অস্কার এবং অন্যান্য

‘অস্কার’ [৩৪]

১৪.১২.৯১, শনিবার বেলা ১১টা নাগাদ নিউ ইয়র্ক থেকে ‘অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স’-এর প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম তথা শুভেচ্ছাবার্তাটি যখন বিশপ লেফ্রয় রোডে পৌঁছয়, সত্যজিৎ তখন ব্যস্ত তাঁর আগামী ছবির স্ক্রিপ্টে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিতে। যে হলিউড ছেলেবেলায় তাঁর কাছে স্বপ্নরাজ্যের মতো ছিল তার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অস্কার’ প্রাপ্তির সংবাদটি সত্যজিৎ রায়কে জানান তাঁর পুত্রবধূ। প্রাক্তন অভিনেতা এবং এখন ‘অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স’-এর প্রেসিডেন্ট কার্ল মলডেনের পাঠানো ব্যক্তিগত টেলিগ্রামটি ‘পথের পাঁচালী’-র স্রষ্টার কাছে ষোলোআনা অপ্রত্যাশিত। কারণ সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ নিউ ইয়র্কেই প্রথম দেখানো হলেও তাঁর নিজের কথায় ‘আমেরিকায় আমার অনেক ছবিই নিয়মিত দেখানো হয়নি। তাই ব্যাপারটা আমার কাছে ”হানড্রেড পার্সেন্ট আনএক্সপেক্টেড”।’

ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তাক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক দিলীপ বসু যখন কলকাতায় জানালেন, সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এর জন্য ১৯৯২ সালে বিশ্বের অস্কার পুরস্কার পাচ্ছেন, তখন বলেছিলেন, মাসখানেক আগেই সারা আমেরিকা থেকে প্রায় ৭০ জন নামজাদা লোকের স্বাক্ষর সহ একটি প্রস্তাব গিয়েছিল অস্কার কমিটির কাছে। কারা ছিলেন সেই তালিকায়? পল নিউম্যান, স্টিফেন স্পিলবার্গ, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, জর্জ লুকাস, জোয়ান উডওয়ার্ড, ইসমাইল মার্চেন্ট, এমনকি ১৯৮৯ সালের সাম্মানিক অস্কার যিনি পেয়েছিলেন, সেই জাপানি ডিরেক্টর আকিরা কুরোসাওয়া-ও। আমেরিকার চলচ্চিত্র জগতের নামিদামি আরও অনেকে। সেই প্রস্তাব বিবেচনা করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অ্যাকাদেমি বোর্ড সত্যজিৎ রায়কেই নির্বাচিত করে এ যাবৎ বিশ্বে ষষ্ঠ সাম্মানিক অস্কার পুরস্কারপ্রাপক হিসাবে। তাঁর আগের নামগুলি হল গ্রেটা গার্বো (১৯৫৫), ক্যারি গ্রান্ট (১৯৬৯), চার্লি চ্যাপলিন (১৯৭২), জেমস স্টুয়ার্ট (১৯৮৪) এবং আকিরা কুরোসাওয়া (১৯৮৯)।

সত্যজিতের জন্মের আট বছর পরে ১৯২৯ সালে তখনকার নির্বাক ছবিকে ঝলমলে এবং আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অস্কার দেওয়া শুরু। পুরস্কারের অভিজ্ঞান হিসাবে যে মূর্তিটি দেওয়া হয়, ভারতীয় মূল্যে তার দাম মাত্র দু-হাজার টাকা। কিন্তু সীমাহীন এর সম্মান। যে কারণে সত্যজিৎ-ও বলেন ‘গোটা হলিউড দুনিয়ার সামনে ওই মূর্তিটা মুঠোয় ধরার অনুভূতিটাই আলাদা।’

এর আগে বিদেশে প্রচুর ‘ব্যক্তিগত স্বীকৃতি’ পেয়ে যাওয়া বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্দেশক বলেন এর চেয়ে বড়ো বিদেশি সম্মান তিনি পাননি কখনো। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। কিন্তু ফিলমসংক্রান্ত? না, অস্কারের উপরে কিছু নয়। কিছু হতেও পারে না। তবে পুরস্কারের ব্যাপারটা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কারণ, তিনি জানান ‘আমেরিকায় আমার অনেক ছবিই নিয়মিত দেখানো হয়নি। ”ঘরে বাইরে” পর্যন্ত চলেছে জানি। তবে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আমার ছবিগুলো ১৬ মিলিমিটারে দেখানো হয়।’ নিউ ইয়র্কেই প্রথম শো হয় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র। প্রথম সমালোচনাও লেখেন মার্কিনমুলুকের লেখকরাই। চূড়ান্ত স্বীকৃতিও এল সেখান থেকেই। গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ স্তরে বাঙালির নাম আঁকা হয়ে গেল, যার জন্য নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের পর গোটা বিশ্বের বাঙালিরা আবার নতুন করে গর্বিত হতে পারবেন। ‘অস্কার’ পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি আসার পরেই জীবন ও চলচ্চিত্র নিয়ে সত্যজিৎ রায় এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেন:

‘আমি অবশ্যই আবার ছবি করব।৩৫ ‘আগন্তুক’-এর পর আমার পরবর্তী ছবি কি হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করেছি।’ কেন হিন্দি ছবি করেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে সত্যজিৎ বলেন, ‘যে ভাষায় আমার দখল নেই, সেই ভাষায় চিত্রনাট্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করলে মনটা খুঁতখুঁত করে।’ প্রসঙ্গত আবার জানালেন, ‘ওঁর মতে সেরা ছবি ”চারুলতা”।’ ভীষণ প্রশংসা করলেন প্রাণবন্ত কলকাতা শহরের। বললেন, ‘এর বাইরে গিয়ে থাকার কথা, করার কথা ভাবাই যায় না।’

সত্যজিৎ বলেন, আমি গর্বিত। চলচ্চিত্রে এর চেয়ে বড়ো পুরস্কার আর হয় না। শরীর সুস্থ থাকলে আর চিকিৎসকের অনুমতি পেলে আগামী মার্চে, লস এঞ্জেলেসে পুরস্কার নিতে নিজেই যাব।৩৬

হায়, তখন কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল তাঁর সেই ইচ্ছে আর পূর্ণ হবে না, নিষ্ঠুর মৃত্যু এসে তাঁকে ছিনিয়ে নেবে, শেষ হয়ে যাবে এক গৌরবময় জীবন।

লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার পুরস্কার হাতে নিয়ে
লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার পুরস্কার হাতে নিয়ে

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘আমার কর্মজীবনের শুরু থেকে আমি বাংলার সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলাম— আর সারা জীবন আমি সেই চেষ্টাই চালিয়ে গেছি।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আমাকে ”পথপ্রদর্শক”-এর ভূমিকা নিতে হয়েছিল। দেশের মানুষ যদি আমার সেই ভূমিকার কথা মনে রাখেন, তাহলেই আমি খুশি।’

সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘সারা জীবন ধরে আমি অনেক কাজ করেছি। অনেক পুরস্কারও পেয়েছি। আমার ধারণা আমার ছবিগুলি কোনো বিশেষ সময়সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। আমার প্রথমদিককার তোলা কয়েকটি ছবি আমি সম্প্রতি টেলিভিশনে দেখেছি। দেখে মনে হল ছবিগুলির আবেদন শেষ হয়ে যায়নি। আমি চাই আমার ছবিগুলি যেন থেকে যায়— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবেদন শেষ হয়ে না যায়।’

গত তিরিশ বছর ধরে আমি ছবি তৈরি করছি। এই তিরিশ বছরে আমার যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা কিছু জেনেছি, শিখেছি, সে সবই আমার ছবিকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার চারপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কেই আমি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। বিশেষত এখন যেহেতু আমি বাইরে গিয়ে ছবি তুলতে পারি না, সেইজন্য আমাকে চারপাশে ঘটনাবলির উপরেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়। যে যে বিষয় সম্পর্কে দর্শকদের কৌতূহল বেশি, সেগুলিকেই আমি ছবিতে প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করি।

চ্যাপলিনের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে স্মারক পুস্তিকা দেখছেন সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন (১৯৮৯)
চ্যাপলিনের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে স্মারক পুস্তিকা দেখছেন সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন (১৯৮৯)

সত্যজিৎ বলেন, তাঁর সারা জীবনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে ‘অস্কার’ পেয়ে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর কাছে ‘অস্কারই’ হল সব পুরস্কারের শেষ— এর চেয়ে বড়ো আর কোনো পুরস্কার থাকতে পারে না। সত্যজিৎ আরও বলেন, ‘অস্কার পুরস্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছে এর থেকে বোঝা গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁরা আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।’

আমার সারা জীবনের কাজের তাঁরা স্বীকৃতি দিলেন এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো কথা। চলচ্চিত্রের জগতে আসার আগে আমি যখন নিছকই ছবির একজন ‘ফ্যান’ ছিলাম তখন আমার কাছে হলিউড ছিল একটা স্বপ্নের দেশ। তখন আমি কোনোদিন চিন্তাও করতে পারিনি যে আমিই একদিন ছবি করব আর সে ছবি বিদেশে সমাদৃত হয়ে আমাকে অস্কার এনে দেবে।

সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন, বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় ছবি তোলার ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাষা। অন্য ভাষায় ছবি করতে গেলে তাঁকে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র মতো ইংরেজিতে চিত্রনাট্য লিখে অনুবাদকের সাহায্য নিতে হবে৩৭ ভাষান্তর করার জন্য।

সত্যজিৎ বলেন, ‘আমার কাছে একটি ছবির সংলাপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্র এবং পরিস্থিতির সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই না হলে সংলাপের ধার নষ্ট হয়ে যায়। সংলাপ তৈরির জন্য অনুবাদকের সাহায্য নিতে হলে সংলাপ সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারি না, সেটাই অন্য ভাষায় ছবি তৈরির ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি দেশে এখন অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁরা সত্যিকার সিনেমার কদর জানেন। তাঁদের জন্য ছবি করেই আমি তৃপ্ত পাই।’

.

পরিশিষ্ট [৩৮]

১৯৮৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ছিল সত্যজিৎ রায়ের জীবনে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট সত্যজিৎকে ওই দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লেজ’ দ নর’ দেবার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। শুধু ওই উদ্দেশ্যেই তিনি কলকাতা এসেছিলেন।

আলিপুরে জাতীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের সাংস্কৃতিক আঙিনায় সত্যজিৎ রায় এক অবিস্মরণীয় নাম। চলচ্চিত্র জগতে এই শতাব্দীর সেরা নাম তিনিই। তাই তাঁর মতো এক মহান ব্যক্তিকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে পেরে আমি ও আমার দেশবাসী আজ কৃতজ্ঞবোধ করছি।’

ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আপনি ভারতীয় সংস্কৃতির যথার্থ প্রতিনিধি, এমন একজন ব্যক্তিকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান জানাবার জন্য আমি কলকাতায় উপস্থিত হতে পেরেছি এজন্য আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। আপনাকে সারা ফরাসি দেশের মানুষ আজ এই সম্মানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।’

বৃহৎশক্তির অন্যতম একটি দেশের যিনি প্রধান, তাঁর কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধার্ঘ ও সম্মান এক বিরল ঘটনা। তাও সেই সম্মানিত মানুষটি যদি দেশের রাজনৈতিক বা কোনো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না হন। শুধুমাত্র নিজের অনন্য গুণে সংস্কৃতিবান মানুষের হৃদয়ে এক বিরাট স্থান দখল করে আছেন আমাদের সত্যজিৎ। কত বড়ো প্রতিভার অধিকারী হলে এটা সম্ভব তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়না। সত্যিই তিনি অদ্বিতীয়।

.

