যৌবন ও কর্মজীবন
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক প্রশান্ত মহলানবিশের সংস্পর্শে এসেছিলেন সত্যজিৎ। মহলানবিশ ছিলেন সুকুমারের বন্ধু। সত্যজিৎকে তিনি পরম স্নেহের চোখে দেখতেন। এশিয়ার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নাম চিরকাল যুক্ত হয়ে থাকবে।
এদিকে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে আসেন, শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। সংগীত, নৃত্য ও শিল্পকলায় শান্তিনিকেতনের তখন খুব নামডাক। সারা দেশ থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও ছাত্রছাত্রীরা ওখানে অধ্যয়ন করতে আসে।
১৯৪০ সালে ইকনমিকসে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করলেন সত্যজিৎ। মা আর রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে তিনি শান্তিনিকেতনে গেলেন, যদিও শিল্পী হবার কোনো আকাঙ্ক্ষা তখন তাঁর ছিল না। ভাগ্য কেমন করে মানুষকে তার নিজের পথে নিয়ে যায়!
ওই বছরই তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। শিল্পবিভাগের প্রধান তখন বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসু। আসল গুরু পেয়ে গেলেন সত্যজিৎ। ছমাসের মধ্যে তাঁর এত উন্নতি হয়েছিল যে, নন্দলাল বসু নিজেও কম অবাক হননি। শিল্পী সত্যজিতের জন্ম হল।
মজার কথা, শান্তিনিকেতনে তিনি কিন্তু কখনো কোনো নাটকে অংশগ্রহণ করেননি। ও ব্যাপারে তখন তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। বরং সন্ধেবেলায় বিছানায় উপুড় হয়ে বই পড়া কিংবা গ্রামাফোনে পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীত শোনাতেই তাঁর ছিল আনন্দ। বেটোফেন, মোৎসার্ট, বাখ (Bach) খুব প্রিয় ছিল তাঁর। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সংগীত সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান আর অনুরাগ ছিল বেশি।
শান্তিনিকেতনে এক বছর কাটবার পর ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ দেহত্যাগ করলেন। শান্তিনিকেতন যেন মরুভূমি হয়ে গেল, ওখানে আর থাকতে মন চাইল না সত্যাজিতের। তাছাড়া মা তাঁর জন্য কত আর করবেন, এবার তাঁর উচিত সংসারের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে নেওয়া।
১৯৪২ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি শান্তিনিকেতনের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে তিনি পরিভ্রমণে বেরুলেন। এলিফ্যান্টার গুহাচিত্র তাঁকে মুগ্ধ করল। কিন্তু আরও অবাক হবার পালা ছিল তাঁর। অজন্তা আর ইলোরা তাঁর চোখ খুলে দিল। প্রাচ্যের শিল্পকলা যে এত উন্নত হতে পারে এটা তাঁর ধারণাই ছিল না। ওখান থেকে তাঁরা গেলেন ঝাঁসি, সেখান থেকে যাবেন খাজুরাহো। দ্বাদশ শতাব্দির বিখ্যাত সব মন্দির যেখানকার প্রধান আকর্ষণ।
সেই মুহূর্তে পার্ল হারবারে বোমা ফেলল জাপানিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়ল এশিয়ায়। সত্যজিৎ সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ফেললেন কলকাতায় ফিরবেন। শান্তিনিকেতনের পাঠ এখানেই সাঙ্গ। আচার্য নন্দলাল বসু তাঁর সিদ্ধান্ত শুনে খুব দুঃখিত হয়েছিলেন, সত্যজিতের মধ্যে তিনি এক উদীয়মান শিল্পীর পরিচয় পেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনের পালা চুকে গেল।
