1 of 2

কলকাতার মসজিদ গির্জা ও অন্যান্য ধর্মস্থান

কলকাতার মসজিদ, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মস্থান 

হিন্দু মন্দিরের মত কলকাতায় মুসলমানদের মসজিদেরও ছড়াছড়ি। প্রতি রাস্তায় ও মুসলমান পাড়ার অলিতে গলিতে মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে বিনয় ঘোষ মশায় যে বলেছেন—”কলকাতা শহরে গত কয়েক বছরের মধ্যে যত্রতত্র করপোরেশনের জায়গায় যে ভাবে মন্দির গড়ে উঠেছে মসজিদ সেভাবে গড়ে উঠেনি, ওঠা সম্ভবপরও নয়” এটা ভুল। নিউ মার্কেটের পূর্বদিকের মসজিদটাই তার দৃষ্টান্ত। এটা বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে করপোরেশনের জায়গার ওপরই নির্মিত হয়েছে। তিনি আরও একটা ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেছেন যে নাখোদা মসজিদ ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের দাঙ্গা- হাঙ্গামার সময় স্থাপিত হয়। নাখোদা মসজিদ ওখানেই বরাবর ছিল। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর, এই মসজিদটাকে মাত্র এর বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছিল। মসজিদটা কচ্ছী মুসলমানগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। 

কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন হিন্দুমন্দির যেমন গান ফাউণ্ডারি রোডের পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত চিত্তেশ্বরীর মন্দির, মুসলমানদেরও তেমনই সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হচ্ছে গান ফাউণ্ডারি রোডের পূর্বপ্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ ধারে অবস্থিত। এটা ইংরেজরা কলকাতায় আসবার আগে থেকেই ওখানে আছে। 

নাখোদা মসজিদের উত্তরে সিঁদুরিয়াপটির হাফিজ জালাউদ্দিনের মসজিদও খুব প্রাচীন। 

নাখোদা মসজিদকেই এখন কলকাতার বড় মসজিদ বলা হয়। তবে ধর্মতলা ষ্ট্রীট ও চৌরঙ্গীর মোড়ে অবস্থিত টিপু সুলতানের মসজিদটা ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দে টিপু সুলতানের ছেলে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ (যাঁর নামে দক্ষিণ কলকাতায় একটা রাস্তা আছে) প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন। টিপু সুলতানের বংশধররা কলকাতায় এসে প্রায় তেরটি বড় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ধর্মতলার মসজিদ ছাড়া, টালীগঞ্জের মসজিদটাই প্রসিদ্ধ। তবে ধর্মতলার মোড়ে ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান মসজিদটি নির্মিত হবার পূর্বে ওখানে যে একটা মুসলমানদের ধর্মস্থান ছিল, তা ওর পিছনের রাস্তার নাম থেকে প্রকাশ পায়। ১৭৮৪-১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মার্ক উড কর্তৃক অঙ্কিত যে ম্যাপখানা ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম বেইলী প্রকাশ করেছিলেন, তাতে বর্তমান ধর্মতলার মোড়ের পিছনের রাস্তাটিকে ইমামবাড়ী লেন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তা থেকেই বোঝা যায় যে ওখানে মুসলমানদের একটা ধর্মগৃহ ছিল। 

টিপু সুলতানের বংশধরদের মত মুরশিদাবাদের নবাব বংশও উত্তর ও মধ্য কলকাতায় অনেকগুলি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে চিৎপুরের গোলকুঠি ও মানিকতলার কারবালা প্রসিদ্ধ। মেটিয়াবুরুজে অযোধ্যার নবাব বংশও অনেকগুলি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চিৎপুরের নবাবরাও (নায়েব-দেওয়ান রেজা খাঁর বংশধররা) কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। শ্যামবাজারে রামরতন বসু লেনের ভিতর ও আপার সারকুলার রোডে (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) মোহনবাগান লেনের বিপরীত দিকে অবস্থিত মসজিদগুলি আমি আমার ছেলেবেলা (বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ) থেকেই দেখে আসছি। এ ছাড়া, পার্কসার্কাস, কড়েয়া, বেকবাগান, ওয়েলেসলি, তপসিয়া, রাজাবাজার, কলাবাগান, নারকেলডাঙ্গা প্রভৃতি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলেও বহু মসজিদ আছে। শিয়ালদহের কুতুবুদ্দিন সরকারের মসজিদ, চিৎপুরের ভোঁসড়ি শাহের মসজিদ ও দরগা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের মানিক পীরের দরগা, ক্লাইভ স্ট্রীটের জুম্মা পীরের দরগা, হেষ্টিংস-এ রজব আলির দরগা, কাশিয়াবাগানে উজির আলি আসফ জার কবর প্রভৃতির নামও উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৪ খ্রীষ্টাব্দে সিদ্দিকি যে সমীক্ষা করেছিলেন তাতে বলা হয়েছে যে কলকাতায় প্রায় ৫০০ মসজিদ আছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে সুন্নী সম্প্রদায়ের মসজিদ। মসজিদ ছাড়া, সিদ্দিকির সমীক্ষা অনুযায়ী কলকাতায় ১৩টি পীরের দরগা ও 

ছয়টি খানকা আছে। পীরের দরগাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চিৎপুর বাগবাজার খাল-পুলের উত্তরে অবস্থিত ঘোর সাহেবের আস্তানা। এখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই পূজা দেয়। ঘোর সাহেবের আস্তানার দক্ষিণেও একটা মসজিদ আছে। 

***

হিন্দুদের যেমন মন্দির ও মুসলমানদের তেমনি মসজিদ, সাহেবদের তেমনি গির্জা। ব্রেবোর্ন রোডে অবস্থিত সেন্ট নাজারথের আরমেনিয়ান চার্চই হচ্ছে কলকাতার ক্রীশ্চান উপাসনার সবচেয়ে প্রাচীন স্থান। ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ২২ জুন তারিখে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সহিত আরমেনিয়ানদের যে চুক্তি হয়, সেই চুক্তি অনুযায়ী ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে আরমেনিয়ানরা একটি ছোট প্রার্থনাগৃহ স্থাপন করে। এই প্রার্থনাগৃহটি বর্তমান সেণ্ট নাজারথের গির্জার ১০০ গজ দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। বর্তমান স্থানের গির্জাটি ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। এই গির্জার সংলগ্ন কবরখানায় এক সমাধি প্রস্তরে লেখা আছে- ‘Rezebeebeh, the wife of the late charitable Sookeas. departed this world to life eternal on the 21st day of Nakha in the year 15”. সালটা হচ্ছে Julpha সনের, এবং সেই অনুযায়ী তারিখটা হচ্ছে ১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১১ জুলাই। এই পাথরখানা থেকে জায়গাটার প্রাচীনত্ব বোঝা যাচ্ছে। (এ সম্বন্ধে যে সব বিতর্ক আছে, আমি বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সেগুলো সবই ভ্রান্তিমূলক। মনে হয়, আমার এ উক্তি কেউ চ্যালেঞ্জ করবেন না। যদি করেন, আমি আগে থাকতেই বলে রাখছি, তিনি হাস্যাস্পদ হবেন)। 

১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার আরমেনিয়ান বণিক আগা নজরের নেতৃত্বে যে গির্জাটি নির্মিত হয়, সেটারই নাম দেওয়া হয় সেণ্ট নাজারথের চার্চ। কলকাতায় আরমেনিয়ান জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, ছোট প্রার্থনাগৃহটিতে উপাসনার জন্য স্থান সঙ্কুলান না হওয়াতেই বড় গির্জাটি তৈরী করা হয়েছিল। ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে গির্জাটির নির্মাণ কার্য করেছিলেন একজন আরমেনিয়ান স্থপতি, নাম লিওন গ্যাভোনা। কলকাতায় তখন ভাল স্থপতির অভাব ছিল বলে, তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল পারস্য দেশ থেকে। ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দে আগা হজরমলের ছেলে আগা ম্যানুয়েল গির্জাটির শিখর তৈরী করে দেয়। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে আগা পেট্রাস অ্যারাটুনের অর্থে গির্জাটির সংস্কার করা হয়। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে আগা ক্যাচিক আরাকিয়েল নামে কলকাতার এক প্রসিদ্ধ আরমেনিয়ান বণিক গির্জাটির সংবর্ধন করেন। গির্জাটির মধ্যে বহু প্রাচীন সমাধি প্রস্তর আছে। বর্তমান শতাব্দীর চল্লিশের দশকে গির্জাটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। 

ইংরেজদের কলকাতায় আসবার সমসাময়িক কালের আর একটি গির্জা হচ্ছে মূরগীহাটার পর্তুগীজ রোমান ক্যাথলিক গির্জা। এ গির্জাটির উদ্ভব হয় এক চালাঘরে অবস্থিত প্রার্থনাগৃহ থেকে। ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে মতী মেরিয়া টেনচ্ নামে এক মহিলার অর্থে ইটের গির্জাটি নির্মিত হয়। ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে মতী সেবাষ্টিয়ান শ’ গির্জাটির সংবর্ধন করেন। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিরাজ কর্তৃক কলকাতা আক্রমণের সময় গির্জাটির কিছু ক্ষতি হয়েছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় নি। ক্লাইভ কর্তৃক কলকাতার পুনরুদ্ধারের পর ইংরেজরা উপাসনার জন্য এই গির্জাটিতেই আসতেন। ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগীজরা পুরানো গির্জাটির স্থানে একটি নূতন গির্জা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ১২ তারিখে গির্জাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ করতে দু বছর সময় লেগেছিল। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর তারিখে “The Virgin Mary of Rosary’র নামে গির্জাটি উৎসর্গীকৃত করা হয়। নূতন গির্জাটি নির্মাণ করাত ৯০,০০০ টাকা খরচ পড়েছিল, তার মধ্যে ৩০,০০০ টাকা গির্জার ভাণ্ডার থেকে দেওয়া হয়েছিল ও বাকী টাকা চাঁদা তুলে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই গির্জাটির সমাধিভূমিতেও কলকাতার অনেক প্রাচীন সাহেবের কবর আছে। গির্জাটি ১৫ নং পর্তুগীজ চার্চ লেনে অবস্থিত। 

ইংরেজরা কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর প্রথম যে গির্জাটি স্থাপন করেছিল, সেটি হচ্ছে সেণ্ট আস গির্জা। এটা বর্তমান রাইটারস্ বিলডিং-এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত ছিল। আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন বলে গেছেন যে এই সুন্দর ও উচ্চ শিখর বিশিষ্ট গির্জাটি পুণ্যবান নাবিকদের দাক্ষিণ্যে নির্মিত হয়েছিল। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে এই গির্জার মহিমাতেই তাদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। আনুমানিক ১৭১৩ খ্ৰীষ্টাব্দ নাগাদ গির্জাটি তৈরী হয়েছিল। ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ঝড়ে গির্জাটির শিখর ধ্বসে পড়ে। তারপর ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিরাজ কর্তৃত্ব কলকাতা আক্রমণের সময় আশপাশের অন্যান্য ঘরবাড়ীর সঙ্গে এই গির্জাটিও ধ্বংস হয়। এই গির্জার শেষ যাজক রেভারেণ্ড গারভাস বেলামী অন্ধকূপ হত্যার সময় মারা যান। 

১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সেণ্ট আন গির্জা নষ্ট হয়ে যাবার পর, ইংরেজরা আরাধনার জন্য ওই গির্জার দক্ষিণে একটি ‘চ্যাপেল’ বা প্রার্থনাগৃহ তৈরী করে নিয়েছিল। এটা পুরানো দুর্গের ভিতরই অবস্থিত ছিল। ২৭ বৎসর যাবৎ পুরানো দুর্গের এই প্রার্থনাগৃহটাই ‘প্রেসিডেন্সি চার্চ’ হিসাবে কার্যকর ছিল। তবে অনেকে মুরগীহাটার পর্তুগীজ গির্জাতেও প্রার্থনা করতে যেতেন। ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ক্লাইভ কর্তৃক আহুত হয়ে একজন সুইডিশ মিশনারী দাক্ষিণাত্য থেকে কলকাতায় আসেন। নাম জন জ্যাকেরিয়া কিয়েরনাণ্ডার। তিনি সস্ত্রীকই কালকাতায় এসছিলেন। ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ৪ নভেম্বর তারিখে এই ধর্মযাজকের কলকাতায় একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের আগেই তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় আসবার পর তিনি এখানে একটা মিশন স্কুল স্থাপন করেন। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় একটি পর্তুগীজ প্রটেষ্টান্ট গির্জা স্থাপনের জন্য গভর্নর ভ্যানসিটার্টের কাছে আবেদন করেন। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ নভেম্বর তারিখে কলকাতা কাউনসিলের অধিবেশনে এক প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ‘যে বাড়িটায় আগে কালেক্টরের অফিস ছিল এবং যেখানে চ্যারিটি স্কুল বসত, সেই বাড়িটা কিয়েরনাণ্ডারকে গির্জা হিসাবে ব্যবহার করতে দেওয়া হউক’। কিন্তু চার বছর পরে ওই বাড়িটা সরকারী কাজের জন্য প্রয়োজন হওয়াতে কিয়েরনাণ্ডার নিজেই একটি গির্জা স্থাপন করতে প্রবৃত্ত হন। গির্জাটি মিশন রো-তে অবস্থিত। নাম মিশন চার্চ। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মধুসূদন দত্ত এখানেই খ্রীষ্টধর্ম দীক্ষা নিয়েছিলেন। গির্জাটি নির্মাণ করতে কিয়েরনাণ্ডার যে অর্থ ব্যয় করেছিলেন তার প্রায় সবটাই ছিল তাঁর প্রথমা স্ত্রী মতী ওয়েণ্ডালার-এর। ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে ওয়েণ্ডালার মারা যাবার পর কিয়েরনাণ্ডার মতী আনা উলী নামে এক বিধবাকে বিবাহ করেন। সেও তার গহনাপত্র গির্জাটির উপকারার্থে দান করে। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে চোখে ছানি পড়ার জন্য কিয়েরনাণ্ডার তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান। তখন তাঁর ছেলে রবার্ট গির্জাটির ভার নেয়। কিয়েরনাণ্ডারের ক্যামাক স্ট্রীট ও ভবানীপুরে (যেখানে পরে লণ্ডন মিশনারী সোসাইটি অবস্থিত ছিল) দুখানা বাড়ী ও অন্যান্য বিষয়-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তার ছেলে নানারকম ‘extravagant speculation-এ টাকাটা উড়িয়ে দেয়। ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে কিয়েরনাণ্ডার যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন তখন তিনি দেউলিয়া। পাওনাদারদের ভয়ে চুঁড়ায় ওলন্দাজদের কুঠিতে আশ্রয় নেন। কিয়েরনাণ্ডারের সম্পত্তি যখন নীলামে উঠল তখন গির্জাটিকে নীলামদারদের হাত থেকে বাঁচালেন মালদহের চার্লস গ্রান্ট সাহেব। তিনি নীলামদারদের ওর মূল্য বাবদ দশ হাজার টাকা দিয়ে দেন। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে গির্জা, স্কুল ও পার্ক ষ্ট্রীটের কবরখানা তিনজন ট্রাষ্টির হাতে দেওয়া হয়। ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে চুঁচুড়া অবরোধের সময় কিয়েরনাণ্ডার ইংরেজদের হাতে বন্দী হন। সেই সুযোগে তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন ও তাঁর বিধবা পুত্রবধূর গৃহে আশ্রয় পান। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মারা যাবার সময় পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। 

কিয়েরনাণ্ডারের গির্জার পর ইংরেজরা যে গির্জা স্থাপন করেছিল, তা হচ্ছে চার্চ লেনে অবস্থিত সেণ্ট জনস্ গির্জা। সোফিয়া গোলডবরন তাঁর ‘হার্টলে হাউস’-এ বলেছেন যে ইংরেজরা যখন ময়দানে নূতন দুর্গ নির্মাণ করেছিল, তখন তার ভিতর একটা গির্জা স্থাপন করেছিল। কিন্তু সে গির্জার কোন সন্ধান পরবর্তীকালে পাওয়া যায় নি। ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম জনসন (কলকাতার বেগম’-এর শেষ স্বামী) নামে এক পাদরী কোম্পানির কাউনসিলের কাছে কলকাতায় এক নূতন গির্জা স্থাপনের জন্য আবেদন পেশ করেন। এর জন্য জনসনকে অনেক আন্দোলন করতে হয়েছিল। কিন্তু ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে এ সম্বন্ধে কিছু বিশেষ উদ্যোগ লক্ষিত হয়নি। ওই বছরেরই ৩ এপ্রিল তারিখে এই উদ্দেশ্যে পুরানো জমিটা মহারাজ নবকৃষ্ণদেব বাহাদুরের কাছ থেকে (যা উনি ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারী তারিখে নীলাম থেকে কিনেছিলেন) ১০,০০০ টাকা মূল্যে খরিদ করা হয়। ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ওটা একটা গির্জা নির্মাণের জন্য চিরস্থায়ী ট্রাষ্টির হাতে দেন। ওই বছরেই পাদরী জনসন এক লটারীর মাধ্যমে ৩০,০০০ টাকা তোলেন। নির্মাণ করতে তিন বছর সময় লেগেছিল। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ জুন তারিখে এই গির্জা উৎসর্গীকৃত করা হয়। ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে ড্যানিয়েল ও ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম বেইলী অঙ্কিত ছবি থেকে দেখা যায় যে ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে যে বারান্দা নির্মিত হয়েছিল, তা ছাড়া গির্জার মৌলিক রূপই বর্তমান ছিল। 

১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার একজন বিশপ নিযুক্ত হয়। প্রথম চারজন বিশপ হচ্ছেন মিডলটন, হেবার, জেমস্ ও টারনার। এঁরা সেণ্ট জন চার্চেই অভিষিক্ত হন। কেননা, ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে কলকাতায় কোন ক্যাথিড্রাল চার্চ বা বড় গির্জা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়নি। ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর তারিখে ময়দানে বর্তমান স্থানে অবস্থিত সেন্ট পলস্ গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কলকাতার এই বড় গির্জাটির স্থপতি ছিলেন ডবলিউ. এন. ফরবস্। গির্জাটি ‘ইণ্ডো-গথিক’ রীতিতে নির্মিত হয়েছিল। গির্জাটি লম্বায় ২৪৭ ফুট, চওড়ায় ৮১ ফুট ও উচ্চতায় ২০১ ফুট। বিশপ উইলসন ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর তারিখে গির্জাটির উদ্বোধন করেন। 

এবার কলকাতার অন্যান্য গির্জাগুলির একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও তালিকা দিচ্ছি—

১। সেণ্ট এন্ড্রুজ গির্জা বা ‘স্কটিশ গির্জা’। 

গির্জাটি রাইটারস বিলডিং-এর পূর্বদিকে অবস্থিত। যেখানে গির্জাটি অবস্থিত, ওখানেই কলকাতার পুরাতন আদালত ছিল। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর তারিখে গির্জাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, এবং ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ৮ মার্চ তারিখে গির্জাটি প্রার্থনাগৃহ হিসাবে সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ৪,৯০০ টাকা ব্যয়ে একটি ঘড়ি গির্জাটির শীর্ষদেশে স্থাপিত করা হয়। 

২। লালবাজারের ব্যাপটিষ্ট চ্যাপেল। ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী তারিখে রামপুরের মিশনারীত্রয় ক্যারী, মারশম্যান ও ওয়ার্ড গির্জাটি স্থাপন করেন। 

৩। ৪৩ নং লোয়ার সারকুলার রোডে অবস্থিত ব্যাপটিষ্ট চার্চ। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। 

৪। ওয়েলেসলী স্কোয়ারের ‘ফ্রি চার্চ’। ডঃ আলেকজাণ্ডার ডাফের প্রচেষ্টায় গির্জাটি নির্মিত হয়। নির্মাণের সময় ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারী তারিখের রাতে গির্জাটির ছাদ ধ্বসে পড়ে। তারপর ১, ১৫, ৫৮ টাকা ব্যয়ে গির্জাটি পুনর্নির্মিত করা হয়। 

৫। ৯ নং মিরজা গালিব স্ট্রীটে অবস্থিত সেন্ট টমাস চার্চ। ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারী তারিখে উদ্বোধন হয়। 

৬। ফোর্ট উইলিয়ামের সেন্ট পিটারস্ চার্চ। ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। 

৭। আমড়াতলা স্ট্রীটের গ্রীক চার্চ। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এখন গ্রীক চার্চ কালীঘাটে ২-এ লাইব্রেরী রোডে অবস্থিত। 

৮। ৯২ নং লোয়ার সারকুলার রোডে অবস্থিত সেন্ট টেরেসা চার্চ। 

৯। সেন্ট জেভিয়ারস্ কলেজের মধ্যে অবস্থিত চার্চ। 

১০। পার্ক সার্কাসে সৈয়দ আমির আলি অ্যাভেন্যুতে অবস্থিত ক্রাইষ্ট দি কিংগ চার্চ।

১১। ৩নং লেনিন সরণীতে অবস্থিত সেকরেড হার্ট চার্চ। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত।

১২। ১৫১ নং লেনিন সরণীতে অবস্থিত থোবার্ন মেথোডিষ্ট চার্চ। 

১৩। ১৮ নং রায় ষ্ট্রীটে অবস্থিত অ্যাসেমব্লী অফ গড চার্চ। 

১৪। ১৩৬ নং লেনিন সরণীতে অবস্থিত ইউনিয়ন চ্যাপেল। ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত। ১৫। ১৩০ নং লেনিন সরণীতে অবস্থিত সেন্ট্রাল এপিসকোপাল মেথডিষ্ট চার্চ। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত 

১৬। ১৬৬ নং লোয়ার সারকুলার রোডে অবস্থিত সেণ্ট টমাস চার্চ। ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত। 

১৭। ৫৬-সি সুরেন্দ্র ব্যানারজি রোডে অবস্থিত মেথডিষ্ট চার্চ। 

১৮। ৮৫ নং সুরেশ সরকার রোডে অবস্থিত ব্যাপটিষ্ট চার্চ। 

১৯। ৫১ নং একবালপুর রোডে অবস্থিত সেণ্ট ইগনেটিয়াস চার্চ। 

২০। ৬৮ নং বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী রোডে অবস্থিত সেন্ট জেভিয়ারস্ চার্চ। ২১। ৩০৮ নং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে অবস্থিত সেন্ট জনস্ চার্চ। 

২২। ৯২ নং রিপন ষ্ট্রীটে অবস্থিত সেন্ট মেরী চার্চ। 

২৩। ৯ নং মিডলটন রোডে অবস্থিত সেন্ট টমাস প্রেসবিটারী। 

২৪। ১৮২ নং বিধান সরণীতে অবস্থিত ক্রাইষ্ট চার্চ। ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত। ‘কৃষ্ণ বন্দ্যোর গির্জা’ নামে পরিচিত। নূতন ভবন ১৮৯৫। 

২৫। ৫ নং ডায়মণ্ড হারবার রোডে অবস্থিত সেন্ট স্টিফেনস্ চাৰ্চ। 

বাঙালী বৌদ্ধদের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা। বৌবাজার থানা ও পুলিশ কোয়ার্টারের গায়ে নালন্দা পার্কের পূর্বদিকে বৌদ্ধদের এই ধর্মমন্দির অবস্থিত। রাস্তার নাম বুদ্ধিষ্ট টেম্পল স্ট্রীটে (আগের নাম ললিতমোহন দাস লেন)। ভিতরে এক ইতালীয় ভাস্করের নির্মিত মহাস্থবির কৃপাশরণের উপবিষ্ট মূর্তি। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ২২ জুন চট্টগ্রামের পটীয় থানার উলাইলাপুর গ্রামে কৃপাশরণের জন্ম হয়। শৈশবে পিতার মৃত্যু হয়। মাতা আরাধনা বড়ুয়া পুত্রকে বুদ্ধের চরণে নিবেদন করেন। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুর ব্রত নেন। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা স্থাপন করেন। 

বৌদ্ধদের অপর এক কেন্দ্র কলেজ স্কোয়ারে অবস্থিত মহাবোধি সোসাইটি। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে অনাগরিক ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এদের হলঘরে বহু সভাসমিতির অধিবেশন হয়। 

* * *

পার্শীদের ধর্ম মন্দির অবস্থিত ৯১ মেটকাফ স্ট্রীটে। এর দোতলার ঘরে আছে অনির্বাণ অগ্নিশিখা। পার্শীরা এই অনির্বাণ অগ্নিশিখারই উপাসক। পার্শীরা প্রথম ভারতে আসে ১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে। কলতাতায় এসে তারা প্রথম মন্দির নির্মাণ করে ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ২৬ নং এজরা স্ট্রীটে। পরে এটা মেটকাফ স্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয়। পার্শীদের ‘টাওয়ার অভ্ সাইলেনস্’ বেলিয়াঘাটা রোডে অবস্থিত। 

শিখদের ধর্মকেন্দ্র হচ্ছে গুরুদ্বার শিখ সংগত। এই সংস্থা ১৭২ নং মহাত্মা গান্ধী রোডে অবস্থিত। 

***

জৈনরা দুই শাখায় বিভক্ত। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর। দিগম্বরদের পরেশনাথ মন্দির ১ নং বসাক লেনে (বড়বাজারে) অবস্থিত ও বাগানের ঠিকানা ২৭ নং বেলগাছিয়া রোড। শ্বেতাম্বরদের সুন্দর মন্দির ও বাগান (দশম জৈন তীর্থঙ্কর শীতলনাথের) কলকাতার বিখ্যাত জহুরী বদ্রীদাস প্রতিষ্ঠিত। ২৯ নং বদ্রীদাস টেম্পল স্ট্রীটে গৌরীবেড়েতে অবস্থিত। মূল মন্দির বড়বাজারে কটন স্ট্রীটে বসাক লেনে। এটা স্থাপিত হয়েছিল ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে। গৌরীবেড়ের মন্দির স্থাপিত হয় ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে, আর বেলগাছিয়ার মন্দির ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *