কলকাতার মিষ্টির দোকান
বাঙালীর প্রসিদ্ধি তার রসনার জন্য। সেজন্যই বাঙালী মেয়েরা ৬৪ রকম ব্যঞ্জন হরেক রকম মিষ্টান্ন বানাতে জানত। এ সম্বন্ধে উত্তর ভারত বাঙলার কাছে পরাহত। উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ছিল ক্ষীরের তৈরি লাড্ডু। তবে ‘দিল্লীকা লাড্ডু কি পদার্থ, তা আমরা জানি না। লাড্ডু ছাড়া বিহার উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের মিষ্টান্ন ছিল ক্ষীরের তৈরি পেড়া। উত্তর ভারতে ছানার তৈরি মিষ্টান্নের কোন বালাই ছিল না। ছানার তৈরি মিষ্টান্ন বাঙলারই বৈশিষ্ট্য। ছানা দিয়ে হরেক রকম মিষ্টান্ন তৈরি করত বাঙালী মেয়েরা। এছাড়া তারা মিষ্টান্ন তৈরি করত ক্ষীরের, ময়দার, নারকেলের ও ডালবাটার। ঘরে ঘরে এগুলো তৈরী হত। ময়দার মিষ্টান্নের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল জিভেগজা। ক্ষীরের খাবারের মধ্যে ক্ষীরের পুতুল, আর নারকেলের খাবারের মধ্যে চন্দ্রপুলি ও নারকেল নাড়ু। জিভে গজাটা ছিল খুব একটা প্রিয় খাদ্য। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা দোকান থেকে জিভে গজা কিনতাম এক পয়সায় চারখানা, তার সঙ্গে কিছু বোঁদে ফাউ।
ছানার খাবারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ছিল সন্দেশ। কলকাতায় সন্দেশের দোকানের মধ্যে কোনটা সবচেয়ে প্রাচীন তা বলা কঠিন। আমার ছেলেবেলায় প্রতি পাড়াতেই সন্দেশের দোকান দেখেছি। নতুন বাজারে মাখন ময়রার সন্দেশই ছিল চমৎকার। ওরা কেবল সন্দেশই বানাত। কড়া ও নরম দু’রকম পাকেরই। সেকালের মিষ্টান্ন সম্বন্ধে জীবনতারা হালদার বলেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকো ছিল মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এখনকার মত তখন অলিগলিতে মিষ্টান্নের দোকান ছিল না। জোড়াসাঁকো অঞ্চলে দোকান ছিল দশ বারোটা। সে সময় ময়দার মিষ্টিরই বেশি চল ছিল। ময়দার মিষ্টির মধ্যে আবার বেশি চলত গজা ও মতিচুর। সাতুবাবুর বাজারে ছিল সবথেকে বড় ছানাপট্টি। দরমাহাটা স্ট্রীটেও ময়রাপট্টি ছিল। সেখানে বিখ্যাত ছিল নাথ ময়রার কাঁচাগোল্লা। বউবাজারে নবকৃষ্ণ গুঁই-এর ছানার পোলাউ, পান্তুয়া, দরবেশ ও বোঁদের স্বাদ ছিল সুন্দর। পান্তুয়া পরে রূপান্তরিত হয় লেডিকেনিতে। লর্ড ক্যানিং একবার মুর্শিদাবাদ পরিদর্শনে যান। মুর্শিদাবাদের সেরা ময়রা তাঁর জন্য দশসেরি পান্তুয়া বানালেন। উপহার দিলেন লেডি ক্যানিং-এর হাতে। সে থেকে লোকেরা মিষ্টিটার নাম দিল লেডিকেনি। তারপর কলকাতাতেও লেডিকেনি তৈরি হতে লাগল।
কিন্তু পরে কলকাতা প্রসিদ্ধ হয়ে গেল তার রসগোল্লার জন্য। এর আবিষ্কারক ছিলেন নবীন চন্দ্র দাস। আবিষ্কারের ইতিহাসটা আমি অন্যত্র দিয়েছি। (‘বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরী শতবার্ষিকী স্মরণিকা’য়)। নবীন প্রথম দোকান করেছিল মাথাঘষা গলিতে। দোকান না চলায়, পরে দোকান করলেন বাগবাজারে আপার চিৎপুর রোডের ওপর শক স্ট্রীটের ঘোড়ার ট্রাম ডিপোর সন্নিকটে। এখানেই নবীন রসগোল্লা সৃষ্টি করেছিল। যেহেতু কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ওখানে ট্রাম চালাবার জন্য কলকাতা করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ২ অক্টোবর তারিখে, তা থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে নবীন রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিল ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের পর। ১১ এপ্রিল ১৯৮৮ তারিখের ‘বর্তমান’ পত্রিকায় গৌতম হোড় লিখেছেন—‘নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা সৃষ্টি করেছিলেন ১৮৬৮-তে।’ মনে হয় ওই তারিখটা ভুল। রসগোল্লা জনপ্রিয় হবার পর ওর বাচ্ছা সংস্করণ রসমুণ্ডী বেরোয়। রসগোল্লার দাম ছিল, দু’পয়সা। আর রসমুণ্ডী এক পয়সাতে চারটে পাওয়া যেত। ফাউ চাইলে দোকানী একটা ফাউও দিত। গৌতম হোড় আরও লিখেছেন, ‘সিমলার নকুড় নন্দীর দোকানও ১৪৪ বছরের পুরনো।’ এটাও সন্দেহজনক উক্তি। কেননা কেউই জানে না কলকাতার মিষ্টির দোকান কত প্রাচীন। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে নকুড় নন্দীর শ্বশুরমশাই হচ্ছেন গিরীশচন্দ্র দে। কড়া পাক সন্দেশের জন্য গিরীশের অসাধারণ প্রসিদ্ধি ছিল।
কলকাতায় শোনপাপড়ি চালু করেন নেপাল চন্দ্র হালুইকর। তাঁর আদি দোকান ছিল আরমেনিয়ান স্ট্রীটে। শোনপাপড়ি অবশ্য নেপাল হালুইকরের সৃষ্ট জিনিষ নয়। আগে থাকতেই এর প্রচলন ছিল বিহার ও উত্তরপ্রদেশে। স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ মহেন্দ্রনাথ দত্ত মশাই বলেছেন যে উত্তরভারতের মিষ্টান্ন যথা অমৃতি, জিলাপি, বালুসাই, রাবড়ি ইত্যাদি তাঁর সময়েই (ঊনিশ শতকের শেষপাদে) কলকাতায় আমদানী হয়। এটাই ঠিক কথা বলে মনে হয়, কেননা কলকাতায় উত্তরভারতের মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকদের আগমন ঘটে ১৮৬৪-৬৫ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার সঙ্গে উত্তরভারতের রেলপথে যোগাযোগ স্থাপনের পর।
আমার ছেলেবেলায় (তার মানে বিংশ শতাব্দীর মুখপাতে) শ্যামবাজারের পাঁচমাথায় প্রসিদ্ধ সন্দেশ-দইয়ের দোকান ছিল হরিদাস মোদকের। হরিদাস মোদকের দোকান ছিল শ্যামবাজার বাজারের পূর্বদিকে একখানা চালা ঘরের মধ্যে শ্যামবাজার ব্রিজ রোডের ওপর। ওই রাস্তা বিস্তৃতকরণ করে আর. জি. কর রোড সৃষ্টির সময় হরিদাস মোদকের দোকান উঠে আসে পাঁচমাথার সামনে আপার সারকুলার রোডে। (এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্ৰ রোড)। ও’দের দোকানটা এখনও জীবিত। সন্দেশ, ছানার জিলাপি ও জিভেগজার জন্য দোকানটা এখনও বিখ্যাত। শ্যামবাজারের মথুলিয়াটোলায় ছিল দ্বারিকচন্দ্র ঘোষের দোকান। দ্বারিকচন্দ্ররও সুনাম ছিল সন্দেশ ও দইয়ের জন্য। বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকের শেষে দ্বারিকের একখানা দোকান প্রতিষ্ঠিত হয় শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে। (আগে ওই ঘরে ছিল বিপিন ময়রার দোকান)। পরে কলকাতার নানা জায়গায় দ্বারিকের দোকানের শাখা খোলা হয়। কলকাতার বাইরে দেওঘরেও একখানা দোকান খোলা হয়। কিন্তু পরে গৃহবিবাদে দ্বারিকের দোকানগুলির হয় বিলুপ্তি, আর তা নয় তো অবনতি ঘটে। এখন শ্যামবাজারের শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক ফড়িয়াপুকুর স্ট্রীটের ‘সেন মহাশয়- এর দোকান। ‘কেশব ভোগ’ ও ‘মালাই চপ’ এঁদের বিখ্যাত।
