আর্দালি নেই – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
আপনি এখন কোথায়? আলিপুরে? রাস্তায় চকিতে দেখা, চকিতে প্রশ্ন করল সুরঞ্জন।
নীলাম্বর হয়তো শুনতে পায়নি। চিনতেই পারেনি হয়তো।
সুরঞ্জন কাছে ঘেঁষে এল। মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘কি, আলিপুরেই আছেন তো?’
‘হ্যাঁ—’, পাশ কাটিয়ে ভিড়ের মধ্যে সরে পড়ল নীলাম্বর।
এই যে, ভাল তো? এমনিধারা একটু হঠাৎ দেখায় পথিক প্রশ্ন। চাকুরের ক্ষেত্রে—কোথায় আছেন, কোন পোস্টে, অথবা কোন ডিপার্টমেন্টে? সেক্রেটারিয়েট হলে, রাইটার্সে, না, আত্মহত্যাটার?
সরে যেতেই নীলাম্বরের মনে হল, সুরঞ্জন না? এক সঙ্গে ছিলাম না যশোরে?
তবে ওর হাউ ডু ইউ ডু-র উত্তরে হাউ ডু ইউ ডু তো বলা হল না!
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সুরঞ্জনকে ধরল নীলাম্বব। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তো এখানেই? কোন ডিপার্টমেন্টে?’
‘প্যাঙ্গস অফ চাইল্ড বার্থে।’ হাসল সুরঞ্জন।
‘তার মানে।’
‘লেবারে।’
বলে যাচ্ছিল, কি মনে করে আবার ফিরল নীলাম্বর। সুরঞ্জনের হাত চেপে ধরল। বললে, ‘আমাকে দেখে মনে হয় আমি এখনো আলিপুরে আছি?’
‘যা, আপনিই তো বললেন—
“হ্যাঁ, বললুম বইকি। বলতে ভাল লাগে। না বলতে পারলে নিঃস্ব নিঃস্ব মনে হয়। সেই যে হিটলার বলেছিল—’
‘কী বলেছিল?’
‘বলেছিল যদি মিলিটারি পোশাক পরা না থাকে উলঙ্গ দেখায়।’
‘তার মানে, আপনি’—শোক অনুমান করলে যেমন হয়, সুরঞ্জনের চোখের দৃষ্টি ধূসর হয়ে গেল। ‘হ্যাঁ ভাই, রিটায়ার করেছি।’
বেলুন ছিলাম, চুপসে গিয়েছি—এমনি শোনাল।
‘আপনার দাদা কোথায়?’ কী বলবে বুঝতে না পেরে মামুলি সাংসারিক প্রসঙ্গে প্রবেশ করল সুরঞ্জন।
‘দাদা বর্ধমান।’
‘বর্ধমানে মানে?’ চমকাল সুরঞ্জন ।
‘মানে তিনি এখনো সার্ভিসে।’
‘সে কি? তিনি রিটায়ার করেননি এখনো?’ চোখ কপালে তুলল সুরঞ্জন।
‘না, তাঁর বয়স আমার চেয়ে কম।’
সুরঞ্জন হো-হো করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বললে, ‘কি করে ম্যানেজ করল?’
‘এপিঠ-ওপিঠ করে।’
মানে কোর্টে এফিডেভিট করে?’ আদালতী পরিভাষা, চট করে ধরে নিল সুরঞ্জন।
‘তা ছাড়া আর কি। মিথ্যে এফিডেভিট করেছে বলে যাঁরা ডিপোনেন্টকে জেলে পাঠান তাঁদেরই মধ্যে একজনের এ কীর্তি।’
ইন্টারভিয়্যুতে প্রার্থীকে যেমন দেখে তেমনি করে সুরঞ্জন সূক্ষ্মচোখে দেখতে লাগল নীলাম্বরকে। উৎসাহের সুরে বললে, আপনার তো সবই আছে দেখছি, কিছুই যায়নি।
‘সবই আছে মানে?’ আহতের মতো রুখে উঠল নীলাম্বর।
‘হ্যাঁ, দেখছি, চোখ ঠিক আছে, দাঁত ঠিক আছে, চুল, ওকে ঠিক পাক ধরা বলে না, ‘আর’,নীলাম্বরের ডানহাতের কবজিটা শক্ত করে ধরল, সুরঞ্জন। ‘সুন্দর সুস্থ শরীর আছে এখনো। প্রশ্ন হচ্ছে, কী হয়ে নয়, কী নিয়ে কত নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেন চাকরি থেকে। ভাল স্বাস্থ্য যখন আছে, তখন আর কী চাই। আপনি তো রাজা।’
‘আমি রাজা!’ প্রায় মুখ ভেংচে উঠল নীলাম্বর: ‘আমার কিছুই যায়নি?’
‘মানে ব্যাবুত্তেন্দ্রিয় হননি তো!”
“তাই বলতে চাও আমার কিছুই যায়নি?”
“আহা, মাইনে—সে তো যাবে, তার কথা কে ভাবছে? আউট হতে হবে এই নিয়মেই তো খেলা। প্রসব হবে না শুধু বাড়বে এ আইন প্রকৃতিতে নেই।’
“তুমি কী বুঝবে,’বুকভাঙা শ্বাস ছাড়ল নীলাম্বর: ‘আমার আসল জিনিসই নেই।’
দাদার স্ত্রী মারা গিয়েছে নাকি? না কি কোনো উপযুক্ত পুত্র? মুখ নীরক্ত কালো করল সুরঞ্জন। ঝাপসা গলায় অনুচ্চে বললে, ‘কী নেই?’
দুটি ছোট্ট কথায় প্রচণ্ড হাহাকার করে উঠল নীলাম্বর: ‘আর্দালি নেই।’
মুখ গম্ভীর করে সুরঞ্জন নিজের গালে হাত বুলুতে-বুলুতে বললে, ‘তা বটে।’
‘ভাবে কার্তিক আছে, ময়ূর নেই।’
‘না, না, ময়ূর নয়, ষাঁড়। ভাবুন শিব আছে ষাঁড় নেই।’ হেসে উঠল সুরঞ্জন। ‘এ তো ভালই হয়েছে। ভাঁড় আনতে ষাঁড় পালিয়েছে।’
‘তুমি বলো কী!’ কাতরতার ছায়া আরো গভীর করে নীলাম্বরের মুখে পড়ল। বললে, ‘আর্দালি ছাড়া বাঁচব কি করে! আর্দালি ছাড়া পেনসনী জীবনের মানে কী! আর্দালিই তো চিরকাল হাটে-মাঠে ঘাটে-বাটে বাজারে বন্দরে পথ দেখিয়েছে, চিনিয়েছে, ছছাট-ছোট করে ভিড় সরিয়েছে, চিনিয়েছে কে আসছে পিছনে। সভায় গিয়েছি কেউ চেনে না, আর্দালিকে দিয়ে বুঝিয়েছি, আর সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কেউ-কেউ অতিভক্তিতে আর্দালিকেও সেলাম করেছে। বুঝেছে সর্বদেবমনস্কারঃ কেশবং প্রতি গচ্ছতি। শেষদিকে গাড়ি কিনলাম কেন? আমার নিজের জন্যে নয়, আর্দালির জন্যে।’
‘আর্দালির জন্যে?’ হাঁ করে রইল সুরঞ্জন।
‘হ্যাঁ, ড্রাইভারের পাশে বসবে বলে। মানে, বসাব বলে। অমনি বসিয়ে বোঝাবো বলে, ভেতরে যাচ্ছেন কে আরোহী, কোন সে কৃষ্ণবিষ্ণু নইলে শঙ্খচক্র ছাড়া বোঝে কে ভি-আই-পি-কে? সেইবার যে বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তী করলাম, গেটে দু দুটো উর্দিপরা আর্দালি রাখবার সাহসে। আর্দালি দেখে বুঝবে লোকের ভিতরে আছেন কে বিদগ্ধ। এমনি কনস্টেবল দাঁড় করাও লোকে চটবে, সাজগোজা আর্দালি দাঁড় করাও গদগদ হবে। মঠে মন্দিরে যেতে হলেও আর্দালিকে নিয়ে গেছি। কত খাতির কত আসুন বসুন। এখনো যাই, আর্দালি নেই, তাই আর কেউ পোঁছে না, এ-কে, এল গেল কেউ বলে না ঘুণাক্ষরে। বুকের আস্ত একখানা হাড় চলে গেলেও বোধ হয় সইত। আর্দালিই তো আমাদের সাইনবোর্ড, লেফাফার ঠিকানা, টিকির জবাফুল।’
‘ও জঞ্জাল গেছে, ভালই হয়েছে। ঝাড়া হাত পা হয়েছেন।’ গুমোটের নয়, হালকা হাওয়ার গলায় বললে সুরঞ্জন: ‘আর্দালি আর কী। আপনার কনস্ট্যান্ট ওয়াচার, আপনার বিরুদ্ধে বেনামি চিঠি, আপনার বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলায় উইটনেস নম্বর ওয়ান। ওই লাগানো-ভাঙানো বিভীষণের কবল থেকে ছাড়া পেয়েছেন বলে তো আয়ু বেড়ে গিয়েছে আপনার।’
‘বেড়ে গিয়েছে! কী যে বলো!’ যুক্তিতে এতটুকুও উদ্দীপ্ত হল না নীলাম্বর। ক্লান্ত ঘোলাটে মুখে বললে, ‘লাইফ-ইনসিওয়ের পলিসি একটা ম্যাচিওর করেছে, কাগজপত্র পাঠাতে হবে রেজেষ্ট্রি করে। প্যাক-ট্যাক করে সব ঠিক করলুম, কিন্তু হায়, পোস্ট করবে কে? ভুলে কলিংবেলের বদলে টেবলের উপর থাবা মারলুম। বাজল না, কেউ দাঁড়াল না এসে প্রত্যুত্তরে। সুরঞ্জন,নীলাম্বর ঘন হয়ে প্রায় কানের কাছে মুখ আনল; কত ঘণ্টা তুমি শুনেছ, মন্দিরের ঘণ্টা, গির্জের ঘণ্টা, ছুটির ঘণ্টা, গোরুর গলায় ঘন্টা, কোনো খেলা শুরু হবার আগেকার ঘন্টা, নীলেমের ঘন্টা—কিন্তু সত্যি করে বলল তো কলিং-বেল-এর ঘণ্টার মতো ঘণ্টা আছে? —যখন সে ঘন্টার উত্তরে দাঁড়াবে এসে আর্দালি।’
‘আজকাল আর অত দাঁড়ায় না।’ বললে সুরঞ্জন। ‘কলিং বেল টিপছেন তো টিপছেন, ঠুকছেন তো ঠুকছেন, ও প্রান্তে চাঞ্চল্য নেই। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠলেও নয়। টুলে কোথাও বা দিব্যি চেয়ারে বসে, বাবু ঘুমোচ্ছেন। আর যদি দুজন থাকে তো ঠেলাঠেলি করছেন পরস্পরে, তুই যা না তুই যা। শেষে মাঝে নিজেকে উঠতে হয় আর্দালি ডাকতে, যেমন কখনো কখনো মামলায় ডাক হলে মক্কেলকে খুঁজে আনতে ছুটতে হয় উকিলকে।’ গলা ছেড়ে হেসে উঠল সুরঞ্জন।
অত হাসিতেও নীলাম্বরেব দুঃখের মেঘ উড়ে গেল না। বললে, ‘চাকর তো সর্বক্ষণই বাজারে আর ছেলেরা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এসে এখন গ্রেস মার্কের জন্য ঘুরছে। তাই নিজেই গেলাম পোস্টাপিসে। চার চারবার লাইন দিতে হল।’
‘সে কি? চার-চারবার?’
‘প্রথম লাইন কত স্ট্যাম্প লাগবে তার হিসেবের জন্যে। দ্বিতীয় লাইন টিকিট কেনবার জন্যে। টিকিট তো কিনলাম, এখন সে টিকিট লাগাই কি দিয়ে? হ্যাঁ, ওই দেখুন, জলের লাইন, জল লাগিয়ে টিকিট সাঁটার লাইন। তৃতীয় লাইন ছেড়ে আবার কাউন্টারের লাইন, সেই প্রথম লাইন, যেটা তখন চতুর্থ, চতুর্থ লাইন ধরলাম। সেই লাইন তখন মাইল খানেক লম্বা হয়েছে। সকালে দশটায় গিয়েছিলাম, বাড়ি ফিরলাম দেড়টায়। বিজ্ঞানের ফলে ওযুধে-ভিটামিনে যে আয়ু বেড়েছিল তার বেশি ক্ষয় হয়ে গেল এই লাইন দিয়ে দাঁড়ানোয়’।
‘কিন্তু চাকরিতে থাকলে আপনি ভেবেছেন আপনার আর্দালি ওই চিঠি পোস্ট করত পোস্টাপিসে গিয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে?’ গাছের তলা থেকে সুরঞ্জন নীলাম্বরকে ফাঁকায় টেনে আনল।
‘করত না? কেন করত না?’
‘বলত এ আপনার পার্সন্যাল কাজ। এ আমার করার কথা নয়।’
‘বা, আমি ইনটারপ্রিটেশান দিতাম। আমি সরকারি কর্মচারী বলেই আমার এই ইনসিওরেন্স, সরকারি কর্মচারী না হলে প্রিমিয়ম দিতুম কেমন করে? সুতরাং এই ইনসিওরেন্স-সংক্রান্ত কাজ নিশ্চিত সরকারি কাজ—’ বাঁ হাতের চেটোতে ডান হাতে কিল মারল নীলাম্বর।
মৃদু-মৃদু হাসল সুরঞ্জন। বললে, ‘ওদের ইনটারপ্রিটেশান আরও সূক্ষ্ম। বলত, আমরা যে অফিসের কর্মচারী এই টাকা সেই অফিসের বিষয় নয়, অতএব বেল মারবেন না, ডাকবেন না আমাদের। মশাই, অফিসে যাব আর্দালি ট্যাক্সি এনে দেবে, কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যাব, আনবে না। বলবে এ আপনার পার্সন্যাল ম্যাটার। সেদিন কী হল শুনুন। আর্দালিকে বললুম, এক পট চা এনে দেবে? বা, এনে দেব বইকী। আপনি অফিসর, আপনার চা আনব না? দিব্যি নিয়ে এল ট্রে সাজিয়ে। কাজ করছিলুম, বললুম, এক কাপ তৈরি করে দাও। বিশ্বাস কববেন? দিল না তৈরি করে। বললে, এ সরকারি নয়, এ আপনার পার্সন্যাল। শিবের বাহন কি শুধু ষণ্ডশাই? পাষণ্ড। আপনি গাছ দেখেছেন, তার ছায়া দেখেছেন। বৃক্ষশাখায় পক্ষী দেখেননি? যে পাখি বলা কওয়া নেই হঠাৎ আপনাকে পথে বসিয়ে উড়ে পালায়। এ ভালই হয়েছে, তাদের আনন্দ গিয়েছে। নইলে কোন কাজটা সরকারি কোন কাজটা ব্যক্তিগত প্রতিপদে এর চুলচেরা হিসেব করতে গিয়ে আরেক দুশ্চিন্তা, আরেক থ্রম্বসিস।’
‘না, না, তা কেন, সবই কি ওই এক রকম?’ নীলাম্বর যেন হঠাৎ অতীতে চলে যেতে চাইল, আর যে দিন যায় তাই সোনার দিন। বললে, প্রথম যখন সেই সাকুলারটা এল, পাশে সিনেমা দেখতে পাবে না, মফস্বলে গিয়ে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে উঠতে পাবে না, আর্দালিকে লাগাতে পারবে না বাড়ির কাজে নিজের কাজে, তখন সটান গেলুম সাহেবের কাছে।’
‘তখন কে সাহেব?’
‘লালমুখো টমসন।’
‘কী নিয়ে গেলেন?’
‘মফস্বলে বা কে যায়, আর সিনেমা ওই সব অধম চিত্ৰই বা কে দেখে! গেলুম আর্দালির বিষয় নিয়ে। বললুম, সাহেব তুমি যদি এক টিন সিগারেট আনতে বললা, আনবে, সেটা বাজার করা হবে না। কিন্তু আমি যদি বলি সালপাতায় করে ভিজে তামাক নিয়ে এস আমার গুড়গুড়ির জন্যে, আনবে না, বলবে, বাজার করা বারণ হয়েছে সার্কুলারে। আমার জন্যে কাটা মাছ কিনে আনাটা বাজার, তোমার জন্যে টিনড ফিস কিনে আনাটা বাজার নয়। সাহেব ভাল ছিল, হেসে উঠল, দিল খুলে। বললে, এক কাজ করো। বই বওয়াও।’ কথাটা মনে হতে নীলাম্বরও হাসল।
‘সে আবার কী?’
