আগুন বোমা ও মন্বন্তর
১৯৪২-৪৩ সালটা কলকাতার পক্ষে এক দুর্দৈবের বৎসর ছিল। ওই বৎসর প্রথম ঘটেছিল এক মর্মন্তুদ অগ্নিকাণ্ড। কলকাতার ইতিহাসে এরকম নিদারুণ ও শোকাবহ অগ্নিকাণ্ড শহরে আগে আর কখনও ঘটেনি, পরেও না। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৪২ সালের ৮ নভেম্বর রবিবার তারিখে। ৫-এ হালসীবাগান রোডে অবস্থিত ‘আনন্দ আশ্রম’ প্ৰাঙ্গ ণে কালীপূজা উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী এক আমোদ প্রমোদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। হোগলা দিয়ে এক প্যাণ্ডেল তৈরি করা হয়েছিল। ঘটনার দিন প্রসিদ্ধ ব্যায়ামবিদ বিষ্ণু ঘোষ তার দলবল নিয়ে ব্যায়ামকৌশল দেখাচ্ছিল। বিষ্ণু ও ওর দলের তখন শহরে খুব জনপ্রিয়তা। সেজন্য এক হাজারের ওপর মেয়ে, পুরুষ ও শিশু ওখানে জড়ো হয়েছিল। বেলা তখন পৌনে চারটা হবে। বিষ্ণুর দল বেশ সুশ্ লভাবেই তাদের ব্যায়াম কৌশল দেখাচ্ছিল। সকলে মুগ্ধনয়নে দেখছিল বিষ্ণুর তেরো বছরের ছেলে কেষ্টর ব্যায়ামকৌশল। এমন সময় মণ্ডপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে লোক চিৎকার করে উঠল ‘আগুন, আগুন’। মণ্ডপের দক্ষিণ দিকটা জ্বলে উঠল। লেলিহান অগ্নিশিখা ক্রমশ অগ্রসর হতে লাগল। ভেতরের সব লোকই গেটের দিকে ছুটে আসতে লাগল। ওইটাই একমাত্র বেরুবার পথ বলে ওখানে জমাট ভিড়। পুরুষরা অধিকাংশই পাঁচিল টপকিয়ে বেরিয়ে এল। পিছনে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে আটক হয়ে পড়ল মেয়ে ও শিশুরা। ১৯৯ জনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল। আহতদের মধ্যে ৩৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। তাদের মধ্যেও ১৪ জন হাসপাতালে মারা গেল। বিষ্ণুর ছেলে কেষ্টও এই অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে প্রাণ হারাল। সমস্ত শহরে বয়ে গেল শোকের স্রোত। কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। কর্তৃপক্ষ আইন জারি করল যে এর পর আর কেউ হোগলার মণ্ডপ তৈরি করতে পারবে না। সেই থেকেই কলকাতায় হোগলার মণ্ডপ তৈরি করা বন্ধ হয়ে গেল।
ওই ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর তারিখে জাপানী বিমান প্রথম কলকাতায় হানা দিল। চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত শান্ত রজনীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে যখন উচ্চনিনাদে সাইরেন বেজে উঠল, তখন শহরের অনেকেই নিদ্রামগ্ন ছিলেন এবং অনেকে শষ্যাগ্রহণ করবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। সাইরেন বাজবার কিছুক্ষণ পরেই শোনা গেল জাপানী বিমানের গুড়গুড় শব্দ। এ মিত্রপক্ষীয় বিমানের পরিচিত শব্দ নয়। এ শব্দটার মধ্যে পূর্বে অপরিচিতির একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। তখন থেকেই কলকাতাবাসী জাপানী বিমানের শব্দের সঙ্গে পরিচিত হল। প্রথম দিন যখন বিমান অক্রমণ হল, তখন সিনেমা হলগুলিতে রাত্রের শেষ চিত্র প্রদর্শন চলছে। সাইরেন বাজামাত্রই চিত্র-প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেল এবং দর্শকরা লবীতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করল। রাস্তায় তখনও যে-সব ট্রাম চলছিল, সেগুলো সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল এবং যাত্রীরা অন্যান্য পথচারীদের সঙ্গে কাছাকাছি বাড়িতে আশ্রয় নিল। বিমানগুলো প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কলকাতার ওপরে ঘুরতে লাগল। কলকাতায় ও উপকণ্ঠে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটা বোমা ফেলল। আক্রমণকারী বিমানগুলোকে বাধা দেবার জন্য ব্রিটিশ পক্ষের জঙ্গী বিমানগুলো আকাশে টহল দিল বটে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন আকাশ যুদ্ধ হল না। তারপর আক্রমণকারী বিমানগুলো চলে গেল। প্রথম দিনের বিমান আক্রমণে জনসাধারণের মনোবল অটুট রইল, এবং পরদিন স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম চলল।
কিন্তু তারপর বিমান-আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করল। কলকাতা শহরে ও উপকণ্ঠে বোমা পড়তে লাগল। যেদিন উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে বোমা পড়ল, সেদিন মনে হল যেন আমাদের বাগবাজারের বাড়ির দেওয়ালের পাশে বোমা পড়ছে। বোমার আওয়াজে আমাদের কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হল, যদিও প্রতিরোধক হিসাবে কানে তুলার ছিপি আঁটা ছিল।
এরপর লোকের মনোবল ভেঙে পড়ল। লক্ষ লক্ষ লোক কাতারে কাতারে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে, কোন যানবাহনের অভাবে, পায়ে হেঁটে বাঙলার বাইরে যেতে শুরু করল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে এত ভিড় যে তিলার্ধ জায়গা রইল না। সকলেই চলেছে উত্তর মুখে। যাবার সময় অনেকে গরু-মোষ ইত্যাদি এক টাকা-দুটাকা দামে বা বিনামূল্যে অপরকে দিয়ে গেল।
তারপর ১৯৪৩ সালে এল এক মন্বন্তর। কলকাতার রাজপথে দেখলাম এক নিদারুণ দৃশ্য। রাজপথ মৃত ও মৃতকল্প লোকে ভরে গেল। গ্রামের হাজার হাজর নিঃস্ব ও বুভুক্ষু নরনারী সামান্য অন্নের প্রত্যাশায় ছুটে এল রাজধানীতে। কিন্তু রাজধানীতে খাদ্য কোথায়? চাউল দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় রাজধানীর লোকই অর্ধ-অনশনে দিন কাটাচ্ছিল। ফলে যারা অন্নের প্রত্যাশায় রাজধানীতে ছুটে এসেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই না খেতে পেয়ে রাজধানীর ফুটপাথের ওপরই তাদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। এই মন্বন্তরে কয়েক লক্ষ লোক মারা গেল। এই মন্বন্তর সম্বন্ধে মাইকেল এডওয়ার্ডস্ তাঁর “দি লাস্ট ইয়ারস্ অব্ ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন — It was authoritatively remarked that Suhrawardy had made a handsome profit out of the sufferings of his fellow countrymen.’