বেলা যে গেল – অন্নদাশঙ্কর রায়
“বেলা যে গেল” শুনে লালাবাবু কী করেছিলেন মনে আছে? সেই দণ্ডেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একবস্ত্রে। যেন ও-পাড়ায় যাচ্ছেন। তাঁর সন্ধান মিলল শেষে বৃন্দাবনে। সেখান থেকে তিনি আর দেশে ফিরলেন না। তাঁর সংসারের প্রয়োজন ফুরিয়েছিল।
তুচ্ছ একটি কথা। যে বলেছিল সে কি তাই ভেবে বলেছিল? না বোধ হয়। তবু তার ফল হলো সুদূরপ্রসারী। জমিদার লালাবাবু হলেন পরম বৈরাগী। এমনটি সচরাচর ঘটে না। তবে একেবারেই ঘটে না যে কেমন করে বলি?
বর্ধমান স্টেশনে ডাউন বম্বে মেল দাঁড়িয়ে। শরৎকালের সকাল। স্নানের ঘর থেকে সাহেবী পোশাক পরে ফিটফাট হয়ে নিজের বার্থে এসে ঠেস দিয়ে বসলেন আর্যকুমার নন্দী। কাগজওয়ালা তাজা কাগজ হাতে হাঁক দিয়ে যাচ্ছিল। কিনলেন একখানা। আগে থেকে বলা ছিল, ছোটা হাজরি দিয়ে গেল খানসামা। খেতে খেতে পড়তে পড়তে ভদ্রলোকের আর কোন দিকে হোঁশ ছিল না, সেই অবস্থায় তাঁর একটা পা টেনে নিয়ে কাঠের বাক্সর উপর রেখে রঙ মাখাতে লাগল এক মুচির ছেলে। অনাহূত।
এমন সময় এক পাঞ্জাবী শিখ গণৎকার জানালার বাইরে থেকে হিন্দীতে বলল, “বাবুর্জী, দেখি আপনার হাত।” আর্যকুমার ওসবে বিশ্বাস করতেন না। তিনি উদ্যোগী পুরুষসিংহ। পুরুষকারের দ্বারা লক্ষ্মী লাভ করেছেন। অন্য দিন হলে ভাগিয়ে দিতেন। কিন্তু পড়তে পড়তে খেতে খেতে তিনি অসতর্ক ছিলেন, আনমনে বাড়িয়ে দিলেন একখানা হাত। গণৎকার বলল, “এ হাত নয়, বাবুজী। ও হাত।”তখন ডান হাতখানা রুমাল দিয়ে মুছে বাড়াতে হলো।
ট্রেন তখন ছাড়ি-ছাড়ি করছে। মুচির ছেলে বকশিস চায়। খানসামাও সেলাম ঠুকছে। গণৎকার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “বাবুজী, জলদি করুন। সময় বেশি নেই।”
মানে কী? মানে তো এই যে এক্ষুনি ট্রেন চলতে শুরু করে দেবে। যাকে যা দেবার তাকে তা যদি এক্ষুনি না দেন, তো কখন দেবেন? তবু আর্যকুমারের মনে খটকা বাধল। তিনি সেই গেরুয়া-আলখাল্লাপরা পাগড়িবাঁধা দাড়িওয়ালা প্রৌঢ়কে শুধালেন, “আর কত সময় আছে?”
গণৎকার এর উত্তরে বলল, “বেলা যে গেল।”
আর্যবাবু লালাবাবুর গল্প জানতেন না। তবু তাঁরও মনে হল, এর কী যেন একটা গূঢ় অর্থ আছে। প্রকাশ্য অর্থটা কিছু নয়। তিনি সেই গণৎকারকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করার পূর্বেই গাড়ি ছেড়ে দিল। নন্দী একখানা নোট ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। গণৎকার কিন্তু কুড়িয়ে নিল না।
স্টক এক্সচেঞ্জের পৃষ্ঠায় দৃষ্টিপাত করে ভদ্রলোক অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, “যত সব বুজরুক। টাকা কুড়িয়ে নিয়ে করত কী? গাঁজা খেত।”
হয়তো লোকটা আশা করেছিল এক টাকার বেশি। অনেক বেশি। তাই নোটখানা ছুঁলো না। ছোঁবে ঠিকই। যথালাভ। হকের পাওনা তো নয়। ঠকিয়ে যা পাওয়া যায়। নন্দী অমন কত দেখেছেন। তা হলেও তাঁর মনটা বিরস হয়ে রইল। তাঁর মতো বড়লোকের সঙ্গে এমন অসভ্যতা করবে এহেন আস্পর্ধা তিনি এর আগে প্রত্যক্ষ করেননি। ঐটুকু উক্তির জন্যে একটা টাকা কি বড় কম হলো। না ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ-করা কুপে দেখে তার পাওনা অমনি বেড়ে গেল?
ঘোড়দৌড় আর খেলাধুলোর পৃষ্ঠায় যখন তাঁর নজর, তখন তাঁর মন থেকে লোকটার চেহারা প্রায় মুছে গেছে। শত শত লোকের সঙ্গে তাঁর নিত্য কারবার। একটি মাত্র মুখ তিনি কতক্ষণ মনে রাখবেন? ধরো, পাঁচ মিনিট। কিন্তু তাঁর কানে তখনো বাজছিল, বাবুজী জলদি করুন। সময় বেশি নেই। বেলা যে গেল।
কী এর প্রকৃত অর্থ? ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় হয়েছে। কী দেবেন দিন। সকালবেলাটা তো কেটে গেল। তেমন কিছু রোজগার হলো না আজ। আপনি বড়লোক। বউনি করুন। কেমন? এই তো এর মানে? এছাড়া আর কী হতে পারে?
আর্যকুমার কাগজখানা সরিয়ে রাখলেন। বিজ্ঞাপনগুলো পড়াও দরকার। কিন্তু এখন নয়। ভাবতে লাগলেন, কী হতে পারে গণৎকারের উক্তির তাৎপর্য। লোকটা কি হাত দেখেই বুঝে ফেলল যে, আর বেশি দিন পরমায়ু নেই? যা করবার করে নিন চটপট। আরো কয়েক লাখ টাকা। আরো কয়েকটা কোম্পানি পরিচালনা।
না, না, বয়স এমন কিছু হয়নি। বাহান্ন বছর বয়সে কেউ ভবের হাটে দোকানপাট গুটোনোর কথা ভাবে না। আরো আট বছর পরে না হয় রিটায়ার করা যাবে। কিন্তু ভবধাম থেকে নয়, তার আরও দেরি। ধরো, সত্তর বছর। এত টাকা আছে যখন তখন আয়ুই বা কিনতে পারবেন না কেন? আজকাল ডাক্তারির যা উন্নতি হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষেরই জীবনের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। তিনি তো অপেক্ষাকৃত অসাধারণ। ইচ্ছা করলে পশ্চিমে গিয়ে বাস করতে পারেন। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মানুষ দীর্ঘজীবী হয়। কিছু না হোক দার্জিলিং তো হাতের কাছেই। সেখানে বসতি করলে হয়।
কিন্তু হাওড়ায় পৌঁছবার আগে তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল এই ব্যাখ্যা যে, বিদায়টা শুধু কর্মক্ষেত্র থেকে নয়, মর্ত্যলোক থেকেই। এবং তার জন্যে সময়মতো আয়োজন না করলে হঠাৎ একদিন করোনারি থ্রম্বোসিস বা সেই জাতীয় কোনও পরওয়ানা এসে হাজির হবে। ব্যাখ্যা বদ্ধমূল হলো বলে উক্তি বিশ্বাসযোগ্য হলো তা নয়। মানুষের মৃত্যু তো চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ নয় যে, কেউ গণনা করে বলতে পারে কবে ঘটবে। বিজ্ঞানীরা যা পারে না, তুমি ভিক্ষাজীবী গণৎকার—তুমি শুধু একবার হাত দেখেই তা পারলে আর আমিও তেমনি আহাম্মক যে বিশ্বাস করে একটা টাকা দক্ষিণা দিলুম।
“আমি বিশ্বাস করিনে।” কথাটা তিনি আপন মনেই উচ্চারণ করলেন একটু ঝোঁক দিয়ে। ট্রেন ততক্ষণে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গেছে। উর্দিপরা ড্রাইভার এসে সেলাম ঠুকছে। বাড়ির গাড়ি প্ল্যাটফর্মের ধারেই মোতায়েন। কুলীরা মাল নামাচ্ছে।
“আমি বিশ্বাস করিনে। বিশ্বাস করতে পারিনে।” আবার তিনি উচ্চারণ করলেন হাওড়ার পোলের উপর দিয়ে যাবার সময় গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। আমিহীন কলকাতায় আমিহীন গঙ্গা এমনি করে বইতে থাকবে, তা মানি। কিন্তু এত শিগগির নয়। এ কখনো হতেই পারে না যে, এক বছর পরে আমিহীন মোটর আমিহীন পোলের উপর দিয়ে এমনি করে ছুটতে থাকবে। ইতিমধ্যেই সওয়ারি নামিয়ে দিয়ে থাকবে।
‘ননসেন্স।” তিনি বলে উঠলেন স্ট্রান্ড রোডে পদার্পণ করে। বলা উচিত চক্ৰাৰ্পণ। তারপর যখন ময়দান কেটে তাঁর মোটর হু হু করে এগোচ্ছে পার্ক স্ট্রীট অভিমুখে, তখন তিনি ড্রাইভার বেচারাকে হকচকিয়ে দিলেন হঠাৎ “ব্যাটা গাঁজা খেয়ে এসেছিল” বলে। চৌরঙ্গির মোড়ে যখন লাল সঙ্কেত দেখে মোটর থামল, তখন তিনি তার কাছে ক্ষমা চাইলেন।
বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে তাঁর ভবন। গাড়ি থেকে নেমেই আবার বলে উঠলেন, “আমি বিশ্বাস করিনে।” অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করেন না যে, এই ভবনে তাঁর মেয়াদ আর ছ’ মাস কি এক বছর। গৃহিণীকে তাঁর প্রথম সম্ভাষণ হলো, “গাঁজাখুরি।” অর্থাৎ তিনি যা শুনে এসেছেন সেটা গাঁজাখুরি।
“কী হয়েছে? ব্যাপার কী?” চিন্তিত স্বরে বললেন তাঁর সহধর্মিণী মনীষা।
আর্যকুমার লজ্জায় বলতে পারলেন না, এক গণৎকার বর্ধমানে কী তাঁকে শুনিয়েছে আর তা শোনা অবধি তিনি অন্য চিন্তা ত্যাগ করেছেন। কিছুতেই ঘাড় থেকে ও ভূত নামছেনা। লোকটা কি সম্মোহন জানে? জোচ্চোর কোথাকার!
“কিছুই হয়নি। মাথায় ঘুরছিল একটা কথা। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।” এই বলে তিনি তখনকার মতো স্ত্রীকে বুঝ দিলেন।
কিন্তু রাত্রে ক্লাব থেকে তাস খেলে ফেরার পরও তাঁর মুখ ছিটকে বেরিয়ে গেল, “ইনক্রেডিবল।” অর্থাৎ তাঁর প্রয়াণ আসন্ন এটা অবিশ্বাস্য।
মনীষার মনে খটকা বাধল। তাস খেলায় হেরে যাওয়া এমন কী অবিশ্বাস্য ঘটনা! তিনি জানতে চাইলেন, “কেন ও কথা বললে? তোমার অবশ্য হাত ভালো ছিল।”
আর্যকুমার যেন একটা অবলম্বন পেয়ে গেলেন। “হাত ভালো ছিল বলেই তো বলছি অবিশ্বাস্য। এত ভালো হাত আমার। হাত দেখে অন্যরকম ধারণা হতেই পারে না।”
এমনি করে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ধোঁকা দিলেন। ভাবলেন, কী দরকার বেচারিকে উদ্বিগ্ন করে তোলা। মেয়েরা যেমন সরলবিশ্বাসী, যে কোনো হতচ্ছাড়া গণৎকারের যে-কোনো অমূলক উক্তিকেই ওরা বেদবাক্য মনে করবে। মনীষা যদিও শিক্ষিত মহিলা তবু তিনিও এসব ক্ষেত্রে সরলা অবল। একবার এক সাপুড়ে তাঁকে একটা শিকড় গছিয়ে দিয়ে দশ টাকা নিয়ে চলে গেল। ওটা নাকি সাপের বিষের ওষুধ। ভাগনেটি বি এস-সি পাশ। সেও বোকার মতো আরো দশ টাকা দিয়ে দিল। তা হলে কিন্তু প্রমাণ হয় যে, ছেলেদেরও মাথায় হাত বুলোনো ঠিক তেমনি সহজ।
আর্যবাবুর দুই কন্যা। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ঝাড়া হাত পী। বিশেষ কোনো সাংসারিক চাপ নেই। স্ত্রীর জন্যে যথেষ্ট অন্ন-সংস্থান আছে। তা ছাড়া মনীষা কেবল নামেই মনীষা নন। ইচ্ছা করলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। সুতরাং নিছক সাংসারিক বিচারে আর্যকুমারের অকালপ্রয়াণ একটা সমস্যাই নয়।
তবু দেখা গেল তিনি সত্যি বিচলিত হয়েছেন। কাউকে বুঝতে দিলেন না কেন। নিজেকেও ভোলালেন। তাঁর যেখানে যতকিছু অ্যাসেটস ছিল, তার একটা তালিকা তৈরি করতে বসলেন গোপনে। যেখানে যতকিছু লায়াবেলিটিস ছিল, তারও আরেক তালিকা। দিনের পর দিন তিনি এই নিয়ে মগ্ন রইলেন। তাঁর কনফিডেন্সিয়াল ক্লার্ক সুনির্মলকে বললেন, “দেখ হে, নিজের সঙ্গে নিজের একটা হিসাবনিকাশ হয়ে থাকা ভালো। এসব তো আমি পরের জন্যে করছিনে। বাদসাদ দিয়ো না।”
নিজের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে যখন তাঁর যথার্থ জ্ঞান জন্মাল, তখন তিনি মনে বেশ শান্তি পেলেন। সকলের সব পাওনা চুকিয়ে দিয়ে মোটের মাথায় তাঁর যা উদ্বৃত্ত থাকে, তার থেকে দুই মেয়েকে দশ লাখ ও স্ত্রীকে দশ লাখ দেওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব। তবে তারা রাখতে জানলে হয়। কে জানে, কে কখন তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে সেই সাপুড়ের মতো দশ আর দশ মিলে বিশ লাখ টাকার হাতসাফাই দেখাবে। তাই তিনি তিনজনের নামে তিনটি বাড়ি তৈরি করে দেবেন স্থির করলেন। সেই নিয়ে চলল স্থপতিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ। জমির সন্ধান। মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা। অ্যাটর্নির বাড়ি আনাগোনা। কর্পোরেশনে তদ্বির। ঠিকাদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত।
তিনখানার দুখানা হবে ম্যানসন। বিভিন্ন পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হবে বহুসংখ্যক ফ্ল্যাট। একখানা হবে বিল্ডিংস। এক বা একাধিক সওদাগরি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হবে দীর্ঘ মেয়াদে। এত বড় কাণ্ডকারখানা, কেউ ঘুণাক্ষরে টের পাবে না, তা কি হয়! কনিষ্ঠ জামাতা গৌতম বলল কনিষ্ঠা কন্যা দূর্বাকে। দূর্বা বলল তার জননীকে।
মনীষা বরাবর স্বামীর বিশ্বাসভাজন। এ যদি সত্যি হতো স্বামী নিশ্চয় তাঁকে জানিয়ে তাঁর অনুমতি নিতেন। তিনি বললেন, “বাজে কথা। আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান নেই। বিজনেস থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে জমিতে পোঁতা মূর্খতা। গবর্নমেন্ট যেদিন খুশি নোটিশ দিয়ে অ্যাকোয়ার করবে।”
দূর্বা বলল, “কিন্তু কয়লার খনিও তো ওরা ন্যাশনালাইজ করতে পারে।”
মনীষা বললেন, “সে সাহস ওদের হবে না। তা হলে সাহেবদের কলিয়ারিও ন্যাশনালাইজ করতে হয়।হুঁ হুঁ। অত বড় বুকের পাটা আছে কার!”
কিন্তু একদিন একখানা দলিল দেখে মনীষা নিজেই ধরে ফেললেন, নন্দী সাহেবের ফন্দি। দলিলখানা তাঁর নামে হবে। তাঁকে সই করতে হবে।
তিনি রূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব হচ্ছে কী? ও কেন?”
আর্যকুমার মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলেন, “তোমারই স্বার্থে। আমার নয়।”
“তুমি তো জানো, বেনামী আমি পছন্দ করিনে। যা করবে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে করবে। লোকসান হয় হবে। চোরের মতো করতে যেও না। বাজারে তোমার সুনাম আছে, তুমি সৎ ব্যবসাদার। ঐ যে ক্রেডিট ওই তোমার সিকুইরিটি।”
আর্যকুমার কেমন করে ভেঙে বলেন যে, দলিলটা বেনামী নয়। তিনি হঠাৎ হার্ট ফেল করে মারা যেতে পারেন বলেই আগে থেকে সব আটঘাট বেঁধে রাখছেন, যাতে লেশমাত্র গোলমাল না হয়। নইলে কে জানে কে কখন মামলা বাধিয়ে বসবে। মেয়েমানুষ লড়তে পারবেন কেন? লড়তে গেলেও তো স্বর্ণলঙ্কা উজাড় হয়।
তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “আমাকে বিশ্বাস কর, আমি অসাধু কাজ করতে যাচ্ছিনে, তোমাকেও অসাধুতায় জড়াচ্ছিনে। মানুষের জীবন, কোনদিন আছে কোনদিন নেই। পঞ্চাশের পর সব মানুষেরই কর্তব্য—হেঁ হেঁ সব পুরুষেরই কর্তব্য—যাদের জন্যে ধন সঞ্চয় তাদেরই উপর তার ভার অর্পণ।”
“বাজে বকছ।” মনীষা রাগ করলেন এত দিন ধরে তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করা হচ্ছে বলে। লুকিয়ে লুকিয়ে করা কি সাধুতার পরিচায়ক?
ব্রাহ্ম মেয়ে বিয়ে করে এই দশা হয়েছে হিঁদুর ছেলের। উঠতে বসতে লেকচার আর বকুনি। শুধু কি তাই? কতবার যে ভদ্রমহিলা ছেড়ে চলে-যাবার ভয় দেখিয়েছেন তার সংখ্যা নেই। ফলে আর্যসন্তানকে সত্যি সাধু হতে হয়েছে। নইলে তাঁর ক্রোড়পতি হওয়া ঠেকাত কে? সেই সঙ্গে উপসর্গগুলিও এসে জুটত। মনীষা সেদিকেও পথ রোধ করে রয়েছেন। পার্টিতে বল, ক্লাবে বল, নাইট ক্লাবে বল, যেখানেই ইনি সেখানেই উনি। একদণ্ড চক্ষের আড়াল করবেন না। ছায়ার মতো অনুগতা হবেন। হতভাগ্য স্বামী।
আর্যকুমার একবার ভাবলেন, বর্ধমানের গল্পটা শুনিয়েই দেবেন। তার পর সে ভাবনা বাতিল করলেন। কেননা তাতে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। মনীষা বলবেন, ওসব বুজরুকি বিশ্বাস কর কেন? বিশ্বাস না করলে তো এসব করার প্রশ্ন ওঠে না।
আর্যবাবুও কি বিশ্বাস করতেন? না, তিনি যুক্তিবাদী সাহেবীভাবাপন্ন বিলেত-ফের্তা বিজনেসম্যান। কে একটা পেশাদার গণৎকার কী বলেছে শুনে তিনি বিশ্বাস করবেন? অথচ তাঁর কাজে ধরা পড়ছিল যে তিনি বিশ্বাস করেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে তর্কে তিনি ভঙ্গ দিলেন। খুলে বললেন না, কেন তিনি অমন কাজ করতে গেলেন।
কাজ কিন্তু বন্ধ রইল না। অ্যাটর্নির পরামর্শ নিয়ে দলিলও হলো। তার থেকে মনীষার নাম বাদ গেল। অগত্যা কন্যাদেরও নাম। খবরটা কনিষ্ঠা কন্যাই বয়ে নিয়ে এল মার কাছে। মনীষা এবার বিশ্বাস করলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে স্বামীর সঙ্গে বাক্যালাপ করলেন না। বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান করে জানতে পেলেন যে, খবরটা খাঁটি। তখন বাক্যালাপই করলেন না।
ঝড় ওঠার আগে অন্তরীক্ষ শান্ত হয়ে যায়। একটি পাতাও নড়ে না। একটি পাখিও ডাকে না। বেশ শীতল লাগে গরমের দিন। আর তার পরে? তার পরেই তাণ্ডব। মাথার উপর ডাল ভেঙে পড়ে, ঘর ভেঙে পড়ে। ভাঙনের আওয়াজকে, প্রাণীদের চিৎকারকে ছাপিয়ে ওঠে ঝড়ের গর্জন।
আর্যকুমার অভিজ্ঞ স্বামী। তাঁর হাড়ে হাড়ে বরফের ছোঁয়া লাগল। আসন্ন মরণের চেয়েও তাঁকে ভাবিয়ে তুলল আসন্ন সাইক্লোন। কী করবেন, কী করতে পারেন তিনি? খুলে বলবেন স্ত্রীকে বর্ধমানের ব্যাপার? কিন্তু তার পরিণাম যদি আরো ভয়ঙ্কর হয়? “বাজে কথা” বলে দাবড়ি দেবেন গিন্নি। ভেস্তে যাবে ইমারত তৈবির আয়োজন। তখন যদি ঐ ব্যাটা গণৎকারের কথাই ফলে যায়, যদি করোনারি থ্রম্বোসিস কি হাই ব্লাড প্রেসার হয়, স্ত্রী কন্যাদের ঠগের হাতে সঁপে দিয়ে যেতে হবে। তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পথে দাঁড়ালে কি তাঁর আত্মা পরলোকে শান্তি পাবে?
সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন নন্দী। বলতে গিয়ে অবশ্য কয়েকবার ঢোক গিলতে হলো। ভণিতাও করলেন তিনি প্রায় আধ ঘণ্টা।
“আমি পরকাল মানিনে, পরলোকে বিশ্বাস করিনে। তবু যদি পরলোক থাকে। আমি ঈশ্বর মানিনে, আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করিনে। তবু যদি মৃত্যুর পর আত্মা থাকে। আমি দেহবিচ্ছিন্ন অশান্তি কখনো অনুভব করিনি, অনুভব করা সম্ভব মনে করিনে। তবু যদি আত্মা অশান্তি ভোগ করে। বুঝলে, মণি। আমার যখন উপায়ান্তর আছে, তখন কেন আমি এ ঝুকি ঘাড়ে করে মরি? কেন একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে যাইনে? তা হলে তোমরাও নিশ্চিন্ত, আমিও নিশ্চিন্ত।”
মনীষার উত্তর হলো, “বেশ বানিয়ে বলতে পারো কিন্তু। রামমোহনের আগে জন্মালে তুমি আমার সহমরণের পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে। তাতে তুমিও নিশ্চিন্ত আমিও নিশ্চিন্ত, তোমার মনে কী আছে, বলব? তুমি চাও না যে আমি আবার বিয়ে করি।”
“আরে, ন্ ন্ ন্ ন্ না—আ! আরে, না, না, না—আ! আমি কি স্বপ্নেও কখনো ভেবেছি যে, তুমি আবার—ছি ছি ও কথা মুখে আনতে নেই।” জিব কাটলেন আর্যপুত্র।
“হ্যাঁ গো, হ্ঁহঁহ্ঁ,হাঁ —আ। আমি তোমার আত্মার অন্তস্থল অবধি দেখতে পাচ্ছি। তোমার কি ধারণা যে, আমার বিয়ের বয়স চলে গেছে? কেউ বিয়ে করবে না আমাকে?” এই বলে আর্যা এমন এক কটাক্ষ হানলেন যাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল।
নন্দী সত্যি মনে করে চমকে উঠলেন। বললেন, ‘ছি ছি, মণি, তুমি কখনো পারে। অমন কাজ? কেন তবে অমন কথা মুখে আনলে?”
“তা তোমাকে কে মাথার দিব্যি দিয়ে সাধছে এই বয়সে ইহলোক ত্যাগ করতে? কার মগজে এ চিন্তা উদয় হয়েছে, বল? তোমার না আমার? গণৎকার কিছু দক্ষিণা আশা করেছিল, তা না হলে ওর পেট চলবে কেন? ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে, তুমি অন্যমনস্ক, তোমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, বেশী সময় নেই, যা দেবেন তা জলদি দিয়ে দিন। নোটখানা তুমি ওর হাতে না দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলে কেন? ওরও তো মানসম্ভ্রম আছে। ও কি অত লোকের সামনে উপুড় হয়ে ভিখিরিদের মতো পয়সা কুড়োবে নাকি? ট্রেন ছেড়ে দিলে তখন যেমন করে হোক তুলে নেবে। তিলকে তাল করতে তোমার জুড়ি নেই। অকারণে কষ্ট পাচ্ছ এই ক’ মাস। কলকাতা শহরে কি জ্যোতিষীর লেখাজোখা আছে? তাদের একজনকে শতখানেক টাকা ধরিয়ে দিলেই তোমার আশি বছর পরমায়ুর গ্যারান্টি পেতে পারতে। চাও তো কালকেই নিয়ে যেতে পারি, তোমার যার উপর আস্থা, তার কাছে।”
আর্যকুমার বুঝলেন সবই, কিন্তু তাঁর মন মানল না। গণৎকারের উক্তির একমাত্র ব্যাখ্যাই ঠিক। আর সব বেঠিক। কিন্তু স্ত্রীকে বোঝানো শক্ত। আরেক ব্যাটা জ্যোতিষীর কাছে গেলে সেও তাই বলবে। মনটা আরো খারাপ হয়ে যাবে। ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়? তিনি বেঁকে বসলেন। বললেন, “কাজ কি কেঁচো খুঁড়ে?”
এবার মনীষার চাপান। “তা হলে চল কাল তোমাকে পি জি’তে দিয়ে আসি। সেখানে তোমার একটা থরো চেক-আপ হয়ে যাক। আর যদি হাসপাতালে থাকতে না চাও বল, বাড়িতেই ব্যবস্থা করি। তোমার স্বাস্থ্য বরাবরই ভালো, তবু যখন কথাটা উঠেছে তখন তোমার মনোবল অটুট রাখার জন্যে একটা ভালোরকম পরীক্ষা দরকার। রোগের জড় ধরা পড়লে এখন থেকেই সাবধান হওয়া যাবে। সাবধানের মার নেই। ক্ষতিটা কী?”
আর্যকুমারের উতোর। “লাভটাই বা কী? ডাক্তার বলবে সাবধান হতে। হব সাবধান। কিন্তু তুমি কি ঠিক জান, সাবধানের মার নেই? যেমন সাবধানের মার নেই তেমনি মারেরও সাবধান নেই। কথাটা আমার নয়। তোমাদেরই গুরুদেবের।”
মনীষা শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী। এককালে কলাকুশলা ছিলেন। সুদর্শনা তো এখনো রয়েছেন। তাঁর মুখ বন্ধ করে দিতে হলে গুরুদেবের কোটেশনই যথেষ্ট।
তিনি তর্ক করলেন, “গুরুদেবের নয়। তাঁর দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের।”
“তা হলে তো আরো গুরুতর।”
এর পর মনীষা দেবী বললেন, “দেখ, তোমার ওটা একটা ফিকসেশন। মানসিক চিকিৎসা না করলে সারবে না। কিন্তু তাতেও তোমার আপত্তি হবে। আমি এখন তোমাকে নিয়ে করি কী? তোমাকে যদি ওই সব করতে দিই তা হলে যেই ওসব সারা হয়ে যাবে অমনি তুমি নিষ্কর্মা হবে। তোমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করবে না। তখন তুমি যে জিনিসটিকে ভয় কর সেই জিনিসটি ঘটবে। তুমি ভাববে, গণৎকারের কথা ফলল। আমি ভাবব, তোমার অবিবেচনার ফল ফলল। তুমি কি মনে কর আমি তোমার টাকা চাই? আমি তোমাকেই চাই। যাকে বিয়ে করেছি সেই যদি না থাকল তবে আমি কাকে নিয়ে থাকব? মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে কি থাকতে পারি?”
“সব বুঝি, মণি। সব বুঝি। কিন্তু আমি যে মনঃস্থির করে ফেলেছি।”
“তা হলে আমাকেও মনঃস্থির করতে দাও। তুমি যখন আত্মহত্যা করবে বলেই বদ্ধপরিকর তখন আমিও দুদিন আগে থাকতে মুক্ত হই। তুমিও আমার স্বামী নও, আমিও তোমার স্ত্রী নই। তারপর তোমার সম্পত্তি তুমি যাকে খুশি লিখে দিয়ে যাও। আমি বলবার কে?”
আর্যবাবু হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। “তার মানে কী, মনীষা? তার মানে কী? কেন তুমি অমন কথা মুখে আনলে? আমি কি কোনো দিন অবিশ্বাসী হয়েছি? কোনো দিন অন্য নারী কামনা করেছি? কেন আমার যাবার আগে আমাকে এত বড় একটা দাগা দিতে চাও? আমাকে শান্তিতে যেতে দাও, মণি। আমি যে বড়ই বেদনা পাচ্ছি। তুমি সে বেদনায় প্রলেপ মাখাবে, না জ্বালা ধরিয়ে দেবে? সবই তো তোমার ও তোমাদের চেতনা লুপ্ত হবার আগে তোমাদের ধন তোমাদের হাতে দিয়ে আমি নিধিমুক্ত হতে চাই। ”
২
একদিন আপিস থেকে ফিরে আর্যকুমার দেখলেন, মনীষা বাড়ি নেই। কেউ বলতে পারল না, তিনি কোথায় গেছেন ও কখন ফিরবেন। একা একা চা খেলেন। তারপর একে একে টেলিফোন করলেন। “মা? না, মা তো এদিকে আসেননি।” উত্তর পেলেন একে একে। তারপর আরো কয়েক জায়গায় টেলিফোন করলেন। “মিসেস নন্দী? না, মিসেস নন্দী তো এখানে নেই।” হদ্দ হলেন আর্যবাবু। হাল ছেড়ে দিয়ে ডাইভানে গড়িয়ে পড়লেন।
সেদিন সিনেমায় শোপ্যাঁর জীবনচরিত। অভিনয় করবেন পল মুনি। উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত হবে। কথা ছিল দু’জনে একসঙ্গে বেরোবেন। একসঙ্গে বসে ছবি দেখবেন। বাজনা শুনবেন। নয়ন ও শ্রবণ পরিতৃপ্ত হলে রসনার পরিতৃপ্তির জন্যে হোটেলে যাবেন। আগে থেকেই রিজার্ভ করা হয়েছে সিনেমার বকস্, হোটেলের টেবিল। কন্যা ও জামাতারাও যোগ দেবে।
একা একা যাওয়া যায় না। অস্থির হয়ে উঠলেন আর্যকুমার। গোসল করে ড্রেস করতে গেলেন এই ভেবে যে, ইতিমধ্যে মনীষা এসে তাড়াহুড়ো বাঁধিয়ে দেবেন ঠিক। ওরকম আগেও হয়েছে। মনীষার ধারণা, তৈরি হতে পুরুষরাই বেশি সময় নেয়। নেহাত ভুল নয়। দাড়ি কামানোর বালাই তো মেয়েদের নেই। তারপর ইংরেজি মতে ড্রেস-শার্ট পরতে যে কসরৎটা করতে হতো সেটা ইদানীং চুড়িদার পায়জামা চড়াতে গিয়ে হয়। বেয়ারার সাহায্য তাতে অপরিহার্য ছিল না, এতে অপরিহার্য। কী কল বানিয়েছে জবাহর কোম্পানি। খামোকা এই গরমে কালো শেরোয়ানি চাপিয়ে নিজের গলা টিপে নিজেকে মারতে হবে। না পরলে নয়। নন্দী হলেন জাতীয়তাবাদী বণিক।
না। মনীষার ফেরবার লক্ষণ নেই। তিনি কি তবে সরাসরি সিনেমায় গেছেন? সেইখানে দেখা হবে। হতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু এমন যদি হয় যে, আর্যকুমার সিনেমায় গেলেন আর তার পরেই মনীষা বাড়ি ফিরলেন, তখন? কী সমস্যা, বলুন দেখি! এর কী সমাধান আছে খুঁজে পাওয়া দায়। টিকিটগুলো আর্যকুমারের কাছে। সেগুলো তিনি গাড়ি করে ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “মেমসাহেব যদি পৌছে থাকেন আমাকে এসে নিয়ে যেও। আর নয়তো এমনি ফিরে এসো খবর নিয়ে।”
মনীষা সে রাত্রে বাড়ি ফিরলেন না। সিনেমাতেও তাঁকে পাওয়া গেল না। কখনো এ রকমটি হয়নি। তবে কি তিনি রাগ করে বাপের বাড়ি গেছেন? টেলিফোনে উত্তর এলো, “কই, না?” পুলিস কমিশনার ছিলেন নন্দীর বন্ধু। তাঁকে রিং করতে হলো। তিনি বললেন, “অ্যাকসিডেন্ট হয়ে থাকলে এতক্ষণে আমরাই আপনাকে জানাতুম। আর কোনো থিয়োরি আপনার পক্ষে সম্মানের নয়। সুতরাং ধৈর্য ধরুন। শুতে যান।”
দুর্দিনের রাত পোহাতে চায় না। রাতভর অনিদ্রা। সকালে নিজের লোক পাঠিয়ে চার পাঁচখানা খবরের কাগজ আনিয়ে নিলেন। কাগজ হরকরার জন্যে সবুর সইল না। তন্ন তন্ন করে পড়লেন। কোথাও মনীষার বা সে রকম কারো উল্লেখ নেই। আশ্বস্ত হলেন। তা হলে দুর্ঘটনা নয়। অন্তত একটা থিয়োরি বর্জিত হল। কলকাতা শহরে আশেপাশে যতগুলো মেন্টাল হোম ছিল প্রত্যেকটাতেই গোপনে গোপনে সন্ধান করলেন তিনি। কোনো ফল হল না। তা হলে আরেকটা থিয়োরি বর্জন করতে হয়।
মানুষটা তা হলে গেল কোথায়? শূন্যে মিলিয়ে গেল? আর্যবাবু এর রহস্যভেদ করতে পারলেন না। অসহায় বোধ করতে লাগলেন। আবার পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন। কেউ বে-আইনীভাবে আটক করে রাখেনি তো? আমেরিকার মতো নিষ্ক্রয় চায়। পুলিশ কমিশনার বললেন, “এ দেশে ওরকম হয় না। আপনি ধৈর্য ধরুন। আপিসে যান।” এখন বাড়ির চাকরদের তিনি বোঝাবেন কী? মিছে কথা বলতে হয়। মেমসাহেব গড়পারে তাঁর বাপের বাড়ি গেছেন। দাদার অসুখ। কবে ফিরবেন কিছু ঠিক নেই।
কিন্তু মেয়েরা যখন টেলিফোনে খবর নেয় তখন মিছে কথা বলতে পারেন না। গলাটা কেঁপে যায়। ওরাও উৎকণ্ঠিত। দূর্বা তো সশরীরে এসে উপস্থিত হলো বাড়িময় বেশ করে খুঁজে দেখতে। কে জানে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছেন কি না।। বড় বড় আলমারি খুলে ঝোলানো কোটে টান দেয়, খাটের তলায় উঁকি মারে। স্নানের ঘর তো এমনিতেই খোলা পড়ে আছে। বক্স রুম তো বাইরে থেকে তালাবন্ধ। তবু সে-সব ঘরও তল্লাস করা হয়। চাকরদের চোখে ধূলো দেওয়া শক্ত। সব জানাজানি হয়ে যায়। বড় মেয়ে পুষ্প এসে অনর্থ বাধায়। চাকরদের ধমকায়। আবার বকশিসের লোভও দেখায়। একই মুখে নরম গরম। চাকররাও একজন আরেকজনকে শাসায়। আবার খোসামোদও করে।
খবরটা আরো ছড়ায়। পড়শিদের কানে পৌঁছয়। আর্যবাবুর লজ্জার পরিসীমা রইল না। প্রতিবেশিনীরা এসে উদ্বেগ জানিয়ে যান। প্রতিবেশীরা কৌতুহল। ইলোপমেন্টের মতো শোনায় না। বয়স যে চল্লিশের ভুল দিকে। তা সত্ত্বেও কারো কারো চোখে সন্দিগ্ধ চাউনি। আর্যবাবুর মর্মে বেঁধে। তিনি লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দেন। মদ। মদ ছাড়া মানুষের বন্ধু কে আছে।
এই পরিস্থিতিতে যা কিছু করা সঙ্গত ও সম্ভব সমস্তই করা হলো। কিন্তু নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান মিলল না। সকলেই ধরে নিল যে, তিনি কলকাতায় নেই, পশ্চিমে বা দক্ষিণে চলে গেছেন। সর্বত্র চিঠি লেখা হলো, দূত পাঠানো হল। তবে কাগজে ছবি ছাপানো হল না, বিজ্ঞাপন দেওয়া হল না। আত্মহত্যার থিয়োরি ধরেও নদীনালা অন্বেষণ করা হলো। তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না।
বাড়ির সরকারমশায়—নেপালবাবু তাঁর নাম—একদিন সবিনয়ে নিবেদন করলেন, “সার, সবই তো একে একে করা গেল। কোনো ফল হল কি?”
“না। সব নিস্ফল।” নিপ্রাণভাবে সাড়া দিলেন আর্য।
“সার, আপনি তো কিছু মানবেন না। আপনাকে ভয়ে বলি কি নির্ভয়ে বলি?”
“নির্ভয়ে বলুন।”
তখন নেপালবাবু প্রস্তাব করলেন, “এবার নখদর্পণ করলে কেমন হয়?”
“নখদর্পণ!” বিস্মিত হলেন নন্দী। “সে আবার কী!”
সে যে কী জিনিস তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ময়মনসিং জেলা থেকে এক মুসলমান এলো, তার সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে। বয়স আট-দশ হবে। কলকাতা শহর সে এর আগে দেখেনি, যেটুকু পথে পড়ে সেইটুকুই তার দেখা। হাওড়ার পোল, হাওড়া স্টেশনের দালান, খড়গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, পুরীর মন্দির, পুরীর সমুদ্রতীর, সিংহাচলমের পাহাড়, এসব কোনো দিনই তার চোখে পড়েনি, পড়ার কথা নয়। তার মাথায় আসতে পারে না, তার কল্পনার অতীত। এক হতে পারে, তার বাপের হিপনোটিক ক্ষমতা তার ওপর ভর করেছিল। বাপের মনের কথাই তার মুখে ফুটছিল।
“কী দেখতে পাচ্ছ?” প্রশ্ন করলেন আর্যবাবু।
মেয়েটি তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখের ওপর দৃষ্টি রেখে উত্তর দিল, “একটা মেয়েলোক।”
“কী রকম দেখতে?” জেরা করলেন তিনি।
“খুব সুন্দর দেখতে।” মেয়েটি একটু বর্ণনাও করল।
“কত বয়স? বিশ একুশ বছর?”
“না। আরো বেশি।”
“ত্রিশ বত্রিশ?”
“আরো বেশি।”
“চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ?”
“হবে। একটা বাস গাড়ি।” মেয়েটি যেন দেখতে পাচ্ছিল সামনে।
“বাস গাড়ি? ট্রামগাড়ি নয়?” আবার তেমনি জেরা।
“না। এঁকে-বেঁকে চলে। একটা পোল। দু’দিকে নদী।” বর্ণনা দিল মেয়েটি।
এইভাবে চলল অনেকক্ষণ। আর্যবাবুর প্রশ্ন আর মেয়েটির উত্তর। মেয়েটির উত্তর যে সরকারমশায়ের শেখানো নয় কিংবা এ বাড়ির আর কারো, সেবিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন আর্য। কিন্তু একটা তথ্য তিনি লক্ষ করলেন। মেয়েটি প্রত্যেকবার উত্তর দেবার আগে বাপের দিকে তাকায়। যেন মনে মনে শুধায়, এবার কী জবাব দেব, বাপজান? অথচ বাপের চোখে মুখে কোনও রকম ইশারা বা ইঙ্গিত নেই। লোকটি সমানে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে।
পাহাড়ের বর্ণনার পর মেয়েটি হাল ছেড়ে দিল। বাপ বলল, “হুজুর, ও আজ কিছু খায়নি। আর পারছে না। ওকে ছুটি দিতে মেহেরবানী হোক।”
“আচ্ছা, পরে আবার হবে”, বলে সেদিনকার মতো নন্দী সাহেব উঠলেন।
পরের দিন তাঁর অভিপ্রায় ছিল লোকটাকে অন্যত্র সরাবেন। তারপর মেয়েটিকে প্রশ্ন করবেন। নতুন সব গোপনীয় প্রশ্ন। যথা, আর কেউ ছিল কি? আর কোনো মেয়েলোক? আর কোনো মরদলোক? কেমন দেখতে? কত বয়স?
কিন্তু সরকারমশায় এসে খবর দিলেন যে, মেয়েটি মাকে ছেড়ে থাকতে পারছিল না। বড় কান্নাকাটি করছিল। তার বাপ তাকে নিয়ে কাল রাত্রেই দেশে ফিরে গেছে।
আপদ গেছে। জীবনে কোনো দিন যা বিশ্বাস করেননি সেই জ্যোতিষী-গণনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একে তো এই বিপত্তি। এখন নখদর্পণের প্রভাবে হয়তো স্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করবেন। যা জীবনে কোনো দিন করেননি।
আর্যকুমার কিন্তু অকস্মাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। তিনি তাঁর নিরুদ্দিষ্টা পত্নীর অনুসরণ করবেন। মেয়েদের ডেকে বললেন, “আমি নিজেই খোঁজ করতে চললুম। খোঁজ না পাওয়া অবধি ফিরব না। এ বাড়ির ভার রইল তোমাদের ওপরে। আপিসের ভার ম্যানেজারের ওপরে।”
বাড়ি থেকে কখন যে তিনি বেরিয়ে গেলেন কেউ দেখতে পেল না। দুপুরের পরে তখন চাকরবাকর আউটহাউসে শুয়ে বিশ্রাম করছে। গেটে অবশ্য দারোয়ান ছিল। কিন্তু তাকে তিনি সিগারেট কিনতে পাঠিয়েছিলেন। ড্রাইভার গাড়িবারান্দায় গাড়ির ভিতরে শোবার জায়গা করে নিয়েছিল। সাহেবকে সে টিফিনের পর আপিসে ফের নিয়ে যাবে। কেন যে তাঁর দেরি হচ্ছিল সে বুঝতে পারছিল না। ঝিমচ্ছিল।
“সর্দার ভাই।” দারোয়ান বলল বড় বেয়ারাকে। “সাহেবকে তো ডেকে সাড়া পাচ্ছিনে।”
বেয়ারা তাড়াতাড়ি মাথায় পাগড়ি দিয়ে ছুটল। ড্রাইভার বলল, “আমিও তো ডেকে সাড়া পাচ্ছিনে।”
না। সাহেব কোথাও নেই। সর্দার অতি পুরাতন ভৃত্য। সে সব দেখেশুনে বলল, “সাহেব তো কিছুই নিয়ে যাননি। খালি হাতে গেছেন। তাঁর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি আর কাবুলি জুতো, কোথাও বেড়াতে গেছেন। একটু বাদে ফিরবেন।”
আহা, সেই ময়মনসিংহের মেয়েটি সেখানে ছিল না। থাকলে তার নখদর্পণে দেখতে পেতো— একটা লোক। না, মেয়েলোক না, মরদ লোক। দেখতে ডাগর। দোহারা। বয়স? না, বিশ একুশ না। ত্রিশ বত্রিশ না। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ না। আরো বেশি। একটা বাস গাড়ি। না ট্রামগাড়ি না। এঁকে বেঁকে চলে। একটা পোল। মস্ত বড় পোল। দুধারে নদী। না, মস্ত বড় নদী না। নদীতে ইস্টিমার। ঢের ঢের ইস্টিমার। একটা দালান। খুব বড় দালান। খুব বড় ঘড়ি। একটা রেলগাড়ি। আরেকটা রেলগাড়ি। আরো একটা রেলগাড়ি। রেলগাড়ি চিকরাচ্ছে। হুস্ হুস্। হুস্ হুস্। অনেক লোক। অনেক, অনেক লোক। রেলগাড়ি চলছে। চলছে, চলছে। অন্ধকার। বেবাক অন্ধকার। রেলগাড়ি চলছে। মানুষ ঢুলছে। অন্ধকার। ফরসা। পদ্মা। পদ্মা। বাঁ দিকে পদ্মা। বেবাক পানি। ডান দিকে পাহাড়। পাহাড়। ঢের ঢের পাহাড়। ইস্টিশন। রেলগাড়ি দাঁড়িয়ে।
সিংহাচলমে গিয়ে আর্যকুমার মনীষার সন্ধান করলেন। যা ভেবেছিলেন তাই। বর্ণনা শুনে পাণ্ডারা বলল, “হাঁ, হাঁ, সেই রকম একজনকে দেখেছিলুম বটে।” কিন্তু কবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ। কেউ বলে, এক মাস আগে। কেউ বলে, এক সপ্তাহ আগে। তিনি তৎক্ষণাৎ সিংহাচলম ত্যাগ করলেন।
মাদ্রাজ গিয়ে প্রথমে পার্থসারথি মন্দির। তারপর কপালেশ্বর মন্দির। যা মনে করেছিলেন তাই। বর্ণনা শুনে পাণ্ডারা বলল, “হাঁ, হাঁ, সেই রকম একজন এসেছিলেন বটে।” কিন্তু কবে ঠিক বলতে পারল না। কালবিলম্ব না করে আর্যবাবু পক্ষিতীর্থ অভিমুখে ছুটলেন। সেখানে দুটি সাদা চিলের আবির্ভাবের পূর্বেই তাঁর অন্তর্ধান ঘটল। কারণ সেই একই। তারপর পণ্ডিচেরি তিরুবান্নামালাই, তিরুপতি, কাঞ্চীপুরম, তাঞ্জোর, তিরুচিরাপল্লী, শ্রীরঙ্গম, মাদুরা, রামেশ্বর, ধনুকোষ্টি, কুমারিকা— যেখানেই যান সেখানেই খবর পান, হাঁ হাঁ, সেই রকম একজনকে দেখা গেছে বটে, কিন্তু কবে তা ঠিক মনে নেই।
এতগুলো লোক যা বলছে তা কি বিলকুল মিথ্যা? নিশ্চয় এসেছিলেন মনীষা। যিনি এসেছিলেন তিনি আর কোনো বাঙালির মেয়ে নন। আর কারো বর্ণনা তাঁর সঙ্গে মেলে না। বাংলাদেশে আর কোন্ মহিলা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও তন্বী, ক্ষীণমধ্যা, ঘনকুন্তলা? খোঁপায় ফুলের মালা জড়াতে আজকাল অনেক বাঙালির মেয়েকেই দেখা যায়, কিন্তু মাথায় তেল দেয় না এমন একজনও নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম মনীষা। সেইজন্যে তাঁর চুল অমন কটা। আর চুল অমন কটা বলেই তো পাণ্ডাদের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। আর পাণ্ডারা ধরিয়ে দিল আর্যকুমারের কাছে। এখন হাতে-নাতে ধরতে পারলে হয়।
অত বড় একটা ম্যারাথন দৌড়ের পর আর্যবাবুর শ্রান্ত হবার কথা। কিন্তু জীবনে তিনি কোনো দিন শ্রান্তি মানেননি। তাঁর জীবনটাই একটানা একটা ম্যারাথন। লক্ষ্মীর পশ্চাতে। এবার তিনি ধাবমান গৃহলক্ষ্মীর পশ্চাতে। তিনি দম নিতে বসলে মনীষা কি আরো এগিয়ে যাবেন না? একেবারে হাতছাড়া হবেন না? তা হলেই হয়েছে!
কিন্তু পশ্চাদ্ধাবন করবেন যে, দক্ষিণ মুখে না উত্তর মুখে? দক্ষিণ দিকে সিংহল। উত্তর দিকে কেরল। কে জানে মনীবা কোন দিকে গেছেন! যদি উত্তরে গিয়ে থাকেন তবে দক্ষিণে যাওয়া বৃথা। আর যদি দক্ষিণেই গিয়ে থাকেন তবে উত্তরে যাওয়া নিরর্থক। আর্যকুমার জনে জনে শুধালেন কেউ তাঁকে দিশা দিতে পারল না। তিনিও মনঃস্থির করতে পারলেন না। দিনের পর দিন ভারতের শেষ স্থলবিন্দুটিতে গিয়ে পদচারণ করলেন। পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর, দক্ষিণে ভারতমহাসাগর। তিন দিক থেকে তিন সাগরের ঢেউ এসে একই স্থানে ভেঙে পড়ছে। অথচ মিশে যাচ্ছে না। অপূর্ব! অপূর্ব!
সমুদ্রের বক্ষে অগণিত শৈল। তার একটিতে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে কত লোক যায়। আর্যবাবুও যান। বঙ্গোপসাগরে সূর্যোদয়। আরব সাগরে সূর্যাস্ত। অপরূপ! অপরূপ! যতবার দেখেন ততবার দেখতে সাধ যায়। আর্যকুমার তো জগৎজোড়া সৌন্দর্যের দিকে কখনো ভুলেও দৃষ্টিপাত করেননি। এখন সে যেন তার প্রতিশোধ নিল। অপ্রতিরোধ্য সে আকর্ষণ। আগেই তিনি দিশাহারা হয়েছিলেন মনীষাকে না পেয়ে। নতুন করে দিশাহারা হলেন তিন সাগরের রঙ্গ দেখে। এক সাগরে উদয়লীলা অন্য সাগরে অস্তলীলা দেখে।
পিছুটান তাঁর এর মধ্যেই ঢিলে হয়ে এসেছিল। কলকাতার কথা মনে পড়ে বইকি, কিন্তু ফিরে যেতে রুচি হয় না। বাড়ি বানানোর হুকুম দিয়ে এসেছিলেন। হুকুম তামিল হচ্ছে কিনা জানতে আগ্রহ নেই। কার জন্যে বাড়ি? তাঁর নিজের জন্যে তো নয়। যার জন্যে সে কোথায়! বিজনেস কেমন চলছে খবর নিতেও তাঁর কৌতূহল ছিল না। ফেল করার মততা কারবার নয়। চালু থাকবেই। নেহাত চুরি-চামারি না হলেই হলো। ইউরোপীয়ান ম্যানেজার ও-জিনিস করবে না।
কন্যাকুমারীর মূর্তি অবলোকন করাও নিত্য কর্ম হয়েছিল। একদিন সেই মূর্তির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখের উপর থেকে একটা পর্দা সরে গেল। তিনি প্রত্যক্ষ করলেন, এই নারীতেই আছে সেই নারী।
এর পরের ইতিহাস লালাবাবুর অনুরূপ। দেশ থেকে লোকজন এলো তাঁকে নিতে।
“কর্তা, আপনি বাড়ি ফিরে যাবেন না?”
“না। এখানে আমি আনন্দে আছি। সেখানে গেলে দুঃখ পাব।”
তাঁর মেয়েরা এলো তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে। তিনি ধরা দিলেন না। বললেন, “ফেরাটা আসল কথা নয়। পাওয়াটাই আসল। এখানে পাচ্ছি। ওখানে পাব না। কাজেই যাব না। যদি পাই, যাব।”
ভিতরে ভিতরে তাঁর আশঙ্কা ছিল যে, সময় বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে। গণৎকারের উক্তি মিথ্যা নয়। কিন্তু কিছুকাল পরে তিনি অনুভব করলেন যে, তাঁর ভয়ডর চলে গেছে। তখন গণৎকারের কথা বিশ্বাস করেছিলেন ভেবে তাঁর হাসি পেলো। পাঁচজন আলাপীকে নিয়ে তাঁর সময় কেটে যায় কে জানে কোনখান দিয়ে। সময়ের হিসাব রাখতেও তাঁর সময় নেই। জানবেন কী করে সময় বেশি না সময় কম?
মনীষার অন্বেষণ কি তিনি ছেড়ে দিলেন? না, অন্বেষণ চলছিল অবিরাম; কিন্তু মানচিত্র ধরে মাটির ওপর নয়। ঘড়ি ধরে সময়ের ভিতরে নয়। কেন, তাড়া কিসের? তিনি কি দু’ মাস পরেই মরছেন যে তাঁকে মরি কি পড়ি করে ছুটতে হবে? যারা সময়ের সুমারি রাখে, ঘড়ি ধরে পথ চলে, তারা অন্বেষণের কী জানে!
শান্তিতে ছিলেন আর্যকুমার। কোথাও যাবার তাড়া নেই। কিছু একটা করবার তাগিদ নেই। সারা জীবনে এই প্রথম সত্যিকারের ছুটি। দেশ থেকে চিঠি আসে। কেউ তাঁর জন্যে বসে নেই। কিছুই তাঁর জন্যে বসে নেই। এর চেয়ে সুখবর আর কী হতে পারে! আগে যে মনে হতো, তাঁর অবর্তমানে সবাই উচ্ছন্ন যাবে, সব বরবাদ হবে, এ কথা ভেবেও তাঁর হাসি পায়।
মেয়েরা জোর করে একটি চাকর পাঠিয়েছিল তাঁর কাছে থাকতে ও তাঁর সেবা করতে। বিপিন তার নাম। সে একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাবু! টৈলিগ্রাম।”
টেলিগ্রামখানা অশুভসূচক নয় তো? খুলতে গিয়ে আর্যবাবুর হাত কাঁপছিল। খুলেই তিনি বিপিনকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন। নইলে পড়ে যেতেন।
মনীষার টেলিগ্রাম। উনি মঙ্গলবার পৌঁছবেন।
বার বার পড়ে তৃপ্তি হল না। মুখস্থ হয়ে গেল পাঠাবার তারিখ, ঘণ্টা, মিনিট, ডাকঘরের নাম। হিসাব করে দেখা গেল, মঙ্গলবার পৌছতে হলে কলকাতা থেকে রেলপথে নয়, আকাশপথে আসতে হবে মাদ্রাজ। তারপর রেলপথে। বাকিটুকু মোটরে। আর্যবাবুর আর ত্বর সইছিল না। তিনি এক ভদ্রলোকের অনুগ্রহে তাঁর মোটরে লিফট পেয়ে নিকটতম রেলস্টেশনে চললেন। পঞ্চান্ন মাইল দূরে।
মনীষা তাঁর স্বামীকে পথ ফুরোবার আগে তিরুনেলবেলি স্টেশনে প্রত্যাশা করেননি। প্রথম চমকটা তাঁরই।
দু’জনেই নির্বাক। সাশ্রুনেত্র। উদ্বেল হৃদয়। মন্থরচরণ। অন্যমনস্ক।
প্রাণ খুলে কথা বলার অবসর যখন হলো তখন দুজনে দুজনকে শোনালেন গত সাত মাসের বৃত্তান্ত। সাতটা মাস তো নয়, সাতটা বছর। না শতাব্দী?
মনীষা কলকাতা শহরেই ছিলেন গা ঢাকা দিয়ে। এক গুজরাতি পরিবারে গভর্নেস হয়ে। তাঁদের কাছে তিনি পাটনার সাবিত্রী সিনহা।
“এত নাম থাকতে সাবিত্রী কেন?”
“কেন?” মনীষা বলবেন কি বলবেন না করতে করতে বলে ফেললেন, “আমি যে সাবিত্রীর মতো প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, তোমাকে যমের অধিকার থেকে ফিরিয়ে আনব। একালের সাবিত্রীর পদ্ধতি সেকালের সাবিত্রীর মতো নয়। তোমাকে অত বড় একটা শক না দিলে তোমার মরণপ্রস্তুতি বাধা পেত না। তোমাকে অমন করে না ঘোরালে তোমার অন্য দিকে মতি যেত না।”
“ঘোরানোর মূলে তো নখদর্পণ?”
“নখদর্পণের মূলে আমি। সরকারমশায় আমারই লোক।”
নন্দী অবাক হলেন। “বল কী! নেপালবাবু সমস্ত জানতেন, অথচ আমাকে জানান নি? এমন নেমকহারাম কি দুটি আছে।”
“না। অমন পরম বান্ধব দুটি নেই। কাউকেই তিনি জানতে দেননি। মেয়েদেরও না। জামাইদেরও না।প্রতি সপ্তাহেই আমাকে তোমার খবর পাঠাতেন গোপনে।”
“প্রতি সপ্তাহেই!” বিশ্বাস করলেন না আর্য। “সিংহাচলম, মহাবলিপুরম, এসব জায়গার খবর তিনি কার কাছে পাবেন যে তোমাকে পাঠাবেন?”
“কেন, তুমিই তো আপিসে টাকার জন্যে টেলিগ্রাম করতে। একসঙ্গে বেশি টাকা চাইতে না। কিন্তু চাইতে নতুন নতুন জায়গা থেকে। আমি তো ভেবেছিলুম কুমারিকায় তুমি তিন চার দিনের বেশি থাকবে না । হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস থাকলে দেখে ভাবনায় পড়ে গেলুম। অসুখ-বিসুখ নয় তো? লোকজন পাঠালুম তোমাকে ঘরে ফেরাতে।”
আর্যকুমার তখন বললেন তাঁর অন্তরঙ্গ উপলব্ধির কথা। এই নারীতে আছে সেই নারী।
“ওমা, তাই নাকি! অ্যাঁ বল কী! সেইজন্যে কন্যাকুমারীকে ছাড়তে চাওনি? আমি নিজে না গেলে দেখছি তোমাকে নড়ানো যেত না?’ মনীষা শিউরে উঠলেন।
‘আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে তোমাকে ধরতে না পেলে ফিরব না, নড়ব না। অমনি করে পেয়ে গেলুম তোমার সন্ধান। যে তুমি বিশুদ্ধ নারীসত্তা। এস, নতুন করে বাঁচি।”
ওঁরা দুই তরুণ-তরুণী কলকাতা ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলেন নতুন করে বাঁচতে। সময় ওঁদের জন্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
শারদীয় ১৩৬৬ (১৯৫৯)