কলকাতার পতিতাপল্লীর পদাবলী
সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলী দেখে মনে হয় যে শীঘ্রই কলকাতার রূপজীবিকারা মিছিল করে পথে নেমে পড়বে এবং উদাত্তকণ্ঠে চিৎকার করবে ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’। কেননা, মাত্র কয়েকদিন আগেই সংবাদপত্রে পড়লাম যে প্রেমচাঁদ বড়াল ষ্ট্রীটের পতিতারা স্থানীয় সমাজবিরোধীদের দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে কর্তৃপক্ষ মহলে এক স্মারকলিপি দিয়ে এসেছে। আবার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের এক খুনের সংবাদে পড়ি যে খুনের মূল কারণ ওই অঞ্চলে এক নূতন পতিতাপল্লীর ‘প্রভুত্ব’ নিয়ে দুই সমাজবিরোধী দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এসব ঘটনাবলীর সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় যে যুগের হাওয়ার অগ্রগতির সঙ্গে শহরের পতিতারাও সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতঃ সে যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে যে যুগের মানুষরা পতিতাদের ঘৃণা করত। এমনকি যারা নাট্যশিল্পী ছিল, তাদেরও বিরূপ দৃষ্টিতে দেখত। আমরা ইতিহাসে পড়ি যে রঙ্গালয়ের প্রথম অবস্থায় ভদ্রপরিবারের মেয়েরা থিয়েটার দেখতে যেত না, যেহেতু বারাঙ্গনারা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করত। গিরিশচন্দ্রই ভদ্রপরিবারের মেয়েদের মন থেকে এই সঙ্কোচটা দূর করেন, থিয়েটারের দ্বিতলে চিক-এর আড়ালে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র আসনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু আজকের সমাজপতিদের কাছে পতিতারা ঘৃণিত জীব নয়। সমাজে তারাও মর্যাদাসম্পন্ন এক শ্রেণী। তারাও মায়ের জাত, তবে পদস্খলিতা মাত্র। তারাও তো সমাজের একটা অভাব পূরণ করে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে এক শ্রেণীর মেয়েরা যদি এই পথে না আসত, তাহলে সমাজে কি বিশ্ লাই না প্রকাশ পেত, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যেখানে পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা অনেক কম। এখানে উল্লেখনীয় যে প্রাচীন ভারতে বারাঙ্গনাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখা হত। রাজসভায় ও উৎসব-অনুষ্ঠানে তাদের জন্য মর্যাদামণ্ডিত আসন সংরক্ষিত হত। (আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ বইখানা দেখুন)।
কলকাতায় পতিতাদের আগমন ঠিক কবে ঘটেছিল, তা আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে সবচেয়ে প্রাচীন নজির যা আছে, তা হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নের। তখনই শহরে পতিতাপল্লী বেশ জাঁকালো ভাবে গড়ে উঠেছিল। কেননা, ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ‘কনসালটেশনস্’ বই থেকে খবর পাওয়া যায় যে কোম্পানি ঈশ্বরী ও ভবী নামে দু’জন বারবনিতার মাল নিলামে বিক্রি করছে। ওই তারিখের আগেই যে শহরে বেশ্যাপল্লী ছিল তার সংবাদ আমরা পাই সিরাজ কর্তৃক কলকাতা আক্রমণের সময় (১৭৫৬) যে সব বিষয় সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল এবং যার জন্য মীরজাফর ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল, তার নামের তালিকা থেকে। সেই বণ্টন তালিকায় আমরা রতন, ললিতা ও মতিবেওয়া নামে গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিতা তিনজন গণিকার নাম পাই।
লঙ সাহেব লিখে গেছেন যে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ইউরোপীয় জাহাজসমূহের নামকরা চিৎপুর অঞ্চলের বেশ্যাপল্লীতে আনাগোনা করত। পরবর্তীকালে চিৎপুর- গরাণহাটার বেশ্যাপল্লীই সোনাগাজী (পরে সোনাগাছিতে রূপান্তরিত হয়েছিল) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। সোনাগাজীর উল্লেখ আমরা প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’- ও পাই। কিন্তু তার অনেক আগে সাহিত্যেও আমরা কলকাতার বারবনিতাদের উল্লেখ পাই। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত গ্রন্থসমূহে আমরা কলকাতার বারবনিতাদের উল্লেখ পাই। তাদের মধ্যে বেশ্যাপ্রধানা ছিল বকনাপিয়ারী। ভবাণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলীর অব্যবহিত পরেই কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রীটে (শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পেছনে) নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় হয়েছিল। ওই নাটকে বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল ষোড়শবর্ষীয়া রাধামণি বা মণি, রানী ও মালিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিল প্রৌঢ়া জয়দুর্গা ও বিদ্যার সহচরীর ভূমিকায় রাজকুমারী বা রাজু। এদের সকলেকেই বরানগরের পতিতাপল্লী থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল। বরানগরের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতায় এসেছিল এক অবৈধ বণিক বা ‘ইনটারলোপার’, নাম আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন। হ্যামিলটনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত থেকে আমরা জানতে পারি যে তাঁর সময়ে বেশ্যাদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য বরানগরে এক বিদ্যায়তন বা ‘সেমিনারি’ ছিল।
তবে শহরের মধ্যে সোনাগাজীই ছিল সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বেশ্যাপল্লী। সোনাগাজী বলতে দর্জিপাড়া, গরাণহাটা, দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রীট, মসজিদ বাড়ি স্ট্রীট, চিৎপুর রোড ইমামবকস্ থানাদার লেন, ইত্যাদি অঞ্চল বুঝাত। এছাড়া, বেশ্যাপল্লী ছিল রামবাগানে মিনার্ভা থিয়েটারের আশেপাশে। আরও বেশ্যাপল্লী ছিল শোভাবাজারের রাজবাড়ির পিছনে ফুলবাগানে, শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর সামনে ও কালাচাঁদ সান্যাল লেনে,হরলাল মিত্র স্ট্রীটের শেষপ্রান্তে বাগবাজারের খালের মুখে, উল্টডাঙ্গায়, মেডিকেল কলেজের সামনে হাড়কাটা গলিতে বা প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীটে, মেডিকেল কলেজের দক্ষিণে ছানাপট্টির পিছনের সরু গলিটার ভিতরে, শ্যামবাজারের কম্-বলিটোলায়, গ্রে স্ট্রীট প্রভৃতি জায়গায়। তবে কলকাতায় এমন একটা বেশ্যাপল্লী ছিল, যেখানে সব প্রদেশেরই, বিশেষ করে ওড়িশার বেশ্যারাই বাস করত। সেটা হচ্ছে ধুকুরিয়া বাগান, জানবাজারের রানী রাসমণির বাড়ির কাছে রামহরি মিস্ত্রি লেন ও উমা দাস লেনে। এছাড়া শহরের আরও নানা জায়গায় বেশ্যারা ছড়িয়ে ছিল, যেমন বালাখানায়, গৌরীবেড়ে, জানবাজার ইত্যাদি জায়গায়। কালীঘাট ও চেতলাও বেশ্যাদের পীঠস্থান ছিল। কালীঘাটের বেশ্যাদের কথা আমরা জনৈকা ইংরেজ মহিলা মিসেস এলিজা ফে-র বিলাতে এক বান্ধবীর কাছে লিখিত পত্রে পড়ি।
এখানে একটা কথা বলা দরকার যে সেকালের বটতলার সাহিত্য সংস্থাগুলি গড়ে উঠেছিল সোনাগাছির বেশ্যাপল্লীরই আশেপাশে। এখানে আরও বলা দরকার যে রঙ্গালয় ও অভিনয় কলার প্রথম অধ্যায় রচিত হয়েছিল শহরের বারবণিতাদের নিয়ে। বস্তুতঃ সে যুগের নামজাদা অভিনেত্রীদের মধ্যে যাঁরা যশস্বিনী হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই পতিতাপল্লীর অধিবাসিনী ছিলেন। যথা ক্ষেত্রমণি, কাদম্বিনী, যাদুমণি, হরিদাসী, রাজকুমারী, বিনোদিনী, নারায়ণী, তারাসুন্দরী, আঙুরবালা, আশ্চর্যময়ী প্রমুখ। এদের সকলকেই রূপজীবিকা মহল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এঁদের অভিনয় দেখে চমকিত হয়েছিলেন ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গীয় রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস থেকে এইসব রূপজীবিকারা অন্তর্হিত হল বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে যখন শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করতে লাগলেন শিক্ষিতা মহিলারা।
বর্তমান শতাব্দীর ত্রিশের দশকের গোড়ায় ‘লীগ অভ্ নেশনস্’-এর এক সমীক্ষা দল যখন কলকাতায় এসেছিলেন পতিতাবৃত্তি সম্বন্ধে সরজমিনে তদন্ত করবার জন্য, তখন তাঁরা দেখেছিলেন যে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে সোভিয়েতদেশীয় বারাঙ্গনারা কেন্দ্রীভূত হয়ে খুব জাঁকালো রকমের বেশ্যাবৃত্তি চালাচ্ছে। তখন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান বারাঙ্গনারা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ফ্রী স্কুল ষ্ট্রীট অঞ্চলে, আর ইউরোপীয় বারাঙ্গনারা পার্ক ষ্ট্রীট অঞ্চলে।
গত শতাব্দীর দুই মহাপুরুষ শিবনাথ শাস্ত্রী ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন পতিতাদের দুর্দশায়। কথিত আছে যে বিদ্যাসাগর মশায় একদিন শীতের রাত্রে পথের ধারে কনকনে শীতের মধ্যে রাববনিতাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পকেট থেকে অনেকগুলো নোট বের করে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন—মা লক্ষ্মীরা, তোমরা ঠাণ্ডায় থেক না, অসুখ করবে, যাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়’।