সেকালের দোল
ষাট-সত্তর বছর আগে গ্রামোফোন রেকর্ডে একটা জনপ্রিয় গান ছিল—‘আজ ফাগুনে এলে কি শ্যাম খেলতে হোলি বৃন্দাবনে।’ কিন্তু বৃন্দাবনে শ্যামের হোলি খেলার উল্লেখ কোন প্রাচীন গ্রন্থে নেই। এমনকি মধ্যযুগের জীমূতবাহন, বৃহস্পতি রায়মুকুট, শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণি প্রমুখদের গ্রন্থসমূহেও নেই। বাঙলাদেশের লোক অবশ্য হোলিকে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা বলে। কিন্তু স্কন্দপুরাণের ‘ফাল্গুন মাহাত্ম্য’ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজে অন্য কথা বলেছেন। ওই কাহিনী অনুযায়ী যুধিষ্ঠির দোলযাত্রার বিবরণ জানতে চাইলে, শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন—সত্যযুগে রঘু নামে এক ধার্মিক ও গুণবান রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি ও অকালমৃত্যু ছিল না। কিন্তু একবার ঢুণ্ঢা নামে এক রাক্ষসীর প্রভাবে প্রজারা ব্যাধিগ্রস্ত হয়। প্রজারা রাজার শরণাপন্ন হলে, রাজা পুরোহিতের কাছে ঢুণ্ঢার বিবরণ জানতে চান। পুরোহিত বলেন, পুরাকালে মালিনীর কন্যা ঢুণ্ঢা কঠোর তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করে। শিবের কাছে সে অমরত্ব বর চায়। শিব বর দেন, মর্ত্য বা সুরলোকে কোন শক্তি তার অনিষ্ট করতে পারবে না। কেবল ঋতু পরিবর্তনের সময় উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তি ও বালকগণ হতে তার বিশেষ ভয় থাকবে। বালকগণ তার বৈরী জানতে পেরে রাক্ষসী তাদের নানারূপে নির্যাতিত করতে থাকে। পুরোহিত বলেন ওই রাক্ষসীর হাত থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে হই হল্লা করে শুষ্ক কাষ্ঠ দ্বারা ওকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে। দোলের আগের দিন চতুর্দশী তিথিতে যে চাঁচর উৎসব হয়, সেটাই ঢুণ্ঢা বধের স্মৃতি।
এখন ঢুণ্ঢা রাক্ষসী মেন্টাসুরে দাঁড়িয়েছে। একশ বছর আগে এটা খুব আনন্দের ব্যাপার ছিল। গ্রামের আবালবৃদ্ধ সকলে খড় বাঁশ ইত্যাদি দ্বারা মেণ্টাসুরের নরমূর্তি তৈরি করে সন্ধ্যার সময় বিপুল হর্ষধ্বনি সহ ওই মূর্তি অগ্নিযোগে ভস্মীভূত করত। এটাই চাঁচর।
কিন্তু লোককাহিনী অনুযায়ী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু নিজ ভগিনী হোলিকা রাক্ষসীকে তাঁর পুত্র হরিভক্ত প্রহ্লাদকে বধ করবার জন্য নিযুক্ত করে। হোলিকা এক বিরাট আগুন জ্বেলে তার মধ্যে প্রহ্লাদকে ফেলে দেয়। কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পায়, এবং হোলিকা নিজেই ওই আগুনে পুড়ে মারা যায়। এই হোলিকা রাক্ষসীর নাম থেকেই ‘হোলি’ নামের উৎপত্তি হয়েছে।
দোলযাত্রার উদ্ভব হয়েছিল সূর্যের উত্তরায়ণের সূচনায় বসন্ত ঋতুর আগমন থেকে। উত্তরায়ণ শুরু হয়, চন্দ্র যখন ফাল্গুনী নক্ষত্রের পাশ দিয়ে যায়। এটা ঘটে ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। এই সময় বসন্ত ঋতুর উদগম হয়। মানুষ তখন শীতের হাত থেকে রক্ষা পায়। প্রকৃতি নূতন রূপ ধারণ করে। মানুষের মন তখন উল্লসিত হয়ে ওঠে। হর্ষে মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে।
মনে হয় বসন্তের উদগমে দেশের নানা প্রান্তে লোকসমাজে যে সব উৎসব পালিত হত, সেগুলোই কালক্রমে হোলি উৎসবে পরিণত হয়েছে। উত্তর ভারতের লোক অবশ্য একে ‘হোলি’ বলে। কিন্তু বাঙলা ও ওড়িশার লোকরা ‘দোলযাত্রা’ বলে। দাক্ষিণাত্যে এর নাম ‘সিঙ্গা’। আর একেবারে দক্ষিণাঞ্চলের লোকরা বলে ‘কমন্নন হব্ব’।
হিন্দুরা এ সময় পরস্পরের গায়ে রঙ দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। তবে বাঙলায় ও ওড়িশায় এটা ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনই পালিত হয়। কিন্তু উত্তর ভারতে এটা পালিত হয় পূর্ণিমা কেটে গেলে প্রতিপদে।
হোলিতে পরস্পরের গায়ে রঙ দিয়ে রঙ্গরস করা এক সময় মুসলমান সমাজেও প্রচলিত ছিল। এটা আমরা জানতে পারি সম্রাট আকবরের অন্তঃপুরে হোলি খেলার এক চিত্র থেকে। বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘কথা’ তার প্রতিধ্বনি বহন করছে।
কলকাতার বাঙালী সমাজে হোলি এখন ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় এটা এক বেশ বড় উৎসব ছিল। তার চেয়েও বড় উৎসব ছিল, আরও একশ বছর আগে। তখনকার লোক কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই বলতে ‘ওদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয়।’ তার মানে, এটা দুর্গোৎসবের মতই একটা বড় উৎসব ছিল। এর আমরা সমর্থন পাই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে। অন্যান্য পরবে সরকারি আপিস যেখানে দু-একদিন বন্ধ রাখা হত, দুর্গোৎসবে বন্ধ রাখা হত আটদিন ও দোলযাত্রায় পাঁচদিন। সে সময় দোল উপলক্ষে সঙও বেরুত। মিছিল করে লোক এমন কুৎসিত সঙ প্রকাশ্যে বের করত ও অশ্রাব্য গান গাইত যে আজকালকার লোক তা কল্পনাও করতে পারে না। মেয়ে-পুরুষ যাকে সামনে পেত, তারই গায়ে রঙ দিত। কারুর গায়েই রঙ ছাড়া কাপড় থাকত না। তাছাড়া, আবির ও রঙে পথঘাট লাল হয়ে যেত। লোক তা নিয়ে খুব আমোদ করত।
কলকাতার বড়লোকদের বাড়ি খুব ঘটা করেই দোলোৎসব হত। বেশ সমারোহের সঙ্গে ই দোলোৎসব হত রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম হয়ে গেলেও, ঠাকুরবাড়িতে দোলে বেশ মাতামাতি হত। বাগবাজারে ভুবন নিয়োগীর বাড়িতেও খুব ঘটা করে দোলোৎসব হত
বর্তমান শতাব্দীর ত্রিশের দশকের আরম্ভ পর্যন্ত প্রতি গৃহস্থকে জামাইবাড়ি দোলের ‘তত্ত্ব’ করতে হত। কাপড়-জামা, মিষ্টান্ন, পিতলের পিচকারি, পিতলের বালতি, রঙের বাক্স, আবির, সাদা বাতাসা, সাদা ও রঙিন ‘মঠ’, চিনির মুড়কি, ফুটকড়াই, তিলেখাজা ইত্যাদি পাঠাতে হত। এখন এটা বন্ধই হয়ে গিয়েছে।
আমাদের ছেলেবেলায় দোলের দিন সকালে যেরকম মাতামাতি হত, তার বর্ণনা ভাষায় ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তখন জারমানি থেকে সস্তার রঙ আসত, সেজন্য রঙ ছোড়াটা খুব বেশি রকমের হত। তাছাড়া, একটা পিচকারির দামও ছিল খুব সস্তা। বাঁশের পিচকারি এক পয়সা। টিনের পিচকারি সাইজ অনুযায়ী দু-পয়সা থেকে দু-আনা ও পিতলের ছ-আনা থেকে দশ আনা। অন্তঃপুরে মেয়েরাও রঙ নিয়ে খুব মাতামাতি করত। আর বাইরে রাস্তায় ছেলেরা যাকে পেত তার গায়ে রঙ দিত। সেজন্য সেকালে দোলের দিন লোক ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে রাস্তায় বেরুত। তবে কনিষ্ঠরা কখনও নিজ গুরুজনদের গায়ে রঙ দিত না। মাত্র কপালে কি পায়ে আবির দিত। যদিও মুসলমানরা এটা পছন্দ করত না, তাহলেও ছেলেরা মুসলমানদের গায়েও রঙ দিত। সেজন্য দোলের দিন মুসলমানরা হিন্দুপাড়ার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করত না। সকালে রঙের খেলা শেষ হয়ে গেলে, বিকালে আবির খেলা হত। বিকালে কনসার্ট পার্টি ও গানও বেরুত।