ঊনআশি
সমুদ্রচিলের কর্কশ চিৎকারে ফিরে এল রানা অবচেতনের অন্ধকার থেকে। ফরফর করে ডানা ঝাপটে ওর পাশে নেমে এল পাখিটা। উড়ন্ত অবস্থাতেই মাথা এ-কাত ও-কাত করে দেখছে ওকে রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে।
নিষ্কলুষ নীলাকাশ উপরে। মৃদুমন্দ ঢেউয়ে টানাহেঁচড়া চলছে ওর শরীরটা নিয়ে। কাছে-দূরে তাকাল রানা চোখ মিটমিট করে। তখনই খেয়াল হলো, ভাসছে ও ভাঙা একখানা রোটরব্লেড আঁকড়ে ধরে।
কীভাবে এল ও এখানে?
ঘোলাটে মগজটা জোড়া দিতে শুরু করল ছিন্ন স্মৃতির টুকরোগুলোকে।
অনেকটা দূরে বৃত্তাকারে ভাসছে পসাইডনের ভগ্নাবশেষ। ওখানেই সমুদ্রসমাধি হয়েছে জাহাজটার। বাতাস ও পানির কানাকানি ছাড়া নীরব শূন্যতা ত্রিসীমানা জুড়ে।
বর্তমান নয়, তরঙ্গের দোলায় দুলতে দুলতে ভাবতে লাগল রানা অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদিও জানে না, কেন। হয়তো আগামীর দিকে তাকানোর অর্থ নেই কোনও। হয়তো এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে মাসুদ রানা চৌধুরীর বর্ণময় জীবনের।
কিন্তু কোনভাবে যদি ডাঙায় পৌঁছুতে পারে?
জানে না রানা। জানে না কিছু।
মনে এল বন্ধুদের কথা। নিজেই ও বিপদের মধ্যে টেনে এনেছে ওদেরকে। আর সেটার মাশুল দিতে হয়েছে অসংখ্যজনের মত ওদেরও অকালে হারিয়ে।
তীক্ষ্ণ অনুশোচনার ছোরা বিধল রানার বুকে। বন্ধুদের এ অবস্থার জন্য কে দায়ী? ও নয়? এই সম্পূর্ণ প্ল্যানটা তো ওরই তৈরি। অথচ এখনও দিব্যি বেঁচে আছে ও নিজে!
নিঃসাড়ভাবে পড়ে রইল রানা ব্লেডটার উপর। শীত শীত করছে। কাঁটা দিয়ে উঠে খাড়া হয়ে গেল গায়ের রোমগুলো।
ওকে একা করে দিয়ে দূরের জঞ্জালগুলোর দিকে ডানা ভাসাল গাংচিল। যদি খাবার-টাবার থাকে ওদিকে
জানে না রানা, একা নয় ও।
‘রানা!’ শোনা গেল আবাহন।
বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠল রক্তের ঢেউ।
অচেনা নয় কণ্ঠটা! ভাসমান আবর্জনার ফাঁক দিয়ে এগোল ও রোটরব্লেডটা নিয়ে। উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে সাঁতার কাটছে ফ্রি-স্টাইলে।
উল্লসিত চিৎকার বেরিয়ে এল তিন দোসরকে দেখতে পেয়ে। খুশির ঠেলায় গতি বাড়িয়ে দিয়েছে সাঁতারের।
‘দেখেছ, বন্ধু, কী পেয়ে গেছি!’ যন্ত্রণা আর রক্তশূন্যতায় সাদা হয়ে আছে হার্ডির চেহারা। তার পরও হাসিটা এলইডি লাইটের আলোর মত উজ্জ্বল। ইনফ্লেটেবল বোটটার যাত্রী এখন তিন রত্ন।
‘আরেকজনের জায়গা হবে, মাঝি?’ কিছু যেন দলা পাকিয়ে গেছে রানার গলার মধ্যে।
সঙ্গে সঙ্গে আমন্ত্রণের হাত বাড়িয়ে দিল হুতোম পেঁচা। ‘ফাজলামো শুরু করেছে আউটবোর্ডটা,’ বিতৃষ্ণা ঝরাল নিজের গুরুকে বোটে তুলে নেয়ার পর।
‘আরে, নো চিন্তা… ডু ফুর্তি!’ এক গাল হাসল রানা। ‘আমি বাংলাদেশের পোলা না? এই গাঙ পারোইতে আমার লাগব বড় জোর তিন মিলিট!’ খুলে নিল ও নৌকার পাশে বাঁধা একমাত্র বৈঠাটা।
‘ছলাৎ’ আওয়াজে পানিতে পড়ল দাঁড়।
দিগন্তের ওপারে কোথাও, বহু দূরে, ওদের অপেক্ষায় রয়েছে এস্তোনিয়ার উপকূল।
…আর ভবিষ্যৎ।
***