ছিয়াত্তর
‘দেরি করে ফেলেছ!’ কন্ট্রোল রুমে সহকারী ছুটে এসে ঢুকতেই বলল নিকলসন রুষ্ট স্বরে। ‘তাড়াতাড়ি আপডেট দাও।’
হাঁ করে হাঁপাচ্ছে নিকলসনের সহকারী। বুকের ছাতি যেন ফেটে যেতে চাইছে। সারা দেহের রক্ত যেন জমেছে এসে মুখে।
‘সাঁড়াশি-তল্লাশি চালানো হচ্ছে, স্যর! জানা মতে, এগারোজন মারা পড়েছে আমাদের! নিখোঁজ আরও ছয়জন! তবে আহত নেই কেউ!’
বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল চিফ। লোকগুলো যে প্রফেশনাল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
‘ক্রাইসিস পয়েন্টের দিকে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি!’ বলল সামসা। ‘সরে যাওয়ার দরকার হতে পারে আমাদের।
পালাতে বলছ? রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের দ্বারপ্রান্তে এসে? প্রশ্নই আসে না!’ রাইটহ্যাণ্ডের জ্যাকেটের দিকে চোখ গেল বৃদ্ধের। ‘অস্ত্র আছে তোমার কাছে?’
জ্যাকেটের ফ্ল্যাপ সরিয়ে হোলস্টারে রাখা গ্লক সেভেনটিন দেখাল সামসা।
নিশ্চিত জানে নিকলসন, প্র্যাকটিস রেঞ্জে ছাড়া কখনও ওটা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি লোকটার।
‘আর্মারি থেকে একটা এমফোর নিয়ে এসে তুমিও যোগ দাও অন্যদের সাথে,’ হুকুম দিল চিফ। ‘পরিস্থিতি যদি সামাল দিতে না পারো, কষ্ট করে আর আসতে হবে না এখানে।’
বিনা আপত্তিতে বেরিয়ে গেল সামসা। আর-সবার মতই যমের মতন ভয় পায় সে বুড়োকে।
জাহাজের প্রত্যেকটা লোক সার্চ পার্টিতে যোগ দেয়ায় সুনসান নীরবতা ভর করেছে কমাণ্ড সেন্টারে।
অ্যাটমিক ঘড়ির দিকে তাকাল বৃদ্ধ। সাত মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডে টার্গেটের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসছে ওরা। টেকনিকাল সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে বাকি শুধু ট্রিগার ডিভাইস আর্ম করে রেড বাটন টিপে দেয়া। ওর নিজের কাজ এটা।
ট্রাউযারের পকেটে আর্মিং কির অস্তিত্ব অনুভব করছে চিফ। ছোটখাটো, নিরেট জিনিশটা আশ্বাস জোগাচ্ছে তাকে। আত্মতুষ্টির সঙ্গে ভাবল—না, এখন কেউ থামাতে পারবে না জোসেফ নিকলসনকে।
সাত মিনিট ছত্রিশ সেকেণ্ড।
নিজের চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল বৃদ্ধ। চোখ বন্ধ করে নানান কিছু ভাবতে ভাবতে আদর করতে লাগল কোলের উপর রাখা সাদা আর কালো ছড়ি দুটোর খোদাই করা সারফেসে।
কোথা থেকে যেন এক রাশ ক্লান্তি এসে ভিড় করেছে মনের দরজায়। দরজা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে দেহের ভিতর। হঠাৎ করেই যেন আরও বেড়ে গেছে বয়সটা। তার পরও এক ধরনের প্রশান্তির অস্তিত্ব মন ও মগজ জুড়ে। উপরের সমস্ত গোলমাল আর বিশৃঙ্খলা থেকে বিচ্ছিন্ন এই জায়গাটা যেন শান্তির নীড়।
‘মিস্টার নিকলসন!’ পিছন থেকে আসা গম্ভীর কণ্ঠস্বরে টুটে গেল নীরবতা।
ঝট্ করে চোখ জোড়া খুলে গেল বৃদ্ধের। ছড়ি দুটো তুলে নিয়ে চেয়ার ছাড়ল ধড়মড় করে। কণ্ঠস্বরের মালিকের মুখোমুখি হতেই জান্তব বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো দৃষ্টি।
এমপিফাইভ হাতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মাসুদ রানা! ‘তো, এখানে বসেই দাবার চাল দেন আপনি!’ রানার চোখের দৃষ্টি দ্রুত ঘুরে এল কামরার চারপাশে।
চমকে গেলেও, ভয় বিশেষ পায়নি নিকলসন। অনেক বছর আয়ু ভোগ করেছে সে। অসংখ্য বার মুখোমুখি হয়েছে যমদূতের। ভয়ডরের অনেকটাই ঊর্ধ্বে চলে গেছে লোকটা।
‘মেজর রানা!’ কণ্ঠেও ফুটল নির্ভেজাল বিস্ময়। ‘আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছেন একেবারে! স্বীকার করছি, আণ্ডার- এস্টিমেট করা হয়েছে আপনাকে।’
‘বলেছিলাম না, দেখা হবে আবার?’ দলবল নিয়ে ঢুকল রানা ভিতরে।
‘সুন্দর জায়গা,’ মাথা দুলিয়ে তারিফ করল ফুলজেন্স। ‘মিস্টার কোহেনও!’ চিনতে পেরে চোয়াল ঝুলে পড়ল লোকটার। ‘রক্ষা করো, ঈশ্বর!’
দেয়ালের একটা সুইচ টেপার জন্য এগিয়ে গেল হার্ডি। প্রথমে ঠনাৎ, তার পর সড়সড় আওয়াজে আর্মারড স্টিলের শাটার নেমে এসে বন্ধ করে দিল দরজা। থার্মাল কাটার দিয়ে রকেট-প্রপেলড গ্রেনেড প্রতিরোধে সক্ষম এই ইস্পাত কাটতে সারা দিন লেগে যাবে। সঙ্কটের মুহূর্তে সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য তৈরি করিয়েছে ওটা নিকলসন।
‘বিদঘুটে অবস্থায় পড়ে গেছি, মনে হচ্ছে!’ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ছড়িতে ভর দিল বৃদ্ধ। ‘তবে এইভাবে ঝুঁকি নেয়ার জন্যে প্রশংসাই করতে হয় আপনাদের। এ ধরনের জেদি লোকেরা অ্যাসেট হতে পারে আমার।’
‘দুঃখিত, মিস্টার নিকলসন,’ জবাব দিল রানা। ‘দুনিয়া ধ্বংস করে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করা স্টাইল নয় আমাদের।’
‘পানের অভ্যাস আছে নিশ্চয়ই?’ আচমকা প্রসঙ্গ পাল্টাল নিকলসন।
জবাব দিল না কেউ।
‘স্পেশাল কিছু হলে কেমন হয়?’
এবারও কারও কাছ থেকে উত্তর এল না কোনও। স্খলিত চরণে চেয়ারের কাছ থেকে সরে দেয়ালঘেঁষা একটা ক্যাবিনেটের দিকে রওনা হলো চিফ।
সতর্ক রইল অন্যরা।
আইভরি ছড়িটা কবজিতে ঝুলিয়ে, কনিয়াকের একটা বোতল তুলে নিল বৃদ্ধ কবাট খুলে।
‘প্রায় আমার সমানই পুরানো এই জিনিস। ডাক্তার এটা হারাম করে দিয়েছে আমার জন্যে। কিন্তু এখনকার এ অবস্থায় হারামই কী, আর হালালই কী!’
ক্রিস্টালের একটা গেলাসে সাবধানে পানীয় ঢেলে নিল বৃদ্ধ। গ্লাসটা উঁচু করে ধরে বলল, ‘আসুন না, টেস্ট নিই একসঙ্গে!’
কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারারের সাথে ড্রিঙ্ক করি না আমরা, ‘ বলে দিল রানা।
এক চুমুক গিলে নিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করল নিকলসন। ‘আমার ও আপনাদের দর্শনে বিস্তর ফারাক, বুঝতে পারছি। একজন সৈনিক আপনি, রানা। ভিতরকার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে দ্বিতীয় কোনও চিন্তা ব্যতিরেকেই আদেশ পালন করতে অভ্যস্ত সৈন্যরা। পাপ-পুণ্য-ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা। সেসব রণকৌশল হয়তো গভীর পানির অতি- বুদ্ধিমান কোনও মহারথীর মগজ থেকে বেরিয়েছে। উপর থেকে যা-কিছু দেখছেন, সেটাই বিশ্বাস করছেন আপনি। কিন্তু আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো আপনার ধারণারও বাইরে’। ধ্বংস নয়, গড়ছি আমরা আদতে। বেটার এক জগৎ সৃষ্টি করছি আপনার, আমার—প্রত্যেকের জন্যেই।’
‘বাকোয়াজ শোনার সময় নেই আমাদের,’ বাদ সাধল কোহেন। রানার দিকে ফিরে বলল, ‘কেটে পড়ি, চলুন, পালের গোদাটাকে নিয়ে।’
‘এতক্ষণে একটা ভালো কথা শুনলাম,’ খোঁত করে উঠল হুতোম পেঁচা।
দেয়ালের স্ক্রিনগুলো এতক্ষণ খেয়াল করে দেখেনি রানা। এবারে করল। কাছিয়ে গিয়ে তাকিয়ে রইল আলোকিত মানচিত্রের দিকে। উজ্জ্বল লাল আলো ঝলসাচ্ছে টার্গেট লোকেশনের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ডান দিকে, লক্ষ্যবস্তুর জিপিএস কো-অর্ডিনেট দেখাচ্ছে আরেকটা কমপিউটার। অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনও শহরের লাইভ স্যাটেলাইট ইমেজ দেখা যাচ্ছে বাঁ দিকের পর্দায়—সূর্যের সোনালি-লাল আভায় আলোকিত হয়ে আছে দিকচক্রবাল।
নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না রানার। অথচ জলজ্যান্ত বাস্তব ওটা।
‘মস্কো,’ উচ্চারণ করল ফিসফিসিয়ে। ‘আপনার পরবর্তী টার্গেট, তা-ই না?’
‘ঠিক তা-ই, মেজর।’ অপ্রীতিকর, কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় কোনও অপারেশন করতে বাধ্য হওয়া সার্জনের মত দুঃখিত অভিব্যক্তি নিকলসনের চেহারায়। ‘ইয়োরোপের সবচেয়ে জনবহুল শহর। রিখটার স্কেলে প্রায় নয় দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে চলেছে বারো মিলিয়ন মানুষের ওপর… এই তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
ঢোক গিলল রানা। বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে আতঙ্কে।
‘লিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ,’ শুষ্ক হেসে বলল চিফ। ‘উনিশ শ’ ষাট সালে চিলির ভালদিভিয়া-তে ঘটা প্রায় দশ গিগাটন ক্ষমতার ভূমিকম্পকেও ছাড়িয়ে যাবে এটা। সেক্ষেত্রে যে-পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন ছিল, বিশ্বাস করুন, সেটা অর্জন করেছি আমরা। স্রেফ একটা বাটন চাপতে হবে আমাকে—ব্যস, সাধের মস্কো শহরটা মুছে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। …আহ-হা, ভুলেই গিয়েছিলাম ব্র্যাণ্ডির স্বাদটা! যাক গে… যা বলছিলাম… এমনকী আপনাকে ও স্বীকার করতে হবে, অসাধারণ এক কৃতিত্ব এটা।’
‘নরকের পিশাচ আপনি, নিকলসন!’ খেতাব দিয়ে দিল রানা।
‘ভুল বললেন, মেজর রানা। পাকা দাবাড়ু আমি। বিরাট এই খেলায় বাজির দর খুব চড়া। সেজন্যে খেলছি জয়ের লক্ষ্য নিয়েই।’ বিরতি নিল চিফ। ‘নয়া কোল্ড ওয়ারের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা। ধারণাই করতে পারবেন না, কী পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে পুরানোটার জন্যে। আমি জানি, কারণ, আমি ওটার প্রত্যক্ষদর্শী।
‘এখন আবার মাথা জাগাচ্ছে রাশা। আধুনিক যুগের পরাশক্তি হিসেবে গণ্য করা চলে দেশটাকে। তার উপর মিতালি পাতিয়ে ফেলেছে চিনের সঙ্গে। মনে হয় না, এই বেলা ওদের টেক্কা দিতে পারব আমরা। যেভাবে ফুরিয়ে আসছে আমাদের রিসোর্সগুলো, পশ্চিমা অর্থনীতির তাতে টিকে থাকা অসম্ভব।’
‘সেজন্যে বৈশ্বিক সাম্রাজ্য নির্মাণের পরিকল্পনা করে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছেন বলে ভাবছেন, তা-ই না?’
