সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সবচেয়ে বেশি অভিনয় করার কৃতিত্ব কিংবা সৌভাগ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের— মোট চোদ্দোটি কাহিনিচিত্রে তিনি রূপদান করেছেন। সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে তাঁর কি ধ্যানধারণা তা জানবার কৌতূহল নিয়ে রবিবারের এক সকালে হাজির হয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে; সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয় এক ভদ্রলোক।

সুদর্শন নায়ক নিজেই দরজা খুলে আমাদের ভেতরে বসালেন। যাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন সন্দেশ পত্রিকার একজন লেখক বলে। আমি বললাম, ‘সত্যজিৎ বাবুর ওপর আমি একটা কাজ করছি, আপনি তো মানিকদার খুব কাছের লোক, আমাকে যদি ওঁর সম্বন্ধে কিছু বলেন।’

তিনটে ধূমপানের পাইপ পরিষ্কার করতে করতে সৌমিত্র বললেন, ‘আমি ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ বলেই আমার পক্ষে কিছু বলা ঠিক হবে না, কারণ সবাই বলবে আমি তো প্রশংসা করবই, তার চেয়ে বরং আপনি প্রশ্ন করুন আমি জবাব দেবার চেষ্টা করব।’ সেই প্রশ্নোত্তর নিচে দেওয়া হল।

প্রশ্ন : আপনি তো অনেকদিন থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সিনেমায় নামবার কথা বোধ হয় ভাবেননি। সত্যজিৎবাবু আপনাকে কোথায় প্রথম আবিষ্কার করলেন?

উত্তর : ‘পথের পাঁচালী’র পর ‘অপরাজিত’ ছবিতে তরুণ অপুর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য উনি একজনকে খুঁজছিলেন। ওঁর ইউনিটের লোকেরা ব্যস্তভাবে সারা কলকাতা চষে বেড়াচ্ছিল। নিত্যানন্দ দত্ত ছিলেন ওঁর ইউনিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর। তিনি আমার এক বন্ধুর বন্ধু। তাঁর কাছেই আমার কথা শোনেন নিত্যানন্দ বাবু, তারপর আমাকে সত্যজিৎবাবুর কাছে নিয়ে যান। কিন্তু তরুণ অপুর পক্ষে আমি বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম তাই ও ছবিতে নামা হয় নি। পরে যখন উনি ‘অপুর সংসার’ করবেন ঠিক করলেন, আমাকে ডেকে পাঠালেন। শুনেছিলাম আমাকে প্রথম দেখে ওঁর পছন্দ হয়েছিল, ঠিক করেছিলেন ভবিষ্যতে বড়োদের ছবি করলে আমাকেই নেবেন।

প্র: উনি যখন আপনাকে ‘অপুর সংসার’-এ কাজ করার প্রস্তাব দিলেন, আপনার কি মনে হয়েছিল?

উ: কোন চরিত্রের জন্য আমাকে নেওয়া হয়েছিল, সে সম্বন্ধে প্রথমে আমার পরিষ্কার ধারণা ছিল না। যখন জানতে পারলাম অপুর জন্য, তখন খুবই আনন্দ হয়েছিল।

প্র: থিয়েটারে অভিনয় আর সিনেমার অভিনয়ে মধ্যে তফাৎ কি?

উ: এ প্রশ্নের জবাব দু-চার কথায় দেওয়া মুশকিল, তবে বলা যায় বেসিক্যালি এক।

প্র: আপনার কোনটা বেশি ভালো লাগে, সিনেমায় অভিনয় না থিয়েটারে?

উ: দুটোই— আসলে সিনেমায় নামার আগ্রহ আগে আমার তেমন ছিল না।

প্র: সত্যজিৎবাবুর যে ক-টা ছবিতে আপনি অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে কোন চরিত্রটি আপনার সবচেয়ে প্রিয় এবং কোন ছবিতে কাজ করে আপনি আনন্দ পেয়েছেন বেশি?

উ: বলা খুব শক্ত। মোটামুটিভাবে বলা যায় ‘অপুর সংসার’, ‘সমাপ্তি’, ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’, ‘অশনি সংকেত’ এই ছবিগুলিতে কাজ করে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।

প্র: ‘পথের পাঁচালী’র পর ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে আমরা আবার সেই গ্রাম্য পরিবেশে ফিরে আসি। সেই সরল মানুষের সুখদুঃখের কথা। সিঙ্গাপুরে যুদ্ধ হচ্ছে, সিঙ্গাপুর কোথায় তার জবাবে গঙ্গাচরণ নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘ওই মেদিনীপুরের কাছে টাছে হবে।’ ‘অশনি সংকেত’ ‘পথের পাঁচালী’র পর সত্যজিৎবাবুর শ্রেষ্ঠ ছবি এ সম্বন্ধে আপনার কি অভিমত?

উ: ‘পথের পাঁচালী’র পর ওটাই শ্রেষ্ঠ ছবি এমন কথা বলা মুশকিল, তবে দুটোর সেটিং প্রায় এক, গ্রামবাংলার চিত্র নিয়ে ছবির কাহিনি।

প্র: ফেলুদার চরিত্রে আপনি জনপ্রিয় হলেও ‘অভিযান’ ছবিতে নরসিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় অনেক উঁচু মানের, এ সম্বন্ধে আপনি কি বলেন?

উ: এ প্রশ্নের জবাব দর্শকরা দেবেন, নিজের অভিনয় সম্বন্ধে আমি কি বলব! তবে ওটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জিং রোল, ওই চরিত্র আমার খুব ভালো লেগেছিল।

প্র: পরিচালক সত্যজিৎ সম্বন্ধে কিছু বলুন?

উ: যাঁদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে উনি শ্রেষ্ঠ। ছবি তোলার ব্যাপারে যেসব দিক আছে, সবকিছুতেই তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। শুধু ফিলম মেকিংয়ের ব্যাপারে তাঁর মতো কম্পিটেন্ট আর যে নেই তা নয়, তবে শিল্পগতভাবে অমন উৎকৃষ্ট চিন্তাভাবনা হয়তো তাঁদের নেই; আবার যাঁদের শিল্পগত দক্ষতা আছে তাঁদের হয়তো ফিলম মেকিংয়ের অতটা কম্পিটেন্সি নেই, সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে সবকিছু গুণের সমন্বয় ঘটেছে।

ওঁর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল অনেক ক্ষেত্রেই উনি শিল্পীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন, তাঁদের নিজেদের মতো কাজ করার সুযোগ দেন যাতে তাঁরা সহজ স্বাভাবিক অভিনয় করতে পারেন। অযথা নির্দেশ বা ডিরেকশনের ওপর জোর না দিয়ে সিচ্যুয়েশনটা বুঝিয়ে দেন। একেবারে আনাড়ি, কোনোদিন অভিনয় করেনি, এমন শিল্পীর ক্ষেত্রেও উনি এমন সুযোগ দিয়ে আশাতীত ফল পেয়েছেন। আবার যেখানে উনি দেখেন শিল্পী সিচ্যুয়েশনটা বুঝতে পারছেন না কিংবা চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না, সেখানে উনি বলে বলে দেন ‘এটা করো’, ‘ওটা করো’, কিংবা ‘এভাবে করো’, ‘ওভাবে করো’। আসল রিহার্সালের ওপর জোর দেবার চাইতে শিল্পীদের স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেবার তিনি পক্ষপাতী।

প্র: দেখা গেছে বিখ্যাত কিংবা নামি লেখকদের কাহিনি নিয়ে ছবি করার দিকেই সত্যজিৎ রায়ের ঝোঁকটা বেশি। যেমন, রবীন্দ্রনাথের তিনটি গল্প নিয়ে ‘তিন কন্যা’, তারপর ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ‘অপুত্রয়ী’, ‘অশনি সংকেত’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শঙ্করের দুটি করে কাহিনি। এ সম্বন্ধে আপনি কি বলেন?

উ: আসলে উনি ভালো গল্প বা কাহিনি খোঁজেন। অনেক সময় সিনেমার খাতিরে সেই কাহিনির কিছু পরিবর্তন করতে হয়, সেভাবে উনি চিত্রনাট্য লেখেন। চিত্রনাট্য এরকমই সাহিত্যই বলা চলে, বরং বলা যায় বিশেষ সাহিত্য। তাছাড়া উনি শুধু সিনেমার জন্যই কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন, যেমন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’— অসাধারণ সেই চিত্রনাট্য; তারপর আছে ‘নায়ক’।

প্র: মানুষ সত্যজিৎ সম্বন্ধে কিছু বলুন।

উ: আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। তবে আগেই বলেছি, আমি ওঁর এতই ঘনিষ্ঠ যে আমার পক্ষে তাঁর সম্বন্ধে ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলা মুশকিল।

প্র: সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার সময় কিছু মজার ঘটনা বলুন।

উ: দেখুন, এত ছবিতে অভিনয় করেছি, আমার ওসব কিছু মনে থাকেনা তবে এ ব্যাপারে মুভি মনতাজে ‘অপু থেকে গঙ্গাচরণ’ নামে একটা রম্য রচনা লিখেছিলাম, সেটা পড়ে দেখতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *