সত্যজিৎ ও আকিরা কুরোসাওয়া
[সত্যজিৎ রায়ের ইংরেজি রচনা থেকে সংগৃহীত]
সানডে টাইমস-এ ভেনিস ফিলম ফেস্টিভ্যালের খবর থেকেই প্রথম কুরোসাওয়া সম্বন্ধে জেনেছিলেন সত্যজিৎ। সেটা ছিল ইংরেজি ১৯৫১ সাল। ‘রাসোমন’ সবে মুক্তিলাভ করেছে। যুদ্ধোত্তর জাপানের প্রথম ছবি। ওই পত্রিকাটি ছবিটি সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলা হয়েছিল, ওটা বছরের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গোল্ডেন লায়নের জন্য বিবেচিত হতে চলেছে।
‘রাসোমন’ গ্রাঁ প্রি পুরস্কার পেয়েছিল এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ওটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল একটি আমেরিকান চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান [আর. কে. ও]। তার ফলে ভেনিসে প্রদর্শিত হবার এক বছরের মধ্যেই কলকাতার মানুষের ছবিটা দেখবার সুযোগ ঘটেছিল। কাহিনির মৌলিকতা, ফল্গুধারার মতো প্রেম, শিল্প, কলাকৌশল আর কলকাতার সেই প্রথম জাপানি ছবি— সব মিলিয়ে বাঙালি দর্শকের মন কেড়েছিল ছবিটা। ‘রাসোমন’ বোধ হয় প্রথম সিরিয়াস এবং শিল্পীসুলভ বিদেশি ছবি যা কলকাতায় রবিবার সকালের শোতে অনেকবার দেখানো হয়েছিল।
ব্যক্তিগতভাবে সত্যজিতের ওপর ওই ছবির প্রভাব হয়েছিল রোমাঞ্চকর। উপর্যুপরি তিনদিন ছবিটা তিনি দেখেছিলেন আর প্রত্যেকবার মনে হয়েছিল ছবির সবকিছু বিভাগের ওপর একজন পরিচালকের এমন নিয়ন্ত্রণ আর কোনো ছবিতে আছে কি? এমনকি পনেরো বছর পরেও ছবির হুবহু ঘটনা ভেসে উঠত তাঁর মানসপটে।
বনের ভেতর দিয়ে কাঠুরের হাঁটাচলা দুরূহ সব কোণ থেকে ক্যামেরায় ধরা হয়েছিল, মহিলাটি যখন ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছেন, দস্যু সেই প্রথম তাকে দেখল, বাতাসে তার মুখের ওড়না সামান্য একটু ফাঁক হয়েছে, দস্যু অসলভাবে একটা গাছের ছায়ায় শুয়ে মশা মারছে, আদালতের দৃশ্য [যেখানে বিচারককে একবারও দেখানো হয় নি], ডাকিনিবিদ্যার দৃশ্য, তারপর বিপরীত দুদিক থেকে বায়ুপ্রবাহ… না, জাপানি চলচ্চিত্র যে অসাধারণ কিছু একটা নিয়ে হাজির হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
.
প্যারিস, লন্ডন সর্বত্রই এখন বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্রকারদের ছবি দেখানো হয়। প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি করে জাপানি ছবি প্রতিযোগিতাতে থাকবেই, কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে আছেন ‘রাসোমন’-এর স্রষ্টা কুরোসাওয়া, সারা বিশ্বের তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। তাঁর সারাজীবনের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে অসম্ভব পরিশ্রম করে একটা বই লিখেছেন ডোনাল্ড রিচি, বইটির নাম ‘দ্য ফিল্মস অফ আকিরা কুরোসাওয়া’, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ১৯৬৫ সালে ওটা প্রকাশিত হয়েছিল।
কুরোসাওয়ার ছবিতে দুটো জিনিস খুব চোখে পড়ে, একটা হল ঘটনার ওপর গুরুত্ব আরোপ, এমনকি হিংস্রতাও তা থেকে বাদ যায়না [তাঁর ছবিতে লড়াই বা যুদ্ধ হিংস্রতার চরমে পৌঁছে যায়] আর অন্যটা হল নীতি শিক্ষা দেবার একটা প্রয়াস। এই দুই বিপরীতধর্মী উচ্ছ্বাস একমাত্র কুরোসাওয়ারই বৈশিষ্ট্য, আর কোনো জাপানি চলচ্চিত্রকারের ছবিতে এমনটি নেই।
জাপানে ‘সামুরাই’ সম্প্রদায় একসময় ছিল পেশাদার যোদ্ধার জাত। কুরোসাওয়া ওই জাতের একজন। তাঁর বাবা ছিলেন পেশাদার অস্ত্র শিক্ষাগুরুদের শেষের দিকের একজন। কুরোসাওয়ার প্রথম ছবিই হল ‘স্যানশিরো সুগাতা’ [Sanshiro Sugata] যার মূল বিষয়বস্তু হল জুডো এবং যুযুৎসুর মধ্যে সংঘাত। উত্তেজনাময় ঘটনার দিকে কুরোসাওয়ার প্রথম থেকেই ঝোঁক তা বোধ হয় বলা যায়।
তাঁর প্রিয় পরিচালক হলেন ফোর্ড, ওয়াইলার, কাপুরা, স্টিভেন্স, হকস— সবাই আমেরিকান। যুদ্ধের কিংবা দ্বন্দ্বযুদ্ধের দৃশ্যে ফোর্ডের ওয়েস্টার্ন ছবির প্রভাব কুরোসাওয়ার ছবিতে পাওয়া যায় বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার মহান সাহিত্যিক টলস্টয়, ডস্টয়ভস্কি এবং টুর্গেনিভের উপন্যাসের প্রভাব। সত্যজিৎ রায় নিজেও অনুপ্রেরণার জন্য এই মনীষীদের রচনায় ডুবে যান। কুরোসাওয়ার সঙ্গে প্রিয় পরিচালক এবং প্রিয় লেখকের ব্যাপারে সত্যজিতের যেন একটা আশ্চর্য মিল। ফোর্ড, ওয়াইলার, কাপুরা তাঁরও প্রিয় পরিচালক।
‘পথের পাঁচালী’ আর ‘অপরাজিত’ পর পর দু-বছর আন্তর্জাতিক ফিলম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাবার পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সত্যজিতের খ্যাতি। ১৯৫৭ সালের গোড়ার দিকে শ্রীমতী কাওয়াকিতা১২ তাঁকে জাপান সফরে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। জাপানি চলচ্চিত্রকে পৃথিবীর মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব শ্রীমতী কাওয়াকিতা নিশ্চয়ই দাবি করতে পারেন। লন্ডনের ন্যাশনাল ফিলম থিয়েটারে ‘পথের পাঁচালী’ দেখেই তিনি ওই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সত্যজিৎ কিন্তু ১৯৬৬-র আগে টোকিও রওনা হতে পারেননি। শ্রীমতী কাওয়াকিতা তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘রে বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক।’
জাপানে ঝটিকা সফরের শেষের দিকে কুরোসাওয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সত্যজিৎ। এ সম্বন্ধে তিনি ইংরেজিতে সুন্দর একটি রচনা লিখেছিলেন, তার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ এখানে দেওয়া হল। [ভাবানুবাদ কারণ ওই চমৎকার রচনার অনুবাদ এ অধমের কম্ম নয়] সত্যজিৎ যদি বাংলায় না লিখে ইংরেজিতে লিখতেন তবে বোধ হয় লেখক হিসেবে তিনি অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করতেন, কারণ সেক্ষেত্রে মাত্র একটি আঞ্চলিক ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকত না তাঁর সাহিত্য প্রতিভা।
কাইয়োটো থেকে টোকিও ফিরছিলেন সত্যজিৎ। সময় তখন প্রায় মধ্যাহ্ন। সুন্দরী জাপানি মেয়েরা একই রকম পোশাকে চাকাওয়ালা গাড়িতে খাবারের প্যাকেট সাজিয়ে বিক্রির জন্য কামরার পাশ দিয়ে চলাফেরা করছিল। লাউডস্পিকারে ওসাকা, কাইওটো, ইওকোহামা এবং টোকিওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগের কথা ঘোষণা করা হচ্ছিল। বড়ো জানালার ধার ঘেঁষে বসে মাঠঘাট যখন চোখের নিমেষে মিলিয়ে যেতে দেখছিলেন, সত্যজিতের মনে হচ্ছিল যেন বিমানে যাচ্ছেন। হোককাইডো লাইনে রেলগাড়ি চলে ঘণ্টায় ১২৫ মাইল বেগে, সেতু কিংবা টানেলের ঝামেলা নেই।
‘নারা’-র পথে একটু ঘুরে, যে অরণ্যে ‘রাসোমন’-এর শুটিং হয়েছিল, তার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। জঙ্গলটা পাহাড়ের উপর, কালিম্পঙে যাবার মতোই রাস্তাটা। ট্রেনে নিজের আসনে বসে সত্যজিৎ ওই বনের কথা— যেখানে অমন দারুণ একটা ছবি তোলা হয়েছিল এবং সেই ছবির নির্মাতার সঙ্গে তাঁর আশু সাক্ষাতের কথা মনে মনে ভাবছিলেন। যাত্রা শেষে আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে তাঁর মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন ছিল।
সত্যজিৎ আশা করছিলেন আর সব নেমন্তন্নের মতো ওটাও যেন জাপানের কোনো সরাইখানায় না হয়। ওইসব সরাইখানার ভেতরের আঙ্গিক সজ্জার কোনো ত্রুটি নেই, আর এমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে আরশোলার কথা চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু— এবং ওটাই জাপান সম্বন্ধে তাঁর একমাত্র অভিযোগ— যে খাবার তাঁকে ওখানে দেওয়া হচ্ছিল সেটা তাঁর কাছে মোটেই রুচিকর ছিল না, তা ছাড়া ওই খাবার মুখে তুলতে দু-হাঁটু যেভাবে বাঁকাতে হচ্ছিল সেটাও তেমন যুৎসই হচ্ছিল না তাঁর কাছে। পৃথিবীর সেরা সুস্বাদু রান্নাও সঠিক পরিমাণে এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে রেকাবি থেকে মুখে তুলতে না পারলে তা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় না। দুটি সরু কাঠি [চপস্টিকস] একজন আনাড়ির হাতে দেবার অর্থই হল আসল উদ্দেশ্য পণ্ড হওয়া।
.
যাহোক ওঁদের সাক্ষাতের স্থান নির্বাচিত হয়েছিল টোকিওর এক পুরোনো রাস্তার এক চীনা রেস্তোরাঁয়। ‘কুরোসাওয়ার প্রিয় রেস্তোরাঁ’ বলেছিলেন শ্রীমতী কাওয়াকিতা, যাঁর আমন্ত্রণে জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। শ্রীমতী কাওয়াকিতা ছিলেন কুরোসাওয়ার খুব কাছের মানুষ।
.
কুরোসাওয়ার মতো দীর্ঘদেহী পুরুষ জাপানিদের মধ্যে বিরল। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছেন, সেইসঙ্গে যথাযথ নম্রতা ঘিরে আছে তাঁকে, স্নিগ্ধ দু-চোখে হাসির ঝিলিক, মৃদু কণ্ঠস্বর— ‘সামুরাই’-এর মতো উত্তেজক ছবির স্রষ্টার চেহারা যেমন ভাবা গিয়েছিল তা থেকে কিন্তু একেবারেই বিপরীত। সত্যজিৎ জানতেন কুরোসাওয়ার ধমনীতে বইছে সামুরাই রক্ত। তাই তিনি মনে মনে তাঁর চরিত্রের আরেকটা দিকের কথা কল্পনা করেছিলেন, যিনি একজন খাঁটি সামুরাই বা পেশাদার যোদ্ধার মতোই লড়াইয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তেন প্রচণ্ড রোষে।
সত্যজিৎ ‘সেভেন সামুরাই’ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন, দেখা গেল ওটা তাঁদের দুজনেরই প্রিয় ছবি। ‘ছবিতে একজন সামুরাই হতে গেলে তার দীর্ঘ এবং কঠোর অনুশীলনের দরকার,’ কুরোসাওরা বললেন। ‘তাকে কেতাদুরস্তভাবে ঘোড়া ছোটাতে হবে, দৌড়তে হবে, তরবারি আন্দোলিত করতে হবে। আক্রমণের সময় একজন সামুরাই কখনো ঘোড়ার পিঠে ঝুঁকবে না। জিনের দুপাশে পা রাখার যে জায়গা, যার ভেতর পা গলিয়ে লাফিয়ে ঘোড়ায় চাপতে হয়, তাতেই দু-পা রেখে তাকে সটান দাঁড়াতে হবে আর দু-হাঁটু ঘোড়ার দু-পাশের জঙ্ঘায় দৃঢ়ভাবে চেপে রাখতে হবে। তার শরীর সামনের দিকে এমন তির্যকভাবে থাকবে যে আক্রমণের তোড়ে সে যেন পেছনদিকে ছিটকে না পড়ে।’
কুরোসাওয়া চেয়ার থেকে উঠে আক্রমণকারী একজন সামুরাইয়ের কেমন ভঙ্গি হওয়া উচিত তা দেখালেন। তিনি আরও বললেন, ‘তরবারি এমনভাবে চালাতে হবে যাতে ফালি ফালি করে কাটা আর ঝপ করে কোপ মারার মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটে। দৌড়ুবার সময় একজন সামুরাইয়ের মাথা দুলবে না, সিধে থাকবে।’
ঐতিহাসিক নির্ভুলতার খাতিরে কুরোসাওয়া যে যুগের ছবি তোলেন, হৃদয়ের যাদুঘর থেকে সে যুগের পোশাক যোগাড় করেন চরিত্রদের জন্য।
‘কিন্তু আপনি তো গোলমালটা কোথায় বুঝতে পারবেন,’ চোখে কৌতুকের ঝিলিক এনে তিনি বললেন, ‘গত পাঁচ ছ-শো বছরে জাপানি জাতটাই মাথায় খাটো হয়ে গেছে, ওই পোশাকের মাপমত বড়োসড়ো চেহারার মানুষ এখন কোথায়!’
সামুরাইদের নিয়ে আর কোনো ছবি করার ইচ্ছে তাঁর আছে কিনা, সত্যজিতের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘না, আরেকটা সামুরাই ছবি আর কখনো করতে পারব কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।’
‘কেন পারবেন না?’ সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন।
‘কারণ এখন ঘোড়ার খুব অভাব। আমি ছবিতে যেসব ঘোড়া ব্যবহার করেছিলাম তার বেশির ভাগ এসেছিল নানান খামার থেকে, কিন্তু এখন খামারের কাজ যান্ত্রিক হয়ে গেছে, এখন শুধু রেসের জন্য ঘোড়া লালনপালন করা হয়।’
আলোচনা প্রসঙ্গে ম্যাকবেথ ছবির কথা তুলেছেন সত্যজিৎ। বার্নাম [Birnam] অরণ্যের গাছগুলো কেটে ফেলার পর পাখির দল যে ম্যাকবেথের প্রাসাদে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই দৃশ্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
‘মানে, ওসব গাছে পাখির বাসা ছিলই, আর পাখিদের কোথাও তো যেতে হবে, তাই আমি ওদের দিয়ে প্রাসাদ অভিযান করিয়েছিলাম। কিন্তু,’ আবার চোখে কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ওই দৃশ্যটা তুলতে আমাদের রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল। আমার মূল পরিকল্পনা ছিল অভিনেতাদের মাথার ওপর পাখিগুলো চক্কর দেবে, কিন্তু ওরা তো শিক্ষিত পাখি নয়, আমরা ওদের ছেড়ে দেবার পর ওরা ধুপধাপ মেঝের ওপর পড়তে লাগল। মোম দিয়ে পালিশ করা হয়েছিল মেঝে, কিছু পাখি পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। ওই একটা দৃশ্য তুলতে পুরো এক সপ্তাহ লেগেছিল।’
লেডি ম্যাকবেথ মা হতে চলেছেন, সেটা ছবিতে দেখাবার যে পরিকল্পনা কুরোসাওয়ার মাথায় এসেছিল সেটা নাকি লরেন্স অলিভিয়ারের খুব পছন্দ হয়েছিল, তাতে লেডি ম্যাকবেথের আচরণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি তাঁর নাটকে ওই পরিকল্পনা ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে কুরোসাওয়াকে চিঠিও লিখেছিলেন। লরেন্স অলিভিয়ার এক ধাপ এগিয়ে এমন মন্তব্যও করেছিলেন যে, ম্যাকবেথের সন্তান কুৎসিত এবং বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাবে। কুরোসাওয়ার কাছে ওই মন্তব্য অমার্জিত মনে হয়েছিল এবং তিনি অলিভিয়ারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সত্যজিৎ শুনেছিলেন আমেরিকার প্রযোজক জো লেভিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা ছবি তোলার জন্য কুরোসাওয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছেন। ইংরেজিতে মাত্র প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন এশিয়াবাসী পরিচালকের ইংরেজি ভাষায় খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ছবি তোলার ঘটনা ওটাই হবে প্রথম।
কুরোসাওয়ার শেষ ছবি [সে সময়] ‘রেড বীয়ার্ড’ দীর্ঘকাল ধরে শুটিং-এর ফলে শুধু ব্যয় বরাদ্দই ছাপিয়ে যায় নি, ছবির নায়কের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ কুড়ি বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল, জাপানি প্রযোজকদের বিষ নজরে পড়েছিলেন তিনি। ‘রেড বীয়ার্ড’ খুব সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, দীর্ঘকাল চলেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওটার পেছনে যে প্রচুর অর্থব্যয় হয়েছিল তা উঠে আসেনি। বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় ছবি করার সম্মতির সেটাই বোধ হয় একমাত্র কারণ।
‘একটা গল্প আমার খুব ভালো লেগেছে,’ কুরোসাওয়া বলেছিলেন, ‘আমেরিকার একটা পত্রিকা থেকে ওটা আমি কেটে রেখেছি। গল্পটা হল একটা মালগাড়ি শিকাগো থেকে ঘণ্টায় আশি মাইল বেগে ছুটছে, গাড়িতে আছে মাত্র তিনটি প্রাণী, কিন্তু এঞ্জিন ঘরে কেউ নেই। যে কারণেই হোক গাড়ির চালক গাড়ি থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ট্রেন এবং ওই তিনজন যাত্রী শেষপর্যন্ত রক্ষা পেয়েছিল এবং কিভাবে সেটাই দেখানো হবে ছবিতে।’
কুরোসাওয়া যদি ওই ছবিটা করতে পারেন তবে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলা মালগাড়িটা একজন আক্রমণাত্মক সামুরাইয়ের মতোই চিত্তাকর্ষক এবং প্রেরণাদায়ক হয়ে উঠবে বলে মনে করেন সত্যজিৎ।
***
১২. ‘১৯৫৭ সালের গোড়ার দিকে শ্রীমতী কাওয়াকিতা’ শ্রীমতী কাওয়াকিতা বলতে এখানে প্রখ্যাত জাপানী চলচ্চিত্র প্রযোজিকা এবং ফিলম তত্ত্বাবধায়ক কাশিকো কাওয়াকিতা-র (১৯০৮—১৯৯৩) কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জাপানি নতুন ধারার চলচ্চিত্রকে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ও তাঁর স্বামী, প্রখ্যাত উদ্যোগপতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক নাগামাসা কাওয়াকিতা (১৯০৩—১৯৮১)-র অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সত্যজিতের গুণমুগ্ধদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন শ্রীমতী কাওয়াকিতা এবং জাপানে সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রচারের নেপথ্যেও ছিল ওঁর অবদান। ১৯৫৬ সালে কাশিকো কাওয়াকিতা ‘পথের পাঁচালী’ দেখে মুগ্ধ হন কান চলচ্চিত্র উৎসবে। ব্রুসেলস-এ সত্যজিৎকে চাক্ষুষ দেখে তিনি তাঁকে ‘শ্রীকৃষ্ণের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আমৃত্যু সত্যজিৎ এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে এক আশ্চর্য সৌহার্দ্য বজায় ছিল শ্রীমতী কাওয়াকিতার।