কঙ্কাল – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
একটা ৱোঙা-ওঠা হাড়-জিরজিরে বুড়ো কুকুর থাবা দুটোর ওপর মুখটা রেখে শুয়ে আছে। পাশেই একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সুধীরবাবু একটা মোটা ইংরাজি বই পড়ছেন। বাঁ-হাতে গড়গড়ার নল।
আমায় দেখে বললেন—“শৈলেন যে, অনেকদিন পরে দেখছি। বোস।”
আমি তখন বাইরে থেকে কলেজে পড়ছি। প্রণাম করে পাশের চেয়ারটায় বসে বললাম—“হ্যাঁ মাস্টারমশাই, বোধ হয় বছর দুই পরে এলাম। আছেন কেমন আপনি?”
“কেমন দেখছ?…ঠিক করেই বলো! খুঁড়ছ—এমন ভয় করবার দরকার নেই। খুঁড়ে এখন পর্যন্ত আমার কেউ কিছু বুঝতে পারে নি।”
—হেসে উঠলেন।
সুধীরবাবু ছিলেন আমাদের বাংলা স্কুলের হেডমাস্টার, ক্ষুদ্র স্কুলের শিক্ষক, কিন্তু অমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ খুব কম দেখেছি জীবনে। কোন একটা বাড়ির কি ব্যক্তিত্ব বলে জিনিস থাকতে পারে? তা যদি সম্ভব হয় তো শুধু যেন তারই সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের ব্যক্তিত্বের তুলনা করা যেতে পারে।
ওঁদের বাড়িটা ছিল শহর থেকে খানিকটা দূরে—নিতান্তই বিচ্ছিন্ন একটা জায়গায়। সামনে দিয়ে জেলা বোর্ডের প্রশস্ত রাস্তাটা পূব-পশ্চিমে সোজা চলে গেছে। তারই সঙ্গে এক লেভেলে এখানকার বড় বিঘার প্রায় বিঘা তিনেক (বাংলায় বিঘা সাতেক) জমি, দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তীর্ণ হয়ে গেছে। এই জমির একেবারে শেষ প্রান্তে ওঁদের বাড়িটা। পুরানোকালের বাড়ি। মাঝখানে প্রশস্ত উঠান, চারিদিকে বড় বড় ঘর। খাপড়া বা খোলার ঘরই। সে সময় অবস্থাপন্ন লোকেদের মধ্যেও কোঠা তোলবার রেওয়াজ ছিল না এদেশে।
বাড়ি আর রাস্তার মাঝখানে লম্বা-চওড়া খোলা জায়গাটায় যত রকম গাছপালা,—আম, কাঁঠাল, কুল, বেল—একটা বিরাট কৎবেল, আরও সব। মাঝখানে খানিকটা ফুলের বাগান, তার পাশেই খানিকটা খালি জায়গা, মাঠ থেকে ফসল কেটে এলে গাদা করবার জন্যে, ঝেড়ে-ঝুড়ে তোয়ের করবার জন্যে।
রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত এই উঁচু ভিট-জায়গাটার পরই বাঁয়ে আর পিছন দিকে নিচু ধানক্ষেত, দুর- বিস্তৃত। ডান দিকে একটা বেশ বড় পুষ্করিণী।
শহর থেকে বিচ্ছিন্ন, উঁচু ডাঙার ওপর পুরনো গাছপালার মাঝে এই বাড়িটা ছিল বড় বিশিষ্ট। উন্মুক্ত, একক, আত্মনির্ভর। চারিদিকের শূন্যতার মাঝখানে, নিঃসঙ্গতাজনিত নানারকম বিপদআপদের মধ্যে নিজের বলিষ্ঠতা সম্বল করে আছে দাঁড়িয়ে। শহরের মধ্যে কত ঘরবাড়ি, কত অট্টালিকা, প্রমোদ-উদ্যান; কিন্তু মাস্টারমশায়ের বেলার-বাড়ির নাম করলে সবই আমার কাছে কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে যেত। তার কারণ, ওসব তো ছিলই, তা ছাড়া বাড়িটার কথা মনে হলেই মাস্টারমশায়ের চেহারাটা যেন ওর কেন্দ্রস্থলটিতে আপনি উঠত জেগে—দীর্ঘ-ছন্দ, বলিষ্ঠ, চোখের তেজের সঙ্গে প্রসন্নতা, বুকে সাহসের সঙ্গে দুঃসাহস।
একটা বাড়ির সঙ্গে একজন মানুষের এরকম আশ্চর্য সমন্বয়, এমন ওতঃপ্রোত হয়ে মিলে যাওয়া আর কোথাও পাইনি আমি। মিলে যাওয়া একটা আশ্চর্য বিরাটত্বের মধ্যে।
অথচ কত সাধারণ। বাড়িটাকে মাস্টারমশাই খামারবাড়ি বলতেই ভালবাসতেন। নিজের সম্বন্ধে বলতেন—“আমি তো চাষাভূষো মানুষ।” অন্তত বেলার বাড়িতে তাঁর এইটাই ছিল রূপ। একেবারে সকালবেলায় গেলে দেখা যেত—বাড়ির আখড়াতেই কুস্তি সেরে বসে আছেন, আখড়ারই কোন ছোকরা-সাকরেদ গায়ে মাটি মাখাচ্ছে। এর পর ছিল বাইরের গৃহস্থালি—পরনে একটা আধময়লা ধুতি, গায়ে গামছা বা একটা তোয়ালে, মাস্টারমশাই খাড়য়ানে (ফসল মাড়াইয়ের উঠান) জন খাটাচ্ছেন, কিংবা বাগানে খুরপি-হাতে গাছ নিড়াচ্ছেন, বা কাটারি-হাতে ছাঁটা-কাটা করছেন। কুড়ুল হাতে কাঠ ফাড়তেও দেখা যেত, কোদাল হাতে জমি কোপাতেও।
এরপর স্কুলে আসতেন। সাধারণ বাঙালির পোশাক, পরিচ্ছন্নতার কণামাত্র ত্রুটি নেই কোথাও। শৌখিনতার ধারে কাছে দিয়েও যায় না।…পা দেওয়ার পর থেকেই স্কুলটা থমথমে হয়ে থাকত। পড়ানর কায়দা ছিল একেবারে নিজস্ব। পাঠ্যপুস্তকের দৈনিক পাঠ সারতে অল্প সময় লাগত। তারপর বাইরের বই বা গল্প নিয়ে পড়তেন। বেশির ভাগই নেপোলিয়ান বা ওই ধরনের দুর্ধর্ষ মহাপুরুষদের। অ্যাবটস্ লাইফ অব নেপোলিয়ান ছিল তাঁর সব চেয়ে প্রিয় বই। মারতেন কম। নৈতিক কিছু ত্রুটি দেখলে তবেই বেত ধরতেন। আর তখন বলতে গেলে মৃত্যুর দরজার কাছাকাছি পর্যন্ত না পৌঁছে গেলে ছাড়তেন না। অবশ্য ত্রুটি তেমন বেশি হলে। বলতেন—এ ছেলে বাদ পড়াই দরকার সময় থাকতে। (এ হেডমাস্টারের জাত গেল কোথায়?)
সেই যে স্কুলের জন্য বাড়ি থেকে বেরুতেন, ফিরতেন একেবারে সন্ধ্যার পর। কোন কোন দিন বেশ রাত হয়ে যেত, কখনও কখনও সমস্ত রাতই কাবার। কোথায় কোন্ বাঙালির বাড়িতে কি বিপদ, বা উৎসবই; মাস্টারমশাই ঠিক আছেন।
অনেকটা দূরে এসে পড়লাম মূল কথা থেকে। মাস্টারমশায়ের কথা উঠলে অত হিসাব রেখে এগুনো যায় না।
শরীরের কথা থেকে আরও পাঁচটা কথা এসে পড়ল। অনেক দিন পরে দেখা তো। সকালেই গিয়েছিলাম। দুজনের জন্য জলখাবার এসে পড়ল। নিমকি, হালুয়া। এখানকার এ খাবার নয়। মুখ নিচু করে দেখছিলাম, মনের প্রশ্নটা বুকে নিয়ে মাস্টারমশাই বললেন—”যা ভয় করছ তা নয়। অত ভদ্র হইনি—ছোলা, মুড়ি, চিড়েভাজা, ছাতু এই সবই চলে আমার এখনও।”
‘তাহলে, মাস্টারমশাই…’ লজ্জিতভাবে প্রশ্ন করলাম।
“তুমি এসেছ…অনেক দিন পরে।”
“আমিই অত ভদ্র হয়ে ফিরব এরকম কামনা করেন?”
হাসলেন। বললেন;“না, আমি শিষ্যাং পরাজয়টা মেনে নিচ্ছি শৈলেন; ভুল হয়ে গেছে। নাও, আরম্ভ করো।”
“আপনি আর একটা ভুল করলেন মাস্টারমশাই…”
কুকুরটাকে একখানা নিমকি দিয়ে এক খামচা হালুয়া তুলে নিয়েছেন, ঘুরে চেয়ে প্রশ্ন করলেন— “আবার কি ভুল দেখলে?”
“ওকে ঘিয়ের জিনিস দিচ্ছেন। নিজেই তো ঘিয়ে-ভাজা একেবারে।”
মাস্টারমশাইয়ের মুখের চেহারা হঠাৎ বদলে গেল। কয়েক মুহূর্ত একটু অন্যমনস্ক হয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললেন—“শৈলেন, দেবতাদের পুজোয় আমরা যা সব জিনিস দিয়ে থাকি, ঘিটাই কি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ নয়?”
“ওটা মানতে বাধা নেই, হোমাগ্নি নিজে তাঁদের জন্যে বহন করে নিয়ে যান যখন। কিন্তু…কিন্তু মাস্টারমশাই, কুকুর আর দেবতা…”
“এবার তুমিই ভুল করছ শৈলেন…একটা কথা ভুলে যাচ্ছ বলাই ঠিক। যুধিষ্ঠির যখন মহাপ্রস্থান করেন তখন আর সবাই-ই রাস্তায় থেকে গেল, সঙ্গে যেতে পারল মাত্র এক সারমেয়।…দেবত্ব তুমি কাকে বলবে?”
কথাটাকে হালকা করে ফেলা যেত, কেননা কুকুরকে ঘি খাওয়ানোর (হয়তো ওই ঘিয়ে-ভাজা কুকুরকে) আমার আপত্তিটা ছিল অন্য-ধরনের। কিন্তু ওঁর আবিষ্ট ভাব দেখে হালকার দিকে যেতেই পারলাম না আর। চুপ করেই খাবারে মনঃসংযোগ করেছি, মাস্টারমশাই বললেন—“শৈলেন বোধ হয় মনে করছ মাস্টারমশাই নিজেকে যুধিষ্ঠির বলতে চান…”
বললাম—“মনে করাকরি নয় মাস্টারমশাই। বলতে চান আর না-ই চান, আমি তো তাই বলেই জানি।”
আরও আবিষ্ট হয়ে পড়েছেন, বুঝলাম কথাটা কানে যায়নি। হালুয়াটা হাতেই ছিল, সেটা ওর সামনে ধরে দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন—“আমার পক্ষে লিয়ন সত্যিই দেবতা হয়ে দেখা দিয়েছিল শৈলেন। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার জীবনে। তুমি লিখছ আজকাল, বলে রাখি, কখনও ইচ্ছে হলে লিখে রেখো।…হ্যাঁ, লিখেই রেখো, আমি খুব তৃপ্তি পাব শৈলেন। জান তো—Love me, love my dog.”
আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগলেন লিয়নের গায়ে। আরম্ভ করলেন—
“আমার অনেক রকম আজগুবি খেয়াল মাথায় ঢোকে, সে তুমি জানই। গত বছর আমের সিজনে যেটা এসে জুটল সেটা আবার একটু বেয়াড়া রকমের আজগুবি। ঠিক করলাম আম চালানির ব্যবসা করতে হবে। ওই সময় কলকাতা, পাটনা, এলাহাবাদ, ছাপরা—চারিদিক থেকে ফড়েরা আসে, বাজারে এক-একখানা ঘর ভাড়া করে গাড়ি-গাড়ি আমের চালান দিয়ে মোটা টাকা নিয়ে যায় এখান থেকে। আমরা রয়েছি এখানে, অথচ একেবারেই ওদিকটা ভাবি না। নয় আড্ডা, নয় পাশ করার চিন্তা, নয় কেরানিগিরির জন্যে বিজ্ঞাপন খোঁজা। তুমি বোধ হয় জান না, বাগানগুলো এখানে প্রায় তিনবার করে হাতফের হয়। একজন হয়তো শ্রীপঞ্চমীর কাছাকাছি গাছে মৌল দেখা দেওয়ার সময় কিনে নিলে বাগানটা। মটর হলে সে সুবিধে দেখে আর একজনের হাতে বিক্রি করে দিল। তারপর চোত-বোশেখের ঝড় ঝাপটা গেল, ঝড়তি-পড়তি যা হওয়ার হয়ে গেল গাছে, তখন আবার অন্য এক খরিদ্দার এসে দাঁড়াল, হাত-ফেরতা হয়ে গেল বাগান। সবক্ষেত্রেই যে এই হচ্ছে এমন নয় অবশ্য; তবে হয়। আমি ঠিক করলাম একেবারে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বাগান হাতে রাখব। রিস্ক, এক-আধ মাসের ব্যাপার নয় তো, কিন্তু একটা ঝোঁক চেপে গেছে, নেমে পড়লাম।
শহরের মধ্যে বা কাছাকাছি বাগান যে নেই এমন নয়, কিন্তু মাথায় ভূত চেপেছে, আমি সে-সব দিকে গেলাম না। বেলা থেকেও অনেক উত্তরে যে রেলের গুমটিটা আছে, দেখে থাকবে, যেটা পেরিয়ে নেপালের বড় সড়কটা পুব হয়ে উত্তরের দিকে চলে গেছে। সেই গুমটি থেকে নেমে আরও প্রায় মাইলখানেক দূরে রাজের একটা খুব বড় বাগান আছে; রেলের ধারে ধারে মাঠ ভেঙে যেতে হয়। সেই বাগানটা ডাকে কিনে নিলাম আমি। প্রায় ষাট বিঘার ওপর টানা বাগান—বাছা বাছা গাছ, শুধু বোম্বাই, বিষ্ণুভোগ, মালদহ, ফজলি। মৌলে ভেঙে পড়ছে ডাল। বাগানের এদিক থেকে ওদিকে নজর যায় না। দিনের বেলায় সূর্যের সঙ্গে দেখা নেই, রাত্তিরে হাত কুড়ি-পঁচিশ পরেই সমস্তটা যেন কালি-লেপা।
ওদিকটায় তোমরা কখনও গেছ কিনা জানি না। সমস্ত জায়গাটা খানা-খন্দর, ছোটবড় জলা আর সুঁতিতে ভরা। ত্রিশ-ভোমরার প্রায় এক ফার্লঙের লম্বা বাদশাহী পুলটা দেখেছ নেপাল সড়কের ওপর, ত্রিশটা খিলানের ওপর গড়া—সেটা দেখে এমন অনুমান করা বোধ হয় ভুল নয় যে, কজলা নদীটা বা তার একটা খুব বড় ধারা কোনকালে এইখান দিয়ে নিশ্চয় বয়ে গিয়েছিল, তারপর সরে যেতে বা শুকিয়ে গিয়ে সমস্ত অঞ্চলটাকে এইরকম তছনছ করে দিয়েছে। মানুষের বাসের একেবারেই অযোগ্য, সড়কের ধারে ধারে ওই যে কখানা ছাড়া-ছাড়া বাড়ি দেখেছ সেই শেষ। যে বাগানটা নিয়েছি তার শেষ দিকে উত্তর-পূব কোণে একটা সুঁতির ওপর এদিককার শ্মশানটা; বেলা, সোনহান, নকটোলি, এইসব জায়গার লোকেরা ব্যবহার করে। একটু তোমাদের সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে, মানুষের বসবাসের পর যেন পূর্ণচ্ছেদের দাঁড়ি টেনে দিয়েছে শ্মশানটা।
বাগানটা নিয়ে আমি তার মাঝখানে পরিষ্কার জায়গা দেখে একটা ছোট চালাঘর তুলে ফেললাম। মৌল ধরেনি এইরকম কিছু কিছু ডালপালা ছাঁটিয়ে দিয়ে একটু ঝরঝরেও করে নিলাম।
যতদিন মৌল রইল ডালে, তারপর মৌলও ঝরে গিয়ে মটর দেখা দিল, ততদিন শুধু মাঝে মাঝে এক-একবার গিয়ে দেখে আসতাম ফসলের অবস্থা কিরকম দাঁড়াতে পারে। আমের গুটি আরম্ভ হয়ে গেলে একটা লোক রেখে দিলাম। বাগান থেকে পোটাক দূরে নেপাল সড়কের ধারে বাড়ি, নাম দুখন। এই সময়টা কিছু বানরের উপদ্রব হয়। ঠিক হোল দুখন সমস্ত দিন ওখানেই থাকবে, ঘুরেফিরে পাহারা দেবে। রাত্তিরে বাদুড়ের অত্যাচার আরও বেশি। রীতিমতো কড়াক্রান্তি হিসেব করে ব্যবসায় নেমেছি, ইচ্ছা ছিল রাত্তিরেও থেকে পাহারা দেয়, রাজি হোল না। কাছেই শ্মশান, একরাশ গল্প উপস্থিত করল আর পরামর্শ দিল, ওদের গ্রামের বুড়ি ডাইনী বৌদির দিদিমাকে যদি এ-কাজে নিয়োজিত করি তো ফল ভালো হয়। সে ‘দানা’ ওর ‘চুড়ৈল’ গোটাকতক লাগিয়ে রেখে দিতে পারে, তাতে চোর-ছ্যাঁচড় বাগানের ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে পারবে না। জানো তো—ভূতের মধ্যে এ দুটো জাত নাকি এ-ধরনের কাজে বেশি দক্ষ।
কথাটা এইখানেই শেষ হোল। রাতের ব্যবস্থা আপাতত রইল বাকি। চোত, বোশেখ, জ্যৈষ্ঠ কেটে গেল এইভাবে। তারপর আম পাড়বার সময় এসে পড়ল। শহরের বাজারে চারিদিক থেকে ব্যাপারীরা এসে ঘর ভাড়া করে বাঁশের গুড়ি কিনে বোঝাই করছে, ঘুরে ঘুরে বাগান দেখছে, আমার কাছেও আসছে, ব্যবসার যে একটা উন্মাদনা আছে সেটা আমার বেশ ভালো করে পেয়ে বসল। এর মধ্যে একদিন তদারকে ঘুরতে গিয়ে যখন একটা গাছ একটু হালকা মনে হোল, আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। পাহারায় গাফিলতি হচ্ছে বলে দুখনাটাকে খুব একচোট বকাবকি করলাম, কিন্তু ভেবে দেখলাম যতই পাহারা দিক, নিজের ওপর তো দেবে না; যদি লোক বাড়িয়ে দিই তো গাছ খালি করার বরং আরও সুবিধেই হবে ওর। ঠিক করলাম নিজেরাই নেমে পড়ব। দিনের বেলায় থাকবে আমার ছোটভাই ক্ষীতু রাত্তিরে থাকব আমি।
এই ব্যবস্থাই চালু করে দিলাম। ক্ষীতু সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে প্রায় সমস্ত দিনটাই ওখানে কাটাত। আমিও এদিকের কাজ সেরে রাত্তিরে একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নিয়ে চলে যেতাম। ততক্ষণ দুখন একলাই থাকত; আমি গেলে ও ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে বাড়ি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে আসত, তারপর রাতটা আমরা পারাপারি করে জেগে পাহারা দিতাম। সেই প্রকাণ্ড বাগানে অবশ্য ঘুরে ঘুরে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়, যদিও বার দুইতিন আমরা তাও করতাম দুজনে একসঙ্গে, ওর হাতে লালঠেন আর আমার হাতে বন্দুক, মাঝে মাঝে আওয়াজ করছি। বাকি সময়টা পাহারার ব্যবস্থাটা থাকত অন্যরকম। বাগানের দূরে দূরে কয়েক জায়গায় একটা করে হাত তিন-চারেকের বাঁশ থাকত পোতা, মাথাটা যার খণ্ড করে চেরা। একটা বাতার মাথায় দড়ি বেঁধে দড়ির একটা খুঁট আমাদের চৌকির পায়ায় বেঁধে রাখা হোত, তার পর একবার এ-দড়ি, একবার ও-দড়িতে টান দিয়ে ছেড়ে দিলেই সেখানে ফটাস ফটাস করে আওয়াজ হোত। স্প্রিং এর মতন আর কি, একটা দেশি পদ্ধতি। এতে বাদুড়গুলো বসতে পেত না, কোনও মানুষের আম চুরির মতলব থাকলেও টের পেত আমরা জেগে আছি। এর মাঝেও এক-একবার করে বন্দুকের আওয়াজ করে দেওয়া হোত যাতে টের পায় জেগে আছি হাতিয়ার-বন্দ্ হয়েই। বেশ চলতে লাগল।
যে-রাত্তিরের কথা হচ্ছে, সেটা কৃষ্ণপক্ষের রাত্তির। তিথিটা ঠিক মনে নেই, তবে সবে পূর্ণিমা গেছে, চাঁদ উঠতে প্রায় প্রহরখানেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। শহরে একটু কাজ পড়ে গিয়েছিল, বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল আমার সেদিন। দুখনাটা সমস্ত দিন বাগানেই থাকে, আমি গেলে সে খেয়ে আসতে যাবে। আমি আর খেতে বসলাম। তাড়াতাড়ি খানকতক লুচি ভাজিয়ে নিয়ে, সেগুলো একটা এলুমিনিয়ামের কৌটোয় পুরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সেই রাত্রে আমার লিয়নের সঙ্গে পরিচয়টা হোল। সে-রাত্রে যে অভিজ্ঞতাটুকু হোল আমার জীবনে তা থেকে আমার মনে, যাকে অন্ধবিশ্বাস বলা যায়, সে-জিনিসটা যেন একটু একটু করে এসে পড়েছে শৈলেন। কথাটা অবশ্য তখন স্ট্রাইক করেনি, তবে পরে আমার মনে হয়েছে কুকুরটা যেন আমার জন্যেই বিশেষ করে প্রতীক্ষা করছিল সেদিন। রেলগুমটির কাছে রাস্তার ধারেই থাবায় মুখ চেপে পড়ে ছিল, আমায় দেখেই বেশ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে এগুল। প্রথমটা ভয়ই পেয়ে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলাম। তারপর খুব যেন পরিচিতের মতন করে ল্যাজ নেড়ে এগিয়ে এসে পা শুঁকতে, আমিও মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করলাম। আমার টাইগারটা কিছুদিন আগে মারা গেছে, গুমটিম্যানটাকে জিগ্যেস করে যখন জানলাম ওর কুকুর নয়, দেখছেও আজ এই প্রথম, তখন এডপ্ট করাই ঠিক করলাম। বাগানটা নিয়ে একটা কুকুরের কথা ভাবছিলাম— অবশ্য যেমন বললে, এ-রকম ঘিয়ে-ভাজা কুকুরের কথা কেউ ভাবে না, তবে আপাতত যখন পেয়ে গেলাম, ছাড়লাম না।
কমলিই ছাড়ল না। একথাও বলতে পার। যেতে যেতে বার দুই এও মনে হোল ঘেয়ে কুকুর হয়তো, রাত্তিরে ঠিক বুঝতেও পারছি না, খেদিয়েই দিই। চেষ্টাও করলুম, দ্বিতীয়বার বন্দুকের নলটা টিপ করেও। গেল না। তখন কৌটো থেকে একটা লুচি বের করে ওকে আনুষ্ঠানিকভাবে এডপ্ট করেই নিলাম। “লিয়ন, লিয়ন”বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ওর নামকরণটাও সেরে নিলাম। ওর চেহারার দৈন্যটা নামের পৌরুষ দিয়ে ঢেকে দেওয়া আর কি। ব্যাটা স্থির হয়ে আত্ম কাহিনীটা শুনছে দ্যাখো না।”
মাস্টারমশাই বারকয়েক মাথায় হাতটা বুলিয়ে দিলেন।
“বাগানে পৌঁছুতে দুখন বললে—একবার দুজনে মিলে ঘুরে আসতে হবে। বেচারার এমনিই দেরি হয়ে গিয়েছিল, আমি জিগ্যেস করতে বললে—বৌদির সেই ডাইনী দিদিমা-বুড়ি মারা গেছে, তাকে দাহ করতে নিয়ে এসেছে। দলটা বেশ বড়, কিছু ভেঙে বাগানে ঢুকে পড়ে আম চুরিতে লেগে যেতে পারে এই সুযোগে। একবার ঘুরে বন্দুকের আওয়াজ করে জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, আমরা আছি।
কথাটা সমীচীন বৈকি, বেরিয়ে পড়লাম দুজনে, লিয়ন রইল পিছনে। ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানের ধারেও গেলাম একবার। বৌদির সঙ্গে আমার জানা-শোনা আছে। বুড়ি-দিদিমা মারা গেছে, খুবই যে শোকাচ্ছন্ন এমন নয়, তবে বলল—আমের সময় সামনেই বাবু, বুড়ি আম খাওয়া হোল না বলে আপশোষ করতে করতে মারা গেল—দুদিন পরেই পাকছে আম, এই একটা দুঃখু থেকে গেল মনে।’
বুড়োমানুষের মৃত্যু সবাই হাল্কাভাবেই নেয়, দলের একজন ঠাট্টা করে বলল—তা খাক না কত খাবে। শহরের সেরা আমবাগানে তো রেখে গেলুম ওকে, কি বলুন মাস্টারবাবু?’
হেসে বললুম—“মাস্টারবাবুর কাছে বন্দুক আছে, সেটারও যেন খোঁজ রাখে বুড়ি।”
বুড়ির গল্প শুনতে শুনতেই ফিরে এলাম ঘরটাতে। বিশ্বাস করি না, তবু আজগুবি-আজগুবি অনেক রকম গল্পই তো গড়ে ওঠে ওদের নিয়ে। দুখন দুটো কলকে সেজে তার একটাতে আগুন দিয়ে আমার গড়গড়ায় চাপিয়ে দিল, অন্যটা পাশে রেখে চলে গেল। যেতেই চাইছিল না, আমিই পাঠিয়ে দিলাম; বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বরং একটু ঠাট্টা করেই এও বলে দিলাম—যদি না আসতে পারে ক্ষতি নেই। বুড়ি আমায় কিছু করতে পারবে না। দুখন চলে গেলে আমি লুচি কখানাও খেয়ে নিলুম, খান তিনেক লিয়নকে দিয়ে। জ্যৈষ্ঠের গরম, তখন বৃষ্টিও নামে নি, তায় অত বড় একটা আমবাগানের একেবারে মধ্যিখানেই তো, অবস্থাটা ত বুঝতেই পারছ। চালাঘরটার সামনে একটা চৌকি থাকত, তাতে সতরঞ্জির ওপর একটা সুজনী পাতা, একটা বালিস। আমি খাওয়া সেরে এক হাতে পাখা আর এক হাতে গড়গড়ার নলটা নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লুম। নিচু চৌকি, লিয়ন পাশে থাবার ওপর ভর করে বসে রইল।
এক সময় বাগানের ওপারে সুঁতীর ধারে শবযাত্রীদের সমস্বরে আওয়াজ উঠল—“রাম নাম সত্য হ্যায়।” ওরা দাহ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। আওয়াজটা আরও বার পাঁচ-ছয় হোল, শেষেরটা বহু দূরে। এর পরই চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার সম্বন্ধে তোমাদের ধারণাটা কি বলো দিকিন শৈলেন?”
গল্প ছেড়ে হঠাৎ প্রশ্নটায় একটু হকচকিয়ে গেছি, মাস্টারমশাই নিজেই বললেন, “ডানপিটে, কুস্তিগীর, ভয় কাকে বলে জানি না—এই তো? নিজেও তাই বলেই জানি নিজেকে। কিন্তু সেদিন দুখন চলে যেতে শুয়ে শুয়ে মনে হোল—লোকটাকে না যেতে বললেই যেন ভাল হোত, নিজেই যখন চাইছিল না যেতে; সঙ্গে খাবারও তো ছিলই।
চিন্তাটাকে অবশ্য অন্য চিন্তা দিয়ে ঠেলে ঠেলে সরিয়েই দিলাম শেষ পর্যন্ত। তামাকটা পুড়ে এলে উঠে অন্য কলকেটায় আগুন দিয়ে গড়গড়ায় বসিয়ে আবার নলটা হাতে করে শুয়ে পড়লাম।
এর পরে একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার, যা ব্যাপারটা হোল তাতে গোলমাল হওয়াটা আশ্চর্যও নয়। ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি জেগেই ছিলুম, কি ঘুমিয়েই পড়েছিলুম, তারপর হঠাৎ জেগে উঠি। সেদিন শহরে বেশ একটু ঘোরাঘুরি আর খাটুনি হয়, তাই থেকে মনে হয় বোধ হয় গাঢ়গোছের একটু তন্দ্রাই এসে গিয়ে থাকবে। যাই হোক, শুয়েই ছিলাম চিৎ হয়ে, হঠাৎ সামনে আমার নজরটা গেল আটকে। আগেই বলেছি, আমি চালাটা তুলেছিলুম বাগানের মাঝামাঝি একটা খালি জায়গা দেখে। পুরনো হয়ে-যাওয়া গোটা তিন গাছ কাটিয়ে ফেলা হয়েছে সেখানে, আরও একটা আপনিই আধশুকনো হয়ে এসেছে। আমার হঠাৎ মনে হোল ঠিক সামনে হাত দশ বারো দূরে যে গাছটা দাঁড়িয়ে, তার একেবারে মাথায়—সে কি করে বর্ণনা করি?—মনে হোল ডালপাতার ফাঁকে ফাঁকে ডালপাতার সঙ্গে মিশে একটা হাত কখন এসে পড়েছে—রক্ত মাংসের হাত নয়, ধপ ধপ করছে সাদা—একটা কঙ্কালের হাতের আঙুলগুলো যদি ফাঁক ফাঁক করে ছড়িয়ে রাখা হয় তাহলে যেমন দেখতে হয়, যেন সেইরকম। তবে পাঞ্জাটা অনেক বড় আর কোন্ আঙুলটা কোথা থেকে আরম্ভ হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে তার যেন ঠিক নেই। হঠাৎ নজরে-পড়া প্রথম খানিকক্ষণ তো চোখ ফেরাতেই পারলুম না, তারপর অনেক চেষ্টা করে, মনের সঙ্গে অনেক যুক্তি করে একটা অগ্রাহ্যের ভাব এনে মাথাটা একটু ঘুরিয়ো নোব, ওরই লাইনে হাত ছ’সাত ডানদিকে, ঠিক ওই ব্যাপার—ওইরকম একটা পাঞ্জা—শুধু হাড়, ঝক ঝক করছে, গাছের ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে। এক দৃষ্টে চেয়ে আছি আমি, জ্ঞানটা স্পষ্ট, মনের সঙ্গে যুক্তিটা চালিয়েও যাচ্ছি, কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, ঘাড় ফেরাবার ক্ষমতাটা হারিয়ে বসেছি আমি, ভয় হচ্ছে, এইরকম একঠায় চেয়ে কাটাতে হবে নাকি আমায়, দুখনটা না আসা পর্যন্ত। এমন কি আপশোষের ভাবটাও বেশ অনুভব করছি—কেন তাকে ঠাট্টা করেই বা আসতে বারণ করেছিলুম।
একটা বিশ্রীরকম অসহায় ভাব—লেখক নই তো, ঠিক বর্ণনা করতে পারছি না। সময়ের জ্ঞানটাও যেন মিটে গেছে। কতক্ষণ গেল ঠিক বুঝতে পারছি না, তারপর ভয়ের যা একেবারে শেষ অবস্থা— মরিয়া হয়ে উঠলুন—ঘাড় না ফেরাতে পারি, উঠে বসব। মনে আছে দুটো কনুইয়ে চাড় দিয়ে সে এক অমানুষিক চেষ্টা করে ঠেলে উঠতে যাব, কনুই দুটো যেন পক্ষঘাতে অবশ হয়ে গেল। পড়ে গেলাম আবার চৌকিটার ওপর। এবার সেই হাত দুটোর স্পষ্ট একটা মুভমেন্ট—মনে হোল আমার উঠতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে দুটো যেন চঞ্চল হয়ে উঠল—ঠিক একটা থাবা মারার ভাব। একটা সেকেন্ডও নয় অবশ্য, তখুনি গেল দাঁড়িয়ে। তারপরেই আরম্ভ হয়ে গেল—
হাত থেকে আরম্ভ করে ক্রমে মুখ, গলা, কোমর, পা, পায়ের আঙুল—নিখুঁৎ একখানি কঙ্কাল, শুধু সচরাচর দেখতে পাই তার চেয়ে বোধ হয় বিশগুণ বড়। এগিয়ে আসছে, আর সে রকম হঠাৎ-চঞ্চল নয়—আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে—মাথাটা আস্তে আস্তে হেঁট হয়ে আসছে— চোখাচোখি হয়ে আছি—ওর অবশ্য চোখ নেই। দুটো অন্ধকার গর্ত, কিন্তু তার ভেতরই কোথায় যেন রয়েছে দৃষ্টি; অব্যর্থ। বেশ বুঝতে পারছি, আমি কোথায় একেবারেই তলিয়ে যাচ্ছি, আর বেশি দেরি নেই। আমাদের এই পৃথিবীর আর সব অনুভূতিই একরকম শেষ হয়ে এসেছে আমার। আছে শুধু গাছের ওই কঙ্কাল বা যাই বলো, আর এদিকে …সেইটেই আমায় আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে খুব যেন একটা ক্ষীণ সুতো দিয়ে রেখেছে ধরে—একটা আঁচড়ের অনুভূতি। টানা আর খুব তাড়াতাড়ি—নখের আঁচড় নয়—লিয়ন আমায় চেটে যাচ্ছে—কপালে গালে, নাকে, মুখে, চোখে, বুকে, হাতে—চেটে চেটে জিভ শুকিয়ে গেছে—আঁচড়ের চোটে সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরে গেছে আমার।
কিন্তু বাঁচিয়ে রেখেছে। বুঝছ না? রক্ত চলাচলটা ওই করে বন্ধ হয়ে যেতে দেয়নি আর কি।…দ্যাখো সব হালুয়াটা কখন অন্যমনস্ক হয়ে দিয়ে ফেললুম বেটাকে। ….ওরে, আর একটু হালুয়া দিয়ে যা তো, থাকে তো। এটা লিয়নের পেটেই গেছে!”
মাস্টারমশাই একটু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলুম—“ব্যাপারটা…?”
“কিছুই নয়।” এবার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি, যেন নিজের ওপর ব্যঙ্গ করেই। বললেন—“পড়ে ওইভাবে চেয়ে গোঁ গোঁ করছি, কানে গেল—‘ধীরবাবু! ধীরবাবু!’—দুখন একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে। বৌদির দিদিমা আম না খেতে পাওয়ায় আপশোষ নিয়ে মরেছে, কি কাণ্ডটা করে বলা যায় না তো। ডাকে সাড়া না পেয়ে বেশ একচোট নাড়া দিতে আমি—‘এ্যাঁ—এ্যাঁ—এ্যাঁ বলে ঘুরে চাইলাম ওর দিকে। বুক থেকে যেন একটা পাষাণভার নামিয়ে খুব বড় একটা নিশ্বাস পড়ল। দুখন জিজ্ঞেস করল—‘কী? অমন করছিলেন কেন?’
পুরো সাড়টা ফিরে আসেনি তখনও; আমি ওপরের দিকে আঙুলটা তুলে ধরলুম।
‘কৈ কিছু নয় তো।’ বলে একটু চেয়ে থেকে ওর চোখ দুটোও যেন কি রকম হয়ে এসেছে। আমিই একটা ঠেলা দিয়ে বললুম—‘তুই আগে এক ছিলিম সাজ তাড়াতাড়ি, অনেকক্ষণ খাইনি তামাক।”
ওর মতিভ্রমের মুখেই আমার চৈতন্যটা পুরোপুরি ফিরে এসেছে আর কি। ততক্ষণে বাগানের পিছনে চাঁদটাও অনেকখানি উঠে এসেছে তো।
কঙ্কাল টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
আমার লোকের সঙ্গ পেয়ে সাহস ভালোভাবেই ফিরে এসেছে।
আর অর্জুনের মতন সে-অবস্থা নেই তো। কীর্তিটা যে নিতান্ত এই উঠতি চাঁদেরই, সেটা আকাশে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে যে কঙ্কালও এগিয়ে এসেছে আমার দিকে…”
“কিন্তু অর্জুনের কথাটা তো বুঝলুম না মাস্টারমশাই।”
“বুঝলে না?”—একটু হেসেই বললেন—“অর্জুনের মনের একাগ্রতা ছিল খুব বেশি। গুরুর কাছে বাণ-ছোঁড়ার পরীক্ষা দিতে গেলেন, পাখির চক্ষু ভিন্ন আর কিছু দেখতে পেলেন না,—দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরেও তাই। তাঁর ছিল ওটা স্বাভাবিক শক্তি। আমার ভয়ের তাড়সে ওই একাগ্রতা এসে গিয়েই তো অবস্থাটা এইরকম দাঁড়িয়েছিল—সব মুছে গিয়ে শুধু বৌদির দিদিমার কঙ্কালটা ছিল দাঁড়িয়ে—একমনে তার হাত, পা, মুখ, দাঁত, চোখ—এমন কি হাসিটুকুও স্পষ্ট করে তুলেছি—লিয়ন না থাকলে ওই এককে সামনে রেখে আমি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিলুম।—নয় কি?”
হালুয়া এসে পড়ল। এবার বাটিটা-সুদ্ধ ওর সামনে ধরে দিলেন মাস্টারমশাই।
২০ মার্চ ১৯৬০