কলকাতায় নববর্ষ
নূতন বছরের পয়লা দিনটাকেই আমরা ‘নববর্ষ’ বলি। কিন্তু এটা মানুষের এক মন-গড়া অভিধা। কেননা, কালপ্রবাহের না আছে কোন সূচনা, না আছে কোন ছেদ বা অন্ত। অনন্তের পথে চলেছে কাল নিরন্তর গতিতে। সেই অনন্ত কালপ্রবাহকেই আমরা ভাগ করে নিয়েছি আমাদের সুবিধার জন্য বর্ষ, মাস, দিন ও ক্ষণে। এ ভাগের হেতু ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কোথাও বা এর ভিত্তি হচ্ছে জ্যোতিষিক, আবার কোথাও বা কোন ঐতিহাসিক বা বৈষয়িক ঘটনা। আবার কোথাও কোথাও একটা আর একটার সঙ্গে জড়িয়ে একাকার হয়ে গেছে। আবার কোথাও রাষ্ট্র বা ধর্মাধিকরণের আদেশে প্রতিষ্ঠিত নববর্ষের দিন, এগিয়ে বা পেছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতে নানারূপ বর্ষ গণনা প্রচলিত ছিল। বিক্রম সংবত শুরু হয়েছিল ৫৮ খ্রীষ্ট- পূর্বাব্দ থেকে, শকাব্দ শুরু হয়েছিল ৭৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, গুপ্তাব্দ ৩২০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, হর্ষাব্দ ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, কলচুরি অব্দ ২৪৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, বাঙলায় ল ণ সংবত শুরু হয়েছিল ১১১৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, নেপালে নেওয়ার সংবত শুরু হয়েছিল ৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, কেরলে কোল্লম অব্দ ৮২৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, আর বাঙলা দেশে বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল সম্রাট আকবরের সময় থেকে, রাজকার্যের সুবিধার জন্য হিজিরা বর্ষের সঙ্গে তৎপরবর্তী সৌর বৎসরে ‘এক’ সংখ্যা যোগ করে। চৈতন্যচরিতামৃত’-এর সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে বঙ্গাব্দ সৃষ্টি হবার পূর্বে বাঙলায় শকাব্দেরই প্রচলন ছিল।
তবে মুসলমান আমলে উত্তর ভারতে ফসলী ও ওড়িশায় আমলী ও বিলায়তী অব্দও প্রচলিত ছিল। ফসলী বর্ষ শুরু হত ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে, আমলী ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশী থেকে ও বিলায়তী আশ্বিন মাস থেকে।
বর্তমানে উত্তর ভারতে বিক্রম সংবতের শুরু হয় চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ থেকে, আর শকাব্দের চান্দ্রবৎসর শুরু হয় চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ থেকে ও সৌরবৎসর কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে। দক্ষিণ ভারতে বাহস্পত্য বর্ষ প্রচলিত আছে। তা শুরু হয় বৈশাখী কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে। কেরলে কোল্লাম বর্ষ শুরু হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে। তামিলনাডুতে নববর্ষ শুরু হয় বাঙলার নববর্ষের দিন থেকেই। ওখানে নববর্ষকে বলা হয় ‘কুডিবৰ্ষম’ গুজরাটে নববর্ষ শুরু হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণা অমাবস্যার পরদিন থেকে। কলকাতাবাসী এই সব রাজ্যের লোকরা এই সব দিন থেকেই তাদের নববর্ষ গণনা করে।
ইংরেজ আমলে কলকাতায় নববর্ষ বলতে পয়লা জানুয়ারী বোঝাত। ওই উপলক্ষে সাধারণ লোক পরস্পরকে ‘নিউ ইয়ারস্ ডে কার্ড’ পাঠাত। অনেকে সাহেবদের ‘ভেট’ দিত। ব্যবসায়ীরা লোককে ক্যালেণ্ডার ও ডায়েরী পাঠাত। দিনটা ‘পাবলিক হলিডে’ ছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এই ছুটিটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন পয়লা বোশেখই নববর্ষের ছুটির দিন হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর এটা একটা উৎসবের দিন হিসাবেও পালিত হয়। সে উৎসবটা কি এবং কিভাবে পালিত হয়, সে কথা আমি পরে বলছি। তার আগে আগেকার দিনে পয়লা বোশেখে কি হ’ত, তা বলে নিতে চাই।
সূচনায় পয়লা বোশেখে বিশেষ কোন শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের প্রচলন আমাদের দেশে ছিল না। আমার সামনেই রয়েছে দু’শো বছরের হিন্দু পর্বের এক তালিকা। ওই তালিকায় এই নববর্ষের কোনও উল্লেখই নেই। পঞ্জিকায় ওদিন মাত্র ধ্বজা রোপণের বিধান লেখা আছে। কিন্তু বাঙলাদেশে ধ্বজা রোপণের বিশেষ কোন লক্ষণ আমি আমার দীর্ঘ জীবনকালের মধ্যে লক্ষ্য করিনি। (উত্তর ভারতে অবশ্য নববর্ষে ধ্বজা রোপণ দেখা যায়। তবে সেখানে বর্ষ আরম্ভ হয় চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদে।) ছেলেবেলায় দেখেছি কলকাতায় ওই দিন পুরোহিত ঠাকুর এসে নূতন পঞ্জিকা পড়ে মেয়েদের বর্ষফল শোনাত ও দক্ষিণা নিয়ে চলে যেত। এখন মেয়েদের মধ্যে ব্যাপক শিক্ষার প্রসার হয়েছে। মেয়েরা পয়লা বোশেখের আগেই, বাড়ির কর্তারা পঞ্জিকা কিনে নিয়ে এলে বর্ষফলটা নিজেরাই পড়ে নেয়। সুতরাং পুরোহিত ঠাকুরের বাড়িতে এসে বর্ষফল শোনাবার পদ্ধতি উঠে গেছে।
আর আগেকার দিনে নববর্ষের প্রথম দিনে হ’ত হালখাতা। সেটা অবশ্য এখনও প্রচলিত আছে, তবে তার আগেকার দিনের রেশ নেই। আমার ছেলেবেলায় দোকানে দোকানে হালখাতা হ’ত। তার দৃশ্য কিছুদিন আগে পর্যন্ত পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ছবিতে দেখতে পাওয়া যেত। বাস্তব জগতে এখন তার আর কোন অস্তিত্ব নেই। তখনকার সময়ে হালখাতার দিনে ময়রারা এক রকম মিঠাই তৈরি করত, যার নাম ছিল ‘হালখাতার মিঠাই’। সে মিঠাই তারা বছরে মাত্র একদিনই তৈরি করত। এখন আর সে মিঠাই তৈরি হয় না।
তখনকার সময়ে হালখাতার দিনে দোকানদাররা সকালবেলা দোকানে গণেশ পূজা ও খাতা মহরৎ করত। খাতা মহরৎ মানে নূতন খাতায় সিঁদূর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা ও দেবতার নাম লেখা। এখনও কোন কোন দোকানে এটা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ দোকানদার হয় কালীঘাটে, আর তা নয়তো দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে তাঁদের নুতন খাতা পূজা করিয়ে নিয়ে আসে।
বিকালবেলা দোকানে নিমন্ত্রণ করা হ’ত খরিদ্দারদের। দোকানে সেদিন ফরাস পেতে আসর তৈরি করে নিমন্ত্রিতদের আদর-আপ্যায়ন করা হ’ত। সকলের গায়ে গোলাপ জল ছিটানো হ’ত। আসরের মাঝখানে বসানো থাকতো রূপার তৈরি হুকাদানের ওপর দু- তিনটে রূপা দিয়ে বাঁধানো হুকা, অভ্যাগতদের তামাক খাবার জন্য। নুতন খাতা নিয়ে আসরের একধারে বসে থাকত দোকানের এক কর্মচারী। অভ্যাগতরা দিত তাদের বাকি টাকা, সম্পূর্ণ, নয়তো আংশিক। আর যাদের বাকির বালাই থাকত না, তারাও টাকা দিত এবং নূতন খাতায়, তাদের নামে সে টাকা জমা করে নেওয়া হ’ত। প্রত্যেককে এক চ্যাঙ্গ ারি করে মিঠাই দেওয়া হত।
আজকের দিনের গণসমাজে নববর্ষের দিনে যে উৎসব পালিত হয়, সেটা হচ্ছে আনন্দের উৎসব। এ উৎসবের উদ্ভব ঘটেছে মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি থেকে- পুরাতনের প্রতি বিতৃষ্ণা ও নূতনের প্রতি মোহাসক্তি থেকে। মানুষ ভুলে যেতে চায় পুরাতন বছরের লজ্জা, কলঙ্ক ও গ্লানি। গড়ে তুলতে চায় নববর্ষে জীবনকে নূতন করে—নূতন আশা, আকাঙক্ষা ও ঈপ্সা দিয়ে। জীর্ণতার পরিবর্তে চায় সজীবতা। সে জন্যই নববর্ষকে স্বাগত জানাবার জন্য আজকের দিনে মেয়েরা পরে নানা রঙের ও নানা ডিজাইনের শাড়ি, ছেলেরা করে কুচকাওয়াজ, মত্ত হয় নাচ-গান ও নানা রকম আমোদ- প্রমোদে।
কলকাতায় গুজরাটি ও মাড়বারি সমাজে নববর্ষ উৎসব পালিত হয় দেওয়ালীর দিনে। ওদিন আলোকসজ্জায় ঘরদোর শোভাময় করা হয়। আর, লোকেরা ওইদিন জুয়া খেলে নির্ণয় করে আগামী বছরে তাদের ভাগ্য। জানি না, বাঙলা দেশেও কোন এক সময় দেওয়ালীর দিন থেকেই নববর্ষ শুরু হ’ত কিনা! কেননা, ওদিনের আলোকসজ্জা, লক্ষ্মীপূজা ও অলক্ষ্মী বিদায়, নববর্ষে সমৃদ্ধির আবাহন ও পুরাতন বর্ষের দীনতার বিসর্জন বলে মনে হয়।