ছেলেবেলা
আবার আমরা ফিরে যাই সত্যজিতের ছেলেবেলায়। ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাস, সত্যজিতের যখন পাঁচ বছর বয়স, ইউ রায় অ্যান্ড সন্স দেউলিয়া হয়ে গেল। এক-শো নম্বর গড়পার রোডের বাড়ি ছেড়ে দিতে হল। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লেন ওই বাড়ির বাসিন্দারা। দেবর মুক্তিদারঞ্জনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের স্ত্রী বিধুমুখী, অল্প কিছুদিন পরে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
সুপ্রভা দেবী শিশুপুত্রকে নিয়ে উঠলেন ছোটো ভাই পি কে দাশের বাড়ি। সেটা ১৯২৬-এর শেষের দিক কিংবা ১৯২৭-এর গোড়ার কথা। শুরু হল এক নতুন জীবন, জমিদারি প্রভাবের বাইরে অন্য এক পরিবেশে।
গড়পার রোডের বাড়িতে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন সত্যজিৎ। পৃথিবীর আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ছাপাখানার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। জন্ম থেকেই যাঁর ব্লক-মেকিং, ছবি তোলা, এসবের সঙ্গে পরিচয়, যাঁর ধমনীতে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের রক্ত, তিনি যে উত্তরকালে রং-তুলি আর কলম হাতে অসাধারণ হয়ে উঠবেন তাতে আর বিচিত্র কি! উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন রং ও চিত্রবিদ্যায় অসামান্য শিল্পী, সুকুমার রায় বিলেত থেকে ফোটোগ্রাফি সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা অর্জন করে এসেছিলেন, কুলদারঞ্জন ছবি এনলার্জের ব্যাপারে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী— ছবি আর ছবি তোলার ব্যাপারটা সত্যজিতের অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া।
গড়পার থেকে সত্যজিৎ তাঁর মার সঙ্গে ভবানীপুরের বকুলবাগানে মামাবাড়িতে এলেন। তখন তাঁর বয়স আর কত, ছয়ে পা দেবেন মাত্র। এই মামা ছিলেন সেজো মামা, প্রশান্ত কুমার দাশ, সত্যজিতের সোনামামা। একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও আমুদে মানুষ, মুখে মুখে অঙ্ক কষতে পারতেন। এখানে থাকতেই বায়োস্কোপের সঙ্গে সত্যজিতের প্রথম পরিচয়। তখনও টকি হয়নি, নির্বাক ছবির যুগ। বেনহুর, কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো, থিফ অফ বোগদাদ, আঙ্কল টম’স কেবিন, এমন সব ভালো ভালো ইংরেজি ছবি দেখার সুযোগ সে সময় হয়েছিল সত্যজিতের। ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ ছবিটা দেখে কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছিলেন।
বকুলবাগানে থাকতেই সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় সন্দেশ দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়েছিল। ছোটোদের মাসিক পত্রিকা রামধনুর তখন রমরমা অবস্থা। বকুলবাগান আর টাউনসেন্ড রোডের মোড়ে ১৬নং টাউনসেন্ড রোড থেকে ওটা বেরুত। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হুকাকাশির গোয়েন্দা কাহিনি তখন একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ‘সোনার হরিণ’, ‘ঘোষ চৌধুরির ঘড়ি’, ‘পদ্মরাগ’-এর মতো ভালো গোয়েন্দা কাহিনি আজও খুব কম লেখা হয়। বালক সত্যজিতের দারুণ ভালো লেগেছিল হুকাকাশিকে। ছোটোবেলায় গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ হয়তো ভাবীকালে ফেলুদা চরিত্র সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ওই বাড়িতেই অনেকদিন ধরে রয়েছে শিশুসাহিত্য পরিষদের কার্যালয়। সপ্তাহে একদিন শিশু সাহিত্যিকরা ওখানে মিলিত হন। এই শিশুসাহিত্য পরিষদ থেকেই প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিককে দেওয়া হয় ‘ফটিক স্মৃতি পুরস্কার’। সত্যজিৎ রায়কে এই পুরস্কার দিতে পেরে শিশুসাহিত্য পরিষদ গর্বিত।
বকুলবাগানেই ইস্কুলে ভরতি হলেন সত্যজিৎ। ইস্কুলের নাম হচ্ছে, বালীগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। তখন তাঁর বয়স নয়, ভরতি হলেন ক্লাস সিক্সে। ছোটোবেলা থেকেই কিন্তু ছবি আঁকায় তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন, ফলে ইস্কুলে ড্রইং মাস্টারের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে তাঁর দেরি হয়নি।
বকুলবাগানে ছোটো মাসি কনক দাশও থাকতেন। তিনি ভালো গাইতেন। হিজ মাস্টারস ভয়েস থেকে তাঁর গান রেকর্ড করা হয়েছিল। বিয়ের পর তিনি হয়েছিলেন কনক বিশ্বাস।
ক্লাস নাইনে যখন পড়েন তখন সত্যজিতের সোনামামা বেলতলা রোডে বাসা বদল করলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের বাড়ির পাশের বাড়ি।
আগেই বলা হয়েছে, সুকুমার রায়ের ঠিক পরেই ছিলেন পুণ্যলতা। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অরুণনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন বিহার কাডারের, তাই হাজারিবাগ, দ্বারভাঙা এসব জায়গায় তাঁকে থাকতে হয়েছিল। নলিনী দাশ তাঁদেরই মেয়ে। সুকুমার রায় নলিনী দাশের বড়ো মামা, সত্যজিৎ মামাতো ভাই। সত্যজিতের চাইতে প্রায় পাঁচ বছরের বড়ো নলিনী দাশ। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর ছোটোবেলায় সত্যজিৎ তাঁর মার সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক বছরই পিসি পুণ্যলতার বাড়ি বেড়াতে যেতেন। সত্যজিতের নিনিদি (নলিনী দাশ) ছোট্ট সত্যজিৎকে আদর করে তাঁদের খেলার আসরে টেনে নিতেন। যতই বছর কাটতে লাগল সত্যজিৎ আস্তে আস্তে তাঁদের খেলার একজন অপরিহার্য সাথী হয়ে উঠলেন (ছুটিতে যখন যেতেন)।
নলিনীদির মুখে শুনেছি ছোটোবেলা, ওঁদের একটা মজার খেলা ছিল হনোলুলু। পাঁচ-সাতজন নিলে খেলা। প্রথম তিনজন মিল রেখে তিনটি লাইন বলবে, চতুর্থজন বলবে, হনোলুলু প্যা প্যা প্যা প্যা। সেই ছড়ার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, যেমন—
প্রথমজন— হনোলুলু বাদাম ভাজা
দ্বিতীয়জন— হনোলুলু জিভে গজা
তৃতীয়জন— হনোলুলু মজা মজা
চতুর্থজন— হনোলুলু প্যা প্যা প্যা প্যা।
সত্যজিৎ অল্প বয়সেই এই খেলায় নলিনীদিদের সঙ্গে মেতে উঠেছিলেন।
আরেকটা ছিল গল্প লেখা খেলা। প্রথমজন গল্পের টাইটেল আর দেড় লাইন লিখে দ্বিতীয় খেলুড়েকে দেবে, তবে প্রথম লাইনটা মুড়ে। দ্বিতীয়জন লেখকের নাম লিখে আর ওই আধলাইন পুরো করে আরও দেড় লাইন লিখবে, তারপর তার নিজের প্রথম লাইনটা মুড়ে তৃতীয় খেলুড়েকে দেবে। এভাবে একটা ছোটো গল্প যতক্ষণ না হয় সবার মধ্যে ভাঁজ করা কাগজটা ঘোরাফেরা করবে। শেষ পর্যন্ত গল্প যা দাঁড়াত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারই মধ্যে খেলুড়েদের মজা আর উদ্ভট চিন্তাভাবনার অন্ত ছিল না।
নিজেরাই সব মজার মজার খেলা আবিষ্কার করতেন। কোনো একটা ফুলের আদ্য অক্ষর একজন কাগজে লিখে সেটা মুড়ে পরের জনকে দিতেন, তিনি আবার আরেকটা ফুলের আদ্য অক্ষর লিখে তৃতীয় জনকে দিতেন, এভাবে সেটা কি ফুলের নামে গিয়ে যে শেষ হত তা আগে থেকে কারও বোঝবার উপায় ছিল না। বলা বাহুল্য, বালক সত্যজিৎও এসব খেলায় শুধু অংশই গ্রহণ করতেন না, পাঁচ-ছ বছর বড়ো দাদা-দিদিদের সঙ্গে সমান তালে খেলতেন।