‘সাদা চোখে, দীর্ঘমেয়াদী এজেণ্ডা এটা। এর বাইরে আরও অনেক জরুরি বিষয় রয়েছে দুশ্চিন্তা করার মত। একটা উদাহরণ দিই। নিউক্লিয়ার যুদ্ধের সম্ভাবনা। আমি নিশ্চিত, ও-জিনিস কাম্য নয় আপনার; নাকি উল্টোটা, মেজর?’
‘সেজন্যেই সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটা চিন্তা করে প্রতিরোধের দায়িত্ব নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষের জীবন নাশ করে?’ বিড়ালের বমি যে-দৃষ্টিতে দেখে লোকে, সেই একই দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে রানা চিফের মুখের দিকে।
‘নির্দিষ্ট একটা শহর আর সেটার বাসিন্দাদের প্রাণের বিনিময়ে যদি দুনিয়ায় স্থিতি আর শান্তি আসে, সেটাই কি গুরুত্বপূর্ণ নয়?’
‘আপনার খেলার নিয়ম পছন্দ হয়নি আমার।’
‘শত শত বছর ধরে এ নিয়মেই খেলে আসছি আমরা, মেজর।’ মারফতি হাসি নিকলসনের চেহারায়। ‘নিয়ম বদলায় না, শুধু প্রযুক্তি বদলায় সময়ের ফেরে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে যদি ডুমডের মত টেকনোলজি থাকত, আপনার কি ধারণা, সেটার ব্যবহার করতাম না আমরা? কী মনে হয়—কেন আমাদের পূর্বসুরিরা টেসলার পরিকল্পনা করায়ত্ত করার জন্যে এত উন্মুখ ছিল? উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্ট্যালিনের কথা। এমনকী উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সালে যখন আপাতদৃষ্টিতে এক জোট হয়েছিলাম আমরা নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে, কী করছিলেন তিনি সেসময়? যেই শেষ হলো যুদ্ধ, সত্যিকারের মাথাব্যথা শুরু আমাদের সোভিয়েতদের সঙ্গে। সেকালের বিজ্ঞানীরা বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি টেসলার প্রযুক্তিকে। আমরা পেরেছি। এর চেয়ে সুবিধাজনক টাইমিং আর হতে পারে না।
‘সাধারণভাবে দেখলে – আমরা যা করছি, সহজেই অশুভের কাতারে ফেলা যায় সেটাকে। কিন্তু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে আপনার উপলব্ধিতে আসবে, প্রকৃতপক্ষে কী এই ডুড়ে? যুদ্ধ আর সংঘাতের অবসান। সব মিলিয়ে, কল্যাণেরই হাতিয়ার এটা।’
‘অবশ্যই,’ চিবিয়ে বলল রানা। ‘আর কল্যাণের তো লিমিট নেই, তা-ই না? মস্কোর পরে কোটা?’
‘জানতে চাইছেন যেহেতু…’ কাঁধ ঝাঁকাল নিকলসন। ‘পাকিস্তানি সরকার আর তাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস আইএসআই যে চরমপন্থী তালেবান নেতাদের মদত জোগাচ্ছে গোপনে, বহু বছর ধরে সেটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়েছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্যে। মধ্য- প্রাচ্যকে নিয়ে আমেরিকান সরকারের যে পরিকল্পনা, সেটার অন্যতম প্রধান অন্তরায় এটা। সে কারণেই পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল শহর, দেশটার অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল করাচিকে করেছি ডুমডের পরবর্তী টার্গেট।’
‘সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ। এর পর সমর্থন তুলে নেয়ার হুমকি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। শুনে মনে হচ্ছে—ছেলের হাতের মোয়া।
‘হ্যাঁ, বাচ্চাদেরই খেলা এটা,’ ঠোঁটের এক পাশ দিয়ে হেসে বলল বৃদ্ধ। ‘সবই ডুণ্ডের কৃতিত্ব।’
‘অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে ওই প্রজেক্টের। হাই-এক্সপ্লোসিভ লিমপেট মাইন সেট করে দিয়েছি আমরা পসাইডনের গায়ে। সাগরের তলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি আপনাদের যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট।’ মাথা দোলাল রানা সিআইএ এজেন্টের উদ্দেশে।
স্রেফ বাটন টেপা, না?’ রিমোট ডেটোনেটরটা বের করল কোহেন। ‘বাটন চাপার মজা কাকে বলে, বুঝবি এবার, শালা শুয়োর!’
‘এটা বলার জন্যে রিস্ক নিয়ে এসে উঠেছেন এই জাহাজে!’ আশ্চর্য হয়ে গেল নিকলসন।
‘অত ছাগল মনে করেন আমাদের?’ পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল রানা। ‘হ্যাঁ, জাহাজটার সঙ্গে ডুবিয়ে দিতে পারতাম আপনাকে। প্রাণভিক্ষা দিচ্ছি তার বদলে। আসছেন আপনি আমাদের সঙ্গে। ট্রায়ালে দাঁড়াতে হবে গণহত্যার জন্যে। মৃত্যুদণ্ড যদি না-ও হয়, বাকিটা জীবন কাটবে গরাদের ওপাশে।’
নির্জলা ভয় দেখা দিল বৃদ্ধের চাউনিতে। বিরাট কপালে চকচকে ভাব ফুটল ঘামের।
‘চেষ্টা করে দেখতে পারেন,’ মরিয়া হয়ে বলল লোকটা। ‘কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না আমার বিরুদ্ধে!’
‘ভুল ধারণা,’ কথা কেড়ে নিল সিআইএ এজেন্ট। ‘সব প্রমাণই জোগাড় হয়ে গেছে। আপনার নিউ ইয়র্কের বন্ধুদের ধন্যবাদ প্রাপ্য সেজন্যে। সত্যগুলো যখন সামনে আসতে শুরু করবে, পেন্টাগনের বাপেরও সাধ্য হবে না তোর পাশে এসে দাঁড়ানোর। কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হবে তোকে, হারামজাদা!’ প্রিয়তমাকে হারানোর আক্রোশ ওগরাল কোহেন।
পাংশুটে হয়ে যাচ্ছে নিকলসন। আচমকা ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খেতে লাগল যেন অক্সিজেনের অভাবে। হাত থেকে গ্লাসটা খসে গিয়ে শত টুকরো হলো মেঝেতে পড়ে।
কাটা কলা গাছের মত লুটিয়ে পড়ল সে বুক খামচে ধরে। অচল পা দুটো ভাঁজ হয়ে গেল শরীরের নিচে।
‘খুব ভালো!’ বলল হার্ডি দাঁতের ফাঁক দিয়ে। ‘খাটনি কমে গেল অনেক।’
‘ঘুমাও, বুড়ো খোকা!’ চুকচুক করল ফুলজেন্স। ‘মরা মানুষগুলোর আত্মা শান্তি পাবে তাতে।’
‘উঁহু, এত সহজে মরতে দেয়া যাবে না!’ শশব্যস্তে বলে উঠল কোহেন। ‘জ্যান্ত বের করে নিয়ে যেতে হবে হারামিকে।’ কাছের টেবিলে ডেটোনেটরটা রেখে ত্বরিত পা চালাল সে লোকটার দিকে।
যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে নিকলসন। শুরু হলো খিঁচুনি। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে লাঠি দুটো।
এগোল কোহেন বৃদ্ধকে সাহায্য করার জন্য।
হায়-হায় করে উঠল রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।