ছেষট্টি
ধীর গতির ভিডিয়ো-দৃশ্যের মত ঘটছে যেন ঘটনাটা। যে- দেয়ালটা ধরে রেখেছিল গার্ডারের প্রান্ত, ভিতরের দিকে বাঁকা হয়ে ধসে পড়ল সেটা। অবলম্বন হারিয়েছে; তিন আশ্রিতকে নিয়ে পড়ে যেতে শুরু করল রুফ সাপোর্ট।
ছুটন্ত ঢেউয়ের মাঝে বিশাল, সাদা একটা কিছুকে ভেসে আসতে দেখল রানা সেলেনার কবজি আঁকড়ে ধরে পড়তে পড়তে। বিদ্যুৎ-ঝলকের মত উপলব্ধিটা এল ওর মনে। স্রেফ পানির চাপে ধসে পড়েনি দেয়াল। মাস্তুলবিহীন এক সেইলিং ইয়ট যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে, জলের দানো গিলে নিয়েছিল যেটাকে বহু মাইল দূরের সাগরে।
দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সমান হয়ে গেছে ইয়টের নাক। পড়ন্ত গার্ডারের কয়েক ইঞ্চি নিচ দিয়ে চলেছে এখন।
সেলেনাকে নিয়ে লাফ দিল রানা ডেকের উদ্দেশে। পিচ্ছিল, জলমগ্ন কাঠের উপর পড়ল দু’জন ঝপাস করে। সঙ্গে সঙ্গেই সরসর করে পিছলে সরে যেতে লাগল ছুটন্ত ইয়টের স্টার্নের দিকে।
হুইলহাউসের কোনায় গিয়ে কাঁধটা বাড়ি খেতেই অস্ফুটে কাতরে উঠল রানা। মুক্ত হাতে ডেকের রেইল ধরে ফেলল ও, ফিরে পেল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ। কাছেই আরেকটা ‘ঝপাস আওয়াজে বুঝতে পারল, ফিল কোহেনও অনুসরণ করেছে ওদেরকে।
গার্ডারটা যদি বোটের উপর পড়ত, দু’টুকরো হতো ইয়টটা। দু’ইঞ্চির জন্য স্টার্ন মিস করল ওটা; পানির ফোয়ারা ছিটাল আধডোবা ইয়টটার পিছনে।
স্রোতের সম্মুখগতির কারণে সচল রয়েছে বোটটা। নানান দিক থেকে গাছের গুঁড়ি এসে বাড়ি মেরে মেরে ছাল তুলে ফেলছে ওটার। ডানে আর বাঁয়ে দুলছে ইয়ট বিপজ্জনকভাবে।
লবণজলের জ্বলুনিতে চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে রানার। শক্ত মুঠিতে রেইল ধরা এক হাতে, আরেক মুঠোয় সেলেনার কবজি।
কীসের জানি ঠেলা লাগছে পায়ে।
কোহেন ওটা। সর্বশক্তিতে জড়িয়ে ধরেছে কিছু একটা। ডেকের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আটকানো অবলম্বনটা।
পিটপিট করে চোখ থেকে পানি সরিয়ে দেখতে পেল রানা, সোজা এগিয়ে চলেছে ওরা বিপরীত দেয়ালের দণ্ডায়মান অবশিষ্টাংশের দিকে।
ছ্যাৎ করে উঠল মনটা অমঙ্গল আশঙ্কায়। দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেলে চুরমার হয়ে যেতে পারে নৌকাটা।
কোহেনের গাছটাই বাঁচাল ওদেরকে সরাসরি দেয়ালে আঘাত করা থেকে। বিরাট এক V-আকৃতির খোঁড়ল খুঁড়ল ওটা পাথুরে দেয়ালে আঘাত করে। এর দু’সেকেণ্ড পরই, ফোকরটার এবড়োখেবড়ো কিনারে ঘষা খেয়ে সশব্দে কেঁপে উঠল ইয়ট। আলগা ইটপাথরের টুকরো ডেকের উপর পড়ে ছিটকে গেল এদিক-সেদিক। তার পরই প্রবল স্রোতের টানে বেরিয়ে এল ওরা দালান ছেড়ে।
পেরিমিটার ফেন্সের যতটুকু খাড়া রয়েছে এখনও, সেটার উপর দিয়ে পার হতে গিয়ে খরখরে ঝাঁকুনি অনুভব করল বোটের যাত্রীরা। ধাবমান তরঙ্গ ছাড়া সামনে মনে হচ্ছে নেই তার কিছু। এখনও কয়েকটা গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ফ্যাক্টোরি বিল্ডিঙের চারপাশে।
অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী প্লাবনটা। প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে ইয়ট নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। শক্ত মতন, ভাঙাচোরা নানান কিছুতে চারদিক থেকে ঠোক্কর খেয়ে এপাশ-ওপাশ দুলতে লাগল বাদামের খোসার মত।
পানির ঝাপটা একটু পর পর অন্ধ করে দিচ্ছে রানাকে। তার পরও হাত ছাড়ছে না সেলেনার। অবিশ্বাস্য লাগছে যে, বিধ্বংসী এই সুনামিতেও এতক্ষণ ধরে টিকে রয়েছে ওরা। একেকটা সেকেণ্ড পার হচ্ছে, আর মনে হচ্ছে ওর, এই বারই বুঝি খতম হয়ে গেল! কিন্তু একটা-না-একটা মিরাকল ওদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে প্রতি বারই।
বলা মুশকিল, কতখানি গভীর এই পানি। দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ওরা ডাঙার উপর দিয়ে। ভাসমান গুঁড়ি আর ভাঙা ডালপালা চতুর্দিকে।
পাথরে টক্কর লেগে বার বার গোঁত্তা খাচ্ছে ইয়টটা। কখনও অনেক উঁচুতে উঠছে ওটার সামনের দিক, কখনও ডুব মারছে হুইলহাউসের উপর ভেঙে পড়া ফেনিল পানির নিচে।
কত দূর সরে এসেছে ওরা কারখানা থেকে? কোনও রকমে পিছনদিকে ঘাড়টা ঘুরিয়ে অবাধ সাগর ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না রানা।
বলা অসম্ভব, ডাঙার কত দূর অব্দি টেনে নেবে ওদের সুনামি। এটুকু জানে শুধু, আঠার মতন লেগে থাকতে হবে ইয়টের সঙ্গে। ফাটল ধরা খোলটা যাতে পুরোপুরি তলিয়ে না যায়, এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।
জলমগ্ন বোটটার পাশে কী যেন জোরালো ধাক্কা মারল। রেইলটা প্রায় ছুটেই যাচ্ছিল রানার হাত থেকে। খাড়া হয়ে গেছে ডেক। চোখে লোনা পানির জ্বালা নিয়ে দেখতে পেল ও, মাটিতে আটকে থাকা বিশাল এক গাছের গুঁড়ির ভাঙা অংশ ফেড়ে দিয়েছে ইয়টটাকে। অজগরের মত বিরাট বিরাট সব মোটা শেকড়ের জটে আটকে গেছে এক পাশ। এ অবস্থায় ইয়টটাকে উল্টে দেয়ার তাল করছে স্রোত।
বুঝতে পারছে রানা, স্রোতের ধাক্কায় বোট ওল্টানোর আগেই করতে হবে যা করার।
কিছুটা দূরেই, একখানা কুঠার লটকানো হুইলহাউসের আউটার বাল্কহেডে। অতিশয় ঢালু ডেক ধরে স্বল্প এই দূরত্বটুকু যদি পেরোতে পারে ও, শেকড় কেটে মুক্ত করতে পারবে হয়তো বোটটাকে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না মেয়েটার কবজি ছাড়তে।
‘যাও তুমি, রানা!’ স্রোতের গর্জন ছাপিয়ে বলল সেলেনা চিৎকার করে। ‘রেইল ধরে রাখছি আমি!’
কবজি ছেড়ে দিল রানা। রেইলিং ছাড়তেই সড়াত করে পিছলে গেল ডেকের উপর দিয়ে। বিপরীত দিকের ডেক রেইল ছাড়া আর কিছুই নেই ওকে ঠেকানোর মত।
প্রচণ্ড জোরে পা দুটো আঘাত করল রেইলে। শক্তিশালী একটা ঢেউ এসে অকস্মাৎ গুঁড়িটাকে ঠেলা মারতেই সোজা হয়ে গেল ডেক। হয়তো কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে বোটটা। যেতে পারে উল্টে।
এ-ই সুযোগ, ভাবল রানা। ভয়ানক দুলুনির সঙ্গে এক পাশ থেকে আরেক পাশে পিছলাতে পিছলাতে হুইলহাউসের দিকে এগিয়ে গেল ও হামাগুড়ি দিয়ে।
একটা ঢেউ এসে ঝাপটা দিলে লেপটে গেল রানা বাল্কহেডের সঙ্গে। আঁকুপাঁকু করছে অক্সিজেনের জন্য। অসাড় শরীরে মালুম পাচ্ছে না যন্ত্রণার। হাত বাড়াল কুঠারটা মুঠোয় নেয়ার জন্য।
যে-মুহূর্তে আংটা থেকে খুলে আনল ওটা, চ্যাপ্টা মতন ধারাল কী যেন সোজা ছুটে এল ঢেউয়ের ফণা কেটে।
লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল রানা ডেকের উপর। কাঁধ-মাথা চলে গেল পানির নিচে। ফ্যাক্টোরি বিল্ডিঙের ছাত থেকে খুলে আসা টিন শিটটা চলে গেল গায়ের উপর দিয়ে। রিকট আওয়াজে হুইলহাউসের কোনা চিরে দিল টিনের পাত। পাতলা কাঠ ভেদ করে ঢুকে দু’টুকরো করে ফেলল, সামনে যা-কিছু পেল।
আধ সেকেণ্ডও যদি দেরি হতো রানার, ওরও একই দশা হতো!
স্রোত এবার গুঁড়িটাকে পানির গভীরে টেনে নিতে চাইছে। এবার সত্যি সত্যিই ওল্টাতে শুরু করল ইয়ট।
প্রায় খাড়া হয়ে যাওয়া হুইলহাউসের ক্ষতবিক্ষত কাঠামো. ধরে ঝুলে রইল রানা কোনও মতে। কানে ভেসে এল সেলেনার চিৎকার। কিন্তু জায়গায় দেখতে পেল না ওকে।
বোটটা পুরোপুরি উল্টে যেতেই ডুবে গেল রানা পানিতে আছড়ে পড়ে। শক্তিশালী ঘূর্ণি-আবর্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ওকে পানির গভীরে। হাতপা চালিয়ে যুঝছে ও, সারফেসে ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে। শ্রবণেন্দ্রিয় ভরাট করে রাখা খলবলে শব্দের ভিতরও উপর থেকে আসা জোরালো আওয়াজটা টের পেল অস্পষ্টভাবে।
দারুণ জোরে কিছু একটা আঘাত করল পিঠে। ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেল সব বাতাস। সঙ্গে সঙ্গে পানির আরও গভীরে তলিয়ে গেল রানা।
নির্জীব হয়ে পড়েছে ও। ডুবছে… ডুবে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি যেন পানির নিচে। স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে আর সায় দিচ্ছে না মন। চিরশান্তির ঘুম এসে নামছে—
ঝট্ করে চোখ দুটো খুলে গেল রানার। হাত ঝাপটাতে লাগল ও উপরে ওঠার জন্য। ভাসমান জঞ্জালের কাঠামো- গুলো দেখতে পাচ্ছে নিজের চারপাশে। সচেতনতা ফিরতেই চোখে পড়ল ওল্টানো ইয়টের স্টার্নটাও। নিচ থেকেও ঠাহর করতে পারছে, ম্লান আলো পড়ে চকচক করছে পানির উপর বেরিয়ে থাকা তলাটা।
নড়ছে না আর ওটা। অস্বচ্ছ আঁধার আর ভাসমান ময়লা- আবর্জনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করল, দুই গাছের মাঝখানে ভাঙা নাক ঢুকে রয়েছে বোটটার। গাছ দুটো এখনও খাড়া রয়েছে মানে, নিঃশেষ হয়ে এসেছে দুর্যোগটার মোমেন্টাম। সে-কারণেই মন্থর হয়ে এসেছে যেন স্রোত।
ভুস করে সারফেসে ভেসে উঠল রানা। পৃথিবীর সবটুকু অক্সিজেন যেন হাঁ করে ভরে নিতে চাইছে ফুসফুসে। পিটপিট করে চোখ থেকে লোনা পানি ঝরিয়ে নিয়ে তাকাল চারপাশে।
কোথায় কোহেন?
কোথায় সেলেনা?
নেই কোনও নামনিশানা।
ডাক দিল নাম ধরে।
সাড়া নেই কারও।
বিস্তৃত ইনল্যাণ্ডের চড়াইয়ের মাঝে, বৃক্ষে ছাওয়া উঁচু এক শৈলশিরায় স্থির হয়েছে ইয়ট। যে-গুঁড়িটার কারণে উল্টেছে নৌকাটা, আধখানা হাল ছিঁড়ে নিয়ে ভেসে গেছে ওটা নির্ঘাত। দুই গাছের ফাঁকে কায়দামতন আটকেছে বাকি আধখানা। নাকটা গুঁজেছে ঢালের বুকে।
‘সেলেনা!’ ডাকল রানা আবার। ‘মিস্টার কোহেন!’
সাঁতরে চলল ও খাড়াইয়ের দিকে।
বেরিয়ে থাকা একখানা শেকড়ের উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে পিচ্ছিল কাদায় টেনে ওঠাল নিজেকে। কম্পিত পা দুটোয় উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল পানির দিকে।
জীবনেও দেখেনি এমনতরো ধ্বংসযজ্ঞ। যুদ্ধক্ষেত্রেও নয়। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ও, সেখান থেকে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে পুব দিকে বিস্তৃত গোটা উপকূলরেখা। পার্থক্য শুধু, উপকূল বলতে নেই কিছু আর সেখানে।
সুনামির তাণ্ডব সয়ে টিকে থাকা কয়েকটা গাছ আর দালানের মাথা কেবল জেগে রয়েছে পানির উপর। আরও দূরের ইনল্যাণ্ডে, বানের স্রোত বইছে এখনও নিচু জমির উপর দিয়ে। দূর থেকে দেখে আগ্নেয়গিরির লাভা বলে মনে হচ্ছে জঞ্জালে ভরা ঢেউটাকে।
চোখের সামনেই দূরের এক বসতি প্লাবিত হতে দেখল রানা। কাত হয়ে ভাসতে ভাসতে ভয়ঙ্করভাবে সামনের দিক গুঁড়িয়ে দিয়ে আস্ত এক ট্রাক ঢুকে গেল কাঠের এক বাড়ির ভিতর। সাগরের ছোবলে ধুয়ে মুছে গেল পলায়নপর গ্রাম- বাসীদের বড়সড় একটা দল।
আরেক দিকে মুখ ঘোরাল ও। কিচ্ছু করার নেই বেচারাদের জন্য।
‘সেলেনা!’ আবার চেঁচাল গলাটা ফাটিয়ে।
নাহ, পেল না উত্তর।
অলক্ষুণে একটা ভাবনা জেঁকে বসতে আরম্ভ করল রানার মনে। সেলেনাকে হারানোর জন্য দোষারোপ করতে লাগল নিজেকে। কেন হাত ছাড়তে গেল মেয়েটার?
সোজা উপরদিকে উঠে গেছে বৃক্ষ-ছাওয়া ঢাল। ঢেউ হয়তো উপরে ছুঁড়ে দিয়েছে ওকে—এই আশায় টলতে টলতে এগিয়ে চলল রানা ঝোপঝাড় ভেঙে। ডানে-বাঁয়ে নজর রেখেছে।
হঠাৎ ভেসে এল কর্কশ চিৎকার।
ঘুরে দাঁড়াল রানা।
কোহেনের গলা! ওল্টানো বোটটার দিক থেকে আসছে।
হামাগুড়ি দিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসেই ছুটল ও শব্দ লক্ষ্য করে। আঁচড়ে-খামচে বোটটার পিঠে উঠে দেখতে পেল লোকটাকে। পানির কিনারায় পড়ে রয়েছে কাদার মধ্যে। কপালের নতুন একটা গভীর ক্ষতের কারণে রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ।
‘হেল্প!’ ব্যথায় হাঁপাতে হাঁপাতে ডান পায়ের দিকে ইঙ্গিত করল কোহেন। ‘নাড়তে পারছি না!’
