বংশ পরিচয়

বংশ পরিচয়

সত্যজিৎ রায়ের পিতামহের আসল নাম কামদারঞ্জন। কামদারঞ্জনের বাবার নাম কালীনাথ রায়, মায়ের নাম জয়তারা, পিতামহের নাম লোকনাথ। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বড়ো মসুয়া গ্রামে তাঁদের আদি বাড়ি। কালীনাথের পূর্বপুরুষ নদিয়া জেলা থেকে পূর্ববাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কালীনাথের আরেক নাম ছিল শ্যামসুন্দর। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জনকে তাঁদেরই এক জ্ঞাতি জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরি পুষ্যি নিয়েছিলেন। সেই পোষ্যপুত্রের নাম রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরি, বাংলা শিশুসাহিত্যের এক কীর্তিমান পুরুষ।

হরিকিশোরের পরে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, তাঁর নাম নরেন্দ্রকিশোর। হরিকিশোরের মৃত্যুর পর উপেন্দ্রকিশোর আর নরেন্দ্রকিশোর জমিদারি ভাগ করে নিয়েছিলেন। তবে বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে উপেন্দ্রকিশোর তেমন পাকাপোক্ত মানুষ ছিলেন না, নরেন্দ্রকিশোরের উপর সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সৃজনশীল কাজের মধ্যেই ব্যাপৃত রেখেছিলেন নিজেকে।

উপেন্দ্রকিশোরের পিতামহ লোকনাথ ছিলেন সাধু প্রকৃতির। সাধন-ভজন নিয়েই থাকতেন। তিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক। আবার পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন সে কালের একজন কৃতী পুরুষ। যেমন ছিল তাঁর বিভিন্ন ভাষা-জ্ঞান, তেমন ছিল অঙ্কে অসাধারণ মেধা। জরিপের কাজে তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা, কিন্তু সাংসারিক জীবনে তাঁর মোটেই আকর্ষণ ছিল না। বিয়ের পরেও তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হল না দেখে তাঁর বাবা রামকান্ত ছেলের তন্ত্রসাধনার পুঁথিপত্র, সব উপকরণ নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। দুঃখে শোকে লোকনাথ শয্যা নিলেন, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন। তিনদিন পর মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনের অবসান ঘটল। তিনি নাকি মৃত্যুর আগে স্ত্রী কৃষ্ণমণিকে বলে গিয়েছিলেন দুঃখ না করতে, তাঁর যে সন্তান আসছে তার বংশধররা কীর্তিমান হবে।

ছোটোবেলা থেকে জমিদার বাড়িতে প্রাচুর্যের পরিবেশে মানুষ হলেও উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে জমিদারি চালচলনের প্রভাব পড়েনি, বরং তাঁর পিতামহ লোকনাথের প্রতিভার স্ফুরণই দেখা দিয়েছিল বেশি। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে তাঁর যেমন মেধা ছিল, সাহিত্য ও শিল্পকলার অনুরাগ ছিল ততোধিক।

ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে এসে ভরতি হলেন উপেন্দ্রকিশোর। মসুয়ার পাট এখান থেকেই ইতি। এই সময় তাঁর বাবা কালীনাথের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সারদারঞ্জন উনিশ বছর বয়সেই অঙ্ক আর সংস্কৃতে ডবল এম এ হয়েছিলেন। পরে তিনি মেট্রোপলিটন, এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছিলেন। অত্যন্ত তেজস্বী ছিলেন তিনি।

সারদারঞ্জনের নাম আরও এক ব্যাপারে বিখ্যাত হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন ক্রিকেটের এক মস্ত অনুরাগী। ভারতবর্ষে ওই খেলা জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা এবং অবদান অবিস্মরণীয়। উপেন্দ্রকিশোরই একমাত্র ব্যতিক্রম, সারদারঞ্জনের অন্য সব ভাইরা ক্রিকেটে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর কিন্তু ক্রিকেট ব্যাটের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রঙের তুলি আর লেখনী। এখানে কালীনাথের পুত্র-কন্যাদের নামের তালিকা দেয়া হল :

