কি করে মহানগরী হল?
১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে জোব চার্ণক কলকাতায় এলেন তৃতীয় বার। তখন থেকেই কলকাতায় ইংরেজদের স্থায়ী বসবাস শুরু হল। তখন কলকাতা মানে তিনখানা পাশাপাশি গ্রাম, সুতানটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর। ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা ১৬ হাজার টাকায় এই তিনখানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কিনে নিয়ে কলকাতার জমিদার হয়। ১৭০৬ খ্ৰীষ্টাব্দে কলকাতার কালেক্টর বা জমিদার একটা সমীক্ষা করান। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, কলকাতার তখন মোট আয়তন ছিল ৫০৭৭ বিঘা। এই ৫০৭৭ বিঘা জমির মধ্যে মাত্র ৮৪১ বিঘা ১০ কাঠায় ঘরবাড়ি ছিল। বাকি জমির ১৫২৫ বিঘায় ছিল ধানক্ষেত, ৪৮৬ বিঘায় বাগান বাগিচা, ২৫০ বিঘায় হত কলার চাষ। ১৮৭ বিঘায় তামাকের চাষ, ১৫০ বিঘায় তরিতরকারির চাষ, ৩০৭ বিঘা ব্রহ্মোত্তর জমি, ১৬৭ বিঘা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির এলাকাভুক্ত, ১১৬ বিঘায় ছিল রাস্তাঘাট, পুকুর, কুয়া ইত্যাদি, আর ১১৪৪ বিঘা পতিত জমি। এই হচ্ছে কলকাতার আদিরূপ। বলা বাহুল্য এ রূপটা হচ্ছে গ্রাম্যরূপ।
১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার জমিদারি কেনবার পর ইংরেজরা এখানে একটা দুর্গ নির্মাণ করে। দুর্গবিশিষ্ট জায়গায় বেশি নিরাপত্তা পাওয়া যাবে ভেবে অনেকেই কলকাতায় এসে বাস শুরু করে। ইংরেজরা তাদের জমি বিলি করে প্রজাস্বত্ব ভিত্তিতে। নির্ধারিত দিনের মধ্যে খাজনা না দিলে, জমি ক্রোক করা হত ও অপরকে বিলি করা হত। জমি পুনরুদ্ধারের কোনও অধিকার ছিল না। জমি অপরকে বেচবারও কোনও অধিকার ছিল না। ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ১২,০০০। আরমেনিয়ান ও পর্তুগীজরাই কলকাতার প্রাচীন অধিবাসী। আর ছিল এদেশী লোক। তারপর এসেছিল ইংরেজরা। এরা সকলেই ছিল বণিক। দেশী লোক যারা কলকাতায় এসে বসবাস করল, তারা অধিকাংশই এইসব বণিকদের দাসদাসী। আর ছিল পালকিবাহকের দল। ইংরেজরা যেসব চাকর-বাকর নিযুক্ত করল তারা হচ্ছে দারোয়ান, সরকার, পিওন, হরকরা. ছাতা বরদার, হুকা বরদার, খানসামা ইত্যাদি। এছাড়া ছিল ইংরেজদের কেরানি, ভলি. গোমস্তা প্রভৃতির দল। এই ক্রমবর্ধমান জনতার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য! শহরে এল দোকানদার, মহাজন, নাপিত, পুরোহিত, ধোবা, মুনশি, ঠিকাদার, দালাল প্রভৃতি নানা শ্রেণীর লোক। শহরে এরা সবাই বসতি স্থাপন করল। তার জন্য তৈরি করল ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি তৈরির জন্য এল ঘরামি, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি। শহরের নানা জায়গায় স্থাপিত হল মুদির দোকান, তামাক ও গুলটিকের দোকান। এমন কি ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে শহরে দু’-খানা গাঁজার দোকান খোলবারও লাইসেন্স দেওয়া হল। গাঁজার দোকান ছাড়া শহরে ‘আরক’ নামে এক প্রকার তীব্র মদের দোকানেরও লাইসেন্স দেওয়া হল। দু’জন লাইসেন্স পেল বিবি ডোমিনগো অ্যাশ ও গোবিন্দ শুঁড়ি।
ইংরেজদের জমিদারী পরিচালনার ভার দেওয়া হল একজন কালেক্টরের ওপর। আর তাকে সাহায্য করবার জন্য নিযুক্ত করা হল একজন এদেশী কালেক্টর, নাম ‘ব্ল্যাক কালেক্টর’ বা ‘কালা কালেক্টর’। তার মাহিনা ছিল চার টাকা। কিন্তু জ্বরে কী করে? পিলেয় মেরে দিত। দুহাতে তারা ঘুষ নিত। একবার সহকারী কালেক্টর গোবিন্দরাম মিত্র কালেক্টরের মুখের ওপরই বলেছিল— সহকারীদের এরূপ ঘুষ নেওয়ার অধিকার সব সময়েই আছে, কেননা, তাদের যা বেতন দেওয়া হয়, তাতে তাদের পদমর্যাদা বজায় রেখে চলা যায় না।’ গঙ্গার ধারে কুমারটুলিতে গোবিন্দরামের বিরাট বসতবাড়ি ও নয়-চূড়াবিশিষ্ট এক কালী মন্দির ছিল। কালী মন্দিরের উচ্চতা ছিল বর্তমান শহিদ মিনারের চেয়েও বেশি। বিদেশীদের কাছে এটা ছিল কলকাতার দিকচিহ্ন। তারা এটাকে ‘দি প্যাগডা’ বলত। প্রথম সহকারী কালেক্টর নন্দরাম সেনও একটা বড় শিবমন্দির করেছিলেন।
১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের কোম্পানির আয়ব্যয়ের খাতায় দেখা যায় যে তখন শহর কোতোয়ালের (বর্তমান পুলিস কমিশনারের পূর্বসূরি) মাহিনা ছিল চার টাকা ও প্রত্যেক পুলিশ রক্ষীর বেতন ছিল মাত্র দু’টাকা। ওই বছরে কোম্পানির গোমস্তার মাহিনা ছিল এক টাকা নয় আনা। কোম্পানির সেরেস্তার জন্য এক মাসে কাগজ কেনা হয়েছিল ছয় আনার ও কালি দু আনার।
শহরের অবস্থা ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। কলেরা, জ্বর ও বসন্ত নিত্য লেগে থাকত। শহরে সাহেবদের জন্য একটা সুন্দর হাসপাতাল ছিল বটে, তবে সেখানে যারা যেত, তারা আর ফিরে আসত না।
আদালতও একটা ছিল, কিন্তু কোন জেলখানা ছিল না। চোর ও খুনীদের শাস্তি দেওয়া হত গঙ্গার ওপারে হাওড়ায় ‘দ্বীপান্তর’ করে। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা দিল্লির বাদশাহ ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে ফরমান পাবার পর, ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় মেয়রস্ কোর্ট নামে এক আদালত স্থাপিত হয়। পরে ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হয়। পরের বছরের ৫ আগস্ট তারিখে এখানেই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ব্রহ্মহত্য, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি। পাছে ব্রহ্মহত্যার পাপ তাদের অসায় বলে, কলকাতার লোক সেদিন গঙ্গার অপর পারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাহেবেরা খুব মিতব্যয়ী ও সংযমী ছিল। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর মোটা ঘুষের টাকায় তারা খুব বিলাসপরাণ হয়ে ওঠে। তারা তখন এক একজন ‘নবাব’ হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতাকে তারা ভোগবিলাসের কেন্দ্র করে তোলে।
কেবল যে সাহেবরাই ঘুষ নিত তা নয়। এদেশী দেওয়ানরাও। তারাই কলকাতার অভিজাত পরিবারসমূহের প্রতিষ্ঠাতা। তারা যে ঐশ্বর্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতেন, তা তাদের বেতনের দিকে তাকালে বুঝতে পারা যাবে কোথা থেকে টাকা আসত তাদের ভোগবিলাসের জন্য।
১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় ১৭টা বাজার ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ‘বড়বাজার’। তার পরই সুতানটির বাজার। সুতানটির বাজার সপ্তাহে দুদিন বসতো— বৃহস্পতিবার ও রবিবার। লোহালক্কড়ের জিনিস থেকে আরম্ভ করে শাকসবজি, কাপড়, জুতা, মাছ, তেল, নুন, ঘি, সবকিছুই বিক্রি হত সুতানটির বাজারে। সেকালে জিনিসপত্তরের দাম খুবই সস্তা ছিল। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার বাজার দর ছিল—চাল ১.৮৭ মণ, ডাল ২.৫০ মণ, ঘি ১৫.৪১ মণ, সরষের তেল ৮.৪৪ মণ, নুন ১.২৫ মণ, ময়দা ৩.৩৭ মণ, চিনি ৭.১৫ মণ, মিষ্টান্ন মেঠাই ১০.০০ মণ ও মোরব্বা ১৯.০০ টাকা মণ। একটা গোটা খাসির দাম ছিল এক টাকা।
সাধারণ ভদ্র গৃহস্থের জীবনযাত্রা ছিল খুব সরল। বারমাসে তারা তের পার্বণ করত। প্রত্যহ তারা গঙ্গাস্নান করত। মেয়েরা ছিল অসূর্যম্পশ্যা। তারা অন্তঃপুরেই থাকত। তাদের কোন অন্তর্বাস ছিল না, তারা পাছাপেড়ে শাড়ি পরত। পুরুষরা পরত ধুতি, গায়ে দিত চাদর ও মাথায় বাঁধত পাগড়ি।
প্রথম একশ বছরের মধ্যে কলকাতার অনেক পরিবর্তন ঘটল। ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস্ গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হবার পর কলকাতা ভারতের রাজধানীর মর্যাদা পেল। কলকাতা এক জনবহুল শহর হল। ১৭১৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ১২,০০০। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ৬০০,০০০। ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় আটখানা পাকাবাড়ি ও ৮,০০০ কাঁচাবাড়ি ছিল। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ৪৯৮ পাকাবাড়ি ও ১৪,৪৫০ কাঁচাবাড়ি ছিল। আগে সাহেবপাড়া ছিল বি-বা-দী বাগ ও চীনাবাজার অঞ্চলে। শতাব্দীর শেষ দুই দশকে চৌরঙ্গী অঞ্চলে। আগে কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি ছিল না। ঘোড়ার গাড়ি চলতে থাকে হেস্টিংস-এর আমলে। দেশী লোকদের মধ্যে মহারাজ নবকৃষ্ণই প্রথম ঘোড়ার গাড়ি কেনেন। হেস্টিংস-এর আমলে ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে চিঠিপত্তর পাঠাবার জন্য একটা ডাকবিভাগও খোলা হয়। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে ঘোড়দৌড়েরও প্রচলন হয়। বাংলা হরফে বই ছাপাও হয়। তবে স্কুল কলেজ ছিল না। ছিল পাঠশালা, চতুষ্পাঠী, মকতাব ও মাদ্রাসা। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে হিকি প্রথম সংবাদপত্র ‘গেজেট’ প্রকাশ করেন। এদেশী লোকদের জন্য একটা হাসপাতালও (বর্তমান মেয়ো হাসপাতালের জনক) স্থাপিত হয়। একেবারে শতাব্দীর শেষে রাজভবনও নির্মিত হতে থাকে। তারপর প্রচেষ্টা চলে কলকাতাকে রূপান্তরিত করবার।
উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই লটারী করে কলকাতাকে রূপান্তরিত করবার চেষ্টা হয়। ১৮০৫ থেকে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে লটারীর টাকায় অনেক পুকুর কাটানো হয়। টাউন হল (১৮০৬-১৩) নির্মিত হয় ও বেলেঘাটা খালের সংস্কার করা হয়। ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে একটা স্থায়ী লটারী কমিটি গঠিত হয় এবং তারাই প্রথম এক বৃহৎ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এই কমিটির কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল কলকাতার সাহেব-পাড়াকে তৈরি করা। এটা তৈরি হয়েছিল ক্যামাক স্ট্রীট অঞ্চলের বস্তিগুলোকে উচ্ছেদ করে। তাছাড়া ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তারা তৈরি করেছিল ব্যাপারীটোলা (ওয়েলিংটন স্কোয়ার অঞ্চল), হেস্টিংস ও হেয়ার স্ট্রীট, ম্যাংগো লেন ও কসাই- টোলা, ক্রীক রো, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, কিড স্ট্রীট, উড স্ট্রীট, ইলিয়ট রোড, পার্ক স্ট্রীট ও চৌরঙ্গী অঞ্চল। গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলও তারা সুসংস্কৃত করেছিল। ময়রা স্কোয়ার থেকে বৌবাজার পর্যন্ত একটা নূতন রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ওয়েলিংটন স্ট্রীট। তারপর ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দের পর ওই রাস্তাটাকে সোজা টেনে আনা হয়েছিল (কলেজ স্ট্রীট ও কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট) শ্যামবাজার পর্যন্ত চার্নকের রাস্তার (পরবর্তীকালের ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড) সঙ্গে মিলিত করবার জন্য? কলকাতায় এসময় পাকাবাড়ির তুলনায় মাটির বাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি।
ইতিমধ্যে বেসরকারী উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দে সরকারী উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজ ও ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মিত হয়। ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে স্ত্রীশিক্ষার জন্য নেটিভ ফিমেল স্কুল (পরবর্তীকালের বেথুন কলেজ) স্থাপিত হয়। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে সরকার হিন্দু কলেজ অধিগ্রহণ করেন ও ওর নামকরণ করেন প্রেসিডেন্সী কলেজ। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে সুপ্রীম কোর্টকে রূপান্তরিত করে হাইকোর্ট স্থাপন করা হয়। ১৮৬২ থেকে ১৮৭২-এর মধ্যে বর্তমান হাই কোর্ট ভবন তৈরি করা হয়।
১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রি স্কুল স্ট্রীটকে বাড়িয়ে ধর্মতলা স্ট্রীটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ক্যানিং স্ট্রীট, ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে বিডন স্ট্রীট, ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে গ্রে স্ট্রীট ও ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে হ্যারিসন রোড নির্মিত হয়।
কলকাতার রাস্তায় জল দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারী তারিখ থেকে। প্রথম জল দেওয়া হয় চিৎপুর রোডে। তার কিছু পরেই কলকাতার রাস্তায় তেলের আলো জ্বালা হয়। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ৫ জুলাই থেকে গ্যাসের আলো ও ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ৮ জুলাই থেকে কলকাতা শহরে পরিশোধিত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এর জন্য কতকগুলো জলাধার সৃষ্টি করা হয়। তারপর ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ মে তারিখ থেকে টালায় একটা পাম্পিং স্টেশন কার্যকর করা হয়। জল নিকাশের জন্য ১৮৬১-৭৫-তে কলকাতা মাটির তলায় ড্রেন পাইপ বসানো হয়। ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা করপোরেশন গঠিত হবার পর থেকে কলকাতার রাস্তাঘাট ও ড্রেন সংস্কার, জল সরবরাহের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যরক্ষা, প্রাইমারী বিদ্যালয়, মিউনিসিপাল মার্কেট, পার্কগুলোর তদারকী করা ইত্যাদির ভার কলকাতা করপোরেশনের ওপরই ন্যস্ত আছে।
কলকাতায় ঘোড়ার ট্রামের প্রবর্তন হয় ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারী থেকে। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর থেকে ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার বদলে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহৃত হয়। ১৮৯৬ সাল থেকে কলকাতায় মোটর গাড়ির প্রচলন হয় ও ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে রিকশ গাড়ির। ১৯২৪ থেকে কলকাতায় বাস সারভিসের প্রবর্তন হয়। কলকাতায় বাইসাইকেল চলেছিল ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। টেলিগ্রাফের প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৫২ থেকে, টেলিফোনের ১৮৭৭ থেকে, ইলেকট্রিসিটি ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, বেতারবাণী ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ও টেলিভিশন ১৯৫৭ থেকে। চক্র রেল ও পাতাল রেল চালু করা হল ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে। কলকাতায় প্রথম ফুটপাত তৈরি হয় ১৮৬১-৬২ খ্রীষ্টাব্দে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীটে রাজভবনের সামনে। তারপর সব বড় রাস্তার ধারে। কলকাতার ফুটপাতগুলোকে সীমেণ্ট দিয়ে বাঁধানো হয় প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের সময়।
কলকাতায় প্রথম মিউনিসিপাল মার্কেট খোলা হয় ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী তারিখে চৌরঙ্গীর লিওসে স্ট্রীট ও বার্টরাম স্ট্রীটের সংযোগস্থলে। নূতন বাজার বলে একে নিউ মার্কেট বলা হয়। কলকাতায় এখন আরও আটটা মিউনিসিপাল মার্কেট আছে। শবদাহের জন্য কলকাতায় চারটা ঘাট আছে—কাশীপুর, বাগবাজার, নিমতলা ও কেওড়াতলায়। ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগস্ট তারিখে কলকাতায় প্রথম ইলেকট্রিক ক্রিমেটরিয়ামের উদ্বোধন হয় কেওড়াতলায়।
কলকাতাকে মহানগরীতে পরিণত করার কাজ প্রধানত শুরু হয় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অ্যাকট পাশ হবার পর। প্রথম তৈরি করা হয় শহরের বুক চিরে একটা বড় রাস্তা (এখনকার চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যু)। পরে ওই রাস্তা বিস্তৃত করে তৈরি করা হয় যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেন্যু ও গিরিশ অ্যাভেন্যু। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যু ও যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেন্যুর সংযোগস্থল থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পর্যন্ত তৈরি করা হয় ভূপেন বোস অ্যাভেন্যু। পূর্বদিকে শ্যামবাজার ব্রিজ রোড বিস্তৃত করে নাম দেওয়া হয় আর, জি, কর রোড। পূর্বদিকে এক কচুরিপানাপূর্ণ জলাভূমি ভরাট করে তৈরি করা হল রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট। উত্তর থেকে দক্ষিণে যেমন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট তৈরি হল, পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকেও কয়েকটা রাস্তা তৈরি করা হল। একটা গ্রে স্ট্রীট থেকে কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রীট পর্যন্ত নাম বি. কে. পাল অ্যাভেন্যু। আর একটা পোস্তার মোড় থেকে পূর্ব দিকে সিমলা ভেদ করে মানিকতলার খালের ওপার পর্যন্ত। এর এক অংশের নাম হল বিবেকানন্দ রোড ও অপর অংশের নাম মানিকতলা মেন রোড। আরও একটা রাস্তা মিশন রো থেকে ওয়েলিংটন স্কোয়ার পর্যন্ত, নাম দেওয়া হল মিশন রো এক্সটেনশন ও গণেশ অ্যাভেন্যু। ওদিকে এণ্টালী ও পার্ক সার্কাস অঞ্চলকে ভেঙে তছনছ করে ফেলা হল। ওদিকটার নূতন রূপ দেওয়া হল এবং পূর্বদিকে ভি. আই. পি. রোড নামে এক নূতন রাস্তা নির্মাণ করা হল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কাজ যা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট করল, সেটা হচ্ছে শহরের দক্ষিণে হোগালা বন কেটে একটা সম্পূর্ণ নুতন অভিজাত পল্লী সৃষ্টি। এই নূতন পল্লীর হৃৎপিণ্ডের ভিতর যে রাস্তাটা তৈরি করা হল, তার নাম দেওয়া হল রাসবিহারী অ্যাভেন্যু এবং শীঘ্রই এ রাস্তায় ট্রাম চলাচল শুরু হল। বড় একটা হল ‘লেক’ তৈরী করা হল, এবং তার সঙ্গে সংযোগ করা হল লেক রোড। তারপর তৈরি করা হল শহরের সবচেয়ে চওড়া রাস্তা সাদার্ন অ্যাভেন্যু। বস্তুতঃ ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যে উন্নয়নমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করল, তার ফলে শহরের চেহারাটা সম্পূর্ণভাবে বদলে গেল।
কলকাতার পাকা বাড়িগুলো আগে পশ্চাদগামী হত, একটা মহলের পর আর একটা মহল। নিমাই মল্লিকের ছিল সাত মহল বাড়ি। এখন বাড়িগুলো তৈরী হয় উর্ধগামী। এক তলের ওপর আর এক তল। চ্যাটার্জি ইনটারন্যাশনালের বাড়ি হচ্ছে ২৪-তল।
এখন কলকাতাকে মহানগরীতে পরিণত করবার দায়িত্ব নিয়েছে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, সংক্ষেপে আমরা যাকে বলি সি. এম. ডি. এ।