বায়ান্ন
জাকউইকের এয়ারফিল্ড থেকে টেক-অফের পর, তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগল ফ্লুগঅ্যাকাডেমি ফ্রেইহফের জমিন স্পর্শ করতে। অবতরণের আগে রেডিয়ো করল রানা। ফলে, গ্রাউণ্ড ক্রুরা অবগত রইল এসটি-ওয়ানের আগমন সম্বন্ধে।
ট্যাক্সিইংরত এয়ারক্রাফটটাকে পথ দেখাল ওরা রিফিউলিং স্টেশনের দিকে। ভানুমতীর খেল দেখাল লুকা ব্রেযনেভের দেয়া রেফারেন্স নাম্বার। জলদি জলদি শেষ হয়ে গেল ফর্মালিটিগুলো।
কোনও রকম প্রশ্ন ছাড়াই জ্বালানি নিতে দেয়া হলো ওদেরকে। নিজস্ব হ্যাঙার স্পেস দেয়া হলো রাতের জন্য। এমনকী কাছের শহর লুকেনওয়াল্ডেতে পৌঁছে দেয়ার জন্য গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিল তারা। পাইলটের উস্কোখুস্কো আর আহত চেহারা যদি বিন্দু মাত্রও কৌতূহলের জন্ম দিয়ে থাকে এয়ারফিল্ড স্টাফদের মনে, বাইরে প্রকাশ করল না সেটা।
কয়েক ঘণ্টার জন্য গুস্তাফ ভিকান্দারকে তার নিজের হাতে ছেড়ে দিয়ে, স্থানীয় এডেকা সুপারমার্কেটে ঢু মারল রানা ও সেলেনা। নতুন কাপড়চোপড়, খাবার আর বোতল বোতল পানি লাগবে লম্বা সফরের জন্য।
গাড়িতে করে এয়ারফিল্ডে ফেরার সময় সেলেনার দিকে তাকাল রানা।
‘একটা কথা ভাবছিলাম…’
‘কী, রানা?’
‘যে-কোনখানে যেতে পারবে তুমি এখান থেকে। কেউ জানতে পারবে না তোমার অবস্থান।’
‘বুঝলাম না! অন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? ইন্দোনেশিয়ায় চলেছি না আমরা?’
‘কীসের মধ্যে গিয়ে পড়ছি, জানা নেই কারও। খুব খুশি হব, তুমি যদি থেকে যাও এখানে। কিংবা অন্য কোথাও গা ঢাকা দিতে চাও তো, বলো। টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
‘গা ঢাকা দেব! কী বলছ এসব?’
‘তোমার নিরাপত্তার জন্যেই বলছি।’
জোরের সঙ্গে ঘাড় নাড়ল সেলেনা। এমনভাবে রানার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রিয় মানুষটার।
‘বৃথাই কথা খরচ করছ তুমি, রানা। আমিই তোমাকে এনে ফেলেছি এই পাঁকের মধ্যে। আর এখন বলছ, তোমাকে একা ছেড়ে গর্তে লুকাব ইঁদুরের মত? ভুলে যাও, মিস্টার! কচি খুকি নই আমি। যা-ই ঘটুক না কেন, শেষ না দেখে পিছু হটছি না।’
এক মুহূর্ত সেলেনার দিকে তাকিয়ে থেকে, কাঁধ ঝাঁকাল রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘চেষ্টা তো করেছিলাম।’
প্লেনে ফিরে এল ওরা।
বাতাসের অভাবে গরম তাওয়া হয়ে আছে হ্যাঙারের ভিতরটা। পাত্তা দিল না রানা। যতটুকু পারা যায়, বিশ্রাম নিতে চায় ও। আগামী দুটো দিন তো ঘুম নেই কপালে।
.
ভোরের কিছু পরে ফের আকাশে উড়ল ব্রেযনেভ এসটি- ওয়ান। পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী যাত্রার প্রথম পর্বের এ-ই শুরু।
জার্মানি পিছনে ফেলে ছুটছে ওরা পুবে পোলিশ সীমান্ত অভিমুখে। পোল্যাণ্ড গেল, ইউক্রেন এল। সবুজ চারণভূমি, ছোট ছোট গ্রাম আর শহর, পাহাড়চূড়ায় গির্জা, হ্রদ, বন- বনানী পিছিয়ে গেল নিচে। কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলরেখা ধরে উড়ে যাওয়ার সময় জলের বুকে দেখা গেল সোনারোদের ঝিলিমিলি।
জর্জিয়ায় এসে কাঠখোট্টা, পাথুরে হয়ে উঠল দৃশ্যগুলো।
এর পর প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার কবলে পড়ল বিমান। খেলনার মত ওটাকে নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল ঝড়। ককপিটে কন্ট্রোল নিয়ে কুস্তি করছে রানা, মাথা ভর্তি উদ্বেগ নিয়ে পাশে বসে রইল সন্ত্রস্ত সেলেনা।
স্থানীয় সময় এগারোটার দিকে পৌঁছল ওরা তিবিলিসিতে। খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও মিনিট কয়েকের বেশি হেরফের হয়নি শিডিউলের। ব্রেনেভ করপোরেশনের ট্যাব থেকে যখন রিফিউলিং সম্পন্ন হলো দ্বিতীয় বারের মত, ততক্ষণে আকাশ থেকে বিদায় নিয়েছে কালো মেঘ; ঝলমলে রোদ চারদিকে।
ঠিক পঁচাশি মিনিট পর আবার আকাশে উড়ল ওরা। এবার কোর্স সেট করেছে দক্ষিণে।
আগের মতই রানার সঙ্গে সামনে রয়েছে সেলেনা। ওদিকে জবুথুবু হয়ে পিছনেই ঘুম দিচ্ছে গুস্তাফ। প্লেনে ওঠার পর থেকে একবারও ওদের কোনও কাজে আসার চেষ্টা করেনি লোকটা।
ইঞ্জিনের অবিরাম গুঞ্জন আর উড়োজাহাজটার সম্মোহনী ভাইব্রেশন হয়তো ঘুমই পাড়িয়ে দিত রানাকে, যদি না মাথার মধ্যে খুঁচিয়ে চলত নিরাপত্তার দুশ্চিন্তা।
আর্মেনিয়া এল আর গেল। এর পর ইরানিয়ান আকাশসীমায় এসে সত্যিকার অর্থেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল রানা। কখন না আবার মোলাকাত হয়ে যায় মিলিটারি ফাইটার জেটের সঙ্গে! সামান্য বেচাল দেখলেই গুলি চালাবে ওরা, কোনও ওয়ার্নিং ছাড়াই।
স্থলপথে গেলেও বিপদের সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট। নিয়ত অস্থির আর অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সেখানে। হাজারো রকমের সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। সিরীয় এবং অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছে কত যে গুপ্ত ঘাঁটিতে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। কোনও একজন স্নাইপারের নজরে পড়লেই হয়েছে! পয়েন্ট ফাইভ জিরো ক্যালিবারের অ্যান্টি-মেটেরিয়াল রাউণ্ডের শিকার হবে ওদের দুর্বল, সাঁজোয়াবিহীন ফিউযেলাজ। তার মানেই, ক্র্যাশ-ল্যাণ্ড।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলো রানার এই দুশ্চিন্তা। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও গুলিবৃষ্টি কিংবা ধাওয়ার মুখে পড়ল না ওরা। তার পর যখন দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ি ল্যাণ্ডস্কেপ শুরু হলো নিচে, কিছুক্ষণের জন্য সুস্থির হয়ে বসার সুযোগ পেল রানা। ইরানের বিস্তীর্ণ সেন্ট্রাল মালভূমি সংলগ্ন আলপাইন-হিমালয়ান মাউন্টেইন সিস্টেমের চোখ ধাঁধানো ঊষর সৌন্দর্যে বিমোহিত সেলেনা চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেল।
‘অদ্ভুত সুন্দর!’ বলল ও শ্বাস চেপে। ‘জীবনে দেখিনি এরকম কিছু!
‘হ্যাঁ, সত্যিই ভালো লাগে ওপর থেকে দেখলে,’ একমত হলো রানা। ‘তবে সশরীরে কখনও যেতে চেয়ো না ওখানে। অতিথিদের পছন্দ করে না ওই এলাকা।’
‘মনে হচ্ছে, প্রচুর অভিজ্ঞতা তোমার এসব ব্যাপারে! বেশ তো… প্লেনটা তা হলে ক্র্যাশ করিয়ো না ওখানে, ঠিক আছে?’
‘সাধ্যমত চেষ্টা করব,’ কথা দিল রানা।
যখন মনে হচ্ছিল, শেষ নেই বুঝি বন্ধুর এ ল্যাণ্ডস্কেপের, ঠিক তখনই সমতল মরুভূমিতে রূপ নিতে শুরু করল দৃশ্যপট।
এখনও দক্ষিণে চলেছে ওরা। ওড়া যেন শেষই হবে না কোনও দিন। ইঞ্জিনের একঘেয়ে আওয়াজটা কান পেতে শুনলে কেমন জানি খাঁ খাঁ করে ওঠে মন। অত্যুজ্জ্বল সূর্যটা নিচের জমিনে নিখুঁত ছায়া ফেলেছে বিমানের।
দারুণ অবসাদ বোধ করছে রানা। ঘন ঘন ফিউল রিড- আউট চেক করে সজাগ রাখল নিজেকে। ঘুম তাড়াতে চোখ পিটপিট করছে বার বার।
‘কথা বলো আমার সাথে,’ বলতে বাধ্য হলো অবশেষে। বহু কাল পর শুনছে যেন নিজের কণ্ঠ। শুষ্কং কাষ্ঠং কোলা ব্যাঙের স্বর।
সেলেনারও বেহাল দশা।
‘কী নিয়ে কথা বলব, বলো তো, রানা?’ বলল ও অনুভূতিহীনভাবে।
‘টেসলা আর ফিজিকস ছাড়া যা মন চায়।’
‘কৌতুক চলবে?’
‘কৌতুক? তুমি?’
‘অত অবাক হচ্ছ কেন?’
‘না, মানে…
‘শুনেই দেখো না!’
‘ঠিক আছে, বলো, শুনি।’
‘সোভিয়েত কৌতুক এটা। … সৈনিকদের ক্লাস নিচ্ছিলেন ক্যাপটেন। হঠাৎ এক সৈনিক উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যর, কুমির কি উড়তে পারে?’
‘না, পারে না,’ বলে, পড়ানোয় মন দিলেন ক্যাপটেন। ‘কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠল সৈনিকটি, ‘স্যর, কুমির কি উড়তে পারে?’
‘ক্যাপটেন একটু বিরক্ত হলেন। ‘যাদের বিচারবুদ্ধি হাঁটুতে, তাদের জন্যে বলছি— কুমির উড়তে পারে না। ‘
‘যথারীতি পড়াচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে আবারও সৈনিকটির একই প্রশ্ন: ‘স্যর, কুমির কি উড়তে পারে?’
‘ক্যাপটেন এবার রেগে গিয়ে বললেন, ‘যাদের মাথায় গোবর ভরা, তাদের জন্যে বলছি—কুমির উড়তে পারে না… পারে না… পারে না!’
‘কিন্তু, স্যর, জেনারেল স্যর যে বললেন, কুমির উড়তে পারে!’ বলল সৈনিকটি।
‘কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলেন ক্যাপটেন। ‘ও, জেনারেল স্যর বলেছেন? সেক্ষেত্রে উড়তে পারে কুমির, তবে খুব নিচ দিয়ে।’‘
‘খাহ-খাহ-খাহ!’
‘ও কী, রানা! ওরকম করছ কেন?’
‘কেন, জানো না? রুশরা কিন্তু হা-হা করে হাসে না… ওরা হাসে খা-খা করে।’
‘যাহ!’ বিশ্বাস করল না সেলেনা।
‘সত্যি! রহস্যপত্রিকায় পড়েছিলাম।’
‘কার লেখা?’
‘বই নয়, ম্যাগাজিন। বাংলাদেশের। রিডার’স ডাইজেস্টের মত অনেকটা।’
‘ও। আরেকটা শুনবে?’
‘কেন নয়?’
‘গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসেছে এক সৈনিক। লনে বসে চা-নাশতা খাচ্ছে মা-বাবার সঙ্গে। এমন সময় অর্ধউলঙ্গ তিন তরুণী হেঁটে গেল বাসার সামনে দিয়ে। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল সৈনিকটি। বাবা-মা ভাবলেন, ছেলে বড় হয়েছে। এবার বিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু আক্কেলগুড়ুম হলো তাঁদের, যখন মেয়েগুলো চলে যাওয়া মাত্রই সৈনিকটি বলে উঠল, ‘দেখলে, বাবা, ওদেরকে? তিনজন একসাথে হাঁটছে, অথচ একজনেরও কদম মিলছে না!’‘
হা-হা করে হেসে উঠল এবার রানা। ‘নাহ, ভুল ভেবেছিলাম। প্রশংসাই করতে হয় তোমার সেন্স অভ হিউমারের।
‘থ্যাঙ্ক ইউ। চাঙা লাগছে একটু?’
‘অনেকটাই। তোমার কী অবস্থা?’
‘আগের চেয়ে ভালো।’
‘আচ্ছা… আমাদের সুইডিশ বন্ধুটি কী করছে, বলো তো!’
বকের মত গলা বাড়িয়ে বাল্কহেডের পার্সপেক্স উইণ্ডো দিয়ে উঁকি দিল সেলেনা। প্যাসেঞ্জার সেকশন থেকে কেবিনকে আলাদা করেছে কাঁচের মত স্বচ্ছ প্লাসটিকের জানালা।
একখানা উইণ্ডো সিটে শরীর ডুবিয়ে দিয়েছে লোকটা। কাঁধের উপর ঝুলে পড়েছে মাথাটা। চিপসের খালি প্যাকেট, দোমড়ানো ড্রিঙ্কের ক্যান আর দলা পাকানো ক’টা স্যাণ্ডউইচের মোড়ক পড়ে আছে পাশের আসনে।
‘আমাদের বেশির ভাগ রসদ সাঁটিয়ে বেঘোরে নাক ডাকাচ্ছে আবার,’ রিপোর্ট করল মেয়েটা। ‘ইচ্ছে করছে, ধাক্কা মেরে প্লেন থেকে ফেলে দিই ব্যাটাকে!’
হাসল রানা।
‘কোথায় রয়েছি, ব্যাখ্যা করবে একটু?’ জানতে চাইল সেলেনা।
বাঁয়ে আঙুল তাক করল রানা। ‘পাঁচ শ’ মাইলমত ওদিক গেলে আফগানিস্তান।’ পলকে চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল যেন প্রাণের বন্ধু সোহেলকে উদ্ধার করে আনার ঘটনাটা।* তাক করল ডান দিকে। ‘আর এক শ’ মাইল এদিকে রয়েছে কুয়েত।’
[*রানা ৩৬৭, সহযোদ্ধা দ্রষ্টব্য।]
‘বালি ছাড়া তো কিছুই দেখছি না আমি!’ অনেকক্ষণ ধরেই বালির সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে ওরা।
অবশেষে অবসান ঘটল নীরস এই একঘেয়েমির। পারস্য উপসাগর স্বাগত জানাল ওদের। টানা মরুভূমির পর পরিষ্কার নীল আকাশের মত শান্ত সাগরের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য প্রশান্ত আর সজীব লাগল ওদের।
চুনকাম করা পাথরের বাড়িঅলা খুদে খুদে শহর আর বন্দরের উপর দিয়ে গর্জন তুলে উড়ে যেতে যেতে উপকূলরেখা স্পর্শ করল রানা। স্ফটিকস্বচ্ছ মহাসাগরে বিন্দুর মত দেখাচ্ছে ইয়ট আর মাছ ধরা নৌকাগুলোকে। নীলের বিপরীতে মুক্তোর মত ঝিকমিক করছে নগর-বন্দর।
আরও দক্ষিণে উড়ে চলল ওরা। কাতার পেরোল। আবু ধাবি পেরোল। তার পর উড়ল হরমুজ প্রণালীর উপর দিয়ে। পৃথিবীর মোট পেট্রোলিয়ামের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিয়ে দানবীয় সব সুপারট্যাঙ্কার চলেছে ওই জলপথে।
ব্যস্ত শিপিং রুটটাকে উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, জলযান আর মিলিটারি কনভয়ের জট লেগেছে ওখানে।
শিগগিরই গাল্ফ অভ ওমানের প্রান্ত ধরে উড়ে চলল বিমান। প্রাচীন উপকূলীয় দুর্গ আর পাম গাছে ছাওয়া সৈকত ওদের নিচে।