কালীনাথ (স্ত্রী জয়তারা)

সারদারঞ্জন (স্ত্রী-শশীমুখী); গিরিবালা (স্বামী-দীননাথ); কামদারঞ্জন (উপেন্দ্রকিশোর) (স্ত্রী-বিধুমুখী); ষোড়শীবালা (স্বামী-শম্ভুনাথ আইচ রায়); মুক্তিদারঞ্জন (স্ত্রী-কুণ্ডলিনী); কুলদারঞ্জন (স্ত্রী-স্বর্ণলতা); প্রমদারঞ্জন (স্ত্রী-সুরমা); মৃণালিনী (স্বামী-হেমেন্দ্রমোহন বসু)।

সারদারঞ্জন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছেন, তাঁর ছোটো ভাইরা লেখাপড়ার জন্য তাঁর কাছে আছেন। শুধু কুলদারঞ্জন উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে থাকতেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকা, ফোটোগ্রাফি, লেখা ইত্যাদিতে কুলদারঞ্জন হাত পাকিয়ে ছিলেন। মসূয়ার সঙ্গে রায় পরিবারের যোগাযোগ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখানে বলে রাখা ভালো, সারদারঞ্জন ও উপেন্দ্রকিশোরের সবচেয়ে ছোটোভাই ছিলেন প্রমদারঞ্জন, বন-জঙ্গলের গল্প বলতে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না বললেই চলে। ‘সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র কাজে তাঁকে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল, এমনকি শ্যামদেশ ও বর্মা মুলুকেও যেতে হয়েছিল। ওখানকার রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে তিনি সুন্দর বই লিখেছেন। তাঁর হাসিটি ছিল দরাজ, প্রাণখোলা। সত্যজিতের হাসি বোধ হয় তাঁর কাছেই পাওয়া। তাঁরই মেয়ে হলেন লীলা মজুমদার— যাঁকে বলা শিশুসাহিত্যের সম্রাজ্ঞী। সুকুমার রায়ের তিনি খুড়তুতো বোন, সত্যজিতের পিসি।

কলেজে পড়ার সময় ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি উপেন্দ্রকিশোর আকৃষ্ট হলেন এবং পরে ওই ধর্ম গ্রহণ করলেন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের একজন সমাজকর্মী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কন্যা বিধুমুখীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। এই নিয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটেছিল। তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় তাঁর পালিত পিতা হরিকিশোর মনে ব্যথা পেয়েছিলেন, তবে তিনি কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের স্বাধীন মতামতের বিরোধিতা করেন নি। সারদারঞ্জনও ভাইয়ের ধর্মান্তর সুনজরে দেখেননি, তবে পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে এ নিয়ে আর ভুল বোঝাবুঝি ছিল না।

দ্বারকানাথের দ্বিতীয়া পত্নীর নাম কাদম্বিনী। বিয়ের আগে তিনি ছিলেন কাদম্বিনী বসু। যেমন ছিলেন সুন্দরী তেমন বিদুষী। ১৮৮২ সালে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তিনি প্রথম দুজন মহিলা গ্রাজুয়েটের একজন (অন্যজন চন্দ্রমুখী বোস)। পরে তিনি ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম গ্রাজুয়েট মহিলা ডাক্তার— ডা. (মিসেস) কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। তিনি বিলেতেও গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ডাক্তারি শাস্ত্রে আরও পাশ করে এসেছিলেন। সেই যুগে অমন অসাধারণ মহিলার কথা চিন্তা করতেও আশ্চর্য লাগে।

কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের তেরো নম্বরের মস্ত বাড়ির দোতলার একটা অংশ ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর সংসার পাতলেন। ওই বাড়িরই ঠিক ওপরের তলায় ছিলেন বিধুমুখীর বাবা দ্বারকানাথ, আর তাঁর তরুণী স্ত্রী কাদম্বিনী। আলাদা সংসার হলেও অনেকটা যেন যৌথ পরিবার। কাদম্বিনী ছিলেন বিধুমুখীর সৎ মা। বিয়ের আগে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন দ্বারকানাথের প্রিয় ছাত্রী। দ্বারকানাথ তখন বিপত্নীক এবং প্রৌঢ়। ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য তিনি সুন্দরী ও সাহসিকা কাদম্বিনীকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন। মজার কথা, সেই সময় খাস ইংরেজ দুহিতাদের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ ছিল।

ক্রমে সাতটি সন্তানের জন্ম দিলেন কাদম্বিনী, আর বিধুমুখীর কোল জুড়ে এল ছটি সন্তান। তেরোটি কচিমুখের কলহাসিতে মুখর হয়ে উঠল তেরো নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের প্রকাণ্ড বাড়ি।

উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখীর প্রথম সন্তান হলেন সুখলতা। সুলেখিকা সুখলতা রাও নামেই তিনি বেশি পরিচিত। ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর গল্পের ও ছড়ার বই আজও সমান আদৃত।

দ্বিতীয় হলেন সুকুমার, সত্যজিতের বাবা। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়স বেঁচেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন শিশু সাহিত্যকে।

তৃতীয় হলেন পুণ্যলতা— পুণ্যলতা চক্রবর্তী, তিনিও সুন্দর লিখতে পারতেন। তাঁর দুই মেয়ের প্রথমজন কল্যাণী কার্লেকর, আর দ্বিতীয়জন সন্দেশ পত্রিকার ছোটো সম্পাদিকা নলিনী দাশ, কবি জীবনানন্দ দাশের ভ্রাতৃবধূ এবং অশোকানন্দর স্ত্রী।

পুণ্যলতার পর সুবিনয় রায়। বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প ও প্রবন্ধ লিখে তিনি নাম করে ছিলেন। তারপর মেয়ে শান্তিলতা আর সবার ছোটো সুবিমল। তিনি ছিলেন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খুব সজাগ; ভাত খেতে সময় লাগত ঝাড়া এক ঘণ্টা। খুব আস্তে আস্তে চিবিয়ে খেতেন, তা না হলে নাকি হজম হয় না। তাঁর লেখা আজগুবি গল্পের জুড়ি নেই।

.

এখানে উল্লেখযোগ্য উপেন্দ্রকিশোরই ভারতবর্ষে প্রথম হাফটোন ব্লক প্রিন্টিংয়ের প্রবর্তন করেন। এ ব্যাপারে তিনি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউ রায় অ্যান্ড সন্স-এর ছাপাখানায় শিশুসাহিত্যের এক যুগান্তকারী গোড়াপত্তন হয়েছিল, এ কথা অনস্বীকার্য। ১৯০০ সাল থেকে বাইশ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে উপেন্দ্রকিশোর সপরিবারে বাস করতে থাকেন, একতলায় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স-এর ছাপাখানা। উপেন্দ্রকিশোরের চতুর্থ ভাই কুলদারঞ্জন রায় তাঁর মেজোদাদার সঙ্গে সুকিয়া স্ট্রিটে থাকতেন।

কুলদারঞ্জন ক্রিকেট খেলায় নাম করেছিলেন। তিনি সুলেখকও ছিলেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের যে সব বই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যেমন ‘অজ্ঞাত জগৎ’, ‘বাস্কারভিলের কুক্কুর’, ‘শার্লক হোমসের কীর্তিকলাপ’ ইত্যাদির তুলনা হয় না।

আগেই বলা হয়েছে, সারদারঞ্জন ক্রিকেটের একজন মস্ত অনুরাগী ছিলেন। তাঁকে নাকি অনেকটা ক্রিকেটের জনক ডব্লু জি গ্রেসের মতো দেখতে লাগত। সেজো ভাই মুক্তিদারঞ্জনও খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, উপেন্দ্রকিশোরের ছোটো বোন মৃণালিনীর স্বামী হেমেন্দ্র মোহন বসু ছিলেন ময়মনসিংহের বিখ্যাত আনন্দমোহন বসুর ভাইয়ের ছেলে। হেমেন্দ্রমোহন কুন্তলীন তেল আর দোলখোস এসেন্স আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর ছিল গন্ধদ্রব্যের ব্যবসা। তাঁরাও কিন্তু ব্রাহ্ম ছিলেন।

মৃণালিনী হলেন সুকুমার রায়ের পিসি, সত্যজিতের সোনাঠাকুমা। তাঁর চোদ্দোজন ছেলে-মেয়ের মধ্যে একজনের নাম নীতিন— তিনিই বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আর চলচ্চিত্র পরিচালক নীতিন বসু। আরেকজন হলেন মুকুল বসু। সিনেমা লাইনে সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসাবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সত্যজিৎ যে পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত সিনেমা পরিচালক হয়েছিলেন তাতে আর আশ্চর্য কি! প্রতিভা এমনই জিনিস, চারদিকে যা কিছু পড়ে থাকে তাই কুড়িয়ে বাড়িয়ে নেয়, কিছুই ফেলে না। সত্যজিৎ শুধু বাপ-ঠাকুরদার গুণই পাননি, ঠাকুমা-দিদিমা-পিসিমা, এক কথায় বংশের সব ধারা থেকেই তিনি আহরণ করেছেন শ্রেষ্ঠ সম্পদ বা গুণ।

নীতিন বসুর আরও তিন ভাইয়ের নাম কার্তিক, গণেশ আর বাপী। কার্তিক বসু, গণেশ বসু আর বাপী বসুর নাম জানে না এমন ক্রিকেট অনুরাগী বোধ হয় বিরল।

এই বইটির প্রথম প্রকাশ যখন আসন্ন, সেই সময় ১৩ এপ্রিল ১৯৮৬ নীতিন বসু ৮৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বাংলা এবং হিন্দি মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছবি তিনি করে ছিলেন। ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিতে তিনিই প্রথম প্লে-ব্যাক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে ‘দেশের মাটি’, ‘দিদি’, ‘দীদার’, ‘ওয়ারিশ’, ‘গঙ্গা-যমুনা’, ‘মশাল’ ইত্যাদি স্মরণীয়।

.

উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছোটোদের মহাভারত’, ‘টুনটুনির বই’, ‘আকাশের কথা’, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ ইত্যাদি শিশুসাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে। আজ সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার আর নলিনী দাশের সম্পাদনায় ছোটোদের জন্য যে মাসিক পত্রিকা সন্দেশ প্রকাশিত হয়, তার সূচনা কিন্তু করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ১৯১৩ সালে (বাংলা ১ বৈশাখ ১৩২০) সন্দেশ-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ— শিশুসাহিত্যে সেটা একটা সুবর্ণ ক্ষণ। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রিয়ংবদা দেবী সবাই লিখেছেন ছোটোদের এই মনভোলানো পত্রিকায়। আগেই বলা হয়েছে, বিষয়-আশয়ের প্রতি উপেন্দ্রকিশোরের তেমন আসক্তি ছিল না, শিল্প ও সাহিত্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল তাঁর স্বপ্ন আর সাধনা।

উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি মাঝে মাঝে উপেন্দ্রকিশোরের বাড়ি আসতেন। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ থেকে আমরা জানতে পারি, একদিন রবীন্দ্রনাথ উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে দেখা করে জগদীশচন্দ্র বোসের বাড়ি যাচ্ছিলেন। বাড়িটা কাছেই ছিল, তাই হেঁটেই যাচ্ছিলেন। খানিকটা গিয়েই তিনি ফিরে এসেছিলেন। পথে একটা মরা ইঁদুর তাঁর চোখে পড়েছিল। তখন আবার কলকাতায় প্লেগের আতঙ্ক। মরা ইঁদুরটার আশেপাশে, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। ইঁদুর থেকে যদি তাদের প্লেগের ছোঁয়াচ লাগে এই চিন্তায় আকুল হয়ে উঠছিল কবির মন। ফিরে এসেই উপেন্দ্রকিশোরকে তিনি বলেছিলেন একটা বিহিত করতে। উপেন্দ্রকিশোর লোক দিয়ে মড়া ইঁদুরটার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবার পর কবি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

সামান্য ব্যাপার থেকেই মহৎ প্রাণের পরিচয় পাওয়া যায়। ওই রাস্তা দিয়ে কত লোক তো হাঁটছিল। কই কারও মনে ও প্রশ্নটা তো জাগেনি। কিছু ছোটো ছেলেমেয়েরা ওখানে খেলা করছে দেখে কবির নরম মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।

সুকুমার রায়কে কবি খুব স্নেহের চোখে দেখতেন, তাঁর প্রতিভাকে উৎসাহ দিতেন। উপেন্দ্রকিশোরের নাতি, সুকুমারের ছেলে সত্যজিৎকে রবীন্দ্রনাথ স্নেহের চোখে দেখবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! সত্যজিতের যখন দশ বছর বয়স, কবি তাঁর অটোগ্রাফের খাতায় চমৎকার একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘যখন ছোটো ছিলাম’ বইয়ে এই কবিতার উল্লেখ আছে:

বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
 দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
 একটি শিশির বিন্দু।

সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায়ের জন্ম ইংরাজি ১৮৮৭ সালে। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই তিনি সুন্দর ছবি আঁকতে আর ছড়া লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম কবিতা ‘নদী’। পরের বছর সুকুমারের সেই ছড়া ছাপা হল ছোটোদের পত্রিকা মুকুল-এ। ন-বছর বয়সেই ছাপার অক্ষরে স্বরচিত লেখায় তাঁর হাতেখড়ি। পয়ার ছন্দে ষোলো লাইনের কবিতা ‘নদী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৬ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় সুকুমার ‘ননসেন্স ক্লাবের’ গোড়াপত্তন করেছিলেন। মজার মজার গল্প, ছড়া আর কৌতুক অভিনয়ে যারা পারদর্শী, তাদের জন্যে এই ক্লাবের সদস্যপদ ছিল অবারিত। বাবার মতো গায়ের রং না হলেও সুপুরুষ ছিলেন, মাথায় বেশ বেড়েছিলেন সুকুমার। মুখে মুখে ছড়া বানাবার অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। লুই ক্যারল আর এডোয়ার্ড লীয়রের মতো ছোটোদের জন্য মজার গল্প আর ছড়া লেখাতেই তাঁর ছিল আনন্দ।

১৯০৬ থেকে ১৯০৮-এর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ননসেন্স ক্লাব। ওই ননসেন্স ক্লাবে সমবয়সি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আমোদ করার জন্য সুকুমার দুটি কৌতুক নাট্য রচনা করেছিলেন, ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। এমন চমৎকার ভাঁড়ামিবিহীন কৌতুকরসোচ্ছল নাটক বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এ কথা এখন স্বীকৃত যে, ননসেন্স ক্লাবের আমন্ত্রণপত্রের জন্য আঁকা ছবিতেই ইলাস্ট্রেটর হিসাবে সুকুমার রায়ের প্রথম আত্মপ্রকাশ।

সুকুমার রায় বিলেত চলে যাবার পর ননসেন্স ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বিলেত থেকে ফিরে আসার পর ওই ক্লাব আবার প্রাণ ফিরে পায়। তবে প্রতি সোমবার ওই ক্লাবের অধিবেশন বসত তাই নামটা বদলে হয়ে গেল ‘মনডে ক্লাব’। অনেকে ঠাট্টা করে বলতেন ‘মণ্ডা ক্লাব’। কালিদাস নাগ, প্রশান্ত মহলানবিশ, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং পরবর্তীকালের অনেক বিখ্যাত মানুষ ওই ক্লাবের সদস্য ছিলেন, তবে তাঁদের মধ্যমণি ছিলেন সুকুমার রায়। শিশিরকুমার দত্ত ওরফে খোকনবাবু ছিলেন সম্পাদক। মাসিক চাঁদা চার আনা। সভার আমন্ত্রণপত্রগুলো মজার ঠাট্টায় সুকুমারই রচনা করতেন। সম্পাদক মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে উধাও হতেন, তাই একবার চিঠিতে লেখা হল:

সম্পাদক বেয়াকুব তাই বলি, সোমবারে
কোথা যে দিয়েছে ডুব মদগৃহে গড়পারে
এদিকেতে হায় হায় দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিত যায় যায়। ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি
 রকমারি পুঁথি কত
 নিজ নিজ রুচিমত
 আনিবেন সাথে সবে
 কিছু কিছু পাঠ হবে
 করজোড়ে বার বার
 নিবেদিছে সুকুমার।

আরেকটি চিঠি [সম্পাদক ফিরে আসার পর]

শুভ সংবাদ
সম্পাদক জীবিত আছেন
আগামী সোমবার
২৫ নং সুকিয়া স্ট্রিটে
৬।। ঘটিকার সময়
তাঁহার শ্রীমুখচন্দ্র দর্শনার্থ
ভক্ত সমাগম হইবে।

সম্পাদক ফিরে এসে সভ্যদের আমন্ত্রণপত্রে লিখলেন:

আমি অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাস তিনেক কলকেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।।
 বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
 কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া!
 চিন্তা নেইক গভীর বিষয়—
 আমার প্রাণে এ সব কি সয়?
এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,
আমি আবার এইছি ঘুরে,
তান ধরেছি সাবেক সুরে।
 শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
 গিরিজার ‘বিবেকানন্দ’,
 মঙ্গলবার আমার বাসায়…
 (আর থেক না ভোজের আশায়)।
১৪ মে :২৫ নং সুকিয়া স্ট্রিট।

বলা বাহুল্য, ক্লাবের অধিবেশনে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা সদস্যদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সুকুমার বি এস সি পাশ করে ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে ফোটোগ্রাফি করে প্রিন্টিং সম্বন্ধে পড়াশোনা করতে বিলেত গিয়েছিলেন। প্রথমে লন্ডন স্কুল অফ ফোটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি ও পরে ম্যাঞ্চেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজিতে প্রিন্টিং টেকনোলজি শিখলেন। ১৯১৩ সালে রয়েল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির ফেলোশিপ নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন।

সুকুমার বিলেত যাত্রা করার কয়েক মাস পরেই ১৯১২-র জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ পুত্র ও পুত্রবধূসহ লন্ডনে গিয়েছিলেন। বিলেতে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন সুকুমার। উপেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আসতেন, তাই ছোটোবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। পরবর্তীকালে দুজনের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকুমারের ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর বোলপুরে যাতায়াত ছিল। রবীন্দ্রনাথের তিনি ছিলেন ‘যুবক বন্ধু। সুকুমারের বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ছিলেন। কিছুদিন আগেই তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কথা ঘোষিত হয়েছে। সেই উপলক্ষে অভ্যর্থনার প্লাবনে এবং সভা-সমিতিতে উপস্থিত থাকার ফলে রবীন্দ্রনাথ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, শিলাইদহে গিয়ে নির্জনতা-সুখ উপভোগ করছিলেন। কিন্তু সুকুমারের বিয়েতে তিনি না এসে পারেননি।

বিলেতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে প্রায়ই দুজনের সাক্ষাৎ হত। বিলেতে এক সভায় সুকুমার ‘দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ’ এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। বিলিতি একটি কাগজে সেটি ছাপা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতার তিনি ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন। যেমন—

মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকনো ফুল,
পড়িছে শিশিরকণা, পড়িছে রবির কর—
পড়িছে বরষা-জল ঝরঝর ঝরঝর…
বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে একই গান, একই গান, একই গান।
[‘সন্ধ্যাসংগীত’ গ্রন্থের ‘হৃদয়ের গীতধ্বনি’ থেকে]
Round thee fall the faded leaves and
Flowers shed their petals,
The dewdrops sparkle on the grass and
Vanish, the sunlight plays with shadows,
The rainpatters on leaves.
And there in the midst of all, thy wasted
Weary soul
Sings the same, the same, the same
Unchanging time.

বিলেত থেকে উপেন্দ্রকিশোরকে লেখা সুকুমারের একটা চিঠি থেকে জানা যায় Rothenstein এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি ইংরেজি অনুবাদের সুখ্যাতি করেছিলেন। দু-তিনজন প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছাপতে আগ্রহী ছিলেন এবং সুকুমার সেই উদ্দেশ্যে অনেকগুলো কবিতার অনুবাদও করেছিলেন।

একটা কথা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, রবীন্দ্রনাথ বেতারের নাম ‘আকাশবাণী’ দেবার আগেই সুকুমার ওই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। সন্দেশ পত্রিকায় ১৩২৯-এর ভাদ্র সংখ্যায় ‘বেতার’ নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘আকাশবাণীর কল’।

বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি সন্দেশ পত্রিকার কিছুটা ভার নিলেন। মজার মজার গল্প, কবিতা আর দারুণ দারুণ সব ছবি এঁকে একটা আলোড়নের সৃষ্টি করে ফেললেন তিনি। উপেন্দ্রকিশোর নিশ্চয়ই উপযুক্ত হাতেই সন্দেশ-এর দায়িত্ব পড়বে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

১৯১৪ সালে উপেন্দ্রকিশোর সুকুমারের বিয়ে দিলেন। পাত্রী ঢাকার মেয়ে। ঢাকার বিখ্যাত সমাজসেবক কালিনারায়ণ গুপ্তর নাতনি, নাম সুপ্রভা। তাঁর মাসতুতো ভাই ছিলেন লখনৌয়ের বিখ্যাত গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেন। সুপ্রভা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী, আর ভারী মিষ্টি ছিল তাঁর গানের গলা। আগেই বলা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সেই বিয়েতে এসেছিলেন।

ওই বছরই একশো নম্বর গড়পার রোডে তিনতলা বাড়িতে উঠে এলেন উপেন্দ্রকিশোর। সাদা রঙের বাড়ি, মাথায় পদ্মফুলের নকশা, পেছনের জমিতে ফল-ফুলের বাগান। উপেন্দ্রকিশোর মনের মতো করে বানিয়েছিলেন ওই তিনতলা বাড়ি।

উপেন্দ্রকিশোরের আরেক ভাই মুক্তিদারঞ্জন বড়ো ভাই সারদারঞ্জনের সঙ্গে থাকতেন। আমার এক নিকট আত্মীয়, অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক এবং পরে বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ মিহির কুমার সেনের মুখে শুনেছি, মুক্তিদারঞ্জন অঙ্কে পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ওই কলেজে অঙ্কের অধ্যাপনা করতেন। ছাত্রদের তিনি প্রাঞ্জলভাবে নানান নিয়মে অঙ্ক শেখাতেন। তিনি ছিলেন খুব স্নেহশীল। একবার কলেজের অধ্যাপকরা আবদার ধরেছিলেন তাঁদের খাওয়াতে হবে। সেটা ছিল পৌষ মাস। তিনি বাড়ি থেকে প্রায় এক-শো জনের মতো লোকের জন্য পায়েস, পিঠে বানিয়ে এনে কলেজের প্রোফেশার্স রুমে সহকর্মীদের পেট পুরে খাইয়েছিলেন। তিনি বেশ শক্তিধরও ছিলেন। কারও সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হলে জামার আস্তিন গুটিয়ে বলতেন, ‘পারবে তুমি আমার সঙ্গে?’ রীতিমতো ব্যায়ামচর্চা করতেন তিনি।

ছোটো ভাই প্রমদারঞ্জন সরকারি জরিপ বিভাগে কাজ করতেন, কর্মস্থল ছিল বিভিন্ন জায়গায়, শিলংয়েও ছিলেন। তাঁদের মা জয়তারা কিন্তু মসুয়া ছাড়েননি, স্বামী-শ্বশুরের ভিটে আগলে ছিলেন। ১৯২০ সালে বিরাশি বছর বয়সে সারাজীবন ময়মনসিংয়ে কাটিয়ে বড়ো ছেলে সারদারঞ্জনের কলকাতার বাড়িতে তিনি চোখ বুজেছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোরের যখন বাহান্ন বছর বয়স, তাঁর শরীরে ভাঙন ধরল। সন্দেশ-এর ভার তিনি দিলেন সুকুমার আর সুবিনয়ের উপর। আগেই বলা হয়েছে, সুবিনয়ও সুলেখক ছিলেন। তিনি প্রেসের কাজটাই বেশি দেখাশোনা করতেন, আর সুকুমার ভার নিলেন সন্দেশ সম্পাদনার।

১৯১৫ সালে ২০ ডিসেম্বর, তিপ্পান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোরের কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটল। মৃত্যুর আগেও তাঁর সৃজনীশক্তি থেমে থাকেনি। তাঁর শেষ দিনটাও রূপকথার গল্পের মতো। ভোরবেলা শোবার ঘরের জানালার সামনে একটা পাখি কয়েকবার ডেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল।

‘পাখিটা কি বলল, শুনলে?’ উপেন্দ্রকিশোরের পাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের তিনি বলেছিলেন, যেন ছোটোদের জন্য আরেকটা গল্প বলতে যাচ্ছেন, ‘বলল, পথ পা, পথ পা।’

১৯২১ সালে ২ মে সুপ্রভার কোল জুড়ে এল একটি ছেলে, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি, নাম রাখা হল সত্যজিৎ। শুনতে হয়তো মজা লাগবে, আজকের এই বিরাট পুরুষ জন্মেছিলেন খুব ছোট্টখাট্টো।

১৯২৩ সালে সত্যজিতের যখন দু-বছর বয়স, কালাজ্বরে ভুগে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে পরলোক গমন করলেন সুকুমার। ওই অল্প বয়সেই শিশুসাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেলেন ‘আবোল তাবোল’, ‘হ-য-ব-র-ল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘হেঁসোরাম হুঁসিয়ারের ডায়রি’ ইত্যাদি অসাধারণ কয়েকটি বই লিখে।

সুকুমারের অকালমৃত্যুতে সুবিনয়ের ঘাড়ে এসে পড়ল ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের সব ভার। কিন্তু ভাগ্য তখন বিরূপ। ওদিকে জমিদারি চলে গেল, এদিকে পাওনাদারদের তাগাদা। বিপদ যখন আসে সবদিক দিয়েই আসে, ছাপাখানা রক্ষা করা গেল না। তবু সন্দেশ পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় বিরাম ছিল না সুবিনয়ের। ১৯২৫ সালে সন্দেশ বন্ধ হয়ে যায়, তারপর আবার ১৯৩২ সালে যাঁরা ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কিনে নিয়েছিলেন, তাঁদের আর্থিক আনুকূল্যে সুবিনয় ওটা প্রকাশ করেছিলেন। বছর দুই চালিয়েছিলেন।

শৈশবের দিনগুলিতে, সত্যজিৎ
শৈশবের দিনগুলিতে, সত্যজিৎ

সন্দেশ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর সুবিনয় রায় ভারত সরকারের জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার চাকরি নিয়েছিলেন। সুবিনয় রায় কিন্তু লেখা ছাড়েননি। ছোটোদের নানান পত্রিকায় গল্প, ধাঁধা আর বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা লিখে চলেছিলেন। ১৯৪৫ সালে বাহান্ন বছর বয়সে তিনিও পরলোকগমন করলেন।

১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকাকে আবার বাঁচিয়ে তুললেন। তখন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ রায়। ১৯৬৪ থেকে লীলা মজুমদার আর সত্যজিৎ রায়ের সম্পাদনায় নতুন চিন্তাধারায় সন্দেশ প্রকাশিত হতে থাকে। নলিনী দাশের নাম তখনও পর্যন্ত সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সিংহভাগ কাজ কিন্তু তাঁকেই দেখতে হত এবং এখনও সেই ব্যবস্থা চলছে। ১৯৭৫ থেকে তাঁর নামও যুক্ত হল সম্পাদনার সঙ্গে।

সত্যজিতের ছোটো কাকা সুবিমল রায় কলকাতার সিটি কলেজ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিনি কিন্তু শিক্ষকতা ছাড়েননি। অবসর নেবার পর লেক টেম্পেল রোডের বাড়িতে সত্যজিতের সঙ্গে শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন। সত্যজিৎ তখন স্বাবলম্বী, সন্দেশ-কে আবার বাঁচিয়ে তুলেছেন। ছোটোকাকা সুবিমলও ওই পত্রিকায় লিখেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *