শকওয়েভ – ৬১

একষট্টি

‘ভুল হচ্ছে আপনার!’ দেঁতো হাসিটা মুছে গিয়ে লাল হয়ে উঠেছে গুস্তাফ ভিকান্দার। ‘ভুল’ শব্দটা একদম নেই আমার ডিকশনারিতে।’

‘অহঙ্কারই পতনের মূল,’ অমোঘ নিয়তির মত উচ্চারণ করল রানা। ‘খুঁটিনাটির দিকে নজর দেন, বলেছিলেন না? ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছেন অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে। মিস ল্যানকাউমের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালাতে গিয়ে খেয়াল করেছিলাম ওর পাসপোর্টটা। ইন্দোনেশিয়ান কোনও ভিসা বা সিল দেখিনি ওতে। কখনোই আপনার সঙ্গে এখানে আসেনি ক্যারেন। কাজেই, যখন ইন্দোনেশিয়ার কথা বললেন, তখনই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নন আপনি।’

বিহ্বল হয়ে গেছে সেলেনা। ‘ও যে একটা প্রথম শ্রেণীর ধোঁকাবাজ, অত আগেই জানতে তুমি, রানা? এখন বুঝতে পারছি—কেন চাওনি, ইন্দোনেশিয়ায় আসি আমি।’

‘সরি, সেলেনা, বলিনি তোমাকে। রিস্ক নিতে চাইনি আমাদের এই বন্ধুটির মনে সন্দেহ জাগানোর।’ ফিরল রানা গুস্তাফের দিকে। ‘অভিনয় শুধু একা আপনিই জানেন না। আপনার সৌভাগ্য যে, আরব সাগরের গভীরতম অংশে ফেলে দিইনি আপনাকে এক ঝাঁক টাইগার শার্কের মাঝে।’

ব্লটিং পেপার দিয়ে কেউ যেন সবটুকু রক্ত শুষে নিয়েছে গুস্তাফের মুখ থেকে। তা-ও হাসল অস্বস্তির হাসি। ‘দারুণ শার্প লোক তো আপনি!’

‘আপনার বসদের মত নই। আগে থেকেই সব কিছু, ভেবে রেখেছে ওরা। এই যেমন… আপনার মত একজন অ্যাসেটের কাভার রক্ষা করতে গানফাইটে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারিং পিস্তল নিয়ে আসা। মাস্টারমাইণ্ডের চিন্তা-ভাবনা!’

এবার আরও পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেল লোকটার চেহারা। আত্মসংযমের খোলসটা খসে পড়ল চাউনি থেকে।

‘ক্-কী বলছেন আপনি?’ তুতলে গেল কথাটা বলতে। বুনো অস্থিরতা খেলা করছে চোখ দুটোতে। ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটছে মস্তিষ্ক। ভীতিপ্রদ অসঙ্গতিটা পরিষ্কার হয়ে আসতেই আড়দৃষ্টিতে তাকাল হাতের পিস্তলটার দিকে।

‘অবাক হলাম।’ আসলেই বিস্মিত রানা। ‘এতক্ষণ লাগল এটা বুঝতে! হ্যাঁ, গিবসনের পিস্তলটার কথাই বলছি আমি, যেটা এখন তাক করে রয়েছেন আমাদের দিকে। ওটা দিয়েই আপনার ওপর গুলি চালানো হয় বেয়াক্কেলের মত জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়ার সময়। জানতেন না বোধ হয়! কী করে জানবেন? পাছার চামড়া বাঁচাতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন তখন! ‘

কিছু বলার চেষ্টায় মুখটা হাঁ হলো গুস্তাফের, কিন্তু স্বর ফুটল না কণ্ঠে।

‘সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্যে তৈরি ছিল ওরা, ‘ বলে চলল রানা। ‘পাছে ব্যর্থ হয় হামলাটা… পাছে পালিয়ে যাই সেলেনা বা আমি। সেজন্যেই এমনভাবে দেখাতে চেয়েছিল ব্যাপারটা, আপনিও যেন টার্গেট ওদের। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে গুলি করেছে আপনাকে… কাভার যাতে নষ্ট না হয় আপনার। অবশ্যই এটা জানতেন না আপনি… জানানো হয়নি আপনাকে। জানলে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্যান্ট খারাপ করার এক্সপ্রেশন আসত না চেহারায়। এবং এখনও একই অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছি বেবুনের পাছার মত লাল মুখটাতে। কী, মিস্টার ভিকান্দার?’

‘কচু!’ উড়িয়ে দিল গুস্তাফ। ‘স্রেফ বিরক্ত করতে চাইছেন আমাকে!’

‘উঁহুঁ… সত্যি কথাই বলছি আমি আপনাকে। ঠিক যেরকম আর্মস চালানোর ব্যাপারে সত্য স্বীকার করেছেন আপনি। যে-দুয়েকটা ব্যাপারে সততার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের কাছে, এটা তার একটা। কিন্তু আপনার জন্যে তা দুঃসংবাদও বটে। ফায়ার আর্মসের ট্রেনিং নেয়া উচিত ছিল আপনার… শিক্ষাটা তা হলে কাজে লাগত এখন।’

‘গোল্লায় যান আপনি!’ আপনা-আপনি লাফাচ্ছে গুস্তাফের ভুরু। ‘আউল-ফাউল কথা বলে বোকা বানাতে পারবেন না আমাকে!’ এক কদম পিছিয়ে গিয়ে আরেকটু উঁচুতে তুলল পিস্তলটা, রক্তশূন্য হয়ে গেছে আঙুলের গাঁট। রানার মাথা বরাবর তাক করে ধরেছে অস্ত্রটা।

‘নিজেই চেক করে দেখুন না!’ কোল্ট কমাণ্ডারটার দিকে ইঙ্গিত করল রানা। ‘কীভাবে চেক করতে হয়, সেটা যদি অবশ্য জানা থাকে আপনার!’

নিশ্চুপ গুস্তাফ।

‘পয়েন্ট থ্রি এইট ক্যালিবারের ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজ লোড করা ওতে,’ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছে রানা। ‘প্রোপেলেন্ট রয়েছে, কিন্তু নেই কোনও প্রজেক্টাইল। নরমাল পাউডারই ভরা, স্ট্যাণ্ডার্ড প্রাইমার। তবে কার্ট্রিজ কেসের মুখটা বাঁকিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেদিক দিয়ে বুলেট বেরোনোর কথা। এ অবস্থায় গুলি করার জন্যে স্পেশাল মডিফিকেশন দরকার অস্ত্রটারও। মানেটা দাঁড়াচ্ছে, স্বাভাবিক অ্যামিউনিশন হ্যাণ্ডেল করতে পারবে না অস্ত্রটা। প্রচণ্ড আওয়াজ করবে, কিন্তু জ্বলন্ত গ্যাস ছাড়া কিছুই বেরোবে না ব্যারেলের মুখ দিয়ে।’

‘মিথ্যে বলছেন আপনি! অযথা এক পিনে আশি রেকর্ড বাজাচ্ছেন!’

এক পা এগোল রানা। ‘যুক্তিতে আসুন, মিস্টার ভিকান্দার! আপনি যে ধোঁকা দিচ্ছেন, সেটা বোঝার পরেও লাইভ ফায়ার-আর্ম রাখতে দেব আপনাকে? একই রসুনের কোয়া আপনি, সেটা জানার পরও? আমার কথা বিশ্বাস না হলে, দিন না, টিপে দিন ট্রিগার! ভুলও তো হতে পারে আমার!’

এই বার কানে পানি গেল লোকটার। আরও দু’কদম পিছিয়ে গেল গুস্তাফ। হাতে কাঁপছে অস্ত্রটা। ঢোক গেলার কারণে ওঠানামা করছে কণ্ঠমণি।

‘কী হলো, মিস্টার ভিকান্দার?’ তাগাদা দিল রানা। ‘খুন করবেন না আমাদের?’

‘ন্-না… খুনি নই আমি! বস আপনাদের—

‘কোথায় আপনার বস? নিশ্চয়ই লেট হচ্ছে আসতে! এটাই সুযোগ নিজেকে বাঁচানোর। টিপে দিন ট্রিগার। আর কোনও উপায় নেই আপনার। আজ যদি খুন না করেন আমাকে; আজ হোক, কাল হোক, আমার হাতেই মরণ হবে আপনার! মীরজাফররা দু’চোখের বিষ আমার।’

ঘৃণা আর আতঙ্কের খেপা চাউনিতে বিকৃত হয়ে গেল চেহারাটা। ট্রিগার চেপে দিল গুস্তাফ ভিকান্দার। কল্পনায় দেখল, যন্ত্রণায় চিৎকার ছেড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে মারাত্মক আহত মাসুদ রানা।

হলদে-সাদা শিখার বর্ণবলয় সৃষ্টি হলো মালের মুখে। তীব্র আওয়াজটা অনুরণিত হতে লাগল গোটা দালান জুড়ে।

চমকে গেছে সেলেনা।

কিন্তু এমনকী পলকও ফেলেনি রানা, পিছু হটা তো

পরের কথা।

আবার ট্রিগার টিপল লোকটা। আবারও পিস্তলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল উজ্জ্বল হলদে-সাদা আলো। কানের পর্দা ফাটানো ‘বুম্‌ম্‌ম্‌’ আওয়াজটা প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে গেল সব দিকে।

‘হা, ঈশ্বর!’ হাহাকার করে উঠল ভিকান্দার।

এখনও পায়ের উপর খাড়া রয়েছে অক্ষত মাসুদ রানা। কেবল দাঁড়িয়েই নেই, সাক্ষাৎ যমদূতের মত ধীর-কিন্তু-দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে ওর দিকে!

হাতের অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে ভাষাহারা হয়ে গেল লোকটা। মাঝরাত্তিরে গোরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পিছন থেকে কেউ যেন কাঁধের ওপর হাত রেখেছে ওর। হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। যেন এক্ষুণি জ্ঞান হারাবে।

‘পাশার ছক পাল্টে গেছে, তা-ই না?’ ঠোঁটের কোনা বেঁকে গেল সেলেনার।

‘জানি, কী চিন্তা চলছে আপনার মাথায়,’ বলল রানা। ‘হয়তো মিথ্যে বলেছি ব্ল্যাঙ্ক কাট্রিজের ব্যাপারে… আসলে মিস করেছেন আপনি। পিস্তলে হাত তো ভালো নয় আপনার। কিংবা হয়তো ভাবছেন—যা যা বলেছি, সবই সত্যি। কিন্তু মিরাকলও তো ঘটতে পারে পরের বার। হয়তো আগামী বার সীসাই থাকবে কার্ট্রিজে! ….একটাই উপায় শিয়োর হওয়ার—’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ট্রিগারে চাপ দিল গুস্তাফ ভিকান্দার।

এবার চমকায়নি সেলেনা। তবে হাত চাপা দিয়েছে দু’কানে। চোখ জোড়ায় নিঠুর, হিংস্র ঔজ্জ্বল্য।

ধোঁয়া বেরোচ্ছে পিস্তলের মুখ থেকে।

‘লাভ নেই,’ বলে চলল রানা। ‘কিছুক্ষণ শুধু কান ভোঁ ভোঁ করবে আমাদের, আর কিছু নয়।’

এগোনো থামায়নি ও। যত আগে বাড়ছে, গাদ্দারটাও ততই পিছিয়ে যাচ্ছে এক কদম করে।

‘প্লিজ!’ বলে উঠল আচমকা। ‘কথাটা শুনুন আগে! ব্যাখ্যা করতে পারব আমি সব কিছু…’

‘এই মাত্র যা করলেন, সে-ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়?’ ফোড়ন কাটল সেলেনা।

‘আপনাদের তো বলেইছি, শুধুমাত্র ঝুঁকি যাচাই করি আমি। ক্যারেনকে ওর পথে চলতে দেয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না আমার। নিজের আসল পরিচয়টা যদি প্ৰকাশ করে দিতাম—’

‘নিজেকেও তা হলে বিপদে ফেলতেন আপনি,’ কথাটা শেষ করে দিল রানা। ‘আপনাকেও হয়তো তখন দেখা দিত রিপেয়ারম্যান। একদিক থেকে ভালোই হতো সেটা… এখনকার এ অবস্থায় পড়তে হতো না আমাদের…’

চামড়া পোড়াচ্ছে যেন জিনিসটা, এমনিভাবে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল গুস্তাফ। ‘এই দেখুন… অস্ত্র নেই আমার কাছে!’ মাথার উপর উঠে গেল হাত দুটো। ‘সারেণ্ডার করছি আমি!’

মাথা নাড়ল রানা। ‘দুঃখিত, ওস্তাদ। অনেক আগেই ওই স্টেজ পার হয়ে এসেছি আমরা। গলা পর্যন্ত পাঁকে ডুবেছেন আপনি। যো জিতা, উওহি সিকান্দার; অওর যো হারা, উওহি ভিকান্দার।’

‘ক্-কী করতে চাইছেন?’ গলা কাঁপছে গুস্তাফের।

‘বেশি কিছু নয়, শুধু ঘাড়টা ভাঙব আপনার,’ বলল রানা শান্ত, স্বাভাবিক কণ্ঠে। ‘শুরু থেকেই আপনাকে পছন্দ হয়নি আমার। আর এখন তো আরও নয়।

আর পিছানোর উপায় নেই লোকটার। আক্ষরিক অর্থেই পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। ওর প্রায় গায়ের উপর এসে পড়েছে রানা।

হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মীরজাফর।

‘করজোড়ে প্রাণভিক্ষা চাইছি আপনার কাছে!’ শুরু হলো তার রোদন ভরা এ বসন্ত… সখি কখনও আসেনি বুঝি আগে। বৃষ্টির মত ঝরঝর করে লবণপানি নামছে দু’গাল বেয়ে। ‘আচ্ছা, আচ্ছা… শুনুন, শুনুন… তিন লক্ষ ডলারের চেক দিচ্ছি আপনাকে! এক্সপেন্স মানি হিসেবে এ টাকা দিয়েছে ওরা। আমাকে ছেড়ে দিলে টাকাটা আপনার… প্রতিটা পাই-পয়সা পর্যন্ত। এক দিনের মধ্যেই অ্যাকাউন্টে চলে আসবে টাকাটা —আরে, কী বলি—এক ঘণ্টার মধ্যে! চলুন, অন্যরা এসে পড়ার আগেই পালিয়ে যাই এখান থেকে। লুকানোর ভালো জায়গা জানা আছে আমার। একবার শুধু ছেড়ে দিয়ে—আম্!’

টেনে-হিঁচড়ে লোকটাকে দাঁড় করিয়ে দিল রানা।

রানার বজ্রমুষ্টির মধ্যে দুষ্ট ছেলের হাতে বিড়ালের বাচ্চার মত ছটফট করে উঠল গুস্তাফ ভিকান্দার। আঁচড়ে, খামচে, ঠেলা-গুঁতো মেরে চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার।

লোকটার ন্যাড়া মাথা আর চোয়াল আঁকড়ে ধরল রানা। তার পর ‘মড়াত’ শব্দে মোচড় মেরে সত্যি সত্যিই মটকে দিল ঘাড়টা।

গলাতেই মরে গেল গুস্তাফের মরণ-চিৎকার। থপ করে লুটিয়ে পড়ল প্রাণহীন দেহ।

বড় বড় চোখ করে লাশটার দিকে চেয়ে রয়েছে সেলেনা। হরর মুভির দৃশ্য দেখছে যেন।

‘সরি, তোমার এটা দেখতে হলো বলে,’ বলল রানা মৃদু স্বরে।

‘মৃত্যুটা প্রাপ্য ছিল লোকটার,’ অনুমোদন করল সেলেনা। ‘আসলে ভাবছিলাম, বড় বেশি সহজ মৃত্যু হলো যেন।’

‘মৃত্যু মৃত্যুই,’ দার্শনিক মন্তব্য রানার। ‘চলো এখন, লোকজন এসে হাজির হওয়ার আগেই পগার পার হই এখান…’

কথাটা শেষ করার আগেই শোনা গেল দূরাগত হেলিকপ্টারের ধুবধুব আওয়াজ।

বড্ড দেরি হয়ে গেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *