কলকাতার বাবু-কালচার
বাবু-কালচারটা কি, এবং এই কালচারের নায়কদের কি কি লক্ষণ ছিল, তার একটা অনুপম বর্ণনা দিয়ে গেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। বাবু সমাজ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, “তাঁহারা পারসী ও স্বপ্ন ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন ধর্মে আস্থাহীন হইয়া ভোগে সুখেই দিন কাটাইত। ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব? মুখে, ভূপার্শ্বে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্নস্বরূপ কালিমারেখা। শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে ফিনফিনে কালো পেড়ে ধুতি। অঙ্গে অতি উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনট করা উড়ানী ও পায়ে পুরু ব্যগলস সমন্বিত চীনেবাড়ীর জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলের লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা ইত্যাদি বাজাইয়া, কবি হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত, এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া আসিত।”
আগে বলেছি যে, এই বাবু সমাজের উদ্ভব কলকাতা শহরেই ঘটেছিল। ইংরেজরা যখন কলকাতায় এসে শহর প্রতিষ্ঠা করে, তখন তাদের সংস্পর্শে এসে যারা রাতারাতি বড়লোক হয়, তাদের প্রভাবেই ‘বাবু-সমাজ’ গড়ে উঠেছিল। ‘বাবু সমাজ’ নামটা দিয়েছিল গ্রামের লোকেরা। কেননা, বাবু সমাজের আচার-ব্যবহার, চিত্তবৃত্তি, বাক্কৌশল, বেশভূষা, পোষাক-আশাক ও জীবনযাত্রা প্রণালী চমক লাগিয়ে দিয়েছিল গ্রামের লোকদের। ধনপ্রাচুর্যের অভিমান-অহংকারের ওপরই এ সমাজের ওপরতলা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা কমলালয়’ বইয়ে কলকাতার বাবু সমাজের পয়সা উপায়ের নানারকম পন্থার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘এরা বনিয়াদী বড় মানুষ নয়, ঠিকাদারী, জুয়াচুরি, পোদ্দারী, পরকীয়া রমণী সংঘটন ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করে বড়লোক হয়েছেন।’
মুখ্যত, দেওয়ানী ও বেনিয়ানগিরিই এদের পেশা ছিল। দেওয়ানী ছিল চাকরী বা গোলামী করা। মনিবের হয়ে তারা মনিবের ব্যবসা (প্রধানত লবণ ও আফিমের ব্যবসা) দেখতেন, জমিদারীর তদারকী করতেন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কাজকর্মের দায়িত্ব পালন করতেন। এক কথায়, দেওয়ানরাই ছিল মনিবের কর্মক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ হর্তাকর্তা বিধাতা। দেওয়ানদের অর্থপ্রাচুর্যের বহর দেখে বেশ বুঝা যায় যে তারা চুরি-চামারী করে মনিবের টাকা রীতিমত ফাঁক করে দিত। আর, বেনিয়ানী ছিল, যাকে বলে মহাজনী কারবার। এরা বণ্ড লিখিয়ে নিয়ে সাহেবসুবোদের টাকা ধার দিত। বিলাসিতার জন্য সাহেবদের প্রায়ই টাকার দরকার হত, এবং সে সময় তারা বেনিয়ানদের শরণাপন্ন হত। ব্যবসার জন্য মূলধন নিয়োগই হউক, বা পণ্যদ্রব্য কেনাবেচার কারণেই হউক, সাহেবদের পদে পদে বেনিয়ানদের ওপর নির্ভর করতে হত। এরূপ টাকা ধার দেবার জন্য বেনিয়ানদের মাঝে মাঝে মার খেতেও হত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধার দেওয়া টাকার অঙ্কটা সুদে আসলে এমনভাবে স্ফীত হয়ে উঠত যে তারা অল্পকালের মধ্যেই বড়লোক হয়ে দাঁড়াত। ভবানীচরণ এঁদের ‘বনিয়াদী বড় মানুষ নয়’ বললেও, এরাই কলকাতা শহরের বনিয়াদী পরিবার-সমূহের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে দাঁড়ায়। পদের ও ধনের গরিমা প্রদর্শন করাই এদের বৈশিষ্ট্য ছিল। এমন কি পূজাপার্বণও এদের কাছে ধনগরিমা প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ভবাণীচরণ বলেছেন, ‘কলকাতার দুর্গোৎসব দেবার্চনা না বলে, ঝাড় উৎসব, বাতি উৎসব, কবি উৎসব, বাঈ উৎসব, কিম্বা স্ত্রীর গহনা উৎসব ও বস্ত্রোৎসব বলিলেও বলা যায়।’ এক একজন ছেলেমেয়ের বিয়েতে বা বাপমায়ের শ্রাদ্ধে দু লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করত। অনেকে আবার সখ করে বিড়ালের বিয়েতেও এরূপ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করত। পয়সা উপার্জনে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য, তারা এইসব উৎসবে সাহেব-মেমদের নিমন্ত্রণ করত। এবং তাদের আপ্যায়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সুরাপান ও নিষিদ্ধ খানাপিনার ব্যবস্থা করত।
ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে ‘বাবু সমাজ’ আচারভ্রষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু গোড়া থেকেই এরা এমন একটা কৌশল অবলম্বন করেছিল, যাতে এদের ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে নিষ্ঠাবান সমাজের কেউ কিছু না বলতে পারে। এরা বড় বড় পণ্ডিতদের কলকাতায় এনে নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের দিয়ে টোল ও চতুস্পাঠী স্থাপন করিয়েছিল। এই সকল অধ্যাপকের বিধানের একটা নিদর্শন ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ জুলাই তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এর স্তম্ভে ছাপা হয়েছিল। ‘বাবু জিজ্ঞাসা করেন, ভট্টাচার্য মহাশয় সুরাপানে কি পাপ হয়? উত্তর : ইহাতে পাপ হয় যে বলে, তাহার পাপ হয়। ইহার প্রমাণ আগম ও তন্ত্রের দুইটা বচন আভ্যাস দিলেন, পাঠ করিলেন এবং কহিলেন মদ্য ব্যতিরেকে উপাসনাই হয় না। বলরাম ঠাকুরও মদ্যপান করিয়াছিলেন। বাবু তুষ্ট হইয়া ভট্টাচার্যকে টোল করিয়া দিলেন।’ ভবাণীচরণও একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এক বাঙ্গাল ব্রাহ্মণ বাবুকে উপদেশ দিচ্ছে যে পরদার ও যবনী বেশ্যা সম্ভোগে ও সুরাপানে পাপ হয়। কুলপুরোহিত শিরোমণি তাকে নির্বোধ বলে গালি দিয়ে বলছেন——আগতা ভৈরবীচক্রে সর্বেবর্ণা দ্বিজোত্তমাঃ। পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে। মাতৃযোনীং পরিত্যজ্য বিহরেৎ সর্বযোনিষু ইত্যাদি।”
শিবনাথ শাস্ত্রী বাবু সমাজের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা বিশেষভাবে প্রযুক্ত এই সমাজের প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধরদের ক্ষেত্রে। এই বংশধররা কিভাবে শিক্ষিত হতেন, তার একটা পরিচয় পাওয়া যায় ‘সমাচার দর্পণ’-এর ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারী ও ৯ জুন তারিখের সংখ্যাদ্বয়ে প্রকাশিত ‘বাবুর উপাখ্যান’ থেকে। এই উপাখ্যানে বিবৃত হয়েছে, চক্রবর্তী একজন অতি বড় ধনবান কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। প্রথমাবস্থায় তিনি নানা রাজকীয় ও জমিদারী সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত থেকে ধনোপার্জন করেছিলেন। তারপর তিনি আফিমের কুঠির দেওয়ানী কর্মে নিযুক্ত হন। কৃত্রিম অকৃত্রিম আফিম তৈরী করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। পুত্রের জন্মের সময় তিনি যথেষ্ট দানাদি করেন ও বাড়িতে টিকটিকির নাচ ও ভেকের গান ইত্যাদি মাঙ্গলিক কর্ম করেন। অন্নপ্রাশনের সময় পুত্রের নামকরণের ব্যাপারে সভাসদ পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কুলাচার্য বললেন, ইনি কুলীনের ঔরসে জাত আর কুলীনের নয় লক্ষণ যথা ‘আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনং। নিষ্ঠা বৃত্তিস্তপোদানং নবধা কুললক্ষণম’ এই পুত্রের আছে, সেই হেতু এঁর নাম তিলকচন্দ্র রাখা হউক। কিন্তু প্রতিবাদের ঝড় তুলে বিদ্যালংকার বললেন, “আপনার এত ঐশ্বর্যে এ সন্তান হইয়াছে ইনি বাবু হইবেন। আমি গণনাদ্বারা অনুভব করিতেছি যে বাবুদের যে নয় লক্ষণ যথা—‘ঘুড়ী তুড়ী জস দান আখড়া বুলবুলি মনিয়া গান। অষ্টাহে বনভোজন এই নবধা বাবুর লক্ষণ” এই পুত্রে রহিয়াছে অতএব ইহার নাম বাবু রাখা হউক। অতঃপর সমন্বয় করে বাবুর নাম রাখা হল তিলকচন্দ্রবাবু। তারপর পুত্র বড় হতে লাগল, কথা বলতে শিখল। তিলকচন্দ্র সকলকেই কটুবাক্য বলে ও মারে। তাকে দমন না করে, সকলেই তাতে আহ্লাদ করে। তিলকচন্দ্রবাবু কোন অপকর্ম করলে তাকে শাস্তি না দিয়ে চক্রবর্তী দেওয়ান শিখিয়ে দেন যে, ‘তুমি কহ আমি করি নাই।’ এইরূপে বাবুকে নিয়ে সর্বদাই আমোদ হয়। তখন তিনি ‘বাবু’ নামে খ্যাত হলেন, কেহ আর তিলকচন্দ্ৰ বলে না। চক্রবর্তী বাবুকে লেখাপড়া শেখালেন না, বল্লেন ‘বামুনের ছেলে গায়ত্রী শিখলেই যথেষ্ট, যা সম্পত্তি রেখে যাব যদি রক্ষা করে খেতে পার কখনও দুঃখ পাবে না। ভাবলেন ‘পুত্রের অদৃষ্টে যাহা থাকে তাহাই হইবে, আমি দেখিতে আসিব না।’ ষোল বছর বয়স হবার পর বাবুর অনেক মোসাহেব ও উমেদার জুটে গেল। এদিকে চক্রবর্তী দেওয়ানেরও দেহান্ত হল। বাবু তখন ধনাধিপতি হয়ে, নিজেই কর্তা হলেন। বাবু সমস্ত রাত্রি বেশ্যালয়ে থাকেন। দীনদুঃখী আত্মীয়-স্বজনেরা যদি বাবুর নিকট আসে, বাবু তাদের ইংরাজী ঘুষা মারেন এবং কহেন যে ‘হামারা পিট্রল লে আও’ এই প্রকার ভয়ানক শব্দ করেন, তাতে দীন দুঃখীরা পলায়ন করে। বাবু কেবলই স্ত্রীলোকের সন্ধানে থাকেন। সেজন্য বাবুর নিকট যদি কোন লোক আসিয়া কয় যে অমুক লোক এই প্রকার দায়গ্রস্ত। বাবু তৎক্ষণাৎ গাড়ি আরোহণ করিয়া তাহার বাটীতে গিয়ে কহেন যে, এ তোমার কোন দায়, আমি সকল উদ্ধার করিব কিন্তু এইক্ষণে কিছু অস্পষ্ট থাকহ আর বৈঠকখানায় কেন বসিয়াছ বাটীর ভিতর চল সেইখানেই পরামর্শ করিব। বাটীর ভিতর গিয়া মিথ্যা আশ্বাসবাক্যে আকাশের চন্দ্র হাতে দিয়া স্ত্রীলোক কোন দিকে থাকে তাহার অনুসন্ধান করেন এবং ঐ চেষ্টাতে প্রত্যহ যাতায়াত করেন।
তারপর ‘বাবু কালচার’কে আশ্রয় করে কয়েকখানা বই লেখা হল। বইগুলি প্রকাশিত হল ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে। বইগুলার নাম ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নববাবুবিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ ও ‘দূতীবিলাস’। সমষ্টিগতভাবে এই বইগুলিকে ‘বাবু কালচার’-এর মহাভারত বলা যেতে পারে। বইগুলি সবই লিখেছিলেন স্বনামে ও বেনামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
যেহেতু ‘নববাবুবিলাস’ হচ্ছে সমসাময়িক কালের বাবু কালচারের একখানা বিশ্বস্ত দর্পণ, সেজন্য ওতে বাবুর যে পরিচয় পাওয়া যায়; তা সংক্ষেপে এখানে বিবৃত করা হচ্ছে। বাবুর মোসাহেবরা বাবুকে উপদেশ দিচ্ছে—”শুন বাবু টাকা থাকিলেই হয় না। ইহার সকল ধারা আছে। আমি অনেক বাবুগিরি করিয়াছি এবং বাবুগিরি জারিজুরি করিয়াছি এবং অনেক বাবুর সহিত ফিরিয়াছি, রাজা গুরুদাস, রাজা ইন্দ্রনাথ, রাজা লোকনাথ, তনুবাবু, রামহরিবাবু, বেণীমাধববাবু প্রভৃতি ইহাদিগের মজলিস শিখাইয়াছি এবং যেরূপে বাবুগিরি করিতে হয় তাহাও জানাইয়াছি। এক্ষণে বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত তথাপি ইচ্ছা হয় তুমি যেরূপে উত্তম বাবু হও এমত শিক্ষা দিই।’
‘প্রথম উপদেশ। যে সকল ভট্টাচার্যরা আসিয়া সর্বদা টাকা দাও, টাকা দাও, ঐ কথা বই আর অন্য কথা বলে না, তাহাদের কথায় কান দিবে না। আমার পিতার শ্রাদ্ধের সময় উহারা যখন কহিল, বাবু শ্রাদ্ধের কি করিব। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম যে শ্রাদ্ধের ফল কি? উহারা বলিল, পিতৃলোকের তৃপ্তি হয়। আমি বলিলাম, কোনকালেও শুনি নাই যে মরা গরুতে ঘাস জল খাইয়া থাকে। ভট্টাচার্য শেষে কহিল বাবুজী আর কিছু কর না কর, পিণ্ডদানটা করা আবশ্যক,তাহাতে আমি কহিলাম আজ আমি উত্তম বুদ্ধিমতী পরমধার্মিকা বকনাপিয়ারীর নিকট যাইব তাহারা যেরূপ পরামর্শ দিবে সেরূপ করিব। বকনাপিয়ারী আমাকে কহিল, ‘তুমি এক কর্ম কর এক ব্রাহ্মণকে ফুরাইয়া দাও, শ্রাদ্ধ দশপিণ্ড ব্রাহ্মণ ভোজনাদি যত কর্ম সেই করিবেক। আমিও তাবত কর্ম ফুরাইয়া দিলাম। অতএব নির্বোধ ভট্টাচার্যেরা আগমন করিলে কদাচ আসিতে আজ্ঞা হয় বসিতে আজ্ঞা হয় এরূপ বাক্য বলিবে না, যদ্যপি কিঞ্চিৎ দিতে হয়, তবে কহিবা সময়ানুসারে আসিবে। এইরূপ মাসেক দুই প্রতারণা করিয়া কিঞ্চিৎ দিবা।’
(এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভবানীচরণ বকনাপিয়ারীকে ‘বেশ্যাপ্রধানা বলে বর্ণনা করেছেন। মনে হয় যে, ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে জনৈক ‘ভাঁড়’ ‘সচিত্র গুলজারনগর’ (সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সুলিখিত ভূমিকা ও টীকা সমেত সম্পাদন করেছেন) নামে যে ব্যঙ্গাত্মক নকসা করেছিলেন, তাতে তিনি ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাস’ থেকেই ‘বকনাপিয়ারী’র নামটা আত্মসাৎ করেছিলেন। চিত্তরঞ্জনবাবু বা অন্য কারুর নজরে এটা পড়েনি।
দ্বিতীয় উপদেশ। গাওনা বাজনা কিছু শিক্ষা কর যাহাতে জিউ খুশী থাকিবে এবং যত বারাঙ্গনা আছে তাহাদিগের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিয়া ঐ বারাঙ্গনা- দিগের সর্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবে, কিন্তু যবনী বারাঙ্গনা সম্ভোগ করিবে; কারণ, তাহারা পেঁয়াজ রসুন আহার করে সেই হেতু তাহাদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবে এরূপ অন্য কোন রাঁড়েই পাইবে না। যদি বল যবনী বেশ্যা গমন করিলে পাপ হইবে তাহা কদাচ মনে করিবে না। যাদের পূর্বজন্মে অনেক তপস্যা থাকে তাহারাই উত্তম স্ত্রী সম্ভোগ করে। যদি বেশ্যা গমনে পাপ থাকিত, তবে কি উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা প্রভৃতি বেশ্যার সৃষ্টি হইত। তারপর পয়ার ছন্দে বললেন—‘কর গিয়া বেশ্যাবাজি, যদি বল কর্ম পাজি, মন শুচি হলে পাপ নয়। যাহার যাহাতে রুচি, সেই দ্রব্য তারে শুচি, তার তাতে হয় সুখোদয়। অন্য অন্য সুখের সৃষ্টি, করি বিধি পরে মিষ্টি, করিলেন সুখের সৃজন। বেশ্যাকচ বিমর্দন, যতনেতে আলিঙ্গন, আর তার শ্রীমুখ চুম্বন। বেশ্যার আলয়ে বাস, এইরূপ দিবানিশি,তুমি বাবু কর আচরণ। ইহাতে অন্যথা কভু মনে না ভাবিবে বাবু, হইবেক দুঃখ বিমোচন।’ (এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সমসাময়িককালে রাজা রামমোহন রায়ের এক যবনী রক্ষিতা ছিল। উমানন্দন ঠাকুরের এক প্রশ্নের উত্তরে রাজা রামমোহন রায় বলেছিলেন যে, ওরূপ যবনী রক্ষিতা শৈবমতে বিবাহিতা স্ত্রীর সামিল। ওই সময় আর একজন বড়লোক প্রসিদ্ধা বাইজী নিকীকে হাজার টাকা মাসিক মাহিনায় রক্ষিতা রেখেছিলেন।)
তৃতীয় উপদেশ। প্রতি রবিবারে বাগানে যাইবা মৎস্য ধরিবা সকের যাত্রা শুনিবা নামজাদা বেশ্যা ও বাই ইয়ারদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া বাগানে আনাইবা বহুমূল্য বস্ত্র, হার, হীরকাঙ্গুরীয়া ইত্যাদি দিয়া তুষ্ট করিবা। দেখিবে কি মজা হয়।
চতুর্থ উপদেশ। যাহার চারি ‘প’ পরিপূর্ণ হইবে তিনি হাফ বাবু হইবেন। চারি ‘প’ হইতেছে পাশা, পায়রা, পরদার ও পোষাক। ইহার সহিত যাহার চারি ‘খ’ পরিপূর্ণ হইবে তিনি পুরা বাবু হইবেন। চারি ‘খ’ হইতেছে খুশি, খানকী, খানা, খয়রাত।’
এরপর বাবু এই উপদেশমত উড়তে লাগলেন। টাকার খাকতি পড়ায় মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করলেন। মহাজনেরা আর যখন টাকা ধার দিল না তখন স্ত্রীর গহনা চুরি করলেন। তারপর বাবু রিক্তহস্ত হলেন। বেশ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিল ও দুমাসের খোরাকী বাবদ বাবুর নামে নালিশ করল। বাবুর দুমাস জেল হল। বাবুর পিতা টাকা দিয়ে বাবুকে খালাস করে নিয়ে এলেন। তারপর পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হলে, মুখাগ্নি করে বাড়ী এলেন। আত্মীয়-কুটুম্ব সকলে বলল, উহার জাত গিয়াছে, উহার বাটী যাওয়া হইবেক না? ইহা শুনিয়া গল-লগ্নীকৃতবাসা হইয়া দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করিলেন। শ্রাদ্ধের উপলক্ষে সমন্বয় হইল। তারপরে এক বাটী বানাইবার পরামর্শ করিলেন। যে বিষয় ছিল, বাটী বানাইতে খরচ হইয়া গেল, অবশিষ্ট কিছু বিষয় থাকিল পাঁচটি কন্যা সন্তানের বিবাহ দিতে হইবেক। বাবু ভাবিলেন, একদিনও স্ত্রীর সহিত বাস করিলাম না, তথাপি এ কি যাতনা। কন্যাদিগের বিবাহ না দিলে জাতি রক্ষা হয় না, ক্রমে পাঁচ কন্যার বিবাহ দিলেন, ধনের শেষ হইল। পরিবার প্রতিপালনার্থ দায়গ্রস্ত হইলেন। শেষে বাটীর পাট্টা বন্ধক কর্জ সুদ সমেত অনেক টাকা দেনা হইল। মহাজন বাটী বিক্রয় করিয়া লইলে আখেরে টালার বাগানে কোন ভাগ্যবানের অধিকারে বাস করিয়া কোনরূপে শেষ জীবন কাটাইলেন।’ এই হচ্ছে বাবু কালচারের নায়কদের জীবনচরিত। কারুর এক পুরুষেই এরূপ ঘটেছে, কারুর আবার দু-তিন পুরুষে।
বাবু কালচারের ঠিক কবে থেকে সূচনা হয়েছিল, তা বলা কঠিন। তবে মনে হয় এর সূত্রপাত হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে, আর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে। বোধ হয়, প্রথম বাবু ছিলেন কলকাতার কালেকটরের সহকারী গোবিন্দরাম মিত্র, যার রতন, ললিতা ও মতি নামে তিন রক্ষিতার নাম আমরা পাই সিরাজ কর্তৃক কলকাতা আক্রমণের জন্য যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল, তার তালিকায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে বাগবাজারের বিখ্যাত ধনী ভুবনমোহন নিয়োগী। (যিনি প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপন করেছিলেন ও ‘নোট’ পুড়িয়ে সিগারেট ধরাতেন ও সরস্বতী পূজার বিসর্জন উপলক্ষে চিৎপুর রোডের উভয় পার্শ্বস্থ বারাঙ্গনাদের মধ্যে এক হাজার জোড়া বেনারসী শাড়ী বিতরণ করেছিলেন। মহাশয়ই ছিলেন কলকাতার শেষ ‘বাবু।’
ভবানীচরণ বাবুদের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের। ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের চিত্র আমরা পাই দুখানা বই থেকে। একখানা হচ্ছে বিদ্যাভূণীকৃত ‘বাবু নাটক’, আর একখানা হচ্ছে টেকচাঁদ ঠাকুর রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’।
ষাটের দশক পর্যন্ত বাবু সমাজ ও তার কালচারের প্রতিপত্তি যে পুরামাত্রায় ছিল, তা আমরা ‘হুতোম পেঁচার নক্শা’ থেকে জানতে পারি। হুতোম এই বাবুদের সম্বন্ধে লিখেছেন—‘বেশ্যাবাজিটা আজকাল এ শহরে বড়মানুষের এলবাস পোষাকের মধ্যে গণ্য। কলকাতার অনেক প্রকৃত হিন্দু দলপতি ও রাজারাজড়ারা রাত্তিরে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখেন না, বাড়ীর প্রধান আমলা দাওয়ান মুচ্ছদীরা যেমন হুজুরদের হয়ে বিষয়কর্ম দেখেন—স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাদের ওপর আইনমত অর্শায়, সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন?…ছোকরাগোছের কোন কোন বাবুরা বাপ-মার ভয়ে আপনার শোবার ঘরে একজন চাকর বা বেয়ারাকে শুতে বলে আপনি বেরিয়ে যান। চাকর দরজায় খিল দিয়ে ঘরের মেঝেয় শুয়ে থাকে, স্ত্রী তুলসীপাতা ব্যবহার করে খাটে শুয়ে থাকেন।…বড় মানুষের বাড়ির পাশে একটি গৃহস্থের সুন্দরী বউ কি মেয়ে নিয়ে বাস করবার যো নেই; তা হলে দশদিনেই সেই সুন্দরী টাকা ও সুখের লোভে কুলে জলাঞ্জলি দেবে। …শহরের বড়মানুষেরা অনেকে এমনি লম্পট যে, স্ত্রী ও রক্ষিতা মেয়েমানুষ ভোগেও সন্তুষ্ট নন, তাতেও সেই নরাধম রাক্ষসদের কামক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না–শেষে ভগ্নী, ভাগ্নী ও বাড়ির যুবতী মাত্রেই তার ভোগে লাগে….অনেক বড়মানুষের বাড়ি মাসে একটি করে ভ্রূণ হত্যা হয়।’
তবে বাবু কালচারের শীঘ্রই পতন ঘটেছিল। এর সহায়ক ছিল শিক্ষার বিস্তার ও ভবানীচরণ যাদের বড়লোকদের নীচেরতলার লোক বলে উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ নামে অভিহিত করেছিলেন, তাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ফলে। এই সমাজের ছেলেরা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল, কেউ এটর্নী, কেউ বৈজ্ঞানিক, কেউ ইঞ্জিনীয়ার, আর কেউ কেরানী হয়েছিল। তার মানে বাবু সমাজকে পশ্চাদপটে হটিয়ে দিয়েছিল একটা শিক্ষিত পেশাদারী সমাজ। এই সমাজই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে বিংশ শতাব্দীর বর্তমান কাল পর্যন্ত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞনিক, আইনজীবী, রাজনীতিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী তৈরী করেছিল। এদেশে বিত্ত ও বিদ্যার সমন্বয় এরাই ঘটিয়েছে। দেশের উন্নতি এদের ওপরই নির্ভর করেছে। এরাই শেষ পর্যন্ত সাধিত করেছিল এদেশ থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান।