শকওয়েভ – ৭২

বাহাত্তর

ফিনল্যাণ্ড উপসাগরের অন্ধকার, উত্তাল তরঙ্গ চিরে ছুটে চলেছে কনটেইনার শিপ। নাম—পসাইডন।

ভোর হওয়ার কিছুটা দেরি আছে এখনও।

উত্তরে ফিনল্যাণ্ডের উপকূল আর দক্ষিণে এস্তোনিয়ার মাঝে আড়াই শ’ মাইল বিস্তৃত এই উপসাগর বাল্টিক সাগরের একেবারে পুব প্রান্তে।

পঁচিশ নট বেগে পানি চিরছে ভিএলসিএস-ক্লাস বিশাল জাহাজটার সম্মুখভাগ। পিছনে, কালো সাগরের বুকে দীর্ঘ, বঙ্কিম, ফেনায়িত গমনরেখা সৃষ্টি করেছে বিশাল বিশাল ডিজেল-চালিত প্রপেলার।

এক হাজার ফুটেরও বেশি দীর্ঘ জাহাজটা। কার্গোর ভারে ভারাক্রান্ত এর বিশালায়তন ডেক আর হোল্ডগুলো।

এক বাল্টিক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে যাওয়ার পথে বড় কোনও জাহাজের সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হয়ে যেতে পারে পসাইডনের। তবে চেহারা-সুরতে ওটার জাতের আর-সব জলযানের মত অবিকল এক হলেও, এমন এক কার্গো বহন করছে জাহাজটা, দুনিয়ার অন্য কোনও জাহাজই বড়াই করতে পারবে না যেটা নিয়ে।

তদন্তের খাতিরে কোস্ট গার্ড কিংবা কাস্টমস কর্মকর্তারা যদি উঠতে চায় জাহাজে, ডেক আর হোল্ডের পেল্লায় ওয়্যারহাউসে সারি সারি কনটেইনার প্রস্তুত রয়েছে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামালে ভর্তি ওগুলো। প্রত্যেকটি কনটেইনার নিয়ম মেনে নথিভুক্ত এবং খালাসের অনুমোদন পেয়েছে।

আসল জিনিস রয়েছে পসাইডনের সিল করা অংশে। ওটার সশস্ত্র পাহারায় নিয়োজিত লোকগুলোরও বিন্দু মাত্র ধারণা নেই জিনিসটার সত্যিকার প্রকৃতি সম্বন্ধে।

ওখান থেকে অনেক উপরে, অন্ধকার হেলিপ্যাডের ব্রিজে ছড়িতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিফ। দৃষ্টি পুব দিকে। শিগগিরই সূর্য দেখা দেবে দিগন্তে।

নিকলসনের পার্সোনাল চপারটা বিশ্রাম নিচ্ছে হেলিপ্যাডে। সাগরের সতেজ বাতাসে ফুসফুস দুটো ভরে নিতে মাঝে মাঝেই এখানে আসে লোকটা। এমনকী হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা হলেও। নিচে থাকলে অধিকাংশ সময় কাটে তার কমাণ্ড সেন্টারে।

ভাবতেও পারবে না কেউ, এরকম এক ইলেকট্রনিকস- গ্যাজেট ভর্তি অফিস থাকতে পারে চাঁছাছোলা চেহারার পুরানো এই জাহাজে। সত্যি বলতে, নানান কমপিউটার প্রযুক্তির সমাবেশ নিয়ে চলমান এই গুপ্ত ঘাঁটিই প্রজেক্ট ডুমডের সত্যিকারের সচল হৃৎপিণ্ড। অনায়াসেই পাল্লা দিতে পারে পেন্টাগনের গহীন করিডোরে লুকানো ওটার ল্যাণ্ডবেইসের সঙ্গে।

ডেকে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল নিকলসন। এগিয়ে আসতে দেখল ওর আর্দালিকে। চিনামাটির কাপ-পিরিচ বয়ে আনছে ট্রেতে করে। পিছন পিছন আসছে গ্রেগর সামসা।

‘আপনার কফি, স্যর,’ কাছে এসে পেশ করল আর্দালি। আইভরি স্টিকটা রেইলে ঝুলিয়ে দিয়ে এবনি কালারের ছড়িতে শরীরের ভর চাপাল বৃদ্ধ। ধোঁয়া আর সুবাস ওঠা কাপটা নিল বিনা বাক্য ব্যয়ে।

‘টার্গেটিং সিকিউয়েন্স শুরু করতে যাচ্ছি আমরা, স্যর,’ জিজ্ঞেস করল চিফের ডানহাত। ‘করব?’

‘হ্যাঁ… শুরু করো। আমি আসছি একটু পরেই। ‘

মৃদু নড করে চলে গেল গ্রেগর সামসা।

সময় নিয়ে কফিটুকু শেষ করল বৃদ্ধ। দেখল পুব আকাশে ছড়িয়ে পড়া ভোরের প্রথম লাল আভা। শেষ বারের মত সাগরটা দেখে নিয়ে পা টেনে টেনে রওনা হলো নিচের দিকে।

মুখের ভাবে প্রকাশ না পেলেও মহা উত্তেজিত হয়ে রয়েছে চিফ। আগামী কয়েক ঘণ্টা ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত মুহূর্ত হতে চলেছে তার। সুদূরের সেই দিনগুলোর মত। কী যে সব দিন ছিল সেগুলো! সিআইএ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স চিফ হিসাবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত তখন প্রতিপক্ষ কেজিবি- প্রধানের সঙ্গে।

অর্ধশতাব্দী পর, নাম না ফাটিয়ে কাজ করাটাই প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে আজ নিকলসনের। প্রচারের কোনও স্থান নেই তার বর্তমান প্রজেক্টে।

তার পরও খানিকটা গোপন খেদ রয়েছে বৃদ্ধের অন্তরে। এতগুলো বছর ধরে লালনপালন করা আল্ট্রা-ক্লাসিফায়েড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামটাই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন তার পেশাগত জীবনের—যেটার সে নাম দিয়েছে ‘ডুডে’। এটাকে এখন কাজে লাগতে দেখেও প্রকাশ্যে কৃতিত্ব দাবি করতে পারছে না—দুঃখ হয় বই কি! দুনিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হতে চলা ঘটনাটা কার ব্রেইনচাইল্ড, কখনোই জানবে না কেউ—আফসোসের নয় ব্যাপারটা?

গুপচুপের অবশ্য উপযুক্ত কারণ আছে। ‘অনুশীলন’ হিসাবে এ-পর্যন্ত যা যা ঘটানো হয়েছে, তাতে ভয়ই ধরে গেছে নিকলসনের। এসবের পিছনে কার হাত রয়েছে, জানাজানি হয়ে গেলে তো আত্মহত্যাই করতে হবে তাকে।

চূড়ান্ত আঘাত হানার পর কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে প্রজেক্টটা। প্রলোভন যত দুর্দমনীয়ই হোক না কেন, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতিরিক্ত ব্যবহার চলবে না এ প্রযুক্তির। বিশ্ব মিডিয়ার শক্তিও সেক্ষেত্রে ধামাচাপা দিতে পারবে না সত্যকে; নিজের খেয়ালখুশিমত যারা ম্যানিপুলেট করতে পারে গণমাধ্যমকে, জোসেফ নিকলসন তাদের অন্যতম হলেও। সন্দেহ জাগবে, গোপন কোনও রাজনৈতিক এজেণ্ডা সফল করার জন্য সুবিধামত প্রচারের আলোয় আনা হয়েছে পর পর ঘটা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো। কাকতালের চাইতে বেশি কিছু মনে হবে তখন। উদ্দীপ্ত করা হবে ষড়যন্ত্র- তত্ত্ববাদীদের।

কাজেই, আজকের পর থেকে, বিজয়ের গর্বকে এক পাশে সরিয়ে রেখে অন্য সব বিষয়ে মনোযোগ দেবে চিফ। অল্প যে-ক’জন বিরুদ্ধবাদী অবশিষ্ট রয়েছে, খুঁজে খুঁজে তাদেরকে চিহ্নিত করে গাপ করে ফেলবে নিখুঁতভাবে। পটল তুলেছে মাসুদ রানা আর সেলেনা বার্নহার্ট। সেই সঙ্গে গেছে কোহেন, ব্রাউন, ফ্লেচার আর গালিফিনাকিস। ক্যারেন ল্যানকাউমের ব্যবস্থা তো হয়েছেই।

ছোটখাটো আরও যেসব হুমকি রয়েছে, তাদেরও ব্যবস্থা করতে হবে। ওর নিজের এজেন্ট এমোস হ্যাঙ্কস ওরফে গুস্তাফ ভিকান্দারও ছিল এই দলে। অনেক কিছুই জানত লোকটা। মেজর রানা যদি ও-ব্যাটার গতি না করত, নিজের সুরক্ষার জন্য বেচারার নাম হিটলিস্টে তুলতে হতো নিকলসনকে।

সম্ভাব্য আরেক বিষফোঁড়ার নাম গ্যাসপার ইলিয়েল, ল্যানকাউমের সাবেক বয়ফ্রেণ্ড। কঠিন কিছু হবে না এ- লোককে ছেঁটে ফেলা। মাতাল অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভিঙের মত করে সাজাতে হবে দুর্ঘটনাটা।

প্রজেক্ট ডুডের সঙ্গে এদের ন্যূনতম সংযোগ ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত ঘটতেই থাকবে এ ধরনের ঘটনা।

ডেকের নিচ দিয়ে চলতে চলতে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে রইল বৃদ্ধ। ধাতব মেঝে আর সিঁড়ির ধাপে খটখট শব্দ তুলছে ছড়ি দুটো।

ডেকের অনেক নিচে, দুই পাশে পাহারা বসানো সিকিউরিটি দরজা দিয়ে কমাণ্ড সেন্টারে প্রবেশ করলে কমপিউটার টার্মিনাল থেকে চোখ তুলে চিফের চাঁদমুখ দর্শন করল কয়েকজন। তবে বেশির ভাগই এতটাই ব্যস্ত আর উত্তেজিত যে, মনোযোগ সরাতে পারল না কাজ থেকে।

ছড়িতে ভর দিয়ে মেইন কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়ল নিকলসন। নিকটতম সহযোগীদেরই শুধু প্রবেশাধিকার রয়েছে বৃদ্ধের এই নিজস্ব জগতে।

গ্লেন গোল্ডের মোজার্ট বাজছে কামরায়।

দেয়াল ঢাকা গাঢ় হার্ডউডের প্যানেলিং ঝলমল করছে কমপিউটার স্ক্রিনগুলোর পিছনে। আরও অনেক কমপিউটার ইকুইপমেন্ট দখল করে রেখেছে বড় এক টেবিল।

চামড়ামোড়া বড় একখানা আরাম-চেয়ারের পাশে ছড়ি দুটো রেখে শরীর ঘুরিয়ে ওতে বসে পড়ল চিফ।

ডুডে নামের হাতিয়ারটার মস্তিষ্ক এই কমাণ্ড সেন্টার। উনিশ শ’ একাশি সালে জোসেফ নিকলসন প্রোগ্রামের দায়িত্ব নেয়ার পর, উৎকর্ষের ছাব্বিশটি ধাপ পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে টেসলা অসিলেটর। তেজস্ক্রিয়তা থেকে জাহাজের লোকেদের রক্ষা করতে হোল্ডের এক বিশেষ অংশে, একখানা কনটেইনারের মধ্যে রাখা হয়েছে হাই-টেনসিল কেইবল দিয়ে ঘেরা ডিভাইসটা। বিপুল যে-শক্তির প্রয়োজন ফুল পাওয়ারে যন্ত্রটা চালু করতে, সেটার জোগান দেয় এসব কেইবল। স্টিম পিস্টনের যুগ গত হয়েছে বহু আগেই।

টেসলার আবিষ্কৃত একমাত্র টেকনোলজি নয় ডুম্‌ডে, যেটা নিয়ে উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সাল থেকে কাজ করে আসছে আমেরিকান সরকার। কিন্তু সবচেয়ে গোপনীয় প্রজেক্ট এখন পর্যন্ত। সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডারপার ডিজাইন করা কমপিউটার সফটওয়্যার। স্যাটেলাইট টেকনোলজির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে সেন্ট্রাল প্রসেসরে দেয়া যে-কোনও জিয়োগ্রাফিকাল কো-অর্ডিনেটে ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক পালস পাঠায় এটা।

ডেভেলপমেন্টের প্রাথমিক পর্যায়ে টেসলার মতই একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে ওদের। উনিশ শ’ আট সালে উত্তর মেরুতে টার্গেট করতে গিয়ে ভুলবশত সাইবেরিয়ায় এনার্জি বিম ছোঁড়েন সার্ব বিজ্ঞানী, জন্ম দেন টুঙ্গুসকা-দুর্ঘটনার। আর প্রথম প্রচেষ্টায় কোর্স থেকে দু’শ’ মাইল দূরে গিয়ে পড়ে ডুডের ধ্বংসাত্মক এনার্জি।

এমনকী এখনও পুরোপুরি আয়ত্তে আসেনি দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খুঁতহীনভাবে এনার্জি প্রেরণের টেকনোলজি। তবে টেকনিশিয়ানরা আশাবাদী, আগামী দু’বছর বা তারও কম সময়ে প্রোগ্রাম অপারেট করা যাবে স্থায়ী কোনও বেইস থেকে।

এরই মাঝে, ছ’শ’ মাইল দূর থেকে ঘরবাড়ির সমান টার্গেটে ফোকাস করার সক্ষমতা অর্জন করেছে সিস্টেম। বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল রেঞ্জের এই সীমাবদ্ধতা। গোটা প্রজেক্টের সম্ভাব্যতা নিয়েই দেখা দিয়েছিল সংশয়। স্বয়ং নিকলসন তখন মোবাইল বেইস তৈরির আইডিয়া দেয়। চাহিদা মোতাবেক যে-কোনও জায়গায় পৌঁছুতে সক্ষম মডিফায়েড কার্গো জাহাজে তোলা হবে অস্ত্রটা।

সেই সুবাদে, পেন্টাগনের সঙ্গে সবিশেষ সম্পর্ক রচিত হলো আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ শিপিং ইউনিট ফ্যান্টম হোল্ডিংসের। আধ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রায়-অসীম শক্তির মহাসাগরগামী ব্যাটারিতে রূপ দেয়া হলো পসাইডনকে।

একটা কামানও তোলা হয়নি জাহাজে। নিকলসনের ব্রেইনচাইল্ড তার পরও একটা মাত্র বাটন চেপে ধ্বংস করতে সক্ষম যুদ্ধজাহাজের পুরো একটা বহরকে, আক্ষরিক অর্থেই।

দশকের পর দশক শান দিয়ে দিয়ে এমন এক অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, ইলেকট্রনিকসের ব্যাপারে বকলম চিফের পক্ষেও সম্ভব সেটাকে অপারেট করা। স্রেফ প্রয়োজন কাঙ্ক্ষিত কো-অর্ডিনেট ঢোকানো। টার্গেটের সাধারণ পোস্টাল কোড দিয়ে এন্টার চাপলেও কাজ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ডুডের মস্তিষ্ক। কয়েক সেকেণ্ডেই নিখুঁতভাবে নিবদ্ধ হবে নিশানা। এর পর শুধু ট্রিগার চাপতে হবে অপারেটরকে।

নিউক্লিয়ার মিসাইলের ডিজাইন অনুসরণ করে বানানো হয়েছে এর ফায়ারিং মেকানিজম। ট্রিগার টেপার পর বিশেষ চাবি দিয়ে বুলেটপ্রুফ কাঁচের হাউসিং খুলে উন্মুক্ত করতে হবে বড় এক লাল রঙের বাটন। নিকলসন ছাড়া আর কারোরই সে-বাটন স্পর্শের অধিকার নেই। মাত্র তিনখানা চাবির দুটোই রয়েছে চিফের দখলে।

লাল ওই বাটন সূচনা করবে সর্বশেষ সিকিউয়েন্সের। ডিভাইস যখন অগাধ শক্তি শুষে নিতে শুরু করবে জেনারেটর থেকে, নিভু নিভু হয়ে আসবে জাহাজের বাতিগুলো। কম্পন আর গুঞ্জন শুরু হবে সবখানে।

ঠিক দু’শ’ চল্লিশ সেকেণ্ড পর চোখের পলকে রিলিজ হবে বিপুল এনার্জি। মুহূর্তে নরক ভেঙে পড়বে বহু দূরের টার্গেটে।

যতক্ষণে আক্রমণের জিয়োফিজিকাল প্রতিক্রিয়া শুরু হবে, শক্তি হারিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়বে ডুডে। অর্থাৎ, পসাইডন আর ছ’শ’ মাইল দূরের ক্ষতিগ্রস্ত যে-কোনও এলাকার মধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক লিঙ্ক খুঁজে বের করা অসম্ভব। প্রায় দু’হাজার বর্গ মাইল বৃত্তাকার পরিধি কাভার করবে এই রেঞ্জ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জাহাজটার খোঁজই পাবে না কেউ।

এক কথায় যাকে বলে, ফুলপ্রুফ আইডিয়া। এরকম অবিশ্বাস্য ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার অধিকারী গুপ্ত ওয়েপন সিস্টেম দেখেনি দুনিয়া আর। ক্ষমতা আর সাফল্যের অসাধারণ এক অনুভূতি সৃষ্টি করছে এটা জোসেফ নিকলসনের মধ্যে। বিলাসবহুল মেইন কন্ট্রোল রুমে নিজের চেয়ারে বসে দেখতে পারে সে স্যাটেলাইটের পাঠানো ধ্বংসলীলার মনোরম লাইভ ভিডিয়ো।

ইন্দোনেশিয়ার মিশনটা ছিল এখন অব্দি সবচেয়ে ফলপ্রসূ অপারেশনগুলোর অন্যতম। সুনামি তৈরির তৈরির নিখুঁত ফ্রিকিউয়েন্সির কাঁপুনি সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে গণিত আর পদার্থবিদ্যার জটিল সংমিশ্রণে, যার রহস্যভেদে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে রাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে বিজ্ঞানীরা। রেঞ্জের বাইরের নিরাপদ বলয়ে পসাইডনকে নোঙর করিয়ে, রাক্ষুসে ঢেউয়ের সুমাত্রা কোস্টলাইনে আছড়ে পড়ে সব কিছু গ্রাস করা দেখে কমাণ্ড সেন্টারের আর-সবার মত অসাড় – অবশ হয়ে গিয়েছিল নিকলসনও।

পলিটিকালি গুরুত্ব কম দুর্যোগটার। তবে এ ঘটনায় ইকোনোমিস্টদের এজেণ্ডায় আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে অগ্রাধিকার পাবে জলবায়ু পরিবর্তন। যদিও টেকনোলজিকালি অভিনব ঘটনা এটা। এই প্রথম এমন সফলতার সঙ্গে সাগরের তলদেশে আঘাত হানার সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে ওরা। কিন্তু বলতেই হবে যে, ভয়ঙ্কর ক্ষমতার পুরোটা এখনও দেখায়নি ডুডে।

আজকের টার্গেটটা বরং অনেক সহজ এর চেয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তটার জন্যই ওর এত বছরের প্রতীক্ষা।

স্রেফ একটা বাটন টিপে হাস্যকর রকম সহজে কর্ম হাসিল করতে পারার আনন্দে হা-হা করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে চিফের। প্রায় চল্লিশটা বছর হাসেনি সে উচ্চ স্বরে। আজ হয়তো ভাঙবে সেই ব্ৰত।

কামরাজোড়া স্ক্রিন আর মনিটরগুলোর উপর চোখ বোলাল নিকলসন। অপারেশনের ম্যাপ দেখাচ্ছে সবচেয়ে বড় পর্দাটা। লাল বৃত্ত ঝলসাচ্ছে টার্গেট এরিয়ার উপর। অন্যগুলো টার্গেটিং কো-অর্ডিনেট, টেকনিকাল রিড-আউট, পসাইডনের জিপিএস পজিশন, হরেক স্যাটেলাইট ইমেজ এবং ডেক আর ওপাশের ক্রমশ আলোকিত হয়ে ওঠা সমুদ্রের লাইভ ক্যামেরা ফিড দেখানোর জন্য।

‘কী অবস্থা, গ্রেগর?’ জিজ্ঞেস করল চিফ। ওধারের টার্মিনালে কাজ করছে লোকটা।

‘প্রায় রেঞ্জে চলে এসেছি, স্যর।’

পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে মাথা ঝাঁকাল নিকলসন। ম্যাপ স্ক্রিন দেখতে দেখতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অত্যাসন্ন দুর্যোগ সম্বন্ধে।

নজিরবিহীন হবে ধ্বংসের মাত্রাটা। কম করেও, বিশ লাখ লোকের প্রাণহানি হবে, অনুমান করা যায়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সামরিক হামলা। অথচ কোনও সৈন্য কিংবা গোলাগুলির বালাই নেই। উপায় নেই কাউকে দোষারোপ করার।

‘কেয়ামতের জন্যে প্রস্তুত হও, পৃথিবী!’ পরমানন্দে চোখ দুটো বুজে এল চিফের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *