কলকাতায় প্রথম ব্ৰহ্মহত্যা
১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ আগস্ট। কলকাতার ইতিহাসে একটা স্মরণীয় দিন। ওই দিন ইংরেজগণ কর্তৃক কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রহ্মহত্যা। হিন্দুর দৃষ্টিতে ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ। পাছে ব্রহ্মহত্যার পাপ তাদের স্পর্শ করে, সেজন্য ৫ আগস্ট তারিখের প্রত্যুষেই কলকাতার লোকেরা শহর ছেড়ে গঙ্গার অপর পারে চলে গিয়েছিল।
যাকে নিয়ে এই ব্রহ্মহত্যা ঘটেছিল, তিনি হচ্ছেন মহারাজা নন্দকুমার রায়। সকলেরই জানা আছে যে ওয়ারেন হেষ্টিংস ষড়যন্ত্র করে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে ব্যাপারটা বিশদভাবে অনেকেরই জানা নেই। সেটাই এখানে বলছি।
নন্দকুমারের পৈতৃক বাসস্থান ছিল বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে। পিতার নাম পদ্মনাভ রায়। তিনি ছিলেন মুরশিদকুলী খাঁর আমিন। নন্দকুমার ফারসী, সংস্কৃত, বাংলা ও পিতার কাছে রাজস্ব-সংক্রান্ত কাজ শিখে আলিবর্দী খাঁর আমলে প্রথমে হিজলি ও মহিষাদল পরগনার রাজস্ব আদায়ের আমিন ও পরে হুগলির ফৌজদারের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। পলাশী যুদ্ধের পর নন্দকুমার নানা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। এই সময় বর্ধমানের খাজনা আদায়ের কর্তৃত্ব নিয়ে ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূত্রপাত হয়। হেষ্টিংস তখন কোম্পানির রেসিডেন্ট ছিলেন।
উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে পরে নন্দকুমার কলকাতায় আসেন। কলকাতায় তিনি একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। তিনি প্রতিভাশালী ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁর নানা রকম গুণে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ শাহ আলম তাঁকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
দেশের লোককে রেজা খাঁর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য দেশের লোকেরও তিনি প্রিয় হয়েছিলেন। তিনি কোনরূপ অত্যাচার সহ্য করতে পারতেন না, এবং সব সময় অত্যাচারিতের পক্ষ নিয়ে দণ্ডধারণ করতেন। তাছাড়া, বিডন স্কোয়ারের নিকট তাঁর বাড়ির দ্বার সব সময়েই দরিদ্র দেশবাসীর জন্য উন্মুক্ত থাকত। প্রত্যহ এক বিরাট জনত তাঁর বাড়িতে ভোজন করত।
এহেন নন্দকুমারের মত ব্যক্তির বিচার পৃথিবীর নবম আশ্চর্যরূপে পরিগণিত হয়েছিল। হেস্টিংস ও তাঁর কাউনসিলের সঙ্গে নন্দকুমারের বনিবনা ছিল না। তিনি হেষ্টিংস-এর রোহিলা যুদ্ধ ও ফৈজাবাদের সন্ধির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। হেষ্টিংস- এর সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরমে ওঠে যখন ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের রানী অভিযোগ করেন যে হেষ্টিংস তাঁর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। ওই ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দেই নন্দকুমার অভিযোগ করেন যে, হেষ্টিংস মুন্নি বেগমের কাছ থেকে ৩,৫৪,১০৫ টাকা ঘুষ নিয়ে তাঁকে নাবালক নবাবের অভিভাবক নিযুক্ত করেছেন। হেস্টিংস প্রত্যভিযোগ আনলেন যে, নন্দকুমার কামালউদ্দিন নামে (কামালউদ্দিন হেস্টিংস-এরই আশ্রিত লোক) এক ব্যক্তিকে প্ররোচিত করেছেন হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ আনবার জন্য। নন্দকুমার এ মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন হেস্টিংস কামালউদ্দিন ও মোহনপ্রসাদ নামক আর এক ব্যক্তি দ্বারা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে এক জালিয়াতির মামলা আনেন। এই মামলাতেই নন্দকুমারের ফাঁসি হয়।
মামলার বিষয়বস্তু ছিল একগাছা মোতির মালা ও কয়েকটি অলঙ্কার। ১৭৬৫ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দের) আষাঢ় মাসে মহারাজা নন্দকুমার এই মোতির হার ও অলংকারগুলি মুরশিদাবাদে বলাকীদাস দামে এক ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন বিক্রয়ের জন্য। মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় মুরশিদাবাদে যে বিশ্ ল অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, সে সময় বলাকীদাসের বাড়ি থেকে এগুলি লুণ্ঠিত হয়। ১৭৭২ বঙ্গাব্দে (১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে) বলাকীদাস যখন কলকাতায় আসেন, নন্দকুমার তখন এগুলি তাঁর কাছ থেকে ফেরত চান। বলাকীদাস এগুলি ফেরত দিতে অসমর্থ হয়ে, নন্দকুমারের আনুকূল্যে একখানা দলিল তৈরি করে দেন। বলাকীদাস ওই দলিলে লিখে দেন যে, কোম্পানির ঢাকায় অবস্থিত খাজাঞ্চিখানায় তাঁর রোক টাকা আছে, তা ফেরত পেলে তিনি নন্দকুমারের ওই মোতির হার প্রভৃতির মূল্য বাবদ ৪৮,০২১ সিক্কা টাকা মূল্য হিসাবে এবং তার ওপর টাকায় চার আনা হিসাবে অতিরিক্ত ব্যাজ দেবেন। এই দলিল সম্পাদনের চার বছর পরে ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে বলাকীদাসের মৃত্যু ঘটে। বলাকীদাস তাঁর মৃত্যুশয্যায় নন্দকুমারকে ডেকে বলেন : আমি আমার স্ত্রী ও কন্যার ভার আপনার ওপর সমর্পণ করে যাচ্ছি। আমি আশা করি এতদিন আপনি আমার প্রতি যেরূপ আচরণ করেছেন, আমার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গেও সেরূপ আচরণ করবেন।’ এর কিছুদিন পরে যখন বলাকীদাসের বিষয়সম্পত্তি ও দেনাপাওনার নিষ্পত্তি হয়, তখন নিষ্পত্তিকারীরা নন্দকুমারের প্রাপ্য টাকাও তাঁকে দিয়ে দেন। তখন বলাকীদাসের উক্ত দলিল বাতিল করা অবস্থায় কলকাতার মেয়র আদালতের ফেজখানায় জমা পড়ে এবং সেখানা সেখানেই থেকে যায়।
হেস্টিংস নন্দকুমারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য, মেয়র আদালতের ফেজখানা থেকে ওই দলিলটা উদ্ধার করেন এবং ওরই ভিত্তিতে এক মামলা রুজু ক’রে বলেন যে দলিলখানা জাল।
১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৬ মে তারিখে কলকাতাবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল যখন তারা শুনল যে নন্দকুমারের ন্যায় ব্যক্তির বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা আনা হয়েছে, এবং তাঁকে সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে রাখার জন্য নির্দিষ্ট জেলখানায় রাখা হয়েছে। সরকারের কাছে আরজি পেশ করা হল যে, নন্দকুমারের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণকে সাধারণ জেলখানায় রাখলে তাঁর ধর্ম নষ্ট হবে। কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। হেস্টিংস-এর প্ররোচনায় বিচারকরা সকলে একমত হয়ে রায় দিলেন যে ‘শেরিফ যেন নন্দকুমারকে সাধারণ জেলখানাতেই রাখে।’
৮মে তারিখে নন্দকুমার প্রধান বিচারপতির কাছে এক আবেদন পত্রে বলেন যে, তাঁকে যদি সাধারণ জেলখানায় রাখা হয়, তা হলে তাঁকে জাতিচ্যুত হবার আশঙ্কায় আহার-স্নান প্রভৃতি পরিহার করতে হবে। সেজন্য তাঁকে এমন কোন বাড়িতে বন্দী করে রাখা হোক যা কোনদিন ক্রীশ্চান বা মুসলমান কর্তৃক কলুষিত হয়নি, এবং তাঁকে প্রতিদিন একবার করে গঙ্গায় স্নান করতে যেতে দেওয়া হোক’। কিন্তু বিচারকরা আবার একবাক্যে বললেন—‘কয়েদীর এরকম আবদার কখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে না।’
নন্দকুমার গোড়া থেকেই জেলখানায় আহার ত্যাগ করেছিলেন। সেজন্য ১০মে তারিখে প্রধান বিচারপতি ইমপে (হেস্টিংস-এর প্রাণের বন্ধু) নন্দকুমারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবার জন্য একজন চিকিৎসককে পাঠিয়ে দেন। চিকিৎসক মন্তব্য করলেন, ‘অনশন হেতু নন্দকুমারের এরূপ শারীরিক অবনতি ঘটেছে যে, পরদিন প্রাতের পূর্বেই নন্দকুমারকে খাওয়ানো দরকার।’ সেজন্য বিচারকরা অনুমতি দিলেন যে প্রতিদিন প্রাতে একবার করে তাঁকে যেন জেলখানার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু নন্দকুমার সে অনুমতি প্রত্যাখ্যান করেন। সেজন্য জেলখানার প্রাঙ্গণে একটা তাঁবু খাটিয়ে সেখানে নন্দকুমারের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। নন্দকুমার সেখানে মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করতেন না।
বর্তমান রাইটার্স বিলডিং-এর পূব দিকে এখন যেখানে সেণ্ট এন্ড্রুজ গির্জা অবস্থিত, সেখানেই তখন সুপ্রিম কোর্ট ছিল। এখানেই ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৮ জুন তারিখে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিচার শুরু হয়। যে বিচারকমণ্ডলী নন্দকুমারের বিচার করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইমপে, হাইড্ চ্যাম্বারস্ ও লেমেস্টার। সরকারী পক্ষের উকিল ছিলেন ডারহাম, আর নন্দকুমারের পক্ষে ফারার। এই মামলায় দশজন ইওরোপীয় ও দুজন ইওরেশিয়ান জুরি নিযুক্ত হয়। দোভাষী ছিলেন হেস্টিংস ও ইমপে র বন্ধু আলেকজাণ্ডার ইলিয়ট। তাঁর নাম প্রস্তাবিত হওয়া মাত্রই, ফারার আপত্তি তুলে বলেন যে, তাঁর মক্কেল একে তার শত্রুপক্ষের লোক বলে মনে করেন। কিন্তু ফারারের এ আপত্তি নাকচ হয়ে যায়। তারপর ফারার বলেন যে, তাঁর মক্কেলকে কাঠগড়ায় না পুরে যেন তাঁর উকিলের কাছে বসতে দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত ফারারের এসব আবেদনও নাকচ করে দেয়।
তারপর আইনের লড়াই চলে। বিচারক চ্যাম্বারস্ মত প্রকাশ করেন যে বিলাতের আইন কলকাতায় চলতে পারে না। সুতরাং এ মামলা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের এলাকার বাইরে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি ইমপে ও অন্য বিচারকরা এর বিপরীত মত প্রকাশ করেন। সুতরাং মামলা চলতে থাকে।
নন্দকুমারকে তখন সওয়াল করতে বলা হয়। নন্দকুমার আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কার দ্বারা আপনার বিচার হওয়া উচিত মনে করেন?’ নন্দকুমার উত্তর দেন— ঈশ্বর ও তাঁর সমতুল্য ব্যক্তি দ্বারা।’ বিচারকরা নন্দকুমারকে জিজ্ঞাসা করেন—‘কাকে আপনি সমতুল্য মনে করেন?’ ফারার উত্তরে বলেন——এটা তিনি আদালতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিতে চান!
সমস্ত বিচারটাই হল একটা প্রহসন মাত্র। মীর আসাদ আলি, শেখ ইয়ার মহম্মদ ও কৃষ্ণজীবন দাস প্রভৃতি অনেকে নন্দকুমারের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন যে, তাঁরা স্বচক্ষে বলাকীদাসের ওই দলিল সম্পাদিত হতে দেখেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৮জুন তারিখে আদালত জুরিদের প্রতি তাঁদের অভিমত প্রকাশ করতে বলে। তাঁরা সকলেই একবাক্যে বললেন—নন্দকুমার দোষী, এবং তাঁর প্রতি কোনরূপ দয়া প্রদর্শন করবার সুপারিশ আমরা করতে পারি না।’ আদালত নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়। (তখনকার বিলাতী আইন অনুযায়ী জালিয়াতি অপরাধে প্রাণদণ্ড হত)। শুধু তাই নয়। নন্দকুমারের সমর্থনে যারা সাক্ষী দিয়েছিল, তাদের অভিযুক্ত করবারও আদেশ দেয়।
কলকাতাবাসীর পক্ষ থেকে নন্দকুমারকে বাঁচাবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা, বিলাতে রাজার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনে জুরিদের অনুমোদন থাকা চাই। জুরিরা সে অনুমোদন দিলেন না।
১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজারের ফাঁসি মঞ্চে নন্দকুমারকে তোলা হল। অত্যন্ত প্রশান্ত মুখে ইষ্টদেবতার নাম করতে করতে নন্দকুমার ফাঁসিমঞ্চে উঠলেন। ইংরেজ-বিচারের যূপকাষ্ঠে বলি হলেন বাঙলার একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। সব শেষ হয়ে গেলে গঙ্গার অপর পারে সমবেত হিন্দু নরনারী ‘বাপরে বাপ’ বলে চীৎকার করে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের পাপ ক্ষালনের জন্য।