নীল পেয়ালা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
আকাশের নীল পেয়ালা উপচে পড়ছে উষ্ণ মধুর রোদ। রোদ তো না, পেয়ালা উপচে জাফরান রঙের চা ঝরে পড়ছে, যত খুশি পান করে নাও, শরীর চাঙা হবে, মন প্রফুল্ল হবে। আহা, শীতের সকালের রোদ। বৈদ্যনাথবাবু এমন দিনে কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারেন না। ওভারকোট, মঙ্কি ক্যাপ, ডার্বি শু, দস্তানা, মোজার বর্ম এঁটে হাতির দাঁতের মাথাওয়ালা সুন্দর ছড়ি হাতে, যেন পৌষের পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে আকাশের পেয়ালা থেকে গড়িয়ে পড়া গরম চা প্রাণভরে সকলের আগে খেয়ে নিতে সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। অথচ তাঁর বাড়িতে তাঁর টেবিলে ততক্ষণে শৌখিন পেয়ালায় ধূমায়িত গরম চা এসে গেছে। কিন্তু বৈদ্যনাথের যেন সেই চায়ে রুচি নেই। ছেলেমানুষের মতন তিনি বাইরে ছুটে এসেছেন।
বস্তুত, বলতে কি, তিনি ছেলেমানুষই হয়ে গেছেন।
তিনি আজ তিপ্পান্নয় পা দিয়ে সতেরো বছর বয়সের স্বপ্ন দেখছেন। বৈদ্যনাথের মনের এই অবস্থা কেন, তলিয়ে দেখতে গেলে খুব বেশি দূর হাতড়াতে হবে না, অনেকদিন ধরে যে এটা হয়েছে তাও না, পরশুর ঘটনা, এখানে এই ক্যানেলের ধারে বাঁকাচোরা পত্রহীন পাকুড় গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে জলের ওপর শীতের সকালের রৌদ্রের অচঞ্চল প্রশান্ত হাসি দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি ছোট হয়ে গেছেন, কিশোর হয়ে গেছেন; শুকনো খসখসে দাড়ির গালে হাত বুলোতে বুলোতে তাঁর মনে হয়েছিল ইচ্ছা করলে মানুষ তার বয়স কমিয়ে দিতে পারে। ইচ্ছা করলে বৈদ্যনাথ ওভারকোট জুতো দস্তানা ছেড়ে খালের জলে সাঁতার কাটতে পারেন, ইচ্ছা করলে তিনি তেলের পিপে বোঝাই লরীটার পিছনে ছুটতে পারেন। শরীরটা কিছু না; মন, মনের দিক থেকে আশ্চর্য এক তারুণ্যের উত্তাপ অনুভব করতে করতে বৈদ্যনাথ কেমন যেন অস্থির ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন।
ছেলেটির পরনে সাধারণ পাজামা পাঞ্জাবি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বইছিল। যে ঠাণ্ডা হাওয়া অন্য যে-কোনো সময় বৈদ্যনাথকে কাবু করে ফেলতে পারত, বিছানায় শুইয়ে দিতে পারত, সেদিন যদিও তাঁর নিজের গায়ে গরম জামাকাপড় ছিল, মনে হয়েছে, এগুলো কিছু না, বাহুল্য, ইচ্ছা করলে তিনিও ওর মতন উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে লম্বা পালক ঘেরা কালো বড় বড় চোখ দুটো জলের ওপর স্থির করে ধরে রেখে এই মুহূর্তে স্বপ্ন দেখতে পারেন।
স্বপ্ন। যেন ছেলেটির স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখের দৃষ্টি বৈদ্যনাথকে এমন করে দিয়েছে। তিনি ভুলে আছেন তাঁর ছুটির আর তিনদিন বাকি আছে, তিনদিন পর আর তাঁর ক্যানেলের ধারে দাঁড়িয়ে, রৌদ্র ছায়ার খেলা, জলের কাঁপন দেখা হবে না, শুকনো পাকুড়ের ডালে কালো কুচকুচে কাকটার কা কা শোনা হবে না তেলের পিপে বোঝাই ধাবমান লরীর দিকে চোখ রেখে ওটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটা যায় কিনা— ভাবা হবে না। এ জি অফিসের এক প্রশস্ত কামরায় প্রকাণ্ড টেবিলের সামনে বসে তাঁকে কলম পিষতে হবে। দশটা পাঁচটা। ট্রাম বাসের ভিড়। কোনোরকমে কাক-স্নান সেরে ভাত খেতে বসা। টিফিনের কৌটো। বৈদ্যনাথের বয়সের আর পাঁচটা পাকা খসখসে দাড়ির গাল, পাকা খেজুরের মতো শুকনো গায়ের চামড়া, মরা মাছের চোখের ফ্যাকাসে রং। সত্যি, তিনি সব ভুলে আছেন। কাল থেকে, পরশু থেকে। আজ তিনি একটু সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। ক্যানেলের ধারে পৌঁছে তিনি সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। পাজামা পাঞ্জাবি উস্কোখুস্কো চুল আপেলের মতো টনকো মসৃণ চামড়া লম্বা পালক ঘেরা কালো চোখ এবং হঠাৎ বিষণ্ণ উদভ্রান্ত হয়ে ওঠা সেই কিশোর তরুণ মূর্তি। কাছে দূরে আশেপাশে কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে বৈদ্যনাথ দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। কেমন দমে গেলেন তিনি। তাঁর শীত করতে লাগল। যেন ক্যানেলের বুক থেকে ছুরির ফলার মতো ধারালো নিষ্ঠুর হাওয়াটা উঠে এসে বুকে বিঁধছিল। বৈদ্যনাথ, সিগারেট বার করলেন। যদি ধূমপানে শরীর গরম হয়। দু তিনটা কাঠি নষ্ট হল। হাওয়ায় দেশলাই জ্বলছে না। একটু সরে গেলেন তিনি, ছাতু ছোলার দোকানের বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে আবার ফিরে এলেন। বৈদ্যনাথ এবার খুশি হলেন, সে এসে গেছে।
‘এসো, আমরা এখানটায় বসি।’
কালকের মতো ছেলেটি আজ হাসল না। গম্ভীর।
বৈদ্যনাথের কথামত ছেলেটি গাছের গুঁড়ির পাথরটার ওপর বসল।
‘চা খেয়ে বেরিয়েছ?’ বৈদ্যনাথ প্রশ্ন করলেন।
ছেলেটি ঘাড় কাত করল এবং বৈদ্যনাথের হাতের সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে বইল। কাল বা পরশু এটা হয়নি। যেন আজ একটু সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে সে তাঁর সিগারেট খাওয়া দেখছে লক্ষ করে বৈদ্যনাথ ঠোঁট টিপে একটা চোরা হাসি হাসলেন।
‘ইস্ কান দুটো কেমন কসকস করছে।’
‘ঠাণ্ডা হাওয়া।’ বললেন বটে, কিন্তু বৈদ্যনাথ সেই সঙ্গে একটু অবাকও হলেন। কারণ হাওয়ার কথা হিমের কথা আজ এই প্রথম তিনি ছেলেটির মুখে শুনছেন। বৈদ্যনাথের এটা ভাল লাগল না। তবে কি তিনি তাঁর টুপি খুলে ওকে পরিয়ে দেবেন। বৈদ্যনাথ মনে মনে শিউরে উঠলেন। তাঁর তিপ্পান্ন বছরের পাকা চুল ঢাকতে কুঁকড়ে যাওয়া শীর্ণ কান দুটো ঢাকতে এই টুপি ভাল। কিন্তু এমন সতেজ কালো কোঁকড়া চুলের ওপর এই টুপি কুৎসিত দেখাবে না! বিদঘুটে দেখাবে না!
‘তা হলে আমরা বেশ জোরে জোরে কিছুক্ষণ হাঁটি। শরীর গরম হবে।’ বৈদ্যনাথ প্রস্তাব দিলেন। ছেলেটি মাথা নাড়ল।
‘আমার হাঁটতে মোটেই ইচ্ছা করছে না।’
অথচ কাল তিনি ছেলেটির সঙ্গে প্রায় জলের ধারে নেমে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ছুটতে ছুটতে ওধারের বড় গাধাবোটের কাছে দুজনে চলে যান। ছেলেটি বলেছিল, সে এই বরফজলে নেমে দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বৈদ্যনাথ কথার উত্তর দেননি।
‘আজ তোমার মনটা খারাপ মনে হচ্ছে?’
‘হ্যা তাই’।
বৈদ্যনাথ সিগারেটের ছাই ঝেড়ে একটু সময় ভাবেন। এমনি সাধারণ পরিচয় হয়ে গেছে। বাবা মা কানপুরে থাকেন। বাবার জুতোর দোকান। গাড়ি বাড়ি আছে। ছেলেটি কলকাতায় বেড়াতে এসেছে। বিবেকানন্দ রোডে থাকেন মামা। এবার ওর স্কুল ফাইন্যালের বছর। তা হলেও বছরে একবার দুবার কলকাতায় না এলে ভাল লাগে না। কলকাতার সিনেমা? ময়দানের সার্কাস? ক্রিকেট খেলা? কী তাকে এত টানছে? হেসে বৈদ্যনাথ কাল প্রশ্ন করেছিলেন। ছেলেটি উত্তর দেয়নি। মিটিমিটি হেসে গাধাবোটের কিনারে ঝাঁক বেঁধে বসা শালিকগুলোর দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল।
‘হঠাৎ মন খারাপ কেন?’ বৈদনাথ আজ আস্তে প্রশ্ন করলেন।
ছেলেটি চুপ করে থেকে খড়ের নৌকাটা দেখছিল।
‘আমাদের বয়সে তোমরা চাঁদে যাওয়া আসা করতে পারবে রকেটে চেপে।’ বৈদ্যনাথ ক্ষীণ গলায় হাসলেন। কিন্তু তরুণ বন্ধুটি হাসল না, হাসল না, অবাকও হল না। এমনকি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালও না। জলের দিকে দৃষ্টি। একটা সাদা হাঁস সাঁতার কাটছে। অস্বস্তিবোধ করলেন বৈদ্যনাথ।অস্বস্তিবোধ করলেন এই ভেবে, আজ কি তিনি এর কাছ থেকে দূরে সরে আছেন না! মনের দিক থেকে? অথচ কাল পর্যন্ত তিনি কিশোর বন্ধুটির কত কাছে কাছে ছিলেন; তার মনের, তার চাওয়ার, পছন্দ অপছন্দ, ভাল লাগা না- লাগার উত্তাপ শীতলতা উচ্ছ্বাস বিরক্তি বৈদ্যনাথ নিজের মন দিয়ে অনুভুতি দিয়ে সুন্দর স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। এবার তাদের কানপুরের গ্রীন-ক্লাবের ব্যাডমিন্টন কম্পিটিশনে সে সকলকে হারিয়ে দিয়েছে, পিং-পং কম্পিটিশনে সে নাম দেয়নি, ওটা মেয়েদের খেলা; হুঁ, বাবার গাড়িটা সে দু তিনদিন চালাতে চেয়েছে বটে কিন্তু মোটরগাড়ির চেয়ে মোটরবাইক তার পছন্দ বেশি, কলেজে ঢুকলে সে একটা স্কুটার কিনবে ঠিক করে ফেলেছে; অদ্দূর হেঁটে ক্লাস করা পোষাবে না। না, মুর্গি পাঁঠার মাংস তার ভাল লাগে না, মাটন—ভেড়ার (ক্যানেলের ওপারে বৈদ্যনাথ কাল তাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছেন এবং দুজনে বসে চা ডিম রুটি খাচ্ছিলেন) মাংস সে ভালবাসে। সিনেমা? সিনেমা দেখতে কলকাতায় আসা? জলের ধারে বৈদ্যনাথ তাকে যে প্রশ্ন করেছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সে গরম চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে। সিনেমা সে দেখে না, হিন্দি বাংলা কোনোটাই না, ইংরেজি টার্জন ছবি যদি আসে তবে মাঝে মাঝে দেখে, কিন্তু তার জন্য কি আর কলকাতায় ছুটে আসতে হয়, ওখানেই—
কাল কথাটা বলার সময় বৈদ্যনাথের দিকে তাকিয়ে ও এমনভাবে হেসেছিল যেন বৈদ্যনাথকে সে অনুকম্পা করছিল। কিন্তু তাতে বৈদ্যনাথ রাগ করেননি, দুঃখ পাননি; তাঁর ভাল লাগছিল এই জন্য যে কিশোর বন্ধু কোনো কথাই তাঁর কাছে গোপন করছে না।
কিন্তু আজ? আজ এই ব্যবধান কে। মেঘলা আকাশের মতো ওর মুখ। অথচ আজও আকাশের নীল পেয়ালা উপচে জাফরান রঙের রোদ খালের ঘোলা জল, জলের ধারে ধারে সবুজ ঘাসের ওপর, মাথার ওপর গাছের শুকনো ডালে, বৈদ্যনাথের হাঁটুর কাছে, ছেলেটির চিবুকের পাশে কানের কাছে ঝরে ঝরে পড়ছে; ওদিক থেকে শালিকগুলো ঝাঁক বেঁধে এদিকে উড়ে এসে কিচিরমিচির করছে, পাকুড়ের ডালে বসে কাকটা তারস্বরে ডাকছে, লোহার টুকরো বোঝাই হয়ে ভারী লরিটা মাটি কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে—চারিদিকের সব রঙ গতি সবই ঠিক আছে, কিন্তু বন্ধু এমন মনমরা হয়ে কেন। ভাবতে ভাবতে বৈদ্যনাথ এক সময় চমকে উঠলেন, তিনিই ভুল করছেন, ব্যবধানটা তিনিই রেখে দিয়েছেন; চিন্তা করে তিনি পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স ও দেশলাই তুললেন।।
কিন্তু তাহলে হবে কি, তাঁর সংস্কারে আটকাল, বোধে বাধল। সতৃষ্ণ চোখে কিশোর তাঁর সিগারেট ধরানো দেখেছে, কিন্তু তিনি তার হাতে একটা সিগারেট তুলে দিয়ে বলতে পারলেন না, ‘খাও, আমি কিছু মনে করব না।’ আর বলতে না পারার দরুন বৈদ্যনাথ বুকের মধ্যে একটা কাঁটার খচ খচ অনুভব করতে লাগলেন।
‘বুঝলে আমার বয়সে তুমি চাঁদে বেড়াতে যেতে পারবে।’ আবহাওয়াটা তরল করতে বৈদ্যনাথ আবার বললেন।
ছেলেটি মাথা নাড়ল।
‘আমি তার আগেই মরে যাব।’
‘কেন?’ বৈদ্যনাথ কেমন যেন শিউরে উঠলেন, ‘ছি, ছি ও কি বলছ। এখন মানুষ বেশিদিন বাঁচে, গড়পড়তা আয়ু বেড়ে গেছে।
‘তা বাঁচুক–আমার বাঁচা হবে না।’
‘কেন, তোমার তো তেমন কিছু একটা অসুখবিসুখ আছে বলে মনে হয় না। আছে কি? নেই। তবে আর না বাঁচার হয়েছে কি।’
‘তা হলেও আমি মরব, ইচ্ছা করেই মরব।’ ছেলেটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সিগারেটটা জ্বলছিল দু আঙুলের ফাঁকে, বৈদ্যনাথ টানতে ভুলে যান। এমন কি দুরন্ত অভিমান ও বুকে নিয়ে বসে আছে যে, ভয়ঙ্কর মৃত্যু-ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসেছে। গলার ভিতরটা কেমন তেতো ঠেকেছিল বৈদ্যনাথের। এমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন সকাল তাঁর চোখে কালো হয়ে উঠল।
‘আমায় বল না, কি হয়েছে। তোমার মনের কষ্ট কি আমি জানতে পারি নে।’
‘কি হবে জেনে।’ ছেলেটি আস্তে আস্তে বলল।
‘আমি যে শান্তি পাচ্ছি না।’করুণ গলায় বৈদ্যনাথ উত্তর করলেন। বস্তুত বৈদ্যনাথের চেহারায় যে বেদনার স্পর্শ লেগেছে বুঝতে তার কষ্ট হল না। কেমন করে জানি হাসল ছেলেটি, যেন বৃদ্ধ বন্ধুকে প্রবোধ দিতে নরম গলায় ও বলল, ‘আপনি জেনেও কিছু করতে পারবেন না, করার কিছু নেই।’ ছেলেটি থামল, এদিক ওদিক তাকাল, তারপর অনেকটা নিজের মনে বলল, ‘হয়তো আজই আমি মরব, আজ বা কাল, একটা চলন্ত লরীটরির সামনে ছুটে গিয়ে পড়ে যাব—তা হলেই ওটা আমায় চাপা দিয়ে শেষ করে দেবে।’
এবার আর বিস্ময় না, রীতিমত ভয় পান বৈদ্যনাথ। ছেলেটির চোখ দেখেন। দীর্ঘপালক ঘেরা কালো চোখ দুটোতে কেমন একটা উদাস উদভ্রান্ত ছবি ফুটে উঠেছে না!
‘চলো এখানে আর না।’ বৈদ্যনাথ হাত ধরে ওকে টেনে তুললেন। আকাশ জল ঘাস রোদে-মরা শুকনো গাছ কিছু না, কে জানে হয়তো আজ তিনদিন ধরে প্রকৃতির এই উদাস ছবি কিশোরের মনে বৈবাগ্য এনে দিয়েছে। বৈদ্যনাথেও জায়গাটা হঠাৎ খারাপ লাগল।
‘কোথায় যাব?’ ছেলেটি তাপত্তির সুর তুলল। ‘আমি বরং ওদিকে চলে যাই, ওই তো রেললাইন দেখা যাচ্ছে না? জায়গাটাও নির্জন, আমি ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিযে—’ বৈদ্যনাথের চোখে চোখ রেখে ছেলেটি ফিক করে হাসল। ‘তাহলে মরতে আধসেকেন্ডও লাগবে না।’ বৈদ্যনাথের বুকের ভিতর নড়ে উঠল। কিশোরেব এই হাসি কান্নার নামান্তর। অতি কষ্টে একটা ঢোক গিললেন তিনি।
‘আত্মহত্যা পাপ, তুমি কি জান না।’ বৈদ্যনাথ মুঠো শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরেন। ‘ঈশ্বর এমন সুন্দর করে তোমায় তৈরি করলেন, আর তুমি কিনা ইচ্ছা করে—’
‘কি হবে মন, মন যদি মরে যায় শরীর থাকা না থাকা সমান। আমার মনটাই তো শেষ হয়ে গেছে, কাজেই এই শরীর বেখে—’
স্তম্ভিত হয়ে বৈদ্যনাথ দার্শনিক উক্তিটা শুনলেন। তিনি যত ছোটটি মনে করেন বন্ধুটিকে তত ছোট তো সে নয়। এর পর কী বলবেন বৈদ্যনাথ, কথা খুঁজে পান না। চিন্তা করেন। তারপর, যেন অনেকটা নিজের মনে বললেন, ‘শুনেছি আত্মহত্যা করলে নরকে যেতে হয়। নরক বড় সাংঘাতিক জায়গা।’
‘আমি স্বর্গেও যেতে চাই নে। শুনেছি সেখানে দেবতারা আছে, আর কেবল ফল ফুলের দেশ। ফুল আর দেবতাদের কাছে থেকে আমার এমন কী সুখটা হবে।’
বৈদ্যনাথ করুণভাবে হাসলেন।
‘আহা, সে তো পরের কথা, এখনও অনেক দেরি তোমার সেখানে যেতে। তার আগে তো তুমি এখানে অনেক দিন থাকবে, এখানে কি কম সুখ, পৃথিবীটা কি কম সুন্দর।’
ছেলেটি নীরব।
‘বলেছিলে কদিন পর কলেজে ঢুকবে, একটা স্কুটার কিনবে। বলেছিলে বড় হয়ে বাবার ব্যবসা দেখতে তুমি কানপুরে পড়ে থাকবে না, পৃথিবীর সব কটা দেশ দেখতে বেরোবে, বলেছিলে—’
‘সে সব কালকের কথা পরশুর কথা—আজ তো আর বলছি নে।’
‘আজ তোমার হয়েছে কি?’ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল বৈদ্যনাথের; ধমকে উঠে ছেলেটির হাতে ঝাঁকুনি দেন। অসহায় চোখে কিশোর বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকায়। তার চোখ দুটো এবার ছলছল করছে। বৈদ্যনাথ কষ্ট পান।
‘এসো আমার সঙ্গে এসো।
‘কোথায় যাব?’
‘ওই তো পার্ক। কত ছেলেমেয়ে এসেছে ওখানে বেড়াতে। তুমি দেখবে তোমার বয়সের একটি ছেলেমেয়েও এমন মুখ ভার করে নেই।’ বৈদ্যনাথ তার সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে এগোতে থাকেন। ছেলেটি হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে। বয়স্ক বৈদ্যনাথ কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না তাঁর তরুণ বন্ধু হঠাৎ এমন চুপসে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাচ্ছে চিন্তা করে বৈদ্যনাথের শীত করছিল, একবার মনে হল তাঁর ব্লাড প্রেসারটা বাড়ছে, একবার মনে হল তাঁর ব্যথাটা নতুন করে চাড়া দিয়ে উঠছে। এটা তো সত্যি কথা, আকাশের রৌদ্রের মতো পাখির গানের মতো একটি নতুন জীবন তাঁর কাছে এসে তাঁকেও নতুন করে তুলছিল, এই দু দিন তিনি পুরনো বৈদ্যনাথ ছিলেন না।
‘দেখছ, তারা কেমন হাসছে কেমন ছুটছে।’
পার্কের একটা বেঞ্চিতে বৈদ্যনাথ বসলেন, ছেলেটিকে পাশে বসালেন। কিন্তু ছেলেটি মোটেই ওদের দিকে তাকাচ্ছে না, চোখ নামিয়ে ঘাস দেখছে। রঙিন ফ্রক পরা মেয়েগুলি বেণী দুলিয়ে স্কিপিং করছে। হাফ প্যান্ট পরা ট্রাউজার্স পরা ছেলের দল ছুটোছুটি করছে, হি হি করে হাসছে।
‘ওদের জিজ্ঞেস করো, ওরা কেউ মরতে চায় না।’
‘ওদের প্রাণে সুখ আছে তাই বাঁচতে চাইছে।’
‘তোমারই বা কি দুঃখ। বাবার এত পয়সা আছে, মা তোমায় খুব ভালবাসে, এখানে বেড়াতে এলে মামা মামীমা ভীষণ আদর করে, বলেছিলে ফি বার কলকাতায় আসার সময় মা বেশি বেশি টাকা পকেটে গুঁজে দেন যাতে কলকাতার অনেক কিছু দেখতে পার কিনতে পার খেতে পার, তাই না?’
ছেলেটি মাথা নাড়ল।
‘তা হলেও আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। আজ সকাল থেকে, আজ ঘুম থেকে উঠেই আমার ইচ্ছা করছে মরে যাই, আর যদি মরতে না পারি, যদি মরতে গিয়ে ভয় পাই তো এমন কোনো দেশে চলে যাব যে, কেউ আমায় খুঁজে পাবে না। আজও চলে যেতে পারি কালও চলে যেতে পারি।’
তার মানে তোমার ভিতরে কোনো কঠিন অসুখ সৃষ্টি হয়েছে, তার মানে তোমার মধ্যে কিছু ভাল লাগর কাউকে ভালবাসার বোধটাই দপ করে নিভে গেছে, তার মানে—ভেবে বৈদ্যনাথ যেন ছেলেটিকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর যেন হঠাৎ মনে হল ছেলেটির সেই সুকুমার কান্তি আর নেই, হাতের গালের চামড়া কুঁকড়ে গেছে; কুঁজো হয়ে বসে ও ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে, বৈদ্যনাথের মনে হল একটি ষাট বছরের বুড়ো তাঁর পাশে বসে আছে, ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। বৈদ্যনাথ ভয় পান। বেঞ্চি ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। উঠে দাঁড়ান কিন্তু সরে যেতে পারেন না। ছেলেটি মুখ তুলল। চোখের কিনারে জলের দাগ, কিন্তু বৈদ্যনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ও ফিক করে হাসল। বৈদ্যনাথের মাথা গরম হয়ে গেল।
চেহারা বিকৃত করলেন বৈদ্যনাথ। পকেট থেকে সিগারেট বার করলেন। ‘স্মোক করবে? অভ্যাস নেই। তা হলেও একটাতেই অভ্যাস এসে যাবে। দেখবে মেজাজ কেমন খুলে গেছে।’
ছেলেটির মুখ লাল হয়ে উঠল। বৈদ্যনাথের হাত থেকে সিগারেট না নিয়ে সে আকাশ দেখতে লাগল।
চটে গিয়ে বৈদ্যনাথ নিজেরটাই ধরান। গলগল করে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। এদিক ওদিক তাকান। তারপর বেঞ্চির দিকে চোখ ফেরান।
‘তোমার বয়সে আমি কি করতাম জান?’
ছেলেটি হাঁ করে বৈদ্যনাথের কথা শোনে।
গলার একটা বিশ্রী শব্দ করে বৈদ্যনাথ হাতের ছড়িটা ঘাসের ওপর ঠুকলেন।
‘ওই যে সবুজ ফ্রক পরা ফর্সা মেয়েটি লম্বা বেণী দুলিয়ে স্কিপিং-এর দড়ি ঘোরাচ্ছে, আমি ঠিক তার কাছে ছুটে যেতাম, ভাব করতাম।’
তা হলে কী হত?’ চোখ বড় করল ছেলেটি।
‘পৃথিবীটা ভাল লাগত, মনে হত একটা স্বর্গ। মনে হত না এই আলোর ভুবন ছেড়ে এক দিনের জন্যও আমি অন্য কোথাও যাই।’
লম্বা নিশ্বাস ফেলল ছেলেটি।
‘কথা বলছ না কেন।’বৈদ্যনাথ তার মাথায় হাত রাখেন, মনে মনে খুশি হন, হয়তো ওষুধে কাজ দিয়েছে, ভাবেন তিনি।
‘আ, কী চুল মেয়েটার, কী সুন্দর গায়ের রং, পা দুটো কেমন লম্বা, হাত দুটোকে মনে হচ্ছে দুটো সোনার বর্শা।’ বলতে যাচ্ছিলেন বৈদ্যনাথ, চমকে উঠলেন, দু হাতে মুখ ঢেকে ছেলেটি ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
‘কাঁদছ, বোকার মতো আবার কাঁদতে শুরু করলে!’ ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে বৈদ্যনাথ নুয়ে ছেলেটির চুল ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে গেছেন, যেন ছেলেটি তাঁর চেয়েও বেশি ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে বৈদ্যনাথকে ধাক্কা মেরে দূরে ঠেলে দিয়ে বিকৃত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল: ‘আপনি আর একবার আমার মৃত্যুর পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন, দ্বিতীয়বার মরতে তৈরি হতে বলছেন, যান, এখান থেকে সরে যান।’
বৈদ্যনাথ কিছু বুঝলেন কি বুঝলেন না, মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে গেট পার হয়ে পার্কের বাইরে এসে দাঁড়ান। যেন কেউ গলাধাক্কা দিয়ে তাঁকে রাস্তার বার করে দিয়েছে। অপমানিত বোধ করেন তিনি।
নুয়ে ছেলেটির মাথা ধরে তিনি যখন ঝাঁকুনি দিতে গেছেন তখন ওর পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটের বাক্সটা বৈদ্যনাথের চোখে পড়েছিল।
তাঁর দু চোখ ঝাপসা হয়ে এল, স্থির দৃষ্টি মেলে আকাশের নীল পেয়ালা থেকে উপচে পড়া শীতের রৌদ্র দেখতে লাগলেন।