মানুষ সত্যজিৎ
সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছ থেকে দেখবার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে তাই মানুষ হিসাবে তাঁকে জানবার সুযোগও আমি পেয়েছি। কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আমি তাঁর মনের প্রসারতা আর মানবিকবোধের দিকটা তুলে ধরবার চেষ্টা করছি।
আগেই বলেছি, কি সিনেমা, কি লেখা, সবকিছুতেই তিনি ভীষণ খুঁতখুঁতে যাতে সামান্য ভুল ত্রুটিও না থাকে। তিনি ওটাকে বলতেন ‘টেকনিক্যাল ভুল’, এমনকি গল্পের বেলাতেও। আমার নিজের একাধিক লেখা এই কারণে বাতিল হয়েছে। একদিন ওঁর ঘরে বসে গল্প করছি। সেদিন ছিল কালীপুজো। সন্ধ্যের পর গিয়েছিলাম। চারদিকে বোমা আর আতসবাজির শব্দ। আমার সঙ্গে আমার লেখক বন্ধু শিশির কুমার মজুমদার ছিলেন। আমাদের দেখে তিনি বললেন, ‘কি, যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে এলে?’
রসিক মানুষ বলেই ও কথাটা প্রথমেই তাঁর মনে এসেছিল। কালীপুজোর সন্ধ্যায় কলকাতা শহর সত্যিই যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র।
কথায় কথায় বলে ফেললাম, ‘মানিকদা, আপনি আমাদের গল্পে টেকনিক্যাল ভুল ধরেন, এবার শারদীয় সংখ্যায় আপনার উপন্যাসে কিন্তু একটা টেকনিক্যাল ভুল আছে।’
কথাটা আমার মুখ ফসকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল আমার এ ধরনের মন্তব্য করা উচিত হয়নি, উনি হয়তো খুব রেগে যাবেন।
উনি কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম?’
আমার যা মনে হয়েছিল তা বললাম। উনি একটুও অপ্রসন্ন হলেন না, বরং কাহিনির ওই জায়গায় কী বলতে চেয়েছিলেন তা আমাকে বুঝিয়ে বললেন।
সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন মানুষের মুখের ওপর ওভাবে বলাটা আমার উচিত হয়নি, কিন্তু তিনি আমার দোষ না ধরে ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। অন্য কোনো নামি লেখকের মুখের ওপর অমন কথা যদি আমি বলতাম, তবে হয়তো চিরদিনের মতো তাঁর বাড়ির দরজা আমার কাছে বন্ধ হয়ে যেত। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের মনের প্রসারতা। আমার মতো নগণ্য এক লেখকের মন্তব্যে এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ না করে স্নেহশীল মনের একটা দিক প্রকাশ করলেন।
আরেকবার আমার একটি গল্প ফেরত দিয়ে তিনি বলেছিলেন গল্পে ‘ফুটনোট’ খুবই বিরক্তিকর। আমার ওই গল্পে একটা ‘ফুটনোট’ ছিল। কিছুদিন পর তাঁর বাড়ি গিয়েছি। তখন ‘অশনি সংকেত’ সবে মুক্তি পেয়েছে। ছবিটা আমার দেখা ছিল। চমৎকার ছবি। ছবির শেষে পর্দায় ফুটে উঠেছিল একটা লাইন, বিয়াল্লিশের মন্বন্তরে বাংলাদেশে… লক্ষ লোক অনাহারে মারা গিয়েছিল।
কথা প্রসঙ্গে আমি বললাম, ‘মানিকদা, আপনি আমার একটা গল্প সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন ”ফুটনোট” বিরক্তিকর। ”অশনিসংকেত” ছবির শেষে পর্দায় ওই লাইনটাও তো একটা ”ফুটনোট”। উনি হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। আমার রসিকতা উনি উপভোগ করেছিলেন। যাঁর মধ্যে রসবোধ আছে তিনিই রস গ্রহণ করতে পারেন, অন্যের কাছে তা পাঁচনের মতো তেতো হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার আমার কথায় আমোদ বোধ করেছিলেন। এখানেই সত্যজিতের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। একটু নাম করেছেন এমন কোনো চলচ্চিত্রকারের কোনো ছবি সম্বন্ধে অমন মন্তব্য করলে তিনি হয়তো আমাকে মারতে উঠতেন।
সত্যজিৎ রায়ের মানবিকবোধের দিকটা তুলে না ধরলে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার এক লেখক বন্ধু, যিনি সন্দেশ পত্রিকার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ, তাঁর মুখেই এ ঘটনা শুনেছি। আমার বন্ধুর এক সহকর্মীর ছেলে নকশাল আন্দোলনের সময় ধরা পড়েছিল। প্রচণ্ড নির্যাতনে সে প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে, তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম। ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো। ছেলেকে বাঁচাবার আর কোনো উপায় না দেখে ছেলের বাবা আমার বন্ধুকে ধরলেন, সত্যজিৎ রায়কে বলে যদি কিছু করা যায়। আমার বন্ধু একদিন সুবিধেমতো সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছিলেন। সব শুনে সত্যজিৎ রায়ের কোমল মন বিগলিত হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘তাই তো, ছেলেটির জন্য কিছু করা উচিত।’
ক-জন এমনভাবে বলে। পরের ব্যাপার আমরা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করি। সত্যজিৎ রায় শুধু মৌখিক সহানুভূতিই প্রকাশ করেননি, ওপরমহলে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন এবং তার ফলেই ছেলেটি সাড়া পেয়েছিল। আজ সে সুস্থ জীবনযাপন করছে, চাকরিও করছে। সত্যজিৎ রায় সেদিন হস্তক্ষেপ না করলে ওই তরুণের জীবন হয়তো আরও অনেকের মতো অন্ধকারেই হারিয়ে যেত। সত্যজিৎ রায়ের মানবিকবোধের প্রমাণ এর চাইতে আর বেশি কী হতে পারে!
.
মানুষ সত্যজিৎ সম্বন্ধে বলতে গেলে এমন ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, তবে আমার নিজের ধারণা তার দরকার নেই। আমি কিন্তু একথা বলছি না যে তাঁর কোনো দোষ নেই, তিনিও তো রক্তমাংসের মানুষ, দোষ ত্রুটি থাকবে না কেন? কিন্তু তাঁর গুণ সব দোষ ছাপিয়ে তাঁকে বড়ো করেছে।
একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখি। উনি আমাদের সঙ্গে সবসময় মন খুলে কথা বলতেন, সে সিনেমা সম্বন্ধেই হোক কিংবা লেখার ব্যাপারেই হোক। ডিটেলস আলোচনা। এক ছুটির দিন ঘরে লোক বেশি ছিল না, উনি ছাড়া আমরা জনা তিনেক। সিনেমা সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। কথায় কথায় বোধ হয় ‘স্টার ওয়ার’ কিংবা ওই জাতীয় ছবির প্রসঙ্গ উঠল। উনি তার কিছুদিন আগেই আমেরিকা ঘুরে এসেছেন। ওখানে দেখা অমন একটা ছবির গল্প তিনি বললেন, এমন সুন্দর সহজভাবে বললেন যে, দেখতে দেখতে কত সময় যে কেটে গেল তার হুঁশই ছিল না আমাদের কারও। যেমন লিখতে পারেন, তেমন চমৎকার গল্প বলতেও পারেন মুখে মুখে।
কথাবার্তার সময় তাঁর মনের দরজা তিনি খুলে দেন। সন্দেশ পত্রিকায় আমার একটা অনুবাদ বেরিয়েছিল, নাম ‘টোরাকের সন্ধানে’। একদিন ওঁর বাড়ি যেতেই বললেন, ‘তোমার ওই অনুবাদটা খুব ভালো হয়েছে।’ ওঁর মুখ থেকে ওই সামান্য কথাটা সেদিন আমার কাছে অসামান্য মনে হয়েছিল। শুধু আমার নয়, ভালো লেখা হলেই তিনি সে কথা বলতেন। অথচ অনেক ছোটো পত্রিকার সম্পাদকও মুখ ফুটে প্রশংসা করা দূরের কথা, ‘ভালো’ শব্দটা উচ্চারণ করতেও যেন তাঁদের সম্মানে বাধে।
আমাদের কথাও উনি মন দিয়ে শুনতেন, আমাদের মতামত জিজ্ঞেস করতেন, আমাদের যুক্তি বাস্তবসম্মত হলে গ্রহণ করতে দ্বিধা করতেন না। বড়ো মন না হলে তা কি সম্ভব! এরকম খোলা মনের মানুষের দেখা সচরাচর মেলে না। আগেই বলেছি, রেনোয়া যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের, কিন্তু ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না, অমন বিখ্যাত মানুষ তাঁর মতো অখ্যাত একজনের সঙ্গে দেখা করবেন কি! যশ মানুষের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা করে, সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশে অনেক বাধা। তবু সত্যজিৎ রায় গিয়েছিলেন এবং অবাক হয়ে দেখেছিলেন রেনোয়ার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর কোনো বেগ পেতে হয় নি।
সত্যজিতের জীবনেও তাই। যশ তাঁর মাথায়, চারপাশে কংক্রিটের দেওয়ালে ঘেরা নয়। সবার তাঁর কাছে অবারিত দ্বার। যে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন, যতটা সম্ভব সবার চিঠির জবাব দেবার তিনি চেষ্টা করতেন। সত্যিকার গুণী কিংবা প্রতিভাধর মানুষ বোধ হয় এমন খোলা মন নিয়েই জন্মান, বিশ্ববরেণ্য এমন একজন মানুষের সঙ্গে একটু নাম করেছেন এমন একজনের আচরণ, ব্যবহারে যেন আকাশপাতাল তফাৎ। সত্যজিৎ রায় প্রতিভা নিয়েই জন্মেছেন, প্রতিভা তাঁর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নি। এ বইটা লেখার ব্যাপারে তাঁর কাছে কিছু তথ্যের জন্য গিয়েছিলাম। প্রথমেই বললেন, ‘তুমি আবার আমাকে নিয়ে পড়লে কেন?’ পারিবারিক ছবির কথা তুলতে তিনি ঠাট্টা করে বললেন, ‘কেউ যে জীবনী লিখবে তা তো কখনো ভাবিনি, তাই ওসব ছবি তুলে রাখিনি।’ রসিক মানুষ। আমি যখন চলে আসছি, তিনি আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। ভাবা যায়! চিন্তা করা যায়! বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত ব্যক্তি, আমার মতো সামান্য একজনকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছেন। এটা হল আভিজাত্যের নিদর্শন, একেই বোধ হয় বলে গ্রেটনেস।
.
এমনকি যখন ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন তাঁর ঘরের দরজার বাইরে কাজে ব্যাঘাত না করার জন্য যে নোটিশ টাঙানো থাকে, সেটাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সহজ, সরল, দরদী এক মানুষ। অহমিকা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, তাই তিনি এত বড়ো হতে পেরেছেন, তাই তিনি সত্যজিৎ রায়, আমাদের পরম শ্রদ্ধার মানিকদা।
.
প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এবং ভারতীয় ছায়াছবি জগতের বিশিষ্ট পুরুষ হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়২৩ ৯ মার্চ ১৯৮৬, নন্দন প্রেক্ষাগৃহে এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় আমি কি সত্যজিৎ রায়ের মতো ছবি করতে পারব!’
সত্যজিতের প্রতি এ যে কত বড়ো শ্রদ্ধার্ঘ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ হিসাবে যদি সত্যজিৎ রায় বড়ো না হতেন তবে শুধু তাঁর শিল্পকর্মের জন্য এত বড়ো প্রশংসা অমন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কখনোই প্রকাশ পেতনা।
.
নন্দন প্রেক্ষাগৃহে সন্দেশ পত্রিকার রজত জয়ন্তী উৎসবের সমাপ্তি দিনে (১৮ মে ১৯৮৬) একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সত্যজিৎ রায় এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক মঞ্চের ওপর বসেছিলেন, বক্তৃতা হচ্ছিল। এক সুন্দরী সাহসিকা কিশোরী সবার অলক্ষ্যে ডায়াসে উঠে পড়েছিল, হাতে তার ক্যামেরা। তার টার্গেট স্বভাবতই সত্যজিৎ রায়। নানান অ্যাংগেল থেকে সে তার স্বপ্নের মানুষটিকে ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইছিল, কিন্তু যতবারই সে শাটার টেপে ক্লিক আর হয় না। এদিকে অন্যরা বিরক্ত হচ্ছিলেন। মেয়েটি অপ্রতিভ, ফরসা মুখ লাল। সত্যজিৎ কিন্তু ব্যাপারটা উপভোগ করছিলেন। হঠাৎ মেয়েটি একটা কাণ্ডই করে বসল। নীরবে ক্যামেরাটা সত্যজিৎ রায়ের হাতে তুলে দিল। অতবড় যিনি ক্যামেরাম্যান, তিনি কি আর তার ছোটো ক্যামেরাটা ঠিক করে দিতে পারবেন না। তার নীরব আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, ক্যামেরা নিয়ে কি একটু করলেন, ব্যস চালু হয়ে গেল। মেয়েটি সকৃতজ্ঞচিত্তে এবং মনের আনন্দে বিখ্যাত মানুষটির ছবি তুলল। এই হলেন সত্যজিৎ। সহজ, সরল, আমুদে এক মানুষ।
.
১৯৫৮ সালে ব্রুসেলসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অন্যতম বিচারপতির আসন অলংকৃত করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
ওটাই তাঁর বিচারকের প্রথম সম্মান। কিন্তু ব্রুসেলসে যখন তিনি পৌঁছুলেন তখন তাঁর সপ্রতিভ আচরণ থেকে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিনি আগে কখনো বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন না। সাংবাদিকদের কাছে তিনি সকৌতুকে মন্তব্য করেছিলেন তিনি যদি ইচ্ছে না করেন তবে ভোট দেবেন না এই শর্তে বিচারকের আসনে বসতে তিনি রাজি হয়েছেন।
ওই উৎসবে রাশিয়া, আমেরিকা, পোল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রাস এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ থেকে নামি নামি প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অন্যান্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে সত্যজিৎ মস্ত এক কাজ করেছিলেন। তিনি সবাইকে এমনকি কর্মকর্তাদের পর্যন্ত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, মাত্র দশটি ছবি থেকে একটিকে বেছে নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছবি নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাঁর যুক্তি ছিল, সিনেমা বোদ্ধারা যখন নির্বাক যুগের এবং সবাক যুগের ছবি তালিকায় রেখেছেন, তখন অমন নির্বাচন কখনোই সঠিক হতে পারে না। তাছাড়াও তিনি বলেছিলেন, ‘পোটেমকিন’ ছবিকে কি ‘গোল্ড রাশ’ থেকে শ্রেষ্ঠ বলা যাবে?
তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছবি’ এই প্রস্তাবটি বাতিল করতে সম্মত হয়েছিলেন সবাই। পরিবর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের বলা হয়েছিল তাঁরা প্রত্যেকে যেন তাঁদের মনোনীত দশটি সেরা ছবির তালিকা পেশ করেন। তা থেকে বিচারপতিরা দশটি ছবিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছবি ঘোষণা করেছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে নির্বাচিত তরুণ বিচারপতি প্রথম আবির্ভাবেই যে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন তা সাদরে মেনে নিয়েছিলেন বিশ্বের তাবড় তাবড় সিনেমাবোদ্ধারা। এটা কম গৌরবের কথা নয়।
***
২৩. হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়— (১৯২২—২০০৬) প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রপরিচালক প্রথম জীবনে রসায়নের কৃতী ছাত্র, নিউ থিয়েটার্সে বি এন সরকারের তত্ত্বাবধানে কর্মজীবন শুরু। বিমল রায়-এর সহকারী হয়ে বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই)-এ পাড়ি দেন গত শতাব্দীর পাঁচ-এর দশকে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও সাফল্যলাভ। বাণিজ্যিক ছবিতে তিনি নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। সত্যজিৎ রায়ের গুণমুগ্ধদের মধ্যে অন্যতম। ‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৫) ছবিটি দেখে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং সত্যজিৎকে বলেন যে তিনি এত নিষ্ঠুর, নির্মম ছবি কেন বানালেন? জীবনের বাস্তব ছবিটা তুলে ধরাই যে সত্যজিতের উদ্দেশ্য ছিল সে কথা বলায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় কথাটা একপ্রকার মেনে নেন। দুজনের এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আমৃত্যু অটুট ছিল।