দশ-বারো বছর বয়সেই সত্যজিৎ ছবি আঁকায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। নলিনী দাশের বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি কলেজে পড়েন। সত্যজিতের তখন বোধহয় ক্লাস নাইন। কলেজের এক অধ্যাপককে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হবে। নলিনীদিরা একটা বিদায় সম্ভাষণ তৈরি করেছেন। একটা আর্ট পেপারে সুন্দর করে সেটা লিখতে হবে। কে লিখবে, কে লিখবে। হাতের কাছেই সত্যজিৎ। তখন তাঁর বয়স আর কত, তেরোর বেশি নয়। তাঁকে বলতেই তিনি খুশি হয়ে কাজে লেগে গেলেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন ধরে ছবির মতো কাজটা তিনি শেষ করলেন। ওই বয়সেই তাঁর মধ্যে একাগ্রতা আর দায়িত্ববোধের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল।
যখন তিনি বাড়িতে বসে ছবির কাজ করেন, কিংবা সন্দেশ-এর লেখা পড়েন বা ইলাসট্রেশন করেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। তারই মধ্যে কত লোক দেখা করতে আসেন, কিন্তু তাঁর কাজের বিরাম নেই। হয়তো কথা বলছেন সেই সঙ্গে তাঁর তুলি চলছে। এক সময় তো সন্দেশ পত্রিকার প্রায় ছবিই তিনি আঁকতেন।
ছোটোবেলায় পিসি পুণ্যলতা চক্রবর্তীর বাড়িতে আরেকটা আকর্ষণ ছিল সত্যজিতের। যখনই তিনি যেতেন, তা সময়টা যাই হোক না কেন, সত্যজিৎকে খুশি করার জন্য সেটা বড়দিন হিসেবে পালন করা হত। নলিনীদির খুড়তুতো দাদা কল্যাণ চক্রবর্তী সাজতেন ‘ফাদার ক্রিসমাস’।
একটা লাল সোয়েটার আর মাথায় লাল টুপি, মুখে তুলো দিয়ে দাড়ি-গোঁফ এঁটে কল্যাণবাবু ঢুকতেন সত্যাজিতের শোবার ঘরে। পিঠে একটা থলি, ফাদার ক্রিসমাস সবাইকে উপহার বিতরণ করবেন। থলিতে কিন্তু বেশ কিছু খালি টিনের কৌটো, সেগুলো ঝমঝম বাজিয়ে ফাদার ক্রিসমাস দিতেন তাঁর আগমন বার্তা। খাটের বাঁজুর ওপর টাঙানো বড়ো একটা মোজার মধ্যে ফাদার ক্রিসমাস রাখতেন সত্যাজিতের জন্য ভালো একটা উপহার। অন্যদের ভাগ্যে হয়তো জুটত মিছিমিছি উপহার। কিন্তু সেটাই দারুণ মজার ব্যাপার হত।
সত্যজিৎ তখন খুব ছোটো, শুধু তাঁকে আনন্দ দেবার জন্যেই এ খেলা চালু হয়েছিল। কিন্তু ওই বয়সেই তিনি একদিন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, শুধু তাঁর জন্যে উপহার কেন, নিনিদিরা পাবে না কেন? তারপর থেকে তাঁদের জন্যেও উপহারের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেটা হয়তো একটা মটরশুঁটি কিংবা তেমন কিছু, কিন্তু তাতেই সবাই খুশি। ফাদার ক্রিসমাসের উপহার তো বটে। তবে, ওই ঘটনা থেকে বালক সত্যজিতের মনের প্রসারতার পরিচয় পাওয়া যায়।
.
সুকুমার রায়ের মাতামহ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন নির্ভীকচেতা, তেজস্বীপুরুষ। সুকুমার রায়ের মধ্যেও সেই গুণের বিকাশ ঘটেছিল। একবার খ্রিস্টান মিশনারিদের এক কাগজে শিক্ষিতা মেয়েদের সম্বন্ধে অত্যন্ত অপমানজনক একটা চিঠি ছাপা হয়েছিল, লিখেছিল এক ছাত্র। সেটা পড়ে সুকুমার এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে কাগজের অফিসে গিয়ে পত্রলেখকের ঠিকানা জেনে তার বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। ছেলেটিকে চেপে ধরতেই সে তার অপরাধ স্বীকার করেছিল, ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়েই সে চিঠিখানা লিখেছিল। সে তার উক্তি প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি দিল। সুকুমার সেই চিঠি নিয়ে ওই কাগজের সম্পাদক পাদরি সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন, অমন কুরুচিপূর্ণ চিঠি ছাপাবার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। পাদরি সাহেব খুব লজ্জিত হয়েছিলেন, তাঁর অজান্তেই নাকি চিঠিটা ছাপা হয়েছিল। যাহোক, ছেলেটির ক্ষমা চেয়ে লেখা চিঠিটা পরের সংখ্যায় ছাপা হবে এই প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন এবং কথাও রেখেছিলেন।
সুকুমার সেদিন সকালেই পত্রিকাটা পড়ে বেরিয়ে গেছিলেন, সারাদিন অভুক্ত থেকে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। একটা অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য এমন সৎসাহস আজ খুব কমই চোখে পড়ে। এই যে মানসিক দৃঢ়তা, এছাড়া মানুষ অপরের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না। সত্যজিৎ রায়ের জীবনেও এর ব্যতিক্রম নয়, তাই তিনি বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন।
১৯৬১ সালের মে মাসে সত্যজিৎ দিল্লি গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনী নিয়ে তোলা ছবিটি নিয়ে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী জনপথ হোটেলে তাঁকে ফোন করে সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে একটা ছবি তুলতে অনুরোধ করেছিলেন। ওই ছবি তোলার আর্থিক অনুদান তাঁর হাতেই ছিল। সত্যজিৎ কিন্তু আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ও বিষয়ে ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁর তেমন উৎসাহ ছিল না। পরে ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে আরও দুটি ছবির প্রস্তাব এসেছিল, শেষেরটি হল তাঁর বাবা জহরলাল নেহরুর জীবনী নিয়ে একটা ছবি। দুটো প্রস্তাবই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সত্যজিৎ। পরে অবশ্য চীনের আগ্রাসী ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অখণ্ডতার উপর একটা ছবি তুলতে তিনি সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। সে কথায় পরে আসব। অনেক চিত্রপরিচালকই প্রধানমন্ত্রীর কন্যার কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেলে লাফিয়ে উঠতেন, কিন্তু সত্যজিৎ অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা সাধারণ মানুষের মতো হলে তিনি কি আর আজকের সত্যজিৎ রায় হতেন!
লোকনাথ মৃত্যুশয্যায় তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণমণির কাছে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছিলেন তা নিষ্ফল হয়নি। তাঁদের একমাত্র সন্তান শ্যামসুন্দর বা কালীনাথের বংশধররা ছড়িয়ে পড়েছিলেন চারদিকে, উজ্জ্বল করেছিলেন বংশের মুখ। শুধু ছেলেদের দিকেই নয়, মেয়েদের দিকেও প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল।
উপেন্দ্রকিশোর জমিদারির যে অংশ পেয়েছিলেন, তা সবই প্রায় বন্ধক ছিল। ওখান থেকে টাকা আসাও বন্ধ। অবস্থা দেখতে সুকুমার গেলেন ময়মনসিং, আর ফিরলেন কালাজ্বর নিয়ে। তখন ও রোগের সুচিকিৎসা ছিল না।
একদিন বাগানে তিনি বসে আছেন, বিলেতের এক বন্ধু দেখা করতে এসেছেন। হঠাৎ দুজনের চোখ পড়ল বাচ্চা সত্যজিতের উপর। তিনি একটা সবুজ রঙের খেলনা ব্যাঙ নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছেন। ওটায় দম দিচ্ছেন আর খেলনা ব্যাঙটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। আনন্দে হাততালি দিচ্ছেন শিশু সত্যজিৎ।
তারপরই চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল বাচ্চার। আরেকটা ব্যাঙ। ওটাও লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, কিন্তু স্প্রিংয়ের দম ছাড়াই। টলতে টলতে বাবার কাছে চলে এল বাচ্চা, দম ছাড়াই ব্যাঙটা লাফাচ্ছে কি করে জানতে! খেলনা ব্যাঙের পাশে যে আসল একটা ব্যাঙ এসে পড়বে তা সে কি করে জানবে!
সুকুমারের মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ কয়েকবারই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। শেষবার তিনি এসেছিলেন ১৯২৩ সালের ২৯ আগস্ট। সুকুমারকে তিনি তাঁর লেখা নয়টি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে কয়েকটি জীবনের আনন্দের। হয়তো সত্যজিতের বিস্মৃত স্মৃতিতে সে গান আর সুর মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনী নিয়ে ছবি করার সময় তিনিও গানে ভরে দিয়েছিলেন।
গড়পারের বাড়ি ছেড়ে আসার কিছুদিন পর সত্যজিতের মা লেডি অবলা বসু প্রতিষ্ঠিত বিধবাদের জন্য ইস্কুল বিদ্যাসাগর বাণী ভবনে চাকরি নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে মেয়েদের সেলাই এবং লেখাপড়া শেখাতেন। এ কাজের জন্য তাঁকে কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলে যেতে হত। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, অমন মা না পেলে সত্যজিতের প্রতিভার হয়তো বিকাশ ঘটত না। অত বড়ো বনেদি পরিবারের স্বচ্ছল অবস্থা থেকে একেবারে নিঃসম্বল অবস্থায় ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, তবু ভেঙে পড়েননি সুপ্রভা দেবী। একমাত্র সন্তানকে আগলে রেখেছিলেন, এতটুকু দুঃখের ছোঁয়া লাগতে দেননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলে বড়ো হবে, অমন যাঁর বাপ-ঠাকুরদা, সে ছেলে সাধারণ হতে পারে না। সত্যিই বাপ-ঠাকুরদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মায়ের মুখে আনন্দের, গর্বের হাসি ফোটাতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৬০ সালে চোখ বোজবার আগে দেশে-বিদেশে ছেলের সম্মান দেখে গিয়েছিলেন জননী সুপ্রভা। পুত্র গৌরবে নিশ্চয়ই তাঁর বুক ভরে উঠেছিল।
তবে একটা সান্ত্বনার কথা, দেউলিয়ার মামলায় বিচারক নির্দেশ দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ যতদিন নাবালক থাকবেন ততদিন প্রতি মাসে গড়পারের বাড়ি ভাড়ার একটা নির্দিষ্ট অংশ পাবেন তাঁর মা। উপেন্দ্রকিশোরের কলেজের এক বন্ধু ছিলেন প্রধান উত্তমর্ণ, বাড়িটা তাঁর ভাগেই পড়েছিল। সৌভাগ্যের বিষয়, তিনি ওই আদেশ পালন করেছিলেন। সত্যজিতের ছোটোবেলায় লেখাপড়ার জন্য অন্তত কারও কাছে হাত পাতার দরকার হয় নি।
অবিশ্যি মামাবাড়িতে সত্যজিতের অনাদর হয়নি কখনো। তাঁর সোনামামা প্রশান্ত কুমার দাশ যখন ছাত্র ছিলেন, ভগ্নীপতির কাছে অনেক বিষয়ে তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন। দিদি আর ভাগ্নেকে আদর করে নিজের কাছে রেখে সেই ঋণ তিনি শোধ করবার চেষ্টা করেছিলেন।
মামাবাড়িতে একটা গুণ সত্যজিতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল যা পরবর্তীকালে ছবি করার ব্যাপারে খুব কাজে এসেছিল। মামাবাড়িতে গান-বাজনার চর্চা ছিল, সেদিকে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ছোটোবয়সেই সংগীত সম্বন্ধে তাঁর মনে গড়ে উঠেছিল একটা ধ্যানধারণা। সংগীত সৃষ্টির সেই বোধ হয় প্রথম সূচনা [এখানে বলে রাখা ভালো, উপেন্দ্রকিশোর খুব ভালো বেহালা বাজাতেন এবং সংগীত রচনা করতেন। সুকুমার রায়ও সুন্দর সুন্দর সংগীত রচনা করেছেন। সংগীতের প্রতি সত্যজিতের অনুরাগ বংশের ধারা]। অনেকেই হয়তো জানেন না, সিনেমায় সংগীত সৃষ্টি করার আগে অনেক সময় সত্যজিৎ শিস দিয়ে প্রথমে সেটা মনে মনে ভেঁজে নিতেন।
সত্যজিৎ জন্মেছিলেন ছোটোখাটো একটি বাচ্চা, চোদ্দো বছর বয়স থেকে হঠাৎ তিনি মাথায় বাড়তে থাকেন। ইস্কুলের পড়া শেষ হবার পর তাঁর মা ঠিক করলেন, ছেলেকে যেমন করেই হোক প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াবেন, যেখানে পড়েছিলেন তাঁর বাপ-ঠাকুরদা। ততদিনে তিনি খুব লম্বা হয়ে গেছেন, রায় পরিবারে অত দীর্ঘদেহী আগে বোধ হয় কেউ ছিলেন না। প্রায় সাড়ে ছ-ফুট, বাঙালিদের মধ্যে এমন উঁচু মাথা হাজারে মেলে না। শুধু বাঙালি কেন, ভিন রাজ্যের মানুষদের মধ্যেও এমন দীর্ঘদেহী সচরাচর নজরে পড়ে না। বাঙালিদের মধ্যে বিধানচন্দ্র রায়ের কথা মনে পড়ে। ডা. রায় প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন বলেই বোধ হয় সত্যজিতের মধ্যে প্রতিভার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা না করলে ‘পথের পাঁচালী’ বোধ হয় কোনোদিনই মুক্তি পেত না। মৃত্যু হত এক প্রতিভার, আমরা বঞ্চিত হতাম মহৎ সৃষ্টি থেকে। বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আমরা তথা সারা পৃথিবীর মানুষ এ ব্যাপারে ঋণী।