পেশোয়ার মোকদ্দমাগুলি
কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সূত্রপাত
১৯২১ সাল হতে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পেশোয়ারে পরে পরে চারটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা হয়েছিল। ১৯২৭ সালে হয়েছিল আরও একটি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা। সব কটি মোকদ্দমাই ফৈজদারী দণ্ডবিধি আইনের (ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের) ১২১-এ ধারা অনুসারে দায়ের হয়েছিল। ভারতে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সূত্রপাত পেশোয়ারেই হয়েছিল। সকলেই জানেন পেশোয়ার তখন ভারতবর্ষে ছিল।
এই মোকদ্দমাগুলি সম্বন্ধে কোনো কথা বলার আগে সংক্ষেপে সেগুলির পিছনকার কিছু বিবরণ এখানে দেওয়া দরকার। ভারতবর্ষে গত শতাব্দীতে কিংবা এই শতাব্দীর শুরুর দিকে যাঁরা রাজনীতিক বিপ্লব ঘটাবার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন তারা ধার্মিক সাধনার ভিতর দিয়েই এগুবার চেষ্টা করেছিলেন। কাজেই, বিপ্লবের পথে যে ধর্মাবলম্বীরাই এগিয়েছেন তাঁরা আপন আপন ধর্মাবলম্বীদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মুসিলম রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের যুদ্ধকে তাঁরা জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ বলেছেন। পাঞ্জাবের নামোহারী শিখেরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলেছেন : “রাজ করেগা খাসা ঔর না রাহেগা কোই”। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ আনন্দমঠই বাঙলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। ‘আনন্দমঠের দর্শনই তাঁদের বিপ্লবের দর্শন। হিন্দু ধর্মের পথের সকল কাঁটা দূর করাই ছিল পুনার চাপেকার ভ্রাতৃগণের উদ্দেশ্য। তাঁদের গঠিত বিপ্লবী সমিতির নাম “Society for the removal of obstacles to the Hindu Religion” তাঁরা ইংরেজ আমলাও খুন করেছিলেন। ‘ভবানী মন্দির’ স্থাপন করে সাধনার ভিতর দিয়েই অরবিন্দ ঘোষ বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জন করতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ-বিরোধী বৈপ্লবিক আয়োজনও আমাদের দেশে ধার্মিক প্রেরণাকে বাদ দিয়ে হয়নি। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বাস আবার শুধু ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাই, তাঁদের ভিতরে একটা আন্তর্জাতিক ভ্রাত্রীয় বোধ ছিল। এর অবশ্য কোনো শ্রেণী-ভিত্তি ছিল না। ছিল ধর্মীয় ভিত্তি।
লাহোরের পলাতক ছাত্রগণ
১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লাহোরের বিভিন্ন কলেজে অধ্যয়ণরত ১৫ জন বিপ্লবী মুসলিম ছাত্র ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পার হয়ে প্রথমে স্বাধীন জাতির ইলাকায় চলে যান, সেখান থেকে যান কাবুলে। তখন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ছিল। আমাদের দেশের সীমান্তগুলি বিশেষ করে পার হতে পেরেছিলেন। তাঁরাই শুধু যে সীমান্ত পার হয়েছিলেন তা নয়, মৌলবী ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীও সীমান্ত পার হয়েছিলেন। তিনি এই ছাত্রদের আগে সীমান্ত পার হয়েছিলেন, না, পরে তা আমার জানা নেই। তবে একটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে লাহোরের ছাত্রদের দেশত্যাগ করার বৈপ্লবিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেনর মৌলবী ওবায়দুল্লাহ সাহেব। এই কাজটি হয়তো তিনি সোজাসুজি করেছিলেন কিংবা করে থাকবেন তাঁর প্রিয় ছাত্র খাজা আবদুল হাইয়ের মারফতে। খাজা সাহেব একজন বিপ্লবী ছিলেন। বাহ্য দৃষ্টিতে তিনি সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনার কাজ করতেন।
উল্লিখিত ১৫ জন ছাত্র পরে ‘পলাতক ছাত্র’ বা ‘মুজাহিদ ছাত্র’ নামে অভিহিত হয়েছেন। ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ ধর্মযুদ্ধ। যাঁরা ধর্মযুদ্ধ করেন তাঁদের বলা হয় ‘মুজাহিদ’। পলাতক ছাত্রদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। যদি সীমান্তে সম্ভব না হয় তবে তুর্কির পক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করা। তুর্কিরা ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো করছিলেনই, তাছাড়া তুর্কির সুলতান ছিলেন মুসলিম জগতের খলীফা। কিন্তু কাবুলে পৌঁছানো মাত্রই মৌলবী ওবায়দুল্লাহ-সহ এই ছাত্ররা বন্দী হলেন-শিখল পরানো বন্দী নয়, নজরবন্দী।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মানী ও তুর্কি আফগানিস্তানে একটি ‘মিশন’ পাঠিয়েছিলেন। ভারত সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করা ছিল এই মিশনের উদ্দেশ্য। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও মৌলবী বারাকতুল্লাহ এই মিশনের সভ্য ছিলেন। ১৯২৫ সালে ২রা অক্টোবর তারিখে তুর্কি জার্মান মিশন কাবুলে পৌঁছেছিলেন। মহেন্দ্র প্রতাপের আত্মকথা হতে জানা যায় যে আমীর হাবীবুল্লাহ খানের সঙ্গে যখন এই মিশনের মূলাকাত হচ্ছিল তখন মহেন্দ্ৰ প্রতাপ, মৌলবী ওবায়দুল্লাহ, সিন্ধী ও লাহোরের ‘পলাতক’ ছাত্রদের নজরবন্দী হয়ে থাকার কথা আমীরকে বলেন। দু’জন শিখকে শিকল পরিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তাঁরা ভারতের কোনো বোমার মামলার সংস্রবে অভিযুক্ত হয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের কথাও মহেন্দ্র প্রতাপ আমীরের গোচরে আনেন। আমীর সঙ্গে সঙ্গেই মৌলবী ওবায়দুল্লাহ ও ছাত্রদের মুক্তি দিয়ে রাজ-অতিথি করার হুকুম দেন। শিখ বন্দী দু’জনকেও জেল হতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
লাহোরের বিভিন্ন কলেজ হতে ১৯১৫ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে যে পনের জন ছাত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের নাম নীচে দিলাম :
(১) আবদুল বারী
আবদুল কাদির
এম.এ অধ্যয়নরত ছাত্র
(২) আবদুল মজীদ খান
(৩) আল্লাহ নওয়াজ খান
(৪) আবদুল্লাহ নওয়াজ
বি.এ. ক্লাসের ছাত্র
(৫) আবদুর রশীদ
(৬) গুলাম হুসায়ন
(৭) জাফর হাসান এবক
(৮) আবদুর খালিক-বি.এ. ক্লাসের ছাত্র, চীফ কলেজ
(৯) মুহম্মদ হাস্সান- বি. এ. ক্লাসের ছাত্র, ইসলামীয়া কলেজ
(১০) খুশী মুহম্মদ ওর্ফে মুহম্মদ আলী
(১১) আবদুল হামীদ
মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র
(১২) রহমত আশলী
মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র
(১৩) সুজা উল্লা
(১৪) আল্লাহ্ নওয়াজ খান নীচের ক্লাসের ছাত্র শাহ্ওয়াজ খানের ভাই। এটা জানা গেছে যে বিদেশে গিয়ে এই ছাত্ররা ধর্মযুদ্ধ (জিহাদ) করেননি, তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামেই লিপ্ত হয়েছিলেন।
কাবুলে অস্থায়ী ভারত গবর্নমেন্ট
১৯১৫ সালে ১লা ডিসেম্বর তারিখে কাবুলে ভারতের একটি অস্থায়ী সরকার স্থাপিত হয়। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ হন তার সভাপতি, আর মৌলবী বারাকতুল্লাহ্ প্রধানমন্ত্রী। মৌলবী ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধী তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বরিত হয়েছিলেন। লাহোরের পলাতক ছাত্ররাও এই অস্থায়ী গবর্নমেন্টে যোগ দিয়ে নানা পদ গ্রহণ করেছিলেন। মহেন্দ্র প্রতাপ তাঁর পঞ্চান্ন বছরের জীবন কাহিনীতে ( My Life Story of Fifty Five Years) লিখেছেন যে তিনি একটি কাজ, আমাদের মতে অসঙ্গত কাজ করেছিলেন। এটাকে তিনি একটি মৌলিক ধারণা (Original idea) নামে আখ্যাত করেছেন। অস্থায়ী ভারত সরকারের সভাপতি হিসাবে পুরু সোনার চাদরে একখানি পত্র খোদাই করে তিনি তা রাশিয়ার জারের নিকটে পাঠান। এই পত্র রচনায় মৌলবী বারাকতুল্লাহ ও মৌলবী ওবায়দুল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। পত্রে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে জারের সাহায্যভিক্ষা যে করা হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। যুদ্ধে কিন্তু রুশ ব্রিটেনের বন্ধু ছিল, আর রাজা মহেন্দ্র প্রতাপেরা জার্মানিরা সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। জার্মান মিশনের ডক্টর ফন হেন্টিগ (Dr. Von Hentig) এই পত্র না পাঠাতে মহেন্দ্ৰ প্ৰতাপকে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা শোনেননি। যুদ্ধের সময় পত্রখানি জারের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গ পর্যন্ত পাঠানো সম্ভব হয়নি। তা পাঠানো হয়েছিল তাশকন্দে জারের গবর্নর জেনেরেলের নিকটে। পত্র বহন করে তাশকন্দে নিয়ে গিয়েছিলেন মুহম্মদ আলী ও শমসের সিং। মুহম্মদ আলী ছিলেন তাশকন্দে নিয়ে গিয়েছিলেন মুহম্মদ আলী ও শমসের সিং। মুহম্মদ আলী ছিলেন লাহোর মেডিকাল কলেজের পলাতক ছাত্র খুশী মুহম্মদ, আর শমসের সিংহের আসল নাম ছিল ডাক্তার মথুরা সিং। এত সোনা খরচ করেও পত্রে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে, পরম সৌভাগ্যের বিষয় এই ছিল বাহক দু’জন প্রাণ নিয়ে কাবুলে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। মহেন্দ্র প্রতাপ এতেও থামলেন না। আবারও তিনি জারের নামে এক পত্র লিখে তাশকন্দে জারের গবর্নর জেনেরেলের নিকটে দু’জনকে পাঠালেন। এই দু’জন আর কাবুলে ফিরে আসেননি। জারের গবর্নমেন্ট তাঁদের গিরেফতার করে ইরানে দখলকার ব্রিটিশ ফৌজের নিকটে পাঠিয়ে দিল সেখানে তাদের গুলি করে মারা হয়। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ শুধু সোনার চাদরে খোদাই করা পত্র পাঠানোর কথা তাঁর পুস্তকে লিখেছেন। অন্য খবরগুলি আমি ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিকের “ সোবিয়েৎ এশিয়ায় ভারতীয় বিপ্লবী” (India Revolutionaries in Soviet Asia) শীর্ষক প্ৰবন্ধ হতে (Link, new Delhi, January 26, 1926) সংগ্রহ করেছি।
লাহোরের পলাতক ছাত্রদের মধ্য হতে আল্লা নওয়াজ বোধহয় আফগান নাগরিক হয়েছিলেন। তাঁকে বার্লিনে আফগানিস্তানের মিনিস্টার নিযুক্ত করা হয়েছিল। মহেন্দ্র প্রতাপ তাঁর পুস্তকে (১৯৪৩ সালে প্রকাশিত) লিখেছেন “Mr. Allah Nawaz is Afghanisthan’s Minister in Berlin”. তাঁদের মধ্য হতে ক’জন কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তা আমি সঠিক বলতে পারব না। লাহোর মেডিকাল কলেজের ছাত্র আবদুল হামীদ “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে” ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি অন্যদের সঙ্গে দেশেও ফিরছিলেন, কিন্তু পামীর পর্যন্ত এসে আর এগুতে পারেননি। পুরনো পুলিস রিপোর্ট হতে জানা যায় যে ১৯২৬ সালে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। পেশোয়ারে তাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমাও হয়েছিল। তাতে তিনি যে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা পান উচ্চ আদালতের আপিলে সেই সাজা বাতিল হয়ে যায়। তারপরে তিনি বোধহয় আর রাজনীতিতে যোগ দেননি, কিংবা কোনো নিরাপদ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর নাম এরপর আর শুনিনি। পলাতক ছাত্রদের মধ্যে খুশী মুহম্মদ ও রহমত আশলী বিদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক নাম করেছিলেন। তাঁদের কিঞ্চিৎ পরিচয় আমি এখানে দেব।
মুহম্মদ আলীর পরিচয়
পুলিসের খাতায় খুশী মুহম্মদের অনেকগুলি নাম। যেমন খুশী মুহম্মদ ওর্ফে মুহম্মদ আলী, ওর্ফে সিপাসি, ওর্ফে ইব্রাহীম ও ওর্কে ডাক্তার নায়ার। তাঁর বাড়ী পাঞ্জাবের জলন্ধর জিলার নওয়ান শহরে। তাঁর পিতার নাম জান মুহম্মদ। খুশী মুহম্মদের মুহম্মদ আলী নামটিই বেশী প্রচারিত হয়েছিল। আমিও তার এই নামটি ব্যবহার করব। ১৯১৩ সালে তিনি লাহোর গবর্নমেন্ট কলেজ হতে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির এফ.এস.সি পরীক্ষা পাশ করে লাহোর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানে পড়ার সময়েই তিনি ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আরও ১৪ জন ছাত্রের সঙ্গে দেশত্যাগ করেন। পুলিসের রিপোর্টে যে তাঁদের পলাতক ও মুজাহিদ ছাত্র নামে অভিহিত করা হয়েছে সে কথার উল্লেখ আমি আগেই করেছি। প্রথম মহাযুদ্ধে ইংরেজ রাশিয়ার মিত্রপক্ষ ছিল। সেই রাশিয়ার সম্রাটকে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে আহ্বান করা এবং প্রতি পদে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মুহম্মদ আলী ও শমসের সিংকে (ডাক্তার মথুরা সিং) তাশকন্দ পর্যন্ত পাঠানো চরম হঠকারী কাজ ছিল। তবুও মুহম্মদ আলী ও শমসের সিং সাহসের সহিত সে কাজে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে তৃতীয় আফগান যুদ্ধের সময় মুহম্মদ আলীকে ভারত সীমান্তে স্বাধীন জাতির ইলাকায় গিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রচার করতে দেখা গেছে। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরে যে তিনি কমিউনিস্ট মতবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সঠিক সময়টা আমার জানা নাই।
আগানিস্তান হতে আরম্ভ করে পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনারের কাজে ঘুরেছেন। তিন জন কমরেডকে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি ফরেন (বৈদেশিক) ব্যুরো স্থাপিত হয়েছিল। তার হেড কোয়ার্টার্স ছিল প্যারিসে। মুহম্মদ আলী এই ব্যুরোর একজন সভ্য ছিলেন। অন্য দু’জন সভ্য ছিলেন যথাক্রমে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ক্লেমেন্স্ পাম দত্ত। হেডকোয়ার্টার্সে থাকতেন বলে মূলত মুহম্মদ আলীই ফরেন ব্যুরোর কাজের পরিচালনা করতেন।
দেশে ফিরে গোপন সাংগঠনিক কাজ করার জন্যে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। কিছুতেই ফিরতে পারেননি। ১৯২৪ সালে একটা ফরাসী জাহাজে চড়ে তিনি পণ্ডিচেরি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসী গবর্নমেন্ট তাঁকে সেখানে তিষ্ঠতে দিলে না। ফরাসী পুলিস তাঁকে চব্বিশ ঘণ্টা এমনভাবে ঘেরাও করে রেখেছিল যে তিনি কিছুতেই ভারতে প্রবেশ করতে পারলেন না। ফরাসী গবর্নমেন্টেরই হুকুমে তাঁকে পরবর্তী জাহাজে চড়ে আন্টোয়ার্প যাত্রা করতে হয়েছিল। মৌলবী ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর সঙ্গে আমানুল্লার আফগান গবর্নমেন্ট তাঁকে ও আরও অনেককে আগানিস্তান হতে বার করে দিয়েছিলেন। তারপরে তিনি কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করেছেন। পার্টির কাজে তিনি পশ্চিম ইউরোপেই বেশী সময় থেকেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন ব্যুরোর সভ্য হিসাবে যে তিনি প্যারিসেই থেকেছেন তার উল্লেখ আমি আগে করেছি। হিটলারের সৈন্যরা যখন প্যারিস দখল করেছিল (জুন, ১৯৪০) তখন মুহম্মদ আলী প্যারিসে ছিলেন। সেই সময়ে কমিউনিস্ট নামধারী কোনো কোনো দুর্বলচেতা ভারতীয় প্যারিসে উপস্থিত ছিলেন। তারা তখনই হিটলারের প্রচারক হয়ে পড়ল এবং তাই করে নিজেদের জীবন বাঁচালো। কিন্তু মুহম্মদ আলী কিছুতেই হিটলারের প্রচারক হতে রাজী হলেন না। এই জন্যে হিটলারের সৈন্যরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলে। এই খবর তখন ভারতের সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত হয়েছিল। মুহম্মদ আলীর কথা জানতেম বলে তা আমার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। অযোধ্যাপ্রসাদের সঙ্গে হম্মদ আশলীর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। ভারতের অন্য এক শহরে এই খবর তারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মুহম্মদ আলীর রুমানিয়া দেশীয়া স্ত্রী ছিলেন। এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর একটি মেয়েও জন্মেছিল। তাঁরা যে কোথায় গেলেন এ খবর আমরা জানতে পারিনি। আশ্চর্য এই যে মুহম্মদ আলীর সহকর্মী ক্লেমেন্স পাম দত্ত ও তাঁর সম্বন্ধে কোনো খবর রাখেন না।
রহমত আশলী ও ওর্ফে জাকারিয়া
পলাতক ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনে মুহম্মদ আলীর পরেই রহমত আশলী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পুলিস রিপোর্টে তার নাম রহমত আশলী ওর্ফে জাকারিয়া, ওর্ফে ইব্রাহীম ইয়াহিয়া ওর্কে গুরলাক (Goorlack), ইত্যাদি। বিদেশে আমাদের কমরেডদের নিকটে তিনি জাকারিয়া নামেই বিশেষ খ্যাত ছিলেন। পাঞ্জাবের গুজরাওয়ালা জিলায় তাঁর বাড়ী ছিল।
কাবুলে যে অস্থায়ী ভারত গবর্নমেন্ট স্থাপিত হয়েছিল জাকারিয়াও তাতে ছিলেন। আবার আমানুল্লাহ্ যাঁদের আফগানিস্তান হতে বার করে দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যেও ছিলেন জাকারিয়া। তিনি কখন কমিউনিজমের দিকে প্রথম ঝুঁকেছিলেন তা আমি জানিনে, তবে ডক্টর দেবেন্দ্র কৌশিক তাঁর ‘লিঙ্ক’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ লেখার জন্য তুর্কিস্তানে পুরনো সোবিয়েৎ পত্রিকা পড়েছিলেন। সে সব থেকে তিনি জেনেছেন যে “১৯১৯ সালের ৯ই জুন তারিখে তাশকন্দে অনুষ্ঠিত তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে জাকারিয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন”। কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের তরফ হতে “ভারতবর্ষ দীর্ঘজীবী হোক” আওয়াজের দ্বারা তাঁর বক্তৃতা অভিনন্দিত হয়েছিল। এই ঘটনা ঘটেছিল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রথম মস্কো পৌঁছানোর এক বছর আগে। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে রায়ের উদ্যোগে তাশকন্দে যখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন জাকারিয়া নিশ্চয় তাশকন্দে ছিলেন না। থাকলে তিনিও মুহম্মদ আলীর মতো পার্টির প্রবর্তক সভ্যদের একজন হতেন। অবশ্য, মুহম্মদ আলীর মতো তিনিও অনেক আগেই নিজেকে কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন। ১৯২৩ সালে জাকারিয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাজে ইরানের নানা স্থানে ছিলেন। সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রাচ্য বিভাগে কাজ করতে দেখা গেছে। বার্লিনেও তিনি আমাদের পার্টির কাজে নিযুক্ত থেকেছেন। তার পরে কখন যে তিনি পারিসের সর্বন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করেছিলেন তা আমি ভালো করে জানিনে। তবে, উনিশশ’ ত্রিশের দশকের শুরুতে কোনো এক বছর তিনি সর্বন ইউনিভার্সিটির · ডক্টরেটে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর থিসিস্ “মার্কসীয় দৃষ্টিতে ভারতের হিন্দু-মুসলিম সমস্যা” নাম দিয়ে ফরাসী ভাষায় পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়েছে।
ডক্টর রহমত আশলী ওর্ফে জাকারিয়ার বয়স এখন (১৯৬৮) আটষট্টি- উনসত্তর বছর হয়েছে। এস. এ. ডাঙ্গে আমাকে এক পত্রে লিখেছিল যে ১৯৪৬ সালে পারিসে এক হোটেলে ডক্টর রহমত আশলী তার সঙ্গে দেখা করে তার বাড়ীতে গিয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। ডাঙ্গে সেই পত্রেই লিখেছিল, সে তাঁকে কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিল, কিন্তু যতটা করা উচিত ছিল ততটা করতে পারেনি। তার মানে, ১৯৪৬ সালে ডক্টর রহমত আশলী অত্যন্ত দুরবস্থায় ছিল। ফাসিস্ট অধিকৃত ফরাসী দেশে ডক্টর রহমত আশলী কি করছিলেন, কোথায় ছিলেন তার কোন খবর আমরা জানিনে। তিনি ফরাসী দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কিনা তাও আমরা জানিনে। শুনেছি ডক্টর রহমত আশলী এখনও (১৯৭০) পারিসে রয়েছেন।
হিজরাৎ ও মুহাজির
খিলাফৎ আন্দোলন হতে হিজরাৎ আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ভারতের মুসলমানদের সাহায্য একান্তভাবেই পেতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁদের নিকটে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
The pledges given by Lioyd George declared unequivocally in these words: “Nor are we fighting to deprive Turkey of the rich and renowned lands of Asia MInor and Thrace which are predominantly Turkis in race”. অর্থাৎ লয়ড জর্জ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই কথাগুলি ঘোষণা করেছিলেন : “এসিয়া মাইনর ও থেসের তুর্কি জাতি অধ্যুষিত প্রাচুর্যময় প্রসিদ্ধ ভূমি হতে তুর্কিকে বঞ্চিত করার জন্যে আমরা এই লড়াই করছি না।”
(The History of the Indian National Congress, Vol. 1, Padma Publications Ltd. Bombay, p 189)
মুসলমানেরা অবশ্য পুরো আরব উপদ্বীপ চাইছিলেন। মাওলানা মুহম্মদ আলীর (‘কমরেড’ সম্পাদক) নেতৃত্বে ১৯২০ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে একটি খিলাফৎ ডেপুটেশন লন্ডনে গেল। কিন্তু লয়ড জর্জ তাঁর ওয়াদা পালন করলেন না। এই খবর দেশে পৌঁছামাত্রই ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসেই একটা প্রবল হিজরাৎ আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গেল। খিলাফৎ ডেপুটেশনের সভ্যরা তখনও লন্ডনে রয়ে গেছেন।
স্বাধীন আফগানিস্তানের ঘোষণা
হিজরাৎ একটি আরবী ভাষার শব্দ। তার অর্থ অত্যাচারের হাত হতে বাঁচার জন্যে আত্ম-নির্বাসন। যে ব্যক্তি হিজরাৎ (আত্ম-নির্বাসন) করেছেন তাঁকে বলা হয় ‘মুহাজির’। মুহাজির শব্দ বহুবচনে ‘মুহাজিরীন্’ হয়। একটি বিশেষ ঘটনার সঙ্গে যখন এই শব্দগুলি জড়িত তখন এগুলির বানান ও উচ্চারণ মনে রাখা উচিত। আমার মনে হয় না যে এটা তেমন কিছু কঠিন কাজ। আশ্চর্য এই যে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো লোকও ‘মুহাজির’কে ‘মুজাহির’ লিখেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা খিলাপ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার হতে লাগল যে ভারতবর্ষ আর মুসলমানদের পক্ষে থাকার উপযুক্ত জায়গা নয়। এখন দেশত্যাগ করে চলে যেতে হবে। এই সময়ে আফগানিস্তানের বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্ খান ঘোষণা করলেন যে ভারতীয় মুহাজিরদের তিনি আফগানিস্তানে থাকার জায়গা দিবেন। বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্ খান তার মর্যাদার আসন হতে এই ঘোষণা করেছিলেন। আগে তিনি ব্রিটিশের বৃত্তিভোগী ছিলেন। রাশিয়ার সোবিয়েৎ গবর্নমেন্ট সৰ্বপ্ৰথম মেনে নেন যে আফগানিস্তান পরিপূর্ণরূপে স্বাধীন দেশ। ১৯১৯ সালের এপ্রিল- মে মাসে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধ (Third Anglo – Afghan War) হয়। আগানিস্তানের অনুরোধে ১৯১৯ সালের ১৪ই মে তারিখে এই যুদ্ধের বিরতি ঘোষিত হলেও ১৯১৯ সালের ৮ই আগস্ট তারিখে রাবলপিণ্ডিতে ইংরেজের সঙ্গে আগানিস্তানের যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে ইংরেজরা আফগানিস্তানকে পরিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকার করে নিয়েছিল। এবং আরও স্বীকার করে নিয়েছিল আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতিতে ইংরেজরা কোনও রূপ হস্তক্ষেপ আর করবেন না। ১৯২১ সালের ২২শে নবেম্বর তারিখে মসৌরিতে পাকাপাকিভাবে এই চুক্তি অনুমোদিত হয়।
কাবুলে প্রথম মুহাজিরগণ
এপ্রিল মাসেই (১৯২০) মুসলমানদের দেশ ত্যাগ শুরু হয়ে যায়। জায়গা-জমীন ও বাড়ি-ঘর বিক্রয় করে সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানেরাই গেলেন সর্বাপেক্ষা বেশী। তারপরে বোধহয় পাঞ্জাবের মুসলমানদের স্থান, অন্যান্য প্রদেশ হতেও অল্প সংখ্যক লোক গেছেন। ডাক্তার পট্টভি সীতারামাইয়া তাঁর কংগ্রেসের ইতিহাসে (The History of the Indian National Congress, Vol.1, page 199) লিখেছেন যে আঠারো হাজার মুসলমান এই সময়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। ভোপালের রফীক আমদের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি (৬০ পৃষ্ঠা) তিনি বলেছেন যে আরও ক’জন মুহাজির সহ তাঁর দলই ১৯২০ সালের ১লা মে তারিখে কিংবা কাবুলে পৌঁছানোর পরের দিন মুহম্মদ আকবর খানও কাবুলে পৌঁছেছিলেন এটা সঠিক তথ্য বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আকবর খানের মোকদ্দমার রায়ে (৩১.০৫.১৯২২) লিখিত হয়েছে যে :
“He [Muhammad Akbar Khan] was at home in Haripur in june, 1920, when the Hijrat movement was at its height.” অর্থাৎ “১৯২০ সালের জুন মাসে যখন হিজরাৎ আন্দোলন তার চূড়ায় পৌঁছেছিল, সে (মুহম্মদ আকবর খান) তখন হরিপুরে তার বাড়ীতে ছিল।”
আমাদের যথাসম্ভব সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা উচিত। সেই জন্যেই মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমার রায় হতে ক্ষুদ্র উদ্ধৃতি এখানে দিলাম। কিন্তু মুহম্মদ আকবর খান তাঁর এক মুলাকতকারীকে বলেছেন যে মুহাজিরদের দেশত্যাগ পুরোপুরি আরম্ভ হওয়ার পনের দিন আগে তাঁরা কাবুলে পৌঁছেছিলেন।
মুহাজিরদের ভিতর হতে সত্যই ব্রিটিশ ও খ্রিষ্টান শাসিত ভারতবর্ষ ত্যাগ করে মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানে বসবাস ইখতিয়ার করতে গিয়েছিলেন। যাঁরা বয়সে যুবক ও শিক্ষিত ছিলেন তাঁদের ভিতরে অনেকে, হয়তো বেশীর ভাগই চেয়েছিলেন যে আনাতোলিয়ায় গিয়ে তাঁরা তুর্কির হয়ে লড়াই করবেন। এই ধরনের যুবকদের ভিতরেও পরে অনেকে মতের পরিবর্তন করেছিলেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা শওকৎ উসমানীর নাম করতে পারি। তাঁর আসল নাম ছিল মাওলা বখ্শ। মাওলা বখ্শের অর্থ আল্লাহর দান। কিন্তু দেশ ত্যাগ করে যাওয়ার সময় শওকত উসমানী যে নাম নিয়েছিল তার অর্থ হচ্ছে উসমানীয় সাম্রাজ্য বলা হতো। মুহাজিরদের ভিতরে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষিত যুবকের ইচ্ছা ছিল কোনরকমে দেশের বাইরে যাওয়া এবং দেখা বাইরে থেকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কি করা যায়। কাবুলে পৌঁছেই কিছু শিক্ষিত যুবক যে মৌলবী আবদুর রবের অনুরোধে বিপ্লবের দেশ সোবিয়েৎ ভূমিতে যেতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন তা আমি অন্যত্র লিখেছি। তা থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায় যে আনাতোলিয়া যাওয়ার একটা বিশেষ উন্মাদনা নিয়ে সকল যুবক দেশ ত্যাগ করেননি। এই যুবকেরা মৌলবী আবদুর রবের মারফতে বাদশাহের নিকট হতে সোবিয়েৎ দেশে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু বাদশাহ্ সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি।
এরপরে শিক্ষিত মুহাজির যুবকগণ দলবদ্ধভাবে আনাতোলিয়া যাওয়ার অনুমতি চেয়ে বাদশাহ্ আমানুল্লাহ খানের নিকটে দরখাস্ত পেশ করেন। প্রথমে সিদ্ধান্ত জানাতে আমানুল্লাহ খান গড়িমসি করছিলেন। কিন্তু মুহাজিররা যখন জানলেন যে বাদশাহের ছাড়পত্র না এলে তাঁরা ছাড়পত্র ছাড়াই রওনা হয়ে যাবেন তখন অনুমতি পাওয়া গেল। জস সিরাজে যে-সকল শিক্ষিত মহাজির ছিলেন তাঁরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন এবং যথাক্রমে মুহম্মদ আকবর খান ও মুহম্মদ জান নেতা নির্বাচিত হলেন। মুহম্মদ আকবর খান হাজরা জিলার হরিপুরের বাসিন্দা। ইংরেজি ও পারসী ভাষা তিনি খুব ভালো জানতেন। পঁচিশ- ছাব্বিশ বছর ছিল তাঁর বয়স। মুহম্মদ জান ছিলেন পেশাওয়ারের লোক। প্রথমে মুহম্মদ আকবর খানের নেতৃত্বে আশি জনের একটি কাফিলা মজার-ই-শরীফ হয়ে রওয়ানা হলেন। শওকৎ উসমানী লিখেছে প্রায় ৩০০ মাইলের হিন্দুকুশের অতি কষ্টসাধ্য পথ তিন সপ্তাহের কিছু সময়ে অতিক্রম করে তাঁরা পাতাকেসর পৌঁছেছিলেন। ওখানে আমুদরিয়া (অক্সাস) সমতল ভূমিতে নেমেছে। মুহম্মদ আকবর খানদের মোকদ্দমার বিচারক, পেশাওয়ারের সেশন জজ জে. এইচ. আর. ফ্রেজার J.H.R Fraser IC.S.) তাঁর রায়ে লিখেছেন পাতাকেসর ‘বলশেভিক’দের জায়গা। শওকৎ উসমানী লিখেছে পাতাকেসর আফগান সীমায় অবস্থিত। ওখান থেকে নদী পার হলেই তিরমিজ,-সোবিয়েৎ ভূমির একটি শহর। উসমানীর কথাই ঠিক। সেই সময়ে তিরমিজ তুর্কিস্তান রিপাবলিকের একটি শহর ছিল। এখন তা উজ্বেকিস্তান রিপাব্লিকের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
একটি কথা রফীক আহমদ বলেননি, শওকত উসমানীও তার লেখায় উল্লেখ করেনি। কিন্তু জজ্ ফ্লেজার তাঁর রায়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন পাতাকেসরে পৌঁছে মুহাজিররা মুহম্মদ আকবর খান ও পেশাওয়ারের আবদুল কাইয়ুমের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। তাঁরা ভাবলেন, এই দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে সোবিয়েৎ ইলাকায় প্রবেশ করলে তাঁদের বিপদ ঘটতে পারে। জজের মতে পাতাকেসরেই মুহম্মদ আকবর খানের নেতৃত্বের প্রায় অবসান ঘটেছিল।
আকবর খান একটি রিসালদার পরিবারে লোক। তাঁদের পরিবার তখনকার সমাজব্যবস্থায়, হয়তো এখনও, সম্ভ্রান্ত ও বিত্তবান ছিল। আকবর খানের পিতা হাফীজুল্লাহ্ একসময়ে সি আই ডি-র লোক ছিলেন। তাঁর কর্তব্য ছিল মুসলিম বিদ্রোহী উপনিবেশ চমরকন্দ (উজবেকিস্তানের সমরকন্দ নয়) ও সমস্তার খবর সংগ্রহ করা। এই দুটি জায়গা ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যখানে স্বাধীন জাতির ইলাকায় অবস্থিত। সরকারী রেকর্ডে আছে যে এক সময়ে তাঁকে সমস্তায় গিয়ে একটি বোমা সংগ্রহ করে আনতে বলা হয়েছিল এবং তিনি এই রকম একটি বোমা জোগাড় করে এনেওছিলেন। এটা ছিল সেই রকমেরই চমরকন্দ বোমা যে রকম বোমা রাবলপিণ্ডি স্টেশনে ছোঁড়া হয়েছিল। বোঝা মুশকিল যে হাফীজুল্লাহ্ কোন্ পক্ষের আসল লোক ছিলেন। বিদ্রোহীরা তাঁকে বোমাটি দিয়েছিলেন কেন? কে জানে তিনিই রাবলপিণ্ডির বোমা এনে দিয়েছিলেন কিনা? মোটের ওপরে, মুহম্মদ আকবর খানের মুহাজির কাফিলার নেতৃত্ব পাতাকেসরে শেষ হয়ে যায়নি। তাঁর সেই নেতৃত্ব তাশকন্দে কাফিলা পৌছা পর্যন্ত ছিল। আর, জজ্ যে লিখেছেন আবদুল কাইয়ুম লাহোরে নিযুক্ত পুলিসের ডেপুটি সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন তা ঠিক নয়। এটা অবশ্য ঠিক যে তাঁর পিতা খান বাহাদুর আবদুল হাকীম খান লাহোরের সি আই ডি পুলিসের ডেপুটি সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন। আবদুল কাইয়ুমকে তাঁর পিতৃ-সংযোগের জন্যে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। তিনি কিন্তু আর দেশে ফিরে না এসে সোবিয়েৎ দেশের নাগরিক হয়েছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে তাঁর নিকটে আবদুল কাইয়ুমের মেয়েকে আনা হয়েছিল।
মোটের ওপরে, পাতাকেসর হতে আমুদরিয়া পার হয়ে আশি-বিরাশি জন মুহাজির তিরমিজ পৌঁছেছিলেন। সেখানে তাঁদের সোবিয়েৎ কর্তৃপক্ষ বিরাটভাবে অভ্যর্থনা করেন এবং তাঁদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন। হিন্দুকুশ অতিক্রমকারী শ্রান্ত ক্লান্ত মুহাজিরগণ তিরমিজে সত্যিকার বিশ্রাম লাভ করলেন। সেই সময়ে এই অঞ্চলে তুর্কমেনরা বাসমাচিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল। তারা কোনো কোনো জায়গায় রেলের লাইন তুলে ফেলেছিল। বাসমাচিরা ছিল ওই দেশের ধনী কৃষক ও ফিউডাল ভূম্যধিকারী। তারা লুঠতরাজও করত। বাসমাচি উজবেক ভাষার শব্দ। তার অর্থ দস্যু। পেছন হতে ব্রিটিশ তাদের অস্ত্র ও অর্থ জোগাচ্ছিল। সাময়িকভাবে তিরমিজ অন্য সোবিয়েৎ ইলাকা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পথে বিপথ আছে বলে সোবিয়েৎ কর্তৃপক্ষ মুহাজিরদের তিরমিজে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। বললেন, তাঁরা যেন স্টীমার আসলে তাতেই যান। প্রথম কাফিলার মুহাজিরদের ভিতরে অর্ধেকেরও বেশী লোক আনাতোলিয়ায় গিয়ে তুর্কিদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের আর কিছুতেই বিলম্ব সইছিল না। তাঁরা প্রস্তাব করলেন তাঁদের দু’খানা দেশীয় নৌকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। তাতেই তাঁরা চার্জও রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত যাবেন। সেখান থেকে রেলপথে যাবেন ক্রাসনোবোদস্ক, তার পরে জলপথে বাকু। সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল নৌকাযোগে কির্কির দিকে মুহাজিররা যাচ্ছিলেন। নদীর কূল হতে তুর্কমেনদের নিমন্ত্রণ এলো। তারা বললো, “তোমরা মুসলমান ভঅই, শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে এসেছো। আমাদের এখানে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে যাও”। নৌকার কিছু সংখ্যক মুহাজির বললেন, “নিমন্ত্রণ যখন করছে তখন কেন ভিড়াব না নৌকা?” কিন্তু মুহাজিররা কূলে যখন নামলেন তখন চার দিক হতে তাঁদের ঘিরে ফেলা হলো। তলাশী করে দেখা হলো তাঁদের নিকটে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা। যখন দেখা গেল যে তাঁদের নিকটে কোনো অস্ত্রই নেই তখন শুরু হলো তাঁদের ছোটানো, আর সঙ্গে সঙ্গে মারও পড়তে লাগল তাঁদের ওপরে। মাজার-ই- শরীফ হতে একজন তুর্কি মুহাজিরদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে সরফরাজ নামক একজন পথে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই এই তুর্কিকে সরফরাজ নাম দিয়েই মুহাজিররা সঙ্গে নিয়েছিলেন। কারণ, এই নামেই আফগান গবর্নমেন্টের ছাড়পত্র তাঁদের নিকটে ছিল। তাঁকে সঙ্গে আনাতে মুহাজিরদের উপকার হয়েছিল। তিনি তাঁদের কথা তুর্কমেনদের বোঝাতে পারছিলেন, আবার তুর্কিমেনদের কথাও বোঝাচ্ছিলেন তাঁদের। শেষ পর্যন্ত মুহাজিরদের সম্বন্ধে তুর্কমেন বৃদ্ধদের সভা বসল। তাতে তাঁদের সকলের প্রতি মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা হলো। তাঁদের গুলি করে মারার জন্যে প্রথম হুকুম দেওয়াও হয়ে গিয়েছিল এমন সময়ে এক বৃদ্ধ সেখঅনে ঘোড়া ছুটিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “বন্দীদের নিকটে আফগান গভর্নমেন্ট আমাদের দায়ী করবেন, চাই কি আমাদের ইলাকা তাঁরা আক্রমণও করতে পারেন। অতএব, বন্দীদের মেরে না ফেলে কয়েদ করে রাখা হোক।” রফীক আমদের বিবৃতি হতে বোঝা যায় যে সেদিন আফগান গবর্নমেন্টের ছাড়পত্রের দৌলতে মুহাজিররা প্রানে বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপরে একদিন লালফৌজের কামান গর্জন শুনে বন্দীদের ছেড়ে দিয়ে তুর্কমেনরা পালিয়ে যায়। মুহাজিরেরা আশ্রয় পেলেন কির্কির দুর্গে। সেখানে তাঁদের জন্যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আর তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন চাদজও যাওয়ার স্টীমারের জন্যে। ইতোমধ্যে তুর্কমেনরা বিরাট সশস্ত্র শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এলো। কির্কির দুর্গ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। লালফৌজ যখন তুর্কমেনদের প্রতি- আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন তখন ভারতের মুহাজিরগণও অধ্যক্ষের নিকটে গিয়ে অস্ত্র চাইলেন। বললেন, তাঁরাও যুদ্ধ করবেন তুর্কমেন প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। অস্ত্র তাঁদের দেওয়া হয়েছিল এবং ট্রেঞ্চ হতে নদীর কূল তাঁরা রক্ষা করেছিলেন। আমাদের দেশের মুহাজিররা যে লালফৌজের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেটা ইতিহাসে আমাদের পক্ষে গৌরবের বিষয় হয়ে থাকবে। এতকাল পরে রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশতম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে সর্বোচ্চ সোবিয়েৎ তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁরা কিকি দুর্গে অস্ত্রধারণকারী মুহাজিরদের একজন, ভোপালের রফীক আহমদকে “Medal for ‘Combatment’ for his valour in fighting against the Counter-revolutionries in Central Asia in the latter half of 1920” দিয়ে ভূষিত করেছেন। সেন্ট্রাল এশিয়ায় ১৯২০ সালের শেষার্ধে প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সম্মাননায় রফীক আদ যে পদক পেলেন সেটা তিনি তাঁর কমরেডদের প্রতিনিধিরূপেই পেয়েছেন। তাঁদের অনেকে আজ বেঁচে নেই। কেন জানিনে, তুর্কমেন দ্বারা গিরেফতার ইত্যাদির বিবরণ মুহম্মদ আকবর খান তাঁরা মুলাকতকারীকে বলেননি।
তুর্কমেন প্রতিবিপ্লবীরা পর্যুদস্ত হওয়ার পরে ভারতীয় মুহাজিররা কিকি হতে স্টীমার যোগে চাদজও যান এবং সেখানে বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে তুর্কমেনদের দ্বারা গিরোর হয়ে যে-ভাবে তাঁরা প্রাণ হারাতে বসেছিলেন এবং কির্কিতে যে-ভাবে মুহাজিররা অস্ত্রধঅরণ করেছিলেন তারপরে তাঁদের মধ্য হতে কোনো মুহাজির আর আনাতোলিয়ায় যেতে চাইবেন না। বিশেষভাবে, তুর্কমেনদের দ্বারা গিরেফতার হওয়া মুহাজিরদের কয়েকজনকে যখন আর পাওয়াই যায়নি। কিন্তু চাদজওতে দেখা গেল যে প্রায় অর্ধেকের মতো মুহাজির আনাতোলিয়া যাওয়ার জন্যে তখনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁরা রেলপথে ক্রাসনোস্ক হয়ে বাকু যাত্রা করলেন। তখন বাকুতেও তুর্কি অফিসাররা তুর্কি সৈন্য রিক্রুট করছিলেন। সোবিয়েৎ তাঁদের সব সুবিধা দিচ্ছিলেন। কির্কির বাকী মুহাজিররা তাশকন্দে গেলেন। এই মুহাজিররা তাশকন্দের মিলিটারি স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। মিলিটারি স্কুল উঠে যাওয়ার পরে তাঁরাই আবার মস্কোতে গিয়ে “শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে” (Communist University of the Toiling East) ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করেছেন। তাশখন্দে ও মস্কোতে তারাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। অন্য কাফিলার লোকেরাও কিছু কিছু এসব কাজে এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি মুহম্মদ আকবর খানের নেতৃত্বে আসা লোকেরাই এগিয়েছিলেন বেশী। এই কাফিলার লোকেদের মধ্য হতে যাঁরা বাকু গিয়েছিলেন তাঁদেরও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। তুর্কিরা তাঁদের বিশ্বাস করেননি, সৈন্যদলে ভর্তিও করেননি। আরও বহু ভারতীয় মুহাজিরের সঙ্গে তাঁরা এই ব্যবহার করেছেন।
–
কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্সটি খুব বড় ছিল না। এই কোর্স শেষ হওয়ার পরে কথা ওঠে যে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা দেশে ফিরে এসে পার্টি গড়ার কাজ আরম্ভ করবেন। নানান পথে তাঁদের দেশে পাঠানোর চেষ্টা হয়। ব্যবস্থা এই হয় যে কমপক্ষে দু’জন একসঙ্গে যাবেন। তাই প্রত্যেককে একজন করে সঙ্গী বেছে নিতে বলা হলো। শওকত উসমানী মসউদ আলী শাহকে সঙ্গী বেছে নিল, মীর আব্দুল মজীদ ফিরোজুদ্দীন মনসুরকে সঙ্গী বেছে নিল, আর রফীক আহমদ সঙ্গী বেছে নিলেন হাবীব আহ্মদ নসীমকে। গওর রহমান খান ও মুহম্মদ আকবর শাহ্ পরস্পরের সঙ্গী হলেন। শওকৎ উসমানী ও মসউদ আলী শাহ্ পারস্যের পাসপোর্ট পেয়ে গিয়েছিল, আকবর শাহ্ আর গওহর রহমানও তাই পেয়েছিলেন। পারস্যের ভিতর দিয়েই একসঙ্গে দু’জন করে তাঁদের চারজন দেশে পৌঁছেছিলেন। আকবর শাহ্ কিন্তু তেরানের গওহর রহমান খান হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। অন্যদের জন্যে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে দেশে আসার ব্যবস্থা তো আগেই হয়নি, এখন পারস্যের ভিতর দিয়েও আর হলো না। এইরকম দশজন ঠিক করলেন যে পামীর পার হয়ে তাঁরা দেশে ফিরবেন। প্রায় অসাধ্য সাধনের কাজ। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। এই দশ জনের নাম :
(১) মীর আবদুল মজীদ (লাহোর)
(২) ফিরোজুদ্দীন মন্সুর (শেখুপুরা
(৩) রফীক আহমদ (ভোপাল
(৪) হাবীব আহমদ (শাজাহানপুর)
(৫) আবদুল কাদির সেরাই (খান) (পেশাওয়ার)
(৬) ফিদা আশলী (পেশাওয়ার
(৭) সুলতান মাহ্মুদ (হাজারা )
(৮) সঈদ আহমদ রাজ (দিল্লী)
(৯) আবদুল হামীদ (লুধিয়ানা জিলা, ১৯১৫ সালের লাহোর মেডিকেল কলেজ হতে পলাতক ছাত্র)
(১০) নিজামুদ্দীন (কোয়েটার ফৌজ হতে পলাতক)
তাশকন্দ হতে রেলপথে রওয়ানা হয়ে শেষ রেলওয়ে স্টেশন হচ্ছে ওশ। ফরগনা উপত্যকার উপর দিয়ে এই রেলওয়ে গেছে। সমরকন্দ, কোকন্দ ও আন্দিজান প্রভৃতি স্থান পথে পড়ে। ফিরোজুদ্দীন বলেছে যে আন্দিজান পার হয়ে ওশ পৌঁছাতে ২০ মাইল বাকী থাকতে একটি রেলওয়ে স্টেশন তাঁদের শেষ স্টেশন ছিল। তারপরে অন্য যান-বাহনের ব্যবস্থা তাঁদের করতে হয়েছিল। এই শেষ রেলওয়ে স্টেশন হতে তাঁরা গিয়েছিলেন গুলচা, গুলচা হতে মুরগাব এবং মুরগাব হতে খরোগ। তাজিকস্তান রিপাবলিকের গোনি-বদশান স্বতন্ত্র ইলাকার ( Autonomous Region) প্রধান স্থান হচ্ছে এই খরোগ। পামীর এই ইলাকার অন্তর্ভুক্ত। ওশ হতে ৩৫০ মাইল পথ তাঁরা ২০টি ‘স্টেজে’ অতিক্রম করেছিলেন। আলতাই পার হওয়ার সময়ে তুষারপাত হওয়ায় তাঁরা অশেষ কষ্ট পেয়েছিলেন। আলতাই পার হওয়ার সময়ে তুষারপাত হওয়ায় তাঁরা অশেষ কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁরা যখন কারাকুল স্তেপে ডেরা পেতেছিলেন তখন হয়েছিল আরও প্রচণ্ড তুষারপাত। তাঁদের ভাগ্য ভালো ছিল যে খরোগে কোনো তুষারপাত হয়নি। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে তাঁরা খরোগে পৌঁছেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ২৫০ হতে ৩০০ জন রুশ সৈন্য ছিলেন। যে-সব সৈন্য ছুটিতে যাবেন তাঁদের জায়গায় এ সকল সৈন্যকে পোস্ট করা হচ্ছিল। ওপরে যে দশজন মুহাজিরকে তিন ভাগে বিভক্ত দেখানো হয়েছে তা কাজের সুবিধার জন্যে খরোগে আসার পরে করা হয়েছিল। প্রথম দলের চারজন, অর্থাৎ মীর আবদুল মজীদ, ফিরোজুদ্দীন মসুর, রফীক আহমদ ও হাবীব আহমদ প্রথমে রওয়ানা হলেন। তাঁরা ইশকাশিম হয়ে এসেছিলেন। একজন শিগগানী তাঁদের ইশকাশিম পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। ইশকাশিম হতে একজন স্থানীয় লোক তাঁদের নুসানী পাস পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে চলে যান। সেখান থেকে তাঁরা চিত্রলে যান। পামীর হতে চিত্রল পর্যন্ত হিন্দুকুশের অংশটা অত্যন্ত দুর্গম। চিত্রলও হিন্দুকুশের অংশ বিশেষ। তারপরে আরম্ভ হয়েছে হিমালয় পর্বত। আফগানিস্তানের এই অংশটা আমাদের কমরেডদের গোপনে রাত্রি বেলা পার হতে হয়েছে। তা না হলে তাঁরা ধরা পড়ে যেতেন।
আমাদের কমরেডদের প্ল্যান ছিল যে ভারতে পৌঁছে যতদিন সম্ভব তাঁর আত্মগোপন করে পার্টির কাজ করবেন। চিত্রল রাজ্যে পৌঁছে তাঁরা কোনো সীমান্ত প্রহরীর চোখে পড়েননি। তাঁরা যখন চিত্রল শহরের পথে এগুচ্ছিলেন তখন একদল লোকের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়ে যায়। এই দলটি কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা জানালেন যে তাঁরা হজ্জ্ব করতে যাচ্ছেন। এদিকে কোথায় হজ্জ্ব করবেন জিজ্ঞাসা ক’রে জানা গেল যে “মাজার-ই-শরীফে”। মজার-ই- শরীফ আমাদের কমরেডদের চেনা জায়গা। তাঁরা মনে মনে ভাবলেন, ভালোই হলো। তারাও বলবেন, তাঁরা মজার-ই-শরীফ হতে হজ্জ্ব করে ফিরেছেন। তাঁরা ফকীর-দরবেশের পোশাক-পরিহিত ছিলেন। চিত্রল শহরে যখন তাঁরা ঢুকছেন তখন তাঁদের পোশাক দেখে লোকেরা তাঁদের ভিক্ষাও দিয়েছিলেন। চিত্রল রাজ্যের শাসককে মের বলা হয়। মেহ্ত্তর পারসী ভাষার শব্দ। তার মানে প্রধান। যারা আমাদের ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে তাদেরও আমরা ময়লা পরিষ্কারের কাজ করিয়ে নিই। এটাও পুরনো দিনের সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তিত একটা শোষণ। যাক, যা বলছিলাম। আমাদের চারজন কমরেড মেতরের প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করে জানালেন যে তাঁরা মজার-ই-শরীফ হতে হজ্ করে ফিরছেন। মজার-ই-শরীফ হয়ে মুহাজিররা তুর্কিস্তানে গিয়েছিলেন। তখন এই স্থান সম্বন্ধে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনি। এখন যখন চারজন কমরেড মজার-ই-শরীফ হজ্জ করে আসার কথা জানালেন তখন এই স্থান সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। মজার-ই-শরীফ আগান তুর্কিস্তানের রাজধানী। এক শ্রেণীর মুসলমানদের নিকটে, বিশেষ করে শিয়া জামাআতের মুসলমানদের নিকটে স্থানটি পবিত্র। মজার-ই-শরীফ দর্শন করে আসা মানে তাঁদের নিকটে হজ্জ্ব ক’রে আসা, যেমন মক্কা হতে লোকেরা হজ্জ করে আসেন। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট দিনে কা’বার মজিদ প্রদক্ষিণ করা ও একটা বিরাট ময়দানে সমবেত হয়ে বিশ্বের সকল দেশের মুসলমানদের সাথে একত্রে ঈদের নামাজ পড়াকে হজ্জ বলা হয়। কথিত আছে যে মুহম্মদের জামাতা ও পিতৃব্য পুত্র এবং মুসলিম জগতের চতুর্থ খলীফা আশলীর কবর ওখানে “আবিষ্কৃত” হয়েছে। তাই থেকে জায়গাটার নাম মজার-ই-শরীফ হয়েছে। ‘মজার’-এর অর্থও কবর। কি করে যে আশলীর কবর ওখানে এলো তা বলা কঠিন। ১৪২০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে সুলতান আশলী মির্জা তাঁর বিখ্যাত মসজিদ ওখানে নির্মাণ করেছেন। মুসলিমদের ভিতরে শিয়া জামাআতের লোকেরা এই মজিদকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে থাকেন। তাঁরা মনে করেন মসজিদটি আশলীর কবর। এ জায়গাটা প্রথমে একটি গ্রাম ছিল। তার নাম ‘খায়র’। পরে এর নাম হয় খোজা খায়রান। তার পরে দ্বাদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর ভিতরে এখানে আশলীর কবর “আবিষ্কার” হয়ে যায় এবং এটা যে প্রকৃতই আশলীর কবর তাও নাকি প্রমাণিত হয়ে যায়। মৃত্যুর কয়েক’শ বছর পরে কি করে যে এমন প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে তা বোঝা আমার পক্ষে অবশ্য খুবই কঠিন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ স্থানকে ভ্রমণকারীরা শুধুই ‘মজার’ নামে অভিহিত করেছেন। গত একশ’ বছরের কিছু বেশীকাল হতে এর নাম ‘মজার-ই-শরীফ’ হয়ে গেছে।
আগের কথায় আসছি। মেহ্তরের প্রাইভেট সেক্রেটারি তাঁর নিকটে লিখিত রিপোর্ট পাঠালেন যে চারজন লোক মজার-ই-শরীফের হজ্জ করে ফিরেছেন। তার ওপরে মেতর হুকুম পাশ করলেন যে তাঁদের প্রত্যেককে একটি করে জুব্বা দেওয়া হোক, আর খাওয়ার জন্যে দেওয়া হোক পঞ্চাশ টাকা। ঘটনাগুলি একের পর এক আমাদের কমরেডদের অনুকূলে ঘটে যাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পরেই তাঁরা উধাও হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু হাবীব আহমদের সংযমের অভাবে মুহূর্তের ভিতর সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গেল। প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলের উপরে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়েছিল। তার জন্যে হাবীব আমদের দুর্দমনীয় লোভ হচ্ছিল। অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলে রাখছিলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি আর থাকতে না পেরে প্রাইভেট সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করলেন, খবরের কাগজের ওপরে তিনি একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন কিনা? প্রাইভেট সেক্রেটারি যেন হঠাৎ আকাশ হতে পড়ে গেলেন। এঁরা যে দরবেশ নন তা তিনি বুঝলেন, মনে মনে হয়তো ভাবলেনও, “কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলেম আমি”। আমাদের চারজন কমরেডকে তিনি বললেন, “আপনারা এখন চলে যেতে পারেন। তবে, চিত্রল ত্যাগ করার আগে ভারত গবর্নমেনটের এজেন্টের সঙ্গে একবার দেখা করে যাবেন”। তাঁরা বাইরে এসে দেখলেন যে অনেক দূর থেকে সাদা পোশাক পরা লোকেরা তাঁদের ওপরে নজর রাখছেন। তাঁদের বুঝতে একটুকুও অসুবিধা হলো না যে গিরেতারই হয়ে গেছেন তাঁরা। তাঁরা চার জন : মীর আবদুল মজীদ, রফীক আহমদ, হাবীব আহ্মদ ও ফিরোজুদ্দীন মসুর।
প্রহরাধীনে তাঁদের পেশোয়ারে পাঠানো হয়েছিল।
যে দশজন মুহাজির খরোগ পৌঁছেছিলেন তাঁদের মধ্যে চারজনের কথা এখানে বলা হলো। দ্বিতীয় দলে ছিলেন তিনজন :- আবদুল কাদির সেরাই (খান), সুলতান মামুদ ও ফিদা আশলী। ইতোমধ্যে আগের দল যে ইশকাশিম পাস হয়ে এসেছিলেন, সে পথ তখন সম্পূর্ণরূপে বরফে ঢেকে গিয়েছিল। তাই স্থির হলো তাঁদের ওয়াখানের পথে পাঠানো হবে। এই পথে সোভিয়েতের শেষ আউট পোস্ট কালাপাঞ্জা পৌঁছুতেই তাঁদের চার দিন লেগে যায়। আগান সীমানায় পৌঁছে দু’রাত্রি কঠোর চড়াইয়ের পথ অতিক্রম করে তাঁরা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১২৫০০ ফিট উচ্চ বরোগিল গিরিসঙ্কটে পৌঁছেছিলেন। এখানে পাসের বরফ ঢাকা পথ দেখিয়ে দিয়ে গাইড বিদায় নিলেন। যথাসময়ে বরোগিল পাসের দক্ষিণ সীমায় তারা চিত্রল রাজ্যের ভূমি স্পর্শ করলেন। ভোরবেলা ছিল। চিত্রলে প্রবেশ করার সময়ে কারুর নজরে তারা পড়লেন না। নিজেদের প্রেরণাতে মেতরের বর্ডার অফিসারের বাড়ীতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। এই তিনজনকেও প্রহরাধীনে পেশোয়ারে পাঠানো হলো।
দশজনের বাকী তিনজন : আবদুল হামীদ, সঈদ আদ রাজ ও নিজামুদ্দিন আর সেবারে আসতে পারেননি। তাঁরা মস্কো ফিরে গিয়েছিলেন।
পেশোয়ারের প্রথম ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা
এটা কিন্তু মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা নয়। কেউ কেউ এই মোকদ্দমাকে তাশকন্দ ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা বলেছেন। এই মোকদ্দমাটিই পেশোয়ারের প্রথম ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা, অবশ্য কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংস্রবে অনুষ্ঠিত ষড়যন্ত্র মোকদ্দমাগুলির মধ্যে। মুহম্মদ আকবর খানের কথা আমরা বারে বারে বলেছি। ৮০জন মুহাজিরের একটি কাফিলার নেতা হয়ে আগানিস্তানের জবলুসিরাজ হতে তিনি সোভিয়েত তুর্কিস্তান অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। পথের কষ্ট ও বিপদের কথা আমি আগেই বর্ণনা করেছি। তাশকন্দেও তাঁকে সম্মানের চোখে দেখা হতো। তিনি মিলিটারি স্কুলেও যোগ দিয়েছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্মৃতিকথায় যদিও তাঁর নামোল্লেখ দেখেছি বলে মনে পড়ে না তবুও মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমার সাক্ষ্য হতে প্রমাণিত হয়েছে যে তাশকন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নিকটে তাঁর অবারিত দ্বার ছিল। রায় তাঁকে সম্মান করতেন।
মুহম্মদ আকবর খান মস্কো যাননি, তাশকন্দ হতেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পরে বেশ কিছু কাল সেখানে থাকা সত্ত্বেও তিনি পার্টিতে যোগ দেননি। কিন্তু পার্টির প্রোগ্রাম তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সাক্ষ্য প্রমাণ হতে তা প্রমাণিত হয়েছে। দেশে ফেরার পথে ১৯২১ সালের ১৩ই মে তারিখে আকবর খানকে কাবুলে দেখা গেছে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই যে তিনি ভারতে ফিরেছিলেন তা নয়। তাঁকে স্বাধীন জাতির ইলাকায় বিদ্রোহীদের উপনিবেশ চমরকন্দেও দেখা গেছে।
যে সকল মুহাজির ফিরে আসছিলেন তাঁদের প্রথম দল ৩রা জুন *১৯২১) তারিখে পেশোয়ারে পৌঁছেছিলেন। এই ফিরে আসার মুহাজিররা পেশোয়ারের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নিকটে ক্রমাগত বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন যে মুহম্মদ আকবর খান বলশেভিকদের পক্ষপাতী লোক। এই কারণে পুলিস ও পেশোয়ারের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা মুহম্মদ আকবর খান সম্বন্ধে খুবই সজাগ হয়ে উঠেন। তাঁরা তাক ক’রে থাকেন যে পেলেই আকবর খানকে ধরতে হবে কিন্তু এর মধ্যে তিনি কখন কোন্ পথে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন তা টের পাওয়া যায়নি। স্থির করেছিলেন, একটা প্রেস কিনে স্বাধীন জাতির ইলাকায় বসাবেন এবং সেখান হতে আমাদের রাজনীতিক সাহিত্য ছাপিয়ে তা ভারতে প্রচার করবেন। প্রেস তিনি কিনে স্বাধীন ইলাকায় পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। তার কিছু সরঞ্জাম পাঠানো তখনও বাকী ছিল। মনে হয় এই প্রেসের কারণেই তিনি লাহোরে গিয়ে থাকবেন। তাঁর মোকদ্দমার কাগজপত্র হতে বোঝা যায় যে লাহোরে তিনি কোনো কোনো মজুর ইউনিয়নের বিশেষ করে প্রেস মজুর ইউনিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে তখন মুহম্মদ আলী কাবুলে ছিলেন। দেশে ফেরার সময়ে মুহম্মদ আকবর খান কিভাবে কি করবেন, না করবেন, তার সব ব্যবস্থা মুহম্মদ আলীর সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করে এসেছিলেন। তাঁর দেশে ফেরার পরে সব কাজ ভালোয় ভালোয় এগিয়েও যাচ্ছিল।
বাহাদুরের পরিচয়
এদিকে পুলিস খবর পেয়ে গিয়েছিল যে মুহম্মদ আকবর খান দেশে ফিরেছেন এবং লাহোরে তাঁর পিতা হাফীজুল্লাহ্ খানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। এর পরে ১৯২১ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর তারিখে মুহম্মদ আকবর খান এবং তাঁর চাকর বলে কথিত বাহাদুর শবে কদরের দূরের দিকে, কিন্তু পেশোয়ার জিলার সীমানার ভিতরে গিরেফতার হয়ে গেলেন। তাঁরা সীমানা পার হয়ে স্বাধীন ইলাকায় যাচ্ছিলেন। এখানে বাহাদুরের কিছু পরিচয় দরকার। বাহাদুর নিজেকে তিব্বতী বলে পরিচয় দিয়েছিল। কাশগরকে বিশেষ পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি দল পুরোগামী হয়ে গিলজিটে গিয়েছিলেন। তাঁরা সেখানে বাহাদুরকে পাচকের কাজে নিযুক্ত করেন। এই দলের সঙ্গে সে ভারতবর্ষে আসে। ১৯১৯ সালে এই দলের সঙ্গেই আবার সে পারস্যে যায়। ১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাগারানে এই পর্যবেক্ষক দলকে ত্যাগ ক’রে সে বলশেভিকদের পক্ষে চলে যায়। এটা অবশ্য মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমায় গবর্নমেন্টের পক্ষের বিবৃতি। তারপরে বাহাদুরকে বুখারা ও তাশকন্দে দেখা গেছে। তার সঙ্গে মুহম্মদ আকবর খানের ফেরার সময়ে কাবুলে তাঁর সঙ্গে বাহাদুরকেও তিনি দেখেছেন। অন্য একজন সাক্ষী বলেছেন যে চমরকন্দে মুহম্মদ আকবর খানের সঙ্গে বাহাদুরের প্রথম পরিচয় হয়েছে। তবে, পরিচয় যেখানেই হোক না কেন, ১৯২১ সালের ৩রা জুন তারিখে মুহাজিরদের যে দল পেশোয়ারে প্রথম ফিরে এসেছিল তার সঙ্গে বাহাদুরও এসেছিল। সে পুলিশের চোখ এড়িয়ে হরিপুরে মুহম্মদ আকবর খানদের বাড়ী চলে গিয়েছিল। সে হাফীজুল্লাহ্ খানের নামে মুহম্মদ আকবর খানের চিঠি এনেছিল।
আগেই বলেছি মুহম্মদ আকবর খান ও বাহাদুর ২৫ শে সেপ্টেম্বর (১৯২১) তারিখে গিরোর হয়েছিলেন। ২৮ শে সেপ্টেম্বর (১৯২১) তারিখে হাফীজুল্লাহ্ খান গিরোর হলেন হরিপুরে তাঁর নিজের বাড়ীতে।
১৯২১ সালের ১০ই অক্টোবর তারিখে উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশের চী কমিশনার ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে (১) মুহম্মদ আকবর খান (বয়স ২৬ বছর), (২) বাহাদুর (বয়স ১৮ বছর) ও মুহম্মদ আকবর খানের পিতা (৩) হাফীজুল্লাহ্ খানকে (বয়স ৫২ বছর) পেশোয়ারের আদালতে অভিযুক্ত করার জন্যে মঞ্জুরী প্রদান করলেন। তিনজন আসামীই তখন পেশোয়ার জেলে বন্দী ছিলেন। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা এই প্রথম আরম্ভ হলো।
এই মোকদ্দমার প্রধান আসামী মুহম্মদ আকবর খান তাশকন্দে থাকার সময়ে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হননি সে কথা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির করণীয় কাজকে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে প্রবেশ করে যে ক’দিন তিনি আত্মগোপন করে ঘোরা-ফেরা করতে পেরেছিলেন তার ভিতরেই তিনি অনেকগুলি সাংগঠনিক কাজ করে ফেলতে পেরেছিলেন। তবে, তিনি যে ধরা পড়লেন সেটা তাঁর অসতর্কতার ফল ছিল, না, কেউ তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল, তা জানিনে।
মুহম্মদ আকবর খান গিরোর হওয়ার পরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গবর্নমেন্ট ও ভারত গবর্নমেন্টের মধ্যে কি ধরনের মত বিনিময় হয়েছিল সে সম্পর্কে কোনো কাগজপত্র আমাদের হাতে আসেনি।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারার (রাজা ও সম্রাটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ষড়যন্ত্র করার) মোকদ্দমার বিচার শুধু সেশনস্ (দায়রা) আদালতেই হতে পারে। এই মোকদ্দমার বিচারও সেশনস্ আদালতেই হয়েছিল। জর্জের নাম ছিল জে.এইচ.আর. ফ্রেজার, আই সি এস (J.H.R.Fraser, I.C.S.)। ১৯২২ সালের ৩১ শে মে তারিখে তিনি মোকদ্দমার রায় শুনিয়েছিলেন। তিনি স্থির করেছিলেন যে মুহম্মদ আকবর খান ও বাহাদুরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয়েছে। এই জন্যে মুহম্মদ আকবর খান ও বাহাদুরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয়েছে। এই জন্যে করেছিলেন। জর্জের মতে হাফীজুল্লাহ্ খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয়নি। এই জন্যে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
এই ভাবে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু পরিসমাপ্তি ঘটেও ঘটল না। সে কথা নীচে বলছি।
পেশোয়ারের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা
যে-মোকদ্দমার কথা এখন লিখতে যাচ্ছি সেটা সময়ের বিবেচনায় তৃতীয় মোকদ্দমা। তবে, প্রথম ও তৃতীয় মোকাদ্দমার মূল আসামী একই ব্যক্তি, —মুহম্মদ আকবর খান। তা ছাড়া, এই তৃতীয় মোকদ্দমাটি আলাদা কেনো মোকদ্দমাই নয়, প্রথম মোকদ্দমা হতেই তার উদ্ভব হয়েছে। এটা জেলের শৃঙ্খলাভঙ্গের একটি মোকদ্দমা মাত্র।
মুহম্মদ আকবর খান হাজারা জিলার হরিপুরের শিক্ষিত ও রিসালদার পরিবারের ছেলে। তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। একথা আগে বলেছি। বড় বড় খানদের ছেলেদের ব্রিটিশ বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিলে তারা ব্রিটিশ ভক্ত হয়ে উঠবে এই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট পেশোয়ারে ইস্লামিয়া কলেজ স্থাপন করেছিলেন। কারণ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দুর্ধর্ষ পাঠানদের বাগ মানতে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট সর্বদা হিমশিম খেয়ে যেতেন। তাই তাঁরা বিশেষ বিশেষ পরিবারকেও তুলে ধরতেন। যেমন আকবর খানদের রিসালদার পরিবার। নাম শুনলেই মনে হবে যে একটি রাজভক্ত পরিবার। এই পরিবারের ছেলে মুহম্মদ আকবর খান পড়েছেন পেশোয়ারের ইস্লামিয়া কলেজে। তাঁর মোকদ্দমার কাগজপত্র হতে আমরা জানতে পারি যে তিনি একবার বি.এ. পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। আবার যখন পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে তাঁর কলেজের ক্লাসে উপস্থিতির শতকরা হার কম। তাই, তিনি দ্বিতীয় বার আর পরীক্ষা দিতে পারেননি। এসব সত্ত্বেও মুহম্মদ আকবর খান একজন সুশিক্ষিত যুবক ছিলেন। তাঁর মোকদ্দমার ইংরেজ জজও বলেছেন আকবর খান ইংরেজি খুব ভালো জানতেন। তাঁর পারসী ভাষার জ্ঞানেরও তারিফ করা হয়েছে।
রিসালদার পরিবারে জন্মগ্রহণ ক’রে এবং পেশোয়ারের ইস্লামিয়া কলেজে বিদ্যার্জন করেও মুহম্মদ আকবর খান ব্রিটিশভক্ত হননি। মুহম্মদ আকবর খানের পিতা হাফীজুল্লাহ্ খান সমস্তা ও চমরকন্দের বিপ্লবী উপনিবেশ সম্বন্ধে পেশোয়ারের ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সকে বরাবর খবর দিতেন। তা সত্ত্বেও মুহম্মদ আকবর খান একজন পাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীরূপে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। কখন যে তার সঙ্গে সমস্তা ও চমরকন্দের বিপ্লবী কলোনীর যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তা আমি জানিনে, তবে যোগসূত্র স্থাপিত যে হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
স্বাধীন জাতির ইলাকায় যে বিপ্লবী কেন্দ্র ওয়াহাবী বিদ্রোহের সময়ে স্থাপিত হয়েছিল তাই চলে আসছিল মুহম্মদ আকবর খানের যৌবনেও। তাঁর প্রথম মোকদ্দমার আপীলের মীমাংসা করতে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জুডিশিয়েল কমিশনার ১৯২২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁর নিকটে দায়ের করা মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমার আপীলের রায় লিখেছেন :
“…that the Chamarkand colony has been created artifically by a number of persons who have no other bond except the conspiracy ( a revolutionary movement against the British Government and some of the members of it personally) itself. Its continuance and existence depends solely upon that conspiracy. No person could voluntarily become a member of that community unless he definitely intended to be a member of that conspiracy.”
অর্থাৎ “… চমরকন্দের উপনিবেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তির দ্বারা কৃত্রিমরূপে গঠিত। এই ব্যক্তিদের নিজেদের ভিতরে ষড়যন্ত্র করার বন্ধন ছাড়া অন্য কোনো বন্ধন নেই। (এটা হলো ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার কিছু সংখ্যক মেম্বরের বিরুদ্ধে একটা বিপ্লবী আন্দোলন।) এর বর্তে থাকা ও অস্তিত্ব সর্বতোভাবে ষড়যন্ত্র করার ওপরেই নির্ভর করে। চাইলেই কেউ এ সম্প্রদায়ের সভ্য হতে পারে না যদি না সে নিশ্চিত ইচ্ছা প্রকাশ করে যে সে ষড়যন্ত্রকারীও হবে।”
চমরকন্দের বিপ্লবী উপনিবেশ সম্বন্ধে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের ধারণা উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জুডিশিয়েল কমিশনারের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। ষড়যন্ত্রের এই ভীতি হতেই সমস্ত জগতের বিচারকার্যের ইতিহাসে ১৯২৩ সালে পেশোয়ারে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছিল।
পেশোয়ারের প্রথম ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ১৯২২ সালের ৩১ শে মে তারিখে মুহম্মদ আকবর খান তিন বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তিনি পেশোয়ারে ডিস্ট্রিক্ট জেলেই ছিলেন। ১৯২৩ সালের ৭ই মার্চ তারিখে পেশোয়ারের এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জে. আমন্ড, আই.সি.এস. “J. Almond, I.C.S” ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে বিচারের জন্যে আবার মুহম্মদ আকবর খানকে দায়রায় সোপর্দ করলেন। তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন দায়রায় সোপর্দ হয়েছিলেন। তাঁদের নাম :
(১) মুহম্মদ হাসান ও
(২) গুলাম মাহ্বুব
মুহম্মদ আকবর খানের বিরুদ্ধে নূতন অভিযোগ এই ছিল যে তিনি পেশোয়ার ডিস্ট্রিক্ট জেলের ভিতর হতে গোপন পথে সাত-আটখানা পত্র বাইরে পাঠিয়েছিলেন। পত্রগুলির প্রাপকেরা সীমানার বাইরের লোক ছিলেন এবং চমরকন্দের বিপ্লবী উপনিবেশের লোকেরাও ছিলেন। আসল পত্রগুলি যথাস্থানে পৌঁছেছিল কিনা তা জানা নেই। কিন্তু নৌশহরার রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে গুলাম মাহবুবের শরীর তল্লাশী ক’রে উল্লিখিত পত্রগুলির প্রতিলিপি পাওয়া যায়। মুহম্মদ হাসান স্বীকার করেছিলেন যে প্রতিলিপিগুলি তাঁর হাতের লেখা। মুহম্মদ আকবর খানের হাতের লেখা তিনি চিনেন না, মুহম্মদ আকবর খানের সঙ্গেও তাঁর কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় কখনও ছিল না। পয়সা নিয়ে তিনি প্রতিলিপি তৈয়ার করেছেন। পত্রগুলিতে মুহম্মদ আকবর খান তাঁর বন্ধুদের খবর দিয়েছেন যে তিনি তিন বৎসরের ও বাহাদুর এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। আকবর খান তাঁর বন্ধুদের লিখেছেন, এ ক’টি দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে (একজন ছাব্বিশ বছরের যুবক এমন কথা বলতে পারেন বই কি), তারপরে তিনি বাইরে গিয়ে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে একত্র হয়ে আবার কাজে লেগে যাবেন। কাবুলে তাঁর বন্ধুদের খবর দিতে বলেছেন। তাঁদের মধ্যে সোনার দাঁতওয়ালা উল্লেখ আছে। ‘কমরেড’ ও ‘তওয়ারিশ’ এই দুটি শব্দেরও উল্লেখ আছে পত্রে। ‘তওয়ারিশ’ রুশ ভাষার শব্দ। তার মানেও কমরেড।
গবর্নমেন্টের অভিযোগের প্রতিটি অক্ষর সত্য ধরে নিলেও মোকাদ্দমা করার পক্ষে এটা একটা কারা-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অতি সাধারণ অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্যে বন্দীর বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো মোকদ্দমাই হয় না। কারণ, তাতে কর্তৃপক্ষের মুখ রক্ষার ব্যাপার আছে। আর যদি মোকদ্দমা হয়ও তাতে দু’চার মাসের সাজা হয় মাত্র। কিন্তু মুহম্মদ আকবর খানের বিরুদ্ধে এর জন্যে রাজা ও সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্র করার মোকদ্দমা হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গবর্নমেন্ট এই মোকাদ্দমা চালাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। প্রেসের জন্যে মাল পাঠাবার কথা পত্রে আছে। সরকারপক্ষ বুঝতেই পারলেন না মালটা কিসের? সোনার দাঁতওয়ালার কথা পত্রে উল্লেখ আছে। সরকারপক্ষ বুঝলেনই না এই সোনার দাঁতওয়ালা কে? ডাক্তার নূর মুহম্মদ, না মুহম্মদ আলী? মুহম্মদ আকবর খানের হাতের লেখা কোন পত্ৰই আদালতে দাখিল করা হলো না। তবুও আদালতে বিচারের প্রহসন হলো। আগের মোকদ্দমার বিচারক জজ ফ্রেজার এই মোকদ্দমায় মুহম্মদ আকবর খানকে ১৯২৩ সালের ২৭শে এপ্রিল তারিখে সাত বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। তার মধ্যে তিন মাস হবে নির্জন কারাবাস। আগেকার তিন বছর শেষ হলে সাত বছরের সাজা আরম্ভ হবে। মুহম্মদ হাসান ও গুলাম মাহ্বুব প্রত্যেকে ৫ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। তাঁদেরও প্রত্যেকের ওপরে তিন মাস নির্জন কারাবাসে থাকার আদেশ হলো।
পেশোয়ারের বিচারের এই অরাজকতার বিরুদ্ধে ভারতের অন্য কোথাও কেউ কিছু বলেছেন এমন কথা শুনিনি। বাঙলার সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র কেন্দ্রীয় আইন সভার সভ্য ছিলেন। ১৯২৬ সালে আমি তাঁকে দিয়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় একটি প্রশ্ন করিয়েছিলেম মাত্র। তা দেখে পেশোয়ারের সার আব্দুল কাইয়ুম আশ্চর্য হলেন। তিনি শ্রীমিত্রের নিকটে এসে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, “এটা তো আমারই কাজ ছিল”। ওই পর্যন্তই। ব্রিটিশের একজন বশংবদ ‘নাইট’ এর বেশী আর কি করতে পারতেন?
মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা (১৯২২-২৩)
“মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা” নামটি আমার দেওয়া নয়। এই মোকদ্দমার নথিপত্রেই এই নামটি রয়েছে। এটা যখন আমার জানা ছিল না তখন আমি অন্যত্র “পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা (১৯২২-২৩)” নাম ব্যবহার করেছি। আসলে ব্যাপারটি কিন্তু তাই। মোকদ্দমাটি আরম্ভ হওয়ার আগেকার কথাগুলি আমি আগেই বলেছি। তা থেকে সকলেই বুঝতে পারবেন কেন মামলাটি দায়ের হলো।
একটি কথা আমি আগে বলিনি। আমি লক্ষ্য করেছি যে এই মামলাটি নিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গবর্নমেন্ট ও ভারত গবর্নমেন্টের মধ্যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। মুহম্মদ আকবর খানের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা শুরু করার আগে এমন কোনো লেখালেখি হয়েছিল বলে মনে হয় না। অন্তত সেই রকম কোনো কাগজপত্র আমার চোখে পড়েনি। আকবর খানের মোকদ্দমা যখন হতে পারল এবং তাতে তাঁর কঠোর সাজাও হয়ে গেল তখন ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের এই সন্দেহ কোথা হতে ও কেন জাগল যে শুধু মস্কো ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্যে কি করে ধৃত বন্দীদের আদালতের বিচারে সাজা হতে পারে? গবর্নর জেনেরেলের একজেকিউটিব কাউন্সিলের সভ্য সার মালম হেইলি স্বয়ং এ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ধৃত বন্দীদের ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বিনা বিচারে নজরবন্দী করে রাখার কথা। একটি কথা আমি এখানে আজকার দিনের তরুণ পাঠকদের জন্য পরিষ্কার করে দিতে চাই যে ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের (The regulation III of 1818) আসল নাম ছিল বেঙ্গল স্টেট প্রিজনার্স এক্ট, ১৮১৮ (The Bengal State Prisoners Act of 1818) সকলেই জানেন বাঙলা দেশেই প্রথম ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু হয়েছিল। তথাকথিত রাষ্ট্র রক্ষার ব্যাপারে এই আইন রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র প্রয়োগ করা হতো। বোম্বে ও মাদ্রাজের জন্যে অবশ্য আলাদা রেগুলেশন ছিল। রাজারাজড়া হতে আরম্ভ ক’রে পেশোয়ার মোকদ্দমার বন্দীদের মতো লোকদেরও এই আইন অনুসারে নজরবন্দী করে রাখা হতো।
আদালতে বন্দীদের বিচার করার কথা উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে কথা উঠল যে রফীক আহমদ ভোপাল রাজ্যের প্রজা। ভারতের ভিতরে তিনি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেননি। তাঁকে কি ক’রে এই মামলার আসামী করা যায়? তখন আবার কথা উঠল যে শওকত উসমানী দেশে ফিরে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে ধ’রে এই মামলায় জুড়ে দিতে পারলে আইনের দিক থেকে (Legal procedure) অনেক বাধা কেটে যায়। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে উসমানীকে? (১৯২৩ সালের ৯ই মে তারিখে উসমানী অবশ্য কানপুরে গিরেতার হয়েছিলেন, আর দায়রা আদালতে জজ্ মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার রায় শুনিয়েছিলেন ১৯২৩ সালের ১৮ই মে তারিখে) শওকত উসমানীকে বাদ দিয়েই মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার মীমাংসা হয়েছিল।
আগে মুহম্মদ আকবর খানের মোকদ্দমা হওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত প্রদেশের গবর্নমেন্ট বারে বারে ভারত গবর্নমেন্টের সঙ্গে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা চালাবার বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। অথচ তাদের মনে ছিল পেনাল কোডের ১২১-এ ধারার কথা। শেষে ভারত গবর্নমেন্টেই ভুলটি ধরিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, আপনার বলতে তো চাইছেন ১২১-এ ধারার কথা, তবে বারে বারে ১২১ ধারা বলছেন কেন? ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১ ধারা হচ্ছে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, তার ন্যূনতম দণ্ড যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। আর ১২১-এ ধারা হচ্ছে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্র করা কিংবা সম্রাটকে ভারত সাম্রাজ্য হতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা। এর ঊর্ধ্বতম দণ্ড হচ্ছে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর আর নিম্নতম দণ্ড যা কিছু হতে পারে।
মোকদ্দমা করার অনুমতি কে দিবেন তা নিয়েও সীমান্ত প্রদেশের গবর্নমেন্টের ভাবনার অন্ত ছিল না। ভারত গবনমেন্ট তাঁদের জানালেন যে অনুমতি আপনাদের চীফ্ কমিশনারও দিতে পারেন। আকবর খানের মোকদ্দমায় এর আগে চী কমিশনারই অনুমতি দিয়েছিলেন।
আসল কথা হচ্ছে এই যে ভারত গবর্নমেন্ট বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে আদালতে বিচার ক’রে বন্দীদের সাজা দেওয়া যায়। তাই তাঁরা ধৃত বন্দীদের ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে নজরবন্দী করে রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ্ কমিশনার সার জন মাফে (Sir John Maffey) জানালেন যে মোকদ্দমা চালালে আসামীদের সাজা হয়ে যাবে, যদিও তিন নম্বর রেগুলেশনের প্রয়োগে তাঁর অমত নেই। সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া ও ভারত গবর্নমেন্টের নীতি ছিল প্রথমে সাজা দেওয়াবার চেষ্টা করা। তা না হতে পারলে রেগুলেশন থ্রি’র প্রয়োগ করা। শেষ পর্যন্ত সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টরও মত দিলেন যে বিচারে আসামীদের সাজা হয়ে যাবে। তবে, দায়রার বিচার ও তার আপিল পেশোয়ারেই হতে হবে। কারণ, মুহম্মদ আকবর খানের আপিলে জুডিশিয়েল কমিশনার যে রায় দিয়েছেন এ মোকদ্দমার আপিলে তিনি তাঁর সেই রায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না।
.
পেশোয়ারে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা শুরু হলো।
অতএব পেশোয়ারে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা আরম্ভ হয়ে গেল। পেশোয়ার জিলার একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট-জে. আমন্ড, আই.সি.এস. যথারীতি মোকদ্দমার প্রথম পর্ব (enquiary) শেষ করে ১৯২৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে বিচারের জন্য মোকদ্দমাটি দায়রায় সোপর্দ করলেন। মুহম্মদ আকবর খানের বিচারক বিখ্যাত দায়রা জজ ফ্রেজার তা প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। মোকদ্দমাটি তিনি লুফে নিলেন। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহসূচক ধারাগুলি যে অধ্যায়ে আছে সেই অধ্যায়ের কোনো ধারা অনুসারে কাউকে অভিযুক্ত করতে হলে প্রাদেশিক গবর্নমেন্ট কিংবা কেন্দ্রীয় গবর্নমেন্টের নিকট হতে আগে অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। এই মোকদ্দমায় সীমান্ত প্রদেশের চীফ্ কমিশনার অনুমতি দিয়েছিলেন। আসামীরা ছিলেন :
(১) মুহম্মদ আকবর শাহ্
পেশোয়ার জিলার নৌশহরা তহসীলের বদরশি গ্রাম, বয়স ২৩ বৎসর;
(২) গওহর রহমান খান
হাজার জিলার হরিপুরের সংলগ্ন দরবেশ গ্রাম, বয়স ২৭ বৎসর;
(৩) মীর আবদুল মজীদ
লাহোর শহরের মোচি দরওয়াজার ভিতরে ধল মহল্লা, বয়স ২১ বৎসর;
(৪) ফিরোজুদ্দীন মসুর, শেখুপুরা শহর; বয়স ২১ বৎসর;
(৫) হাবীব আহ্মদ শাহজাহানপুর শহর, বর্তমান উত্তর প্রদেশ;
(৬) রফীক আহমদ, ভোপাল শহর, ভোপাল স্টেট, বয়স ২৪ বৎসর;
(৭) সুলতান মাহ্মুদ হরিপুর, হাজারা জিলা, বয়স ২৪ বৎসর;
(৮) আবদুল কাদির খান (সোই) পেশোয়ার।
এই মোকদ্দমায় দু’জন রাজসাক্ষী হয়েছিল। তাদের নাম (১) ফিদা আশলী ও (২) গুলাম মুহম্মদ। ফিদা আশলী পেশোয়ারের লোক, আবদুল কাদির খানের তিনজনের গ্রুপের সঙ্গে পামীর, ওয়াখান ও বরোগিল পাস হয়ে চিত্রলে পৌছেছিল। সে মস্কোতে শ্রমজীবী প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে এবং মস্কোতে সে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেয়নি। সে তাশকন্দ হতেই দেশে ফিরে এসেছিল। তাকে শুধু সাক্ষ্য দেওয়ানোর জন্যেই পুলিস পেশোয়ার জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। তাকে রাখাও হয়েছিল এই মোকদ্দমার আসামীদের সঙ্গে, কিন্তু তাঁরা কেন যে তাকে সঙ্গে থাকতে দিলেন তা বোঝা মুকিল। সে তাঁদের কথাবার্তা শুনে শুনে নিজের মনে একটা গল্প খাড়া ক’রে নিচ্ছিল। রফীক আমদের বিবৃতি হতে জানা যায় যে গুলাম মুহম্মদ নিম্ন আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছুই বলেনি। কিন্তু মোকদ্দমা সেশন্স কোর্টে যাওয়ার পরে সে তাঁদের বিরুদ্ধে চুটিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিল। আর ফিদা আশলী নাকি নিম্ন আদালতেই চুটিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিল। সেশন্সে যাওয়ার পরে উল্টো কথা বলেছিল। অর্থাৎ আসামীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। শুরু হতেই ফিদা আশলীকে জেলে আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছিল। মোটের উপরে, ফিদা আশলী ও গুলাম মুহম্মদ দু’জনেই রাজসাক্ষীরূপে মুক্তি পেয়েছিল।
নিম্ন আদালতে আসামীরা একজন উকিল নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর কাজ ছিল অন্যায়ভাবে কোনো দলীল পত্র যেন মোকদ্দমায় ঢুকিয়ে না দেওয়া হয় তা পর্যবেক্ষণ করা। আসল বিচার যখন দায়রা আদালতেই হবে তখন নিম্ন আদালতে অর্থ ব্যয় করে কী লাভ?
দায়রা আদালতে আসামীদের পক্ষে মামলার তদবীর ভালোই হয়েছিল। তাঁদের আত্মীয়রা লাহোর হাইকোর্টের নামজাদা ব্যারিস্টার, বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক মিস্টার আবদুল কাদিরকে (পরে সার আবদুল কাদির, লাহোর হাইকোর্টের জজ) নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর পরিচালনার ফলেই বোধ হয় জজ আসামীদের কঠোর সাজা দিতে সাহস পাননি। আমি আগেই বলেছি যে ভারত গবর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বিশ্বাসই করতে পারেননি যে আদালতের বিচারে আসামীদের সাজা দেওয়া যায়। এই জন্যে তাঁরা ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন অনুসারে বিনা বিচারে আসামীদের বন্দী করে রাখার পক্ষে ছিলেন। স্থানটা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বলেই শেষ পর্যন্ত তাঁরা মোকদ্দমা চালাবার অনুমতি দেন।
১৯২৩ সালের ১৮ই মে তারিখে ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইনের (ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের) ১২১-এ ধারা অনুসারে পেশোয়ারের সেশন্স জজ জে. এই. আর. ফ্রেজার, আই. সি. এস. আসামীদের নিম্নরূপ সাজা দিলেন :
(১) মুহম্মদ আকবর শাহ্ ও
(২) গওহর রহমান খান,
প্রত্যেকের দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড;
(৩) মীর আবদুল মজীদ,
(৪) ফিরোজুদ্দীন মনসুর,
(৫) হাবীব আহমদ ও
(৬) রফীক আহমদ ও
(৭) সুলতান মামুদ
প্রত্যেকের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
আবদুল কাদির খান (সেহরাই) বে-কসুর খালাস পেল।
যে কোনো রাজনৈতিক ও বিপ্লবী আন্দোলনে পুলিস সর্বদা আপন লোক ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই রকমটা সর্বদেশে ঘটে থাকে, জারের রাশিয়াতেও ঘটতো। আগের ও পরের সব কিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কিছুমাত্র অন্যায় হবে না যে আবদুল কাদির খানকে চর হিসাবে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট হিজরাৎ যাত্রীদের সঙ্গে পাঠিয়েছিল। মুহাজিরদের সঙ্গে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাঁদের চরদের না পাঠিয়েই পারেন না। তারপরে অক্টোবর বিপ্লবের পরে সোবিয়েৎ দেশেরও খবর সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। আবদুল কাদির খান একজন পাশ করা পুত ও উর্দু মুশী ছিল। ভারত গবর্নমেন্টের নিযুক্ত পরীক্ষক বোর্ড (The Board of Examiners) এই রকম পরীক্ষা নিতেন। এই মুন্শীরা (সংস্কৃত ও বাংলা ইত্যাদি পড়াবার জন্যে পণ্ডিতেরাও ছিলেন) ব্রিটিশ সিবিল ও মিলিটারি অফিসারদের ভাষা শিক্ষা দিতেন। হিজরাতে যাওয়ার সময়ে আবদুল কাদির খান মধ্য ভারতের মৌতে (Mhow) অবস্থিত মিলিটারি স্টাফ্ কলেজে আর এ এফ অফিসারদের পুস্তু ও হিন্দুস্তানী পড়াত। তার নিজের ভাষায় “I Was lecturer in Pushtu and Hindustani to the R.A.F Officers Stationed at the Military Staff College, Mhow. Central India.” (The Times’, London’। এটা ধারণা করা কিছুমাত্র অন্যায় হবে না যে এখানেই চরের কাজ করার জন্যে আবদুল কাদিরকে তৈয়ার করা হইয়াছিল। এখানেই তাকে রুশ ভাষাও শেখানো হয়েছিল। প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের কথা বলতে গিয়ে আবদুল কাদির অভিযোগ করেছে যে “…Thought some of us had learned Russian, the Indian Section was always taught through the medium of English.” (“The Times’, London)। অর্থাৎ, “যদিও আমরা কিছু লোক রুশ ভাষা শিখেছিলেম তবুও ভারতীয় ছাত্রদের সর্বদা ইংরেজি ভাষার মারফতে পড়ানো হতো।” (‘টাইমস্’ লন্ডন)। মাত্র কয়েকমাস সোবিয়েৎ দেশে বাস করে কেউ রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস ও মার্কসীয় তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে বক্তৃতা বোঝার মতো রুশ ভাষা আয়ত্ত করতে পারেন না।
আবদুল কাদির খানের বিবৃতি হতে বোঝা যায় যে সে অনেক মিথ্যা বলেছ। পেশোয়ারে পুলিসের নিকটে বিবৃতি দিয়ে সে বলেছে, “I went to Jablus Siraj and from there the Tashkent under Muhammad Akbar Khan of Haripur.” অর্থাৎ “আমি জবলুস সিরাজে গিয়েছিলেম এবং সেখান হতে হরিপুরের মুহম্মদ আকবর খানের নেতৃত্বে গিয়েছিলেম তাশকন্দ।” এটা মিথ্যা কথা। লন্ডনের ‘টাইমস্’ পত্রিকায় আবদুল কাদির নিজেই লিখেছে, সে অক্সাসের (আমু দরিয়ার) পথে যায়নি। (মুহম্মদ আকবর খান কিন্তু এই পথেই গিয়েছিলেন। ‘টাইমস্ -এর প্রবন্ধে আবদুল কাদির লিখেছে যে সে ততা বাজারের পথে সোবিয়েৎ দেশে প্রবেশ করেছিল এবং রেলপথে ‘মার্ক’ (Merv) ও বুখারা হয়ে তাশকন্দ পৌঁছেছিল। আকবর খানের নেতৃত্বে যাওয়া লোকদের মধ্য হতেই বেশী লোক কমিউনিস্ট হয়েছিলেন। সেই জন্যে আকবর খানের সঙ্গে গিয়েছিলেন বললে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের নিকটে তাঁর রিপোর্ট বেশী মূল্যবান বিবেচিত হবে, এই কথাই হয়তো আবদুল কাদির খান ভেবেছিল।
তাশকন্দে আবদুল কাদিরের পায়ে গুলি লেগেছিল রফীক আহমদ এই কথাটা আমায় পরিষ্কার ক’রে বলতে পারেননি বলে এই সম্বন্ধে “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন” (The Communist Party of India and Its Formation Abroad) নামক পুস্তকে আমার লেখাও পরিষ্কার হয়নি। এখন আবদুর কাদিরের বিবৃতি ও লন্ডন ‘টাইমস্’ পত্রিকার প্রবন্ধ পড়ে যা বুঝেছি তা হচ্ছে এই।
কাদিরেরা কয়েকজন ইন্ডিয়া হাউস হতে রেলওয়ে স্টেশনে যান। সেখানে তাঁরা প্রথমে প্রচার-অভিযানে যে ট্রেনটি এসেছিল সেটা পর্যবেক্ষণ করেন। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পরে তাঁরা দেখতে পান যে নিকটবর্তী একটা গুদামে আগুন লেগে গেছে। তাঁরা দাঁড়িয়ে তাই দেখতে থাকেন। হঠাৎ সমস্ত জায়গা সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যায়। আবদুল কাদিরের পকেটে কিছু সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তখন কথাটা সে তার অনুবাদককে (Interpreter) জানাল। অনুবাদক বললেন স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গে রাখা সম্পূর্ণরূপে বে-আইনী কাজ। গেট দিয়ে বের হলে তল্লাশি হওয়ার ও ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে ব’লে আবদুল কাদির দেওয়াল টপকে চলে যেতে চেয়েছিল। সেই সময়ে কর্তব্যরত সান্ত্রী তার পায়ে গুলি করেন। এইরূপ গুলি করার জন্যে আবদুল কাদির সোবিয়েৎ গবর্নমেন্টকে নিষ্ঠুর (ruthless) গবর্নমেন্ট বলেছেন। আমি যানিনে কোন্ দেশের গবর্নমেন্ট এইরকম অবস্থায় গুলি না ক’রে পারতেন।
মস্কোতে আবদুল কাদির ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা তেমন কিছু করেনি, −হস্পিটালে থেকেছে, মস্কো হতে দশ মাইল দূরে এক স্যানাটেরিয়ামেও ছিল। খুব সম্ভবত আবদুল কাদির অসুখের ভাব করেছিল বেশী। এই ভাবে আলাদা থেকে সোবিয়েৎ দেশ সম্বন্ধে সে তার ব্রিটিশ প্রভুদের জন্যে রিপোর্ট সংগ্রহ করে থাকবে। মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় সরকার পক্ষ তেমন কোনো প্রমাণ আবদুল কাদিরের বিরুদ্ধে উপস্থিত করেননি। আবদুল কাদির নিজেই লিখেছে যে আদালতে সরকারী উকীল (পাবলিক প্রসেকিউটর) তার সাজা দাবী করেননি। তাই সে বে-কসুর খালাস পেয়েছিল।
খালাস হওয়ার পরে আবদুল কাদির যে পুলিসের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সংস্রব রেখেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে গওহর রহমান খান দিল্লীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি সভায় আমাদের নিকটে আবদুল কাদির সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন স্বাধীন উপজাতি ইলাকায় যাওয়ার একটা পথের মাথায় আবদুল কাদিরকে একবার ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। সে ওখানে কেন, এই কথা তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে খোলাখুলিভাবে গওহর খানকে জানালেন যে ওই পথে একজনের যাওয়ার কথা আছে। আবদুল কাদির যে পুলিসের কাজ করে, একথা গওহর রহমানের জানা ছিল। তাই তাঁকে কথাটা জানাতে আবদুল কাদিরের কোথাও বাধেনি।
আশফাকুল্লাহ্ খান কাকোরি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পলাতক আসামী ছিলেন। তিনি ছিলেন উত্তর প্রদেশের শাহজানপুর শহরের বাসিন্দা। মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার হাবীব আহমদও ছিলেন ওই শহরের লোক। এই হাবীব আমদের মারফতেই স্থির হয় যে আশফাকুল্লাকে প্রথমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের স্বাধীন উপজাতির ইলাকায়, সেখান থেকে কাবুলে এবং কাবুল হতে মস্কোতে পাঠানো হবে। প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন আশফাকুল্লাহ্ খান। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার যুগ্ম সম্পাদক ছিল জানকীপ্রসাদ, সে নিজের নাম লিখত জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টা। অন্য সেক্রেটারি ছিল সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে। জানকীপ্রসাদকে পুলিস কিনে নিতে সমর্থ হয়েছিল। সম্ভবত তারই মারফতে আশফাকুল্লাহ্ খানের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টার খবরটি পুলিসের কানে চলে যায়। তারই জন্যে পথে পাহারায় বসেছিল আবদুল কাদির খান। তার পুলিসের কাজের জন্যে সে ব্রিটিশের দ্বারা পুরস্কৃতও হয়েছিল। ১৯৩০ সালে দেখা গেছে যে আবদুল কাদির খান লন্ডন স্কুল অফ্ ওরিয়েনটাল স্টাডিজে পুষতু ভাষার লেকচারার। সেই সময়েই সে লন্ডনের ‘টাইমস্’ পত্রিকায় “সোবিয়েতের ছাত্র” (A Pupil of the Soviet) নাম দিয়ে পরে পরে তিনটি প্রবন্ধ লেখে। আবদুল কাদির খানের এই লেখাটি ১৯৩০ সালের ২৫শে, ২৬শে ও ২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘টাইমস্’ (লন্ডন) পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ২৫শে ও ২৬শে তারিখে ‘টাইমস্’-এর ১৫ পৃষ্ঠায় ও তৃতীয় দিন ১৫ ও ১৬ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে।
একটি কথা এখানে বলা দরকার। মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আসামীরা আদালতের কাঠগড়াকে তাঁদের মতবাদ প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেননি। রাজনীতিক মতবাদ প্রচারের জন্যে পেশোয়ারের কোর্টের মঞ্চকে ব্যবহারের কথা শুধু স্বপ্নলোকের বাশিন্দারা তুলতে পারেন, বাস্তবে তা একেবারেই সম্ভব ছিল না। আসামীরা সাধারণভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা বলেছেন একটা কিছু না করলে সোবিয়েৎ দেশে তাঁদের শুধু শুধু খেতে দেবে কেন? তাই তাঁরা মিলিটারি স্কুলে ভর্তি হয়েছেন এবং ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছেন এই একই কারণে। গবর্নর জেনারেলের একজেকিউটিব কাউন্সিলের হোম মেম্বর সার মালকম হেইলী পর্যন্ত আসামীদের সাজা হওয়া সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন। তিনি বলেছেন মস্কো ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে বলে কোনো লোকের বিরুদ্ধে কি করে মোকদ্দমা চলতে পারে! কিন্তু মোকদ্দমা চলেছিল এবং আসামীদের সাজাও হয়েছিল। পুলিসের নিকটে বিবৃতিতে আসামীরা খারাপ কিছু বলেনি। আসল কথা, জেল হ’তে বার হওয়ার পরে তাদের বেশীর ভাগই পার্টির কাজ করেছেন।
ভারতবর্ষে আমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি তাতে দেখেছি যে বিপ্লবীরা দীর্ঘকাল জেলে কিংবা অন্যভাবে বন্দী হয়ে থেকে মুক্ত হওয়ার পরে তাঁদের মধ্য হতে অনেকেই রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন। মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় দণ্ডিত সাতজন আসামীর ভিতরে মীর আব্দুল মজীদ, ফিরোজুদ্দিন মসুর, গওহর রহমান খান দেশের ভিতরেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করেছেন। শুরুর দিকে হাবীব আহমদও কিছুকাল দিল্লীতে পার্টির কাজ করেছিলেন এবং ভোপালের রফীক আহমদও তখন তাঁর সঙ্গে দিল্লীতে কিছুকাল ছিলেন। হিজরাৎ করার সময়েই মুহম্মদ আকবর শাহ্ বোধ হয় ইনটারমিডিয়েট ক্লাসে পড়তেন। ১৯২৫ সালের কোনও মাসে তিনি জেল হতে ছাড়া পেয়ে আসার পরে পেশোয়ারে কলেজে ভর্তি হয়ে যথাক্রমে ইনটারমিডিয়েট ও বি এ পরীক্ষা পাস করেন। তাঁর বাবা তাঁকে আইন পড়িয়ে উকীল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পেশোয়ারে তখন আইন পড়ানো হতো না। আকবর শাহের পিতা পুত্রকে লাহোর পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কারণ, মীর আব্দুল মজীদ রয়েছে সেখানে। শেষ পর্যন্ত আকবর শাহ্ আশলীগড় বিশ্ববিদল্যালয়ে ভর্তি হয়ে আইনের পরীক্ষা পাস করেছিলেন। নৌশহরাতে তিনি ওকালতি করতেন। পার্টির কোনও কাজই তিনি করতেন না, হয় তো তাঁর মনে পার্টির প্রতি কিছু সহানুভূতি ছিল। হঠাৎ ১৯৩৯ সালে আমরা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম যে মুহম্মদ আকবর শাহ্ সুভাষচন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিয়েছেন। এত কাল পরে তিনি সক্রিয়(?) রাজনীতিতে এলেন, সে রাজনীতি আবার সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতি! কোনও কমিউনিস্টের পক্ষে ভাবা মুশকিল। শুনেছি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে বসুর দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যাপারেও মুহম্মদ আকবর শাহ্ সহায়ক ছিলেন। বসু কিন্তু জার্মান একনায়ক হিটলারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে দেশত্যাগ করেছিলেন।
সুলতান মাহ্মুদ জেল হতে বার হয়ে এসে কোনো রাজনীতিতে যোগ দেননি।
মীর আবদুল মজীদ মীরট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমারও (১৯২৯-৩৩) আসামী ছিলেন।
মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার আবদুল কাদির খান সহ সাতজন আসামী পামীর অতিক্রম করে চিত্রল রাজ্যে এসেছিলেন। চারজন এসেছিলেন নুসানী পাস হয়ে, আর তিনজনে এসেছিলেন বরোগিল পাসের ভিতর দিয়ে। মুহম্মদ আকবর শাহ্ ও গওহর রহমান খান ইরানী পাসপোর্ট নিয়ে সমুদ্রপথে এসেছিলেন। এই নয়জনের, একজন ফিদা আশলী রাজসাক্ষী হয়েছিল।
কিছু কিছু কাগজপত্র নিজে প’ড়ে, আবার কিছু কিছু কথা’ যাঁরা পড়েছেন তাঁদের মুখে শুনে আমি বুঝেছি যে ‘আফজল’ নামক ব্যক্তিটি কে তা সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরো কিছুতেই আবিষ্কার করতে পারেননি। চিঠিপত্রে নামটি উল্লেখ হতে দেখে তাঁরা যাঁকে-তাঁকে আজল বলে সন্দেহ করেছেন। নাম ও কোড আবিষ্কারের ব্যাপারে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর অদ্ভুত ধৈর্য ও ক্ষমতার পরিচয় বরাবর পাওয়া গিয়েছে। আমি ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই যে আজলের ব্যাপারে তাঁরা কেন অকৃতকার্য হলেন! আজ এতকাল পরে বলতে কোনো আপত্তি উঠতে পারে না। সেই সব পুরানো দিনের অফিসাররাও আর বেঁচে নেই। আজল ছিলেন গওহর রহমান খান। খবর পেয়েছি যে হওহর রহমান খানও বেঁচে নেই। ১৯৫৪ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে।
ব্রিটিশ আমলে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ তিব্বতের মতো নিষিদ্ধ দেশ না হলেও প্রায় নিষিদ্ধ দেশই ছিল। সে প্রদেশ হতে ভিতরের খবর বাইরে যাওয়া একরকম অসাধ্য ব্যাপার ছিল বললেও চলে। জেল হতে পত্র বাইরে পাঠানোর
অপরাধে পেনাল কোডের ১২১-এ ধারা অনুসারে মুহম্মদ আকবর খানের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। এ খবর যদি দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হতো এবং সংবাদপত্রে তা সমালোচিত হতো এমন সাজা কখনও হতে পারত না। ব্যাপারটি এইরকম ছিল যে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ধৃত বন্দীদের বিচার উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বাইরে হলে তাঁদের সাজাই হতো না। এই জন্যেই ভারত গবর্নমেন্টের কঠোর ব্যবস্থা ছিল যে পেশোয়ারের মোকদ্দমাগুলির খবর যেন বাইরের সংবাদপত্রগুলিতে ছাপা না হয়, আর হলেও যেন খুব সামান্য পরিমাণে হয়। ১৯২৩ সালের ১৮ই মে তারিখে পেশোয়ারের দায়রা জজ মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় রায় দিয়েছিলেন সেদিনই তো খবরটি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ডক্টর রাশব্রুক উইলিয়াম্স্ (Rushbrook Williams) তখন ভারতে গবর্নমেন্টের প্রচার বিভাগে ছিলেন। তিনি পরম কৌশলে মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা সম্বন্ধে ১২৯ শব্দের একটি বিবৃতির মুসাবিদা করেন। এই বিবৃতিটি সংবাদ হিসাবে ৬ই জুন তারিখে (মোকদ্দমার রায় দেওয়ার ১৯ দিন পরে) এলাহাবাদের ইংরেজ মালিকের ইংরেজি দৈনিক ‘পাইওনীয়ারে’র রাবলপিণ্ডিস্থিত সংবাদদাতাকে দেওয়া হয়। তিনি বোধ হয় ডাকে খবরটি পাঠিয়েছিলেন। ‘পাইওনীয়ারে’ তা ছাপা হয়েছিল ৯ই জুন (১৯২৩) তারিখে। এই বিবৃতি এসোসিয়েটেড প্রেসকেও নাকি দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা কি ভাবে তা প্রচার করেছিলেন তা জানিনে। মনে হয় না যে তা কোথাও ছাপা হয়েছিল।
কাগজে না ছাপালেও রটনা হয়েছিল যে বলশেভিক চর’দের নানান জায়গায় গিরেফ্ফার করে পেশোয়ারে পাঠানো হয়েছে। সেখানে গোপন কক্ষে তাঁদের বিচার চলেছে। কোনো দিক হতে কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্রিটিশের পরম সমর্থক ব্রিটিশ মালিকদের বড় বড় কাগজগুলিও নিজেদের বড় অসহায় বোধ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল কলকাতার স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকার। তখন যিনি সম্পাদক ছিলেন তাঁর নাম বোধ হয় ছিল মিস্টার নিউম্যান।
৫ই আগস্ট (১৯২৩) তারিখের ‘স্টেটস্ম্যান’ লিখল :
“Some weeks have elapsed since the last of a series of arrests of Bolshevik agents in different parts of India was effected. These arrests were carried out, we believe at the instance of the Governmet of Frontier Province, which had become possessed of a list of names. At any, rate, none of the prisoners was placed before the local magistracy, all being set up for trial to Peshawar. But no words has yet come of any trial. Presumably the cases are being heard in camera, and there may be good reasons why the names of witness should not be difulged. But the Government will be making a grave mistake if it suppresses the evidence and the result of the trial. The only effect of such a policy will be to lend colour to the suspicion that Government is shielding not only the witnesses but others who ought to be in same dock with the prisoners.”
এর সার কথা : “কয় সপ্তাহ হয়ে গেল ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে ‘বলশেভিক’ চরদের গিরেফ্ফার করা হয়েছে। আমাদের মনে হয় এ সব গিরেফতার সীমান্ত প্রদেশেলন গবর্নমেন্টের কথামতো করা হয়েছে। এ গবর্নমেন্টের নিকটে নামের একটি তালিকা আছে। যাই হোক না কেন, ধৃত ব্যক্তিদের কাউকে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও হাজির করানো হয়নি, সকলকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পেশোয়ারে বিচারের জন্যে। সম্ভবত, মোকদ্দমাগুলির বিচার গোপন কক্ষে হচ্ছে। কারণ থাকতে পারে যে সাক্ষীদের নাম প্রকাশ করা উচিত নয়। কিন্তু যদি প্রমাণ আর বিচারের ফলাফল চেপে রাখা হয় তবে গবর্নমেন্ট দারুণ ভুল করে বসবেন। এই নীতির ফলে সন্দেহ কেবল বাড়তেই থাকবে যে গবর্নমেন্ট শুধু সাক্ষীদের বাঁচাচ্ছেন না, বাঁচাচ্ছেন তাঁদেরও যাঁদের স্থান হওয়া উচিত ছিল বন্দীদের সঙ্গে কাঠগড়ায়।”
এ ব্যাপারে ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে রটনাও চলেছিল। কথা উঠেছিল উসমানী আর আমাকেও পেশোয়ারের মস্কো মোকদ্দমায় জড়ানো হবে। সীমান্ত প্রদেশের ওয়ারেন্টের বলে ধৃত হয়ে উসমানী পেশোয়ারে নীতও হয়েছিল। আমাকে কিন্তু ওই প্রদেশের গবর্নমেন্ট নিতে রাজী হলেন না।
সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর সি কে (C. Kaya) ‘স্টেটসম্যানের’ শেষ বাক্যটির উচ্চারণে বড়ই ব্যথিত হয়েছিলেন; তিনি হোম ডিপার্টমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে বললেন, এ যদি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র কথা হতো তবে তিনি কিছুই মনে করতেন না। কিন্তু ‘স্টেট্সম্যান’ বলল এমন কথা! মনে হয় সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টরদের মতো লোকদের কথা মনে করেই ‘স্টেটস্ম্যান’ তাঁদের বন্দীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছিল।
এইবারে কিন্তু গবর্নর জেনেরেলের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভ্য স্যার ডব্লিউ মালকম হেইলীর টনক নড়ল। তিনি ‘স্টেট্সম্যানে’র (সম্পাদক?) মিস্টার নিউম্যানকে একখানি “ব্যক্তিগত” ও “গোপনীয়” (Private and Confidential) পত্র লিখলেন। তাতে খুব যে সঠিক তথ্যের সমাবেশ করলেন তা নয়। পত্রে বললেন, পেশোয়ারের ‘বলশেভিক এজেন্টদের সকলের সাজা হয়ে গেছে। একজন শুধু বে-কসুর খালাস পেয়েছেন। তাঁরা ছাত্র জাতীয় লোক। তাঁদের সাজার খবর খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। এম. এন. রায়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতেন ব’লে লাহোরে, যুক্ত প্রদেশে (এখনকার উত্তর প্রদেশ) এবং বাঙলায় সব নিয়ে তিন জনকে গিরেফ্ফার করা হয়েছে। তাঁরা ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন অনুসারে নজরবন্দী হয়ে আছেন। ষড়যন্ত্রের অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলতে পারে কিনা গবর্নমেন্ট তা বিবেচনা করে দেখছেন। চিঠি-পত্রের মারফতে ষড়যন্ত্র হলে এই সকল চিঠি-পত্রের লেখক কে তা আদালতে প্রমাণ করা বড় মুশকিল। এই তিন জন লোককে বিচারের জন্যে পেশোয়ারে পাঠানো হয়নি। মালকম হেইলীর কথা সত্য নয়। শওকত উসমানীকে পুলিস প্রহরায় পেশোয়ার জেলে পাঠানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার বিচার সেখানে হয়নি। স্যার মালকম হেইলী তাঁর পত্রে তিনজন নজরবন্দীর নামোল্লেখ করেননি। লাহোরে গিরোর হয়েছিলেন গুলাম হুসায়ন, যুক্ত প্রদেশের কানপুরে শওকত উসমানী এবং বাঙলার কলকাতায় মুজফফর আহমদ (অর্থাৎ লেখক নিজে)। পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা বা মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার কথা আপাতত আমি এখানেই শেষ করলাম।
জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়
১৯২২ সালের কথা শেষ করার আগে আমাকে আরও দুই জনের সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে। তার প্রথম নাম জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়, আর দ্বিতীয় নামটি হলো অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়। অবনী মুখার্জি নামেই এই ব্যক্তিটি সমধিক পরিচিত ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে যে আমার সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, সে কথা আগেই বলেছি। ১৯২২ সালের কোন্ মাসে তা মনে করতে পারছি না, একদিন ভূপেন্দ্রকুমার এসে আমায় জানালেন যে, চারুচন্দ্র ঘোষকে (যক্ষ্মা রোগী) সঙ্গে নিয়ে কিছুকাল তিনি হরিদ্বারে গিয়ে থাকবেন। সেই সময়ে তাঁর বন্ধু মুনশীগঞ্জের জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় আমার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করবেন। তাঁকে কলকাতা আসার জন্যে পত্র লেখা হয়েছে। পরে শোনা গেল যে হরিদ্বারে বড় ম্যালেরিয়া হয়। তাই তাঁরা আর হরিদ্বারে গেলেন না। অনেক পরে তাঁরা ডেহরী-অন-শোন গিয়েছিলেন। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় কিন্তু একদিন কলকাতা এলেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করলেন। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছিলেম। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের রোগীর সেবা তো ছিলই, তাছাড়া তিনি এদিকে-ওদিকে যাওয়া-আসা করতেন। এখন বুঝতে পারছি, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন তিনি তখনও ছেড়ে দেননি। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার দেখা হতো বেশী, কাজে কাজেই কথাও হতো বেশী। আর, আমার মনে হতো তিনি ভুপেন্দ্রকুমার দত্তের চেয়েও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন বেশী। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির পুরানো সভ্য নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (মানবেন্দ্ৰনাথ রায়) তখন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজন নেতা হয়েছিলেন বলে যে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় মার্কসবাদ লেনিনবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেই সময়ে আমার তা মনে হয়নি। মতবাদটা খুব গভীরভাবে তিনি গ্রহণ না করতে পারেন, কিন্তু গ্রহণ তিনি করেছিলেন। শুনেছি পরে তাঁকে এর জন্যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টিতে কিছু মূল্য দিতে হয়েছিল।
ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’তে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল বটে, তবে তার কলকাঠি আমার হাতে ছিল। এই কথাটা অর্ধ সত্য। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তই আমায় বলেছিলেন, বিদেশে চিঠিপত্র আমিই পাঠাব। তাঁরা যদি কোনো চিঠি পাঠাতে চান তাও আমায় তাঁরা দিবেন, আমি তা পাঠিয়ে দেব। আবার তাঁদের ব্যক্তিগত নামের চিঠিপত্রও আমার দেওয়া ঠিকানাতেই আসবে, আমি সে-সব চিঠি তাঁদের পৌঁছিয়ে দেব। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো আমি ভুল বুঝেছিলাম, তারা তখন বিপদের ঝুঁকি নিতে চাননি। অল্পদিন এভাবে কাজ চলেছিল। পরে তাঁরাও সোজাসুজি পত্রাদি লিখেছেন এবং পত্রাদি পেয়েছেনও। সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেসিল কে (Cecil Kaye) লিখেছেন, “মুজাফ্ফর আহমদ গিরফতার হয়ে যাওয়ার পরে রায় তাঁর কাজে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়কে নিযুক্ত করেছিলেন”।
এম. এন. রায় সেই সময়ে যে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়কে পত্রাদি লিখেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর একখানি বা দুখানি চিঠির (ঠিক মনে নেই ক’খানা) ফটোস্টাট কপি কানপুর ‘বলশেভিক’ ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হয়েছিল। হয়তো জীবনলালের হাতে আসল চিঠি পৌছেছিল। তা না হলে আদালতে গবর্নমেন্ট ফটোস্টাট কপি দাখিল করতেন না। এই চিঠিতে আমার গিরেফ্ফার হওয়ার জন্যে এম. এন. রায় (তাঁকে ধন্যবাদ!) কিঞ্চিৎ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন।
১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট তারিখে নজরুল ইস্লামের সপ্তাহের দুবার প্রকাশিত ‘ধুমকেতু’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমে ৩২, কলেজ স্ট্রীটের দোতলায় ‘ধুমকেতু’র অফিস ছিল। পরে সেই আফিস ৭, প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের দোতলায় উঠে যায়। আমার ধারণা, থেমে থাকা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন ‘ধুমকেতু’র লেখার ভিতর দিয়ে আবার মাথা তুলেছিল। ৭, প্রতাপ চাটুজ্যে লেনস্থিত ‘ধুমকেতু’র আফিসে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতারা যাতায়াত করেছেন। আমি দেখেছি বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় এসেও নজরুল ইসলামকে আলিঙ্গন করে গেছেন। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় তো হামিশা আসতেনই। ভূপেন্দ্রকুমারের রোগী চারুচন্দ্র ঘোষ তখন শ্যামবাজারের একটি বাড়ীতে ছিলেন। নজরুল ইস্লাম আর আমি তাঁকে সেখানে দেখতেও গিয়েছি।
‘ভ্যানগার্ড’ ইত্যাদি কাগজ পাঠাবার জন্যে আমি বহু ঠিকানা জার্মানীতে পাঠিয়েছিলেম। যাঁদের ঠিকানা পাঠিয়েছিলেম তাঁদের সম্মতি আগে গ্রহণ করিনি। শুধু দেখেছি তাঁরা যে কোন ধরনের রাজনীতির লোক কিনা। এইভাবে আমি অনুশীলন সমিতির নেতা প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঢাকার সুত্রাপুরস্থিত বাড়ীর ঠিকানাও দিয়েছিলেম। সেই সময়ে তার সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না। পত্রিকা কিন্তু তাঁর বাড়ীর ঠিকানায় নিয়মিত আসছিল। অনুশীলন সমিতির তরুণেরা তখন জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়দের (যুগান্তরের) তরুণদের ঠেস দিয়ে বলতে লাগলেন-”আমাদের সঙ্গে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সংযোগ রয়েছে। তাই, এই পত্রিকাগুলি আমাদের নিকটে আসছে। কই, তোমাদের নিকটে তো আসছে না”। জীবনলাল আমায় একথা জানালেন। তাঁদের ঠিকানা কেউ আমায় আগে দেননি বলে আমি তা জার্মানীতে পাঠাতে পারিনি। তবে তখনই জীবনলালের নিকট হতে তাঁদের ঠিকানা নিয়ে আমি জার্মানীতে পাঠিয়ে দিলাম। তাছাড়া, তখন পর্যন্ত যত কাগজ বার হয়েছিল সে সবের পুরনো কপি সংগ্রহ করেও মুনশীগঞ্জ ও ঢাকায় পাঠানোরা জন্যে তাঁর হাতে আমি দিলাম।
১৯২৩ সালের ১৭ই মে তারিখে আমি কলকাতায় গিরেস্তার হয়ে ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশন (The Regulation III of 1818) অনুসারে জেলে বন্দী হয়ে থাকি। আমার গিরোর সংক্রান্ত দীর্ঘ কাহিনী আমি কানপুর ‘বলশেভিক’ ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সংস্রবে বলব। এখানে শুধু এতটুকুই বলব যে আমার এই গিরেফ্ফার হতেই ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিচ্ছেদের সূত্রপাত হলো।
আমি কয়েকমাস (প্রায় চার মাস) বাঙলা দেশে একাই ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের বন্দী ছিলেম এবং প্রথমে ছিলেম কলকাতার আশলীপুর সেনট্রাল জেলে। এর পরে ১৯২৩ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ও আরও ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ‘রেগুলেশন থ্রি’র বন্দী হয়ে আশলীপুর সেন্ট্রাল জেলেই এলেন। তবে, আমার সঙ্গে এক ওয়ার্ডে নয়। আমি একটি ওয়ার্ডে একা ছিলেম। জেলের ওয়ার্ডার ও কয়েদীরা তাকে খারাব ভাষায় “রেণ্ডি ফাটক” বলতেন। আসলে এটা এক সময়ে মেয়ে কদেয়দীদের ফাটক ছিল। কিছুকাল আগে হতে আশলীপুর সেনট্রাল জেলে মেয়ে কয়েদীর রাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে জেলে ঢুকে ‘রেণ্ডি ফাটকে’ আমায় রাখা হবে শুনে মনটা খারাব হয়েছিল। তারপর যখন শুনলাম চিত্তরঞ্জন দাশ ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদও ওই ওয়ার্ডেই ছিলেন তখন আমি মনে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা লাভ করলাম।
ভূপেন্দ্রকুমার দত্তরা আট-দশজন যে এলেন তাদের ভিতরে জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন না। তিনি কংগ্রেসের মিটিং-এ দিল্লী গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বোম্বে হয়ে কলকাতা ফিরতে তাঁর দেরী হয়েছিল। অবশ্য কলকাতায় ফিরে এসে তিনিও ধরা পড়েছিলেন। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের কয় মাসের বাইরের কাজ-কর্ম হতে মনে হয়েছিল যে তিনি মতের পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ, মনে হয় ঠিক করেছিলেন যে কমিউনিস্ট আন্দোলনে আর তিনি এগুবেন না। তবুও বুঝলাম না কেন যে তিনি আশলীপুর সেন্ট্রাল জেলে এসে ওয়ার্ডারের মারফতে আমায় বলে পাঠালেন, আমি যেন চেষ্টা করে তাঁদের সঙ্গে থাকতে যাই। সেই চেস্টা আর আমায় করতে হয়নি। তাঁরা মেদিনীপুর সেনট্রাল জেলে আর আমি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বদলী হয়ে গেলাম।
১৯২৩ সালের মে মাসে আমি গিরেফতার হয়েছি। তখন পর্যন্ত আমি জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়দের অকপটে বিশ্বাস করেছি। আমার মনে তাঁদের সম্বন্ধে এতটুকুও দ্বিধাবোধ ছিল না। আমি ভাবতাম তাঁরাও আমায় সেইভাবেই বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু এতকাল পরে ভারত গবর্নমেন্টের মুহাফিজখানার (National Archives of India) কল্যাণে জানতে পারছি যে তাঁরা একটি বিষয়ে অন্তত আমার নিকটে অকপট হননি। বিষয়টি আমার নিকটে তাঁরা গোপন করেছেন। এটা যদি আমি একেবারেই জানতে না পেতাম তা হলে বরঞ্চ ভালো হতো। জানার ফলে চার-পাঁচ বছর কম অর্ধ শতাব্দী পরেও মনটা কি রকম খচখচ করছে।
সেই যে ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভূপেন্দ্রকুমার দত্তরা গিরেতার হয়েছিলেন তার পরে তাঁরা বা’র হয়ে এসেছিলেন ১৯২৮ সালের শুরুর দিকে। ভূপেন্দ্রকুমার সম্পূর্ণরূপে তাঁদের পুরানো পথে ফিরে গেলেন। কোনোদিন আমার সঙ্গে আর দেখাও করলেন না। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ও আমাদের সঙ্গে এলেন না। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা তখন কমিউনিস্ট বর্জনের যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন সেটাও তিনি এড়িয়ে চলেননি। কিন্তু মনে হয়েছিল তাঁর সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী মনে মার্কসবাদের ছোঁয়া লেগে কিঞ্চিৎ যেন ভাঙন ধরেছিল। দেখা হলে জীবনলাল আমার সঙ্গে বন্ধুভাবে মিশতেন। চা খাওয়ানোর জন্যে রেস্তোরাঁয় টেনে নিয়ে যেতেন। যতটা মনে পড়ে ১৯৩১ সালে তিনি বসো দুর্গে বিনা বিচারে বন্দী ছিলেন, আর আমি ছিলেম মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার (১৯২৯-৩৩) আসামী। সেই সময়ে তিনি বক্সা দুর্গ হতে আমায় পত্র লিখে জানিয়েছিলেন যে “মোকদ্দমায় দেওয়া আপনাদের বিবৃতিগুলি এখানকার বন্দীদের মনে দাগ কাটছে”।
যদি অমার্জিত ভাষায় বলি তবে বলতে হবে যে জীবন চাটুজ্যে একজন ভালো ‘ছেলেধরা’। অর্থাৎ তিনি তরুণদের তাঁর দলে খুব টানতে পারেন। এ বিষয়ে চমৎকার গুণ আছে তাঁর, অন্তত, এক সময়ে ছিল। তাঁর এই তরুণ দল হতে ১৯৩৯-৪০ সালে বহু যুবক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে চলে আসেন। জীবনলাল আমায় তার জন্যে তাঁর একখানা কাগজে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। কমরেডরা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আমি তা পড়িনি। কারণ তাঁর দলের যুবকদের কমিউনিস্ট পার্টিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদই এনেছিল, আমি আনিনি। আমি পুরানো বন্ধুদের স্মৃতি মনে রাখতে চেয়েছিলেম।
পার্টি গড়ার পুরানো দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে আমি কখনও কাউকে বলিনি যে সেই শুরুর দিনগুলিতে ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত আর জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতিও আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। কারণ, তাঁরা এসে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। আমি কিছু বললে তাঁরা তা অস্বীকার করতে পারতেন। ১৯২০-এর দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের নিকট হতে আমরা কম বাধা পাইনি। এখন ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত তাঁর স্মৃতিকথা “বিপ্লবের পদচিহ্ন”তে সে-সব কথা কিছু কিছু লিখেছেন। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ও সে-সব কথা অন্যদের কিছু কিছু বলেন শুনেছি। বিশেষ করে আমার চতুঃসপ্ততিতম জন্মদিনে তিনি নিম্নলিখিত পত্রখানাও লিখেছেন :
JIBANLAL CHATTERJEE
PRACHARIKA PRESS
249 Bowbazar St., Cal-12
25.7.1963
সাথী মুজফফর আর্মদের ৭৪তম জন্ম বার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। এক কালের খুব নিকট বন্ধু ছিলেন তিনি। বর্তমানে মতাদর্শ ও কর্মপন্থায় আমরা ভিন্নমত পোষণ করলেও অতীতের বন্ধুত্বের স্মৃতি আজও অম্লান রয়েছে। এই স্মৃতি আজ আরও বড় হয়ে উঠেছে এই জন্যে যে এই বন্ধুটি আজ বিনাবিচারে আটক হয়ে আছেন। যে কংগ্রেস বিনাবিচারে আটক রাখার আইনকে জঙ্গলী আইন বলে বলতো সে কংগ্রেসী আমলে অতীতের একজন মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ বয়সে আটক হয়ে আছেন।
আশা করবো, সাথী মুজফফর আমদের ৭৪তম জন্ম-বার্ষিকী পালনের উপলক্ষে আমাদের দেশবাসী বিনাবিচারে আটক রাখার নীতির প্রতিবাদ করে তাঁর মুক্তির দাবী করবেন।
জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়