পটভূমি – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
পিচের কালো পথগুলি দ্রুত পার হয়ে আসছিল রঞ্জনা, —অপরাহ্নের আলো ঠিকরে পড়া কত গলির মোড়, কত রিকশার টুংটাং, ট্যাক্সির ঘোরাফেরা, বিভিন্ন বিপণির রঙিন বিজ্ঞপ্তি। ট্রাম-বাস-সমাকীর্ণ বড় রাস্তার সমুদ্রে এখনও সে পড়েনি, —কিন্তু এই বিভিন্নমুখী হাটপথের স্রোতগুলিও কম প্ৰখর নয়, দুরন্ত এক বন্যার বেগে সে যেন ভেসে চলেছে,—দুপাশের ভবন-সমারোহ তার কাছে আজ ঝাপসা, বিবর্ণ! যেন ইটের ইমারত নয়,—তাস, বাতাস জোরে বইলেই উড়ে যাবে। মানুষ নয়, পুতুল, আঘাত লাগলেই টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে।
কিন্তু ভাঙাবাড়ির অন্ধকার কোণে রূপকের স্ত্রীর মধ্যে যে অদ্ভুত নিশ্চিত ভাব সে এইমাত্র লক্ষ্য করে এল, তা সে সত্যিই আশা করেনি। পিচ্ছিল কলতলায় ঝিরঝিরে ক্ষীণ জলাধারার নীচে কাদামাখা তিন বছরের রোরুদ্যমান ছেলেটাকে বসিয়ে গলিত সাবানের টুকরোটা দিয়ে স্নান করাচ্ছিল রূপকের কৃশতনু স্ত্রী; তাকে হঠাৎ এতদিন পরে চোখের সামনে দেখে একবার মুখ তুলল মাত্র, তারপরে ছেলেটাকে সজোরে একদিকে টেনে এনে ভিজে গামছাটা দিয়ে ঘষে দিতে লাগল সারা গায়ে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর রঞ্জনা বলল,—‘কেমন আছো, বউদি?’
শিশুটিকে শুকানো গামছা দিয়ে নিপীড়িত করতে করতে একটু বোধ হয় বাঁকা হাসল রূপকের স্ত্রী অনীতা, বলল,—‘বাঙলা কথা বার্তা তো দিব্যি শিখে ফেলেছ, দেখছি!’
‘কই আর শিখলাম!’
ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল অনীতা, বলল,—‘কথাবার্তায় তো একটুও টান নেই।’
ঘরের দিকে বারান্দায় সিমেন্ট উঠে যাওয়া রুক্ষ মেঝের উপরে তালাবন্ধ চামড়ার পুরনো সুটকেশটা পড়ে আছে। তার উপরে একটা জাহাজ ও জাহাজ-কোম্পানির নাম-ছাপানো-লেবেলের মধ্যে রূপকের নাম বড় বড় অক্ষরে কালি দিয়ে লেখা,—সেই দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রঞ্জনা।
অনীতা বলল, ‘ঘরে এসো।’
দু-একবার ইতিপূর্বে এসেছে এ বাড়িতে, কিন্তু কোনওদিন এ সস্নেহ আহ্বান শোনেনি রঞ্জনা। একটু অবাক হয়েই বলল,—‘আসব?’
‘এসো।’
বারান্দায় উঠে এসে চটা-ওঠা মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে ছেলেটাকে একটা প্যান্ট পরিয়ে দিতে দিতে অনীতা থমকে-থেমে-যাওয়া রঞ্জনার দিকে একবার অপাঙ্গে তাকাল, বলল,—‘ভিতরে গিয়ে বসো। আমি ছাদ থেকে শুকনো জামা-কাপড়গুলি এখুনি তুলে আনছি।’
রঞ্জনা ছেলেটাকে কাছে টানবার চেষ্টা করল, কিন্তু সে এলো না, মায়ের গা ঘেঁষে মায়ের কাপড় ধরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে লাগল। রঞ্জনা বলল,—‘কোথায় গেছে?’
‘কে?’—অনীতা প্রশ্নের তাৎপর্যটা ভাল করে না বুঝেই উত্তর দিল, —‘ছেলেমেয়েরা? ছেলে গেছে মাঠে খেলতে, মেয়ে গেছে পাশের বাড়ি গান শিখতে। কোলেরটা অবেলায় পড়ল ঘুমিয়ে, ঘরে গিয়ে দেখ, অয়েলক্লথের ওপর কাঁথা পেতে শুয়ে আছে।”
‘আমি তা’ বলছি না বউদি,’—রঞ্জনা থেমে কোনওক্রমে বলল, ‘আজই তো রওনা হচ্ছে?
‘হ্যাঁ।’
রঞ্জনা বলল, ‘বাক্সও তো তৈরি দেখছি।’
‘সবই তৈরি।’
একমুহূর্ত থেমে থেকে রঞ্জনা আবার বলল, ‘সন্ধ্যা আটটায় ট্রেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘মাদ্রাজ থেকে জাহাজে উঠছে, না?’
‘হ্যাঁ।’
এবার উত্তর দিয়েই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে অনীতা,—‘তুমি ভিতরে গিয়ে তক্তাপোষের ওপর একটু বোসো ভাই, আমি ছাদ থেকে এখুনি আসছি।’
তর তর করে পাশের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল অনীতা, পিছন-পিছন ছেলেটা। রঞ্জনা এসে দাঁড়াল ঘরের ভিতরে। তাকের উপর যে বইগুলি থরে-থরে সাজানো থাকত, সেগুলি নেই,সমস্ত ঘরখানার শোভাই যেন হারিয়ে গেছে।
ঘুমন্ত শিশুর কাছে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল রঞ্জনা, ছ মাসের ছোট্ট শিশুটির মুখখানা দেখতে দেখতে তার পাশেই বসে পড়ল সে। দেখতে দেখতে রূপকের মুখের আদলটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে! সেই চোখ আর পাতলা ঠোঁট দুটি!
বছর চারেকে কি কেটে যায়নি ইতিমধ্যে? সে এক স্মরণীয় দিন। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রঞ্জনা। বিশ্ববিদালয়ের ব্যবস্থা অনুযায়ী একদল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বিশাখাপত্তন থেকে নেভির একটি ছোট জাহাজে করে সমুদ্র-ভ্রমণে বেরিয়েছিল তারা। সেই জাহাজে উধাও সমুদ্রের বুকেই তো তার রূপকের সঙ্গে দেখা। অন্ধ-মেয়ে বাঙালি ছেলেকে দেখে মুগ্ধ হল, তাকে ভালবেসে বাঙলা ভাষাকে ভালবাসল।
নেভির এক অফিসারের আত্মীয় এই রূপক, কীভাবে রেলের পাশ পেয়ে বেড়াতে এসেছিল ওয়ালটেয়ারে। তাঁবই চেষ্টায় নেভির জাহাজে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সুযোগ পেয়েছিল সারাদিন ধরে সমুদ্রের দোলায় দুলবার।!
সকালে বেরিয়ে জাহাজ তখন বিকেলে ফিরবার মুখে। ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অসুস্থ অথবা ক্লান্ত বোধ করে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে, শুধু দাঁড়িয়ে আছে ধুতি পাঞ্জাবি-পরা সেই বাঙালি ছেলেটি সামনের ডেকে রেলিংয়ের ধারে। তন্ময় হয়ে সারা দিনমান সে শুধু সমুদ্রই দেখেছে। ঢেউ আর ঢেউ,— নীল আর নীল! মাঝে মাঝে ভাঙা ঢেউয়ের মাথায় স্ফটিকের মতো শুভ্র আভা যেন ঝলসে উঠছে। কোথায় হারিয়ে গেছে তটরেখা, দূরে দিগন্তে ঘন নীল সুস্পষ্ট সমান্তরাল রেখা বিস্তৃত হয়ে আছে, তারই মাথার উপরে আকাশের গায়ে থরে থরে সাজানো সুশুভ্র মেঘপুঞ্জ, যেন সার বেঁধে উড়ে চলেছে সাগর-বিহঙ্গের দল! সেই শুভ্র মেঘের রেখায় রেখায়, নীল সমুদ্রের তরঙ্গ-শীর্ষে-শীর্ষে ছোঁয়া লেগেছে রঙিন গোধূলির। একটা তীব্র নেশার মতো সমস্ত হৃদয়-মনকে মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
নেশা লেগেছিল রঞ্জনারও মনে। জাহাজের রেলিং-ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রূপকের সেই ধ্যানমগ্ন রূপ ওর মনে কী যে মোহ বিস্তার করেছিল সেই ম্লানায়মান দিবাবসানের স্নিগ্ধ মুহূর্তে, সমস্ত জীবনটাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে এক নতুন দিকে প্রবাহিত করে দিল।
ওর এক দূর সম্পর্কের ভাই সঞ্জীব রাও ছিল ওর সহপাঠী—খুব হাসিখুশি, আলাপী, আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। সেদিন জাহাজে ও-ই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় করেছিল রূপকের সঙ্গে। রূপকের কাছ থেকে ফিরে এসে দাঁড়িয়েছিল রঞ্জনার কাছে। বলল,—‘আলাপ করবে ওই বাঙালি ভদ্রলোকটির সঙ্গে?’
‘কেন?’
‘তুমি তো টেগোর-টেগোর করে পাগল হতে,—এই লোকটিও কবি, বাঙালি কবি।’
‘সত্যি!’
‘হ্যাঁ।’
কিন্তু সঞ্জীবের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি—সেদিনের সেই সমুদ্রের দোলায় দুলতে দুলতে জাহাজ যখন ফিরে আসছিল বন্দরের দিকে,—কী আশ্চর্য, রূপকই কাছে এসে কথা বলেছিল সবার আগে। বলেছিল, ‘সবাই সেলুনে গিয়ে চা-টা খাচ্ছে, আপনি গেলেন না?’
‘না।’
‘সমুদ্র দেখছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল রূপক মুহূর্তে। বলেছিল,—‘আমার জীবনে সমুদ্রকে দেখা, সমুদ্রকে পাওয়া এই প্রথম।’
‘আপনি নাকি কবি?’
অবাক হয়ে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল রূপক। একটু হেসে বলেছিল,—‘সে প্রসঙ্গ ছেড়ে দিন। আমি রেলের অস্থায়ী কেরানি, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিকীর্ণ। সুতরাং অতীব নিরীহ ব্যক্তি।’
‘কেমন লাগল সমুদ্র?’
‘চমৎকার।’ রূপক যেন স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছিল,-‘মনে হয় ভেলা নিয়ে সারাজীবন ভেসে বেড়াই!’
একটু হেসে রঞ্জনা বলেছিল,—‘স্ত্রীপুত্রকন্যার কথা বলছিলেন না?’
মুহূর্তে একটা কালো ছায়ায় যেন ঢেকে গেল ওর সমস্ত উজ্জ্বলতা, কোনও ক্রমে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম।’
তারপর? রূপক যতদিন ছিল ওয়ালটেয়ারে, তারা প্রতিদিন দেখা করেছে। সঞ্জীব অবশ্য ছিল ছায়ার মতো সঙ্গে। অনর্গল কথা বলে গেছে, রূপক। রঞ্জনা বিপুল আগ্রহে শুনে গেছে। সঞ্জীব গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে। মাঝে মাঝে রূপকের নির্দেশে শিষ্ট ছাত্রীর মতো বাংলায় কথা বলবার চেষ্টা করেছে রঞ্জনা, ভুল উচ্চারণ হয়তো হয়ে গেছে কখনও, শুনে হেসে উঠেছে রূপক, সঞ্জীবের গাম্ভীর্য এক মুহূর্তের জন্যও টলেনি।
একদিন চলে যায় রূপক। বলে যায়,—আবার আসব। এবার তোমরা আমাকে দেখবে জাহাজে। বন্দরে নামব, আসব তোমাদের বাড়ি। জাহাজ যেদিন ছাড়বে, এসো তোমরা জেটিতে,—হাতে রুমাল নিয়ে দোলাতে-দোলাতে আমাকে বিদায় দিও।’
কবি-মনের উচ্ছ্বাস বলেই কথাটাকে সেদিন নিয়েছিল রঞ্জনা কিন্তু আজ ওর এই কথাগুলিই বারবার মনে পড়ছে, বারবার চোখের কোণ সজল করে তুলছে। রূপককে সেদিন সে ঠিক চেনেনি। রূপক কেন, কোনও পুরুষকেই না। স্বভাববৈরাগী পুরুষ স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ঘরসংসার করে চলেছে, তাকে মোহমুগ্ধ করে রাখাই নারীজীবনের সাধনা। স্বপ্নভঙ্গ হলেই নির্ঝরের বাঁধ ভাঙবে, ধারায় ধারায় প্রবল বেগে সে ছুটে যাবে সমুদ্রের দিকে। কিন্তু একথা কী সে তখন বুঝত?
দিন যায়, পরীক্ষা তার সামনে। অবশেষে পরীক্ষাও শেষ হল। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, জীবনের পরীক্ষাও। সঞ্জীব এসে একদিন বলল, ‘তোমার বাঙলা পড়া কতদূর?’
‘অনেক দূর।’
সঞ্জীব চেয়ারটা টেনে ওর খুব কাছে সরে এসে বসল,—‘আমি কলকাতায় যাচ্ছি। চাকরি পেয়ে।’
সাগ্রহে বলে ওঠে রঞ্জনা,—‘আমাকে নিয়ে যাবে?’
তীব্র আনন্দের উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় সঞ্জীব। বলে, ‘যাবে তুমি?’
কিছুই যে ভাল লাগে না রূপক চলে যাবার পর থেকে। যেন চারিদিকে সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। সঞ্জীব ওর টেবিলে-রাখা হাতখানার ওপর সন্তর্পণে রাখে নিজের হাত। বলে—‘তোমার বাবা কিছু বলবেন না?’
রঞ্জনা ঠোঁট টিপে একটু হেসে বলেছিল,—‘যাতে না বলেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ধর্মে খ্রিস্টান, মর্মে হিন্দু। তবে এক্ষেত্রে চার্চের সুবিধা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আবেগে কল্লোলিত হয়ে ওঠে সঞ্জীব, ওর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে সজোরে টেনে নিয়ে বলতে থাকে,—‘কবে, কবে, কবে?’
একটু হেসে রঞ্জনা বলে,—‘দাঁড়াও, একটা চাকরি জোগাড় করি আগে। তোমার ওপর সমস্ত চাপটাই দিতে চাই না।’
চাকরি পায় রঞ্জনা অতি সহজেই। তার বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু কী একটা ইন্সিওরেন্সের কলকাতা শাখার ম্যানেজার এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। চার্চের অনুষ্ঠানের পর আসে কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাট, চৌরঙ্গির অফিস, রঞ্জনাকে সাজের নেশায় পেয়ে বসে, নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশটুকুও সে যেন নিতে চায় না। সঞ্জীবের ঘোরাফেরার চাকরি, কলকাতাকে কেন্দ্র করে সে ঘুরে বেড়ায় শিলং-গৌহাটি, দিনাজপুর আর দার্জিলিং। যেন একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে এসে পড়ে দুজনে।
কোথায় মুছে যায় অন্ধ্র মেয়ের অভ্যস্ত প্রসাধন, কোথায় ঝরে যায় অন্ধ্র মেয়ের অনবদ্য স্বাস্থ্যসৌষ্ঠব। রূপকের বাড়িতে গিয়ে কলকাতার রূপককে প্রথম আবিষ্কার করার তিথিক্ষণ থেকে এ এক অদ্ভুত কৃচ্ছ্রসাধন শুরু হয় ওর। ওর সচেতন মন ডুবে থাকে কাজের নেশায়। কাজের পরে কাজ, পরের কাজ টেনে নিতেও ওর দ্বিধা হয় না। অবচেতন মন নিজেকে ভেঙে ফেলার সাধনায় দিন-দিন উন্মুখ হয়ে ওঠে। রূপকের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাঙা ঘর, রূপকের স্ত্রী অনীতার কঙ্কালসার শরীর, রূপকের নিজের কর্মক্লান্ত ক্ষীণ মূর্তি যেন দিন দিন চাবুকের মতো কশা হানতে থাকে তার স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহ-সম্পদের ওপর। সঞ্জীব গৌহাটির পালা শেষ করে যখন ঘরে আসে, অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে এক-একদিন বলে, তুমি কী ছিপছিপে গড়নের বাঙালি মেয়ে হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছ?
শ্রান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে রঞ্জনা নিজের স্থুল অধরোষ্ঠের ওপর আঙুলটা বুলিয়ে নেয়। বিচিত্র হাসি হেসে বলে, ‘পারছি কই!
রূপকের উজ্জ্বল চোখদুটিই শুধু জানিয়ে দেয় তার জাগ্রত কবি-সত্তার কথা, নইলে আর কোথাও তার স্বাক্ষর নেই, না জীবনে, না কর্মে। এক একদিন পথভোলা খেয়ালি পথিকের মতোই এসে পড়ে রূপক তার অফিসে। বলে, ‘সেই সমুদ্রের কথা মনে আছে?’
প্রশ্ন শুনে কাজ করা হাত দুখানি আড়ষ্ট হয়ে যায় রঞ্জনার, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, ‘স্বপ্নের মতো মনে হয়।’
‘কেন সমুদ্রতীরের ঘর ছেড়ে এই জনসমুদ্রে এলে?’
‘কেন!’
‘হ্যাঁ, কেন?’
রঞ্জনা হাতের কলমটা তার অধরোষ্ঠের ওপর ঠেকিয়ে বলে, ‘এতদিন পরে এ প্রশ্নই বা কেন?
সমুদ্রতীরবাসিনীকে সমুদ্র থেকে আলাদা করে দেখতে পারি না’,—রূপক বলে যায় উন্মত্তের মতো, ‘দেখে এসেছ তো আমাকে, আমার ঘরে? আমাকে বেরিয়ে পড়তেই হবে। খুব চেষ্টা করছি। খুব ধরাধরি করছি। জাহাজে কেরানির চাকরি, বুঝলে? আর ফিরব না।’
রঞ্জনা একটু থেমে থাকবার পর বলে, ‘তোমার ঘরের তাকের ওপরের থরে-থরে সাজানো বইগুলির ওপর লোভ হয়।’
হঠাৎ ওর হাতের ওপর এসে পড়ে রূপকের হাত, বলে, ‘যাবার আগে বইগুলি তোমাকেই দিয়ে যাব।’
অক্ষরে অক্ষরেই কী কথা রাখল রূপক? আজ ভোরে যখন রিকশায় করে সত্যি সত্যিই বইগুলি সে তার ঘরে নিয়ে এল, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারেনি রঞ্জনা। ‘চলে যাচ্ছি রঞ্জনা, পেয়েছি জাহাজে কেরানির কাজ। আজ সন্ধ্যাতেই ট্রেন। মাদ্রাজ যাব।’
‘বসো তুমি?’
‘বসব না।’—চোখদুটি যেন অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। রূপক বলল, ‘শিপিং অফিস, হেন-তেন অনেক কাজ। অনীতা পাবে এবার দেড়শো টাকার কেরানি স্বামীর কাছ থেকে মাসে-মাসে তিনশো টাকা, পারবে ওর ছেলেমেয়েদের ভাল খাওয়াতে, ভাল পরাতে। আর তুমি নাও আমার বই। আমার ভাললাগা ওর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছুঁয়ে আছে।
ঝড়ের মতো চলে যায় রূপক। আর সারাদিন স্তব্ধ হয়ে কেটে যায় রঞ্জনার। বইগুলি সাজায়, নানান লেখকের নানান ধরনের বই। ভ্রমণ-কাহিনীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সত্যিই কি চলে যাবে ও? সত্যিই কি চলে যাবে ঘর-সংসার ছেড়ে, অনীতাকে ছেড়ে?
অনীতা এসে ঘরে ঢোকে এই সময়। হাতে তার ছাদ থেকে তুলে নিয়ে আসা একরাশ কাপড়চোপড়। তক্তাপোষের এক পাশে ফেলে রেখে আঁচলধরা ছেলেটাকে টেনে নেয় কোলের কাছে, ঘুমন্ত শিশুটির দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলে, ‘খুব ঘুমুচ্ছে আজ।’
শীর্ণ শরীর, কিন্তু অনীতার মুখখানা ভারী কোমল লাগে রঞ্জনার চোখে, পাতলা ঠোটদুটি ফুলের পাপড়ির মতো। দারিদ্র্যখিন্ন বাঙালি মেয়ের দেহসৌষ্ঠব নেই, কিন্তু আনন-মাধুর্যকে অস্বীকার করবে কে? তবু অনীতা পারল না বাঁধতে রূপকের বিবাগী মনটাকে? উঠে দাঁড়াল রঞ্জনা।
অনীতাও বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। বলল, ‘ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে বুঝি?’
‘না। তোমার সঙ্গে।’
‘আমার সঙ্গে!’ হেসে উঠল অনীতা, ‘সে-কী!’
‘হ্যাঁ, একটি প্রশ্ন,’ রঞ্জনা বলল, ‘ওকে জাহাজের চাকরি তুমি নিতে দিলে?’
‘দিলাম। দেব না কেন? চাকরি খারাপ নাকি? মাস গেলে আমিই তো পাব তিনশোটি করে টাকা।’
‘তা পাও।’ রঞ্জনা এগিয়ে এল ওর দিকে, ‘কিন্তু এ কথা কী ভেবেছ, ও আর ফিরবে না?’
‘ফিরবে না কেন? ছুটিতে ছুটিতে আসবে। তাই বা কেন? আমাকে তো বলেছে, বছর দুই পরে কিছু রোজগার করবার পর ছেড়ে দেবে জাহাজের চাকরি।’
‘সমুদ্র তুমি কখনও দেখেছ?’
‘না।’
‘সমুদ্রের নেশা তুমি জানো না।’ রঞ্জনা বলে, ‘ওর বিবাগী মন। বাঘ যেমন মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষ ছাড়া আর কিছুই ছোঁয় না, এ ধরনের পুরুষের কাছে সমুদ্রের স্বাদ সেই রক্তের স্বাদ। তুমি ওকে কি বেঁধে রাখতে পারছ না অনীতা?’
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ অনীতা, বলে,—‘কি আবোল-তাবোল বকছ? যাবে কোথায় ও? এই যে কুচোকাঁচাগুলি রয়েছে, এদের টানে আসতেই হবে ওকে।’
আশ্চর্য ওর নিশ্চিন্তি। একটা পাথরে আঘাত লেগেই যেন পথে বেরিয়ে আসে রঞ্জনা। কাকে বোঝাবে? নারীত্ব যখন সব ভুলে নিছক মাতৃত্বের দৈনন্দিনতায় এসে দাঁড়ায়, তখন কোন সুষমা কোন মাধুর্যের ডোরে এসে বাঁধা পড়বে মোহমুগ্ধ পুরুষ?
পথ না হলে বোধ হয় কান্নায় ভেঙে পড়ত রঞ্জনা। সঞ্জীব গেছে দার্জিলিং, কাকে অবলম্বন করে সে আজ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, এখন, এই মুহূর্তে! রূপককে যে ফেরাতেই হবে। কিন্তু কেমন করে?
বাড়ি ফিরতে হবে দ্রুত পায়ে। রূপকের সঙ্গে দেখা সে করবে হাওড়া স্টেশনে। নিজের শীর্ণ নীরস শরীরটার দিকে তাকিয়ে আজ এতদিন, পরে হাহাকার করে উঠল মন। মনটাকে নিয়েই খেলা করে এসেছে এতদিন দেহটাকে করেছে অবহেলা।
আজ অন্ধ্র-মেয়ের অভ্যস্ত সুনিপুণ প্রসাধনে পুষ্পিত হয়ে উঠবে রঞ্জনা, আজ তার নারীত্বের চরম পরীক্ষা। কিন্তু তবু বুকের ভিতরটা উঠছে গুমরে-গুমরে। মৃণাল লবঙ্গলতিকা, পেলব দেহবল্লরী। সে জানে, আজ সমস্তই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেই অনিবার্য প্রত্যাঘাতে আজ তার টুকরো-টুকরো হয়ে যাওয়াই দরকার।
২৪ অক্টোবর ১৯৫৪