বাবুসমাজের বাজির লড়াই
ধর্মীয় সামাজিক উৎসবে আনন্দ প্রকাশের জন্য বাজির ব্যবহার অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে এসেছে। কালীপূজার দিন এর ব্যবহার তুঙ্গে উঠত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এর ব্যবহার খুবই বেড়ে গিয়েছিল। তার কারণ ইংরেজরা আমোদ-প্রমোদের জন্য যখন তখন আতসবাজি ব্যবহার করতো। সেজন্য বাজির ব্যবসাটা সে যুগে খুব লাভজনক ছিল। এর জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হত।
১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ময়নুদ্দীন বারুদওয়ালাকে বাজি তৈরি করবার জন্য লাইসেন্স দিয়েছিল। আবার ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে আতসবাজির কারখানার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল কালীচরণ সিংহকে। প্রতি বৎসরই এরকম লাইসেন্স দেওয়া হত।
কথায় বলে কারোর পৌষ মাস আর কারোর সর্বনাশ। অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতায় কোঠাবাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই কম। অধিকাংশই ছিল কাঁচা চালাবাড়ি। ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে শহরে পাকা বাড়ি ছিল মাত্র আট খানা, আর কাঁচা চালাবাড়ি ছিল ৮০০০। ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে এই সংখ্যা যথাক্রমে ছিল ৪০ ও ১৩,৩০০, ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে ১২১ ও ১৪,৭৪৭ এবং ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ৪৯৮ ও ১৪,৪৫০। প্রায়ই আতসবাজিসমূহ এইসব চালাবাড়ির ওপর পড়ে সেগুলোকে ভস্মীভূত করে দিত। সেজন্য তাদের নিরাপত্তার জন্য ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর তারিখে কোম্পানি এক আদেশ জারি করে। সে আদেশের ভাষা—‘শহরের মধ্যে আতসবাজি ছোঁড়ায় অনেক স্থানের চালাঘরে আগুন লেগে পাড়াকে পাড়া ভস্মীভূত করে দিয়েছে। পেরিন পয়েন্ট ও শহরের মধ্যে আমাদের যেসব বারুদখানা আছে—এরূপ আতসবাজির দ্বারা তারও বিপদ ঘটতে পারে। এজন্য আদেশ করা যাচ্ছে, কলকাতার মধ্যে আর আতসবাজি ছুঁড়তে দেওয়া হবে না। বাজির দোকানগুলো তুলে দেওয়া হবে।’
মনে হয় এরূপ নিরাপত্তামূলক আদেশ বিশেষ কার্যকর হয়নি। কেননা, আমরা দেখি এর দু’বছর পরে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে কালীচরণ সিংহকে আতসবাজি তৈরি করবার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। তার মানে শহরে আতসবাজি ছোঁড়া, বিশেষ করে কালীপূজার সময় পূর্ণোদ্যমেই চলেছিল।
সেযুগে কালীপূজার সময় বাজি ছোঁড়া একটা সার্বজনীন ব্যাপার ছিল। সাধারণ গৃহস্থরা তো আতসবাজি ছুঁড়তোই, ধনীসমাজে এটা আবার অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতো। এ সমাজের লোকদের ‘বাবু’ বলা হতো। বাবুরা ছিল এক অদ্ভুত জাত। ‘এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, পায়রা উড়াইয়া, বুলবুলের লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা ইত্যাদি বাজাইয়া, কবি হাফ-আখরাই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকোযোগে আমোদ করিয়া আসিত।’ এদের বাপ-ঠাকুরদারা নানারূপ অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জন করে কলকাতার অভিজাত পরিবারসমূহের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল এবং তাদের বংশধররাই ‘বাবু’ হয়ে সে টাকার অপব্যয় করতো। এমনকি পুতুলের বিয়েতে, বিড়ালের বিয়েতে তারা হাজার হাজার টাকা খরচ করতো। আর মদ ও মেয়ে-মানুষের পেছনে টাকা ব্যয় করেই এরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল।
এহেন বাবুরা কালীপূজার সময় আতসবাজি নিয়ে হই-হুল্লোড় করবার জন্য বারাঙ্গনাদের গৃহে সমবেত হতেন। সারা বছরে যেসব মেয়ে-মানুষদের বাবু জুটতো না, কালীপূজার দিন তাদের ঘরেও লোক আসতো। তখন তারা দুটো ভালোমন্দ জিনিস পেটভরে খেতে পেতো। মাংস হতো, ভালো ভালো মদ আসতো—ভালো জামাকাপড় পেতো। স্নানযাত্রা, রাসযাত্রা, কালীপূজা, কার্তিক পূজা—এ সময়গুলোই ছিল ওদের মরসুম।
যাঁরা বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ পড়েছেন, তাঁরা তো জানেন একবার কালীপূজার দিন রাত্রে বড়বাজারের বড়বাড়ির ছোটকর্তার রক্ষিতা চুনীদাসীর জানবাজারের বাড়িতে কি ঘটেছিল। ছোটকর্তার রক্ষিতার বাড়ির দক্ষিণেই ছিল কতকগুলো বাজারের মেয়ে-মানুষের বাড়ি। ও-বাড়িতে মেয়ে-মানুষ ছিল চল্লিশটা, আর কালীপূজার দিন হুল্লোড় করতে বাবু এসেছে একশো জন। বাবুরা মেয়েগুলোকে ছাদের ওপর নিয়ে গিয়ে হইহুল্লোড় করে তুবড়ি ছুঁড়ছে। চুনীদাসী ছোটকর্তার সঙ্গে বাজি দেখবার জন্য ছাদে উঠেছে। একটা বাজি এসে পড়লো চুনীদাসীর উঠোনে। সেখানে ছিল চুনীদাসীর এক পোষা টিয়া পাখি। বাজিটা শেষ করে দিল চুনীদাসীর টিয়া পাখিটাকে। রেগে আগুন হয়ে উঠলো ছোটকর্তা। রাগলে ওঁর জ্ঞান থাকে না। হুকুম দিলেন চাকর বৃন্দাবনকে—এখুনি তুবড়ি কিনে আনো—হাজার টাকার তুবড়ি। বড়বাড়ির বাবুদের তো হাজার ছাড়া কথাই নেই। বৃন্দাবন তুবড়ি কিনতে গেল। কিন্তু হাজার টাকার তুবড়ি তো চাট্টিখানি কথা নয়। কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পাওয়া গেল, তাই নিয়ে হাজির হলো বৃন্দাবন ছোটকর্তা হুকুম দিলো—ছোঁড়ো সবাই ওদের দিকে। ও বাড়ির মেয়েরা আর বাবুরাই বা ছাড়বে কেন। তারাও ছোটকর্তার তুবড়ি ফাটার সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করলো। ও-বাড়ির ছাদের আলসের ওপর সার-সার চল্লিশটা তুবড়ি বসিয়ে চল্লিশটা মেয়ে একসঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিলো। চল্লিশটা তুবড়ি আকাশের দিকে মুখ করে শোঁ শোঁ শব্দে ফুলের তোড়ার মতো উড়ে চলেছে। একসঙ্গে চল্লিশটা মেয়ের হুল্লোড়। আর তাদের একশো বাবু। পাড়াটা মাত হয়ে উঠেছে। ছাদের ওপরই মাদুর পেতে হারমনিয়াম নিয়ে নাচ-গান চলেছে। একশো বাবু একসঙ্গে চিৎকার করে উঠছে—কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ। হঠাৎ এদিক থেকে বৃন্দাবন ছুঁড়লো তুবড়ি। তুবড়ির ঝাঁক। ও-মা-গো বলে ছিটকে পড়লো মেয়েদের দল। গান-বাজনা মাথায় উঠলো তাদের। শাড়িতে সেমিজে আগুনের ফুলকি লেগেছে। উদ্দাম হয়ে উঠলো আসর। তারপর আরো তুবড়ির ঝাঁক গিয়ে পড়লো আবার। ছোটকর্তা বলে—দে বৃন্দাবন, সব মাগীদের পুড়িয়ে মার, পাঁচ গণ্ডা তুবড়ি নিয়ে বাজি পোড়াতে আসে। এক একটা তুবড়ি শোঁ শোঁ করতে করতে যায় আর ওদের ছাদে পড়ে ছত্রখান হয়ে যায়। আগুনের ফোয়ারা ছোটে। কিলবিল করে ওঠে মাগীগুলো। মাগীরা বলে- এ কী কাণ্ড মা, পালিয়ে যাই নিচে। কিন্তু বাবুরা ছাড়বে কেন? তারা পয়সা খরচ করে ফূর্তি করতে এসেছে, এত সহজে মাটি হবে সব! দু’ একটা মাগী মরলো কি গেল, তাতে তাদের কী। তারপর একটা তুবড়ি এসে পড়লো একেবারে ছোটকর্তার গায়ে। চুনীদাসী ছুটে গিয়ে, ছোটকর্তার গায়ের সে আগুন না নেভালে, ছোটকর্তা তো আগুনে পুড়ে একাকার হয়ে যেত। কালীপূজার দিন বাবুসমাজের হুল্লোড়ের এ একটা বিশ্বস্ত বর্ণনা।
বাবুরা যেমন মেয়ে-মানুষের বাড়ি গিয়ে বাজি পুড়িয়ে হইহুল্লোড় করতো, বড়বাড়ির ছেলেমেয়েরাও তেমনি কালীপূজার রাত্রে হাজার হাজার টাকার বাজির শ্রাদ্ধ করতো।
সব লোকের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই অন্য বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিত নানারকম বাজি ছুঁড়ে, যেগুলো আকাশে গিয়ে নানারকম ফুলের জ্বলন্ত মালা বা অন্য আকৃতির জিনিস সৃষ্টি করতো। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজি বলে গণ্য হতো, যা আকাশের গায়ে লিখে দিত—God save the King!