সত্যজিৎ ও জাঁ রেনোয়া

সত্যজিৎ ও জাঁ রেনোয়া

১৯৫০ সালে সত্যজিৎ রায় যখন ডি. জে. কীমার বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন তখন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়া ‘দি রিভার’ ছবির শুটিং তুলতে কলকাতা এসেছিলেন। ওটার লেখক রুমার গডডেনের [Rumer Godden] কাহিনির পটভূমিকা ছিল আমাদের এই পশ্চিমবাংলা।

সত্যজিৎ রায় তখন থেকেই চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছেন, ভালো ইংরেজি ছবি এলে দেখা চাই-ই। বিখ্যাত পরিচালকদের নাম তখন তাঁর নখদর্পণে। এই সুযোগ নষ্ট করার মানুষ ছিলেন না সত্যজিৎ। তিনি তখন সাধারণ একজন শিল্পী, রেনোয়ার মতো খ্যাতিমান একজনের সঙ্গে দেখা করব বললেই তো দেখা করা যায় না, যশ মানুষের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য ব্যুহ সৃষ্টি করে, সেটা ভেদ করা সহজ ব্যাপার নয়।

যাহোক সত্যজিৎ সাহসে ভর করে একদিন সন্ধ্যেবেলা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন আর আশ্চর্য, খুব সহজেই দেখা হয়ে গেল। সত্যজিৎ রায় নিজের পরিচয় দিলেন সিনে ক্লাবের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। সেই সাক্ষাৎকার ইংরেজি সিনেমা পত্রিকা সিকোয়েন্স-এ ছাপা হয়েছিল। চমৎকার একটি রচনা, যেমন ভাষার ঝঙ্কার তেমন সুললিত ভাবের প্রকাশ। তার যথাসম্ভব ভাবানুবাদ এখানে দেওয়া হল:

রেনোয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপেই তাঁকে এত নম্র আর বিনয়ী মনে হয়েছিল যে সত্যজিৎ যা যা প্রশ্ন তাঁকে করবেন মনে মনে ঠিক করে গিয়েছিলেন যেমন, কেন তিনি তাঁর ছবির জন্য ‘রিভার’-কেই বেছে নিলেন, হলিউডে ছবি তুলে তিনি আনন্দ পান কিনা, তিনি কি ফ্রান্সে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন, এসব প্রশ্ন না করে তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন, ভারতবর্ষ তাঁর কেমন লাগছে?

রেনোয়া চিন্তাশীলের মতোই জবাব দিয়েছিলেন, ‘এ দেশকে ভালোমতো জানবার পর এ প্রশ্নর জবাব দেব। আপাতত আমি শুধু কলকাতা শহরকে জানতে চেষ্টা করছি, আমার তো বেশ ভালো লাগছে।’ দু-তিনবার কলকাতা শহর এবং গঙ্গার বুকে তিনি ঘুরেছেন, সে সম্বন্ধে অনেক কিছুই তাঁর বলবার ছিল। গঙ্গা নদীতে সেই সাবেকি আমলের নৌকো তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, নতুন যা কিছু দেখেছেন সবই অবাক করেছে তাঁকে। ‘বুঝলেন’, তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হয় ভারতবর্ষ আদিম যুগের সৌন্দর্য এবং সরলতা এখনও ধরে রেখেছে। যেভাবে মাঝিরা দাঁড় টানে, কৃষক জমি চাষ করে, মেয়েরা কুয়ো থেকে জল তোলে, তা প্রাচীন মিশরের দেয়ালচিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।’

এক উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে রেনোয়ার দেখা হয়েছিল। তারা পাকিস্তান [এখন বাংলাদেশ] থেকে সারাটা পথ এসেছিল নৌকোয়। পথে অবিশ্বাস্য সব রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছিল। রেনোয়া বলেছিলেন তাঁর বিশ্বাস ওদের কাহিনি নিয়ে সুন্দর ছবি করা যায়। সত্যজিৎ জবাব দিয়েছিলেন ছবি করার মতো অমন ঘটনা ভারতবর্ষে ছড়াছড়ি।

‘নিশ্চয়ই সেসব নিয়ে ছবি হবে,’ শিশুর সারল্যে বলেছিলেন রেনোয়া।

‘না,’ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘ভারতীয় চলচ্চিত্রের পরিচালকরা চারপাশের বাস্তব ঘটনার চাইতে হলিউডের চোখ ঝলসানো ছবিই পছন্দ করেন বেশি।’

‘ওহ, আমেরিকার ছবি…’, রেনোয়া সখেদে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘আমি জানি ওদের প্রভাব খুব খারাপ।’

.

সত্যজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরেই ক্যালকাটা ফিলম সোসাইটি রেনোয়াকে এক সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেখানে নানারকম প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল তাঁকে। ভাঙা ভাঙা মিষ্টি ইংরেজিতে অথচ বেশ স্বচ্ছন্দের সঙ্গে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন তিনি। ‘রিভার’ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, দি নিউ ইয়র্কার-এ ওই উপন্যাসটির সমালোচনা তাঁর চোখে পড়েছিল। ওই পত্রিকায় কাহিনির যে সারাংশ বেরিয়েছিল তাতে তাঁর মনে হয়েছিল ওটায় ভালো ছবি করার উপাদান আছে। উপন্যাসটা পড়ে সেই ধারণা আরও তাঁর বদ্ধমূল হয়েছিল, তখুনি ওটা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।

সত্যজিৎ ওই উপন্যাসটি পড়েননি, বিষয়বস্তু সম্বন্ধেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না, শুধু জানতেন বাংলার কোনো নদী (সম্ভবত গঙ্গা) নিয়ে ওই ছবির কাহিনি। হলিউড থেকে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যা ছবি তোলা হয় তা সব বিকৃত রুচির। তাই রেনোয়ার মতো একজন বিখ্যাত পরিচালক ভারতবর্ষের আসল রূপটা ছবিতে তুলে ধরবেন এই আশায় সত্যজিৎ উৎফুল্ল হয়েছিলেন। কিন্তু রেনোয়া যখন জানালেন শুধুমাত্র আমেরিকার দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্যই ‘রিভার’ ছবি তোলা হচ্ছে, ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের তেমন পরিচয় ওতে আশা করা উচিত হবে না এবং ছবিতে একটি মাত্র ভারতীয় চরিত্র থাকবে, তাও এক ইউরোপিয়ান পরিবারের ভৃত্যের চরিত্র,১১ তখন সত্যজিৎ হতাশ হয়েছিলেন। অবিশ্যি পটভূমিকা হবে ভারতীয়, যেহেতু শুটিং হবে কলকাতায়। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঠিক বিবরণ বা পটভূমিকার জন্য সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ছুটে আসা সত্যজিতের কাছে একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল।

ইউরোপের নামি চলচ্চিত্র পরিচালকরা হলিউডে কাজ করতে গেলে কি অসুবিধের মুখোমুখি তাঁদের হতে হয় এ প্রশ্নের জবাবে রেনোয়া বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় সব ব্যাপারেই যে উন্মাদনা বা বাতিক সেটাই ইউরোপের চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছে হতাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ওদের সেই বাতিকগ্রস্ত ব্যাপারটা চোখে না দেখা পর্যন্ত ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। ধরুন আপনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, আপনি কোথাও যেতে চান। আপনি ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে গেলেন। কিন্তু আপনি কি দেখবেন? দেখবেন ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে স্টেশনে এসেছে। এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার। ফ্রান্সে ট্রেন ঘড়ি ধরে চলে না। এমন নিষ্ঠায় আপনি অভ্যস্ত নন, ফলে আপনি অস্বস্তি বোধ করবেন। তারপর আপনি স্টুডিয়োতে কাজ করতে গেলেন। আপনি ফ্লোরে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনি কি দেখবেন? দেখবেন আপনাকে সময়সূচি মেনে চলতে হবে, এতটুকু নড়চড় হবার যো নেই। তারপর ওরা তদারকি শুরু করবে। ওরা ছবির শব্দ মিলিয়ে দেখবে, একবার নয়— ডাবল চেক করবে যাতে শব্দের সঠিক প্রয়োগ পাওয়া যায়। ওরা আলোর ব্যবস্থাও অমন মিলিয়ে নেবে, সেটাও ভালো। কিন্তু তারপর ওরা পরিচালকের অনুপ্রেরণা ডাবল চেক করবে— সেটা তেমন ভালো ব্যাপার নয়।’

রেনোয়ার মতে কতকগুলো পরিবর্তনাতীত ব্যাপারই হলিউডে সাধু সংকল্পের প্রধান অন্তরায়। এই প্রসঙ্গে তিনি তারকাপ্রথা, সেন্সরের অসংখ্য আচরণবিধি এবং সিনেমাকে পণ্যদ্রব্যের মতো গণসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতার কথা উল্লেখ করেন। দৈবাৎ যদি কোনো ভাগ্যবান পরিচালক একটি খাঁটি গল্প, তাতে অভিনয় করার মতো উপযুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী [তারকা নয়] এবং কাহিনি চিত্রায়িত করার মতো শিল্পগত স্বাধীনতার সুযোগ পান, তবেই একটা উল্লেখযোগ্য ছবি হতে পারে। একমাত্র ‘সাদার্নার’ [Southerner] ছবি করার সময় তিনি হলিউডে অমন আদর্শ পরিবেশে কাজ করতে পেরেছিলেন।

রেনোয়া এটাও বিশ্বাস করেন যে, দেশের সঙ্কটের সময়েই সবচেয়ে ভালো ছবি তৈরি হয়, আত্মতুষ্টির মনোভাব চলচ্চিত্রের পক্ষে ভালো নয়। ‘যুদ্ধের ফলে ইতালিয়ান ছবির কথা ভাবুন,’ তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিফ এনকাউন্টারের কথা মনে করুন। বিমান আক্রমণে লন্ডনের ওই দুর্দশা না হলে অমন ভালো ছবি তৈরি হত বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয় হলিউডে এখন যা দরকার তা হল বেশ ভালোমতো বোমাবর্ষণ।’

.

‘ওই ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে দেখুন,’ প্রস্ফুটিত এক পলাশগাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে রেনোয়া বলেছিলেন। লোকেশনের সন্ধানে কয়েকবারই তাঁর সঙ্গী হবার যে সৌভাগ্য সত্যজিতের হয়েছিল, সেটা তার প্রথম। ‘ওই ফুলগুলি,’ রেনোয়া বলেছিলেন, ‘ভারি সুন্দর। কিন্তু আমেরিকাতেও আপনি ফুল দেখবেন। যেমন পয়েনসেটিয়া। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচুর ওই ফুল ফোটে। কিন্তু সবুজ পুকুরের পাড়ে ওই কলাগাছের ঝাড়, এটা আপনি ক্যালিফোর্নিয়ায় পাবেন না। এই হচ্ছে বাংলাদেশ।’

লোকেশনের জন্য তিনি তেমন একটা জায়গা খুঁজছিলেন যেখানকার দৃশ্যে এমন সব মৌলিক উপাদান থাকবে যা ছবির পক্ষে শুধু উপযোগীই হয়ে উঠবে না এ দেশের আসল রূপটাও ফুটে উঠবে সেই সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, ছবিতে অনেক কিছুই দেখানো যায় না, কিন্তু সঠিক দৃশ্যটি যাতে দেখানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

ওই বয়স আর অমন ভারী চেহারা সত্ত্বেও রেনোয়ার উৎসাহ এবং শক্তি বিস্ময়কর। সঠিক দৃশ্যের ছবির জন্য সঠিক লোকেশনের খোঁজে মাইলের পর মাইল খারাপ পথে তিনি অনায়াসে হাঁটছেন। মাঝে মাঝে কাজের মধ্যে তিনি এত তন্ময় হয়ে যেতেন যে, তাঁর স্ত্রী ধমক দিয়ে বলতেন, ‘অতক্ষণ তোমার রোদে থাকা উচিত নয়,’ কিংবা ‘জাঁ, তুমি নিশ্চয়ই ছটার সময় অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা ভুলে যাওনি!’

ওইসব সফরের সময় রেনোয়া নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁর যৌবনের কথা, বাবার কথা, গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে মহান আন্দোলনকারীদের কথা, সিনেমা ছাড়া যার প্রতি তাঁর গভীর আসক্তি সেই মৃৎশিল্পের কথা এবং অবিশ্যিই সিনেমার কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। হাসপাতালে যখন তিনি আরোগ্যের পথে তখনই চলচ্চিত্রকে জীবিকা করার কথা প্রথম তাঁর মাথায় আসে, অবশ্যি সত্যিকার হাতেখড়ি আরও পরের ঘটনা, সেটা ঘটেছিল কিছুকাল সাংবাদিকতা করার পর। ফরাসি দেশের নির্বাক যুগের ব্যবসায়িক চলচ্চিত্রকে সামগ্রিকভাবে নিশ্চল এবং নিষ্ফল বলে উল্লেখ করেছিলেন রেনোয়া। শব্দের প্রবর্তনের পর হঠাৎ যেন যাদুমন্ত্রবলে একটা পরিবর্তন সূচিত হল। রেনোয়া সে সম্বন্ধে বলেছেন ‘এ যেন কেউ চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং দর্শকদের মাঝখানে আনাগোনার যে গুপ্ত দরজা সেটা খুলে দিয়েছিল। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমরা যাই করেছিলাম, দর্শক তা উপলব্ধি করেছিল। এমন বোদ্ধা দর্শক না পেলে ফরাসি চলচ্চিত্র কখনোই পূর্ণতার দিকে এত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারত না। ওঁরা (দর্শক) আমাদের খুব সাহায্য করেছেন এবং আমি অন্তত তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

জার্মানরা যতদিন ফ্রান্স দখল করেছিল ততদিন ফরাসি চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলা যায়, তারপর কলাকৌশলের বা প্রযুক্তিবিদ্যার গুণগত বিচারে কোনো ঘাটতি না হলেও বিষয়বস্তুর দিক থেকে নিশ্চয়ই অবনতি ঘটেছিল।

নিজের গোড়ার দিকের ছবির মধ্যে রেনোয়া La Chienne-কে তাঁর অন্যতম প্রিয় ছবি বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা দুঃখের বিষয় যে ছবিটাকে দ্বিতীয়বার অত খারাপ করে তৈরি করতে হয়েছিল। [ওই দ্বিতীয় সংস্করণ পরিচালনা করেছিলেন ফ্রিজ ল্যাঙ এবং নাম দিয়েছিলেন ‘স্কারলেট স্ট্রিট’]। তিরিশ দশকের শেষের দিকে শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে La Regle du Jeu ছিল রেনোয়ার বিশেষ আদরের কারণ ওটা ছিল সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। এমনকি ওটাতে তিনি একটা ভূমিকায় অভিনয় পর্যন্ত করেছিলেন। রেনোয়া নাকি ছোটো গল্পের ছবি করার ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। বাণিজ্যিক সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবার জন্য এমন দুটো ছবি করার কথাও হয়েছিল, রেনোয়া মোপাশাঁর গল্পের ওপর কাজ শুরু করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন ওটা শেষ করে দ্বিতীয়টা ধরবেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ছবিটা পরিসমাপ্তির আগেই পরিত্যক্ত হয়েছিল। দখলকারী জার্মান সৈন্যরা যতদিন ফ্রান্সে ছিল রেনোয়ার এক বন্ধু নেগেটিভগুলো নাৎসিদের হাতে পড়ে নষ্ট না হয় তাই লুকিয়ে রেখেছিলেন। দেশ থেকে বিদেশি সৈন্য সরে যাবার পরই ওগুলো প্রিন্ট করা হয়েছিল এবং মুক্তিলাভ করেছিল ছবি— বর্ণনার মধ্যে যে ফাঁক বা অসংলগ্নতা থেকে গেছিল তা পূরণ করা হয়েছিল উপযুক্ত টীকা দিয়ে।

রেনোয়া নিজে কিন্তু ওই ছবিটা [Partie de campagne] তখনও পর্যন্ত দেখেননি কারণ জার্মান সৈন্যরা যেদিন প্যারিসে ঢুকেছিল, সেদিনই তিনি একটা ছোটো সুটকেশে যা কিছু সম্ভব ভরে নিয়ে প্যারিসকে বিদায় জানিয়েছিলেন।

.

প্যারি থেকে হলিউড। নতুন জায়গায় গুছিয়ে বসার অপরিহার্য অসুবিধে ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার জীবন মোটামুটি ভালোই লেগেছিল। মনোরম আবহাওয়া, চমৎকার বন্ধুও পেয়েছিলেন। আলোকচ্ছটার মতো উদ্ভাসিত যাঁর নাম, সেই চ্যাপলিন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। রেনোয়া তাঁর জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। ‘চ্যাপলিন এখন বিষণ্ণ এক মানুষ,’ রেনোয়া বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় কেউ তাঁকে বুঝল না।’ চ্যাপলিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বন্ধে রেনোয়া বললেন, ‘শেষবার তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তিনি সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের নিয়ে সংগীতমুখর একটা ব্যঙ্গাত্মক ছবির কথা চিন্তা করছিলেন। তবে আমার মনে হয়না তিনি তা করবেন, কেননা কাউকে অসন্তুষ্ট না করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন, আবার তাছাড়া খাঁটি ছবি তোলা যায় না।’

হলিউডে যে পাঁচটা ছবি তিনি করেছেন, তার মধ্যে ‘দি ডায়েরি অফ এ চেম্বারমেড’ অথবা ‘সোয়াম্প ওয়াটার’ সম্বন্ধে তিনি কিছুই বললেন না। আমেরিকায় সে সময় এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যেন ইউরোপে প্রতিরোধ আন্দোলন একটি অবাস্তব কাহিনি মাত্র, তারই জবাবে তিনি ‘দিস ল্যান্ড ইজ মাইন’ ছবিটা করেছিলেন, তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন অধিকৃত একটি দেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তি আন্দোলনে সহযোগী। ‘দি সাদার্নার’ ছবিটা করে তিনি খুব তৃপ্তি পেয়েছিলেন কারণ আমেরিকা এবং ওখানকার মানুষের একটা খাঁটি চিত্র তিনি তাতে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে ওটাই আমেরিকায় তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি।

‘দি ওম্যান অন দি বীচ’ ছবিটা একটা দুর্ঘটনা বলেই মনে করেন রেনোয়া। গোড়ার দিকে যা তাঁকে আকষ্ট করেছিল তা হল ওই কাহিনির প্রধান রমণীর চরিত্র, যার জীবনের মূলকথাই ছিল ভালোবাসা। পরে ছবি করতে গিয়ে তিনি বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বুঝতে পারলেন ওই চরিত্রটির বিকাশ যেভাবে দেখানোর দরকার তাতে তাঁর রীতিনীতি সায় দিচ্ছে না। ফলে যেসব দৃশ্যে খুব আবেগপূর্ণ পরিবেশ হওয়া উচিত ছিল, সেখানে তিনি কৌশলে পরিস্থিতি এড়িয়ে মেকী এবং প্রযুক্তিবিদ্যার ঝকমকিতে সস্তায় বাহবা কুড়োবার পন্থা গ্রহণ করেছিলেন।

রেনোয়ার মতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কবোধের গভীর আবেগের মতো মূল্যবান আর কিছু চলচ্চিত্রে নেই। এই অখণ্ডতা বা বিশ্বস্ততাকে কার্যকরী করার জন্যেই প্রযুক্তিবিদ্যার উপকারিতা ও প্রয়োজন। তার বাইরে ওটা প্রায় অনধিকার প্রবেশের অপরাধে অপরাধী এবং সেইসঙ্গে নিজেকে জাহির করার দোষে দুষ্ট। ‘আমেরিকায়’, রেনোয়া বলেছিলেন, ‘ওঁরা কলাকৌশল নিয়েই বেশি চিন্তা করে, মানবিকবোধটা তাই অবহেলিত থেকে যায়।’

আমেরিকায় সাম্প্রতিক বাস্তবধর্মী ছবির প্রবণতা সম্বন্ধে রেনোয়ার কি ধারণা, সত্যজিতের এই প্রশ্নের জবাবে রেনোয়া বলেছিলেন, ‘নতুন কিছু নয়।’ তিনি আরও বলেছিলেন তাঁর ছবি La Bete Humaine-এর বেশির ভাগ শ্যুটিংই তিনি করেছিলেন Le Havre লোকেশনে। সাদার্নারের [অথবা ‘সাউদার্নার’] জন্য খুব কম সেটই তিনি বানিয়েছিলেন, কিন্তু তাই বলে এ ব্যাপারে তিনি মোটেই গোঁড়া নন। ‘আমি মনে করি সময়ে সময়ে একটা সেট খুব কাজে লাগে। তবে লোকে যদি বাস্তবানুরাগ আচরণ না করে তবে বাস্তবের পটভূমিকায় ছবি করার মানে হয় না। অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করবার কথা আমিও শুনেছি। ওটা ঠিক আমার মাথায় ঢোকে না। অপেশাদার একজন অভিনেতা র‌্যামু (Raimu) বা গ্যাবিনের (Gabin) স্থান নিতে পারে এমন কথা কি চিন্তা করতে পারেন? আমি তো পারি না। ব্যক্তিগতভাবে পেশাদারি বৃত্তি সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।’

তাঁর ব্যাপক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও রেনোয়া কিন্তু চারুকলার ব্যাপারে তাঁর মতবাদে আশ্চর্যরকম মুক্ত পুরুষ। সুন্দরভাবে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন ‘প্রতিবার আমি যখন নতুন ছবি তুলি, বাচ্চা ছেলের মতো গোড়া থেকে আমি চলচ্চিত্র সম্বন্ধে শিখতে চাই।’

.

ইউরোপ যাত্রার আগের দিন সত্যজিৎ হোটেলে রেনোয়ার সঙ্গে আরেকবার দেখা করেছিলেন। তিনি এক ট্রাঙ্ক বোঝাই স্মারকচিহ্ন নিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছু তাঁর মুগ্ধ ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া। কিছু নিজে তিনি বাজার এবং দুর্লভ জিনিসপত্রের দোকান থেকে কিনেছিলেন। কলকাতায় চার সপ্তাহ অবস্থানের মধ্যে তিনি অনেক ঘুরেছেন, দেখেছেন এবং চিন্তা করেছেন। পশ্চিমবাংলা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। একদিকে মনোরম ভূদৃশ্যের অভিনবত্ব অন্যদিকে নোংরা ও সাধারণ মানুষের দুর্দশা আর দারিদ্র্য। সামান্য কুঁড়েঘর দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন, আবার এক ভিখিরিকে দেখে বেদনাহত হয়েছেন। একটা কয়লাখনি দেখে তাঁর মনে এত গভীর নাড়া দিয়েছিল যে কয়েকদিন ধরে তিনি শুধু ওটার কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি তোমাদের মন থেকে হলিউডকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের স্টাইল বা ঢঙ উন্নত করবার চেষ্টা করো তবে এখানেই দারুণ দারুণ ছবি করতে পারবে।’

নভেম্বর মাসে ইউনিটের লোকজন নিয়ে আবার তাঁর কলকাতায় আসার কথা। ভারতে আউটডোর শুটিংয়ের পক্ষে ওটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়। অবিশ্যি চিত্রনাট্য আবার নতুন করে লিখতে হবে। ‘এবার আমি যখন লন্ডন যাব, লেখক রুমার গডেনের সঙ্গে বসে কাহিনি নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা করব,’ রেনোয়া বলেছিলেন। ‘আমি গল্পের খানিকটা অদলবদল করতে পারি, হয়তো কিছু নতুন চরিত্রও যোগ করতে পারি। ভারতীয়দের জীবনযাত্রা আর রেড ইন্ডিয়ানদের জীবনযাত্রার মধ্যে যে ফারাক তা দেখাবার জন্য এক ভারতীয় পরিবারকেও আনতে পারি ছবিতে।’ পরিকল্পনাটা ভালোই মনে হয়েছিল সত্যজিতের।

‘সেই সন্ধ্যেয় আমি যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম,’ সত্যজিৎ রায় তাঁর চমৎকার রচনাটির ছেদ টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল রেনোয়ার মধ্যে সৃষ্টির সক্রিয়তা এখনও যথেষ্ট অটুট আছে। হয়তো হলিউডে যাবতীয় ব্যর্থতার উপর ”দি রিভার” এক নতুন এবং প্রাণবন্ত যুগের সূচনা করবে।’

‘এখন যেহেতু তিনি আমেরিকার নাগরিক, প্যারিসে তাঁর ফেরবার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে যেটা খুব দরকার তা হল হলিউডের মেকি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসা এবং সে ব্যাপারে ভারতবর্ষ এক ভালো আশ্রয় সন্দেহ নেই। রেনোয়া এখানে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেন। তাঁকে বিক্ষিপ্ত করার মতো এখানে কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকবে না, পরিচালকের অনুপ্রেরণার তদারকি এবং ডবল চেকিংয়ের কোনো ব্যাপারই থাকবে না, আর অবিশ্যিই এখানে নির্দিষ্ট সময় ধরে চলবেই না রেলগাড়ি।’

***

১১. ‘একটি মাত্র ভারতীয় চরিত্র থাকে, তাও এক ইউরোপিয়ান পরিবারের ভৃত্যের চরিত্র’ জাঁ রেনোয়া পরিচালিত ‘দ্য রিভার’ (১৯৫১) ছবিতে ভারতীয় পরিচারিকার ভূমিকায় অভিনয় করেন সেকালের অন্যতম খ্যাতনামা অভিনেত্রী সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জাঁ রেনোয়ার এই ছবিতে শিক্ষানবিশের মতোই শুটিং-এর প্রাথমিক অভিজ্ঞতার হাতেখড়ি হয়েছিল সত্যজিৎ ও পরবর্তীকালে তাঁর ছবির অন্য দুই প্রধান স্থপতি শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও আলোকচিত্রী সুব্রত মিত্রের। ‘দ্য রিভার’ ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন আরেকজন প্রখ্যাত ভারতীয় আলোকচিত্রী রামানন্দ সেনগুপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *