স্ত্রৈণ – সন্তোষকুমার ঘোষ
এক
নীরদ ভয় পায়নি। কমলার হিম চোখের স্থির মণি দুটির দিকে চেয়ে থাকতে না। সিঁদুর-লেপা ভীষণ সুন্দর কপালটা ছুঁতেও না। পায়ের দিকে চোখ নামিয়েছে; আঙুলগুলো কঠিন, একটু-বা বাঁকান, আলতায় ছোপান। বুক তবু কাঁপেনি। রাশি রাশি তাজা ফুল মরা শরীরটায় নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছে।
পথে নেমেই ওরা কর্কশ গলার হরিধ্বনি তুলেছিল। নীরদ চমকে উঠেছে, কিন্তু ভয়ে নয়। ওরা বরং চুপ করে থাকলে ভাল হত। এক পশলা বৃষ্টিতে ভেজা পিচের রাস্তায় ওদের খালি পায়ের ছপছপ শব্দ শোনা যেত।
শ্মশানেও ওরা বড় বেশি হল্লা করছিল। কোথা থেকে টেনে টেনে এনে ছুড়ে ফেলছিল কাঠ, ঘিয়ের ভাঁড় উপুড় করে ঢালছিল। বিড়ি ধরিয়ে খুকখুক করে কাশছিল কয়েকজন, একজন বিশ্রী একটা গান ধরেছিল। শীতার্ত একটা কুকুর ফিরে ফিরে এসে চিতাটিকে প্রদক্ষিণ করে শরীরটা সেঁকে নিল, নাক উঁচু করে উৎকট গন্ধ শুঁকল হাওয়ায়, তারপর মট করে একটা হাড় ফাটতেই কেঁউ করে পিছিয়ে গেল। শোকার্ত অশ্বত্থগাছটির পাতা চুঁইয়ে তখন জল ঝরছে।
একজন বলল, “কী ঠাণ্ডা মাইরি, আর খানিকটা থাকতে হলে বুকে সর্দি বসবে, ওখানেই শুতে হবে।”
ইশারায় সে ছিতাটা দেখিয়ে দিল।
আর একজন ভরসা দিয়ে বললে, “না, বেশিক্ষণ লাগবে না।” বলেই উপরের দিকে তাকাল। “আর বৃষ্টি যদি না হয়, তবে বড় জোর আধ ঘণ্টা।”
“বউটা কী হালকা আর রোগা। ভাল করে খেতে পেত না নাকি?” বলেই তৃতীয় একজন আড়চোখে নীরদের দিকে চেয়েছে।
নীরদ একটু দূরে বসে ছিল। ঘাটের সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে নেমে যেখানে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে, তার কাছাকাছি। দশ-বারো বছরের একটা ছেলে তখন থেকে চোখের জল মুছছে। বোধ হয় মা মারা গিয়েছে। ওকে নিয়ে এসেছে মুখে আগুন দিতে হবে বলে। যেটুকু করবার, করা হয়ে গিয়েছে, ছুটি পেয়ে এখন ছেলেটি কাঁদছে। শুধুই কাঁদছে না, মাঝে মাঝে চোখ খুলে ভাটির দিকে ভেসে-যাওয়া কচুরির গাঢ় সবুজ পাতা আর বেগুনি ফুল অবাক হয়ে দেখছে। হয়তো ঘাটের সিঁড়ি গুনছে। কিন্তু যে কটা ডুবে আছে, তার আর হিসাব পাবে না। যে কচুরিপানাগুলো ভেসে গেল, জোয়ারের টানে তার কিছু কিছু হয়তো এই ঘাটেই ফিরে আসবে, কিন্তু তার মা আর ফিরবে না। কিন্তু এসব কথা কি ছেলেটি ভাবছে? ওই বয়সের ছেলেরা কি কিছু ভাবে, ভাবতে পারে?
আসলে, গায়ের চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নীরদ টের পেল, তার নিজের ভাবনাই সে ছেলেটির উপর আরোপ করেছে। কমলা আর ফিরবে না। কাল রাতে ছিল, ভালবেসেছিল, আজ সকালে ছিল, ঝগড়া করেছিল। একসঙ্গে খেতেও বসেছিল দুজনে।
হঠাৎ জল খেতে গিয়ে কমলা বিষম খেল, নীরদ ধমক দিয়ে বলে উঠল, “সব কাজে তোমার তাড়াতাড়ি।”
আরও কী বলবে মনে মনে ঠিক করছিল, কিন্তু বলতে হল না। কমলার হাত থেকে খসে গ্লাসটা তখন মেঝেয় খান খান হয়ে পড়েছে। সেই কাচের টুকরো আর জলের মধ্যেই শুয়ে পড়েছে কমলা, ছটফট করছে।
তাড়াতাড়ি পাখাটা জোরে চালিয়ে দিল নীরদ, জানলা-দরজা খুলে বাইরের বোদ আর হাওয়ার কাছে সাহায্য চাইল।
“বড় কষ্ট।”
কমলার মাথাটা নীরদ তুলে নিল কোলে, ওর জামা-কাপড় ঢিলে করে দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
ওরই ফাঁকে একবার উঠে নীচের দোকান থেকে ফোন করে ডাক্তারকে খবর দিতে পেরেছিল।
ডাক্তার ঘরময় ছড়ান জল তর কাচের টুকরোগুলোর দিকে তাকালেন, চশমার আড়ালে সন্দিগ্ধ ভ্রু কুঞ্চিত হল, বিরক্ত ঠোঁট উল্টে নাড়ি দেখলেন, মাথা নাড়লেন আস্তে আস্তে।
কমলার চোখের পলক মণি ততক্ষণে স্থির হয়ে এসেছে।
নীরদ তথনও ভয় পায়নি।
অশ্বত্থগাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে জল ঝরছে, কনকনে হাওয়া চিতার আগুনটাকে ঝুঁটি ধরে নাড়ছে আর জ্বালা জুড়তে নিস্তব্ধ নীল একটি নদীর জলে ঘাটের কয়েকটি সিঁড়ি ডুব দিয়েছে—একটু ছমছমে ভাব, কিন্তু একে ভয় বলে না।
পিঠে কে হাত রেখেছে। নীরদ চমকে ফিরে চাইল। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক। উদ্যোগী হয়ে তিনিই সব ব্যবস্থা করেছেন, ডেকে এনেছেন শ্মশানবন্ধুদের।
“ফুরিয়ে গেছে। জল ঢেলে দেবেন আসুন।”
সম্মোহিত নীরদ ভদ্রলোককে অনুসরণ করেছে।
সব ধোঁয়া নিবে গিয়েছে, সব ছাই ধুয়ে গিয়েছে।
নীরদ চলে আসবে, সেই ভদ্রলোকই ওর হাত ধরে টেনেছে।
“ওদের কিছু দিন। পরিশ্রম হয়েছে, ওরা চা খাবে।”
নীরদ বাক্যব্যয় না করে একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়েছে।
“আমি এবার যাই।”
“কোথায় যাবেন?”
“বাসা—বাসাতেই যাব।”
“একটু দাঁড়ান। আমিও আসছি।”
নীরদ অন্য সময় হলে হেসে উঠত। ভদ্রলোক ওকে একা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছে না। যথাসাধ্য নম্র গলায় নীরদ বলল, “না, আমি একাই যাব।”
ওর স্থির, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভঙ্গি দেখে ভদ্রলোক হয়তো একটু ভয় পেলেন। বললেন, “আচ্ছা, আসুন।”
তখন পায়নি, কিন্তু নীরদ ভয় পেয়েছে পরে, বাসায় ফিরে এসে।
প্রথমে অভ্যাসবশে বিজলি ঘুণ্টির বোতাম টিপেছিল। দরজা খুলল না, হালকা চটিপরা পায়ের পরিচিত শব্দ শোনা গেল না, নীরদ ভয় পেল। সে-ভয়টা মাছির মতো উড়ে এল, একটু অস্বস্তি হল, কিন্তু তাকে তাড়াতেও সময় লাগল না। কমলা নেই, দরজা খুলবে কে? ভয় গেল, তবু ফোকর খুঁজে চাবি পরাতে গিয়ে নীরদকে গলদঘর্ম হতে হল। ঝিমবে বলে আয়েসি একটা বিড়াল প্যাসেজের নিরালা কোণটি বেছে নিয়েছিল। আলোয় বিব্রত, পায়ের শব্দে চকিত হয়ে সে ছিটকে তাকটার উপরে গিয়ে বসেছে। শোবার ঘরে পা দিতে না দিতে কয়েকটা প্রগলভ চড়ুই ফরফর করে জানলার বাইরের আকাশে ফেরারি হয়েছে।
চোখে আলো লাগছিল, নীরদ দু হাতে পর্দা টেনে ঘরে ছায়া বিছিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে, ঠিক ভয়ে নয়, শরীরের সব কটি পেশি সহসা যেন কঠিন হয়ে গেল।।
এতক্ষণ বেশ ছিল ঘরটা; ছড়ান, গড়ান, চওড়া। হঠাৎ ছোট হয়ে গেল। এই রকমই হয়, নীরদ জানে। আলোয় দেয়ালগুলো আলাদা হয়ে সরে সরে থাকে, যেন কেউ কাউকে চেনে না। কিন্তু যেই একটু একটু করে অন্ধকার ঘনায়, দেয়ালগুলো পা টিপে টিপে তখন এগিয়ে আসে। ওদের ষড় আছে, নিষুতি রাতে একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়াবে। অন্ধকারে আলাদা থাকতে কি ওদের ভয়!
আলো নিভলেই, তাই নীরদ হাত বাড়িয়ে কমলাকে ছুঁয়ে থাকত। এই ছ মাস ধরে। রোজ।
বিছানাটা পাতাই ছিল; নীরদ ইচ্ছে হলে শুয়ে পড়তে পারত। কিন্তু যাকে ছুঁয়ে থাকবে সেই মানুষটা কই! এই বিছানার চাদরটার মতোই নীরদের অভ্যস্ত জীবন আর নিয়মকে এলোমেলো করে দিয়ে সে চলে গিয়েছে। তবু বালিশে মুখ ডুবিয়ে দিতে তারই যেন খানিকটা ফিরে এল। চুলের গন্ধের সঙ্গে থেঁতলানো বেলফুলের গন্ধ মাখামাখি হয়ে মিশে আছে। শুধু ফুল কেন, চুল কেন, ভাবতে ভাল লাগছে না। তবু সত্যি, একটু ঘামের গন্ধও আছে। এই তিনে মিলে কমলা। তার শরীর, তার ব্যক্তিত্ব। তাকে চেনবার চিহ্ন। তিনেরই এক কাজ, একজনকেই মনে করিয়ে দেয়। তাকে ছায়া-ছায়া ঘরে ডেকে আনে।
আনে বটে, কিন্তু ঠিক তাকে নয়, তার মায়াকে। তাকে তখন ছোঁয়া যায় না, কাছে টানা চলে না। সে থাকে দূরে দূরে, সরে সরে, অলৌকিক কণ্ঠস্বরে।
“কষ্ট হচ্ছে না তোমার?”
“হচ্ছে। খুব।”
কনুইয়ের মুখের আধখানা ঢাকা, নীরদ শুয়ে শুয়ে শুনতে পেল।
“কী করবে তুমি এখন?”
“ঘুমব।”
“সারা বিকেল?”
“সারা বিকেল। সারা রাত্রি।”
মিছে কথা। একটা মরা মানুষকে মিছে কথা দিয়ে নীরদ ভোলাবে না। সে ঘুমুতেই তো চায়, কিন্তু পারছে কই, পেয়ালায় যেমন করে চা জুড়য়, এক আকাশ রোদ তেমনই জুড়িয়ে ঠাণ্ডা আর হলদে হয়ে এল, নীরদ তখনও বিছানায় শুয়ে আছে। পিপাসা পেয়েছে, মেটাতে পারেনি, কুঁজো আছে, জল নেই, কেননা কমলা নেই। সারা ঘরে ভাঙা কাচের টুকরো ছড়িয়ে সে চলে গিয়েছে।
দেয়ালে অবশ্য এখনও তার ছবি আছে—সে তো কেবলই ছবি। তবু নীরদ তাকেই নালিশ জানাল, “এই দেখ না, আমি এখনও সেই জামা-কাপড়েই আছি যা পরে শ্মশানে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে শুকনো কাপড় এগিয়ে দিচ্ছ না। আসল কমলা হলে দিতে।”
“আসল কমলা হলে এতক্ষণ স্টোভে কাপ দুই চা-ও গরম হয়ে যেত। বারান্দার টবটাতে এতদিনে ফুল ফুটেছে, সেখানে বেতের চেয়ার টেনে বসতাম দুজনে। কথা বলতাম। কীই বা বলতাম! হয়তো কিছুই বলতাম না। অন্তত কথা দিয়ে বলতাম না।
“আসল কমলা হলে এতক্ষণ ঘাড়ের নীচে, যেখানে ভাঙা খোঁপা-চোয়ান তেল, পাউডার আর ফুল বিচিত্র একটা উত্তেজক গন্ধ সৃষ্টি করেছে, সেখানে মুখ রাখতাম। গ্রাণ নিতাম। আমার নাক কাঁপত, ঠোঁট স্ফুরিত হত, কলজে অতিসচল হত, আঙুলের ডগা শক্ত।
“কিন্তু তুমি, ছবির কমলা, তোমাকে নিয়ে আমি কী করব! হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারি, তার বেশি কিছু না। বড় জোর বুকে চেপে ধরতে পারি, কিন্তু সেখানেও কাঠের ফ্রেমের বাধা, কাচের আড়াল। বাসনার পেষণে ঠুনকো কাচটাই চুরচুর হবে।”
“তোমাকে নিয়ে কী করি! কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হল, কী করি আমার নিজেকে নিয়ে!”
যতক্ষণ বেদনা ছিল কমলার জন্যে, ততক্ষণ নীরদ নিজেকে শক্ত রাখতে পেরেছে। কিন্তু যেই নিজের কথা মনে পড়ল, অমনই চেতনার এই-ছেড়ে এই-ঘেঁড়ে হত আকাশ কান্নার কুয়াশায় ছেয়ে এল। কী করি, কী করি! আজ রবিবার। অন্য অন্য রবিবারে আমরা বেড়াতে যেতাম। কমলা হাঁটতে চাইত। জুতোর স্ট্র্যাপ যতক্ষণ না এই-ছেঁড়ে এই-ছেঁড়ে হত, ততক্ষণ হাঁটতেই থাকত। শো-কেশে সাজানো বেসাতি চোখ দিয়ে চাখত। যেদিন বেড়ানো ছিল না, সেদিন গান-শোনা ছিল, কিংবা ছবি দেখা, কিংবা কিছু না, শুধু বসে থাকা। আমার সব কটি বিকেলের স্বত্ব ওকে বিনা শর্তে দান করেছিলাম। সেই বিকেল আমার হাতে অফুরন্ত অনন্তকাল হয়ে জমে রইল, একে নিয়ে কী করি!
যখের-ধন-পাওয়া দিশাহারা মানুষের মতো নীরদ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরিয়েছিল, নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইল তার ধোঁয়ার দিকে। যেন ওর সব প্রশ্নের জবাব ওই ধোঁয়ার রেখায় রেখফায়ায় লেখা হয়ে যাচ্ছে।
সিগারেটের ধোঁয়ায় কখনও মুখের ছায়া পড়ে না, কিন্তু মনটাকে স্পষ্ট পড়া যায়, কিন্তু একথা নীরদ এর আগে তো কোনও দিন ভেবে দেখেনি।
আবার দরজায় তালা দিল নীরদ, রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
দুই
বেলা বলল, “আরে, নীরদবাবু যে, আসুন, আসুন। তারপর? পথ ভুলে নাকি?”
পর পর কয়েকটা সিগারেট টেনে আর খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে নীরদের স্নায়ু শক্ত হয়েছিল। হেসে বলল, “ভুলে নয়, চিনে।”
এসব জায়গায় জুতসই জবাব দেয়াই রীতি।
বেলা ভ্রূভঙ্গি করল, মুচকে হাসল একটু, শেষে বলল, “আপনি বসুন, এখুনি আসছি।”
বলেই ওঘরে গেল, যেতে যেতে দু ঘরের মাঝের পর্দাটা টেনে দরজা-জোড়া করে দিতে ভুলল না। পর্দাটা টানবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে একটু হাসল।
সে-হাসিব যা-খুশি-তাই মানে করা যায়। কোনও মানে নাও থাকতে পারে।
অবশ্য মানে নিয়ে ব্যস্ত হবার দরকার নীরদ বোধ করেনি। কেননা মাথার উপরে পাখাটা, অনলস এবং বিশ্বস্ত, ঘুরছিল, চেয়ারটা হেলান অতএব আরামপ্রদ, আর হাতের কাছেই সচিত্র একটা সিনেমা-কাগজ আধ-খোলা। ব্যস্ত হাওয়ায় পড়বার ফুরসুত নেই, একটার পর একটা পাতা উল্টে যাচ্ছিল। হয়তো একটু আগে পত্রিকাটা ছিল তন্দ্রাতুর বেলার হাতে। সেও সম্ভবত এক বর্ণ পড়েনি, শুধু ছবি দেখেছে। হাওয়া পড়ে না, পড়তে জানে না। মেয়েরা জানে তবু পড়ে না। ছবি দেখে। থাকলে।
যে-হাওয়া নিরক্ষর এবং অন্ধ, শুধু পাতা ওল্টায়, তার আবর্তে সিগারেট ধরান দুঃসাধ্য। কিন্তু নীরদ অভ্যস্ত, কোনও অসুবিধা হল না। দীর্ঘ একটা টান দিয়ে সে চাইল পর্দাটার দিকে। হাওয়া তো চপল আর উৎসুকও—সে কি পর্দাও মাঝে মাঝে সরায় না? একবারও কি তার সাধ হয় না, ও-ঘরে উঁকি দিতে? যে-ঘরে বেলা গিয়েছে?
বেলা এ-ঘরে নেই। এখন নেই। নীরদ আছে। বসে আছে। একটু আগে বেলা এখানেই ছিল, নীরদ ছিল না। নীরদ এল, বেলা রইল না। ও-ঘরে গেল।
আসলে, ক্ষয়ে-আসা সিগারেটটার দীপ্ত ডগা ইতিমধ্যেই নীরদকে বুঝিয়ে দিয়েছিল বেলা এখন ও-ঘরেও নেই। কলঘরে গিয়েছে। মুখ-টুখ ভাল করে ধোবে, ঢুলুঢুলু চোখে জল ছিটিয়ে, ফোলা ফোলা গাল প্রথমে সাবানে পরে শুকনো তোয়ালেয়, আরও পরে স্নো পাউডার ঘষে ঘষে ঘুমের সব আদরের ছাপ মুছে ফেলবে।
মেয়েদের এসব সংকোচের কোনও মানে কি আছে? যেন ঘুম দ্বিতীয় একটা পুরুষ, যাকে নিয়ে বেলা এতক্ষণ ভরদুপুরে দরজা-ভেজান ঘরে ছিল; চিহ্ন মুখে-চোখে মেখে নীদের সামনে এসে দাঁড়াতে বেলার এখন লজ্জার অবধি নেই। যতক্ষণ এ-ঘরে ছিল, ততক্ষণ তাই মুখের আধখানা আঁচলে ঢেকে রেখেছিল।
বেলার কাছে যে ঘুম পুরুষ, নীরদের কাছে সে-ই আবার মেয়ের বেশে দেখা দিতে পারে, “চোখ বোজ তো” বলেই মনের সব ভাবনার আলো নিবিয়ে দিয়ে, বুকের ভিতরে মুখ লুকিয়ে, মিশে গিয়ে, সত্তাকে অবশ করে দিতে পারে। ততক্ষণ বেলা কলঘরে জল ঢালুক, কিংবা পা টিপে টিপে পাশের ঘরে ফিরে জামা বদলাক, পাটভাঙা শাড়ির চকচকে খোলসে নতুন হোক। তখন কৌতুহলী হাওয়া পর্দা সরিয়ে ও-ঘরে যত খুশি উঁকি দিক না, ক্ষতি নেই।
“ঘুমিয়ে পড়লেন?”
চকিত নীরদ চোখ মেলল। বেলা স্নান সেরে এসেছে। কনুই রেখেছে ওর চেয়ারের হাতলে, ছোট্ট মোড়াটা টেনে মুখোমুখি বসেছে। মুখ টিপে হাসছিল কিনা নীরদ বুঝতে পারল না, চোখ রগড়ে সোজা হয়ে বসল, তবু জড়তা গেল না, তখন হাই তুলল।
‘ঘুমইনি তো। চোখ বুজে ছিলাম।” এইটুকুই যথেষ্ট হত, তবু নীরদ যোগ করল, “ভাবছিলাম।”
“আজকাল আর দেখতে পাই না যে! ডুমুরের ফুলটি হয়েছেন।”
“না তো।” নীরদ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “তবে হ্যাঁ, এই, কাজ থাকে।”
“বুঝেছি।” বেলা বলল, “বউ বকে। নীরদবাবু, তুমি তো বিয়ে করেছিলে, না? তা বউ কোথায়?”
নীরদ ফস করে বলল, “নেই।”
“নেই?”
একবার ঢোক গিলল নীরদ, বলল, “মানে, এখানে নেই।”
“বাপের বাড়ি বুঝি?”
নীরদ ঘাড় কাত করল।
“হঠাৎ বুঝি?”
নীরদ বিরক্ত হয়ে উঠছিল, ঘামছিল। এই জেরার যেন শেষ নেই! ঘরে ছায়া নেমে এসেছে, বিকালে রোদের গায়ে পাকা পেয়ারার রং ধরেছে, নীরদের মনে হল সেটা থকথকে বুড়োটে—নরম, বিস্বাদ। নীরদ নিজেও যেন অক্ষম হয়ে পড়েছে, ফোকলা মাড়িতে পেয়ারাটাকে চেপে ধরতে চাইছে, পারছে না, লালায় মাখামাখি হয়ে পেয়ারাটা কেবলই ফসকে ছিটকে পড়ছে।
অস্থির হয়ে নীরদ হাতের সময়-ঘড়িটার দিকে চাইল, তারপর বেলার সময়হীন চোখে। বলল, “চল না, যাই, একটু ঘুরে আসি।”
সে-কথা বেলা শুনতে পেল না, অন্তত ভান করল না শোনবার। কনুইটা এগিয়ে এনে এবার রাখল নীরদের হাঁটুতে, আর এক হাতে গাল রেখে বলল, “বললে না তো নীরদবাবু, বউ হঠাৎ বাপের বাড়ি গেল কেন?”
“না, ঠিক হঠাৎ নয়,” এখন ঘাম নেই, তবু নীরদ রুমাল বার করে কপাল মুছল।—“না, ঠিক হঠাৎ নয়। শরীর খারাপ হল, মানে এই সময়ে, প্রথমবাৱে, ওরা সবাই বাপের বাড়ি যায়।”
“ও,” বেলা বলল পা দোলাতে দোলাতে। চোখ ছোট করে বলল, “বুঝেছি।” |
তাড়া-খাওয়া চোরের মতো দ্রুতত্রস্ত হাওয়া হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ল, কাঁপতে থাকল পর্দার আড়ালে, ঢুকল খাটের নীচে, চাদরের ঝালরটা শুধু থেকে থেকে কাঁপতে থাকল।
জানলা বন্ধ করে দিয়ে এল বেলা, এবারে চেয়ারের হাতলে বসল। হয়তো স্বেচ্ছায়, হয়তো ভার সামলাতে একটা হাত রাখল নীরদের কাঁধে। পায়ের বুড়ো আঙুল একবার বাঁকাল, সোজা করল, কের বাঁকা করল, তারপর শাড়ির পাড়ে সবটাই ঢেকে ফেলল। নীরদ আড়চোখে চেয়ে দেখতে পেল, বেলার চোখে এখনও দুষ্টুমি। আস্তে আস্তে ওর কাঁধ ধরে, ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, “বল না নীরদবাবু, এসময়ে তোমাদের বউয়েরা কী করে! বাপের বাড়ি যায়, আর কী? খুব ঘুমোয়, পড়ে পড়ে, না? যাচ্ছেতাই সব জিনিস খুঁটে খুঁটে খায়?”
“খায়।”
“আর তোমরা, তোমরা তখন আমাদের কাছে আস, কেমন?”
হাততালি দিতে গেল বেলা, ভার সামলাতে পারল না, কেননা শাড়ির পাড় দিয়ে সম্পূর্ণ করে ঢাকা পা দুটি তখনও ছিল উঁচুতে, গড়িয়ে পড়ছিল, নীরদ হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল, ধরল, কিন্তু ফেলল না, বরং টানল, টানতেই দু হাতের অঞ্জলি একটি নরম, মসৃণ মুখের স্পর্শে ভরে গেল।
তারপর, তারও অনেক পর, অন্ধকার নামল। নামল, নাকি বেরিয়ে এল ঘরেরই কোণ থেকে, যেখানে দুখানি ইটের উপরে তোরঙ্গ আর সুটকেশ সাজানো; রোজ ভোরে অন্ধকার ভয়ে ভয়ে সরে সরে তোরঙ্গের নীচে লুকিয়ে রোদের থাবা থেকে গা বাঁচায়। আবার সন্ধ্যা হতেই ভিতু কচ্ছপের মতো গলা বাড়িয়ে দেয়। আস্তে আস্তে তার সাহস বাড়ে, ক্রমে নিজেকে ছড়ায়, গোটা ঘরখানাই ছেয়ে ফেলে। এই পৃথিবীটাও নিমেষে একটা অতিকায় কচ্ছপ হয়ে যায় নাকি, নীরোম-নরম তলপেটে আলো লুকিয়ে একপিঠ অন্ধকার নিয়ে কাঁপে?
কান পাতলে শোনা যায়, নীরদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ই এখন শুধু অনুভূতি আর শ্রুতি হয়ে গিয়েছে। তাই সে-ও শুনতে পেল, সেই অন্ধকারও এক সময় গুনগুন করে ওঠে। অন্ধকার নয়, বেলা। বেলা গুনগুন করছে।
নীরদ নিজেকে বলতে শুনল, “একটা গান করবে?” কোলের শীতলে ডুবিয়ে রাখা মুখ তুলে বেলা বলল, “এখন, এইভাবে?”
“এইভাবে।”
নীরদ দৃঢ়, গাঢ় গলাতেই বলেছিল, তবু বেলা শুনল না, হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আলো জ্বেলে দিল, ঘরের কোণ থেকে নিয়ে এল একটা বাজনা। নীরদ তখন দু হাতে চোখ ঢাকল।
খানিক পরে গান থামিয়ে বাজনাটা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আবার সেই আগের মতোই নীরদের খুব কাছে এসে বলল, “নীরদবাবু, তোমার বউ গান জানে?”
“জানে।”
“গায়? শোনায় তোমাকে?”
“শোনায়।”
“রোজ?”
নীরদ বলল, “রোজ।”
বেলাকে আবার প্রগল্ভতায় পেয়েছে, দু হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরল নীরদের, আধ-আধ গলায় বলল, “তোমার বউ রোজ আর কী করে, নীরদবাবু?”
“রান্না করে খাওয়ায়।”
“কখন বাড়ি ফিরবে, সেইজন্যে বসে থাকে?”
“থাকে।”
“বিকেল হতে না হতে গা ধোয়, খুব সাজগোজ করে?”
“করে।”
“রোজ?”
“রোজ।”
ওর বুকে তর্জনী দিয়ে টোকা দিতে দিতে বেলা বলল, “আর, আর কী করে?”
“আর,”নীরদ হঠাৎ প্রবল আবেগে বেলার মুখখানা বুকে চেপে ধরে বলল, “আর, অনেকক্ষণ ধরে, আমার সঙ্গে এইভাবে মিশে থাকে।”
তিন
সোজা উঠে এসে দরজার ফোকরে চাবি গলিয়ে দিল নীরদ, আর ভয় করল না। একেবারে শোবার ঘরে ঢুকে আয়নার সমুখে দাঁড়াল। চোখের মণি এখনও কি বিস্ফারিত, নাকের ডগা স্ফীত? ঠিক বুঝল না। কাচটা যেন ঘষা-ঘষা।
পকেটে হাত দিল, উঠে এল বেলফুলের মালা। কখন বেলার খোঁপা থেকে ওর আঙুল মালাটা খুলে নিয়েছে, মনে নেই তো। ফুলগুলো তুলে নাকের কাছে ধরল, জানা-জানা গন্ধ। কার? বেলার, না, কমলার? ঠিক চেনা গেল না।
কমলার ছবিটার দিকে চোখ পড়ল তখন। প্রথমে চমকে উঠেছিল, দু পা পিছিয়েও গিয়েছিল ভয়ে, কিন্তু পর মুহূর্তেই সাহসে ভর করে নীরদ এগিয়ে গেল। মালাটা ঝুলিয়ে দিল ফ্রেমে। জোর করে হাসল। তারপরে খুব কোমল, অবুঝকে লোকে যে সুরে বোঝায়, সেই সুরে বলল, “জানি, তুমি আমাকে অবিশ্বাসী ভাববে, রাগ করবে। বলবে, একটা দিনও তোমার তর সইল না? কিন্তু এ-রাগের কোনও মানে হয় না। বোকা মেয়ে, কিছু বোঝ না। আমি তো এতক্ষণ তোমার সঙ্গেই কাটালুম।”
কাচের উপরে আঙুল ঘষে আদর করতে করতে নীরদ আবার বলল, “ওই দেখ, তুমি বিশ্বাস করছ না। বলছ, তোমার সঙ্গে নয়, বেলার সঙ্গে। বেলা নয়, বেলা নয়, সত্যি বলছি, তুমি, তুমি, তুমি। আর কেউ নয়। রোজ ঘরে ফিরে তোমাকে পাই, আজ পেলাম না। সব ফাঁকা ঠেকল। ঠেকল বলেই তো—”
নীরদ হঠাৎ থেমে গেল। সে বুঝতে পেরেছে। বেলা তো নয়ই, কমলাও নয়, কেউ নয়। অভ্যাস।
তাড়াতাড়ি সরে এল নীরদ, বারান্দায় দাঁড়াল। বৃষ্টিভেজা পিচের পথে ওর আসল মনের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়া সব জানে তাই নীরদ তাকেই জিজ্ঞাসা করল: আমরা কি তবে বিশেষ কাউকে নয়, আসলে কয়েকটা অভ্যাসকেই ভালবাসি? হঠাৎ একটা দাঁত পড়লে ফাঁকা লাগে, গালের ভিতরে জিভ ঘুরিয়ে হারানো দাঁতটাকে খুঁজি। সিগারেট ফুরিয়েছে জেনেও পকেটে হাত ঢুকিয়ে প্যাকেট হাতড়াই। সবই কি তাই।
নির্ভয়, নির্ভার নীরদ আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
২৭ জুলাই ১৯৫৮