ঊনসত্তর
ওয়াদা রাখল রানা। পরের পুরোটা দিন, পুরো রাত, এবং তার পরের দিনটাও নড়ানো গেল না ওকে সেলেনার পাশ থেকে। নার্স, ডাক্তার—কারও কোনও কথাই কানে তুলল না ও। খুব বেশি খিদে না পেলে মুখে তুলল না কিছু। ঘুমানোর কাজটা সারল দয়াপরবশ নার্সের এনে দেয়া চেয়ারে বসে। একমাত্র মেডিকেল টিম যখন দেখতে এল সেলেনাকে, তখনই শুধু ওয়ার্ড ছাড়ল বেয়াড়া মানুষটা।
হাসপাতাল আর সেলেনার কামরাটাই নিজস্ব জগৎ হয়ে উঠেছে রানার। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে, ওয়ার্ডে আসা নিউজ রিপোর্টগুলো। চলতে-ফিরতে সক্ষম আবাসিক রোগীরাই মূলত টিভি বুলেটিনের দর্শক হিসাবে পালন করছে বার্তাবাহকের ভূমিকা।
খবর অনুযায়ী, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সুনামি ছিল ওটা। অন্তত দশ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়েছে। দুর্যোগের কারণ হিসাবে জলবায়ুর বিশৃঙ্খলা, সৌর ঝড়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন—এসব নানান সম্ভাবনা নিয়ে তুলকালাম চলছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে। যথারীতি সাহায্যের ডালি উপুড় করে দিয়েছে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো।
শুনতে শুনতে অসুস্থ বোধ করতে লাগল রানা।
প্রতিনিয়ত একটু একটু করে জোর ফিরে পেতে দেখছে সেলেনাকে। নিয়মিত এসে দেখে যাচ্ছেন ডক্টর আবদুল্লাহ।
কঙ্কাশনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হিসাবে মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, স্মৃতিভ্রংশ, বমি বমি ভাব, ইত্যাদি যেসব উপসর্গের কথা বলেছিলেন ডাক্তার, প্রতি ভিজিটেই একটু একটু করে কমে এল সেসব আশঙ্কার সংখ্যা। তৃতীয় সন্ধ্যায় এক পাশে ডেকে নিয়ে রানাকে জানালেন, শিগগিরই হাসপাতাল ছাড়তে পারবে সেলেনা। বিব্রত ভঙ্গিতে যোগ করলেন এর পর, চাপ রয়েছে মুমূর্ষু রোগীদের। সেজন্যই ছাড়তে হচ্ছে বিছানাটা। বিপদও অবশ্য কেটে গেছে মিস বার্নহার্টের।
ফিল কোহেনও দেখতে আসছে সময়ে সময়ে। গোড়ালি ঠিক হয়ে গেছে লোকটার। সেলেনার দ্রুত উন্নতি দেখে সে-ও খুশি রানার মত।
প্রাক্তন মেজর যখন সঙ্গ দিচ্ছে মেয়েটাকে, নিজের কাজে ব্যস্ত রইল সিআইএ এজেন্ট। চতুর্থ বার যখন ওয়ার্ডে এসে হাজিরা দিল লোকটা, গোমড়ামুখো এক যুবককে নিয়ে এল সাথে করে।
জাকার্তার আমেরিকান এমব্যাসির হ্যারি হফম্যান বলে নিজের পরিচয় দিল যুবকটি। দুর্যোগকবলিত আমেরিকান নাগরিকরা যাতে ঠিক মত ফিরতে পারে দেশে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার উপরই ন্যস্ত।
ভদ্র গোছের, বুদ্ধিদীপ্ত লোক বলে মনে হলো তাকে রানার। বিশ্বাস করা যায়। ঠিক হলো, প্রথমে শিকাগোয় পাঠিয়ে দেয়া হবে মেয়েটাকে। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই চলবে চিকিৎসা। পুরোপুরি সুস্থ হলে ফিরে যেতে পারবে ও ক্যানাডায়।
হ্যারি হফম্যানকে রাজি করানোর পিছনে সিআইএ এজেন্টের তুকতাক রয়েছে, এটুকু বুঝতে পারল রানা; কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করাটা সমীচীন মনে করল না।
জাদুমন্ত্রের মত ঘটতে লাগল এর পরের সব কিছু। চতুর্থ দিন সকালের মধ্যেই সুসম্পন্ন হয়ে গেল সমস্ত জোগাড়যন্ত্র।
হফম্যানের এক সহকারী কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছে সেলেনার জন্য। বিছানা থেকে ওকে নামতে সাহায্য করল সিস্টাররা।
ড্রেস চেঞ্জ করার সময় বেরিয়ে যেতে হলো রানাকে। নিরন্তর শক্তি ফিরে পাচ্ছে মেয়েটা। তবে কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলার পক্ষে যথেষ্ট দুর্বল এখনও। হুইলচেয়ারে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছেন ওকে চিকিৎসক।
বিদায়ের ক্ষণ এসে উপস্থিত হলো এক সময়। হুইলচেয়ার ঠেলে ওয়ার্ড থেকে বের করে নিয়ে এল রানা মেয়েটাকে।
হফম্যান আর কালো সুট পরা ওর ক’জন কলিগ লবিতে অপেক্ষা করছিল। দুর্যোগের প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পর, অন্য রকম মনে হচ্ছে হাসপাতালটাকে।
‘যেতে ইচ্ছে করছে না, রানা!’ বলল সেলেনা বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে।
চাকাঅলা চেয়ারটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটার হাত ধরল রানা। ‘মিস্টার হফম্যান আর ওঁর লোকেরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সাথে থাকছেন তোমার। শিকাগোতে পৌঁছনোর পর সরকারি লোকজনের হাতে তুলে দেয়া হবে তোমাকে। ওঁদের হেফাজতে নিরাপদ থাকবে তুমি। সুস্থ হলে ফিরতে পারবে অটোয়ায়।’
‘বলছি, তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না!’ বলল সেলেনা অনুনয়ের সুরে, ‘তুমিও চলো না সাথে!’
‘উপায় নেই যে!’
টপ করে এক ফোঁটা গরম পানি পড়ল সেলেনার চোখ থেকে। সাথে সাথেই মুছে ফেলল চোখটা। ‘আবার দেখা হবে তো, রানা?’
নির্মল হাসল রানা। ‘নিশ্চয়ই! হবেই হবে!’
‘না, হবে না… জানি আমি!’ আরও কিছু বলার জন্য ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বেরোল না। গাল দুটো কুঁচকে গেল খানিকটা। সামলে নিয়ে যোগ করল সেলেনা, ‘ভালো করেই চিনি আমি তোমাকে। এবার ওদের পেছনে লাগতে যাচ্ছ তুমি, তা-ই না, রানা?’
‘খেলা তো এখনও শেষ হয়নি, সেলেনা!’
‘কিন্তু, রানা… বিষাক্ত সাপের চাইতেও ভয়ঙ্কর এরা। প্রাণে বাঁচতে দেবে না তোমাকে!’
‘আগেও তো চেষ্টা করেছে… কই, পারেনি তো!’
বার বার ঘড়ি দেখছে হফম্যান আর ওর সহকর্মীরা।
‘যেতে হচ্ছে এখন।’ হাসল রানা ঠোঁট টিপে। শেষ বারের মত হাতে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, দুই হাতে হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়টা ওর ভেঙে ফেলার উপক্রম করল মেয়েটা।
গালে চুমু দিয়ে কোনও মতে ছাড়া পেল রানা সেলেনার কবল থেকে। আমেরিকান এমব্যাসির কর্মকর্তাটির উদ্দেশে ইশারা করতেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল ওর ফিমেল অ্যাসিস্ট্যান্ট।
র্যাম্পওয়াক ধরে অপেক্ষমাণ গাড়িটার দিকে যেতে দেখল ওদের রানা। হুইলচেয়ার ঠেলছে হফম্যানের সহকারিণী। জাকার্তা এয়ারপোর্টে জেট বিমান রয়েছে সেলেনার অপেক্ষায়।
গাড়ির পিছন-দরজাটা যখন মেলে ধরা হলো, শেষ বারের মত ঘাড় ঘোরাল সেলেনা হাত নেড়ে বিদায় জানানোর জন্য।
কিন্তু তার আগেই উল্টো ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করেছে মাসুদ রানা। কোনও রকম দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না ও বিদায়বেলায়।