একটি পাড়াগাঁয়ের মেয়ের প্রেমকাহিনী – সরলাবালা সরকার
প্রেম না হলে কোনও কাহিনীই হয় না। স্বামীজির মতো যিনি মহাসাধু, তিনিই বলে গিয়েছেন,
“শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি
জীবনে সত্য সার,
তরঙ্গ আকুল ভবঘোরে এক তরী
করে পারাপার।
আর সেই তরণীটি হল ‘প্রেম’।
আবার বঙ্কিমবাবু লিখেছেন, “বাল্যপ্রণয়ে অভিসম্পাত আছে।” তাঁর ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাস সেই অভিসম্পাতেরই কাহিনী।
কিন্তু সব জায়গাতেই কি একথা খাটে? অন্তত দজ্জাল মেয়ে ‘অনি’র বেলায় তো তা খাটেনি।
দজ্জালকে কে না ভয় করে?—বাবা, মা, এমনকী পাঠশালার গুরুমশায় পর্যন্ত। তাই মেয়েকে রাখতে পারেননি অন্নপূর্ণার মা।
‘অনু’ ‘অনামুখী’ ‘মুখপুড়ি’ ‘হাড়হাবাতি’ ‘পাড়াকুঁদুলি’—শ্রীকৃষ্ণের যেমন সহস্র নাম, অন্নপূর্ণার সেইরকম সহস্র নাম না হলেও একশো নাম তো বটেই, কোনও নামেই অন্নপূর্ণার আপত্তি নেই। তাই শিশির যখন ডাকে তাকে ‘অনুভা’ বলে তখন সে যেমন হাসিমুখেই উত্তর‘ দেয়, মা যখন ডাকেন ‘অনামুখী’ বলে তখনও সে তেমনিই সহজভাবেই উত্তর দেয়। সে জানে দুটো নামই তারই ঠিক ঠিক নাম। তাই সে সহজভাবেই বুঝে নিয়েছে যার মুখে যে নামটা মানায়।
শিশির আর অন্নপূর্ণা চার বছরের ছোট বড়,—কিন্তু তারা যেন পিঠোপিঠি ভাইবোন, এইভাবেই কেটেছে তাদের ছেলেবেলা। দুজনেই জলের পোকা, সাঁতার দিতে পেলে আর কিছু চায়না। ডুবসাঁতার, চিতসাঁতার, দাঁড়সাঁতার—সাঁতারের রকম রকম কায়দা। দুজনেই গাছে উঠেছে পাল্লা দিয়ে, কে কত মগডালে উঠতে পারে। দুজনেই মারামারিতে ওস্তাদ—অন্নপূর্ণা খামচিয়ে দিয়েছে, শিশির টেনেছে বিনুনি ধরে। আবার দুজনেই দুজনকে খোসামোদও করেছে, আমসত্ত্ব চুরি করে এনে দিয়ে, আর ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে দিয়ে। এইভাবেই কেটেছে ছেলেবেলা। সেই শিশিরকে পড়াশুনার জন্য যশোরে যেতেই হল। মামার বাড়ি আছে যশোরে, মামা উকিল। মেধাবী ছেলে, গ্রামেই ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পেয়েছে তিন টাকা করে।
আর অন্নপূর্ণা? সেও হার মানবার মেয়ে নয়, পড়তে লাগল ‘নয়শো রূপেয়া’ নাটক, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নবীন তপস্বিনী’, বঙ্কিমবাবুর ‘দুর্গেশনন্দিনী’, রমেশ দত্তের ‘মাধবীকঙ্কণ’।
পড়ে বুঝতে পারল যে সরলা আর রঞ্জনের যদি বিয়ে না হত তা হলে তাদের মরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। যদি তার শিশিরদাদার সঙ্গে বিয়ে না হয় তা হলে সে কিছুতেই বাঁচবে না।
জলে সাঁতার দিতে নামলেই তার প্রতাপ আর শৈবলিনীর অগাধ জলে সাঁতারের কথা যখন মনে পড়ত তখন সে ভাবত, সাঁতরে সাঁতরে তারা পালিয়ে যাবে অন্যদেশে।
একদিন শিশির যখন গ্রামে এল তখন এই প্রস্তাবও সে করেছিল তার কাছে, কিন্তু শিশিরদাদা যেন কী? প্রস্তাবটা শুনেই তাকে ধমকে দিয়েছিল, বলেছিল, ‘এইসব বিদ্যে হয়েছে বুঝি তোর উপন্যাস পড়ে? খরবদার আর উপন্যাস পড়বিনে।’
উপন্যাস পড়বে না তো কী পড়বে? খালি ভূগোল আর ব্যাকরণ? ‘স্বর্ণলতা’ বইখানা সে পাঁচবার পড়েছে, কিন্তু তবু আবার পড়তে ইচ্ছে করে।
পড়তে পড়তে কত যে উদ্বেগ, কত যে ভয় কী হবে কী হবে এর পর? স্বর্ণলতা কি উদ্ধার পাবে শশাঙ্কশেখরের হাত থেকে, না জোর করেই তার বিয়ে দেবে? হিন্দুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তো আর উপায় নেই।
সেই সঙ্গে নিজের জন্যও ভাবনা হত, যদি বাবা আর মা তার বিয়ে দিয়ে দেন। সেই কেশব ঘোষের সঙ্গে, কী হবে তা হলে? বড়মানুষ তারা, পঞ্চাশ বিঘা ভাল ধানী জমি তাদের, সেই জমি থেকে দশ বিঘে দিতে চেয়েছে কেশব ঘোষের বাবা তার বাবাকে। বাবা কি এ লোভ ছাড়তে পারবেন? মাকে দেবে সোনার বাউটি, আর নাকে নথ। এই সব কথাই হচ্ছে আজকাল, শুনে ভয় হচ্ছে অন্নপূর্ণার, কী হবে তার! শিশির রইল যশোরে, তারই যেন সব দায়।
মনের দুঃখে কবিতা লিখে ফেলল একটা। এর আগেও কবিতা লিখেছে সে হাতির সম্বন্ধে,—যেমন “অত বড় জন্তু হয়ে কেন থাক মানুষের বশে?”
লিখেছে—গোরুর সম্বন্ধে, “বাছুর পায় না দুধ, মানুষ নির্দয় বড় সব দুধটুকু দুয়ে নেয় ঘটি ভরে, হাম্বা হাম্বা ডাক ছেড়ে বাছুর চেঁচিয়ে মরে।”
কিন্তু সে পদ্যগুলো তেমন জুতসই হয়নি। এবারের পদ্যটা হয়েছে খাসা।
“কেশবে কে সবে সখি, যে সবে সে সোক। (হ উহ্য আছে। সোক অর্থাৎ সহুক)। শিশিরে পেতেছি শয্যে যা হোক তা হোক।” নিজে নিজেই আওড়ালে বার কতক। বাঃ, সুন্দর হয়েছে ত!
ওই ভুঁদো কেশব, কে ওকে সইবে? আমি ওকে বিয়ে করব না—করব না—করব না—এই তিন সত্যি করলাম। দেখি কে আমার বিয়ে দিতে পাবে?
পানপত্রের দিন ঠিক হয়ে গিয়েছে। কেশব ঘোষের বাবা জগদ্দুর্লভ ঘোষ গাড়িভর্তি জিনিস নিয়ে আসছে নওগাঁ থেকে। নওগাঁর বড় উকিল সে।
নাগরি নাগরি গুড়—মানকচু গোটা দশ বারো। হাঁড়িভর্তি তিলপাটালি, এক চাঙারি পান, আরও কত কী জিনিস।
সর্বনাশ! পানপাত্র হয়ে গেলে আর তো বিয়ে বন্ধ হবে না।
ছুটে গেল অন্নপূর্ণা মার কাছে। “বিয়ে যে দেবে তা আমার মত নিয়েছ?”
মা গালে হাত দিলেন। তাজ্জব কথা! মেয়ের বিয়ের আবার নিতে হবে মেয়ের মত? কালে কালে কতই শুনবেন!
অন্নপূর্ণা বলে, “কেন, সেকালে রাজার মেয়েদের বিয়ের মত নেওয়া হত না? এই তো সেদিন পড়লে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। দ্রৌপদী পষ্টাপষ্টি বললেন, “আমি কর্ণকে বিয়ে করব না।’ তোমরা যে সাবিত্রীর ব্রত কর, সেই সাবিত্রী কী করেছিলেন—নারদ মুনিকেই মুখের উপরই বললেন, “সত্যবান ছাড়া অন্য কাউকেই আমি বিয়ে করব না।’ তোমাকে বলছি ‘শিশির ছাড়া আমি আর কাউকেই বিয়ে করব না, কিছুতেই না।”
মা বললেন, “এই বিদ্যে হয়েছে তোমার? হতভাগা শিশির জপিয়ে জপিয়ে এই করেছে তোমাকে? আছে কী তাদের? এক কাঠা জমিও নেই। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাবি কী? তোর জানো কি ডালচালের সিধে পাঠাতে হবে?”
“কে তোমাদের ডালচাল চায়? তুমি পাবে হাতের সোনার বাউটি, আর বাবা পাবেন দশ বিঘে জমি। সেই লোভেই বলি দিচ্ছ মেয়েকে।”
“কী বললি? বলি দিচ্ছি? বড্ড মুখ হয়েছে না? বলি দিচ্ছি? দোষটা কী দেখলি কেশবের? একটু বয়েস হয়েছে, আর একটু ট্যারা। কোথায় আছে ময়ূর-চূড়া কার্তিক? না, কুমোরবাড়ি বায়না দিয়ে গড়িয়ে আনতে হবে?”
“আছে, তোমার চোখের সম্মুখেই আছে। শিশিরকে দেখতে পাও না? না, টাকার লোভে চোখ গিয়েছে অন্ধ হয়ে?”
মা এবার ভীষণ রেগে গেলেন, “গাড়িভর্তি জিনিস নিয়ে পানপত্র করতে এসেছে যারা, তাদের আমি ফিরিয়ে দেব বলতে চাস? আজ তোর পত্তর করবই করব, পুরুত ঠাকুরকে খবর পাঠিয়েছি। পাড়াশুদ্ধ নেমন্তন্ন করেছে তারা।…ওমা, অনি, তোর চোখ দুটো যে ফুলেছে দেখছি। চোখ উঠল না কি? তা হলেই তো চিত্তির। কাল আশীর্বাদ করবে তারা, এরকম চোখ দেখে বলবে হয়তো মেয়ের চোখে কোন দোষ আছে।”
অন্নপূর্ণা মাকে ধমক দিয়ে উঠল, বলল, “মা, চুপ করবে? আমার চোখ নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। দরদ কত? তারা কী বলবে তাই নিয়েই তো তোমার ভাবনা, আমি মরি কি বাঁচি তাতে কী যায় আসে তোমার? বাউটি তো পাবে,—সেই আনন্দেই থাক। পাওয়াচ্ছি বাউটি, বাউটির বদলে হাতে দড়ি পড়বে দেখো। দীঘির জলে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরব, আর লিখে রেখে যাব—মায়ের যন্ত্রণায় ডুবে মরলাম।”
মা আর সহ্য করতে পারলেন না। এসব কী বাক্যি? কী দজ্জাল মেয়ে রে বাবা! সাত জন্মে এমন দজ্জাল কেউ দেখেনি। যাক, ভালয় ভালয় পানপত্রটা হয়ে যাক, কী জানি তখন আবার কী হুজ্জুত বাধায়!
পানপত্রের সমস্ত প্রস্তুত, কুটুম্বস্বজন উপস্থিত হয়েছেন। পুরুত হাঁকছেন, “মেয়ে আনো, মেয়ে আনো।” থালার উপর ধানদুর্বা, দই আর, সিঁদুর মাখানো একটা আকবরি মোহর—এই মোহর দিয়ে দস্তখত দিয়ে দুই পক্ষের সম্মতি স্বাক্ষরিত হবে। মোহরটা ছিল লক্ষ্মীর কৌটোয়।
কিন্তু মেয়ে কোথায়? অন্নপূর্ণা অদৃশ্য হয়েছে। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ঢেঁকশাল, ধানের গোলার নীচে, মল্লিকদের বাড়ি—না, কোনখানেই না।
তবে কি সত্যিই দীঘিতে ডুবেছে? দীঘিতে জাল ফেলা হল। কিন্তু পাওয়া গেল না।
বরের বাপ ফিরে গেলেন, গাড়ি ভর্তি জিনিস গাড়ির ভিতরই রইল। বললেন, “থাক পড়ে ওসব। শুভকর্মের নাম করে যা এনেছিলাম তা আর ফিরিয়ে নিয়ে যাব না।”
আক্ষেপ করে বললেন, “বরং মৌলিকে বিয়ে দেব ছেলের, বংশজ হয়ে থাকবে। আমার কুলক্রিয়ায় অরুচি হয়েছে।”
সবাই শুনলে। সবাই বললে, “ছি ছি, এমন দজ্জাল মেয়ের মরে যাওয়াই ভাল। ও মেয়ের আর বিয়ে হবে না।”
কিন্তু মেয়ে কোথায়…এইটুকু বাচ্চা সে কোথায় রইল সারারাত, এই শীতের রাত্রে?
অগ্রহায়ণ মাস, চাষির ছেলে শেষরাত্রে খেজুর রস চুরি করতে গিয়ে দেখলে, গাছতলায় একটা ডুরে কাপড়।
ও বাবা পেতনি না কি? অন্নপূর্ণা নয় তো? হয়তো চুরি করতে এসেছিল খেজুর রস!
ও মা, এ যে অসাড় হয়ে পড়ে আছে। মরে গিয়েছে নাকি? শেষে কি খুনের দায়ে পড়ব?
চেঁচিয়ে উঠল সে, “মিত্তির মশাই, আসুন শিগগিরি, অনুদিদি এই গাছতলায় পড়ে আছে।”
মেয়ে অজ্ঞান, ভীষণ জ্বর গায়ে, ধান দিলে খই হয় এমনি গায়ের তাত। মা মাথা কুটতে লাগলেন। আবাগি যা বললে তাই করলে শেষে!
কবিরাজ গ্রামের মানুষ, অন্নপূর্ণাকে খুবই ভালবাসেন। রোগী দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।
বাতশ্লেষ্মা বিকার। বাঁচা কঠিন। শহর থেকে ডাক্তার আনতে হবে।
বিড়-বিড় করে খালি বকছে অন্নপূর্ণা। যেন কোনও কবিতা আবৃত্তি করছে। কান পেতে শুনলে যা বোঝা যায়, তা কেবল “শিশির শিশির” এই দুটো কথা।
নিজের কবিতাই আবৃত্তি করছিল অন্নপূর্ণা, “শিশিরে শয্যে পেতেছি যা হবে তা হোক।”
অন্নপূর্ণার বাবার ওই—একটি মাত্র মেয়ে, নিশ্বাস ফেললেন, শিশিরের সঙ্গে বিয়ে দিলে মেয়েটা বেঘোরে মারা যেত না।
মা বললেন, “অমন মেয়ের মরে যাওয়াই ভাল। মেয়েসন্তান, যদি বাঁচে ওর কি আর বিয়ে হবে?”
শিশিরের বাবা খবর পেয়ে এসেছেন যশোর থেকে।
তিনি বললেন, “মালক্ষ্মী যদি আমার ঘরে আসেন আমি তাঁকে মাথায় করে নেব। বিয়ে হবে না? ওই মেয়ের আবার বিয়ে হবে না? শিশির, যা একবার কাছে, দেখি তোর ডাকে সাড়া দেয় কি না?”
তিন দিন তিন রাত্রি একইভাবে বিছানার পাশে বসে ছিল শিশির। পরীক্ষায় জেলার মধ্যে সেরা হয়ে পাশ হয়েছে, সোনার মেডেল পেয়েছে, কুড়ি টাকার জলপানি পেয়েছে, কাকে শোনাবে এ সব কথা?—কেবল শুনছে অন্নপূর্ণা ফিস্ফিস্ করছে
“কেশবে কে সবে সখি,
যে সবে সে সোক,
শিশিরে পেতেছি শয্যে যা হবে
তা হোক।
দশ বছর পরের কথা। শিশির তখন যশোর কোর্টের সব চেয়ে বড় উকিল।
যখন তখন শোনাত অন্নপূর্ণাকে—“একটা কবিতা শুনবে—
কেশবে কে সবে সখি
যে সবে সে সোক
শিশিরে পেতেছি শয্যে
যা হবে তা হোক।”
কেমন কবিতাটা বল দেখি?
অন্নপূর্ণা বলত, “তোমার লজ্জা করে না আবার মুখ নেড়ে কবিতা শোনাতে। দজ্জাল মেয়ের কাছে তো হেরে গেল সবাই। পালিয়ে এলে যশোরে কিন্তু হার মানলে কি ওই দজ্জাল মেয়ে?”
“না গো না, পালাইনি, পরীক্ষা এল যে, তাই আসতে হয়েছিল, তখন কি জানতাম রাই উন্মাদিনী প্রেমের বলে অসম্ভবও সম্ভব করতে পাবেন। দজ্জাল মেয়ের দজ্জালির কাছে হার মানতে হয় বিধাতা পুরুষকেও। কথায় বলে, ‘জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিনই বিধাতা নিয়ে।’ এখন দেখছি বিয়েটা বিধাতার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে এক গেয়ে দজ্জাল মেয়ে।”
১১ নভেম্বর ১৯৬০