সংশোধনী: ‘ছেলেবেলা’-য় সূচনায় বলা হয়েছে ১৯২৭ সালে ইউ. রায় দেউলিয়া হয়েছিল। ওটা হবে ১৯২৫ (মতান্তরে ১৯২৬)।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরঁ-র থেকে লিজিয়ন অব অনার প্রাপ্তি। (১৯৮৯)
ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরঁ-র থেকে লিজিয়ন অব অনার প্রাপ্তি। (১৯৮৯)
ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান, 'লিজিয়ন অফ অনার' অনুষ্ঠানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে (১৯৮৯)
ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান, ‘লিজিয়ন অফ অনার’ অনুষ্ঠানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে (১৯৮৯)

অস্কার নিলেন সত্যজিৎ [৪০]

১৬ মার্চ ১৯৯২, সোমবার [৩ চৈত্র ১৩৯৮] আড়ম্বরহীন এক অনুষ্ঠানে কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে অসুস্থ সত্যজিৎ রায়ের হাতে অস্কার সম্মানের স্মারক মূর্তি তুলে দিলেন অস্কার কমিটির প্রতিনিধি, হলিউডের জনপ্রিয় প্রোডিউসার আল শেয়ার্জ। স্মরণ রাখতে হবে, ১৯৯১-এর ১৫ ডিসেম্বর এই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। ৩০ মার্চ লস এঞ্জেলেসের ডরোথি স্টেডিয়ামে ঘটবে নক্ষত্র সমাবেশ এবং সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুরস্কার গ্রহণের দৃশ্য ভিডিওতে দেখানো হবে। প্রায় একফুট উঁচু ঝকঝকে সোনা রঙের এই ট্রফির নিচে সোনালি প্লেটের ওপর লেখা ‘অ্যাকাডেমি অনারারি অ্যাওয়ার্ড টু সত্যজিৎ রে ইন রিকগনিশন অফ হিজ রেয়ার মাস্টারি অফ দ্য আর্ট অফ মোশন পিকচার্স—১৯৯২।’

আগে একবারই অস্কার কমিটি পুরস্কার গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়াকে। অসুস্থ থাকায় তিনি কিন্তু নিজে পুরস্কারটি নিতে পারেননি। তাঁর ছেলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল পুরস্কার। এর আগে ১৯৮৯ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেঁর নিজে কলকাতায় এসে সত্যজিতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর দেশের শ্রেষ্ঠ সম্মান পুরস্কার ‘লিজিয়ন অফ অনার’। জানা গেছে এ বছর সান ফ্রান্সিসকো ইন্টারন্যাশনাল ফিলম ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ আকিরা কুরোসাওয়া অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়কে, তাঁর জন্মদিনে। ওই ফেস্টিভ্যালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘চারুলতা’ প্রভৃতি সাতটি ছবিও দেখানো হবে। ওই উৎসবের জন্য সন্দীপ রায়ের ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিটি নির্বাচিত হয়েছে। কথা আছে ওখানে ২ মে ১৯৯২ তাঁর হাতে সত্যজিৎ রায়কে প্রদত্ত কুরোসাওয়া পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হবে।

সত্যজিৎ রায় মাসাধিককাল শ্বাসকষ্ট রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ওই নার্সিং হোমে ছিলেন। ওই অসুস্থ অবস্থাতেও সত্যজিতের রসবোধের ঘাটতি ছিল না। পুরস্কার গ্রহণ করবার আগে প্রোডিউসার আল শেয়ার্জকে রসিকতা করে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন আপনি পরিচালক, বলুন আমাকে কি করতে হবে?’ ধাতুর ওপর সোনালি আস্তরণ দেওয়া মূর্তিটি বেশ ভারী। ওটা নেবার পর সত্যজিৎ রায় সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘আজ এই সম্মান, এই স্বীকৃতিতে আমি ধন্য, গর্বিত।’

লিজিয়ন অব অনার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে (১৯৮৯)
লিজিয়ন অব অনার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে (১৯৮৯)

জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়। এবার পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সমতুল চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘অস্কার’।

.

সম্মানিত সত্যজিৎ

১৯ মার্চ, ১৯৯২। দেশের সাংস্কৃতিক জগতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিতে সত্যজিৎ রায়কে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ প্রোফেসর’ এই সম্মান দেবার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

বিশিষ্ট পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদদের কাজের স্বীকৃতিতে ১৯৪৯ সালে এই সাম্মানিক পদটি চালু করা হয়। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য আজীবন মাসিক আট হাজার টাকা। এর আগে যাঁরা এই সম্মান পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ড. সি. ভি. রমন, ড. সত্যেন বোস, ড. সালিম আলি, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সত্যজিৎ এর আগে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, প্রতিদিন পুরস্কারের তালিকা দীর্ঘ হতে এত দীর্ঘতর হয়ে চলেছে যে তার সঙ্গে তাল রেখে চলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের থেকে শ্রীমন্ত শঙ্করদেব পুরস্কার নিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।(১৯৮৯)
অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের থেকে শ্রীমন্ত শঙ্করদেব পুরস্কার নিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।(১৯৮৯)

ভারতরত্ন সত্যজিৎ [৪১]

২০ মার্চ, ১৯৯২। আবার সম্মান। এবার ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘ভারতরত্ন’। খবরে প্রকাশ, এই সিদ্ধান্ত নাকি সম্পূর্ণ আকস্মিক, কোনো পূর্বনির্ধারিত ঘটনা নয়। শুক্রবার ২০ মার্চ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও হঠাৎই মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকলেন। তারপর গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। রাত সওয়া আটটা নাগাদ চিরাচরিত প্রথা ভেঙে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ঘোষণা করা হল ‘উল্লেখযোগ্য এবং অসাধারণ কর্তব্য সাধনের’ জন্য সত্যজিৎকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হল।

ভারতরত্নের ইতিহাসে এমন ঘটনা প্রথম। কারণ এই সম্মান রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ঘোষণা করা হয় প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন। তবে সত্যজিৎ রায়ের জীবনের চমকের ঘটনা বিরল নয়। তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান দেবার জন্য ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট মিতেঁর উড়ে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁকে চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘অস্কার’ দেবার ব্যাপারটাও যেমন বিরল ঘটনা তেমন অস্কার কমিটির প্রতিনিধির, কলকাতায় এসে স্মারক মূর্তিটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়াটাও এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

এই প্রথম একজন চলচ্চিত্র পরিচালক এমন বিরাট সম্মান, ‘ভারতরত্ন’ পেলেন। তাঁর আগে অধিকাংশ সম্মান প্রাপকই ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ। শুধু মহান ইঞ্জিনীয়র বিশ্বেশ্বরাইয়া আর সমাজসেবিকা মাদার টেরিজা ছিলেন ব্যতিক্রম।

আনুষ্ঠানিক ‘অস্কার’ [৪২]

লস এঞ্জেলস, ৩০ মার্চ ১৯৯২: টি. ভি.-র পর্দায় ভেসে উঠল ‘রোমান হলিউডের’ নায়িকা, বিশ্ববিখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের ছবি। ৬৪তম অস্কার পুরস্কার বিতরণীর সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে ডরোথি শ্যান্ডলার প্রেক্ষাগৃহের সুসজ্জিত মঞ্চে তিনি সত্যজিতের এই পুরস্কার প্রাপ্তির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন। দুধ আলতা রং-এর ইভনিং গাউনে এখনও মোহময়ী মনে হচ্ছিল এককালে দর্শকদের মনকাড়া রূপসী অভিনেত্রীকে।

এই উৎসব উপলক্ষে ডরোথি স্টেডিয়ামে হয়েছিল নক্ষত্র সমাবেশ। ঝলমলে পোশাকে, ঝলমলে স্টেডিয়ামে, অড্রে হেপবার্ন হাতে কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বললেন, ‘চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে তাঁকে এই বিশেষ পুরস্কার দিচ্ছে অ্যাকাদেমি অফ মোশন পিকচার্স আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স। তাঁর ছবির অসামান্য মানবিক আবেদন বিশ্বের সমস্ত চলচ্চিত্রকারকে গভীর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।’ পর্দায় ফুটে ওঠে ‘পথের পাঁচালী’র কিছু দৃশ্য। অড্রে হেপবার্ন আরও বলেন, ভারতে যেসব ঐতিহ্যের চিরন্তন ও সর্বজনীন আবেদন রয়েছে, সেগুলিকেই তিনি তাঁর ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে হেপবার্ন বলেন, ‘সত্যজিৎ অসুস্থ তাই আজ তিনি সশরীরে আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে, কলকাতা থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।’

.

তারপরই প্রেক্ষাগৃহের সুসজ্জিত মঞ্চের পেছনের বড়ো পর্দায় ভেসে উঠল বহু আকাঙ্খিত সেই দৃশ্য। নার্সিং হোমের বিছানায় আধশোয়া সত্যজিৎ। দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তিত্বের ছবি। রোগে ক্লিষ্ট কিন্তু মুখের হাসি পাণ্ডুর নয়। হাতে ধরা চলচ্চিত্রে পৃথিবীর সেরা পুরস্কার। সারা প্যাভিলিয়ন জুড়ে গম গম করে উঠল তাঁর জলদ গভীর কণ্ঠস্বর: ‘এ এক বিরাট পুরস্কার। এটা আমার চলচ্চিত্র জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া— এরপরে আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না।’ চলচ্চিত্র জগতের প্রবাদপুরুষের কণ্ঠে খাঁটি ইংরেজি উচ্চারণে এই কয়েকটি কথা শুনে সারা প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ল উচ্ছ্বাসে।

এই সঙ্গে দেখানো হল অস্কার পুরস্কারের ৬৪ বছর ইতিহাসের ছবি এবং ‘চারুলতা’, ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘দেবী’র ক্লিপিংস।

.

সত্যজিতের মুকুটে আরও একটি পালক ৪৩

৭ এপ্রিল ১৯৯২। উনচল্লিশতম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ ছবি ‘আগন্তুক’ শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিবেচনার ‘স্বর্ণকমল’ পুরস্কার পেয়েছে। আসলে ছবিটি দুটি পুরস্কার পেয়েছে।

সেরা ছবির জন্য প্রযোজক এন. এফ. ডি . সি. পেল একটি স্বর্ণকমল এবং ৫০ হাজার টাকা।

সত্যজিৎ পেলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান স্বর্ণকমল আর ৭৫ হাজার টাকা।

এর আগে ১৯৯১-এর ২৫ জানুয়ারি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ফ্রিপ্রেসি’ পুরস্কার পেয়েছিল ‘আগন্তুক।’

.

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যজিতের সংগ্রহশালা [৪৪]

১২.৪.৯২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সংগ্রহশালা তৈরি হচ্ছে। এই আর্কাইভে থাকবে সত্যজিতের সব ছবির পূর্ণ দৈর্ঘ্য, স্বল্প দৈর্ঘ্য এবং ঝকঝকে ভিডিয়ো প্রিন্ট। এগুলি গবেষণা ও অন্যান্য কাজে পাওয়া যাবে। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের লেখা ছবির চিত্রনাট্যের কপি, সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি এবং যাবতীয় বইপত্র, ছবির পোস্টার ও অন্যান্য প্রামাণ্য তথ্যও ওই সংগ্রহশালায় থাকবে। এই আর্কাইভ তৈরি করতে এক লাখ ডলার খরচ হবে।

.

বিদেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য

কিংবদন্তী জাপানী চলচ্চিত্র পরিচালক আকিয়া কুরোসাওয়া সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুতে বলেছেন, ‘এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখা চন্দ্র, সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভুত ঘটনা।’

.

২৪.৪.৯২। সানফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনের পর ওই উৎসবকে উৎসর্গ করা হয় সত্যজিৎ রায়ের নামে। উপস্থিত দর্শকরা দাঁড়িয়ে নতমস্তকে সত্যজিতের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

.

বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার শামসুল হক সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করে বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের কাছে দ্রোণাচার্য। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যের জগতে বাংলাকে সম্মানের আসন দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ রায় দিলেন বাংলা ছবিকে সেই সম্মান।’

.

‘এমন একজন প্রতিভাবান সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতার ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করেছি।’ —রিচার্ড অ্যাটেনবরো

.

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব বুত্রোস ঘালি শোকবার্তায় বলেছেন, জীবন ও মানুষকে যে কতভাবে একজন শিল্পী ধরতে পারেন সত্যজিৎ রায় আমাদের তা দেখিয়েছেন। তাঁর ছবি সারা বিশ্বকে অভিভূত করেছে।

.

লন্ডনে বেশ কয়েকটি দৈনিক সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বিশেষ লেখা ও শ্রদ্ধার্ঘ বেরিয়েছে। দ্য ইন্ডিপেডেন্ট পুরো এক পাতা জুড়ে লেখা ও ছবি ছাপিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। লিখেছে, সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু হলেও ‘অপু ত্রয়ী’, ‘জলসাঘর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র মধ্য দিয়েই তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকা শোকবার্তায় লিখেছে, বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যেসব পরিচালক এসেছেন তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়কে গ্র্যান্ডমাস্টার বলে উল্লেখ করা যায়।

দ্য টাইমস লিখেছে, সাহিত্যে যেমন চেকভ তেমনই চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়।

.

নেপালের প্রধানমন্ত্রী গিরিজাপ্রসাদ কৈরালা গভীর শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, সত্যজিতের গভীর জীবনবোধ তাঁকে বার বার আকৃষ্ট করেছে। ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

আমেরিকায় সব খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় সত্যজিৎ রায়ের ছবি। নিউইয়র্ক টাইমস পুরো এক পাতা জুড়ে তিনটে ছবি সমেত ছেপেছে পিটার ফ্লিটের একটা বড়ো লেখা। তিনি লিখেছেন, অপু নিয়ে তিনটে ছবি সিনেমার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ অসাধারণ পরিচালককে আমরা ভুলব কি করে?

লস এঞ্জেলস টাইমস লিখেছে, সত্যজিৎ রায় বিশ্ববন্দিত অথচ ওঁর কদর ভারতবর্ষে নেই। বিদেশিরাই সত্যজিৎ রায়কে বেশি সম্মানিত করেছে।

ইউ. এস. এ. পত্রিকায় লিখেছে, ৩০ মার্চ টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা অস্কার হাতে সত্যজিৎ রায়ের ছবি আমেরিকানদের স্মৃতিতে চিরদিন থেকে যাবে।

.

উল্লেখযোগ্য ঘটনায়

[সংক্ষিপ্ত ঘটনাপঞ্জি] কিছু সংযোজন।

১৯৫৩— পুত্র সন্দীপের জন্ম।

১৯৬১—ছবির সংগীত রচনা শুরু।

১৯৬৩—টাইম পত্রিকার মতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১১ জন চিত্রপরিচালকের অন্যতম।

১৯৬৫—প্রথম বাংলা বই ‘প্রফেসর শঙ্কু’।

১৯৬৭— ‘প্রফেসর শঙ্কু’ আকাডেমি পুরস্কার।

১৯৭৮—বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি তাঁকে সর্বকালের তিনজন সেরা পরিচালকের অন্যতম বলে সম্মান জানাল। অন্য দুজন হলেন চার্লি চ্যাপলিন ও ইঙ্গমার বার্গম্যান।

১৯৮১— বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টরেট’ উপাধি।

১৯৮২— ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে অন্যতম বিচারক। বিশ্বের সেরা দশজন চিত্র পরিচালকের অন্যতম রূপে ‘গোল্ডেন লায়ন অফ সেন্ট মার্ক’ পুরস্কার। চলচ্চিত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ‘হেডলেস অ্যাঞ্জেল ট্রফি’ দ্বারা সম্মান জানাল ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি। রোম চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ভিসকন্তি’ পুরস্কার লাভ।

১৯৯০— ‘আগন্তুক’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্র সমালোচকদের পুরস্কার পেল।

১৯৯১— বেলজিয়াম থেকে ‘সত্যজিৎ রায় অ্যাট সেভেন্টি’ গ্রন্থ প্রকাশ। ফরাসি দেশের স্কুলে ‘ফটিকচাঁদ’ র‌্যাপিড রিডার হিসাবে নির্বাচিত।

.

টীকা

৩৪. ‘অস্কার’ ১৪.১২.১৯৯১ তারিখে সত্যজিৎ রায় তাঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাসভবনে আগামী ছবি ‘জাগরণ’-এর চিত্রনাট্যের খসড়ার কাজ করছিলেন; (লেখক যদিও ‘ফিনিশিং টাচ’ বলে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তা ঘটেছিল ১৯৯২-র ফেব্রুয়ারি নাগাদ, তখন সত্যজিৎ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন) সেই সময় তিনি অস্কার প্রাপ্তির খবর পান। পরিবারের বাকি সদস্যরা খবরটি আগাম জানতে পেরে সত্যজিতকে একটা চমক দিতে চান। সত্যজিতের পুত্রবধূ শ্রীমতী ললিতা রায় একটি কাচের বাটিতে অনেকগুলি কাগজের ভাঁজ করা টুকরো রেখে সত্যজিতকে তার থেকে একটা বেছে নিতে বলেন। সত্যজিৎ একটি কাগজ তুলে নিয়ে মোড়ক খুলে দেখেন তাতে লেখা ‘অস্কার’। সত্যজিৎ যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে যান। এই চমকটি যাতে প্রত্যাশিতভাবে আসে সেই ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে কাচের বাটিতে রাখা কাগজের প্রত্যেকটিতেই ‘অস্কার’ কথাটাই লিখে দেওয়া ছিল। সত্যজিৎ সেটি নিশ্চিতভাবেই বুঝেছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুমন এই নির্মল আনন্দের সবটুকু উপভোগ করতে পেরে ভীষণভাবে উৎফুল্ল হয়েছিল।

‘অস্কার’ প্রাপ্তির খবর পাওয়ার পর থেকে ফের অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভরতি হওয়ার আগে পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। একটি সর্বভারতীয় স্তরের নিউজ চ্যানেল ও বেতার ছাড়াও দূরদর্শনের জন্য দুটি সাক্ষাৎকার দেন সত্যজিৎ। তার মধ্যে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর।

.

৩৫. ‘অস্কার’— ‘আমি অবশ্যই আবার ছবি করব। ”আগন্তুক”-এর পর আমার পরবর্তী ছবি কি হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’ সম্ভবত ১৯৯২-এ গোড়ায় দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ তার পরবর্তী ছবি সম্বন্ধে কিছু বলতে চাননি, তবে ঠিক এর অব্যবহিত পরেই শর্মিলা ঠাকুরকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘It’s about a doctor.’ একজন ডাক্তারের ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং সামাজিক-মানসিক টানাপোড়েনের উপর ভিত্তি করেই যে গড়ে উঠেছে তার আগামী ছবির চিত্রনাট্য এটুকু আমরা জানতে পারি। সত্যজিৎ এও বলেন যে সে ছবিতে বেশ অনেকখানি আউটডোরে শুটিং থাকবে।

এর সমসময়েই, ৪ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি ১৯৯২ এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় যৌথভাবে সাক্ষাৎকার দেন আজকাল পত্রিকার তরফে জ্যোতির্ময় দত্ত এবং লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার টিম ম্যাকগার্ককে। কথোপকথনে আবার উঠে আসে আগামী ছবির প্রসঙ্গ। সত্যজিৎ বলেন—

… সদ্য শেষ করেছি একটি চিত্রনাট্য যার শুটিং, আশা করছি শুরু হবে ফেব্রুয়ারির গোড়ায়।… বিষয়? এখন যাকে ঘিরে নিত্য চিন্তা— চিকিৎসার প্রগতি এবং তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে কারা? ধরুন, গতকাল যে ইঞ্জেকশন আবিষ্কৃত হল, তার সুফল আমি নিজে পেয়েছি, যে ইঞ্জেকশন তার… দাম ছিল ৪,০০০ টাকা। এখন তার চেয়েও উন্নত, দ্রুত-ফলদ ইঞ্জেকশন বেরিয়েছে, যার দাম ২০,০০০ টাকা। এটা প্রগতি বটেই। কিন্তু এই প্রগতি সমাজের কয় শতাংশের সঙ্গতির মধ্যে? এই নিয়ে আমার চিত্রনাট্যের দোটানা।

বস্তুত, উল্লিখিত চিত্রনাট্য ‘জাগরণ’-এর তৃতীয় এবং শেষ খসড়ার কাজ সত্যজিৎ হাসপাতালে থাকাকালীন শেষ করেন ফেব্রুয়ারি ১৯৯২-তে। সত্যজিতের প্রয়াণের পর সন্দীপ রায় ছবিটি নির্মাণ করেন, স্বত্ব এবং নাম নথিভুক্তিকরণজনিত সমস্যায় ছবিটি ‘উত্তরণ’ (ইংরেজিতে ‘দ্য ব্রোকেন জার্নি’) নামে মুক্তিলাভ করে ১৯৯৪-এ।

সত্যজিতের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র মতো, ‘জাগরণ’ ছবির চিত্রনাট্য ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কাহিনির ছায়ায় রচিত হয়েছিল।

.

৩৬. ‘সত্যজিৎ বলেন আমি গর্বিত।… শরীর সুস্থ থাকলে আর চিকিৎসকের অনুমতি পেলে আগামী মার্চে, লস এঞ্জেলেসে পুরস্কার নিতে নিজেই যাব।’ লেখকের রচনায় এখানে সত্যজিৎ রায়ের আশাবাদী মনোভাবই ধরা পড়েছে। তবে এর কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই হয়তো তাঁর শরীর দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তাবে আর সেভাবে সাড়া দেয়নি। ফলস্বরূপ ১১ জানুয়ারি ১৯৯২-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে অস্কার আনতে ‘হয়তো সশরীরে যাব না, জেট-ল্যাগ আছে, ধকল ও ঝক্কি তো কম নয়। তবে ওরা বিশেষ অ্যান্টেনা বসিয়ে, দুটি উপগ্রহ মারফত এমন ব্যবস্থা করে দেবে, যাতে কলকাতা থেকেই আমি উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারব। আধুনিক প্রযুক্তি দারুণ জিনিস, তাই না?’

.

৩৭. ‘… ইংরেজিতে চিত্রনাট্য লিখে অনুবাদকের সাহায্য নিতে হবে’ সুরেশ জিন্দাল প্রযোজিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ (১৯৭৭) ছবির চিত্রনাট্য পরিচালক লিখেছিলেন ইংরাজিতে। চিত্রনাট্যকার শামা জাইদি এবং জাভেদ সিদ্দিকি সেটির ভাষান্তর করেন।

.

৩৮. পরিশিষ্ট ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘লিজ দ’ নর’ বা ‘লিজিয়ন অফ অনার’ নিতে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধতার কথা চিন্তা করে, ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে তিনি ফরাসি সরকারের উদ্দেশে একটি চিঠি দিয়ে তাঁর অবস্থার কথা জানান। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ স্বয়ং এলেন কলকাতায় সত্যজিৎ রায়কে সম্মানিত করতে।

আলিপুরের বেলভিডিয়ার প্রাসাদ এবং জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয়েছিল এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। ফরাসি দূতাবাসের তরফ থেকে সত্যজিতের কাছে গাড়ি পাঠানোর প্রস্তাব আসে, স্বভাবোচিত সৌজন্য দেখিয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর নিজের গাড়িতেই সভাস্থলে উপস্থিত হওয়ার কথা জানান। অনুষ্ঠানের দিন খাঁটি বাঙালি পোশাক ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সত্যজিতের কাঁধে ছিল তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির একটি নকশাদার কাশ্মীরি শাল। ন্যাশনাল লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে সত্যজিতের এহেন প্রাপ্তির জমায়েতে হাজির ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, অভিনেতা বসন্ত চৌধুরি, পরিচালক মৃণাল সেন সহ বহু সম্মানীয় ব্যক্তি। মিতেরঁ সত্যজিতকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘expressing modern India with the sensitivity of the great poet.’ সত্যজিৎ তাঁর প্রাপ্তিস্বীকার ভাষণে বলেন যে এই সম্মান জাঁ-রেনোয়ার দেশ থেকে এসেছে, যাঁকে তিনি নিজের অন্যতম শিক্ষক বলে মনে করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকা-র তরফে এই সভার একটি মনোজ্ঞ প্রতিবেদন রচনা করেন যার শিরোনামটি ছিল সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ ‘বৃষস্কন্ধ আর নন বটে, অবশ্যই মহাবাহু।’ অনুষ্ঠানের বিবরণ দিতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, সত্যজিৎ তাঁর ভাষণে শুধুমাত্র রবীন্দ্রপূজা করেই অব্যাহতি নেননি বরং সুচারুভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি, অনুপ্রেরণা, বাংলার লেখক, শিল্পী ও কৃতী পূর্বসূরীদের তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র জগতের থেকে তৃতীয় ব্যক্তিত্ব যিনি এই বিরল সম্মান লাভ করেন, তাঁর আগে প্রখ্যাত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া এবং অরসন ওয়েলস এই শিরোপায় ভূষিত হয়েছিলেন।

.

৪০. অস্কার নিলেন সত্যজিৎ ১৬ মার্চ ১৯৯২ বেলভিউ নার্সিং হোমে সত্যজিৎ রায় লাভ করেন ‘অস্কার’ সম্মানের স্মারক। স্ত্রী বিজয়া রায়ের হাত দিয়েই পুরস্কারটি সত্যজিতের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অস্কার কমিটির প্রতিনিধি, হলিউডের প্রযোজক আল শেয়ার্জ। প্রাথমিকভাবে কথা ছিল ৩০ মার্চ লস এঞ্জেলেসে গিয়ে সত্যজিৎ রায় আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারটি গ্রহণ করবেন, কিন্তু হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায় এবং চিরাচরিত প্রথা ভেঙে হলিউড কর্তৃপক্ষ কলকাতায় এসে এই পুরস্কার দিয়ে যান সত্যজিৎ রায়কে। সেই সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন সত্যজিৎ পত্নী শ্রীমতী বিজয়া রায়, অধ্যাপক দিলীপ বসু, শ্রীমতী নলিনী দাস এবং হলিউডের প্রযোজক আল শেয়ার্জ। অস্কার প্রতিনিধি শেয়ার্জের তত্ত্বাবধানেই সত্যজিতের পুরস্কার গ্রহণের দৃশ্যের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হয় হাসপাতালে। পুরস্কারের ভারী স্মারকটি অসুস্থ সত্যজিতের পক্ষে ধরে থাকা রীতিমতো কষ্টকর হয়ে পড়ায়, তাঁকে সে কাজে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক দিলীপকুমার বসু।

লেখক মঞ্জিল সেন কথাপ্রসঙ্গে লিখেছেন ‘… অস্কার কমিটি পুরস্কার গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়াকে। অসুস্থ থাকায় তিনি কিন্তু নিজে পুরস্কারটি নিতে পারেননি…।’ এ তথ্যটি ভুল। ১৯৯০ সালের আয়োজিত ৬২তম অস্কার পুরস্কার অনুষ্ঠানে জ্যাক ভ্যালেন্টি, পরিচালকদ্বয় জর্জ লুকাস ও স্টিভেন স্পিলবার্গের সঞ্চালনায় সজ্জিত মঞ্চে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জাপানি ভাষাতেই দোভাষীর সাহায্যে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে কৃতজ্ঞতা জানান কর্তৃপক্ষকে। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেই সম্ভবত প্রথমবার চিরাচরিত প্রথা বদলান অস্কার কমিটি। সানফ্রান্সিসকো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল এই সময়েই ঘোষণা করেন যে ১৯৯২-এ ‘আকিরা কুরোসাওয়া সম্মান’ বা ‘কুরোসাওয়া অ্যাওয়ার্ড’ তারা সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে (২ মে) তাঁর হাতে তুলে দেবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সানফ্রান্সিসকো চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হয়েছিল ইরভিং লেভিনের হাত ধরে, আমেরিকান এই প্রযোজক ১৯৫৭ সালে সূচনা করেন এই উৎসবের যার মুখ্য আকর্ষণ ছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) এবং আকিরা কুরোসাওয়ার ‘থ্রোন অফ ব্লাড’ (১৯৫৭)। ২০০৩ সালের পর ‘কুরোসাওয়া পুরস্কার’-এর নাম বদলে রাখা হয় ‘ইরভিং লেভিন ডিরেক্টিং অ্যাওয়ার্ড’। বর্তমানে সেই নব নামাঙ্কিত পুরস্কারই বহাল রয়েছে।

.

৪১. ভারতরত্ন সত্যজিৎ— ২০ মার্চ ১৯৯২-এ প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও সত্যজিৎ রায়ের ‘ভারতরত্ন’ প্রাপ্তির খবর ঘোষণা করেন। সেই সময় অসুস্থ সত্যজিৎ কলকাতায় বেলভিউ নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে শয্যাশায়ী থাকা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের রসবোধ ছিল অটুট। ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত হওয়ার খবর শুনে সত্যজিৎ সকৌতুকে স্ত্রী বিজয়া রায়কে বলেছিলেন, ‘এবার দেখছি পুরস্কার দেওয়ার ধুম পড়ে গেছে!’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ন অফ অনার’ লাভ করার পরও স্বদেশের ‘ভারতরত্ন’ সম্মান পেতে কেন সত্যজিৎ-কে ‘অস্কার’ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল? এই শীর্ষক বিতর্ক সংবাদমাধ্যমে সেই সময় এবং সত্যজিৎ-প্রয়াণ পরবর্তী অধ্যায়েও রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। সত্যজিতের মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর নকশায় তৈরি ভারতরত্ন পুরস্কারের স্মারক সত্যজিৎ স্বহস্তে নিতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর প্রাথমিক আপত্তি কাটিয়ে উঠে এই সম্মান গ্রহণ করেন পুত্র সন্দীপ রায়।

.

৪২. আনুষ্ঠানিক ‘অস্কার’ সত্যজিৎ রায়ের অস্কার প্রাপ্তির খবর সম্পর্কে সারা বিশ্ব সহ ভারতবর্ষ এবং কলকাতা শহর ওয়াকিবহাল ছিল ১৯৯২ সালের জানুয়ারি থেকেই। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে সত্যজিতের আমেরিকা যাত্রা গোড়া থেকেই অনেকটাই অনিশ্চিত ছিল, তাতে সিলমোহর পড়ে যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভরতি হন সত্যজিৎ রায়। ৩০ মার্চ ১৯৯২ টিভির পর্দায় দীর্ঘ রোগভোগে ক্লান্ত সত্যজিতকে ‘অস্কার’ পুরস্কারের স্মারক হাতে নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করতে দেখে আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল গোটা কলকাতা শহর। সংবাদপত্রের পাতা ভরে গিয়েছিল প্রশস্তিতে। তবে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডে সত্যজিতের বাসভবনে আবহটি ছিল শোকাবহ। কারণ কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যরাই জানতেন যে সত্যজিৎ রায় তখন ‘কোমায়’ অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ৩০ মার্চ যে ছবি টিভির পর্দায় ফুটে উঠেছিল তার ভিডিয়ো রেকর্ডিং হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগে, মার্চ মাসের ১৬ তারিখে। এরপর সত্যজিৎ রায়ের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং ২৩ এপ্রিল ১৯৯২-এ দীর্ঘ ৮৭ দিনের লড়াই শেষ হয় তাঁর।

.

৪৩. সত্যজিতের মুকুটে আরও একটি পালক সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ ছবি ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) ভারতে মুক্তিলাভ করেছিল ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বের (অধুনা মুম্বাই-এর) ‘ইরোস’ প্রেক্ষাগৃহে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য ছবিটি দর্শকেরা দেখার সুযোগ পান সত্যজিৎ-প্রয়াণের পর ১৯৯২ সালের জুন-জুলাই নাগাদ। তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জানা যায়, ছবির মুক্তির সময় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এন এফ ডি সি)-র সঙ্গে সত্যজিৎ পুত্র, পরিচালক শ্রী সন্দীপ রায়ের কিঞ্চিৎ মতানৈক্য ঘটেছিল।

.

৪৪. ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যজিতের সংগ্রহশালা ১৯৯১ সালের ২ মে, সত্যজিৎ রায়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (সান্তাক্রুজ) তাদের সত্যজিৎ আর্কাইভ বা সংগ্রহশালাটি আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা করে। সত্যজিৎ-কৃত পোস্টার, গ্রন্থ-প্রচ্ছদ, সিনেমার টাইটেল কার্ড, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অলংকরণ, প্রকাশিত বই, এমনকী সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিবিধ আলোকচিত্রী ও সংগ্রাহকদের কাছে থাকা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ও অন্যান্য সংবাদপত্র প্রতিবেদনের প্রতিলিপিও সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল Ray FASC নামক এই সত্যজিৎ-সৃষ্টি সংরক্ষণাগারে। সমগ্র আর্কাইভটি গড়ে ওঠার নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শ্রীদিলীপকুমার বসুর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শ্রীবসুর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একটি পারিবারিক যোগসূত্রও ছিল। সত্যজিতের সহপাঠী এবং পরবর্তীতে শান্তিনিকেতন কলাভবনের অধ্যক্ষ শ্রীদিনকর কৌশিকের কন্যা শ্রীমতী দয়ানী বসু বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন শ্রীদিলীপকুমার বসুর সঙ্গে। ফলে অধ্যাপক বসুর সত্যজিৎ সংযোগ যে দৃঢ়তর হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কর্মকাণ্ডের এই বিপুলায়তন সংগ্রহ সত্যজিৎ রায় সশরীরে আমেরিকায় এসে দেখে যেতে পারেননি, তবে বিজয়া রায়, সন্দীপ রায়, ললিতা রায় এবং সত্যজিৎ পৌত্র সৌরদীপ রায় ১৯৯৩—৯৪ নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে এই আর্কাইভ দেখে গিয়েছিলেন। সত্যজিৎ-সৃষ্টির তালিকা, ছবি এবং সন তারিখ উল্লেখ সহ Ray FASCর ওয়েবসাইটিও ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে সেটি পুনর্নিমাণের জন্যই হয়তো বন্ধ করা হয়েছে। ২০১৫ নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মহাফেজখানাটিকে স্থানান্তরিত করা হয় আমেরিকার রকওয়েল ক্যানিয়ন রোডে অবস্থিত দ্য প্যাকার্ড হিউম্যানিটিজ ইনস্টিটিউটে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৬র ২২ ফেব্রুয়ারি ৭৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন অধ্যাপক দিলীপ বসু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *