মাসে আমার কলকাতা ফেরার কিছু দিন পরে শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি মস্কোর কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়েছেন, কিন্তু কমিউনিস্ট হননি আমার অভ্যাস হচ্ছে যে কোনো লোকের সঙ্গে বিশেষ করে শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লোকের সঙ্গে নতুন দেখা হলে তাঁর নিকট হতে আমি অনেক কিছু জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁর সঙ্গে আমার যখন কথা হচ্ছিল তখন কথায় কথায় আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি অনুশীলন সমিতির সেই ছাত্রটির কথা যাঁকে নলিনী গুপ্ত চিঠি দিয়ে এম এন রায়ের নিকটে পাঠিয়েছিলেন। আমি তার নাম জানতেম না। তিনি যে আগের জুন মাসে দেশে ফিরে এসেছেন সে কথাও আমার জানা ছিল না। শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁকে তো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করা হয়নি। তাঁর মস্কো পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই অনুশীলন সমিতির পত্রও পৌঁছে যায় যে তিনি বিশ্বস্ত লোক নন। এই কারণে নাইডু নাম দিয়ে তাঁকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়ে যাওয়ার পরে একদিন আমি তাকে শিবনাথ বন্দোপাধ্যায়ের দেওয়া খবর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি। তিনি স্বীকার করলেন যে খবরটি সত্য। বললেন, অনুশীলন সমিতির ভিতরে নানা সংঘাত চলেছে। তারই বলি হয়েছেন তিনি। “বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে” যোগ দেওয়ার পরে ধরণী গোস্বামীও একদিন বলেছিলেন যে কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত সমিতির ভিতরে এমন জোর উপদলীয়তা চালিয়েছে যে, ‘তার ফলে আমাদের সমিতির বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়েছে।’ পুলিনবিহারী দাসের ‘সমাজ সেবক সঙ্ঘ’ ও ‘হক কথা’ প্রভৃতির যখন কঠোরভাবে সমালোচিত হতে লাগল তখন সমিতির ভিতরেও ঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হলো। চারজন নেতা-

(১) প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় (২) নরেন সেন (৩) রমেশ আচার্য ও (৪) রমেশ চৌধুরী সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। তাঁরা বললেন, টাকা গ্রহণ ইত্যাদি সব অপকর্মের জন্যে একটা পুলিনবিহারী দাসই দায়ী। তাঁকে তাঁরা ছেঁড়া তেনার মতো দূরে ছুঁড়ে দিলেন।

১৬ই এপ্রিল হতে ১৮ই এপ্রিল (১৯২৬) পর্যন্ত গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী ও ধরণীকান্ত গোস্বামী প্রভৃতি গোপনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থাৎ তাঁদের নিজস্ব কমিউনিস্ট পার্টির যে অনিয়মিত কন্ফারেন্স করেছিলেন তার রিপোর্টে (তাঁদের প্রস্তাবসহ) তাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন ব্যুরোর নিকটে পারিসে পাঠিয়েছিলেন। এই কন্ফারেন্সের পরে, ২৯ শে এপ্রিল তারিখে গোপেন চক্রবর্তী ক্রিমিনাল প্রসেডিউর কোডের ১১০ ধারা অনুসারে ঢাকায় গিরোর হন। মনে হয় ১৯২৫ সালের জুন মাসে দেশে ফেরার পর হতে তিনি গা-ঢাকা দিয়ে চলছিলেন। ধরা পড়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা হয়নি, তিনি বিনা বিচারে বন্দীও হননি।

১৯২৬ সালের কোন্ মাসে তা ঠিক মনে করতে পারছিনে, তবে এপ্রিল মাসের কয়েক মাস পরে, একদিন ধরণীকান্ত গোস্বামী ৩৭, হ্যারিসন রোডে আমার নিকটে এলেন। তিনি পারিস হতে মুহম্মদ আলীর লেখা একখানি পত্র সঙ্গে এনেছিলেন। পত্রখানি বেশ বড় ছিল এবং হাতে লেখা ছিল। সম্ভবত গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে তা লেখা হয়েছিল। তবে, যে নামে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছিল তা উচ্চারণ করা যায় না। পরে যতীন মিত্রকেও আমি গোপেন্দ্রকৃষ্টের ওই একই নাম ব্যবহার করতে শুনেছি। ধরণী গোস্বামী আমাকে ওই পত্রের কয়েক ছত্র মাত্র পড়ে শোনালেন। পত্রখানি আমার হাতে দিলেন না। পত্রখানি হাতে লেখা ছিল। তার যতটুকু আমায় পড়ে শোনানো হয়েছিল তা আমি স্মৃতি থেকে এখানে তুলে দিচ্ছি :

“মুজফফর আহমদ এখন জেল হতে বার হয়ে এসেছেন, রাজনীতিক কাজেও নেমেছেন। এই অবস্থায় আপনারা কেন আলাদা দল ক’রে আলাদা হয়ে কাজ করবেন? আমরা চাই আপনারাও মুজফফর আমদের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করুন।

আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, “আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আপনারা এখনই পার্টিতে আসুন।” তাঁরা “বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের” কথাই আমায় বলছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির কথা নয়। এখন পুলিস রিপোর্টে পাওয়া যাচ্ছে যে তাঁরা ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার কনফারেন্স করেছিলেন। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি লাহোরে গিয়েছিলেম। আমি যাওয়ার আগে জানকীপ্রসাদ লাহোরে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার খোলাখুলি কনফারেন্স ডেকে এক কেলেঙ্কারি করেছিল। আমার মনের ইচ্ছা এই ছিল কনফারেন্স যখন ডাকাই হয়ে গেছে তখন কোনো রকমে তার কাজ নির্বাহ করতে হবে। আমি লাহোর হতে ধরণীকান্ত গোস্বামীদের পত্র লিখে জানতে চাইলাম তাঁরা এই কন্ফারেন্সের ব্যাপারে কতটা সাহায্য করতে পারেন? কোনও সাড়াই তাঁরা দেননি এই ব্যাপারে। সাকলাতওয়ালার আগমন উপলক্ষে আমি লাহোর হতে বোম্বে গিয়েছিলেম। ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কলকাতায় ফিরে আসি।

সেই যে কবে ধরণীকান্ত গোস্বামী মুহম্মদ আলীর পত্রের কয়েকটি ছত্র আমায় পড়ে শুনিয়েছিলেন তার পরে কয়েক মাস তিনি কৃষক ও শ্রমিক দলে যোগদান করার বিষয়ে আর কোনো কথাই বললেন না। কমিউনিস্ট পার্টির বিষয়ে তো চুপ করে থাকলেনই। আমার বোম্বে হতে ফেরার পরে কথা আরম্ভ হলো। ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে ধরণীকান্ত গোস্বামী, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী, নীরদকান্ত চক্রবর্তী ও প্যারীমোহন দাস এই চারজন সশরীরে বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে যোগ দিলেন। আরও কয়েকজনের নামও তাঁরা লিখিয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁরা কখনও অফিসে আসেননি। এই ক’জনের আবার দুর্নাম ছিল। প্রমথ ভৌমিকের নাম তালিকায় ছিল। কিন্তু তিনিও কোনো দিন আমাদের অফিসে আসেননি। ১৯৩৮ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রকৃত পরিচয় হয়। বিনাবিচারে বন্দীদশা হতে মুক্তি পেয়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে এসেছিলেন।

কৃষ্ণনগরের পরে বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের দ্বিতীয় সম্মেলন হয় ১৯২৭ সালের ১৯ শে ও ২০ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে। অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন। অনুশীলন সমিতি হতে চারজন সভ্যও যোগ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগর কনফারেন্সের পূর্বে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর শাসুদ্দীন হুসয়নের নিকটে এসে লেবর স্বরাজ পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। শামসুদ্দীন যখন শন্তিনিকেতনে শিক্ষক ছিলেন তখন সৌমেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল তা ছাড়া, হেমন্তকুমার সরকার ও কাজী নজরুল ইস্লামের সঙ্গেও সৌমেন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল। শাপুরাজি সাকলাতওয়ালা এই কন্ফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন।

নলিনী গুপ্ত সম্বন্ধে আগে অনেক লিখেছি। তাঁর আসল রূপ তখনও ধরা পড়েনি। তার ওপরে আমি বিরক্ত ছিলেম। কিন্তু আমার মোকদ্দমায় আসামী ছিলেন বলে আমি তাঁকে ছাড়তে পারছিলেম না। তিনি পুলিসের চর এটা বুঝতে পারলে নিশ্চয় তাঁকে বিদায় করে দিতুম। এই সময়ে তাঁর উপদলীয়তায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলেম। তবে তিনি ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়ে বিদেশে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছিলেন।

বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের দ্বিতীয় সম্মেলনে অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতি হয়েছিলেন, আর সেক্রেটারি হয়েছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌম্যেন্দ্ৰনাথ সম্বন্ধে আমি আমার “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন” নামক পুস্তকে অনেক লিখেছি। নলিনী গুপ্ত সম্পর্কেও বর্তমান পুস্তকে প্রচুর লেখা হয়েছে।

সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদেশে যাওয়ার আগে আমরা কমিটির একটা সভা ডাকলাম। এই সভায় তিনি তাঁর সেক্রেটারির পদটা ছেড়ে না দিয়ে দীর্ঘ দিনের ছুটি নিলেন। তাঁর জায়গায় একটিং সেক্রেটারি হলেন আবদুর রজ্জাক খান

ব্যাপারটি যখন ইতিহাসের বিষয়ীভূত তখন নিজের কথা কিছু না বললে সত্য গোপন করা হবে। কৃষ্ণনগরের কন্ফারেন্সে কুত্সুদ্দীন আহ্মদ সাহেব ও হেমন্তকুমার সরকার যুক্ত সম্পাকদ্বয় হলেন বটে কিন্তু সেক্রেটারির কাজ তাঁদের একজনও কিছু করলেন না। সে কাজ আমাকেই চালাতে হলো। কাগজ পরিচালনার সমস্ত কাজও আবদুল হালীম আর আমিই চালালেম। দ্বিতীয় কনফারেন্সের পরে আবদুর রজ্জাক খান নবাগতদের জিদের ফলে একটি সক্রেটারি হলেন। কিন্তু তার পরে তিনি কাজে খুব মনোযোগ দিলেন না। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের তৃতীয় কনফারেন্স ১৯২৮ সালের ৩১ শে মার্চ ও ১লা এপ্রিল তারিখ ভাটপাড়াতে হয়েছিল। এই কনফারেন্স করার আগে তার প্রস্তুতির জন্য তাকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। ভাটপাড়া কনফারেন্সও তিনি উপস্থিত থাকনেনি। এটা একটি বিশিষ্ট কনফারেন্স হয়েছিল। কারণ, “A Call to Action” (এ কল টু একশন) নামক পুস্তিকায় যে প্রস্তাবগুলি মুদ্রিত হয়েছে তার সবগুলি প্রস্তাব এই সম্মেলনে আলোচিত ও গৃহীত হয়। এই সম্মেলনেই বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের ইংরেজী নাম ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টি অব বেঙ্গল করা হয়, বাঙলা নাম যা ছিল তাই থেকে গেল। A Call to Action (এ কল টু একশন) এবং এই ভাটপাড়া কনফারেন্সের রিপোর্ট পরে পুস্তিকাকারে মুদ্রিত হয়েছিল। এই কন্ফারেন্সে আমি সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলাম।

মীরাটের কনফারেন্সে সংযুক্ত প্রদেশের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টি গঠিত হয়। এবং সেখানে আমরা এই ঘোষণাও প্রকাশ করি যে, ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা কলকাতায় একটি সারা ভারত ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টির কনফারেন্স ডাকবো। সেই কনফারেন্সেই সব কটি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টিকে একত্র করে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (ভারতের মজুর ও কৃষকদল) গঠন করবো। এর আগে আমাদের বাঙলা দেশে পার্টি সম্বন্ধে আরও কিছু খবর দেওয়া প্রয়োজন। ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে আমরা ৩৭, হ্যারিসন রোড হ’তে ২/১, ইওরোপীয়ান এ্যাসাইলাম লেনের বাড়ীর দোতলায় একটি পুরো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির অফিস তুলে আনি। এখানে একটি ঘরে আমাদের অফিসে ছিল এবং অন্য দুটি ঘরে আমরা বাস করতাম।

অনুশীলন সমিতি হ’তে যাঁরা বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে এসেছিলেন, ঢাকার গোপাল বসাককে নিয়ে তাঁদের সংখ্যা আরও কয়েকজন বেড়েছিল। যদিও তাঁরা আমাদের সঙ্গে থাকতেন তাঁরা তেমন মনোযোগ দিয়ে পার্টির কাজ করলেন না। এমন কি একদিন অন্য কাউকে কিছু না জানিয়ে তাঁরা ‘ওয়ার্কার্স প্রটেকশন লীগ’ নাম দিয়ে একটি বড় সাইনবোর্ড পার্টি আফিসের দোতলায় লাগিয়ে দিলেন। আসল ব্যাপারটি ছিল এই যে, ১৯২৭ সালের শেষ ভাগে এবং ১৯২৮ সালে আমাদের আন্দোলন খুব বেড়ে যায়, তাতে ধরণীকান্ত গোস্বামী প্রভৃতি সম্বন্ধে (কিন্তু গোপেন চক্রবর্তী সম্বন্ধে নয়) অনুশীল সমিতির নেতাদের দৃষ্টি ভঙ্গী বদলে গেল। আমি আগে বলেছি অনুশীলন সমিতির কেদারেশ্বর সেনগুপ্তের চক্রান্তে (ধরণীকান্ত গোস্বামীর কথা) ধরণীকান্ত গোস্বামীদের অনুশীলন সমিতির বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল। গোপেন চক্রবর্তী বিদেশ হ’তে ফিরে আসার পরে যখন অনুশীলন সমিতির নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন ( গোপাল বসাকের রিপোর্ট) তখন একমাত্র নরেন সেন ছাড়া আর কোন নেতা তাঁকে গ্রহণ করলেন না। নরেন সেনও তখন সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে বা’র হয়ে যাচ্ছিলেন। সমিতির নেতাদের তখন জোর ভক্তি ছিল অবনী মুখার্জির ওপরে, নলিনী আর অবনীর একত্রে স্থান ছিল না। গোপেন আবার ছিলেন নলিনীর লোক। কিন্তু ১৯২৮ সালে ধরণীকান্ত গোস্বামী প্রভৃতির উপরে অনুশীলন সমিতির নেতাদের ভক্তি আবার ফিরে এলো। কারণ, তখণ আমাদের আন্দোলন খুব জমে উঠেছে। এই নেতাদের তাঁদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা সাক্ষাৎ করলেন বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের অফিসে ‘ওয়ার্কার্স প্রটেকশন লীগে’র নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে সেটাও আমি সহ্য ক’রে নিলাম। বাইরের লোককে বোঝাতে থাকলেম যে, ‘ওয়ার্কার্স প্রটেকশন লীগ” মজুরদের ক্ষতিপূরণের মামলা ইত্যাদি চালাবে।

১৯২৮ সালে আমাকে দু’বার বোম্বে যেতে হয়েছে। সেই সময়ে তাঁরা, অনুশীলন সমিতি হতে-আসা কমরেডরা, আবদুর রজ্জাক খানকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে মিটিং করেছেন। নীরেন সেন নামক ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টির একজন সভ্য আমাকে এই খবর দিলেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তাঁকে এই কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “এতদিনের পুরানো কথা আমার কিছু মনে নেই।” বহু বৎসর নীরেনের সঙ্গে আমার কোনো যোগ ছিল না। রাধারমণ মিত্রের মারফতে আমি তাঁর নিকটে খবর পাঠাই। রাধারমণ মিত্রকে বলেছিলেম কেন নীরেনকে আমার দরকার। নীরেন সেন যখন খবর দিয়েছিলেন তখন তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলেম, “ওঁরা কি চান?” নীরেন বললেন, “ওঁরা চান যে সারা ভারত কনফারেন্সের পরে ধরণী গোস্বামী বাঙলা দেশের সেক্রেটারী হবেন।” আমি তখনই নীরেন সেনকে বলে দিই যে, “আমার সম্মতি আমি এখনই লিখে দিতে পারি। আমি যদি সারা ভারত পার্টির সম্পাদক হই, তা’ হলে বাঙলা দেশর সম্পাদক ধরণী গোস্বামীই তো হবেন।” কিন্তু এর কোন প্রতিক্রিয়া তাদের ভিতরে হয়েছে বলে মনে হলো না। সারা-ভারত কনফারেন্সের ব্যাপারে তাঁরা আমাকে খুব কম সাহায্যই করলেন। এমনকি মাথার উপরে কনফারেন্সের কাজ ফেলে, তাঁদের প্রত্যেকেই ঝরিয়া অল-ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে চলে গেলেন। তাঁদের বাসনা ছিল যে কিছু পথ এগিয়ে গিয়ে বোম্বের কমরেডদের তাঁরা হাত করবেন।

আমি যতটা বুঝতে পারলাম এই দখল করার ব্যাপারটা তখন তাঁদের মনে কাজ করছিল। তার বন্দোবস্তের জন্য তাঁরা আলাদাভাবে কাজ করছিলেন, অবশ্য গোপনে। এও তাঁরা চাইছিলেন যে বাউড়িয়ার স্ট্রাইক-করা চটকল মজুরদের দলবদ্ধভাবে এনে সম্মেলনে ভোট দেওয়াবেন এবং পার্টি দখল করে নেবেন। কিন্তু এই মজুরেরা পার্টি সভ্য না হওয়ায় ভোট দিতে পারলেন না।

সারা-ভারত সম্মেলনে আমরা পার্টিতে নূতন-আসা সোহন সিং জোশকে সভাপতি করেছিলাম। তার কারণ ছিল এই যে বোম্বের কোনো কমরেডকে সভাপতি করতে চাইলে এস.এ. ডাঙ্গের নাম উঠতো। কিন্তু তার বন্ধু জোগলেকর ও নিম্বকর তখন তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। তাকে সভাপতি নির্বাচন করলে বোম্বেতে পার্টির ভিতরে দারুণ ঝগড়া বেঁধে যেতো। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা সোহন সিং জোশের নাম প্রস্তাব করেছিলাম এবং সম্মেলনে তিনিই সভাপতি হয়েছিলেন। ভারতের যে সকল জায়গায় আমাদের পার্টির সভ্য ছিলেন, সেই সব জায়গা থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। ২১ শে, ২২ শে ও ২৩ শে ডিসেম্বর, ১৯২৮, এই তিন দিন সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। হলও ভাড়া করা হয়েছিল এই তিন দিনের জন্যে। কিন্তু ২৩শে তারিখ সম্মেলনে গোলমাল হওয়ায় ২৪শে তারিখেও সম্মেলন হয় অতিথিদের জন্যে ভাড়া করা বাড়ীতে, ১২১, লোয়ার সার্কুলার রোডে।

অলবার্ট হলে (এখন কফি হাউস) আমাদের অধিবেশন হয়েছিল। ২২শে তারিখে সন্ধ্যার পরে আমরা কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা আলাদা ভাবে অলবার্ট হলের কমিটি রুমে একটা সভা করলেম। আমরা স্থির করেছিলেম যে ধরণীকান্ত গোস্বামী এবং গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে তাতে ডাকা হবে। কারণ, আমাদের ইচ্ছা ছিল তাঁদের দু’জনকে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ক’রে নেওয়া। সেই সময়ে ধরণী গোস্বামীকে ওখানে পাওয়া গেল, কিন্তু গোপেন কোথায় চলে গিয়েছিলেন। মিটিং-এ বসা মাত্রই ধরণীকান্ত গোস্বামী বললেন,–”এটা কিসের মিটিং?” বেন ব্রাডলি (বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি,-ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য) উত্তর দিলেন, “এটা কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং”। ধরণীকান্ত গোস্বামী বললেন, “আমি তো কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য নই। আমাকে কেন এখানে ডাকা হলো?” বেন ব্রাডলি উত্তর দিলেন, “তোমাকে পার্টিতে নেওয়ার জন্যে আমরা প্রস্তাব করব।” ধরণীকান্ত গোস্বামী খুবই চটলেন এবং মিটিং হ’তে উঠে চলে গেলেন। অর্থাৎ তাঁরা যে আলাদা কমিউনিস্ট পার্টি করতে চেয়েছিলেন, সেটা তাঁদের মন হ’তে তখনও মুছে যায়নি। সেদিন সরার রাত্রি ধ’রে তাঁরা কাজ করলেন। সভ্যদের, বন্ধুদেরও দরদীদের বোঝালেন যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার জন্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। মুজফফর আহমদ সেই অধিকার usurp করেছে, অর্থাৎ জোর ক’রে কেড়ে নিয়েছে। এখন (মুজফফরের) কমিউনিস্ট পার্টি সব কিছু দখল করে নিচ্ছে। ধরণী ও গোপেনদের সমর্থক মহলে একটা ‘গেল’ ‘গেল’ রব উঠল | বঙ্কিম মুখার্জি ও রাধারমণ মিত্র ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সভ্য ছিলেন না, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করতেন। কালীকুমার সেন ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সভ্য ছিলেন। ধরণীকান্ত গোস্বামীর প্রচারে তাঁদেরও মনে দাগ কাটলো। আরও কেউ কেউ কথাটা বিশ্বাস করলেন। কারণ, গোপেন মস্কো গিয়েছিলেন। সেখানে কি অবস্থায় ছিলেন সে খবর কে রাখেন? ২৩ শে তারিখে কনফারেন্সে এই নিয়ে খুবই গোলমাল হলো। আমরা আরও একদিন কনফারেন্সের সময় বাড়িয়ে দিলাম। সে বাড়িয়ে দেওয়া দিনেও গোলমাল মিটল না। ধরণীকান্ত গোস্বামী তাঁর দলবল নিয়ে কনফারেন্স হতে বার হ’য়ে গেলেন। অবশ্য আব্দুর রজ্জাক খান ও শামসুল হুদা তলেতলে তাঁদের দিকেই ছিলেন। কনফারেন্স শেষ হয়ে গেল। বাঙলা দেশের সেক্রেটারী আমিই থেকে গেলাম। সারা-ভারত পার্টির আফিস কলকাতায় না রেখে বোম্বেতে স্থানান্তরিত করা হলো। আর এস নিম্বকর সারা ভারতের সেক্রেটারী নির্বাচিত হলো।

২৩ শে তারিখে আমাদের একটা মিছিল বার করার প্রোগ্রাম আগে থেকে স্থির করা ছিল। এই মিছিল আমরা বা’র করলাম। পার্ক সার্কাসে যেখানে কংগ্রেসের অধিবেশন হবে সেই স্থান পর্যন্ত আমরা গেলাম। অনেক সব স্লোগান সেদিন আমরা দিয়েছিলেম। তার মধ্যে একটি ছিল “মজুর ও কৃষকের সোবিয়েত রিপাবলিক”। তখনও কিন্তু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত আমাদের নিকটে আসেনি। সেখানে অনুশীলন সমিতির শ্রেষ্ঠ নেতা প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায়ও ঔৎসুক্য ও উত্তেজনাপূর্ণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। অনুশীলন সমিতির জন্য ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি দখল করা হয়েছে কিনা এ খবর জানার জন্যে তিনি প্রায় মরে যাচ্ছিলেন। ধরণী গোস্বামী ভিড়ের ভিতরে ছিলেন। প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় বারে বারে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করছিলেন, “ধরণী গোস্বামী কোথায়?” কিঞ্চিৎ বিরক্তির সহিত আমি বলেছিলেম, “এই ভিড়ের ভিতরে কোথাও আছেন”।

গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর কথা

গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী সম্বন্ধে আমার কিছু বলা দরকার। ১৯২২ সালের আগের কথা না ধরলেও, ১৯২২ সালের জানুয়ারী মাস হতে আমি ভারতবর্ষের ভিতরে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমি কোনদিন কোন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেম না। গোপেন চক্রবর্তী অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেন। আমি যদি কোন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য হ’তে চাইতাম, তাহলেও অনুশীলন সমিতির সভ্য আমি হতে পারতাম না। কারণ, তাঁদের গোপন গঠনতন্ত্রে (কনটিটিউশন) লেখা ছিল যে, অনুশীলন সমিতিতে অ- হিন্দুর প্রবেশ নিষেধ। আমি মুসলিম নাম নিয়ে জন্মেছি। গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ১৯২৬ সালের মাঝামাঝির আগে হয়নি। নলিনী গুপ্ত দ্বিতীয়বার যখন বাঙলা দেশে এসেছিলেন (জুলাই, ১৯২৩) তখন আমি জেলে। সেই সময়ে অনুশীলন সমিতির লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ‘যুগান্তরে’র নেতারা আগের বারেও তাঁকে পাত্তা দেননি। তাঁরা জানতেন তিনি দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন লোক। দ্বিতীয় বারে নলিনীকে কাজ দেওয়া হয়েছিল যে সে মস্কোর কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ছাত্র জোগাড় ক’রে পাঠাবে। নলিনী একাজ না ক’রে বোার ফর্মুলা ছেলেদের শিখিয়েছে এবং নিজের সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলেছে। একমাত্র সে গোপনে চক্রবর্তীকে পাঠিয়েছিল। তাঁরও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল।

আমার সঙ্গে গোপেন চক্রবর্তীর কোনো দিক হতে কোনো সম্পর্ক ছিল না। আগেই বলেছি মস্কোতে তিনি মাত্র নয় মাস ছিলেন। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ পাননি। দেশে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি মস্কোতে আবার বিয়ে করেন। সেই স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তাঁকে ( গোপেনকে) দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফেরার সময়ে পারিসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন ব্যুরোর সভ্য মুহম্মদ আলী তাঁর কানে কি মন্ত্র দিয়েছিলেন তা আমি কি করে জানব? কিন্তু এটা তো আমি জানতাম যে মুহম্মদ আলী তাঁকে আমাদের সঙ্গে কাজ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি আগেও একথা বলেছি। আমি জানতামও না গোপেন চক্রবর্তী যাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা কি করতেন। এতকাল পরে ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট হাতে আসায় বুঝতে পারছি যে তাঁরা একটি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে চাইছিলেন। এই জন্যেই ধরণীকান্ত গোস্বামী এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হতে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু গোপেন চক্রবর্তীর ক্ষমতা আমি কি করে কেড়ে নিলাম! ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে তিনি যখন হামবুর্গে পৌঁছেছিলেন তখন তো কানপুরের আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলেছে। ১৯২৫ সালের জুন মাসে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। তখনও আমি জেলে। ১৯২৬ সালের জানুয়ারী মাসে আমি কলকাতায় ফিরেছি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯২৬ সালের শেষার্ধে।

আগেই বলেছি গোপেন চক্রবর্তীরা পেজান্ট্স এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টিতে ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে আমাদের তরফ হতে তিনি লিলুয়ার রেলওয়ে ধর্মঘটে কাজ করছিলেন। শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই সময়ে সেই ধর্মঘটের কাজে লিপ্ত ছিলেন। এই সময়ে একটি কথা বলি। একদিন শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নিকটে এসে প্রস্তাব করলেন যে তাঁরা ফিলিপ স্প্রাট ও আমার নামে মস্কোতে রেড ইন্টারন্যাশনাল অফ লেবর ইউনিয়ন্সের নামে সাহায্যের জন্যে একটি টেলিগ্রাম পাঠাতে চান। আমি বললেম, “মিত্র মশায় (কিরণচন্দ্র মিত্র ওর্কে জটাধারী বাবা) নিজে যা খুশী করছেন, একটি স্ট্রাইক কমিটি পর্যন্ত গঠন করলেন না, আমি এই সঙ্গে আমার নাম জড়াতে চাই নে।” তা সত্ত্বেও তাঁরা আমাদের দু’জনের নামে টেলিগ্রাম ক’রে দিলেন। তাতে লিখে দিলেন সাহায্যের টাকা সোজাসুজি কে.সি. মিত্রের নামে পাঠিয়ে দিবেন। পুলিস এই টেলিগ্রাম আটকাল। স্টেট্সম্যানের একজন ইংরেজ রিপোর্টার ছিলেন, নাম মিস্টার প্লুটন। তিনি গিয়ে টেলিগ্রাম আফিস হতে সেই টেলিগ্রামের একটি কপি বা’র করে আনলেন। তিনি আমাদের আফিসে এসে জিজ্ঞাসা কররেন, “মিস্টার স্প্রাট ও আপনি কি এই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন”? আমি মনে মনে স্তম্ভিত হলাম, কিন্তু মুখে বললাম, “আমরা স্ট্রাইকের জন্যে আমাদের নাম ব্যবহার করার অধিকার তাঁদের দিয়েছি”। মিস্টার প্লুটন টেলিগ্রামটি পরের দিনের স্টেট্সম্যানে ছেপে দিলেন। খবরটি ইউরোপে তারযোগে পাঠিয়ে দিয়ে রয়টার পরের কাজটি করে দিলেন। কয়েকদিনের ভিতরে মস্কো হতে বিশ হাজার টাকা এসে গেল।

হওড়ার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার গুরুসদয় দত্তের সাহায্যে কে.সি. মিত্ৰ ব্যাঙ্ক হতে টাকাটা তুলে নিলেন।

আমরা আশ্চর্য হলাম যে মিত্র মশায় কিংবা শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা গোপেন চক্রবর্তী কেউ আমাদের এই খবরটি দিলেন না। আমি একদিন গোপেন চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করলেম, “আপনি তো আমাদের পার্টির সভ্য। আপনি জানে মিত্র মশায় আমাদের নাম ব্যবহার করেছেন। আপনি অন্তত টাকা আসার খবরটা আমাদের জানালেন না কেন?” গোপেন শুনে যেন আশ্চর্য হলেন, বললেন, “আপনাদের কারণে তো টাকা আসেনি। হাওড়া কংগ্রেসের হরেন্দ্র ঘোষ একবার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর একটা আন্তর্জাতিক সংযোগ হয়েছিল। সেই সংযোগের মারফতে টাকাটা এসেছে।” এই গোপেন চক্রবর্তীকেও সেদিন আমায় চিনতে হয়েছিল। যাই হোক, ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির বিশ্বস্ত সভ্য গোপেন চক্রবর্তী কখনও ছিলেন না। হরেন ঘোষ খোলাখুলিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির এবং কমিউনিস্টদের সব কিছুর শত্রু ছিলেন। গোপেনের মতে সেই তিনিই নাকি রেড ইন্টারন্যাশনাল হতে টাকা আনিয়ে দিয়েছিলেন! কোনো বিশ্বস্ত সভ্য কি এই রকম কথা কখনও বলতে পারেন? আমার মনে হয় গোপেন চক্রবর্তীর মনে তখন উপদলীয় রাজনীতি কাজ করছিল। তিনি হয়তো স্থিরই করেছিলেন যে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টির সভ্য তিনি আর থাকবেন না। সেই জন্যই তিনি এই পার্টির বার্ষিক চাঁদা দিতে বারে বারে অস্বীকার করছিলেন।

গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী ভ্রান্তিতে ভুগছেন। তাঁর বিশ্বাস যে বাঙলা দেশে তিনি পার্টির দ্বিতীয় সভ্য। প্রথম সভ্য কে সে কথা তিনি বলছেন না। নলিনী গুপ্ত কি? সে তো কখনও নিজেকে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য বলতা না। বলত সে জাতীয়বাদী বিপ্লবী। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী ১৯৩৪ সালের জুন মাসের আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হননি। তাঁর ভ্রান্তির অপনোদন কখনও হবে কিনা তা জানিনে। হালে তিনি তাঁর হস্তলিখিত স্মৃতিকথা বহু লোককে পড়াচ্ছেন। অসত্য তথ্যে পরিপূর্ণ তাঁর এই স্মৃতিকথা। আশ্চর্য এই যে ইতিহাসের অধ্যাপক শান্তিময় রায়ও গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ফাঁদে পা দিয়েছেন। তার ফলে তিনি অসত্য তথ্যের সমাবেশ ক’রে তালগোল পাকানো শুরু করেছেন। (সোভিয়েত বিপ্লব ও ভারতবর্ষ : শান্তিময় রায় লিখিত)।

জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টা

আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টার সঙ্গে কানপুর কমিউনিস্ট কনফারেন্সের সময়ে আমার প্রথম দেখা। আমি যখন ১৯২৩ সালে প্রথম গিরোর হই, সেই সময়ে জানকীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতেম না। কানপুরেই সে আমাকে প্রথম পরিচয় দিল যে সে কমিউনিস্ট পার্টির লোক এবং এম. এন. রায় ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। জানকীপ্রসাদকে আমি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম “তোমার এই বাগেরহাট্টা পদবীটা কি”? সে বললো, “আমার গৌড় ব্রাহ্মণ। আগে বাঙলা দেশে ছিলাম, বাঙলা দেশ হতে পালিয়ে রাজপুতনায় এসেছি। এসেছি বাগেরহাট থেকে। সেইজন্য বাগেরহাট্টা লিখি।” দেখা গেল জানকীপ্রসাদ খুব করিতকর্মা ও চালাক লোক। ইংরাজী দ্রুত বলতে পারে। সে আরও একটি পরিচয় দিল যে সে শওকত উসমানীর সহপাঠী। জানকীপ্রসাদের বাবা মাধবপ্রসাদ বিকানীরের উকিল ছিলেন। শওকত উসমানীও বিকানীরের লোক। তারা একই সঙ্গে বিকানীরের ডুঙ্গর কলেজে (হাইস্কুল) পড়ত। জানকীপ্রসাদ কিন্তু শওকত উসমানীর সংস্রবে কমিউনিস্ট হয়নি। সে কী করে কমিউনিস্ট হলো, এম. এন. রায় কী করে তাঁর সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালেখি আরম্ভ করলেন তার কিছুই জানি না। এস. ভি. ঘাটেও আমাকে এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেনি। আমার মনে হয়, আজমীঢ়ের কোনো লোকের সূত্রে জানকীপ্রসাদ এম. এন. রায়ের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালেখি আরম্ভ করে থাকবে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসেই কার নিকট হতে জানি না, আজমীঢ়ে প্রথম এসেছিল। অবশ্য মস্কো হতে আসেনি, এসেছিল ইউরোপের কন্টিনেন্‌ট হতে। আজমীঢ়ের সূত্রেই জানকীপ্রসাদের সঙ্গে এম. এন. রায়ের হয়তো যোগাযোগ ঘটে থাকতে পারে।

কানপুর কমিউনিস্ট কনফারেন্সে জানকীপ্রসাদ ও এস.ভি. ঘাটে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনটা কনফারেন্সে হয়নি। কনফারেন্সে যে এক্‌জেকিউটিব নির্বাচিত হয়েছিল সেই কমিটি জানকীপ্রসাদ ও এস.ভি. ঘাটেকে যুগ্ম সেক্রেটারি মনোনীত করেন। তখন পার্টি আফিসে বোম্বে চলে যায়। তারপরে পার্টি আফিস যে দিল্লীতে উঠে গেল সেই ব্যবস্থায় জানকীপ্রসাদ ঘাটেকে রাজী করিয়েছিল। হাবীব আহ্মদ মস্কো কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ ক’রে বাইরে এসেছিলেন। শাজাহানপুরের লোক হলেও হাবীব আদ দিল্লীতে কিছু ব্যবসা করতেন। তাঁর বাবা ভারত গবর্নমেন্টের হাওয়াই জাহাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি বড় চাকুরি করতেন। সেই সময়ে ১৯২৫-২৬ সালে তিনি অবসরপ্রাপ্ত হয়ে মক্কা চলে যান।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। কাকোরি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আসামী আশফাকুল্লাহ্ খান তখন পলাতক ছিলেন। তিনি ছিলেন হাবীব আমদের বন্ধু। হাবীব আমদের সূত্রে পলাতক আশফাকুল্লাহ্র সঙ্গে জানকীপ্রসাদের পরিচয় হয়। জানকীপ্রসাদও তাঁকে নানা জায়গায় আশ্রয় দিয়েছিল। পরে আমার গভীর সন্দেহ হয়েছিল যে, আশফাকুল্লাহ্ জানকীপ্রসাদের কারণেই ধরা পড়েছিলেন। তারপরে জানকীপ্রসাদ আমাদের মত না নিয়েই দিল্লীতে কমিউনিস্ট কনফারেন্স ঘোষণা করে দেয়। এই ঘোষণার পরে সে কলকাতায় এসেছিল এবং কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে ছিল। তখনই আমরা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সম্বন্ধে ইংরেজি ভাষায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতে একটা ছাপানো ইতিহার প্রচার করি। এই ইতিহারটি কলকাতায় গৌরাঙ্গ প্রেসে ছাপা হয়েছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা তখন হিন্দু-মুস্‌লিম দাঙ্গায় খুব উস্কানি দিচ্ছে। দু’টি সংস্থার প্রেস পৃথক থাকলেও উভয়ের মালিক সুরেশচন্দ্র মজুমদার আমাকে ঠেস দিয়ে বলেছিলেন, – “মহাশয়, আপনারা তো মহাপ্রাণ ব্যক্তি, আর আমরা হলাম গিয়ে অল্পপ্রাণ লোক।” এই ইতিহারটি মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার একজিবিট। এর মুসাবিদা জানকীপ্রসাদের নিকটে ছিল। সে আমায় বলেছিল এটা এভেলিন রায়ের লেখা। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। কারণ, ১৯২৫ সালের শেষভাবে এভেলিন রায় আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালের শুরুর দিকেও দেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। এভেলিন হয়তো তখনই এটা লিখে থাকবেন। এর দু’এক ছত্রে কুত্সুদ্দীন সাহেব কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করেছিলেন কোথায় তা আমার ভালো মনে নেই। এমনও হতে পারে যে এই ইতিহারটি এম. এন. রায়ও লিখে থাকতে পারেন। জানকীপ্রসাদ দিল্লীতেই কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কনফারেন্স ডেকেছিল। পরে সে স্থান বদলে লাহোরে কনফারেন্সের স্থান স্থির করে। তখনও আমার নিজের মনে এবং অন্য কমরেডদের মনেও এই ইচ্ছা ছিল যে আমরা কোনও রকমে লাহোরেই কনফারেন্সটা ক’রে ফেলবো। আসলে খোলাখুলি কমিউনিস্ট কনফারেন্স ডাকার দিকে আমার বেশী উৎসাহ ছিল না।

১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে আমি লাহোরে যাই। হাওয়া পরিবর্তনের জন্যই গিয়েছিলাম। ১৯২৬ সালে আমার বারে বারে জ্বর হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন সকাল বেলা দেখলাম যে জানকীপ্রসাদ সেখানে এসে হাজির। তাকে জিজ্ঞাসা করলেম যে, তুমি কেন এলে? সে উত্তর দিল যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই বোম্বে হ’তে ঘাটের চিঠি এল। ঘাটে আমাকে লিখেছে যে, ১৪ই জানুয়ারী (১৯২৭) তারিখে সালাতওয়ালা আসছেন। জানকীপ্রসাদকে শীঘ্রই ‘পাঠিয়ে দাও’। তখন আমি জানকীপ্রসাদকে বললেম, “আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। তুমি কালকের দিনটাও এখানে থেকে যাও। পরশু আমরা একত্রে যাবো”। জানকীপ্রসাদ বললো, “আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। কারণ, কাল আমার দিল্লীতে অনেক কাজ আছে। টাকা কড়ি একেবারেই হাতে নেই। তার যোগাড় দিল্লীতেই করতে হবে। আরও অনেক কাজ রয়েছে।” এই বলে সে রাত্রের গাড়ীতেই জানকীপ্রসাদ দিল্লী চলে গেল। তার পরের দিন রাত্রের গাড়ীতে আমিও রওয়ানা হলাম। তৃতীয় দিন সকাল বেলা দিল্লী স্টেশনে টিকিটের কাউন্টারের ওখানে জানকীপ্রসাদের সঙ্গে আমার দেখা হ’লো। জানকীপ্রসাদ ও আমি একত্রেই টিকিট কিনলাম এবং একত্রেই বি.বি. সি.আই ট্রেনে বোম্বে পেলাম। এর আগে আমি কখনও বোম্বে যাইনি। জানকীপ্রসাদই আমায় ধোবি তালাওর একটি হোটেলে নিয়ে গেল। পথে ট্রেনে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-”তুমি তো বলেছিলে তোমার নিকটে টাকা নেই। এত তাড়াতাড়ি একদিনে টাকাকড়ি কোথা হতে জোগাড় হ’লো?” তখন জানকী প্রসাদ একটা ভুল করল। সে আমাকে বললো- “ভাই, সারাদিন ঘুরে ঘুরে কোথাও টাকা পেলাম না। সন্ধ্যাবেলা আমি নিরাশ হ’য়ে একজন বাঈজীর বাড়ী গেলাম। বাঈজীর সঙ্গে আগে হতে পরিচয় ছিল। মাঝে মাঝে আমি ওখানে গান শুনতে যাই। বাঈজী আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘পণ্ডিতজী, আপনাকে এত উদাস দেখাচ্ছে কেন?’ আমি বললাম আমার কিছু টাকার দরকার। সারাদিন ঘুরে ঘুরে কোথাও টাকা পেলাম না। তখন বাঈজী আমাকে একটা ট্রেতে একশ’ টাকার একখানা নোট এনে দিল।”

আমার মনে খুব সন্দেহ হলো। কারণ, আমি বরাবর শুনেছি বাঈজীরা লোকের কাছ থেকে টাকা নেয়, তারা যে কাউকে এইভাবে টাকা দিয়েও থাকে, তা আমার বিশ্বাস হলো না। আরও একটা জিনিস সেই সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল। জানকীপ্রসাদ লাহোরে আমায় বলেছিল যে, ‘কাল ডেভিড পেট্রির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। (ডেভিড পেট্রি ছিলেন ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত ইনটেলিজেন্সে ব্যুরোর ডিরেক্টর)। তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন ‘লাহোর তো কোনো হাওয়া বদলাবার জায়গা নয়, মুজফফর কেন হাওয়া বদলাতে লাহোরে গেল’?” আমি জিজ্ঞেস করলেম—”তুমি ডেভিড পেট্রিকে কি করে চিনলে?” সে বললো, দিল্লীতে আমাদের আফিস আসার পরে পরিচয় হলেছিল”। আমি তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলেম-”দিল্লীতে কোথায়, কি করে তোমার সঙ্গে ডেভিড পেট্রির দেখা হলো?” সে বললো, “আমি মেইডেন্স হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন পেট্রি হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। আমাকে দেখেই এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন।”

লাহোরে শোনা ঐ কথার সঙ্গে বাঈজীর টাকা দেওয়ার কথা মিলিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহ হলো যে জানকীপ্রসাদ খুব সম্ভবতঃ ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর নিযুক্ত করা লোক। আমার মনে যে সন্দেহ হয়েছিল, আমি তা কথাবার্তায় বা ব্যবহারে প্রকাশ করলেম না।

বোম্বেতে পৌঁছে ঘাটের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই আমি তাকে সব কথা খুলে বলি। তাকে বলি যে, জানকীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমাদের সাবধান হ’তে হবে। আমি নিজের মনে চিন্তা ক’রে তখনই ঠিক করে ফেললাম যে লাহোরের কমিউনিস্ট কনফারেন্স আমি কিছুতেই হ’তে দেব না। যেমন ক’রেই হোক ওটাকে আমি ভণ্ডুল করে দেবো। শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল করে দিতেও পেরেছিলেম। সাকলাতওয়ালা বোম্বেতে আমাদের বলেছিলেন, “১৪ই মার্চ কার্ল মার্কসের মৃত্যু দিবস। সেদিন আমি আমাদের যত মজুর-সংগঠন আছে, তাদের সঙ্গে দিল্লীতে একটা মিটিং-এ মিলিত হ’তে চাই।” সেই মিটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থান হ’তে আমাদের কমরেডরা দিল্লী এসেছিলেন। আর সেই সময়ে অল-ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন দিল্লীর হিন্দু কলেজে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।

দিল্লীর চাওড়িবাজার আর্য সমাজ মন্দিরে আমাদের সভা হয়েছিল। আমি সভাপতিত্ব করেছিলাম। অনেকে অনেক পুস্তকে লিখেছেন, ঐ সভাটি কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কনফারেন্স ছিল। আসলে মোটেই তা নয়। ঐ সভাটি সালাতওয়ালার ইচ্ছা পূরণের জন্যই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের বিভিন্ন স্থানের নেতৃস্থানীয় কমরেডদের কাছে আমি জানকীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমার সন্দেহের কথা বলি। তখন গওহর রহমান খান আমাদের বলেন যে, আশফাকুল্লাহ্ খানের ব্যাপারে জানকীপ্রসাদের উপরে তাঁরও সন্দেহ আছে। আমরা যে জানকীপ্রসাদকে সন্দেহ করছি, সে তা বুঝতে পারে। তখন দিল্লীর রয়েল হোটেলে পার্টি মেম্বারদের পৃথক সভায় জানকীপ্রসাদ কেঁদে ফেলে, বলে, “আমাকে সন্দেহ করা হচ্ছে”। আমরা বলি “কোথায় সন্দেহ করা হলো? তোমাকে তো কিছু বলা হয়নি।”

আগে হ’তে ১৯২৭ সালের ৩১শে মে তারিখে বোম্বেতে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির একটি সাধারণ সভা হওয়ার কথা ছিল। আমি ঘাটেকে বলেছিলেম—”ওই সভাটাও ভেঙে দাও”। নিম্বকর ও জোগলেকর প্রভৃতির কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে তেমন কিছু আগ্রহ তখন ছিল না। ঘাটে ইচ্ছে করলেই সভাটি ভেঙ্গে দিতে পারতো। কিন্তু চিরকালের দুর্বল মানুষ ঘাটে। সে সভাটি ভণ্ডুল করতে পারেনি। আমি তাতে যোগ দিইনি। তাতে কমিউনিস্ট পার্টির একটা গঠনতন্ত্র (কনটিটিউশন) গৃহীত হয়েছিল। তা’ছাড়া আরও প্রস্তাব পাস হয়েছিল। জানকীপ্রসাদ সেই সভাতেই ঘোষণা ক’রে যে সে আর কোন কিছুতেই থাকবে না। কারণ, সে বুঝতে পারছে তার উপরে কমরেডদের বিশ্বাস নেই। তারপর হতে সে আর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক রাখেনি। আমাদের সন্দেহ যে ঠিকই ছিল তার প্রমাণ আমরা পেলাম মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়।

আমরা যখন মীরাট মোকদ্দমার সংস্রবে গিরোর হই, সেই সময় রেওয়ারিতে জানকীপ্রসাদের বাড়ীতেও তল্লাশি হয়। (রেওয়ারি দিল্লীর নিকট গুড়গাঁও জিলার একটা শহর। তার সেখানকার এক কাকা তাকে পোষ্য গ্রহণ করেছিল।) জানকীপ্রসাদের বাড়ী হতে যে সমস্ত কাগজপত্র পুলিস এনেছিল সেই সমস্ত কাগজপত্র অনুসন্ধান ক’রে আমরা ভারত গবর্নমেন্টের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর নামে পাঠানো একটা বিলের নকল পেয়ে যাই। আশ্চর্য এই যে জানকীপ্রসাদ যে আমার সঙ্গে দিল্লী হতে বোম্বে গিয়েছিল তার সেই ভ্রমণেরই রাহাখরচের বিল ছিল ওটা। জানকীপ্রসাদকে আমি শেষ দেখেছিলেম ১৯৩৮ সালে। সে হঠাৎ একদিন কলকাতায় ৭৭, চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে আমার ঘরে এসে উপস্থিত হয়। আমি তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করি—”তুমি কী করে এলে? কোথায় আমার ঠিকানা পেলে?” সে বললে, “তুমি ঘাবড়িও না- আমি এখন আর কোন রাজনীতি করি না। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম পানবিড়ির দোকানে দোকানদারেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তারা তোমার নামও উচ্চারণ করছিল বলে আমি তাদের তোমার ঠিকানার কথা জিজ্ঞাসা করি, তারা তোমার ঠিকানাটা দেয়।” জানকীপ্রসাদ বলে, “এখন আমি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে থাকি। ইস্ট ইন্ডিয়ান ফিল্মের জন্য ‘উদয়’ নামে একটি চিত্রনাট্য লিখেছি। সেটা কলকাতায় দেখানো হবে। সেই উপলক্ষে আমি কিছুদিন এখানে বিপিন পাল রোডে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আছি। আবদুল হালীম আর তুমি আমার ফ্ল্যাটে খেতে আসবে একদিন।” আমরা অবশ্য খেতে যাইনি। ও সত্য-সত্য কোন সিনেমার ব্যাপারে এসেছে কি না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ হয়েছিল। পরে ‘উদয়’ নাম দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা পোস্টার দেওয়ালে দেখেছিলাম। জানকীপ্রসাদ এখন বেঁচে নেই।

বলা হচ্ছে যে ১৯২৬ সালে আমার কলকাতা ফেরার পরে আমার কথা মতোই কলকাতায় পার্টি মিটিং ডাকা হয়েছিল। কথাটা সত্য নয়। আমি কোনও মিটিং ডাকিনি। শামসুদ্দীন হাস্সান দু’বার ও জানকীপ্রসাদ একবার নিজেদের প্রেরণাতেই কলকাতা এসেছিল। দিল্লীতে আফিস স্থানান্তরিত করার কথাও আমি কিছু বলিনি। প্রথমে দিল্লীতে ও পরে লাহোরে কমিউনিস্ট কনফারেন্সে ডাকার ব্যাপারেও আমি ছিলাম না। ঘাটেকে ভালো মানুষ পেয়ে জানকীপ্রসাদ সব কিছু করেছিল।

শওকত উস্‌মানী সম্বন্ধে আরও কিছু কথা

শওকত উস্‌মানী সম্বন্ধে আমি আরও কিছু কথা লিখে রাখছি। পরে যাঁরা তথ্যানুসন্ধান করবেন তাঁদের কাজে লাগবে। কানপুর ‘বলশেভিক’ ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় পাওয়া সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করে ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সে ঝান্সি জেল হতে মুক্তি পেল। লাহোরের মীর আব্দুল মজীদ ও ভোপালের রফীক আদ তাকে জেলের গেটে স্বাগত জানালেন। এই দু’জনই ১৯২১ সালে মস্কোতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পরে দিল্লী ও লাহোর হয়ে সে আজমীঢ়ে যায়। উসমানী বিকানীরের নাগরিক। বিকানীর দেশীয় রাজ্য হওয়ার কারণে সে সেখানে যেতে সাহস পেল না।

উসমানীর মুক্তির কয়েক দিন পরে আমি পার্টির কাজে বোম্বে গিয়েছিলেম। সেখান হতে কলকাতা ফেরার সময়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমীঢ়ের ঘোরা পথে কলকাতা ফিরলেম। সেখানে অর্জুনলাল শেঠীর বাড়ীতে তার সঙ্গে আমার দেখা হলো। আমাদের পার্টির অবস্থা সম্বন্ধে সে আমার নিকট হতে কিছুই জানতে চাইল না। সে প্রস্তাব করল যে “আমি মস্কো চলে যেতে চাই। তোমরা পার্টি হতে আমার সেই অনুমতি দাও।” আমি তার এই প্রস্তাবে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেম। আমি তাকে বললাম “তুমি অনেকদিন পরে জেলের বাইরে এসেছ। এখন আমাদের সামনে আন্দোলন করার ও পার্টি গড়ার পরম সুযোগ এসেছে। এই সময়ে তুমি মস্কো যাওয়ার পক্ষে কিছুতেই মত দেবে না।” শওকত উস্‌মানী মনঃক্ষুণ্ণ হলো? শুধু কি মনঃক্ষুণ্ণ? সে মনে মনে আমায় তার শত্রু ভেবে নিল। এই রকমই ছিল তার স্বভাব। বোম্বেতে গিয়েও পার্টির নিকটে সে তার মস্কো যাওয়ার প্রস্তাব তুলেছিল। তার প্রস্তাব পার্টি গ্রহণ করেনি। পুরানো পুলিস রিপোর্টে দেখেছি ডাঙ্গে নাকি তলে তলে তাকে সমর্থন জানিয়েছিল।

আমি সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে বা অক্টোবরের শুরুর দিকে আজমীঢ় গিয়েছিলেম। নভেম্বর মাসে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতে কানপুরে গিয়ে দেখলেম উসমানী সেখানেই রয়েছে। তার মস্কো যাওয়ার সম্বন্ধে সে আর কোনো কথা উচ্চারণ করল না। কিন্তু তলে তলে মস্কো যাওয়ার কাজই সে করে যাচ্ছিল। কিছুদিন পরে সে একটি ‘নাম কে ওয়াস্তে সাংবাদিক এজেন্সি খুলে দিল্লীতে গিয়ে বসল। পার্টির সভ্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিপত্র সে লেখালেখি করত, কিন্তু পার্টির কোনো কাজই করত না।

শওকত উস্‌মানী যে দিল্লীতে তার বাসা বাঁধল, তার খরচ কি করে চলত? কে দিত তাকে টাকা? আমরা খবর পেয়েছিলেম যে সৈয়দ মসউদ আলী শাহ্ উসমানীর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করত। ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে যখন ভোপালের রফীক আহমদ সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় আমার দেখা হয়েছিল তখন তিনিও আমায় বলেছিলেন যে উসমানীর খরচ চালাবার জন্যে মসউদ আলী শাহ্ ঠিকাদারীর কাজ নিয়েছিল।

উসমানীর দিল্লী থাকার সময়ে রফীক আহমদ একবার দিল্লী গিয়েছিলেন।

উসমানী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে পার্টির কথা সে মানবে না, যেমন করে হোক মস্কো সে যাবেই এবং সেখানে গিয়ে ভারতের পার্টিকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে। দিল্লীতে এসে প্রথমে সে মসউদ আলী শাহের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে। তার সাহায্য ছাড়া উসমানীর যাওয়া সম্ভব ছিল না। মসউদ আলীর কথা আমি আগে বলেছিল। সে ব্রিটিশ স্পাই বা চরের বৃত্তি গ্রহণ করেছিল। কাজেই সে উসমানীর প্রস্তাবে খুশী হয়েছিল। উসমানীরা যখন প্রথম বারে (১৯২১) দেশে ফিরে আসে তখন মুহাজিরদের ভিতর হতে যাঁরা পার্টির সভ্য হয়েছিলেন তাঁদের প্রত্যেককে একজন ভ্রমণের সাথী বেছে নিতে বলা হয়েছিল। শওকত উসমানী তখন মসউদ আলী শাহকেই সাথী বেছে নিয়েছিল। মস্কোতে যাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। তাঁদের ভিতরে শওকত উসমানীই সকলের আগে দেশে ফেরার প্রস্তাব পেশ করে। মসউদ আলী আর শওকত উসমানী সকলের আগে ইরানের ভিতর দিয়ে দেশের দিকে রওয়ানা হয়। তাদের দু’জনেই একত্রে ইরান অতিক্রম করেছে। কিন্তু দেশে প্রবেশ করবার সময় তারা আগে-পরে প্রবেশ করেছিল কিনা তা আমি জানিনে। কর্নেল সেলিসল কে ব’লছেন তারা আগে-পরে প্রবেশ করেছিল কিনা তা আমি জানিনে। কর্নেল সেসিল কে’ ব’লছেন তারা আগে-পরে দেশে এসেছিল।

মস্‌উদ আলী শাহ্ ১৯২০ সালে হিজরাত করেছিল। অর্থাৎ, সে একজন ব্রিটিশ চর হিসাবে হিজরাতকারীদের সঙ্গে নিয়েছিল। অভিজাত পরিবারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সে তার চরবৃত্তির মূল্য হিসাবে পথের সব কষ্ট স্বীকার করেছিল। তাশকন্দে এম. এন. রায়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরেও কিছু কিছু মুহাজির যুবক তাকে সন্দেহ করত। কিন্তু সে এম. এন. রায় ও এভেলিন রায়ের স্নেহ আকর্ষণ করেছিল। তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যখন গঠিত হয় তখন মুহাজিরদের ভিতর হতে মসউদ আলী শাহ্ ও আবদুল কাদির খানও ব্রিটিশের চর ছিল। পরে অন্যদের সঙ্গে মসউদ আলীও মস্কো গিয়েছিল এবং তারপরে শওকত উসমানীর ভ্রমণের সাথী হয়ে দেশে ফিরে আসে।

শওকত উসমানী ১৯২৩ সালে ধরা পড়ার পরে পুলিসের কাছে বয়ান দিতে গিয়ে বলে যে,–সে লাহোরে গিয়েছিল তার ভ্রমণের সাথীকে খুঁজবার জন্যে, কিন্তু তাকে সে পায়নি। আমার মনে হয়, মস্‌উদ আলী শাহ্ মীরাটের সাধানার বাশিন্দা হলেও তার সঙ্গে শওকত উসমানীর লাহোরে দেখা করার কথা হয়ে থাকবে। ১৯২২ সালেই মসউদ আলী দ্বিতীয়বার ইরানের পথে মস্কো যায়। সম্ভবত : এবারও শওকত উসমানী মস্কো যেতে চেয়েছিল। কিন্তু লাহোরে গিয়ে সে মসউদ আলীকে পায়নি। মস্‌উদ আলী তোন হয়ে মস্কো পৌঁছেছিল। মস্কোতে যে ব্রিটিশ কমার্শিয়াল মিশনের ইনটেলিজেন্স অফিসার বা গোপন ব্যাপারের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে দেখা করে। তাঁকে সে নিজের গোপন সংক্ষিপ্ত ‘Bellmount’ জানিয়ে দেয় এবং বলে যে, সে ভারতবর্ষের কর্নেল সেসিল কে’র সঙ্গে পরিচিত। ব্রিটিশ কমার্শিয়াল মিশনের গোপন ব্যাপারের ভারপ্রাপ্ত অফিসার এই খবর “দি রাইট অনারেবল দি মারকুইস কার্জন অব্ কোডেলস্টন, পি সি কে জি,…” কে জানান। এবং মসউদ আলীর মুখে শুনে তার পরিচয়ও সেই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অফিসার কার্জনকে পাঠান। সেই পরিচয়টি হলো এই যে,−সে (অর্থাৎ মসউদ আলী) ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত তাশকন্দের মিলিটারি স্কুলে ছিল। তারপরে সে মস্কো হতে ইরানের ভিতর দিয়ে ভারতে রওয়ানা হয় এবং ১৯২১ সালের ১৫ই ডিসেম্বরে ভারতে পৌঁছায়। ভারপ্রাপ্ত অফিসার জানালেন যে, মসউদ আলীর সব কথা যাচাই করার সুযোগ তাঁর নেই। তবে, আলী শাহ্ শিক্ষিত ব্যক্তি। নিজেকে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে, এবং খুব ভালো (excellent) ইংরাজী বলতে পারে। মস্কো আসার পরে আলী শাহ্ বার্লিনে গিয়েছিল। সেখানে রায়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। তারপর সে মেজর গ্রীনের মারফতে মেজর ফলির [Folly(?)] সঙ্গে দেখা করে এবং ১৪ই অক্টোবর তারিখে (১৯২২) টেলিগ্রামযোগে ভারতবর্ষ থেকে ১০০ পাউন্ড পায়। তারপর সে থার্ড ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেস (নভেম্বর ৫ হতে ডিসেম্বর ৫) যোগ দেবার জন্যে মস্কো চলে আসে। বার্লিনে তাকে বলা হয়েছিল যে মস্কোতে তার সঙ্গে আর একজনের দেখা হবে। কিন্তু সেই ‘একজন’ তার সঙ্গে এস শেষ পর্যন্ত দেখা করেনি। মসউদ আলী বলল যে, সেইজন্য আমি একাই রিপোর্ট করছি।

আমার সন্দেহ হয় যে, সেই ‘আর একজন’ হয়তো নলিনী গুপ্ত ছিল। নলিনী গুপ্ত ভারতে পুলিসের কাছে বিবৃতি দেবার সময় বলেছে যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেসে সে এবং মসউদ আলী শাহ্ দর্শক হিসেবে যোগদান করেছিল। কংগ্রেস সম্বন্ধে আলী শাহ্ রিপোর্ট করেছে যে, ভারত হতে কোন প্রতিনিধি (Delegate) কংগ্রেসে আসেনি। অথচ এই প্রতিনিধিদের রাহাখরচ বাবতে ৮০০ পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসে ভারতের কাজের জন্য নতুন করে কোন টাকা মঞ্জুর করা হয়নি।

মসউদ আলী শাহ্ পরে আর একবার বার্লিনে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এম. এন. রায় তাকে লিখে জানিয়েছিল যে, সে হয় মস্কোতে থাকুক নতুবা ভারতবর্ষে ফিরে যাক। আমি এই কথাগুলি ইন্ডিয়া হাউসের কাগজপত্রের ফটোস্টাট কপি হতে সঙ্কলন করেছি। এর পরের খবর কর্নেল সেসিল কে’ তাঁর পুস্তকে লিখেছেন যে, মস্‌উদ আলী শাহ্ রাশিয়াতে গিরোর হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। কারাগার থেকে সে পালিয়ে যায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে আলী শাহ্ গিরোর হয়েছিল। গিরোর হলে আমরা অন্যান্য ভারতীয় কমরেডদের নিকট হতে খবর পেতাম। আমার মনে হয় মসউদ আলী শাহ্ ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরে এসেছিল তা না হলে সে শওকত উসমানী ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ১৯২৮ সালে আবার মস্কো যাবার সাহস পেত না।

দিল্লীতে বসে বসে শওকত উসমানী তার মস্কো যাওয়ার ব্যবস্থায় লেগে গেল। ১৯২৭-২৮ সালের প্রবল মজুর আন্দোলন, দীর্ঘস্থায়ী মজুর ধর্মঘট প্রভৃতি তার মন টলাতে পারল না। সে মস্কো যাবেই। ১৯২৮ সালের ১৭ই জুলাই হতে ৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন হবে, এটা মনে রেখেই সে তার প্রস্তুতি করতে লাগল। আগে যাঁরা মস্কোতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন তাঁদের ভিতরে লাহোরের মীর আব্দুল মজীদ, শেখুপুরায় ফিরোজুদ্দীন মনসুর ও হরিপুরের (হাজারা জিলা) গওহর রহমান খান, উসমানীর মতে, কিছু বেশী মাত্রায় কমিউনিস্ট ছিলেন। সে তাঁদের নিকটে ঘেঁসল না। পেশোয়ার জিলার মুহম্মদ শফীক, শাজানপুরের হবীব আহমদ যেতে রাজী হলেন, কিন্তু রফিক আহমদ অস্বীকার করলেন। শফীক সম্বন্ধে আগে অনেক বলেছি।

১৯২৮ সালের পার্টির কাজের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ ছিল না। জেল হতে মুক্তি পাওয়ার পরে হয়তো তাঁর ওপরে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। হবীব আহমদও তখন পার্টির জন্যে কিছুই করছিলেন না। জাল পরিচয়পত্র নিয়ে যেতে হবে জেনেও তাঁরা যেতে রাজী হলেন।

যাওয়ার আগে উসমানী কয়েকটি মজুর ইউনিয়নের নামে পরিচয়পত্র জাল করেছিল। আজমীঢ়ের অর্জুনলাল শেঠীও একটি জাল পরিচয়পত্রে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। শেঠীজী উসমানীকে কিছু টাকাও জোগাড় করে দিয়েছিলেন।

সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র তখন কেন্দ্রীয় আইন সভার সভ্য ছিলেন। তার মারফতে উসমানী জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে। তিনি আলমোড়া হতে দিল্লী এসে উসমানীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমাদের আন্দোলনের গোড়ার দিকে জীবনলাল যে আমার সহকর্মী ছিলেন সে-কথার উল্লেখ আমি আগে করেছি। উসমানী কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল অন্য হিসাবে, অর্থাৎ জীবনলাল যে যুগান্তর দলের নেতা ছিলেন সেই হিসাবে।

জীবন চট্টোপাধ্যায় আমাকে লিখেছেন :

“আমাদের অনেক আলাপ হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকেই আমি শুনেছিলাম তাঁর জেলের অভিজ্ঞতার কথা, কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিবর্তনের কথা।…মোটের উপর তাঁর কথা হলো জেলে পরস্পরের মধ্যে নানারকম ঝগড়া- কলহ ছিল। এসব ঝগড়া-কলহ নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারেও হতো। আবার সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা উপদলীয় ঝগড়াঝাঁটিও খুব চলত। পার্টি ফান্ড প্রভৃতি নিয়েও ঝগড়াঝাঁটি ছিল।…এসব কারণেই তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর পুরানো কমরেডরা এসব কাজের একেবারে অযোগ্য।

“তাই তিনি চান যুগান্তর পার্টির সাহায্য করতে। তিনি হাঁটা পথে আবার রাশিয়ায় যাবেন। যাওয়ার risk আছে। ওখানে গিয়েও কি অবস্থায় পড়েন, তা এখনই আন্দাজ করতে পারছেন না। তবু তিনি চেষ্টা করবেন রাশিয়া যাতে ভারতের liberation movement কে সাহায্য করতে রাজী হন তাঁর জন্য ওঁরা পাঠাতে পারেন অস্ত্র ও টাকাকড়ি। যদি তাঁদের রাজী করানো যায় তাহলে যোগ্য দলের কাছে যাতে সে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন তিনি। তিনি মনে করেন যুগান্তর পার্টির কাছে পৌঁছালেই তা দিয়ে কাজ হবে।

“সঙ্গে সঙ্গে ওসমানী বলেছিলেন, ‘আপনাদের পার্টির কোনও খবর আমায় না বলবেন; কারণ আমাকে আপনারা ভালভাবে চেনার সুযোগ এখনও পাননি। কেবল এমন একটা ঠিকানা আমায় দিন যেখানে চিঠি লিখলে আপনারা সে চিঠি পাবেন। আর ওখানে গিয়ে ঐ ঠিকানায় আমি লিখে জানাব কোন্ ঠিকানায় আপনার যোগাযোগ করবেন।”

“আমি একটা ঠিকানা তাঁকে দিয়েছিলেম। আর একটা code তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া কয়েকটি শব্দের code তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।

“তিনি চলে যাওয়ার পরে যে ঠিকানা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল সেখানে কোনও খবরই আসেনি…।

আপনাদের
জীবনলাল চট্টোপাধ্যয়
২২.৮.৬৯”

কানপুরের মোকদ্দমায় আমরা চারজন মাত্র আসামী ছিলাম। আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্য ছিল। কিন্তু উসমানী যত ঝগড়া-কলহের কথা বলেছে চারজনের ভিতরে তত ঝগড়া-কলহের সম্ভাবনা ছিল না। তা ছাড়া, আমরা চার-পাঁচ মাস মাত্র একত্রে ছিলাম।

১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষাশেষিতে যখন আমাদের সারা-ভারত ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির কনফারেন্স হচ্ছিল তখন উসমানী বিদেশ হতে ফিরে আসে। এসেই সে আমার মারফতে পার্টির নিকটে আত্মসমর্পণ করে। স্বীকার যে সে অন্যায় করেছে। তার জাল পাসপোর্ট সে আমাকে রাখতে দেয়। এমন কি তার পকেটে যে দু’চারটি বিদেশী মুদ্রা ছিল সেগুলিও ভয়ে সে আমাকে দিয়ে দেয়। উসমানী বলল, “আমায় যে শাস্তি দেবে তা আমি মাথা পেতে নেব। আমাকে কোথাও গ্রামে কাজ করতে পাঠিয়ে দাও।”

এই সময়ে উসমানী আমায় বলে যে কি ভাবে সে পরিচয়পত্র ইত্যাদি জাল করেছে। সেই সময়ে সে আমায় বলে যে যাওয়ার আগে সে কানপুরের বিজয়কুমার সিংহের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তাঁকে বলেছে যে বিদেশ হতে তাঁদের সংগঠনের জন্য অনেক টাকা পাঠাবে। বিজয়কুমারের নিকট হতে সে দু’শ টাকা নিয়েছিল।

উসমানীরা সৈয়দ মসউদ আলী শাহের নেতৃত্বে গিয়েছিল। করাচির ইরানী কসালের নিকট হতে ইরানী প্রজারূপে তারা সকলেই নূতন আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট করিয়ে নিয়েছিল। মসউদ আলী শাহ্ না থাকলে এ পাসপোর্টগুলি তারা কিছুতেই পেত না। মসউদ আলী শুধু যে অভিজাত পরিবারের ছেলে ছিল তা নয়, সে ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্তও ছিল। ইরানে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। ইরানে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরাই বাস করেন। ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছিল এমন সময়ে উসমানীরা মস্কো পৌঁছালেন। সকলেই খুশী হলেন। আগে আর কখনও এমনভাবে ভারতের প্রতিনিধিরা ভারতবর্ষ হতে রওয়ানা হয়ে রাশিয়ায় এসে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কোনোও কংগ্রেসে যোগদান করেননি। তাঁদের নিকটে স্তূপীকৃত পরিচয়পত্র। প্রতিনিধিরা পূর্ব পরিচিত। শওকত উস্‌মানী কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র। মোকদ্দমায় দণ্ডভোগ করে কারামুক্ত হয়েছে। তার নাম কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটারী। তখনও সেই পার্টিই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গ (section)। শওকত উস্‌মানী ও শফীক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরূপে গৃহীত হলো এবং অপর দু’জনকে সম্ভবত ইয়ং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কংগ্রেসে পাঠানো হলো। শওকত উস্‌মানী তো ষষ্ঠ কংগ্রেসে প্রেসিডিয়ামের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিল।

এই প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে অবশ্য ভারত হতে খবর নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। সোবিয়েত দেশ হতে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে খবর নেওয়া অসম্ভব ছিল। অপরিস্ফুট (cryptic) ভাষায় আমরা যখন লন্ডন হতে কলকাতায় টেলিগ্রাম পেলাম এবং সেই ভাষাতেই তার জওয়াবও দিলাম তখন ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হয়ে গেছে। আমরা বলেছিলেম প্রতিনিধিদের ভিতরে সকলেই জাল পরিচয়পত্র নিয়ে গেছে। তাদের ভিতরে সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছে, আর বাকীরা বোকা। শওকত উসমানী কংগ্রেস শেষ হওয়ার পরে সরে পড়েছিল। তখনও আমাদের বার্তা পৌছায়নি। সে ক্রিমিয়ায় হাওয়া বদল ক’রে ইউরোপ হয়ে চলে আসে। অন্যদের খবর শুরুতে কিছু পাইনি। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসেও বাকী তিনজন— মস্‌উদ আলী, হাবীব আহ্মদ ও শফীক মস্কোতে ছিল। রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের পুস্তকে তার উল্লেখ আছে। [৫০] তিনি এক পত্রে আমায় লিখেছিলেন, এই তিন জনের একজনকে (নিঃসন্দেহে বলা যায় সৈয়দ মসউদ আলী শাহকে) একদিন গভীর রাত্রে ঘুম থেকে তুলে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরে তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। মসউদ আলী শাহ্ যে একজন ব্রিটিশের চর তা নিশ্চয়ই সোবিয়েত গবর্নমেন্টের নিকটে ধরা পড়ে গিয়েছিল, এবং সেই রাত্রিতে তাকে ওইভাবে বধ্যভূমিতেই নিশ্চয় নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকবে। শওকত উসমানীর কথা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। মস্‌উদ আলী শাহ্ যে বিশ্বাস করার মতো লোক নয় এ ধারণা মুহাজির কমরেডদের মধ্যে অনেকে পোষণ করতেন। তা সত্ত্বেও উসমানী তাকেই প্রথম বারে সাথী নির্বাচন করেছিল। আর যদি কর্নেল কে’র লেখা সত্য হয় যে মসউদ আলী দ্বিতীয় যাত্রায় মস্কোতে গিরোর হয়ে জেল হতে পালিয়ে এসেছিল তা হলে ১৯২৭-২৮ সালে শওকত উসমানী তা বুঝল না কেন? তারা তখন কয়েক মাস ঘনিষ্ঠভাবে বাস করেছিল। শওকত উসমানীর এমন বন্ধুও আছেন যাঁরা বলছেন মসউদ আলী শাকে সোবিয়েত গবর্নমেন্টের হাতে সমর্পণ করার জন্যেই ১৯২৮ সালে শওকত উস্‌মানী তাকে মস্কো নিয়ে গিয়েছিল। এটা সত্য কথা নয়। তা হলে তো মস্কো পৌঁছেই শওকত উসমানী তাকে সোবিয়েত গবর্নমেন্টের হাতে দিয়ে দিত। মস্‌উদ আলী শাহ্ও উসমানীর মতো জাল পরিচয়পত্র (ম্যান্‌ডেট) নিয়ে গিয়েছিল। সেও সম্ভবত যোগদান করেছিল ইয়ং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কংগ্রেসে প্রতিনিধিরূপে। রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ বলছেন ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসেও তিনি মস্কোতে শফীক, হবীব ও আলী শাকে একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন, হোটেল লুকে তারা থাকত।

[50. My Life Story fiftyfive years, pp, 156-57]

শফীক, হবীব আহ্মদ মসউদ আলী শাহ্ সম্পর্কে শওকত উস্‌মানী ফিরে আসার পরে দীর্ঘকাল পর্যন্ত আমরা কোনো খবর পাইনি। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের পুস্তকে মুদ্রিত ও পত্রে লেখা ১৯২৯ সালের খবর আমরা এখন পড়ছি, আগে কিছুই জানতে পারিনি। ১৯৩২ সালের শেষার্ধে সেশন্স কোর্টে মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার শুনানি শেষ হয়ে যায়। তখন মোকদ্দমার রায় লেখার জন্যে জজ লম্বা সময় (পাঁচ মাস) নিলেন। ব্রিটিশ মজুরেরা আমাদের জন্যে আন্দোলন করেই যাচ্ছিলেন। তাঁরা সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর্ ইন্ডিয়ার মারফতে প্রস্তাব করলেন যে রায় লেখার সময়টা আসামীদের কোনো স্বাস্থ্যকর স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। ভারত গবর্নমেন্ট স্থির করলেন যে আমাদের আলমোড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠানো হবে। ঠিক এই সময়টাতে একদিন অপরাহ্নে আমি আমাদের ব্যারাকের গেটে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় জেল আফিস হতে একজন লোক এসে এক বাণ্ডিল চিঠিপত্র আমার হাতে দিয়ে গেল। সবচেয়ে ওপরের পত্রখানি ছিল একখানি পোস্ট কার্ড শওকত উসমানীকে লেখা। পড়ব বি, পড়ব না, তা স্থির করার আগেই পত্রখানি আমার পড়া হয়ে গেল। বোম্বে হতে মুহম্মদ শফীক লিখেছেন। যতটা আমার মনে আছে তা হচ্ছে এই : শফীক আগের দিন জাহাজ হতে নেমেছেন। ইউরোপ হয়ে (লন্ডন হয়ে লিখেছিলেন কিনা মনে করতে পারছিনে) এসেছেন। তারপরে লিখেছে ‘তোমাদের এই কষ্ট স্বীকারে কি ফায়দা হবে? কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে সংযুক্তিকরণ (affiliation) ছিল তাও তো স্থগিত হয়ে আছে।’ কিন্তু মুহম্মদ শফীক এতদিন কোথায় কিভাবে ছিল, বন্দী হয়েছিল কিনা, কিছুই জানি না। আন্দাজে আমরা অনেক কথা বলেছি, কেউ কেউ বলেছেন রুশ ও ব্রিটিশ বন্দীর বিনিময়ের ফলে শফীক ফিরে আসতে পেরেছে, সঠিক খবর কিন্তু কিছুই আমরা পাইনি। এই পুস্তকে শফীকের ঠিকানা আছে। পাকিস্তানের কোনো অনুসন্ধিৎসু বন্ধু ইচ্ছা করলে খবরটা নিতে পারেন। হবীব আদ নসীমেরই বা কি হলো? সে উত্তর প্রদেশের শাাহানপুর শহরের বাশিন্দা ছিল। কেউ ইচ্ছা করলে খবর নিতে পারেন। মহেন্দ্র প্রতাপের পত্র হতে বোঝা যায় মসউদ আলী শাহের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। শফীকের পত্রের সাদা ভাষায় লেখা এই ক’টি ছত্রের ভিতরে কি যে লুকানো ছিল, কিছুই বুঝলাম না, শওকত উসমানীর মাথা খারাব হয়ে গেল। সে বেঁকে বসল যে আলমোড়া সে যাবে না। কারা কর্তৃপক্ষ একজন লোকের জন্য গার্ডের একটা বড় সংখ্যা মোতায়েন রাখতে চান না। অনেক বুঝিয়ে, অনেক সম্‌ঝিয়ে শওকত উসমানীকে তো আলমোড়া নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু সেখানে গিয়েও তার মাথা খারাবই থেকে গেল। এই সময়ে (১৯৩২) শওকত উসমানী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হতে বহিষ্কৃত হয়। এ সব উনিশ শ’ ত্রিশের দশকের কথা। আমি নিজেকে উনিশ শ’ বিশেষ দশকের ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখছি।

অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সম্মেলনের সময়ে ভিতরে ভিতরে ফাঁক পেলেই কমিউনিস্ট পার্টিরও মিটিং হয়েছে। সমস্ত ভারতের পার্টি সভ্যরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভাবতে অবাক্ লাগে, উসমানী যে পার্টির নির্দেশ অমান্য করে জাল পরিচয়পত্র নিয়ে মস্কো গেল সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হলো না। সে যে এসেই ক্ষমা চেয়েছিল তাতেই সব কিছু চাপা পড়ে গেল। সে দিন আমরা কত দুর্বল পার্টি ছিলাম। কিন্তু পার্টি মিটিং-এ স্থির হয়েছিল যে লাহোরকে কেন্দ্র ক’রে শওকত উসমানী তার কর্মস্থল বেছে নেবে। সে লাহোরে গিয়েওছিল, কিন্তু থাকল না, চলে গেল বোম্বেতে। সেখান থেকে বা’র করল একখানি উর্দু কাগজ—”পয়ামে মজদুর” নাম দিয়ে। উসমানী ছিল বিকানীর রাজ্যের একজন অতি দরিদ্র প্রজা। কিন্তু তার মেজাজ যে রকমের ছিল তাতে বিকানীরের মহারাজা হলেই তাকে ভালো মানতো।

যদি কোনো লোকের নিকট উসমানীকে নতি স্বীকার করতে হতো সেই লোকলে জীবনে সে কোনদিন ক্ষমা করতে পারত না। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নিকট তাকে যে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল তার বিবরণ আমি আগে দিয়েছি। ‘এই বুঝি আমি অন্যের চেয়ে ছোট গণ্য হয়ে গেলাম’ তার মনে এই রকম একটি ভাবনা সর্বদা তাকে তাড়া করে বেড়াত। ১৯২৭-২৮ সালে যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ভিতরের অবস্থা কতটা জানত তা আমি জানিনে, তবে এম. এন. রায়কে উৎখাত করার এবং সম্ভব হলে তাঁর শূন্য সিংহাসনে চড়ে বসার উদ্দেশ্য নিয়ে উসমানী মস্কো গিয়েছিল। এম. এন. রায় তো প্রায় উৎখাত হয়েই ছিলেন, আর শওকত উসমানী খুব তাড়াতাড়ি যদি পালিয়ে না আসত তবে বিপদে পড়ত। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় দেখে যে কত সুবিধাবাদী ছিল শওকত উসমানী!

মীরাট মোকদ্দমার রায় হতে আমি এখানে কিঞ্চিৎ তুলে দিচ্ছি :

“He asked me to tell you that ‘your men’ attacked him over there without reason. But the C.I. has cut his feet as well as yours. He has nothing against you.” (Meerut Communist Conspiracy Case Judgement, Vol. II. Page 437 )

এই উদ্ধৃতি জজ রায়কে লেখা ডক্টর অধিকারীর এক পত্রের মুসাবিদা হতে নিয়েছেন। অধিকারীর সবে উসমানীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তিনি তাকে ভালো করে চিনেননি, বোঝেননি। তবুও রায়ের কিছু ক্ষমতা নেই জেনেও তিনি তাঁর নিকটে উসমানীর জন্যে ওকালতি করছেন। আর সুবিধাবাদী উসমানী অধিকারীর মারফতে রায়কে খবর পাঠাচ্ছেন যে তাঁর বিরুদ্ধে উসমানীর কোনো নালিশ নেই। অথচ মওকা মতো অবস্থায় পেলে সে রায়কে বিশ হাত গভীর জলের তলায় ডুবিয়ে দিত। উসমানী রায়কে জানাতে চেয়েছে যে অকারণে রায়ের লোকেরা মস্কোতে তাকে আক্রমণ করেছে। তাতে সি. আই. (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল) উসমানী ও রায় উভয়ের পায়ের তলা হতে মাটি সরিয়ে নিয়েছেন।

উসমানীরা জাল পরিচয়পত্র ষষ্ঠ কংগ্রেসে যোগ দিতে গিয়েছে এবং একজন ব্রিটিশ চরের সাহায্যে গিয়েছে। তারপরে সেই চরকে তাদের একজন হিসাবে সঙ্গে নিয়েও গিয়েছে। এই সত্য প্রকাশ করা কি উসমানীকে আক্রমণ করা? আশ্চর্য এই যে এটাই ডক্টর অধিকারী রায়কে জানাতে যাচ্ছিলেন।

ডক্টর গঙ্গাধর অধিকারী

ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট লাভ করার জন্যে গঙ্গাধর অধিকারী ১৯২২ সালে জার্মানীতে গিয়েছিলেন। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মার্কসবাদেরও পড়াশুনা করেছিলেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডক্টরেট তো তিনি পেয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে জার্মানীর কমিউস্টি পার্টির সভ্যও তিনি হয়েছিলেন। পার্টি সভ্য হওয়ার অনেক পরে জার্মানীতেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ডক্টর অধিকারী বলেছেন রায় তাঁকে খনও নিজের বাসস্থানে নিয়ে যাননি, তাঁদের আলোচনা রেস্তোরাঁতেই হয়েছে। এটা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয় না যে রায়ের আলোচনা অধিকারীর মনে দাগ কেটেছিল। দেশে ফেরার সময়ে যে তিনি এম. এন. রায়ের প্রতিনিধি হয়ে ফিরেছিলেন এ কথা তিনি গোপন করেননি। ১৯২৮ সালের ১০ ই ডিসেম্বর তারিখে তিনি বোম্বে পৌঁছেছিলেন। কলকাতায় আমাদের কনফারেন্স শুরু হয়েছিল। ঘাটে তাঁকে বোম্বেতে দেখে এসেছিল। সে-ই আমায় প্রথম জানালো যে রায়ের তরফ হতে অধিকারী নামে একজন এসেছেন। তারপরে অধিকারী কলকাতা আসার পরে ঘাটেই প্রথম তাঁকে কলকাতার অলবার্ট হলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি আমায় বললেন যে “I am coming from Roy” – (আমি রায়ের নিকট হতে আসছি)। রায় সেই সময়ে ভারতবর্ষে লোক পাঠাচ্ছিলেন। এটা অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় যে জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টির (সোবিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পরে বৃহত্তম পার্টি) সভ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশে ফিরলেন রায়ের লোক হয়ে! রায়ের বিরুদ্ধে কি কি চার্জ আছে তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, ভারতে আমরা তখনও জানতাম না। আমরা তখনও জানতাম না যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসে কি কি আলোচনা হয়েছিল, তিনি জার্মানীতে ছিলেন ব’লে সব কিছু জানতেন। রায়ের বিরুদ্ধে চার্জগুলির কথা তিনি তন্ন তন্ন করে জানতেন, আমরা এদেশের কমিউনিস্টরা তা জানতাম না। কমরেড ক্লেমেন্স পাম দত্ত ষষ্ঠ কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন এম. এন. রায় ছিলেন না। এই জন্যে কমরেড ক্লেমেন্স পাম দত্ত ইংল্যান্ডে ফেরার সময়ে জার্মানীতে এম. এন. রায়ের নিকটে সব কিছু বিস্তৃতভাবে রিপোর্ট ক’রে গিয়েছিলেন। এই রিপোর্ট করার সময়ে ডক্টর অধিকারী আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন। তিনি জেনেছিলেন ও বুঝেছিলেন যে নিজের বিচ্যুতির জন্যে কমিউনিস্ট ইন্‌টারন্যাশনালে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দিন ফুরিয়েছে। তবুও কেন তিনি মানবেন্দ্রনাথের তরফ হতে ভারতে এলেন? তিনি জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। সুন্দর কাবাডি বা অন্যদের মতো তিনি ছিলেন না। তাঁরা আগে কোনো কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন না। তাঁদের রায় রিক্রুট করেছিলেন।

বেচারা ডক্টর অধিকারী ছ’বছর পরে দেশে ফিরে পুরো এক’শ দিনও বোধ হয় বাইরে থাকতে পাননি। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় গিরেফ্ফার হয়ে জেলে যান। জেলে তিনি পার্টি শৃঙ্খলা হতে কখনও বিচ্যুত হননি। মানবেন্দ্রনাথ রায় সম্বন্ধে তাঁর মোহ কেটে গিয়েছিল।

গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা

আমরা গ্রেট ব্রিটেনের অধীন দেশ ছিলাম। এই জন্যে ইংরেজদের পক্ষে আমাদের দেশে যাতায়াতের সুবিধা ছিল এবং সেই জন্যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালেরও নির্দেশ ছিল যে দেশের অধীন দেশ আছে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে অধীন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।

ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। ভারতীয় ছাত্র ও ভারতীয় নাবিকদের ভিতরে তাঁরা কাজ করার চেষ্টা করেছেন। তবে নাবিকদের ভিতরে কাজ ক’রে তাঁরা সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কলকাতার পোর্টে এমন কোনো ভারতীয় নাবিকের দর্শন আমরা পাইনি যাঁরা দেশে এসে আমাদের পার্টিতে যোগ দিয়েছেন, বা আমাদের সঙ্গে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। একমাত্র কলকাতার নাবিক আবদুল হাকীম আমাদের জন্যে একখানি পত্র বহন করে এনেছিলেন। তাঁর সদিচ্ছা সত্ত্বেও এই পত্র নিয়ে একটা বিপর্যয় ঘটে যায়। এই বিশিষ্ট পত্রখানি তিনি নিরাপদে কলকাতা পর্যন্ত এনেছিলেন। সেবারে তিনি বেশ কিছুদিন কলকাতা ছিলেনও কিন্তু ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে (এখন এই রাস্তাটির নাম ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির পথিকৃত সভ্য আবদুল হালীমের নামে আবদুল হালীম লেন হয়েছে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির আফিসে এসে তিনি তা আমাকে দিতে বেমালুম ভুলে যান। (পত্রখানি আমাকেই দেওয়ার নির্দেশ ছিল।) আবার সফরে যাওয়ার সময়ে এডেন হতে বাড়ীতে চিঠি লিখতে গিয়ে রাইটিং প্যাডের ভিতরে দেখতে পেলেন যে আমাকে লেখা পত্রখানি ডেলিভারি দেওয়া হয়নি। তখন এডেনেই তিনি পত্রখানি ডাকে ফেলে দিলেন। মুজফফর আমদের নামে ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনের ঠিকানায় পাঠানো একখানি বড় খাম তো পুলিসের হাতে যাবেই। এই পত্র নিয়ে ভারতের সেন্ট্রাল লেজিএলটিব এসেমব্লিতে দারুণ হৈ চৈ হয়েছিল। পত্রখানি মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় সরকার পক্ষের ৩৭৭ নম্বর একজিবিট।

বোম্বে ও করাচী পোর্টে ব্রিটেনের পার্টি সংস্রবে আসা কোনো ভারতীয় নাবিক পার্টিতে এসেছেন কিনা তা আমি জানিনে। বিখ্যাত আমীর হায়দার খান ও পার্টির সংস্রবে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসেন।

ভারতীয় ছাত্রদের ভিতরেই ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি ভালো কাজ করেছেন। আগেকার দিনে ভারতের ‘কালা আদমী’দের সহিত ইংরেজরা হয় তো পার্থক্য বজায় রেখে মিশতেন। কিন্তু ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের ভিতরে এই রকম পার্থক্য বোধ ছিল না, তাঁরা প্রাণ খুলে ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে মিশতেন। এই কারণে ভারতীয় ছাত্ররা সহজে ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের প্রতি আকৃষ্ট হতেন। তবে, উনিশ শ’ বিশের দশকে যে-সকল ভারতীয় ছাত্র লন্ডনে কিংবা ইংল্যান্ডের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে আমাদের ব্রিটিশ পার্টির সংযোগে এসে কমিউনিস্ট হয়েছিলেন এমন কেউ সেই দশকে দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কিংবা গণ আন্দোলনে যোগ দেননি।

বাঙলা দেশে চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট মিস্টার পি সি নন্দী ১৯২৭-২৮ সালে দেশে ফিরে এসে কমরেড ক্লেমেন্স পাম দত্তের মৌখিক বার্তা আমায় পৌছিয়েছিলেন। কমরেড ক্লেমেন্স পাম দত্ত “গণবাণী”র জন্যে লন্ডনে সংগ্রহ- করা পনের পাউন্ড মিস্টার নন্দীর মারফতে পাঠিয়েছিলেন। সেই টাকাও তিনি আমায় দিয়েছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নের হিসাব অডিট্ করার ভিতর দিয়ে তিনি আমাদের পার্টির সঙ্গে কিঞ্চিৎ দূর-সংযোগ বজায় রাখছিলেন। খুব শীঘ্রই তিনি তা থেকেও সরে গেলেন।

মেদিনীপুরের অধিবাসী পুলিনবিহারী দিন্দা ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। ১৯২৮ সালে তিনি ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় গিরেস্তারের পরে তিনি শুধু পার্টিই ছাড়লেন না, ছাড়লেন কলকাতাকেও। বাকী জীবন তিনি মেদিনীপুরে কাটিয়েছেন। এখন তিনি আর বেঁচে নেই।

১৯২০-এর দশকে অধ্যাপক ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ক্যামব্রিজে পড়ার সময়ে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির সহিত ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখতেন। তিনি জার্মানী হতে প্রকাশিত ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির সাহিত্য ইংল্যান্ডে ভারতীয়দের মধ্যে বিতরণ করতেন। বার্লিনে গিয়ে তিনি এম এন রায়ের সঙ্গে দেখাও করেছেন। I.P.I.-র (ইম্পিরিয়েল পুলিস ইনটেলিজেন্সের) রিপোর্ট তাঁর নামের বিশেষ উল্লেখ আছে। কিন্তু দেশে ফিরে এসে তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেননি, কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। উনিশ শত চল্লিশের দশকে এবং পঞ্চাশেও কিন্তু সুগভীরভাবে ও সপরিবারে তিনি আমাদের সঙ্গে কর্মলিপ্ত হয়েছিলেন।

ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগের ভিতর দিয়ে যাঁরা কমিউনিস্ট হয়েছিলেন তাঁদের ভিতরে লাহোরের ব্যারিস্টার মিস্টার জীবনলাল কাপুরও একজন। কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় সেশন্‌স কোর্টে তিনি আমাদের পক্ষ সমর্থন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তখন কলকাতা থেকে কুদ্দীন আহমদ ও আবদুল হালীম মণিলাল ডক্টরকে নিযুক্ত করে ফেলেছিলেন। ব্রিটিশ পার্টির সংস্রবে আসা যে সকল ভারতীয় ছাত্র উনিশ-শ’ ত্রিশের দশকে দেশ ফিরেছেন তাঁদের ভিতরে অনেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এবং এখনও কাজ করছেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে ডক্টর কুঅঁর মুহম্মদ আশরাফ ১৯২৩ সালের শুরুতে আমাদের সংস্রবে এসেছিলেন। তখনকার পুলিস রিপোর্টে তাঁর নামোল্লেখও পাওয়া যায়। ব্রিটেনে তিনি পার্টির ঘনিষ্ঠ সংস্রবে ছিলেন। ত্রিশের দশকে দেশে ফিরে এসে তিনি পার্টির সব সময়ের কর্মী হয়েছেন। সজ্জাদ জহীর, ডক্টর জেড এ আহমদ আর হাজরা বেগমও ত্রিশের দশকে এসে পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। তামিলনাডুতে এস মোহন কুমারমঙ্গলম ও পার্বতী কৃষ্ণান (এঁরা দুজন ভাই-বোন) ত্রিশের দশকেই এসেছেন এবং পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। বাংলা দেশের নিখিলনাথ চক্রবর্তী, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ও রেণু রায় (চক্রবর্তী) ব্রিটিশ পার্টির সংস্রবে এসেই কমিউনিস্ট হয়েছেন। চল্লিশের দশকের শুরুতে বা কিছু আগে-পরে তাঁরা দেশে ফিরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যাপারটি কিছু পৃথক। তিনি সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য হিসাবে বিনা বিচারে বন্দী ছিলেন। ত্রিশের দশকে অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনিও বন্দী-নিবাসে মার্কসবাদ- লেনিনবাদের পড়াশুনা আরম্ভ করে দেন। এই বন্দী অবস্থাতেই তিনি বহরমপুরে বন্দী নিবাস হতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এ পরীক্ষা দিয়ে ডিটিংশনের সহিত পাশ করেন। তাঁর বিত্তবান ও অর্থশালী পিতা তখন গবর্নমেন্টকে লেখেন যে তিনি তাঁর পুত্রকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠাতে চান। গবর্নমেন্ট তাতে রাজী হওয়ায় ভূপেশ গুপ্ত ইংল্যান্ডে পড়তে গেলেন। তাঁর মার্কসবাদ- লেনিনবাদের শিক্ষা এদেশেই আরম্ভ হয়েছিল। সেই দেশে গিয়ে তিনি সেই শিক্ষাকে বাড়িয়েছিলেন। চল্লিশের যুগে আরও অনেকে ইংল্যান্ড হতে ফিরে এসে পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। সকলের নাম এখানে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ইংল্যান্ডে জবরদস্ত কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, কিন্তু দেশে ফিরে এসে তাঁরা কিছুই করেননি।

ওপরে যাঁদের নাম আমি উল্লেখ করেছি তাঁদের ভিতরে ডক্টর আশরাফ আর বেঁচে নেই, আর একমাত্র জ্যোতি বসুই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট)- এর সভ্য। বাকী সকলেই দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে রয়েছেন।

অন্য ভাবেও গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্য আমরা পেয়েছি। আমাদের কাজে সাহায্য করার জন্যে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা এদেশে এসেছেন। তাঁদের অবশ্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালই পাঠিয়েছেন। ভারতবর্ষ গ্রেট ব্রিটেনের অধীন দেশ ছিল বলে ইংরেজের পক্ষে, কমপক্ষে যে- কোনো ব্রিটিশ প্রজার পক্ষে, এদেশে এসে আমাদের কাজে সাহায্য করাটা ছিল অনেক সুবিধাজনক। একজন ব্রিটেনের বাশিন্দাকে বা অন্য কোনো ব্রিটিশ প্রজাকে ভারতবর্ষ হতে বহিষ্কার করার কোনো আইন ছিল না। ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ পার্টির সভ্য পার্সি গ্লাডিং (Percy Gladding) ভারতবর্ষে এসেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত কমিউনিস্টদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। আমি নিজে তখন জেলে ছিলেম।

জর্জ এলিশন

পাসিং গ্লাডিং ফিরে যাওয়ার কমবেশী এক বৎসর পরে জর্জ এলিশন (George Allison) আসেন। ১৯২৬ সালের ৩০ শে এপ্রিল তারিখে তিনি বোম্বে পৌছেছিলেন। জাতিতে তিনি স্কচ ছিলেন এবং পেশায় ছিলেন একজন কয়লা খনির মজুর। আর, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির তিনি ছিলেন একজন পদস্থ ও বিশিষ্ট সভ্য। এদেশে আসার সময়ে রেড-ইন্টারন্যাশনাল অফ লেবর ইউনিয়নস তাঁকে কি কি উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁর মুখ হতে সে কথা আমি কখনও শুনিনি। তবে তাঁর কাজ-কর্মের প্রোগ্রাম হতে আমরা যা বুঝেছিলাম তাতে খোলাখুলিভাবে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করবেন, আর পার্টির সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখবেন গোপনে। মে মাস হতে অক্টোবর পর্যন্ত তিনি বোম্বেতে ছিলেন। সেখানে এলিশনকে কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি। ছয় মাস তাঁর নির্বিঘ্নে কেটেছিল। কেউ বোঝেননি যে তিনি একজন কমিউনিস্ট।

জর্জ এলিশন স্বনামে ভারতে আসেননি। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি নাম করা সভ্য ছিলেন ব’লে স্বনামে সাম্রাজ্য ভ্রমণের ভিসা পাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজেই, ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল (Donald Campbell) এই ছদ্মনামে তাঁকে পাসপোর্ট গ্রহণ করে ভারতে আসতে হয়েছিল। ১৯২৬ সালে নভেম্বর মাসে জোগলেকরের কাছ থেকে আমার নামে পরিচয়পত্র নিয়ে ক্যাম্পবেল নামীয় এলিশন কলকাতায় এলেন। আমি তখন অসুখে শয্যাগত। জোগলেকরের পত্রে কোথাও লেখা ছিল না যে পত্রবাহক ব্রিটিশ পার্টির একজন সভ্য। হয়তো সে তা জানতও না। সে আমায় লিখেছিল যে পত্রবাহক একজন ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। কলকাতায় কিছু ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে চান। আমার ওখানে (৩৭, হ্যারিসন রোডে) এলিশন সকালবেলা এসেছিলেন। তিনিও বললেন ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করার কথা। বললেন, রাত্রে আবার আসবেন। আমি বললাম একজন ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নিকটেই থাকেন। রাত্রে আমি তাঁকে আমার ঘরে ডেকে আনব। আমি শিবনাথকে বললাম, “দেখুন, আমি অসুস্থ। আপনি রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এঁকে একখানা ট্যাক্সি কিংবা ঘোড়ার গাড়ীতে চড়িয়ে দেবেন।”

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এলিশনকে চিনেছিলেন। ফুটপাথে নেমে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি আমায় চিনেননি। অমুক সালে মস্কোর লেনিনগ্রাড স্টেশনে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।” সেই মুহূর্তেই এলিশনের কথাটা মনে পড়ে গেল। কারণ, তাঁর জীবনে মাত্র একবারই একজন ভারতীয়ের সঙ্গে মস্কোর লেনিনগ্রাড স্টেশনে দেখা হয়েছিল। এলিশনের মনে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মাল যে বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মস্কোর কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, আর মুজফফর আহমদ যখন ডেকে এনে তাঁর সঙ্গে বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তখন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন কমিউনিস্ট না হয়েই পারেন না; এরপরে এলিশনের সঙ্গে বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব ভাব হয়ে গেল। বন্দ্যোপাধ্যায়কেই এলিশন তাঁর ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল নামীয় পাসপোর্টখানা সযত্নে ও সঙ্গোপনে রেখে দেওয়ার জন্য দিলেন। সেই মুহূর্ত থেকেই সর্বনাশের শুরু হলো।

আমি এলিশনের খবরের জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকি। কিন্তু কোনো খবরই তিনি পাঠাচিছলেন না। আবার আমি ভাবি, কোথাকার কে যে এলেন? প্রতি বৎসর যাঁরা মজুরদের অবস্থা ও আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করতে ইউরোপ হতে বিশেষ করে ইংল্যান্ড হতে আসেন তাঁদের একজন কেউ হবেন বোধ হয়। এর পরে আমি ওই নভেম্বর মাসেই লাহোরে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন ব্যুরোর মেম্বর মুহম্মদ আলীর একখানি পত্র এসেছে। তাতে অন্য অনেক কথার সঙ্গে লেখা হয়েছে যে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন বিশিষ্ট সভ্য। তাঁর সম্বন্ধে যেন বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কলকাতায় না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কারণ, ক্যাম্পবেল তখন কলকাতার ট্রেড ইউনিয়নের দু’দলের ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। আরও পরিষ্কার ভাষায় বললে তিনি কিশোরীলাল ঘোষের বাক্‌পটুতায় আকৃষ্ট হয়ে মৃণালকান্তি বসুর দলের দিকে ঝুঁকেছিলেন। আমি কলকাতায় আবদুল হালীমকে পত্র লিখে সব কথা জানালাম। সে সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পবেলের সঙ্গে দেখা করল, কিন্তু তিনি (ক্যাম্পবেল) আবদুল হালীমকে কোনো আমল দিলেন না। ৩৭, হ্যারিসন রোডে তিনি হালীমকে দেখেছিলেন। সে দিনও যদি তিনি হালীমকে সব বলতেন তবে সর্বনাশের হাত হতে রক্ষা পাওয়া যেত।

১৯২৭ সালের জানুয়ারীতে আমি লাহোর হতে বোম্বে পৌঁছে দেখলাম ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলও কলকাতা হতে বোম্বে পৌঁছেছেন শাপুরজী সাকলাতওয়ালার বোম্বে আগমন উপলক্ষেই আমাদের বোম্বেতে এই সমাবেশ। জানকীপ্রসাদ আমার সঙ্গেই এসেছিল। লাহোরের শামসুদ্দীন হাস্সানও এসে পৌছেছিল এবং এসেছিল মাদ্রাজ হতে সি কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গারও। ভারতে পৌঁছানোর পরে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলের বোম্বে অবস্থানের প্রথম ছয় মাস তাঁর সম্বন্ধে কেউ কিছু বোঝেনি। কলকাতা হতে ডাকযোগে জোগলেকরকে তিনি যে- পত্র লিখেছিলেন সে পত্র বোম্বেতে পুলিসের হাতে পড়ে যায়। তা থেকেই পুলিস ক্যাম্পবেল সম্বন্ধে তদন্ত শুরু করে। আমরা যখন বোম্বেতে পৌঁছালাম তখন ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল সম্বন্ধে সব ব্যাপার হাট করে দেওয়া হয়েছে। পুলিস ইনফরমার পরিবৃত হয়েই আমরা বোম্বেতে ছিলাম। তবে আমরা কেউ তখনও জানতাম না যে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল হচ্ছেন আসলে জর্জ এলিশন।

বোম্বেতে আমরা কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেম। (১) ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টি শুধু বাঙলাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, অন্যান্য প্রদেশেও তাকে প্রসারিত করতে হবে। বোম্বেতে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি স্থাপন করার ব্যবস্থা তখন হয়ে গেছে। (২) বোম্বে হতে একখানি মারাঠী সাপ্তাহিক বা’র করতে হবে, নাম হবে “ক্রান্তি”। বাঙলার সাপ্তাহিক “গণবাণী” তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হলো যে “গণবাণী”কে আবার চালু করতে হবে। (৩) আরও সিদ্ধান্ত হলো যে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল কলকাতায় থাকবেন, আর নবাগত ফিলিপ স্প্রাট থাকবেন বোম্বেতে।

ক্যাম্পবেল আর আমার মধ্যে ব্যবস্থা হলো যে তিনি বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের ক্যালকাটা মেইলে ফিরবেন। আর, আমি ফিরব ভিন্ন পথে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের ক্যালকাটা মেইলে। আমার পথ কিছু বেশী, কাজেই আমার সময় বেশী লেগেছিল। বোম্বে হতে আমার ট্রেনটি ছেড়েও ছিল দেরীতে।

কলকাতা ৩৭, নম্বর হ্যারিসন রোডে পৌঁছেই খবর পেলাম ওখানে পুলিসের তল্লাশি হয়ে গেছে। আমার ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলের জন্যে ভয় হয়ে গেল। তিনি কয়েক ঘণ্টা আগে পৌঁছেছিলেন। সদর স্ট্রীটের একটি বোডিং হাউসে তিনি থাকতেন। তখন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৩৭, হ্যারিসন রোডে এসে পৌঁছেছিলেন। তাঁকেই ক্যাম্পবেলের খবর আনার জন্যে পাঠালাম। তিনি ফিরে এসে জানালের যে ক্যাম্পবেল গিরেস্তার হয়ে গেছেন। কারণ ছিল শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাখতে দেওয়া সেই পাসপোর্ট। তিনি ভাটপাড়ার কালিদাস ভট্টাচার্যকে পাসপোর্টখানি রাখতে দেওয়া সেই পাসপোর্ট। তিনি ভাটপাড়ার কালিদাস ভট্টাচার্যকে পাসপোর্টখানি রাখতে দিয়েছিলেন। ব্যানার্জি আর ভট্টাচার্য বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশনের যথাক্রমে সেক্রেটারি ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পুলিস নিশ্চিত খবর পেয়েছিল। কালিদাস ভট্টাচার্যের ঘরে ঢুকে একটি কুলুঙ্গিতে হাত দিতেই পাসপোর্টখানি পেয়ে গেল এবং তাই নিয়ে চলে গেল। ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল সবে রেলওয়ে স্টেশন থেকে তাঁর সদর স্ট্রীটের বোর্ডি হাউসে ফিরেছিলেন। পুলিসের দলবল সেখানে উপস্থিত হয়ে বলল, “মিস্টার ক্যাম্পবেল, আমরা আপনার পাসপোর্টখানি পেয়ে গেছি। আপনি আমাদের সঙ্গে লালবাজারে (পুলিস হেড্‌ কোয়ার্টার্সে) চলুন।” লালবাজার হতে ক্যাম্পবেলকে কলকাতা চীফ্ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে হাজির করানো হলো। কিন্তু ক্যাম্পবেলের মোকদ্দমা হবে বোম্বেতে, সেখানেই তিনি জাহাজ হতে নেমেছিলেন। বোম্বে হতে ওয়ারেন্ট এসে না পৌঁছানোর কারণে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে জামিনে ছেড়ে দেওয়ার অর্ডার দিলেন। কিন্তু ক্যাম্পবেল আমাদের বলে রেখেছিলেন যে যদি তিনি কখনও ধরা পড়েন তবে আমরা যেন এগিয়ে গিয়ে তাঁর জামিন ইত্যাদি না করাই। যে-সব ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের সঙ্গে তিনি মেলামেশা করেন তাঁদের দিয়েই যেন এ কাজটা করানো হয়। এটা পুলিসকে ধোঁকা দেওয়ার ব্যাপার ছিল। ওই মাসে তাঁর বোম্বে যাওয়ার পরে তাঁর সম্বন্ধে পুলিস সব কিছু জেনে গিয়েছিলেন। কাজেই, ধোঁকা দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। তবুও আমরা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম। কেউ ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলের জামিন দাঁড়াতে রাজী হলেন না। বাধ্য হয়ে আমরাই এগিয়ে গিয়ে তাঁকে জামিনে বা’র করলাম। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর জামিন দাঁড়িয়েছিলেন।

ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলের গিরেস্তারকে কেন্দ্র করে বাঙলায় একটা বেশ ‘ডামাডোল’ হয়ে গেল। কেউ কেউ বললেন শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যাম্পবেলকে ধরিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে যে পাসপোর্ট সঙ্গোপনে রাখতে দেওয়া হয়েছিল সেই পাসপোর্ট পাওয়া গেল কিনা ভাটপাড়ার কালিদাস ভট্টাচার্যের বাড়ীর কুলুঙ্গিতে! শিবনাথ বললেন, “আমি তো বিশ্বস্ত লোককেই পাসপোর্টখানি রাখতে দিয়েছিলেম। তাঁকে সব রকমে সাবধানও করে দিয়েছিলেম। কারিদাস ভট্টাচার্য সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেন, প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বিনা-বিচারে বন্দীও ছিলেন, এখনও তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির একজন সভ্য। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের (The Peasants and Workers Pargy of Bengal) সঙ্গেও তিনি ঘোরাফেরা করেন। আমি কোথায় অন্যায় করলাম?” কালিদাস ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, তিনি তাঁর বোনের বাড়ীতে পাসপোর্টখানি তাঁকে ফেরৎ দিয়ে যান। নতুন ব্যবস্থা করার আগেই তা পুলিসের হাতে পড়ে যায়। পুলিস নিশ্চিত খবর পেয়ে এসেছিল। তারা কালিদাস ভট্টাচার্যের বাড়ীতে ঢুকেই কুলুঙ্গির ভিতরে হাত দিয়ে পাসপোর্টখানি তুলে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঘর থেকে বা’র হয়ে চলে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার! কালিদাস ভট্টাচার্য পাসপোর্টের গুরুত্ব বুঝতেন। তবুও কেন তিনি তার রাখার নূতন ব্যবস্থা করলেন না? ভাটপাড়ায় ব্রাহ্মণীদের এত সব বিরাট বিরাট বাড়ী আছে যে কয়েক গজ হেঁটেই তিনি তার একটি বাড়ীতে এই দলীলখানি রেখে আসতে পারতেন। ১৯২৭ সালের জানুয়ারী মাসে পুলিস সে- সব বাড়ীতে ঢুকত কিনা তাতে গভীর সন্দেহ আছে। কে যে এ ব্যাপারের জন্যে দায়ী তা কখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে, পুলিস নিশ্চিত খবর পেয়ে এসেছিল, আর কালিদাস ভট্টাচার্য বড়ই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলকে বোম্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করার জন্যে মোকদ্দমা হয়। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে লন্ডন হতে সিবিল সার্বিস অফিসার ও আরও কে কে এসেছিলেন। কোর্টে প্রমাণ হয়ে গেল যে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল নামীয় পাসপোর্ট জাল, আর ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল আসলে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট সভ্য জর্জ এলিশন। বিচারে তাঁর আঠারো মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে গেল। এই আঠারো মাস সাজা খাটার পরে ইচ্ছা করলেই ব্রিটিশ প্রজা হিসাবে তিনি ভারতে থেকে যেতে পারতেন। ব্রিটিশ প্রজাকে ভারতবর্ষ হতে বহিষ্কার করার কোনো আইন ছিল না। কিন্তু ব্রিটেনের ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের সঙ্গে চক্রান্ত করে ভারতের ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট সাজা শেষ হওয়ার আগেই বোম্বে পোর্টে জর্জ এলিশনকে ইংল্যান্ডগামী একখানি জাহাজে তুলে দিল।

একটি খনি দুর্ঘটনার ফলে এলিশন খনিতে কাজ করার অনুপযুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ভিতরে একটা সহজাত নেতৃত্ব ছিল। ব্রিটিশ পার্টির পলিট ব্যুরোর তিনি একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ফিলিপ স্প্রাট

জর্জ এলিশনের পরে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি হতে এসেছিলেন ফিলিপ স্প্রাট। ১৯২৭ সালের জানুয়ারী মাসে সাকলাতওয়ালার বোম্বে আসাকে উপলক্ষ করে জর্জ এলিশনও কলকাতা থেকে বোম্বে এসেছিলেন। সেই সময়ে কয়েকদিন তাঁর সঙ্গে ফিলিপ স্প্রাটের দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ আলোচনা হয়েছিল।

স্প্রাট তখন ছিলেন একজন যুবক, ২৭ বছর মাত্র বয়স। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ফিজিক্স অনার্স (ট্রাইপোস) নিয়ে বি এ পাস করেছিলেন এবং গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। তাঁকে শিখিয়ে-পড়িয়ে সি পি দত্ত (Clemens Palme Dutt) ভারতে পাঠালেন। তিনি ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বে পৌঁছেছিলেন। কেউ কেউ লিখেছেন যে ১৯২৬ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর তারিখে তিনি বোম্বে পৌঁছেছিলেন। ১৩ ই জানুয়ারী (১৯২৭) সন্ধ্যা বেলা আমার সঙ্গে ফিলিপ স্প্রাটের প্রথম দেখা হয়েছিল বোম্বের ওয়াই এম সি এ-তে। সি কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার আমাকে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

আগেই বলেছি, জর্জ এলিশন জাল পাসপোর্ট নিয়ে আসার মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিছু দিন যেতে না যেতে ফিলিপ স্প্রাটও জড়িয়ে পড়লেন একটি রাজদ্রোহের (১২৪-এ আই. পি. সি) মোকদ্দমায়। তাঁর সঙ্গে এস. এস. মিরাজকর ও আরও একজন আসামী হয়েছিলেন। স্প্রাট “ইন্ডিয়া এন্ড চায়না” (“ভারত ও চীন”) নাম দিয়ে একখানি পুস্তিকা লিখেছিলেন। মিরাজকর এর প্রকাশক ও অন্য একজন মুদ্রক ছিলেন। এই তিনজনের নামেই বোম্বের চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে রাজদ্রোহের মোকদ্দমা দায়ের হলো। তাঁদের অবশ্য জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

মিসেস সরোজিনী নাইডুকে আমাদের বোম্বের কমরেডরা মা ডাকতেন। সকলে মিলে তাঁকে ধরলেন যে তিনি যেন এই মোকদ্দমার তদবীর করার জন্যে মিস্টার এম এ জিন্নাকে রাজী করান। মিসেস নাইডু নিজে মিস্টার জিন্নার বাড়ীতে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু মিস্টার জিন্না ব্রী নিতে রাজী হলেন না। তবে, একটি মূল্যবান উপদেশ তিনি মিসেস নাইডুকে দিলেন। বলরেন, দরখাস্ত করে কেসটি হাইকোর্টের সেশনসে ট্রান্সফার করিয়ে নেওয়া হোক। সেখানে ফিলিপ স্প্রাট ইউরোপীয়ান জুররের দ্বারা বিচারের দাবী ছেড়ে দিবেন। তাতে বেশীরভাগ ইন্ডিয়ান জুররের দ্বারা মোকদ্দমার বিচার হবে। ভারতবর্ষে একজন ইংরেজের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মোকদ্দমা হচ্ছে বলে স্বভাবতই ভারতীয় জুররা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়েই পারেন না। বোম্বের কমরেডরা মিস্টার জিন্নার উপদেশ অনুসারে কাজ করেছিলেন। মোকদ্দমা হাইকোর্টের সেশনে সোপর্দ করা হলো। একজন ইউরোপীয় জুরর ও আটজন ভারতীয় জুররকে নিয়ে হাইকোর্টের সেশনে জুরী গঠিত হয়েছিল। বিচারের পরে আটজন ভারতীয় জুরর মত দিলেন যে আসামীরা নির্দোষ। একজন ইউরোপীয় জুররই শুধু আসামীদের দোষী সাব্যস্ত করলেন। বহুজনের সাথে একমত হয়ে বিচারপতি আসামীদের মুক্তি দিলেন। ইন্ডিয়া-চায়না মোকদ্দমার পরিসমাপ্তি এইভাবেই ঘটেছিল।

১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি (বেন ব্রাডলি) এ দেশে এলেন। তাঁর বোম্বেতে থাকা স্থির হওয়ায় ফিলিপ স্প্রাটর কলকাতায় আসা স্থির হয়। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গেই স্থায়ীভাবে কলকাতায় আসেননি। একদল আমেরিকান টুরিস্টের সঙ্গে নিজেকে জার্মান- আমেরিকান পরিচয় দিয়ে একজন সোবিয়েত দেশীয় কমরেড এসেছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসে এই কমরেডের নাম মজুত ছিল এটাই তার আসল নাম। তাঁর পাসপোর্ট কি নাম ছিল তা জানিনে। তিনি সেই সময়ে ইয়ং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজন নেতা ছিলেন। যতদিন

আকাশ : ৪৫৮

টুরিস্টরা কলকাতায় ছিলেন ততদিন ফিলিপ স্প্রাটকেও এই কমরেডের সঙ্গে কলকাতার কন্‌টনেন্‌টাল হোটেলে থাকতে হয়েছিল। সময়টা ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাস ছিল। আমাকেও একদিন রাত্রে কনটিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে কমরেড মাজুতের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। সোবিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে নানা দেশ আছে। কিন্তু কমরেড মাজুত কোন দেশের লোক তা ফিলিপ স্প্রাট স্থির করতে পারেননি। তাঁর মতে মাজুত নিশ্চয় রুশ ছিলেন না। টার্ক হতে পারেন, ককেশিয়ানও হতে পারেন। স্প্রাটের ধারণা ভুল ছিল। মাজুত ছিলেন আমেরিকা হতে ফিরে আসা রুশ ইহুদী। যাই হোক, সে যাত্রা স্প্রাট আমাদের সঙ্গে ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে কয়েকদিন মাত্র ছিলেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাদ্রাজ সেশনে (ডিসেম্বর ১৯২৭) যোগ দেওয়ার জন্যে আমরা একসঙ্গে মাদ্রাজে যাই। সেবারেই প্রথম ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির তরফ হতে ন্যাশনাল কংগ্রেসের গৌহাটি সেশন্সের নামে সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া স্বনামে ইতিহার বিতরণ করেছিল। এই ইতিহারটি ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি তৈয়ার করে লন্ডনে ছেপেছিল। আমরা কলকাতায় ছাপানো প্যাকেট ডাকে পেয়েছিলেম। কমরেড আবদুল হালীম গৌহাটিতে ইতিহারগুলি বিতরণের ব্যবস্থা করেছিল।

মাদ্রাজ হতে ফিলিপ স্প্রাট বোম্বে চলে গিয়েছিলেন। পুরো জানুয়ারী মাস তিনি বোম্বেতে বসে বসে “A Call to Action”-এ (এ কল টু একশন) মুদ্রিত প্রবন্ধগুলি রচনা করেছিলেন।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শুরুর দিকে বোম্বেতে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির কমিটির একটি মিটিং হয়। এই মিটিংয়েই A Call to Action-এ মুদ্রিত প্রস্তাবগুলি আলোচিত ও গৃহীত হয়। আমিও এই সভায় যোগ দিয়েছিলেম। এই সময় ৩রা ফেব্রুয়ারী তারিখে, সাইমন কমিশন বোম্বেতে জাহাজ হতে অবতরণ করেন। বোম্বেতে হরতাল পালিত হয়। বহু কারখানার মজুরেরা ধর্মঘট করেন। আমরা মাতুঙ্গা হতে মজুরদের মিছিল নিয়ে ফোরাস রোড পর্যন্ত হেঁটে এসেছিলেম। এই উপলক্ষেই ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্‌স পার্টি কাস্তে-হাতুড়ি খচিত লাল পতাকা ও ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় বার হয়েছিল। তাতে বোধহয় সর্বপ্রথম মাইক ব্যবহার করা হয়।

কমরেড মাজুতের চুরিস্টরা কোথায় গিয়েছিলেন তা জানিনে। এই ফেব্রুয়ারী মাসে (১৯২৮) তাঁরা বোম্বেতে এসেছিলেন। বোম্বের একটা হোটেলে তাঁর সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়। এবারে তাঁর সঙ্গে বেশীক্ষণ কথা হয়েছিল। তিনি এম এন রায় সম্বন্ধেও আমায় প্রশ্ন করেছিলেন। আসল কথা হচ্ছে এই যে এম এন রায়ের কাজ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করার জন্যেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল মাজুতকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন।

১৯২৮ সালের মার্চ মাসে ফিলিপ স্প্রাট পাকাপাকিভাবে কলকাতায় এসে আমাদের সঙ্গেই ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে (বর্তমান নাম আবদুল হালিম লেন) থাকতে লাগলেন। এবারে তিনি তাঁর জীবনধারণের প্রণালী আমাদের মতো করে নিলেন, খাওয়া-দাওয়া সব আমাদের মতো, শুধু পোশাকটা আধা ইউরোপীয়ান মতো থেকে গেল। আমরা প্রবল আপত্তি করলাম, কিন্তু স্প্রাট কিছুতেই কোন কথা শুনলেন না। তিনি ট্রেড ইউনিয়নেও কাজ আরম্ভ করলেন। আমাদের কলকাতা ইলাকায় ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করা বোম্বের মতো সহজ ছিল না। তখনকার দিনে বোম্বের কলকারখানাগুলি বোম্বে শহরের ভিতরে অবস্থিত ছিল। চার পয়সার ট্রামের টিকিট কিনে সর্বত্র যাওয়া চলত। কিন্তু কলকাতার শিল্প ইলাকা ছিল হুগলী নদীর দু’ধারে বিস্তৃত, লম্বায় ৬০/৭০ মাইল হবে, বেশীও হতে পারে। একজন দরিদ্র ভারতীয় যে-খাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, একজন দরিদ্র ইউরোপীয় সে-খাওয়া খেয়ে বাচতে পারেন না। দরিদ্র ইউরোপীয়ের খাওয়া-পরার মান দরিদ্র ভারতীয়ের মানের চেয়ে অনেক উন্নত। কিন্তু ফিলিপ স্প্রাট নিজেকে আমাদের মানে অবনমিত করেছিলেন।

১৯২৮ সালের বাঙলার মজুর আন্দোলনের কঠোর শ্রম তিনি সহ্য করেছেন। কখনও তিনি পার্টির শৃঙ্খলা হতে এতটুকুও বিচ্যুত হননি। তিনি বিচ্যুত হয়েছিলেন শুধু তাঁর ইউরোপীয় মান হতে। এই জন্যেই সম্ভবত তিনি আর ইউরোপে ফিরে যেতে পারলেন না।

ফিলিপ স্প্রাট ও আমরা অন্যান্য মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আসামীরা একত্রে গিরেফ্ফার হয়ে মীরাট জেলে গিয়েছি। জেলে কোনোদিন কোনো অশোভন কাজ ফিলিপ স্প্রাট করেননি। তাঁর বিপ্লবী-মর্যাদা কখনও ক্ষুণ্ণ হতে দেননি।

এই পুস্তক আমার পার্টি জীবনের স্মৃতিকথা। এখানে আমি ঘটনার সন্নিবেশ করে যাচ্ছি। যে ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি আমায় লিখে যেতে হচ্ছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিলিপ স্প্রাটের অবদান যে অত্যন্ত বেশী এটা আমায় স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বড় দুঃখ যে এই ফিলিপ স্প্রাট আজ দলত্যাগী। পার্টি ছেড়ে দিয়ে তিনি যে পার্টির একজন দরদী হয়েছেন তা নয়, তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের একজন দুশমনে পরিণত হয়েছেন। পৃথিবীতে এইরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে; তবুও এক সময় আমার মনে হয় যে ফিলিপ স্প্রাটের ব্যাপারে এ রকমটা না ঘটলেই বুঝি ভালো হতো। দলত্যাগী হয়ে স্প্রাট যে একটা মোটা বেতনের চাকরি পেয়েছেন তাও নয়। একটি ভারতীয়কে বিয়ে করে তিনি কষ্টের জীবনযাপন করছেন। তাঁর কাছে আজ বড় হচ্ছে সর্বতোভাবে কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করা।

বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি

এটা তাঁর পুরো নাম। সংক্ষেপে তাঁর ভালোবাসার নাম বেন ব্রাডলি। মজুর শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। ১৪ বছর বয়সে কারখানার কাজে যোগ দেন। তার অল্প পরেই ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের শিক্ষা আরম্ভ করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে যখন শুরু হলো তখন তাঁর বয়স ষোল বছর। ১৯১৬ সালে তিনি ন্যাভিতে যোগ দেন এবং আড়াই বছর পরে এই কাজ হতে ছাড়া পান। ভারত গবর্নমেন্টের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে ১৯২১-২২ সালে তিনি একবার নয় মাসের জন্যে ভারতে এসেছিলেন। রাবলপিণ্ডিতে একটি অস্ত্র-মেরামতের কারখানায় তাঁকে কাজ করতে হতো। তার পর হতে পেশায় তিনি জার্নিম্যান ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন। তাঁর ইউনিয়নের নাম ছিল ইঞ্জিনীয়ারদের যুক্ত ইউনিয়ন (Amalganmated Union of Engineers)।

১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি যখন আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্যে ভারতবর্ষে এসেছিলেন তখন ভারতবর্ষ তাঁর নিকটে একেবারে অপরিচিত স্থান ছিল না। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ভারতে তীব্র মজুর সংগ্রাম চলেছিল। এই সংগ্রামের মধ্যেই বেন ব্রাডলি এদেশে এসে পড়েছিলেন। সুতাকল ও রেলওয়ে মজুরদের সংগ্রামে তিনি একান্তভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বোম্বেতে কেন্দ্র করেই তিনি কাজ করেছেন। খাওয়া-পরার স্ট্যান্ডার্ড, বিশেষ করে, খাওয়ার স্ট্যান্ডার্ড, ফিলিপ স্প্রাটের মতো তিনি কমিয়ে দেননি। সেই জন্যে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়নি।

মীরটা কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় অভিযুক্ত হয়ে কোনো দিন এতটুকুও দুর্বলতার পরিচয় তিনি দেননি। মোকদ্দমায় তাঁর দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। হাইকোর্টের আপীলে সে-সাজা কমে এক বছরের হয়েছিল।

১৯২৯ সালের ২০ শে মার্চ তারিখে অন্য সকলের মতো তাঁকেও পুলিস গিরোর করতে গিয়েছিলেন। রেলওয়ে ইউনিয়নের কাজে বোম্বের বাইরে ছিলেন বলে সেদিন ধরা পড়েননি। তার দুই বা তিন দিন পরে ধরা পড়েছিলেন। আর, মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসে। ইউরোপে ফিরে গিয়ে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকটে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে বিস্তৃত রিপোর্ট দাখিল করেছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে বেন ব্রাডলিই তাম্বে নামে ভারতের পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

বেন ব্রাডলি লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। তিনি ভারতবর্ষে ছিলেন, ভারতবর্ষে তিনি আন্দোলন করেছিলেন এবং আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেছিলেন, এ কথার উল্লেখ করতে তিনি গৌরব বোধ করতেন। যেমন করেই হোক আরও একবার ভারতবর্ষে আসার স্বপ্ন তিনি দেখতেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর সে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারেনি।

তিনি আমাদের সঙ্গে সর্বদা চিঠি লেখালেখি করতেন। তিনি ব্লাড প্রেসারে ভুগছিলেন। এই ব্লাড প্রেসারের জন্যেই তাঁকে হস্পিটালে পাঠানো হয়েছিল। হস্পিটালে যাওয়ার সময় তিনি আমায় পত্র লিখেছিলেন যে রক্তের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি হস্পিটালে যাচ্ছেন। আমার কি হয়েছিল যে সঙ্গে সঙ্গেই সে পত্রের উত্তর আমি দিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে পত্রোত্তর দিলে ব্রাডলি তা পেতেন। তারপরে খবর পেলাম যে বেন ব্রাডলি আর নেই। কেন তার পত্রোত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিলাম না এ জন্যে আজ আমার অনুতাপের সীমা নেই। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে আমাদের এই পরম বন্ধু ও সহযোদ্ধা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *