গরমকালের কলকাতা
সাহেবরা ঠাণ্ডা দেশের লোক। এদেশে এসে কীভাবে তারা গরমের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করত, এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে জাগে। উত্তরটা দিয়েছিল, ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দের এক সংবাদপত্রে, এক ইংরেজ সম্পাদক ইংরেজদের লক্ষ্য করে। তিনি লিখেছিলেন—’যদি গরমের হাত থেকে বাঁচতে চাও, তাহলে কাছে রক্ষিতা রেখে দেবে’। সে যুগের সাহেবী সমাজে রক্ষিতা রাখা মানে এদেশি মেয়েকে ঘরণী করে নেওয়া, কেননা, ইংরেজ-মেয়েকে রক্ষিতা রাখা সে যুগের সাহেবী সমাজে নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। এটা আমরা জানতে পারি ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দের এক লেখকের বিবৃতি থেকে। তিনি লিখে গেছেন—”Concubinage is so generally practised in India by Europe- ans at the same time so tacitly sanctioned by married families, who scruple not to visit at the house of a bachelor that retains a native mistress though were she an European they would avoid it as polluted.” (অতুল সুর, ‘কলকাতা : এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস’ পৃষ্ঠা ১১১ দ্রঃ)।
গরমের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য এদেশি মেয়েদের ঘরণী রাখা সে যুগের সাহেবী সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল। সে যুগের ভাষায় তাদের ‘বিবিজান’ বলা হত। সে যুগের এক ইংরেজ মহিলা বিলেতে তার এক বান্ধবীকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, এদেশে অবস্থিত সব সাহেবেরই একজন করে বিবিজান থাকত। এই বিবিজানদের অধিকাংশেরই ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা রয়ে গিয়েছে। মাত্র কয়েকজনের সম্বন্ধেই আমরা লিপিবদ্ধ নজির পাই। ভারতের সংবাদপত্রের জনক ‘হিকির গেজেট’-এর সম্পাদক হিকি সাহেবের এক এদেশি ঘরণী ছিল। এই মেয়েটির গর্ভে হিকি সাহেবের দশটি সন্তান হয়েছিল। সমসাময়িককালে আর এক হিকির (ইনি আইনবিদ ছিলেন) দু’জন এদেশি ঘরণীর কথা পড়ি তার নিজের লেখা রোজনামচা থেকে। তার প্রথম ঘরণী ছিল এক বাঙালি মেয়ে। তাকে হিকি পরিহার করেছিলেন তার ব্যভিচারিতার জন্য। আর তার দ্বিতীয় ঘরণী ছিল একজন হিন্দুস্থানী মেয়ে। এদের বিষয়ে বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে আমার ‘কলকাতার চালচিত্র’ (১৯৮২) বইয়ে। এসব বিবিজানদের ছেলেমেয়েদের সাহেবরা নিজের ছেলেমেয়েরূপেই মানুষ করত। এটা আমরা জানতে পারি কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্ণকের জীবনী থেকে ও পার্ক স্ট্রীটের কবরখানার এক স্মৃতিফলক থেকে। শার্লট নামে তিন বছরের এক শিশুর কবরের ওপর ওই স্মৃতিফলকে লেখা আছে—’মোস্ট লাভলি অ্যাণ্ড বিলাভেড্ চাইল্ড অফ চার্লস রীড অ্যাণ্ড বিবিজান’। সমসাময়িককালে ফরস্টার সাহেব যিনি প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন তাঁর ইংরেজি-বাংলা অভিধান সংকলনের জন্য তাঁরও এক হিন্দস্থানী ঘরণী ছিল।
গরম কাটাবার জন্য এদেশি মেয়েদের রক্ষিতা রাখা প্রথাটা পর্তুগীজ আমল থেকেই চলে এসেছিল। এদেশি মেয়েদের রক্ষিতা রাখবার অধিকার সম্বন্ধে পর্তুগীজরা একখানা ফারমানও পেয়েছিল সম্রাট শাজাহানের কাছ থেকে। পর্তুগীজ সাহেবদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য এদেশি মেয়েদের লালসা উৎকটভাবে চিত্রিত হয়ে আছে সপ্তদশ শতাব্দীর কাঁচড়াপাড়ার এক মন্দিরগাত্রে গাঁথা এক টেরাকোটা চিত্রফলকে (ছবিটা দেওয়া আছে আমার ‘হিস্ট্রি অ্যাণ্ড কালচার অব বেঙ্গল’ (১৯৬৩) বইয়ে)। বস্তুত ১৯৪৭ খ্ৰীষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত সাহেবরা এদেশি মেয়েদের ঘরণী রাখত।
সেকালে সাহেবরা কীভাবে গরম কাটাতো সে সম্বন্ধে তো এতক্ষণ বললাম। এবার এদেশের লোকের কথা বলি। সাধারণ বাঙালি, মাথাটাকে রৌদ্রের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য মাথায় পাগড়ি বাঁধত। আর ধনীলোকরা মাথায় পরত শামলা। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখদের আমরা ছবিতে দেখি মাথায় শামলা-আঁটা অবস্থায়। আর বড়লোকেরা যখন বাইরে বেরোত, তখন তাদের সঙ্গে যেত ছাতাবরদার। আমরা পড়ি যে মহারাজ নবকৃষ্ণদেব বাহাদুর প্রত্যহ প্রাতঃকালে যখন গঙ্গাস্নানে যেতেন, তখন তাঁর সঙ্গে যেত এক ছত্রবাহক এক বর্ণাঢ্য ছাতা নিয়ে। আর কোর্ট-কাছারি, অফিস-দপ্তরের জানালা-দরজায় গরমকালে টাঙানো হত খসখসের টাটি—প্রতি আধঘণ্টা অন্তর সেগুলোতে জল ছিটাবার জন্য নিযুক্ত থাকত লোক! ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই ছিল। এখন এয়ার-কণ্ডিশনিং চালু হবার পর এসব উঠে গেছে।
তখনকার দিনে বাড়িতে লোক ব্যবহার করত হাতপাখা। কেননা, ষাট-সত্তর বছর আগে পর্যন্ত ইলেকট্রিক ফ্যান বা আলোর ব্যবহার সাধারণ গৃহস্থের বাড়িতে ছিল না। যদিও বিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরেই ‘কলিকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশন’ সংগঠিত হয়ে গিয়েছিল, তা হলেও কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবহার বিশের দশকের আগে ঘটেনি। ফ্যানের ব্যবহার আরও পরে ঘটেছিল।
গরমকালের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পানীয় জলের, কেননা কলকাতায় নলের সাহায্যে পানীয় জল সরবরাহ কলকাতা করপোরেশন কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল উনিশ শতকের সত্তরের দশকে। তার আগে সাহেবরা পানীয় জল সংগ্রহ করত লালদিঘি থেকে। আর দেশি পাড়ার লোকরা পানীয় জল সংগ্রহ করত স্থানীয় পুষ্করিণী বা দিঘি থেকে। সিমলা অঞ্চলের লোকরা পানীয় জল সংগ্রহ করত হেদুয়ার পুষ্করিণী থেকে। অনেক অভিজাত পরিবারের বাড়িতে ‘জলের ঘর’ থাকত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—’তখন জলের কল বসেনি। বেহারা কাঁখে করে কলসীভরে মাঘ-ফাল্গুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়ো বড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল।’ (রবীন্দ্রনাথ, ‘ছেলেবেলা’ পৃষ্ঠা ১২)।
আগেই বলা হয়েছে যে তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান ছিল না। বৈঠকখানায় বড় হাতপাখা বা টানাপাখা (পরে দেখুন) দিয়ে গরমের দিনে বাবুদের ক্লান্তি দূর করা হত। কোর্টকাছারিতে হাকিমদের জন্যও এই ব্যবস্থা ছিল। গরমের দিনে অন্তপুরিকারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেত, রান্নাঘরে জ্বালানী কাঠের আগুনের তেজে ও রান্নাঘরের বাইরে অবরুদ্ধ অন্তঃপুরে সূর্যের তাপে। রাত্রি বেলায় সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের লেকেরা ঘরে না শুয়ে ছাদে আশ্রয় নিত। গরমের দিনে ছাদে শোয়াটা আরামদায়ক ছিল দুই কারণে। ছাদের ওপর হাওয়াটা পাওয়া যেত। আর হাওয়াটা থাকার দরুন মানুষ মশার উৎপাত থেকে রেহাই পেত। যারা ঘরে শুতো, তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল তালপাতার হাত পাখা। সেজন্য যারা ঘরে শুতো তাদের খুব ঘামাচি হতো।
এসবই আমার ছেলেবেলার কথা বলছি। তার মানে বিংশ শতাব্দীর মুখপাতের কথা। এবার বলি গরমকালে আমাদের স্কুলে কি ঘটত। গরমকালে স্কুলে টানাপাখা টাঙানো হত। এগুলো হচ্ছে প্রায় স্কুল-ঘরের প্রস্থ পরিমাণ কাঠের ডাণ্ডায় বাঁধা হাত-দুই তিন- চার-প্রস্থ কাপড়, যা ঝুলানো থাকত একটা কাঠের ডাণ্ডায়। তিন-চারখানা টানাপাখা টাঙানো হত প্রতি ঘরে। একগাছা লম্বা দড়ি দিয়ে পাখাগুলো পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা থাকত। দু’দিকেই দড়ির প্রান্ত নেমে আসত মেঝে পর্যন্ত এবং দু’জন লোক দু’দিকে মেঝের ওপর বসে সেগুলো টানতো। পাখা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে যখন তাদের একটু তন্দ্রার ভাব আসত তখন আমরা ছেলের দল চেঁচিয়ে উঠতাম— ‘পাখাওয়ালা, পাখা খিচ।’ আমার সহপাঠীদের মধ্যে যারা একটু দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল, যেমন ছোনে মুজমদার (যে পরবর্তীকালে ফুটবল খেলার মাঠে প্রখ্যাত হয়েছিল) পাখা ওয়ালার সঙ্গে সম্বন্ধীর সম্বন্ধ পাতিয়ে বলে উঠত—‘এই শালা পাখা ওয়ালা, মারেগা লাথ, জোরসে পাখা খিচ।’ তবে খুব গরমের সময় (বোশেখের মাঝামাঝি সময় থেকে রথযাত্রার পর পর্যন্ত) স্কুল বন্ধ থাকত। একে ‘সামার ভেকেশন’ বলা হত। হাইকোর্ট এ সময় তিনমাস বন্ধ থাকত। আর লাটসাহেব ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এ সময় দার্জিলিং, সিমলা বা অন্য কোন শৈলাবাসে যেত।
বোশেখ মাস হলেই বাড়ির মেয়েরা তুলসী গাছের ‘ওপর ঝারা’ বেঁধে দিত। আর ছোট ছোট মেয়েরা প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠেই সাজি হাতে ফুল সংগ্রহ করতে বেরোত। তারপর বাড়ি ফিরে এসে মাটি দিয়ে শিবঠাকুর তৈরি করে শিবপূজা করত। যে মন্ত্র বলত, তার কোনও মাথামুণ্ড ছিল না। যেমন ‘শিল শিলেটন শিলে বাটন, গৌরী আছেন ঘরে’ ইত্যাদি; সবশেষে প্রার্থনা করত ‘যেন শিবের মত বর পাই।’ মেয়েদের আরও অনেক ব্রত ছিল। মেয়েদের কৃত এইসব ব্রতপালন এমন একটা আবহ ও ব্যস্ততা সৃষ্টি করত যে তারা গরমের প্রকোপটা ভুলেই যেত। সধবারা এ সময় করত সাবিত্রী ব্রত। সাবিত্রী ব্রত খুব ঘটা করে করা হত। এতে অনেক লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হত। আবার বিধবারা বোশেখ মাসে কলসী উৎসর্গ করত। কলসী উৎসর্গ মানে জলভরা কলসী ব্রাহ্মণকে দান করা।
সেকালের গরমকালে মানুষ ফল খাবার এক মহাসুযোগ পেত। ফলের ছিল মহাসমারোহ—আম, কাঠাল, জাম, জামরুল, ফুটি, তরমুজ, লিচু, তালশাঁস, কালোজাম, গোলাপজাম, ফলসা, বৈচি, টেপারি ইত্যাদি। সবই ছিল খুব সস্তা। ত্রিশের দশক পর্যন্ত এক ঝুড়ি (৮০ টা) ল্যাংড়া আম বারো আনা থেকে এক টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। কালোজাম এক পয়সায় দু কুড়ি থেকে তিন কুড়ি। তালশাঁস এক পয়সায় চার খানা। দেখতাম কাবলিওয়ালারা আট আনায় একটা বড় কাঁঠাল কিনে বাজারে বসেই গোটা কাঁঠালটা খেয়ে ফেলত। ফলের সময় বৈবাহিক বাড়িতে একটা ‘ফলের তত্ত্ব’ করা হত। এটা ছিল সেকালের একটা ফালতু তত্ত্ব। কেননা এরপরই আসত জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব। জামাইষষ্ঠীর তত্ত্বতেও থাকত প্রচুর ফল।
গরম পড়লেই অফিসের জানালা-দরজায় টাঙানো হত খসখসের টাটি। আধঘণ্টা অন্তর পানিওয়ালা এসে পিচকারী দিয়ে জল ছিটিয়ে খসখসের টাটিগুলোকে ভিজিয়ে দিয়ে যেত। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত খসখসের টাটি কলকাতার অফিসসমূহে গরমের আসান ছিল। তারপর ‘এয়ার কণ্ডিশনিং’ প্রবর্তিত হবার পর খসখসের টাটি অন্তর্হিত হয়।