কলকাতায় জুয়ার ঢেউ
প্রথম মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) দু-তিন বছর আগের কথা। তখন আমাদের বাড়ি ছিল শ্যামবাজার স্ট্রীটের ওপর, পাঁচমাথার অতি সন্নিকটে। আমাদের বাড়ির বিপরীত দিকের ফুটপাথের সামনে কতকগুলি খোলার চালবিশিষ্ট দোকানঘর ছিল। দোকানঘরগুলির পর একটা সরু গলি। ওই গলির ভিতর ছিল একটা তুলোর দোকান। দোকানের নিশানাস্বরূপ গলির মুখে বড় রাস্তার উপর তুলোওয়ালা ঝুলিয়ে রাখত একটা তুলো-ভরা ঝুড়ি। আমরা ওই গলিটাকে তুলোর গলি বলতাম। আর ওই খোলার চালের ঘরগুলির মধ্যে একখানা ঘরে ছিল এক ভদ্রলোকের দোকান। নানা জায়গার নিলাম থেকে তিনি নানা রকমের জিনিস কিনে এনে গাদা করতেন ওই দোকানঘরটিতে। আমি তখন ছেলেমানুষ। ছোট ছেলের কৌতূহলী মন নিয়ে ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম তাঁর নানারকমের বিচিত্র পণ্যসম্ভার।
একদিন দেখি, তাঁর দোকানের সামনে ঝুলছে একখানা সাইনবোর্ড—মাপে এক হাত চওড়া ও দু হাত খাড়াই। বোর্ডটির মাথায় লেখা ‘আমেরিকান কটন ফিগার’। আর তার নিচে দশটা লাইন, প্রত্যেক লাইনের গোড়ায় লেখা আছে যথাক্রমে ওয়ান, টু, থ্রি ইত্যাদি—এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা।
যেদিন ওই সাইনবোর্ডটা প্রথম দেখলুম, অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলুম সেটার দিকে। জিনিসটা কী, তা বুঝবার চেষ্টা করলুম। ওটার মাথায় লেখা ‘আমেরিকান কটন ফিগার’ শব্দ ক’টার অর্থ করতে লাগলুম। ভূগোলের বইয়ে পড়েছিলুম যে, আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে আমেরিকা নামে একটা দেশ আছে। সুতরাং অর্থ করলুম ‘আমেরিকান’ মানে আমেরিকা দেশ সংক্রান্ত কোন ব্যাপার। ওয়ার্ডবুকে পড়েছিলুম ‘কটন’ মানে তুলো, আর ‘ফিগার’ মানে সংখ্যা। ‘ফিগার’ সম্বন্ধে কোন গোলমালই হল ন, কেননা চোখের সামনেই বোর্ডের ওপর তো দেখলুম এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা। এখন সমস্যা হল, এটা আমেরিকা দেশের তুলোর কী সংখ্যা? প্রথম ভাবলুম, বোধ হয় এটা তুলোর দামের সংখ্যা। মনে মনে ভাবলুম, তবে কি ইনি ওই পাশের গলির দেশী তুলো-ব্যবসায়ীর সঙ্গে তুলোর প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা শুরু করলেন? লোকটার প্রতি বেশ রুষ্ট হলুম ও ওই তুলোর গলির তুলোওয়ালার ওপর সহানুভূতি হল। তারপর দোকানের ভিতরটায় ভাল করে তাকিয়ে দেখলুম। না, কোন জায়গায় তো তুলোর নামগন্ধ নেই। তখন ভাবলুম বোধ হয় ভদ্রলোক কোন নিলাম থেকে বোর্ডখানা কিনে এনেছেন ও দোকানের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছেন। এই কথা ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে গেলুম।
কিন্তু এই স্বস্তি মাত্র এক রাত্তির স্থায়ী হল। পরের দিন দেখি যে, কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের ওপর মল্লিকদের পাকা ঘরে যে সকল স্টীল ট্রাঙ্কের দোকান ছিল, সে গুলির প্রত্যেক দোকানের সামনে ঝুলছে অনুরূপ সাইনবোর্ড। তখন আবার ভাবলুম, না, এরা সকলে জোট বেঁধে তুলোর ব্যবসাই শুরু করছে। তুলোর গলির তুলোওয়ালা বেচারীর কী হাল হবে, ভেবে মনে মনে খুব কষ্ট পেলুম
আমার বাবা ছিলেন চিকিৎসক। তাঁর ডাক্তারখানা ছিল ঠিক শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর বিপরীত দিকের ফুটপাতের ওপর সামনের ঘরে। বাবার ডাক্তারখানায় যাবার পথে রোজই ওই দোকানঘরগুলোর ভিতর উঁকি মেরে দেখতুম, ওদের তুলো এল কিনা। তুলোর কোন হদিশ না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলুম, যাক, যে কদিন ওদের তুলো না আসে সে কদিন বেচারী তুলোওয়ালা বেঁচে যাবে।
এরপর যখন আরও দোকানঘরের সামনে ‘আমেরিকান কটন ফিগার’-এর সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখলুম তখন কৌতূহলী হয়ে একদিন আমার বড়দাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বড়দা, দেখেছ বেচারী তুলোওয়ালাকে মারবার জন্য কত তুলোর দোকান হয়েছে। কিন্তু ওদের দোকানে তুলো নেই কেন?’ আমার কথা শুনে বড়দা তো হেসেই খুন। বললেন, “আরে পাগল, ওগুলো তুলোর দোকান নয়। ওগুলো তুলোর খেলা। নামে একরকম জুয়ার দোকান।’ বড়দাকে জিজ্ঞাসা করতে বড়দা আমাকে জুয়াটা বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, দেখেছিস তো, ওই বোর্ডগুলিতে এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা লেখা আছে। আজ যদি কেউ কোন সংখ্যায় এক আনা পয়সা লাগায় আর সামনে কাল যদি সেই সংখ্যা ওঠে, তা হলে সে কাল আট খানা পয়সা পাবে। পয়সা লাগাবার সময় ওরা একটা রসিদ দেয়, আর কাল ওই রসিদটা দেখালেই ওরা আট আনা পয়সা দিয়ে দেয়।’ বড়দাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আচ্ছা, প্রত্যেক দোকানে কি আলাদা অলাদা নম্বর ওঠে?’ বড়দা বললেন, “না; সব দোকানে একই নম্বর ওঠে। নম্বরটা ঠিক করে দেয় বড়বাজারের মারবাড়ী জুয়াড়ীরা। সেখানেই তুলোর খেলার স্নায়ুকেন্দ্র। সকল দোকানকেই সেই নম্বর মানতে হয়। কেননা, এরা সকলেই হচ্ছে তাদের ‘বুকী’। ‘বুকী’ শব্দটার অর্থ কী, তাও বড়দা বুঝিয়ে দিলেন।
তখনকার দিনের স্কুল-কলেজের ছেলেদের একটা অভ্যাস ছিল। বিকালবেলায় তারা হয় হেদুয়ায় আর তা নয়তো গোলদীঘিতে বেড়াতে যেত। আমার বড়দাও যেতেন। একদিন বড়দার সঙ্গে আমিও বেড়াতে গেলুম। দেখি, শ্যামবাজারের মোড় থেকে শুরু করে কলেজ স্ট্রীটের মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুধারে অসংখ্য দোকানের সামনে ঝুলছে সেই একই সাইনবোর্ড—‘আমেরিকান কটন ফিগার।’
এক কথায় রাতারাতি কলকাতা শহরে গজিয়ে উঠল হাজার হাজার তুলোর খেলার দোকান। খেলাটা শহরের লোককে এমনভাবে আকৃষ্ট করল যে সারা শহরে জুয়ার বন্যা বয়ে গেল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাড়ির কর্তা খেলেন, গিন্নী খেলেন। বৌ খেলে, মেয়ে খেলে। ছেলে খেলে, জামাই খেলে। রাঁধুনী বামুন খেলে, ঝি-চাকর খেলে। মুটে, মজুর খেলে। দোকানদার খেলে, ব্যবসাপতি খেলে। এক কথায় শহরের সকল শ্রেণী, সম্প্রদায় ও স্তরের লোকই তুলোর খেলায় মত্ত হয়ে উঠল। এমন কী স্কুলের ছেলেরাও মারবেল গুলি নিয়ে ওই খেলা খেলতে শুরু করে দিল।
তুলোর খেলায় যে নম্বরটা উঠত, সেটা আমেরিকার নিউ অরলীস শহরের তুলোর ফাটকা-বাজারের দরের ভিত্তিতে নির্ধারিত হত। তুলোর খেলার যে বোর্ডগুলো দোকানের সামনে টাঙানো থাকত, তাতে এক থেকে দশ নম্বর ছাড়া আরও দু-তিনটি বহু-অঙ্ক বিশিষ্ট সংখ্যা থাকত। সকলেরই ধান্ধা ছিল ওই সংখ্যাগুলি থেকে পরদিনের নম্বর আবিষ্কার করা।
আমার বাবার ডাক্তারখানায় বিকাল বেলায় তিন বৃদ্ধ মিলিত হতেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম জন ছিলেন গোপালচন্দ্র দাস মশায়। তিনি বাংলা ভাষার অভিধান সংকলক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মশায়ের জ্যাঠামশায়। জ্ঞানেন্দ্রবাবু প্রায়ই তাঁর জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সেজন্য জ্ঞানেন্দ্রবাবুকে আমি ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। বোধহয় গোপালবাবুই শহরের একমাত্র লোক যিনি তুলোর খেলা খেলতেন না। অপর দুজন ছিলেন সিংগী মশায় ও মিত্তির মশায়। জ্যোতিষী হিসাবে সিংহী মশায়ের বেশ নামডাক ছিল। তিনি একবার আমার হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, লেখা-পড়া আমার মোটেই হবে না, আমি ভবিষ্যতে ছুতোরের কাজে বিশেষ দক্ষ হব। সিংগী মশায় জ্যোতিষের সাহায্যে নম্বর বের করে তুলোর খেলা খেলতেন। মাঝে মাঝে তিনি সফল হতেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই অকৃতকার্য হতেন।
মিত্তির মশায় আগে অ্যাকাউনটেন্ট-জেনারেলের অফিসে চাকরি করতেন। তুলোর খেলার সময় তিনি অবসরপ্রাপ্ত বেকার। তিনি সারাদিন ধরে ওই বহুসংখ্যাবিশিষ্ট রাশিগুলি নিয়ে অঙ্ক কষতেন, আর পরের দিনের সংখ্যা বের করবার চেষ্টা করতেন। একদিন বিকাল বেলায় মিত্তির মশায় বেশ উৎফুল্ল হয়ে এসে বাবাকে বললেন, ডাক্তার, কেল্লা ফতে, শালা, অমুকের বাচ্চারা আর কতদিন আমাদের ঠকাবে। অঙ্ক কষে নম্বরের সূত্র বের করে ফেলেছি। কালকের নম্বর হচ্ছে নয়।” আমার বাবা, সিংগী মশায় ও মিত্তির মশায়—এই তিন জনেই সেদিন ৯ নম্বরে এক টাকা করে লাগিয়ে দিলেন। সে- রাতটা আমার ঘুম হল না, পরদিনের জন্য খুব উৎসুক হয়ে রইলুম। পরদিন দেখি’- ‘ভো কাটটা’। উঠল ছয় নম্বর। নয় নম্বরের বদলে ছয় নম্বর ওঠায় তিন জনের টাকাই নয় ছয় হয়ে গেল।
এই রকমভাবে সমস্ত শহরের লোকই সেদিন কালকের নম্বর কী আসবে, তাই জল্পনা-কল্পনা, অঙ্ক কষাকষি ও জ্যোতিষের শ্রাদ্ধ করতে লাগল। কিন্তু কেউ কারুকে বলতে চাইত না সে সেদিন কোন্ নম্বরে বাজি লাগিয়েছে, পাছে আর কেউ সেটা জানতে পেরে লাভবান হয়। যার নম্বর উঠত, সে সেদিন বুক ফুলিয়ে হাঁটত। আর যার উঠত না, সে আবার বেপরোয়া হয়ে ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে পরের দিনের জন্য প্রস্তুত হত।
সেদিন আমাদের বাড়ির সংলগ্ন মল্লিকদের বাড়ির ঝি একথালা সন্দেশ এনে মার সামনে রাখল। বলল, ‘মা পাঠিয়ে দিলেন।’ তখনকার দিনে কোন সুসংবাদ থাকলে প্রতিবেশীরা পরস্পরের বাড়ি সন্দেশ পাঠিয়ে সংবাদটা দিতেন। (শব্দতাত্ত্বিকদের এটা গবেষণার বিষয় যে সন্দেশ’ শব্দের অর্থ ‘সংবাদ’, এই প্রথা থেকে উদ্ভুত হয়েছে কিনা— )। ‘মা মল্লিক বাড়ির ঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সংবাদ গো?’ ঝি উত্তরে বলল, মা আজ বাজিমাৎ করেছেন কি না, তাই এই সন্দেশ পাঠিয়ে দিলেন।’ মল্লিক বাড়ির ছাদের পাঁচিলের ধারে দাঁড়ালেই আমাদের বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা যেত। কিছু পরেই পাঁচিলের ধারে মল্লিক গিন্নীর আবির্ভাব। উচ্চকণ্ঠে তিনি ডাকছেন, ‘ও দিদি, ও দিদি, একটা সুসংবাদ শোন। পরশু রাত্তিরে স্বপ্নে দেখি যে মা চণ্ডী স্বয়ং আবির্ভূতা হয়ে বলছেন, কাল তুই পাঁচ নম্বরে পাঁচ টাকা লাগা।’ তাই কাল পাঁচ নম্বরে পাঁচ টাকা লাগিয়েছিলুম। আজ চল্লিশ টাকা পেয়েছি।’ তারপর এক গাল হেসে বললেন, ‘বুঝেছ, কর্তার এক মাসের মাইনের চেয়েও বেশি।’ মা ক্লিষ্ট মনে কথাটা শুনলেন, কেননা মায়ের নম্বর ওঠেনি। মা মল্লিক বাড়ির ঝিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যারে, তুই তো গিন্নীমার নম্বর দোকানে লাগিয়ে আসিস, তা তুই পাঁচ নম্বরে কিছু লাগাস নি?’ মল্লিকবাড়ির ঝি বলল, ‘তা আর কী করে লাগাই বল না, গিন্নী যে ছেলের দিব্যি দিয়ে দেয়। একটা ছেলে নিয়ে ঘর করি, কী করে ওই দিব্যি অমান্যি করি বল।’ বস্তুত, এই সময় মানুষের মনে স্বার্থপরতা খুব প্রবল হয়ে উঠেছিল, কেউ চাইত না যে, তার নম্বরের সাহায্যে অপরে লাভবান হয়। সকলের একই চিন্তা। কালকের নম্বর কী ভাবে আবিষ্কার করা যাবে। মল্লিক গিন্নীর সাফল্যের কথা শুনে, আমাদের পাড়ার অনেকেই কালীঘাটে গিয়ে মানত করল, ‘মা, আমাকে কিছু টাকা পাইয়ে দাও, আমি টাকায় এক আনা হারে তোমার পুজো দিয়ে যাব।’ অনেকে আবার অন্যান্য কালীতলায় গিয়ে গণনা করাতে লাগল।
এইভাবে সারা শহরে প্রবাহিত হল জুয়ার বন্যা। লোক এক আনা লাগিয়ে আট আনা পেলে, আগেকার নষ্টধন উদ্ধারের জন্য আট আনাই লাগিয়ে দিত পরের দিনের জন্য অন্য নম্বরে। সকলেরই এক আকাঙ্ক্ষা, অপরকে টেক্কা দেওয়া। এই টেক্কা দেওয়ার আকাঙক্ষা এমন তীব্রভাবে লোককে আক্রান্ত করল যে, লোকে দশ আনা পয়সা খরচ করে দুখানা রসিদ কাটাতে লাগল—একখানা জোড় সংখ্যার, আর একখানা বিজোড় সংখ্যার। নম্বর-এর আর পালাবার উপায় নেই। জোড় নম্বর উঠলে, লোক মাত্র জোড় নম্বরের রসিদখানা অপরকে দেখিয়ে গর্ববোধ করত। আর যদি বিজোড় নম্বর উঠত, তাহলে বিজোড় সংখ্যার রসিদ খানা দেখাত। আশ্চর্য হয়ে গিয়ে লোক পরস্পর বলাবলি করত, ‘দেখ, অমুকের বরাত কী, রোজই বাজিমাৎ করছে।’ প্রথম যারা এটা করত, তারা এটাকে গোপন রাখত। কিন্তু যখন রহস্যটা ফাঁস হয়ে গেল, তখন সকলেই ওই একই পথ অবলম্বন করল। ফলে, দশ আনা লাগিয়ে লোকে আট আনা পেতে লাগল। আজকের দিনের লোক বুঝতে পারবে না যে, সেদিন ওই দু আনা ক্ষতির পরিমাণ কত বড়। কেননা, তখনকার দিনে যে-কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনিক বাজার খরচ হত মোট চার আনা। সেদিনকার দিনে বাজারে পারশে, ট্যাংরা, বাগদা চিংড়ি, ভেটকি প্রভৃতি মাছের দর ছিল তিন আনা থেকে চার আনা সের, আর কাটা বড় রুই মাছের দর ছিল ছয় আনা সের। তিনটা বড় বড় বেগুন পাওয়া যেত এক পয়সায়, আলুর সের ছিল দু পয়সা থেকে চার পয়সা, আধ পয়সায় এক আঁটি নটে কিংবা কলমী শাক পাওয়া যেত, যার ওজন হবে আধ সেরের কাছাকাছি। মাংস ছয় আনা সের ছিল, আর হাঁসের ডিমের দাম ছিল এক পয়সায় একটা।
সুতরাং শেষের দিকে যখন পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার জেদ মানুষকে গ্রাস করল, তখন বহুলোক ও পরিবার তুলোর খেলার প্রকোপে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। সংবাদপত্রে এই নিয়ে আন্দোলন হতে লাগল। খেলার সূচনা থেকে প্রায় আট দশ মাস উত্তীর্ণ হবার পর সরকার খেলাটা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু যারা সর্বস্বান্ত হল, তাদের প্রায় সবাই বাঙালী, আর যাদের সিন্দুকে বাঙালীর পয়সাটা গিয়ে পৌঁছল, তারা মারবাড়ী।
খেলাটা উঠে যাবার পর আবার রাতারাতি পট পরিবর্তন হল। কেউ তুলোর খেলার দোকানকে রূপান্তরিত করল খাবারের দোকানে, কেউ ডাইং-ক্লিনিং-এর দোকানে, কেউ ছাতার দোকানে, কেউ ঘড়ির দোকানে, কেউ স্টীল ট্রাঙ্কের দোকানে, কেউ বা আবার চপ-কাটলেটের দোকানে।
শহরের বুকের ওপর প্রকাশ্যভাবে দিনের আলোয় এরূপ ব্যাপক জুয়ার স্রোত পূর্বে বা পরে আর কখনও হয়নি।