বহুবাজার অঞ্চলে নবকৃষ্ণ গুইয়ের দোকানের এখন বৃদ্ধি ঘটেছে। ওঁদের তৈরি ছানার মুড়কি তুলনাহীন ও অদ্বিতীয়। পাশে ভীম নাগের দোকানের আয়তন ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। অথচ একসময় ভীম নাগই ছিল কলকাতার শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন বিক্রেতা। আমরা দেখেছি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিকালে কলেজ স্ট্রীট ও বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীটের মোড়ে পুরানো অ্যালবার্ট বিলডিং-এর তলায় অবস্থিত আর ক্যামব্রের বইয়ের দোকানে গল্পগুজব করে, বাড়ি ফেরবার পথে তাঁর গাড়ি দাঁড় করাতেন ভীম নাগের দোকানের সামনে, এবং ওরা ওঁর হাতে তুলে দিত আধসের সন্দেশ, যা ওঁর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাত না, গাড়িতেই মিষ্টান্নবিলাসী আশুতোষ ওটা শেষ করতেন। তবে ভীম নাগের দোকান সাইজে ছোট হয়ে গেলেও ওঁদের তৈরি সন্দেশ গুণ ও স্বাদের দিক দিয়ে পুরানো ঐতিহ্যই বহন করে।
এখন কলকাতার অলিতে গলিতে মিষ্টান্নের দোকান। তবে যে সব দোকান প্রসিন্ধ এবং কোন্ জিনিসের জন্য বিখ্যাত তার উল্লেখ করছি। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের কাছে যোগমায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ভাপা সন্দেশ, শৈল সুইটস্-এর ল্যাংচা, ফড়িয়াপুকুরের মোড়ে অমৃত’-এর দই, ‘জলযোগ’-এর দই ও বড়দিনের সময় নানারকম কেক ইত্যাদি, রাধা সিনেমার নীচে কে. সি. ঘোষের রসমালাই ও মালাই চপ, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নোনতা, ঢাকাই পরটা, ঢাকাই শোনপাপড়ি, কড়াপাকের অমৃতি ও ক্রিম রোল, রঙমহল থিয়েটারের পাশে নদীয়া সুইটস্-এর পানতুয়া ও সরপুরিয়া-সরভাজা, গরাণহাটার মোড়ে সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সকালবেলা জিলিপি ও বিকেলবেলা মালপো, সুকিয়া স্ট্রীটের নন্দলাল ঘোষের দোকানের রাবড়ি, জোড়াসাঁকোয় নেপাল হালুইকরের গাজরের হালুয়া, বিবেকানন্দ রোড ও সেনট্রাল অ্যাভেন্যুর মোড়ে শর্মার দোকানের কালাকাঁধ ও কাজু বরফি, কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে কলেজ রো-এর ভিতরে সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছানার পায়েস, শিয়ালদহের কাছে নাটোর সুইটস্-এর রসকদম্ব, ‘মধুরিমা’র রসকদম্ব, সত্যনারায়ণ গুপ্তের সন্দেশ, কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কমলাভোগ, নাগের ঘিয়েভাজা গজা, হ্যারিসন রোড ও চিৎপুর রোডের মোড়ে ইন্দ্রের দোকানের ‘বেদনা’ বোঁদে, ধর্মতলায় শর্মা কিংবা কল্পতরুর নানারকম মিষ্টান্ন (কম দামী পেঁড়া সমেত), জানবাজারে সরস্বতী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দই ও বেলের মোরব্বা, তালতলায় যশোদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের যশোধি, মল্লিকবাজারের লী সুইটস্-এর সন্দেশ (বিশেষ করে কাঁচাগোল্লা), বেকবাগানে ‘মেঠাই’-এর কড়াপাক সন্দেশ, তেওয়ারির জিলিপি ও লাড্ডু, ভবানীপুরে সেন মশায়ের রোজক্রীম ও দ্বারিক-এর নিঁখুতি, হরির হরিভোগ বা কেক সন্দেশ ইত্যাদি।
তবে আমাদের ছেলেবেলার অনেক মিষ্টান্ন এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন তিলকুটো, জিভেগজা, চিত্রকুট, ক্ষীরের বরফি, বেলের মোরব্বা, ছানার গজা ইত্যাদি। ওগুলো প্রতি মিষ্টান্নের দোকানেই পাওয়া যেত। কোনো কোনোটা এখন মাত্র বিশেষ দোকানেই পাওয়া যায়।