তখন তাঁর বয়স একুশ। একটা চাকরি চাই। কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে তিনি তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবেন এ আত্মবিশ্বাস তাঁর ছিল, কিন্তু কলকাতায় চাকরি পাওয়া অত সহজ ছিল না। ছমাস বসে থাকবার পর ১৯৪৩ সালে মাত্র পঁচাশি টাকা মাস মাইনেয় বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কীমারে তিনি চাকরি পেলেন, ওটার মালিকানা তখন ইংরেজদের হাতে। তাঁর কাজ হল বইয়ের মলাটের ছবি আঁকা। পরে সিগনেট প্রেস থেকেও তাঁর কাছে কাজের আহ্বান এল, কীমারের সঙ্গে সঙ্গেই ওটা করা যাবে। কীমারের সদর দপ্তর ছিল লন্ডনে, কলকাতার শাখা আপিসে ওপরের দিকে বেশ কিছু ইংরেজ অফিসার ছিল। তাঁরা কিন্তু সত্যজিতকে চিনতে ভুল করেননি, ফলে চাকরিতে উন্নতি আর মাইনে বাড়ার ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হল না।
লন্ডন থেকে সে সময় কোম্পানির কলকাতা আপিসের কাজকর্ম কেমন চলছে তা দেখবার জন্য এক জাঁদরেল অফিসার এলেন। তাঁর সম্মানে একটা ককটেল পার্টি দেওয়া হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের সবাই সেজেগুজে পার্টিতে গেলেন এবং অবিশ্যিই ইউরোপিয়ান পোশাকে। সত্যজিৎ একমাত্র ব্যতিক্রম, তিনি গেলেন ধুতি পরে। সবাই যখন রঙিন সুরায় বিভোর, তিনি পান করলেন টমোটোর রস। এই হলেন সত্যজিৎ।
প্রায় দশ বছর তিনি ডি জে কীমারে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন, ওখানকার একজন ডিরেক্টরের পদে পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন।
কীমারে কাজ শুরু করার পর থেকেই কিন্তু ছবি তোলার ব্যাপারটা তাঁর মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ১৯৪০-এর গোড়ার দিকে কয়েকটা ভালো বাংলা ছবি হয়েছিল, তার ক্যামেরাম্যান ছিলেন বিমল রায়। তিনি যখন ‘উদয়ের পথে’ করলেন, সত্যজিৎ তার মধ্যে যেন নিজের ভাবনা চিন্তার একটা সূক্ষ্ম যোগ খুঁজে পেলেন। হিন্দি ‘দো বিঘা জমিন’ তাঁর মন নাড়া দিয়েছিল। ‘উদয়ের পথে’ আর ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগাল, তিনি স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করলেন। তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা ‘দ্য প্রিজনার অফ জেন্ডা’ নিয়ে একটা চিত্রনাট্য। ওই কাহিনি ভিত্তি করে একাধিক ছবি আগেই জনপ্রিয় হয়েছিল। সত্যজিৎ বিমল রায়ের সঙ্গে ও বিষয়ে কথা বলেছিলেন কিন্তু তিনি ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেননি।
এতেও হতাশ হলেন না সত্যজিৎ। কিছুদিন পরে তিনি দুটো গল্পের সিনারিও লিখলেন— একটা ছোটো গল্প ‘উইলিয়ামসন’কে ভিত্তি করে, অন্যটা রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ কাহিনির ভাব নিয়ে। একজন প্রযোজক ‘ঘরে বাইরে’ করবার জন্য এগিয়ে এলেন, চুক্তি পর্যন্ত সই হয়ে গেল। এই সময়েই বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয়। বংশী চন্দ্রগুপ্ত কাশ্মীরের মানুষ। তিনি তখন ছবি আঁকা ছেড়ে সিনেমায় আর্ট ডিরেক্টর হবার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের পরিচয়ের মধ্যেও যেন ভাগ্যদেবীর প্রসন্ন হাসির ছোঁয়া। বংশীর সঙ্গে সত্যাজিতের সম্পর্ক ভাবীকালে নিবিড় হয়ে উঠেছিল, সত্যজিতের অধিকাংশ ছবির শিল্প নির্দেশক ছিলেন তিনিই। বংশী চন্দ্রগুপ্তর আকস্মিক মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক।
সত্যজিৎ আর বংশী ছুটির দিন হলেই ‘ঘরে বাইরে’ ছবি তোলার জন্য লোকেশনের খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন, সত্যজিতের গলায় ঝোলানো থাকত একটা ক্যামেরা। কিন্তু ওই ছবির প্রযোজক আর পরিচালক তাঁদের ইচ্ছেমতো স্ক্রিপ্ট বদলাতে চাইলেন, সত্যজিৎ তাতে রাজি হলেন না ফলে চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। এটা বোধ হয় ১৯৪৬ সালের ঘটনা। তার প্রায় চল্লিশ বছর পরে ‘ঘরে বাইরে’ ছবি করেছিলেন সত্যজিৎ, তখন তিনি স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত।
১৯৪৫ সালে, অর্থাৎ যে বছর ‘ঘরে বাইরে’র চুক্তি খারিজ হয়ে গেল তার আগের বছর, সিগনেট প্রেস সত্যজিৎকে ‘পথের পাঁচালী’ বইয়ের এক সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ছবি আঁকার ভার দিল। ওটার কাজ করার সময় থেকেই ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে একটা ছবি করার চিন্তা তাঁর মাথায় আসে। ওই সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্য তিনি যে ছবি এঁকেছিলেন তার সামান্যই কিন্তু পরবর্তীকালে সিনেমার জন্য তিনি যে স্কেচ করেছিলেন তার সঙ্গে মেলে। ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে একটা ছবি করার কথা তাঁর মনে উঁকি ঝুঁকি মারলেও ওই সময় তিনি কিন্তু ওটার কোনো চিত্রনাট্য লেখেননি। সেটা আরও পরে। তবে এ কথা ঠিক যে ১৯৪৯ সালে ‘পথের পাঁচালী’ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাঁর মন।
ছোটোবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি তিনি ভীষণভাবে আকৃষ্ট। ১৯৪৭-৪৮ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ক্যালকাটা ফিলম সোসাইটি। শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্ত (অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের বাবা) এবং শ্রী হরিসাধন দাশগুপ্ত গোড়া থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই সত্যজিৎ একই ছবি অনেকবার দেখতেন আর খুঁটিনাটি বিষয় লিখে রাখতেন।
পুডভকিন, পল রোখা, ভ্লাদিমির নিলজেন, আইজেনস্টাইন তাঁর মনে জাগাত অসীম কৌতূহল। তখন ১৯৪৭ সাল, এঁদের চলচ্চিত্র-চেতনা তাঁর কাছে ছিল এক নতুন আবিষ্কারের মতো। জন ফোর্ড, ফ্রিৎজ, ল্যাঙ, ফ্র্যাঙ্ক কাপরা, জন হাস্টন, লুবিস, বিলি ওয়াইলডার, এঁদের তোলা ছবি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ছোটোবেলায় লে মিজারেবল গভীর রেখাপাত করেছিল তাঁর মনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিছু সোভিয়েত ছবি সত্যজিৎকে খুব নাড়া দিয়েছিল। সেগুলো হল, ‘আইভান দ্য টেরিবল’, ‘আলেকজান্ডার নেভঙ্কি’, ‘স্টরম ওভার এশিয়া’, ‘প্রফেসর ম্যামলক’ ইত্যাদি।
আবার আমরা কয়েক বছর আগের ঘটনায় ফিরে যাই। ১৯৩১ সালে সত্যজিতের যখন দশ বছর বয়স, মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছেন, তখন তাঁর বড়োমামা [সুপ্রভা দেবীর বৈমাত্রেয় ভাই] চারুচন্দ্র দাশ হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার, বিলেতে গিয়েছিলেন, খুব হইচই করতে ভালোবাসতেন। তাঁর চার মেয়ে গৌরী, সতী, জয়া আর বিজয়া। মেয়েরা এসে উঠলেন প্রশান্ত দাশের বাড়ি। নাচে, গানে, অভিনয়ে সবাই পারদর্শিনী।
সত্যজিতের রুচির সঙ্গে বিজয়ার রুচির খুব মিল, দুজনের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল। দুজনেরই সংগীতের দিকে দারুণ ঝোঁক। প্রথমদিকে ওঁরা জনপ্রিয় গায়ক পল রবসন, নেলসন এডি এঁদের রেকর্ড নিয়ে মেতে উঠেছিলেন কিন্তু পরে পাশ্চাত্য মার্গ সংগীতের দিকে ঝোঁকেন। দুজনের কেউই কিন্তু জাজ পছন্দ করতেন না। সত্যজিৎ তাঁর হাত খরচের সব টাকাই ঢালতেন রেকর্ডের পেছনে।
সত্যজিতের বয়স যখন আঠারো, তিনি বুঝতে পারলেন বিজয়াকে তিনি ভালোবাসেন, বিজয়ার অবস্থাও তথৈবচ, সত্যজিৎ ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্কে মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের নিয়ম নেই, যদিও দক্ষিণ ভারতে মামা আর ভাগ্নীর বিয়ে খুব শুভ ঘটনা। ওঁরা ঠিক করলেন পরস্পরের প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত থাকবেন, কখনো বিয়ে করবেন না। বিজয়া অভিনয়ের জন্য বোম্বে চলে গেলেন।
১৯৪৮ সালে সত্যজিৎ মাকে নিয়ে মামাবাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসা করলেন। তখন তাঁর রোজগার ভালো, প্রায় বাইশ বছর মামাবাড়ি কাটিয়ে স্বাধীনভাবে জীবন শুরু করলেন। সত্যজিৎ ধরেই নিয়েছিলেন বিজয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে না, সামাজিক অনুশাসনই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সুপ্রভা রায়, এ বিয়েতে যাঁর দিক থেকে বাধা আসবার কথা ছিল সবথেকে বেশি, তিনিই বললেন, তাঁর ছেলে যদি সুখী হয় তবে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না। আশ্চর্য মহিলা ছিলেন সুপ্রভা রায়। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে যে সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় তিনি দিয়েছেন আজও তা বিরল— এখনও বাঙালি পরিবারে এমন বিয়ের কথা উঠলে চারদিক থেকে প্রবল বাধার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ঢাকার বিখ্যাত কালীনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন সুপ্রভা দেবীর মাতামহ, তাঁর কীর্তিকলাপ সে সময় সমগ্র ঢাকা জেলায় লোককাহিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মজার কথা, শৈশবে তাঁকেও কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের মতো এক অবস্থাপন্ন পরিবারে দত্তকপুত্র রূপে গ্রহণ করা হয়েছিল। ছোটোবেলা থেকেই সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অসীম দরদ। হিন্দু সমাজের কঠিন অনুশাসন সত্ত্বেও নিচু জাতের মানুষদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে তিনি ভয় পেতেন না। ১৮৬৯ সালের নভেম্বর মাসে যখন তাঁর বয়স উনচল্লিশ, তিনি তাঁর স্ত্রী এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রকে নিয়ে ঢাকা শহরে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার জন্যে। দীক্ষা নেবার আগে তাঁদের সঙ্গে একাসনে বসেছিল তাঁদের দুজন ভৃত্য— সবাই একসঙ্গে দীক্ষিত হবেন। এমনই ছিল কালীনারায়ণের মনের উদারতা। ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারক কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা।
দীক্ষার পর নিজের জমিদারিতে ফিরে এসেই তিনি গ্রামে এক ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনুন্নত এবং কৃষকশ্রেণিদের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের জন্য তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কালীনারায়ণ গুপ্তর কণ্ঠস্বর ছিল দরাজ। তাঁর স্ত্রী অন্নদা দেবী সুললিত কণ্ঠে ধর্মের গান গাইতেন।
কালীনারায়ণ কিছু চিকিৎসাবিদ্যায়ও অর্জন করেছিলেন, ছোটোখাটো অস্ত্রোপচার করতে পারতেন। কত লোকের অসুখ যে তিনি সারিয়েছিলেন তার হিসেব নেই। গ্রামের মানুষ তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করত। স্টেশনমাস্টারকে তিনি বলে রেখেছিলেন দূরযাত্রীদের যারাই গাড়ি ধরবার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে তাদের যেন তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তিনি তাদের আহার বিশ্রামের ভার নেবেন। এমনকি যাত্রীদের মধ্যে যারা দুঃস্থ, তাদের তিনি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন।
তাঁর যখন বৃদ্ধ বয়স তখন তিনি দিনের পর দিন এক অসুস্থ মেথরের সেবা করেছিলেন। মৃত্যুর পর নিচু জাতের ওই মানুষটার শব বহন করার লোক জোটেনি। কালীনারায়ণ শবদেহ নিজের কাঁধে তুলে শ্মশানঘাটে গিয়েছিলেন। জমিদারের এই কাণ্ড দেখে গাঁয়ের মানুষরা লজ্জায় ছুটে এসেছিল, তাদের হাতে শব দেবার অনুরোধ করেছিল। কালীনারায়ণ তাদের বলেছিলেন, ‘ও যখন বেঁচে ছিল, আমার অনেক উপকার করেছে। ওর শেষ কাজ করতে পারলে আমি শান্তি পাব।’
এমন মানুষের নাতনি সুপ্রভা দেবী সংস্কার মুক্ত হবেন এতে আর বিচিত্র কি!
তখন কলকাতায় অমন আত্মীয়তা সম্পর্কের মধ্যে বিয়ের নিয়ম ছিলনা, কিন্তু বোম্বেতে ছিল, তবে বর কনের একজনকে বোম্বের অধিবাসী হতে হবে। বিজয়াতো আগে থেকেই ওখানে আছেন তাই অসুবিধে হল না। সত্যজিৎ বোম্বাই গেলেন বিয়ে করতে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বিজয়া দাশ হলেন বিজয়া রায়, সত্যজিৎ-জায়া।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বিয়ের পর থেকেই সত্যজিতের জীবনে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা, ধাপে ধাপে উন্নতির সোপান বেয়ে উঠেছেন তিনি, পেয়েছেন বিপুল যশ, সারা বিশ্বের সম্মান। বিজয়া রায় নিশ্চয়ই এ কৃতিত্বের ভাগীদার। তিনি সত্যজিৎকে শুধু অনুপ্রেরণাই যোগাননি, বড়ো হবার সবরকম সাহায্য করেছেন, দুঃসময় নিজের গা থেকে গয়না খুলে দিতেও ইতস্তত করেননি। মাতা ও জায়া সৌভাগ্যে নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবান সত্যজিৎ।
ওই সময় কলকাতায় এলেন হলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়া, তাঁর ‘রিভার’ ছবির শুটিং করতে। সত্যজিৎ হোটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। নিজের পরিচয় দিলেন একজন চলচ্চিত্রানুরাগী ও ফিলম সোসাইটির সংগঠক বলে। রেনোয়া গ্রামবাংলার সঙ্গে পরিচিত একজন লোক খুঁজছিলেন, সত্যজিৎ সেই সুযোগ গ্রহণ করলেন। তাঁর সঙ্গে ঘুরলেন, ‘পথের পাঁচালী’ সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনার কথাও বললেন। রেনোয়া তাঁকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন যদি হলিউডের ধারা ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব ধাঁচে ছবি তোলার চেষ্টা করো তবেই মহৎ ছবি তুলতে পারবে, তার আগে নয়। কত বড়ো খাঁটি কথা রেনোয়া বলেছিলেন কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা বোধ হয় তিনি নিজেও জানতেন না।
এদিকে যে বিজ্ঞাপন সংস্থায় তিনি কাজ করছিলেন, সেখানে তাঁর কাজের সুখ্যাতি বিলেতেও গিয়ে পৌঁছেচে। ১৯৫০ সালে তাঁকে আর্ট ডিরেক্টরের পদে প্রমোশন দিয়ে কয়েক মাসের জন্য লন্ডন অফিসে বদলি করা হল।
ওই প্রথম বিদেশ যাত্রা। সস্ত্রীক লন্ডন গেলেন সত্যজিৎ। এক অভাবনীয় সুযোগ এল তাঁর জীবনে। যেসব ভালো বিদেশি ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিংবা কখনো হয়তো দেখা হত না, আশ মিটিয়ে তা দেখলেন। পাঁচ মাসে পঁচানব্বুইটি— মারি সিটন তাঁর বইয়ে লিখেছেন সাড়ে চার মাসে নিরানব্বইটি ছবি সত্যজিৎ দেখেছিলেন। আবার ফ্লেহার্টি ফাউন্ডেশন সেমিনারে সত্যজিতের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এইচ গ্রে লিখেছেন সত্যজিৎ লন্ডনে তিন মাস ছিলেন, তার মধ্যে নব্বুইটারও বেশি ছবি দেখেছিলেন।
যেদিন লন্ডনে পৌঁছুলেন সেদিনই সন্ধ্যায় পর পর দুটো ছবি দেখেছিলেন কার্জন সিনেমায়, তার একটা হল ‘দি বাইসাইকেল থিফ’— পরিচালক ভিট্টারিও ডি সিকা। মুগ্ধ হয়ে গেলেন সত্যজিৎ। এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন স্টুডিয়োর বাইরে শুধু অপেশাদার অভিনেতা দিয়ে পরিচালক কী কাণ্ড ঘটাতে পারেন! ইতালিতে যা সম্ভব কলকাতায় তা কেন নয়? এই প্রশ্নটাই জাগল তাঁর মনে। তারকা ছাড়াই শুধু লোকেশনের উপর ভিত্তি করে মনের মতো একটা ছবি।
এরপর দেখলেন ‘মিরাকল অফ মিলান’। রবার্ট ফ্লেহার্টির ‘মানুক অফ দ্য নর্থ’ ও ‘লুসিয়ানা স্টোরি’ দেখে তাঁর মন ভরে গেল।
রাশিয়ান ছবির মধ্যে ডভঝেনস্কির প্রতিভা তাঁকে আপ্লুত করলে। ডনস্কয়ের ‘চাইল্ডহুড অফ ম্যাক্সিম গোর্কি’ তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগাল।
‘দি বাইসাইকেল থিফ’ দেখে তিনি মনস্থির করলেন নিওরিয়ালিস্টিক স্টাইলে ‘পথের পাঁচালী’ ছবি করবেন। লন্ডন থেকে ভারতে ফেরার সময় ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্যে তিনি হাত দিলেন। এ ছবি করার পেছনে এক বিশুদ্ধ শিল্প ভাবনা কাজ করেছিল, যার ছিল সার্বজনীন আবেদন। ১৯৫০-এর অক্টোবরে কলকাতায় ফিরেই তিনি চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করে ফেললেন। বেশ কিছু প্রযোজককে তিনি খসড়া দেখালেন, তাঁদের আকৃষ্ট করার জন্য তিনি ছবির প্রায় পাঁচ-শো রেখাচিত্র এঁকেছিলেন, কিন্তু কেউই উৎসাহ দেখালেন না।
তাঁর ইউনিটে তখন বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আর্ট ডিরেক্টর (রেনোয়ার সঙ্গে সদ্য কাজ করে তাঁর কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে), সুব্রত মিত্র, ক্যামেরাম্যান (রেনোয়ার শুটিংয়ের তিনি ছিলেন একজন মনোযোগী দর্শক, বিশেষ করে ক্লড রেনোয়ার ক্যামেরার কাজ আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন তিনি)। আরও তিনজন এসে যোগ দিলেন ইউনিটে। দুলাল দত্ত, ছবির সম্পাদনার কাজের দায়িত্ব পড়ল তাঁর উপর, শান্তি চ্যাটার্জি সহযোগী আর বাঁশের মতো রোগা লম্বা অনিল চৌধুরি, অমন চেহারা হলেও মানুষটি কিন্তু খুব শক্ত। সুখে দুঃখে এই ক-জন সবসময় সত্যাজিতের পাশে ছিলেন।
ছবিটা তোলার ব্যাপারে অনেক প্রযোজকের দ্বারস্থ তাঁরা হয়েছিলেন, তাঁদের একজন হলেন অরোরা ফিলমের অজিত বোস। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ‘পথের পাঁচালী’র পরিবেশনার স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন এবং আরও পরে ‘অপরাজিত’র টাকা যুগিয়েছিলেন। শ্রীবোস চিত্রনাট্য দেখে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু বলেছিলেন তিনি ছবি তৈরির জন্য টাকা ঢালতে রাজি যদি নামি কোনো পরিচালকের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে সম্মত হন সত্যজিৎ।
বলা বাহুল্য সত্যজিৎ রাজি হননি, আর্থিক সঙ্কট থাকলেও মনের দিক থেকে তিনি দেউলিয়া ছিলেন না। তাঁর মানসিক দৃঢ়তার এটাও এক দৃষ্টান্ত। ছবি হয় তাঁর নির্দেশনায় হবে নয়তো হবে না।
‘অপুর সংসার’ প্রযোজনা করেছিলেন অসিত চৌধুরি, ওটা হল ওই সিরিজের তৃতীয় ছবি। তাঁর কাছেও যাওয়া হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’র জন্য। তখন কিন্তু তিনি মনে করেছিলেন সত্যজিতের মাথা খারাপ হয়েছে।
সত্যজিৎ আর তাঁর ইউনিটের সবাই একজন প্রযোজকের খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন। একটা ছবি তখন কলকাতায় দারুণ শোরগোল ফেলেছিল, বক্স অফিস হিট। ওঁরা ভাবলেন পরিবেশক নিশ্চয়ই খানদানী মানুষ। টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে ভদ্রলোকের ঠিকানা খুঁজে অনিল চৌধুরি তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, সত্যজিতের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বললেন। ভদ্রলোক যেন ব্যাপারটায় গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। তিনি অনিল চৌধুরির সঙ্গে তক্ষুণি সত্যজিতের বাড়ি গিয়ে দেখা করলেন। অনেক প্রশ্ন করলেন, তার মধ্যে একটা হল সিনেমা করার জন্য কাহিনির স্বত্ব কেনা হয়েছে কিনা। সত্যজিৎ জানালেন কাহিনিকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু তখনও পর্যন্ত টাকা দেওয়া হয় নি। ভদ্রলোক জানালেন এক সপ্তাহ পরে চুক্তিপত্র নিয়ে তাঁদের মধ্যে বৈঠক হবে। তারপরই সেই ভদ্রলোক এক মজার খেল দেখালেন। বিভূতিভূষণের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বললেন, তাঁর পরলোকগত স্বামীর ওই কাহিনির জন্য দশ পনেরো হাজার যা টাকা লাগে তিনি দেবেন, ভদ্রমহিলা যেন সত্যজিতের মতো এক অনভিজ্ঞের হাতে ওটা ছেড়ে না দেন। ছবি তোলার ব্যাপারে সত্যজিতের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, ওই কাহিনির ছবি করা খুব নামি পরিচালকের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব।