অঙ্গার – প্রবোধকুমার সান্যাল
বছর আষ্টেক হল দিল্লিতে আমি চাকরি করি। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক কম। কোনো কোনো বছরে কলকাতায় এক আধবার আসি, ঘুরে বেড়িয়ে সিনেমা দেখে আবার ফিরে চলে যাই। নৈলে, ইদানীং আর আসা হয়ে ওঠে না।
বছর তিনেক আগে ফরিদপুর থেকে শোভনা আমাকে চিঠি লিখেছিল—ছোড়দাদা, তুমি নিশ্চয় শুনেছ আজ ছ’মাস হতে চলল আমার কপাল ভেঙেছে। ছেলেটাকে নিয়ে কিছু দিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলুম, কিন্তু সেখানেও আর থাকা চললো না। তোমার ভগ্নিপতি এক আধশো টাকা যা রেখে গিয়েছিলেন, তাও খরচ হয়ে গেল। আর দিন চলে না। তুমি আমার মামাতো ভাই হলেও তোমাকে চিরদিন সহোদর দাদার মতন দেখে এসেছি। ছেলেটাকে যেমন করে হোক মানুষ করে তুলতে না পারলে আমার আর দাঁড়াবার ঠাঁই কোথাও থাকবে না। এদিকে যুদ্ধের জন্য সব জিনিসের দাম ভীষণ বেড়ে গেছে। নুটু পাস করে চাকরি খুঁজছে, এখনও কোথাও কিছু সুবিধে হয়নি। মা ভেবে আকুল। ইস্কুলের মাইনে দিতে না পারায় হারুর পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবার কোম্পানির কাগজ ভেঙে সব খাওয়া হয়ে গেছে। তুমি যদি এ অবস্থায় দয়া করে মাসে মাসে দশটি টাকা দাও, তাহলে অনেকটা সাহায্য হতে পারে। ইতি—
দিল্লিতে আমার এই চাকরির খোঁজ প্রথম পিসেমশায় আমাকে দেন, সুতরাং শোভনার চিঠি পেয়ে স্বৰ্গত পিসেমশায়ের প্রতি আমার সেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতাটা হৃদয়াবেগের সঙ্গে ঘুলিয়ে উঠল। সেই দিনই আমি পঁচিশটি টাকা পাঠিয়ে দিলুম এবং শোভনাকে জানালুম তোর ছেলে যতদিন না উপার্জনক্ষম হয়, ততদিন প্রতি মাসে আমি তোর নামে পনেরো টাকা পাঠাব।
সেই থেকে শোভনা, পিসিমা, নুটু, হারু—সকলের সঙ্গেই আমার চিঠিপত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পুজোর সময় এবং নতুন বছরের আরম্ভেও আমি কিছু কিছু টাকা তাদের দিতুম। তিন বছর এই ভাবেই চলে এসেছে।
ইতিমধ্যে যুদ্ধের গতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কি প্রকার অবস্থা দাঁড়িয়েছে, অথবা শোভনারা কিভাবে তাদের সংসার চালাচ্ছে, এর পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ খবর আমি নিইনি, দরকারও হয়নি। মাঝখানে বোমার ভয়ে যখন কলকাতা থেকে বহু লোক মফঃস্বলের দিকে এখানে ওখানে পালিয়েছিল, সেই সময় শোভনার চিঠিতে কেবল জানতে পেরেছিলুম, ফরিদপুরে জিনিসপত্রের দর খুব বেড়ে গেছে। অনেক লোক এসেছে—ইত্যাদি। কিন্তু টাকা আমি নিয়মিত পাঠাই, নিয়মিত প্রাপ্তিস্বীকার এবং চিঠিপত্রও আসে। যা হোক এক রকম শোভনাদের দিন কাটছে।
কিন্তু প্রায় ছ’মাস আগে মাসিক পনেরো টাকা পাঠাবার পর দিন কয়েক বাদে টাকাটা দিল্লিতে ফেরত এলো। জানতে পারলুম ফরিদপুরের ঠিকানায় পিসিমারা কেউ নেই। কোথায় তারা গেছে, কোথায় আছে, কিছুই জানা যায়নি। চিঠি দিলুম, তার উত্তর পাওয়া গেল না। আর কিছুকাল পরে আবার একবার মনি-অর্ডারে টাকা পাঠালুম, কিন্তু সে টাকাও যথাসময়ে ফেরত এলো। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ করে গিয়েছিলুম। ভাবলুম, টাকার দরকার হলে তারা নিজেরাই লিখবে, আমার ঠিকানা তো আর তাদের অজানা নয়।
কিন্তু আজ প্রায় তিন বছর পরে হঠাৎ কলকাতায় যাবার সুযোগ হলো এইমাত্র সেদিন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সাহেব যাচ্ছেন কলকাতায় তদ্বির-তদন্তের কাজে। আমাকেই সঙ্গে যেতে হবে। ভাবলুম, এই একটা সুযোগ। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে কোনো একটা শনিবারে যাব ফরিদপুরে সোমবারটা নেব ছুটি—দিন দুয়েকের মধ্যে দেখাশোনা করে ফিরব। একটা কৌতূহল আমার প্রবল ছিল, যাদের বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে কোনো সংস্থান হবার কোনো আশা নেই, সেই দরিদ্র পিসিমা আর শোভনা পনেরো টাকা মাসোহারার প্রতি এমন উদাসীন হলো কেন? শুনেছিলাম, ফরিদপুর টাউনে ইতিমধ্যে কলেরা দেখা দিয়েছিল, তবে কি তাদের একজনও বেঁচে নেই? মনে কতকটা দুর্ভাবনা ছিল বৈ কি।
সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় এলুম এবং এসে উঠলুম পাঁচগুণ খরচ দিয়ে এক হোটেলে। এসে দেখছি এই বিরাট মহানগর একদিকে হয়ে উঠেছে বাঙালিপ্রধান ও আর একদিকে চলছে যুদ্ধ সাফল্যের প্রবল আয়োজন। দেশের সবাই বলছে, দুর্ভিক্ষ; গভর্নমেন্ট বলছেন না, এ দুর্ভিক্ষ নয়, খাদ্যাভাব। দুটোর মধ্যে তফাৎ কতটুকু সে আলোচনা আপাতত স্থগিত রেখে সপ্তাহখানেক ধরে আমার কর্তব্যস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলুম। এর মধ্যে আর কোনোদিকে মন দিতে পারিনি। এইভাবেই চলছিল। কিন্তু ছোট পিসির মেজ ছেলে টুনুর সঙ্গে একদিন শেয়ালদার বাজারের কাছে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতেই, কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। একটা ফুলকাটা চটের থলেতে সের পাঁচেক চাল আর বাঁ-হাতে ডাঁটাশাক নিয়ে সে বিকেলের দিকে পথ পেরিয়ে যাচ্ছিল। দেখা হতেই সে থমকে দাঁড়াল। বললুম, কিরে টুনু?
চমকে সে ওঠেনি, কিছুতেই বোধ হয় সে আর চমকায় না। কেবল তার অবসন্ন চোখ দুটো তুলে সে শান্তকণ্ঠে বললে, কবে এলে, ছোড়দা?
তার হাত ধরে বললুম, তোদের খবর কি রে?
খবর?—বলে সে পথের দিকে তাকাল। কসাইখানার মৃত্যুপথযাত্রী রুগ্ন গাভীর মতো দুটো নিরীহ তার চোখ; যেন এই শতাব্দীর অপমানে সে-চোখ আচ্ছন্ন। মুখ ফিরিয়ে বললে, খবর আর কি? কিছু না।
হাসিমুখে বললুম, এ কি তোর চেহারা হয়েছে রে? পঁচিশ বছর বয়স হয়নি, এরই মধ্যে যে বুড়ো হয়ে গেলি?
আমার মুখের দিকে চেয়ে টুনু বললে, বাংলাদেশে থাকলে তুমিও হতে ছোড়দা—
কথাটায় অভিমান ছিল, ঈর্ষা ছিল, হতাশা ছিল। বললুম, চাল কিনলি বুঝি?
টুনু বললে, না আপিস থেকে পাই কনট্রোলের দামে। চারজন লোক, কিন্তু সপ্তাহে ছ’ সেরের বেশি পাইনে। এই তো যাব, গেলে রান্না হবে। তোমার খবর ভালো, দেখতেই তো পাচ্ছি। বেশ আছো।— আচ্ছা, চলি। যুদ্ধ থামবার পর যদি বাঁচি আবার দেখা হবে।
বললুম, শোভনাদের খবর কিছু জানিস? তারা কি ফরিদপুরে নেই।
না—বলে একটু থেমে টুনু পুনরায় বললে—তাদের খবর আমার মুখ দিয়ে শুনতে চেয়োনা ছোড়দা?
কেন রে? তারা থাকে কোথায়?
বৌবাজারে, তিনশো তেরোর এফ নম্বরে। হ্যাঁ, যেতে পারো বৈকি একবার। আসি তা হলে—এই বলে টুনু আবার চলল নির্বোধ ও ভারবাহী পশুর মতো ক্লান্ত পায়ে।
টুনুর চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে যেরকম নিরুৎসাহ লক্ষ্য করলুম, তাতে শোভনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার রুচি চলে যায়। কলকাতায় এসে তারা যদি শহরতলীর আনাচে-কানাচে কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো, তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু বৌবাজার অঞ্চলের বাসাভাড়াও তো কম নয়। একটা কথা আমার প্রথমেই মনে হলো, নুটু হয়তো ভাল চাকরি পেয়েছে। আজকাল অন্ন দুর্লভ, চাকরি দুর্লভ নয়। যারা চিরনির্বোধ ছিল, তারা হঠাৎ চতুর হয়ে উঠল এই সম্প্রতি। একশো টাকার বেশি মাসিক পাবার কল্পনা যাদের চিরজীবনেও ছিল না, তারা যুদ্ধ সরবরাহের কনট্রাক্টে সহসা হয়ে উঠল লক্ষপতি এবং দুর্ভিক্ষকালে চাউলের জুয়াখেলায় কেউ কেউ হল সহস্রপতি। হয়তো নুটুর মতো বালকও এই যুদ্ধকালীন জুয়ায় ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে। এ যুদ্ধে কী না সম্ভব?
ওদের খবর নেবো কি নেবো না এই তোলাপাড়ায় আর কাজের চাপে কয়েকটা দিন আরও কেটে গেল। হঠাৎ অফিসের সাহেব জানালেন, আগামীকাল আমাদের দিল্লি রওনা হতে হবে। এখানকার কাজ ফুরিয়েছে।
আমারও এখানে থাকতে আর মন টিকছিল না। আমার হোটেলের নীচে সমস্ত রাত ধরে শত শত কাঙালির কান্না শুনে বিনিদ্র দুঃস্বপ্নের এই কটা দিন কোনোমতে কাটিয়েছি—আর পারিনে। দুর্গন্ধে কলকাতা ভরা। তবু এখান থেকে যাবার আগে একবারটি পিসিমাদের খবর না নিয়ে যাওয়ার ভাবনায় মন খুঁত খুঁত করছিল। বিশেষ করে যাবার আগের দিনটা ছুটি পেলুম জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার জন্যে। একটা সুযোগ পাওয়া গেল।
বৌবাজারের ঠিকানা খুঁজে বার করতে আমার বিলম্ব হল না। মনে করেছিলুম তারা যে-অবস্থাতেই থাকুক না কেন, হঠাৎ গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা চমক দেবো। কিন্তু বাড়িটা দেখে আমিই দিশাহারা হয়ে গেলুম। সামনে একটা গেঞ্জি বোনার ঘর, তার পাশে লোহার কারখানা, এদিকে মনিহারি দোকান, ভিতরে ভূষিমালের আড়ত। নীচেকার উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, সমস্ত নীচের তলাটায় কতকগুলি লোক শোণদড়ির জাল বুনছে ক্ষিপ্রহস্তে। উপর তলাটায় লক্ষ করে দেখি, বহু লোকজন। ওটা যে মেসবাসা, তা বুঝতে বিলম্ব হল না। একবার সন্দেহক্রমে বাড়ির নম্বরটা মিলিয়ে দেখলুম। না, ভুল আমার হয়নি—টুনুর দেওয়া এই নম্বরই ঠিক।
এদিক ও ওদিকে দু’চারজনকে ধরে জিজ্ঞেস পড়া করতে যখন বেশ একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলেছি, দেখি সেই সময়ে বছর বারো তেরো বয়সের একটি মেয়ে সকৌতুকে উপর তলাকার সিঁড়ি বেয়ে মেসের দিকে যাচ্ছে এবং তাকে দেখে চার পাঁচটি লোক উপর থেকে নানারঙ্গে হাতছানি দিচ্ছে। আমি তাকে দেখেই চিনলুম, সে পিসিমার ছোট মেয়ে। তৎক্ষণাৎ ডাকলুম, মিনু?
মিনু ফিরে তাকাল। বললুম, চিনতে পারিস আমাকে?
না।
তোর মা কোথায়?
ভেতরে
বললুম, আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল দেখি? এ যে একেবারে গোলকধাঁধা। আয়, নেমে আয়।
মিনু নেমে এল। বললে, কে আপনি?
পোড়ারমুখি।—বলে তার হাত ধরলুম। বললুম, চল ভেতরে তোর মার কাছে গিয়ে বলব আমি কে! মুখপুড়ি, আমাকে একেবারে ভুলেছিস?
আমাকে দেখে উপরতলাকার লোকগুলি একটু সরে দাঁড়াল। বেশ বুঝতে পারছিলুম, আমার হাতের মধ্যে মিনুর ছোট্ট হাতখানা অস্বস্তিতে অধীর হয়ে উঠেছে। উপরে উঠতে গিয়ে সে বাধা পেয়েছে, এটা তার ভাল লাগেনি। তার দিকে একবার চেয়ে আমি নিজেই তার হাতখানা ছেড়ে দিলুম। মিনু তখন বললে, ওই যে, চৌবাচ্চার পাশে গলির ভেতর দিয়ে সোজা চলে যান ওদিকে সবাই আছে।
এই বলে সে ওপরে উঠে গেল। চোখেমুখে তার কেমন যেন বন্য উদ্দ্ভ্রান্তের ভাব। এই সেদিনকার মিনু—পরনে একখানা পাতলা সস্তা ডুরে, চেহারায় দারিদ্র্যের রুক্ষ শীর্ণতা—কিন্তু এরই মধ্যে তারুণ্যের চিহ্ন এসেছে তার সর্বাঙ্গে। আমি একটা বিষণ্ণ নিশ্বাস ফেলে ভিতর দিকে পা বাড়ালুম।
বিস্ময় চমক দেবার উৎসাহ আর আমার ছিল না। সরু একটা আনাগোনার পথ পেরিয়ে আমি ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলুম, পিসিমা?
কে?—ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এলো এবং তখনই একটি স্ত্রীলোক এসে দাঁড়াল। বললে, কাকে চান?
অপরিচিত স্ত্রীলোক। রং কালো, নাকে নাকছাবি, মুখে পানের দাগ, পরনে কাচের চুড়ি। এই প্রকার স্ত্রীলোকের সংখ্যা বৌবাজারেই বেশি। বললুম, তুমি কে?—এই বলে অগ্রসর হলুম।
স্ত্রীলোকটি বললে, আমি এখানকার ভাড়াটে।
এমন সময় একটি ছেলে বেরিয়ে এল। দেখেই চিনলুম, সে হারু। হাসিমুখে বললুম, কি হারু, চিনতে পারিস? তোর মা কোথায়?
সে আমাকে চিনলো কি না জানিনে, কিন্তু সহাস্যে বললে, ভেতরে আসুন।মা রাঁধছে।
অগ্রসর হয়ে বললুম, তোর দিদি কোথায়?
দিদি এখুনি আসবে, বাইরে গেছে। আসুন না আপনি?
বেলা বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু এ বাড়ির বাসিপাট, এখনও শেষ হয়নি। দারিদ্র্য এর আগে এমন করে আর আমার চোখে পড়েনি। ছায়ামলিন দরিদ্র ঘর-দুখানার ভিজা দুর্গন্ধ প্রথমেই নাকে এলো,— এ পাশে নর্দমা, ওপাশে কুৎসিত কলতলা। এক ধারে ঝাঁটা, ভাঙা হাঁড়ি কয়লা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে অসভ্যতা আর অশিক্ষা মিলে ঘর দুয়ারের কেমন ইতর চেহারা পোড়া কাঠকুটোর ভিড়। ছেঁড়া চটের থলে টাঙিয়ে পায়খানা ও কলতলার মাঝখানে একটা আবরু রক্ষার চেষ্টা হয়েছে। পিসিমাদের মতো শুদ্ধাচারিণী মহিলারা কেমন করে এই নরককুণ্ডে এসে আশ্রয় নিলেন, এ আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য। একটা বিশ্রী অস্বস্তি যেন আমার ভিতর থেকে ঠেলে উপরে উঠে এলো।
রান্নার জায়গায় এসে পিসিমাকে পেলাম। সহসা সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি চটাওঠা একটা কলাইয়ের বাটি মুখের কাছে নিয়ে চা পান করছেন। আমাকে দেখে বললেন, একি, নলিনাক্ষ যে? কবে এলে?
কিন্তু আমি নিমেষের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম তাঁর চা খাওয়া দেখে। পিসিমা হিন্দু ঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা, স্নান আহ্নিক পুজো গঙ্গা স্নান, দান ধ্যান—এই সব নিয়ে চিরদিন তাঁকে একটা বড় সংসারের মহীয়সী প্রতিপালিকার মতো দেখে এসেছি। সদ্যস্নাতা, গরদের থান পরা পিসিমাকে পূজা-অর্চনার পরিবেশের মধ্যে দেখে কত দিন মনে মনে প্রণাম করে এসেছি। কিন্তু তিন বছরে তাঁর একি পরিবর্তন? আমিষ রান্নাঘরে বসে ভাঙা কলাইয়ের বাটিতে চা খাচ্ছেন তিনি?
বললুম, পিসিমা, প্রণাম করবো। পা ছুঁতে দেবেন?
পা বাড়িয়ে দিয়ে পিসিমা বললেন, কলকাতায় আমরা কমাস হল এসেছি, তোমাকে খবর দেওয়া হয়নি বটে। আর বাবা, আজকাল কে কার খবর রাখে বলো। চারিদিকে হাহাকার উঠেছে।
আমি একটু থতিয়ে বললুম, পিসিমা—আপনাদের মাসোহারার টাকা আমি নিয়মিতই পাঠাচ্ছিলুম…কিন্তু আজ ছ’ মাস হতে চলল আপনাদের কোনো খোঁজ খবর নেই?
খবর আর আমরা কাউকে দিইনি, নলিনাক্ষ! পিসিমার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ঔদাসীন্য আর অবহেলায় ভরা। একদিন আমি তাঁর অতি স্নেহের পাত্র ছিলুম, কিন্তু আজ তিনি যে আমার এখানে অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে খুশি হননি, এ তাঁর মুখচোখ দেখেই বুঝতে পারি।
হ্যাঁগা, দিদি—? বলতে বলতে সেই আগেকার স্ত্রীলোকটি হাসিমুখে চাতালের ধারে এসে দাঁড়াল। পিসিমা মুখ তুললেন। সে পুনরায় বললে, তুমি বাজারে যাবে, না আমি যাব, গা? বৌবাজারে আজ এই এত বড় বড় টাটকা তপসে মাছ এসেছে—একেবারে ধড়ফড় করছে!
তার লালাসিক্ত রসনার দিকে তাকিয়ে পিসিমার মুখখানা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে এলো। তিনি বললেন, তুমি এখন যাও, বিনোদবালা।
এমন উৎসাহজনক সংবাদে উৎসাহ না পেয়ে ম্লানমুখে বিনোদবালা সেখান থেকে সরে গেল। পিসিমা বললেন, তোমার কি খুব তাড়াতাড়ি আছে, নলিনাক্ষ?
বিশেষ কিছু না! —বলে আমি হাসলুম—আজকের দিনটা আপনাদের এখানে থাকবো বলেই আমি এসেছিলুম পিসিমা।
তা বেশ ত’ বেশ ত’—তবে কি জানো বাবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট কিনা—বলতে বলতে পিসিমা চা খেয়ে বাটি সরিয়ে দিলেন। আমার থাকার কথায় তাঁর দিক থেকে কিছুমাত্র আনন্দ অথবা উৎসাহ দেখা গেল না।
বললুম, শোভনা কোথায় পিসিমা?
সে আসছে এখুনি, বোধ হয় ও-বাড়ি গেছে।
ঈষৎ অসন্তোষ প্রকাশ করে আমি বললুম, সে কি আজকাল একলা বাসা থেকে বেরোয়?
পিসিমা বললেন, না, তেমন কই? তবে তেলটা নুনটা মধ্যে মাঝে দোকান থেকে আনে বৈকি। বিনোদবালা যায় সঙ্গে।
পিসিমা তাঁর কথার দায়িত্ব কিছু নিলেন না, কিন্তু কেমন একটা মনোবিকারে আমার মাথা হেঁট হয়ে এলো। বললুম, শোভনার ছেলেটি কোথায়? কত বড়টি হয়েছে?
পিসিমা বললেন, তার খুড়ো-জ্যাঠা আমাদের কাছে ছেলেটাকে রাখল না, নলিনাক্ষ। তাদের ছেলে তারা নিয়ে গেছে।
সে কি পিসিমা, অতটুকু ছেলে মা ছেড়ে থাকতে পারবে? শোভনা পারবে থাকতে?
তা পারবে না কেন বলো? এক টাকায় দু সের দুধও পাওয়া যায় না, ছেলেকে খাওয়াবে কি? নিজেদেরই হাঁড়ি চড়ে না কতদিন! অসুখ হলে ওষুধ নেই। শাড়ির জোড়া বারো চোদ্দ টাকা। চাল পাওয়া যায় না বাজারে। আর কতদিন মুখ বুজে সহ্য করবো নলিনাক্ষ? ভিক্ষে কি করিনি? করেছি। রাত্তিরে বেরিয়ে মান খুইয়ে হাত পেতেছি।—বলতে বলতে পিসিমা নিশ্বাস ফেললেন। পুনরায় বললেন, কই, কেউ আমাদের চাল ডালের খবর নেয়নি, নলিনাক্ষ!
অনেকটা যেন আর্তকণ্ঠে বললুম, পিসিমা, টুনুদেরও এই অবস্থা। সবাই মরতে বসেছে আজ, তাই কেউ কারো খবর নিতে পারে না। টুনুর কাছেই আপনাদের ঠিকানা পেলুম।
পিসিমা এতক্ষণ বসেছিলেন, অতটা লক্ষ করিনি। তিনি এবার উঠে দাঁড়াতেই তাঁর ছিন্নভিন্ন কাপড়খানার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালুম। তিনি বললেন, এ বাড়ির ঠিকানা তুমি আর কাউকে দিয়ো না, বাবা।
এমন সময় মিনু এসে দরজার কাছে চঞ্চল হাসিমুখে দাঁড়ালো। বললে, মা, মা, শুনছ? এই নাও একটা আধুলি…হরিশবাবু দিল—
মিনুর মাথার চুল এলোমেলো, পরনের কাপড়খানা আলুথালু। মুখখানা রাঙা, গলার আওয়াজটা উত্তেজনায় কাঁপছে। অত্যন্ত অধীরভাবে পুনরায় সে বললে, যোগীন মাস্টার বললে, কি জানো মা, আজ রাত্তিরে গেলে সেও আট আনা দিতে পারে।
পিসিমা অলক্ষ্যে আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, বেরো—বেরো হারামজাদি এখান থেকে। ঝেঁটিয়ে মুখ ভেঙে দেব তোর।
মিনু যেন এক ফুৎকারে নিবে গেল। মায়ের মেজাজ দেখে মুখের কাছ থেকে সরে গিয়ে সে অনুযোগ করে কেবল বললে, তুমিই তো বলেছিলে!
হারু ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ফের মিছে কথা বলছিস, মিনু? এখন তোকে কে যেতে বলেছিল? মা তোকে রাত্তিরে যেতে বলেছিল না।
পিসিমা ব্যস্তভাবে বললেন, নলিনাক্ষ, তুমি বড্ড হঠাৎ এসে পড়েছ বাবা। এখন ভারি আতান্তর, তুমি ঘরে গিয়ে বসে গে।
ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে এসে তক্তার মলিন বিছানাটার ওপর বসলুম। গলার ভিতর থেকে কি যেন একটা বারম্বার ঠেলে উঠছিল, সেটার প্রকৃত স্বরূপটা আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না। আমি এই পরিবারে মানুষ, আমি এদেরই একজন, এই আত্মীয় পবিবারেই আমার জন্ম। অথচ আজ মনে হচ্ছে এখানে আমি নবাগত, অপরিচিত ও অনাহূত একটা লোক। যারা আমার পিসিমা ছিল, ভগ্নী ছিল, যাদের চিরদিন আপনার জন বলে জেনে এসেছি—এরা তারা নয়, এরা বৌবাজারের বিনোদবালাদের সহবাসী, এরা সেই আগেকার সম্ভ্রান্ত পরিজনদের প্রেতমূর্তি।
মনে ছিল না জানলাটা খোলা। বৌবাজারের পথের একটা অংশ এখান থেকে চোখে পড়ে। সেখানে অসংখ্য যানবাহনের জটলা—ট্রাম, বাস, মোটর, গরুর গাড়ি আর মিলিটারি লরির চাকার আঁচড়ানির মধ্যে শোনা যাচ্ছে অগণ্য মৃত্যুপথযাত্রী দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের আর্তরব। জঞ্জালের বালতি ঘিরে বসে গেছে কাঙালিরা, পরিত্যক্ত শিশুর কঙ্কাল গোঙাচ্ছে মৃত্যুর আশায়, স্ত্রীলোকদের অনাবৃত মাতৃবক্ষ অন্তিম ক্ষুধার শেষ আবেদনের মতো পথের নালার ধারে পড়ে রয়েছে।
জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে এদিকে মুখ ফিরাবো, এমন সময় শুনি হারু আর মিনুর কান্না—পিসিমা একখানা কাঠের চেলা নিয়ে তাদের হঠাৎ প্রহার করতে আরম্ভ করেছেন। উঠে গিয়ে বলবার ইচ্ছা হল, তাদের কোনো অপরাধ নেই—নিরপরাধকে অপরাধী করে তোলার জন্যে দিকে দিকে যেসব ষড়যন্ত্রের কারখানা তৈরি করা হয়েছে, ওরা সেই ফাঁদে পা দিয়েছে, এইমাত্র। কিন্তু উঠে বাইরে যাবার আগেই বাইরে শোনা গেল, কলকষ্ঠের সম্মিলিত খলখলে হাসি। সেই হাসি নিকটতর হয়ে এলো।
ঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখি, বিনোদবালার সঙ্গে শোভনা। আমি তাকে ডাকতেই সে যেন সহসা আঁতকে উঠল। দরজার কাছে এসে শোভনা শিউরে উঠে বললে, একি ছোড়দাদা? তুমি ঠিকানা পেলে কেমন করে?
বললুম, এমনি এলুম সন্ধান করে। কেমন আছিস তোরা শুনি?
নিজের চেহারা এতক্ষণে শোভনার নিজেরই চোখে পড়ল। জড়সড় হয়ে বললে আমি আশা করিনি তুমি আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাবে।
বললুম, কিন্তু আমাকে দেখে কই একটুও খুশি হলিনে তো?
শোভনা চুপ করে রইল। পুনরায় বললুম, এতদিন বাদে তোদের সঙ্গে দেখা। কত দেশ বেড়ালুম, দিল্লিতে কেমন ছিলুম—এইসব গল্প করার জন্যেই এলুম রে। তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিলি, থাকতে পারবি?
না পারলে চলবে কেন, ছোড়দা?
এদিক ওদিক চেয়ে আমি বললুম, কিন্তু এ-বাড়িটা তেমন ভালো নয়। তোরা এখানে আছিস কেন, শোভা?
এখানে আমাদের ভাড়া লাগে না।
সবিস্ময়ে বললুম, ভাড়া লাগে না? এমন দয়ালু কে রে?
শোভনা বললে, যাঁর বাড়ি সে ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন।
আজকালকার বাজারে এমন দয়া দুর্লভ!
শোভনা বললে, তাঁর কেউ নেই, একলা থাকেন কিনা তাই—
বোধ হয় বিনোদবালা আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, সেই দিকে মুখ তুলে চেয়ে শোভনা সরে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে আবার সে যখন এসে দাঁড়াল, দেখি পাতলা জ্বালের মতন শাড়িখানা ছেড়ে শোভনা একখানা সরু পাড় ধুতি পরে এসেছে।
বললুম, শোভনা তোরা ঠিকানা বদলালি, আমাকে চিঠি দিতে পারতিস।
ঠিকানা ইচ্ছে করে দিইনি, ছোড়দা।
কিন্তু মাসোহারার টাকা নেওয়া বন্ধ করলি কেন রে?
একটু থতিয়ে শোভনা বললে, ছেলের জন্যই নিতুম তোমার কাছে হাত পেতে। কিন্তু ছেলে ত’ নেই, ছেলে আমার নয়, তাই নেওয়া বন্ধ করেছি।
প্রশ্ন করলুম, তোদের চলছে কেমন ক’রে?
শোভনা বললে, তুমি আজ এসেছ, আজই চলে যাবে—তুমি সে কথা শুনতে চাও কেন, ছোড়দা?
চুপ করে গেলুম। একথা শোনবার অধিকার আমার নেই, খুঁচিয়ে জানবারও দরকার নেই। বললুম, নুটু কোথায়?
সে লোহার কারখানায় চাকরি করে, টাকা পঁচিশেক পায়। সপ্তাহে সপ্তাহে কিছু চাল-ডাল আনে। আজকাল আবার নেশা করতে শিখেছে, সবদিন বাড়িও আসে না।
বললুম, সে কি, নুটু অমন চমৎকার ছেলে, সে এমন হয়েছে? হারুর পড়াশুনোও তো বন্ধ। ও কি করে এখন?
শোভনা নত মুখে বললে, এই রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে, হারুর কাজ জুটেছিল, কিন্তু সেদিন কতকগুলো খাবার চুরি যাওয়ায় ওর কাজ গেছে। এখন বসেই থাকে।
স্বভাবতই এবার প্রশ্নটা এসে দাঁড়াল শোভনার ওপর। কিন্তু আমি আড়ষ্ট হয়ে উঠলুম। কথা ঘুরিয়ে বললুম, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার ভাল লাগেনি শোভা। মিনুটা এখন যাই হোক একটু বড় হয়েছে, ওকে যখন তখন বাইরে যেতে দেওয়া ভাল নয়। বাড়িটায় নানা রকম লোক থাকে, বুঝিস তো।
বাইরে জুতোর মসমস শব্দ পাওয়া গেল। চেয়ে দেখলুম, আধ ময়লা জামাকাপড় পরা একটি লোক এক ঠোঙা খাবার হাতে নিয়ে ভিতরে এল। মাথায় অল্প টাক, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ—লোকটির বয়স বেশি নয়। চাতালের ওপর এসে দাঁড়িয়ে বললে, কই, বিনোদ কোথা গেলে? এক ঘটি জল দাও আমার ঘরে। আরে কপাল, খাবারের ঠোঙা হাতে দেখলে আর রক্ষে নেই। নেড়ি কুকুরের মতন পেছনে পেছনে আসে, মেয়ে পুরুষগুলো কেঁদে কেঁদে। ছোঁ মেরেই নেয় বুঝি হাত থেকে। পচা আমের খোসা নর্দমা থেকে তুলে চুষছে, দেখে এলুম গো। এই যে, এনেছ জলের ঘটি, দাও। এ-দুর্ভিক্ষে চারটি অবস্থা দেখলুম, বুঝলে বিনোদ? আগে ঝুলি নিয়ে ভিক্ষে, যদি দুটি চাল পাওয়া যায়। তারপর হল ভাঙা কলাইয়ের থাল, যদি চারটি ভাত কোথাও মেলে। তারপর হাতে নিল হাঁড়ি, যদি একটু ফ্যান কেউ দেয়। আর এখন, কেবল কান্না,—কোথাও কিছু পায় না। আরে পাবে কোত্থেকে—গেরস্থরা যে ভাত গুলে ফ্যান খাচ্ছে গো। যাই, দুখানা কচুরি চিবিয়ে পড়ে থাকি।—বলতে বলতে লোকটি ভিতর দিকে চলে গেল।
আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ করে শোভনা বললেন, উনি ছিলেন এখানকার কোন ইস্কুলের মাস্টার। এখন চাকরি নেই। রান্নাঘরের পাশে ওই চালাটায় থাকেন।
একলা থাকেন, না সপরিবারে?
না। ওঁর সবাই ছিল, যখন উপার্জন ছিল। তারপর বড় মেয়েটি কোথায় চলে যায়, স্ত্রী তার জন্যে আত্মহত্যা করেন। ছেলে দুটি আছে মামার বাড়ি। ছোড়দা, বলতে পারো আর কত দিন এমনি করে বাঁচতে হবে? এ যুদ্ধ কি কোনো দিন থামবে না?
উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত, সান্ত্বনা দেবারও কিছু ছিল না। চেয়ে দেখলুম শোভনার দিকে। চোখের নীচে তার কালো কালো দাগ, মাথার চুলগুলো রুক্ষ্ম ও বিবর্ণ, সরু সরু হাত দুখানা শির ওঠা, রক্তহীন ও স্বাস্থ্যহীন মুখখানা। যেন যুদ্ধের দাগ তার সর্বাঙ্গে, যেন দেশজোড়া এই দুর্ভিক্ষের অপমানজনক চিহ্ন মুখেচোখে সে মেখে রয়েছে; তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে কেমন যেন আত্মদ্রোহিতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলুম। সেদিনকার শান্ত ও চরিত্রবতী শোভনা—আমার ছোট বোন—আজ যেন অসন্তুষ্ট অগ্নিশিখার মতো লকলকে হয়ে উঠেছে। আমার কোনো সান্ত্বনা, কোনো উপদেশ শোনবার জন্যে সে আর প্রস্তুত নয়। কিন্তু আমার অপবিতৃপ্ত কৌতূহল আমাকে কিছুতেই চুপ করে থাকতে দিল না। এক সময়ে বললুম, শোভা, এটা তো মানিস, সামনে আমাদের চরম পরীক্ষার দিন। চারিদিকে এই ধ্বংসের চক্রান্তের মধ্যে আমাদের টিকে থাকতেই হবে। যেমন করেই হোক নিজেদের মান-সম্ভ্রম বাঁচিয়ে—
মান-সম্রম?—শোভনা যেন আর্তনাদ করে উঠল—কোথায় মান-সম্ভ্রম ছোড়দা? আগে বুকের আগুন নিয়েছিলুম সবাই, এবার পেটের আগুনে সবাই খাক হয়ে গেলুম। কে বলেছে প্রাণের চেয়ে মান বড়? কোন মিথ্যেবাদী রটিয়েছে, আমাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না? ছোড়দা, তুমি কি বলতে চাও, যদি তিল তিল করে না খেয়ে মরি, যদি পোড়া পেটের জ্বালায় ভগবানের দিকে মুখ খিঁচিয়ে আত্মহত্যা করি, যদি তোমার মা বোনের উপবাসী বাসি মড়া ঘর থেকে মুদ্দোফরাসে টেনে বার করে, সেদিন কি তোমাদেরই মান-সম্ভ্রম বাঁচবে? যারা আমাদের বাঁচতে দিলে না, যারা মুখের ভাত কেড়ে নিয়ে আমাদের মারলে, যারা আমাদের বুকের রক্ত চুষে-চুষে খেলে, তাদেরই কি মান-সম্রম কোথাও বাড়লো? যাও, খোঁজ নাও ছোড়দা, ঘরে-ঘরে গিয়ে। কাঙালিদের কথা ছাড়ো, গেরস্থ বাড়িতে ঢুকে দেখে এসো। কত মায়ের বত্রিশ নাড়ি জ্বলে-পুড়ে গেল দুটি ভাতের জন্যে, কত দিদিমা-পিসিমা-খুড়িমা-বোন-বৌদিরা আড়ালে বসে চোখের জল ফেলছে একখানি কাপড়ের জন্যে। গামছা আর ছেঁড়া বিছানার চাদর জড়িয়ে কত মেয়ে-পুরুষের কাটছে, জানো? বাসি আমানি নুনগুলে খেয়ে কত্ত লাজুক মেয়ে প্রাণধারণ করছে, শুনেছ? মান-সম্রম! মান-সম্ভ্রম নিজের কাছেই কি রইলো কিছু, ছোড়দা?
সপ্রতিভ লজ্জাবতী নিরীহ শোভনাকে এতকাল দেখে এসেছি। তার এই মুখর উত্তেজনায় আমার যেন মাথা হেঁট হয়ে এল। আমি বললুম, কিন্তু কনট্রোলের দোকানে অল্প দামে চাল-কাপড় এসব পাওয়া যাচ্ছে—তোমরা তার কোনো সুবিধে পাওনা?
শোভনা আমার মুখের দিকে একবার তাকালো। দেখতে দেখতে তার গলার ভিতর থেকে পচা ভাতের ফেনার মতো একপ্রকার হাসি বমির বেগে উঠে এল। শীর্ণ মুখখানা যেন প্রবল হাসির যন্ত্রণায় সহসা ফেটে উঠল। শোভনা হা হা হা করে হাসতে লাগল। সে হাসি বীভৎস উন্মত্ত, নির্লজ্জ এবং অপমানজনকও বটে। আমার নির্বোধ কৌতূহল স্তব্ধ হয়ে গেল।
পিসিমার কাছে মার খেয়ে মিনু ও হারু এসে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। হঠাৎ তাদের দিকে চেয়ে শোভনা চেঁচিয়ে বললে, কেন, কাঁদছিস কেন? দূর হয়ে যা সামনে থেকে—
বিনোদবালা যেন কোথায় দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে বললে, মাসি মেরেছে ওদের। ও-বাড়ির হরিশবাবুর কাছ থেকে মিনু পয়সা এনেছিল কি না—হারু কি যেন বলে ফেলেছিল তাই—
শোভনার মাথায় বোধ হয় আগুন ধরে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললে, মা? কেন তুমি ওদের মারলে, শুনি?
পিসিমা কলতলার পাশ থেকে বললেন, মারবো না? কলঙ্কের কথা নিয়ে দুজনে বলাবলি করছিল, তাই বেদম মেরেছি। বেশ করেছি।
কিন্তু ওদের মেরে কলঙ্ক ঘোচাতে তুমি পারবে?
পিসিমা চিৎকার করে উঠলেন, ভারি লম্বা লম্বা কথা হয়েছে তোর, শোভা! এত গায়ের জ্বালা তোর কিসের লা? দিনরাত কেন তোর এত ফোঁসফোঁসানি? কপাল পোড়ালি তুই, মান খোয়ালি সে কি আমার দোষ? পেটের ছেলেমেয়েকে আমি মারবো খুন করবো, যা খুশি তাই করবো—তুই বলবার কে?
শোভনা গর্জন করে বললে, পেটের মেয়েরা যে তোমার পেটে অন্ন জোগাচ্ছে তার জন্যে লজ্জা নেই তোমার? মেরে মেরে মিনুটার গায়ে দাগ করলে—তোমার কী আক্কেল? একেই তো ওই চেহারা, এর পর ঘর খরচ চলবে কোত্থেকে? লজ্জা নেই তোমার?
তবে আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙব, শোভা—এই বলে পিসিমা এগিয়ে এলেন। উচ্চকণ্ঠে বললেন, নলিনাক্ষ আছে তাই চুপ করেছিলুম। বলি, ফরিদপুরের বাড়িতে বসে বিনোদবালার ঠিকানা কে জোগাড় করেছিল? গাড়িভাড়া কার কাছে নিয়েছিলি তুই?
অধিকতর উচ্চকণ্ঠে শোভনা বললে, তাহলে আমিও বলি? মাস্টারকে কে এনে ঢুকিয়েছিল এই বাসায়? হরিশ-যোগেনদের কাছে কে পাঠিয়েছিল মিনুকে? আমাকে কেরাণীবাগানের বাসায় কে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল? উত্তর দাও? জবাব দাও? হোটেলের পাঁউরুটি আর হাড়ের টুকরো তুমি কুড়িয়ে আনতে বলোনি হারুকে? নুটু বাড়ি আসা ছাড়লো কার জন্যে?
মুখ সামলে কথা বলিস, শোভা।
এমন সময়ে বিনোদবালা মাঝখানে এসে দাঁড়াল ঝগড়া মিটাবার জন্য। মারমুখী মা ও মেয়ের এই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য অধঃপতন দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলুম না। উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালুম। বললুম, পিসিমা, আপনি স্নান করতে যান। শোভা তুই চুপ কর, ভাই। এরকম অবস্থার জন্যে কার দোষ দিবি বল? তোর আমার পিসিমার, হারু-মিনুর—এমন কি ওই বিনোদবালা, মাস্টারমশাই, হরিশের দলেরও কোনো দোষ নেই। কিন্তু অপরাধ যাদের তারা আমাদের নাগালের বাইরে শোভা। যাকগে, আমি এখন যাই আবার এক সময়ে আসবো।
শোভনা কেঁদে বললে, আর তুমি এসো না ছোড়দা!
আমি একবার হাসবার চেষ্টা করলুম। বললুম, পাগল কোথাকার!
পিসিমা বললেন, এত গোলমালে তোমার কিছু খাওয়া হল না বাবা, নলিনাক্ষ। কিছু মনে করো না।
বিনোদবালা বললে, চলো, ঢের হয়েছে। এবার খেয়ে-নেয়ে তৈরি হও দিকি? গলাবাজি করলে তো আর পেট ভরবে না। পেটটা যাতে ভরে তার চেষ্টা করো। আমি কি আগে জানতুম তোমরা ভদ্দরলোকের ঘর, তাহলে এমন ঝকমারি কাজে হাত দিতুম না।
অপমানিত মুখে পলকের জন্য বিনোদবালার মুখের দিকে চোখ তুলে অগ্নিবৃষ্টি করে আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম। পাতালপুরীর সুড়ঙ্গলোকের কদর্য কলুষ রুদ্ধশ্বাস থেকে মুক্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালুম রাজপথের ওপর দিগন্ত জোড়া মুমূর্ষুর আর্তনাদের মধ্যে। এ বরং ভালো, এই অগণ্য ক্ষুধাতুরের কান্না চারিদিকে পরিব্যাপ্ত থাকলেও কেমন একটা দয়াহীন সকরুণ ঔদাসীন্যে এদের এড়ানো চলে। কিন্তু যেখানে চিত্তদারিদ্রের অশুচিতা, যেখানে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসীর মর্মান্তিক অন্তর্দাহ, যেখানে কেবল নিরুপায় দুর্নীতির গুহার মধ্যে বসে উৎপীড়িত মানবাত্মা অবমাননার অন্ন লেহন করছে সেই সংহত বীভৎসতার চেহারা দেখলে আতঙ্কে গলা বুজে আসে।
কিন্তু এরা কে? সেই ফরিদপুরের ছোট বাড়িটিতে ফুলের চারা আর শাকসব্জি দিয়ে ঘেরা ঘরকন্নার মধ্যে আচারশীলা মাতৃরূপিণী পিসিমা, লাজুক একটি সদ্যফোটা ফুলের মতো ভগ্নী শোভনা, চাঁপার কলির মতন নিস্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হারু, নটু, মিনু—এরা কি সেই তারা? কেন একটি সুখী পরিবার ধীরে ধীরে নীতিভ্রষ্ট হল? কেন তাদের মৃত্যুর আগে তাদের মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটল এমন করে? কোন দয়াহীন দস্যুতা এর জন্যে দায়ী?
এই কয়মাসে মাসোহারার টাকাটা আমি অনায়াসে খরচ করতে পারি বৈকী। অন্তত দিল্লি যাবার আগে ওদের এই অবস্থায় রেখে চুপ করে চলে যেতে পারিনে। সুতরাং অপবাহ্নকালটা নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে কিছু কিছু খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করা গেল। শতকরা দশগুণ বেশি দামে চাল এবং পাঁচগুণ বেশি দামে আর সব খাবার জিনিসপত্র এখান ওখান থেকে কিনতে লাগলুম। কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেটা এই বিগত শ্রাবণের কৃষ্ণপক্ষ, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। স্বল্পালোক কলকাতার পথঘাট পেরিয়ে একখানা গাড়িতে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে চললুম আবার শোভনাদের ওখানে। নিজের বদান্যতায় কোন গৌরব বোধ করছিনে, বরং সমস্ত খাদ্যসামগ্রীগুলোকে ঘৃণ্য মনে হচ্ছে। খাদ্য আজ জীবনের সকল প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠেছে বলেই হয়তো খাদ্যের প্রতি এত ঘৃণা এসেছে। এসব পদার্থ আগে ছিল ভদ্রজীবনের নীচের তলাকার লুকানো আশ্রয়ে। সেটার কোনো আভিজাত্য ছিল না—আজ সেটা যেন মাথার ওপর চড়ে বসে আপন জাতিচ্যুতির আক্রোশটা সকলের ওপর মিটিয়ে নিচ্ছে।
তবু দুর্গম পথঘাট পেরিয়ে সেগুলো নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হলুম বৌবাজারের বাড়ির দরজায়। বহু পরিশ্রম আর অধ্যবসায় ব্যয় করে দু-তিনজন লোকের সাহায্যে সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলুম সেই সরু আনাগোনার পথের এক ধারে। মাস তিনেকের মতো খাদ্যসম্ভার কিনে এনেছিলুম। জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে লোকগুলোকে বিদায় করলুম।
ভিতর দিকে কোথায় যেন একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছিল, তারই একটা আভা এসে পড়েছিল আমার গায়ে। কলতলার ওপাশ থেকে শোনা গেল, নারীকণ্ঠের সঙ্গে ইস্কুল-মাস্টারের কথালাপের আওয়াজ জড়ানো। তা ছাড়া নীচের তলাটা নিঃসাড়—মৃত্যুপুরীর মতো।
আমি কয়েক পা অগ্রসর হয়ে গেলুম। ডাকলুম, মিনু? হারু?
কোনো সাড়া নেই। যে ঘরখানায় দুপুরবেলায় আমি বসেছিলুম, সে ঘরখানা ভিতর থেকে বন্ধ। বুঝতে পারা গেল, ক্লান্ত হয়ে পিসিমারা সবাই ঘুমিয়েছে। আবার আমি ডাকলুম, মিনু, ও মিনু?
বোধ করি বাইরের থেকে আমার গলার আওয়াজটা ঠিক বোধগম্য হয়নি, ঘরের ভিতর থেকে শোভনা সাড়া দিয়ে বললে, দিনরাত এত আনাগোনা কেন গা তোমার? মিনু ও-বাড়িতে গেছে, আজ তাকে পাবে না, যাও। হতভাগা, চামার!
আমি বললুম, শোভা, আমি রে, আর কেউ নয়, আমি—ছোড়দা। দরজাটা খোল দেখি?
ছোড়দা?—শোভনা তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে বসে পড়ল। অশ্রুসজল কণ্ঠে বললে, ছোড়দা, পেটের জ্বালায় আমরা নরককুণ্ডে নেমে এসেছি! তুমি আমাকে মাপ করো, তোমার গলা আমি চিনতে পারিনি।
শোভনার হাত ধরে আমি তুললুম। বললাম, কাঁদিসনে, চুপ কর। তোরা তো একা নয় ভাই, লক্ষ লক্ষ পরিবার এমনি করে মরতে বসেছে। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না, এমনি করেই এই অবস্থাকে পেরিয়ে যেতে হবে, শোভা। শোন, কালকেই আমি দিল্লি যাব, তাই তাড়াতাড়িতে তোদের জন্যে চারটি চাল-ডাল কিনে আনলুম—ওগুলো তুলে রাখ।
চাল-ডাল এনেছ?—দুর্বল শরীরের উত্তেজনায় শোভনা যেন শিউরে উঠলো। যেন ভাবী ক্ষুধাতৃপ্তির কল্পনায় কেমন একটা বিকৃত উগ্র ও অসহ্য উল্লাস তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কাঁপতে লাগল। রুদ্ধশ্বাসে সে বললে, তুমি বাঁচালে—তুমি বাঁচালে, ছোড়দা। তোমার দেনা আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারব না!—এই বলে আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে আমার চিরদিনের আদরের ভগ্নী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বললুম, ওর সঙ্গে নতুন জামাকাপড়ের একটা পুঁটলি রয়েছে, ওটা আগে তুলে রাখ, শোভা।
শোভনা আমাকে ছেড়ে দিয়ে কেরোসিনের ডিবেটা নিয়ে এসে খাদ্যসামগ্রীর কাছে দাঁড়িয়ে একবার সব দেখল। তারপর অসীম তৃপ্তির সঙ্গে কাপড়ের বস্তাটা তুলে নিয়ে ঘরের ভিতরে চৌকির নিচে রেখে এলো। বললে, ছোড়দা, মনে আছে, কোরা জামাকাপড় পরে লোকের সামনে এসে দাঁড়ানো আমাদের পক্ষে কী লজ্জার কথা ছিল? দোকান থেকে চাল-ডাল এলে লুকিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতুম— পাছে কেউ ভাবে, চাল কেনার আগে আমাদের বুঝি খাবার কিছু ছিল না! মনে আছে, ছোড়দা?
হেসে বললুম, সব মনে আছে রে!
শোভনা করুণকণ্ঠে বললে, তুমি বলতে পারো ছোড়দা, এ দুর্ভিক্ষ কবে শেষ হবে? সবাই যে বলছে, নতুন ধান উঠলে আমাদের আর উপোস করতে হবে না?
তার আর্তকণ্ঠ শুনে আমি চুপ করে রইলুম। কারণ, সরকারি চাকর হলেও ভিতরের খবর আমার কিছুই জানা ছিল না। শোভনা পুনরায় বললে, ফরিদপুরের সেই মস্ত মাঠ তোমার মনে আছে ছোড়দা? ভাব তো, সেই মাঠে আমনের সোনার শীষ পেকেছে, হাওয়ায় তারা ঢেউ খেলছে আনন্দে, মাঠে মাঠে চাষার দল গান গেয়ে গেয়ে কাটছে সেই ধান,—সেই লক্ষ্মীকে ভারে ভারে তারা ঘরে তুলে আনছে! মনে পড়ে?
শোভনার স্বপ্নময় দুটি চোখ হয়তো সেই সোনার বাঙলার মাঠে মাঠে একবার ঘুরে এলো, কিন্তু আমি কেরোসিন ডিবের আলোয় এই নরককুণ্ড ছাড়া আর কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না। কেবল নিশ্বাস ফেলে বললুম, মনে পড়ে বৈকী।
কিন্তু এ কি শুনছি ছোড়দা? —শোভনা আমার মুখের দিকে আবার ফিরে তাকাল। সভয় চক্ষু তুলে সে পুনরায় বললে, গোছা গোছা কাগজ বিলিয়ে আবার নাকি ওরা শুষে নিয়ে যাবে সেই আমাদের ভাঙা বুকের রক্ত? নবান্নর পর আবার নাকি ভরে যাবে আমাদের ঘর কান্নায়? বলতে পারো, তুমি?
কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলুম সহসা বাইরে কার পায়ের শব্দ পেয়ে শোভনা সচকিত আতঙ্কে অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর কম্পিত অধীর কণ্ঠে সে বললে, ছোড়দা, এবার তুমি যাও, তোমার অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয় ন’টা—আমার মনে ছিল না, নিশ্চয় ন’টা বেজেছে। এবার তুমি যাও ছোড়দা।
এগুলো তুলে রাখ আগে সবাই মিলে?
রাখবো, ঠিক রাখবো—একটি একটি চাল-ডালের দানা গুণে গুণে রাখবো—কিন্তু এবার তুমি যাও, ছোড়দা। আলো ধরছি, তুমি যাও, একটুও দেরি কোরো না, লক্ষ্মীটি ছোড়দা…
শোভনা চঞ্চল অহির উদ্দাম হয়ে এসে আমাকে যখন একপ্রকার টেনে নিয়ে যাবে, সেই সময় একটি লোক চাল-ডালের বস্তার ওপর হোঁচট খেয়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়ে বললে, ওঃ, নতুন লোক দেখছি। চাল-ডাল এনে একেবারে নগদ কারবার।
লোকটার পরনে একটা খাকি সার্ট, সর্বাঙ্গে কেমন একটা নেশার দুর্গন্ধ। আমি বললুম, কে তুমি?
আমি কারখানার ভূত, স্যার।—এই বলে হঠাৎ শোভনার একটা হাত ধরে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে বললে, এসো, কথা আছে।
কথা কিচ্ছু নেই, ছাড়ো৷ বলে শোভনা তার হাতখানা ছাড়িয়ে নিল।
বটে!—লোকটি ভুরু বাঁকিয়ে বললে, আগাম একটা টাকা দিইনি কাল?
রুদ্ধশ্বাসে শোভনা বললে, বেরিয়ে যাও বলছি ঘর থেকে?
বাঃ—বেরিয়ে যাব বলে বুঝি এলুম দেড় মাইল হেঁটে? বেশ কথা বলে পাগলি।
চিৎকার করে শোভনা বললে, বেরোও বলছি শিগগির? চলে যাও—দূর হয়ে যাও ঘর থেকে—
লোকটা বোধ হয় তক্তাখানার ওপর বসবার চেষ্টা করছিল। হেসে বললে, আজ বুঝি আবার খেয়াল উঠল?
শোভনা আর্তনাদ করে উঠল—ছোড়দা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছ তুমি? এ অপমানের কি কোনো প্রতিকার নেই?…দাঁড়াও, আজ খুন করবো—বঁটিখানা…
বলতে বলতে ছুটে সে বেরুল—রান্নাঘরের দিকে চলল। লোকটা এবার উঠে বাইরে এল। বললে, মশাই, এই নিয়ে মেয়েটা আমাকে অনেকবারই খুন করতে এলো, বুঝলেন? আসলে মেয়েটা মন্দ নয়, কিন্তু ভারি খেয়ালি! তবে কি জানেন স্যার, আমরা হচ্ছি জরুরি কাজের লোক, লোহা-লক্কড় নিয়ে কাজ করি—মেয়েমানুষের মেজাজ-টেজাজ অত বুঝিনে! এসব জানে ওই বাবু মার্কা লোকগুলো, ওরা নানারকম ভাঁড়ামি করতে পারে!
এমন সময় উন্মাদিনীর মতন একখানা বঁটি হাতে নিয়ে শোভনা ছুটে বেরিয়ে এলো। পিসিমা ধড়মড়িয়ে এলেন, হারু ছুটে এল। লোকটি শান্তকণ্ঠে বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, আর খুন করতে হবে না, দেখছি আজ খেয়ালের ভূত চেপেছে ঘাড়ে। আচ্ছা—এই যাচ্ছি সরে।
বিনোদবালা আর পিসিমা দৌড়ে এসে ধরে ফেললেন শোভনাকে।
লোকটি পুনরায় নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললে, বেশ, সেই ভালো। বিনোদের ঘরে রইলুম এ-রাত্তিরটার মতন। কিন্তু মাঝ রাত্তিরে আমাকে নিশ্চয় ডেকে ঘরে নিয়ো, নৈলে কিছুতেই আমার ঘুম হবে না, বলে রাখলুম।—আচ্ছা, বেশ, কাল না হয় আড়াই সের চালই দেওয়া যাবে। আয় বিনোদ, তোর ঘরে যাই। বলতে বলতে বিনোদের হাতখানা টেনে নিয়ে ইস্কুল-মাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেল।
শোভনা সহসা আমার পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। বললে, কবে, কবে ছোড়দা, কবে এই রাক্ষুসে যুদ্ধ থামবে, তুমি বলে যাও। তুমি বলে যাও, কবে এই অপমানের শেষ হবে, আমাদের মৃত্যুর আর কতদিন বাকি?
আস্তে আস্তে আমি পা ছাড়িয়ে নিলুম। শোভনার হৃদপিণ্ড থেকে আবার রক্ত উঠে এলো। বললে, তুমি যেখানে যাচ্ছ, সেখানে যদি কেউ মানুষ থাকে, তাদের বলো এ যুদ্ধ আমরা বাধাইনি, আমরা দুর্ভিক্ষ আনিনি, আমরা পাপ করিনি, আমরা মরতে চাইনি…
শোভনা কাঁদুক, সবাই কাঁদুক। আমি অসাড় ও অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাইরে এসে পথে নামলুম। অন্ধকারে কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না শুধু অন্ধকার, অনন্ত অন্ধকার। কেবল মনে হলো, অঙ্গারের আগুন যেমন পুড়ে পুড়ে নিস্তেজ হয়ে আসে, তেমনি মহানগরের ক্ষুধাশ্রান্ত কাঙালিরা চারিদিকে চোখ বুজে পথে-ঘাটে নালা নর্দমায় শুয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি কান পেতে শুনছে!
৬ অক্টোবর ১৯৪৩