সাহেব বললে, ‘উকিলদের বলো খুব করে নজির সাইট করতে। বি-এল-আর থেকে এ-আই-আর-যত রাজ্যের চর্বিতচর্বণ। উকিলদের আর তা বলতে হবে না, বললুম সাহেবকে, নজর আর নজির—এ দুই নিয়েই তো আছে উকিল। আর আইন? আইন গিয়েছে পাইন বনে, হাওয়া খেতে। সাহেব আরেক কিস্তি হাসল, বললে, সেই সব নজিবের পাহাড়, বইয়ের গিরি-গোবর্ধন, বওয়াও ওদেরকে দিয়ে। ওরা ঝুক, কোন বাজার হালকা।‘’
‘আমরা তো ওভারস্টে করি, ফাইল আপ টু ডেট করে রাখি।’ চালাক-চালাক চোখ করে বললে সুরঞ্জন: ‘সুপিরিয়র ভাবে কী এফিসিয়েন্ট, আর আমি জানি অন্তরের যন্ত্রণা। আদা জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে আর আর্দালি জব্দ “বসাইয়া রাখিলে।”
‘আমি তখন চৌকিতে। আমার আর্দালি মহীমোহন আমার বাড়িতে রাঁধে, খায় থাকে। আমি বললাম মহীমোহন, সার্কুলার এসেছে, তোমার আর আমার এখানে রান্না করা চলবে না, সুতরাং বুঝতেই পাচ্ছ খাওয়া থাকাও, চলবে না।’ নীলাম্বব অতীতের কথা বলতে গিয়ে একটু বুঝি বা আর্দ্র হল অলক্ষ্যে।
‘কী বলল মহীমোহন?’ সুরঞ্জন ধরিয়ে দিল।
‘মাটিতে পড়ে আমার দু পা জড়িয়ে ধরল। বললে বাবু, আমি যদি এখন আলাদা ঘরভাড়া করি, নিজের খাওয়া খরচ নিজে চালাতে যাই, সদরে, ইস্কুলে আমার ছেলেটা পড়ছে, সে আর মানুষ হবে না। আমার সমস্ত স্বপ্ন ধুলো হয়ে যাবে। সদরে-মফস্বলে দুটো সংসার চালাই আমার কি সেই মুরোদ আছে?’
‘তারপর? আপনি সার্কুলার অমান্য করলেন?’ প্রশ্নে একটু বুঝি বা বিদ্রুপ মেশাল সুরঞ্জন।
‘আমি ধমকে উঠলাম। বললাম সরকারি হুকুম তামিল করতেই হবে আমাকে। আর আমার এখানে থাকা চলবে না তোমার। তুমি থাকো, আর কেউ বেনামিতে নালিশ করে দিক। তখন আমি কৈফিয়ত দিয়ে মরি। আমার প্রমোশন নিয়ে টানাটানি পড়ুক। হবে না—তুমি অন্যত্র আস্তানা নাও।’
‘মহীমোহন তবুও পা ছাড়ে না—তাই না?’ কথার সুর বুঝে আন্দাজে এগোল সুরঞ্জন।
‘তার চেয়েও বেশি। ছেলের দোহাই দেয়। বলে, ছেলেটাকে মানুষ করব বড় করব। এই আমার একমাত্র সাধ বাবু—’
‘তারপর কী করলেন?’
‘বললুম, বেশ, তুমি থাকো আমার বাড়ি, যেমন খাচ্ছিলে খাও দুবেলা, কিন্তু তুমি রাঁধতে পারবে না। তোমাকে দিয়ে বাড়িতে কাজ না করালেই তো হল। তোমাকে যদি আমি এমনি খেতে থাকতে দিই তা হলে তো সরকার আপত্তি করতে পারবে না। এমনতো কোনো সার্কুলার নেই যে খেতে-থাকতে দিলে কাজ—রান্না করিয়ে নিতে হবে। তবে আর ভয় কী কথা কী। তুমি থাকো, খাও, কিন্তু খবরদার, রান্না করতে পারবে না। রান্না কী, কুটো কেটে পারবে না দুখান করতে। বাবুর মতো থাকবে।’
‘থাকল?’
‘থাকল। কিন্তু তার সে যে কী যন্ত্রণা, তোমাকে কী বলব সুরঞ্জন। খাচ্ছে থাকছে অথচ তৃণ কাজ করতে পারছে না সার্কুলারের শাসনে—সে দিনে দিনে শুকিয়ে যেতে লাগল। সন্দেহ হতে লাগল, খায় না বোধহয় পেট ভরে। বোধহয় পুরো রাত ঘুমোয় না। তারপর যখন বদলি হয়ে গেলাম, তখন—’ থামল নীলাম্বর।
‘তখন খুব কাঁদল?’ হাসল সুরঞ্জন।
‘শুধু ওইটুকু বললে কিছুই বলা হল না। মৃত্যু নয়, আঘাত নয়, বাড়িঘর বা চাকরি চলে যাওয়া নয়, একটা জ্যান্ত মানুষের জন্যে আরেকটা জ্যান্ত মানুষ অনাত্মীয় মানুষ যে কাঁদতে পারে এ কখনো ভাবতে পারতুম না।’
‘ও বুঝি আপনার জন্যে কাঁদছে? ও কাঁদছে ভাতের জন্যে।’
‘ভাতের জন্যেই তো কাঁদবে। ভাত তো অমনি আসে না, কোনো মানুষের হাত দিয়েই তো আসে।’ নীলাম্বর সামলাল নিজেকে: ‘কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এলাম। হাকিমের জন্যে কে কাঁদে, আর্দালির জন্যেই হাকিমের কান্না। রাম যে হা-লক্ষ্ণণ হা-লক্ষ্মণ করেছিল, তার মানে, কেঁদেছিল: হা-আর্দালি, হা-আর্দালি বলে।’
‘সরকারের উচিত রিটায়ার্ড অফিসারের সঙ্গে রিটায়ার্ড অর্ডালি ট্যাক করে দেওয়া।’ হাসতে হাসতে বললে সুরঞ্জন। ‘এটাই সার্ভিসের কন্ডিশন করে দেওয়া।’
কদিন পরে সকাল বেলা ছোট-ছেলে উপরে এসে বললে, নীলাম্বরকে, ‘নীচে তোমাকে কে ডাকছে।’
‘কে?’
‘আর্দালি। আর্দালির মতো পোশাক।’ কংসের কাছে কে শোনাল কৃষ্ণনাম! এ কী অকরুণ! তাড়াতাড়ি চটি উলটো-উলটি করে পরে ফের সামলে-শুধরে দ্রুত পায়ে নীচে নামল নীলাম্বর।
এই তো সেই দিব্যকান্তি রক্তবাস স্ফীতবদ্ধপরিকর মোহনমূর্তি। তাপতৃষাহর অমৃতের সরোবর। এই তো সেই প্রার্থিত প্রতীক্ষিত।
এ কি, থলেতে করে কিছু শীতের তরকারি নিয়ে এসেছে—কপি বেগুন কড়াইশুটি টোম্যাটো। শীর্ণ হলেও কতগুলি কলা।
‘মধ্যমগ্রামে একটু বাড়ি করেছি। সঙ্গে একটু তরকারির খেত। ছেলেটা মানুষ হয়েছে। কলকটারিতে ঢুকেছে কেরানি হয়ে। শ্রীচরণে কিছু দিতে না পেরে শান্তি পাচ্ছিলাম না।’ লোকটা নীলাম্বরের পায়ের কাছে নুয়ে পড়ল।
‘এ কি, কে তুমি? এসব কেন দিচ্ছ?’ আগুন দেখলে যেমন করে তেমনি পিছু হটল নীলাম্বর।
‘আমাকে চিনতে পাচ্ছেন না? আমি মহীমোহন।’
‘ও! মহীমোহন? তা-তুমি আছ এখনো চাকরিতে? বা, বেশ, বয়সে ম্যানেজ করতে পেরেছ? কিন্তু আমার কাছে আর এসেছ কেন? আমি তো আর চাকরিতে নেই। আমি রিটায়ার করেছি।’
‘তা জানি। জানি বলেই তো এসেছি, পেরেছি আসতে। নইলে চাকরিতে থাকলে এসব কী পারতুম দিতে? সাহস পেতুম? আমি আপনার সেই আর্দালি।’ স্নিগ্ধ মুখে তাকাল মহীমোহন।
‘কিন্তু জানো, আমার আর আর্দালি নেই।’নীলাম্বর বললে।
‘না থাক। কিন্তু মানুষ তো আছে।’
১৭ জানুয়ারি ১৯৬০