কারণটা দেখতে পেল রানা। ইয়টের নিচে চাপা পড়েছে পা-টা।
কোহেনকে সাহায্য করবে, না সেলেনাকে খুঁজে বের করবে আগে, সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগল রানা একটা মুহূর্ত। শেষ পর্যন্ত অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে পারল না কোহেনকে।
পিছলে নামল ও বোট থেকে। মাটি খোঁড়ার মত কোনও কিছু পাওয়া যায় কি না, খুঁজতে লাগল আশপাশে। পেয়ে গেল চ্যাপ্টা একখানা পাথর। বেলচার কাজ চালানো যাবে এ দিয়ে।
কোহেনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বেলচা-টার সাহায্যে ভেজা মাটি তুলতে শুরু করল ও পায়ের নিচ থেকে।
‘ডক্টর বার্নহার্ট কোথায়?’ ব্যথায় বিকৃত মুখে জিজ্ঞেস করল কোহেন।
‘একই প্রশ্ন আমারও।’ খোঁড়া বন্ধ করেনি রানা।
কয়েক মিনিটেই মুক্ত হয়ে গেল পা-টা।
‘নাহ, ভাঙেনি। মচকেছে শুধু, গোড়ালির বেঢপ ফোলাটা পরীক্ষা করে রায় দিল রানা। ‘দাঁড়াতে পারবেন?’
‘পারব বোধ হয়।’
ধরল কোহেন রানার বাড়ানো হাতটা। কোঁচকানো মুখে উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে খানিকটা শুকনো জায়গায় উঠে হেলান দিল একটা গাছের গায়ে।
‘যিশুর মা!’ দৃষ্টি মেলে দেখছে প্রলয়ের দৃশ্য। শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে যেন।
‘থাকুন এখানেই,’ বলল তাকে রানা।
‘চললেন কই আপনি?’ বোকার মত প্রশ্ন করল কোহেন।
‘খুঁজতে হবে না সেলেনাকে?’ কাঁধের উপর দিয়ে জবাব দিল রানা। কণ্ঠে উম্মা। হাতপায়ের সাহায্যে নামতে লাগল আবার পানির দিকে।
দ্বিধাহীন চিত্তে ঝাঁপ দিল ও পানিতে। বোটটা ছাড়িয়ে সাঁতরাতে লাগল ভেসে আসতে থাকা জঞ্জালগুলো এড়িয়ে। সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে চোখ দুটো। মাঝে মাঝে থেমে ডাকছে মেয়েটার নাম ধরে। প্রতি মুহূর্তেই আশঙ্কা বাড়ছে জলজ্যান্ত সত্যটার ব্যাপারে—সাঁতার জানে না সেলেনা। ওল্টানো বোটের আঘাত থেকে রক্ষা যদি পেয়েও থাকে, ভেসে যাবে বন্যার স্রোতে।
ফুসফুস ভরে অক্সিজেন নিল রানা। ডুব দিল জলের আঁধারে। শক্তিশালী স্ট্রোকের সাহায্যে নেমে চলেছে নিচের দিকে।
শেকড় যেখানে ছিঁড়ে নিয়েছে বোটটা, সেখানটায় এসে সাত ফুট নিচে খুঁজে পেল রানা ছেঁড়া অংশের এবড়োখেবড়ো ফোকরটা। সাঁতরে ঢুকে পড়ল ও ফোকরের অন্ধকারে। মনে হলো, সাঁতার কাটছে কালির দোয়াতের মধ্যে। আশার দীপ টিমটিম করছে অন্তরে—আটকা পড়া কোনও এয়ারপকেটের মধ্যে জীবিত দেখতে পাবে মেয়েটাকে।
কিন্তু নোংরা পানি ছাড়া কিচ্ছু নেই বোটের অভ্যন্তরে। ফোকর গলে বেরিয়ে এল রানা। পানি ঠেলে ফিরে চলল সারফেসের দিকে।
‘লাভ নেই, রানা! চলে আসুন!’ কোহেনের কণ্ঠ ভেসে এল পাড় থেকে। ‘হারিয়েছি আমরা মেয়েটাকে।’
পাত্তা দিল না রানা। এত সহজে হাল ছাড়ার বান্দা নয় ও।
কঠোর প্রচেষ্টায় সাঁতরে এল অর্ধনিমজ্জিত স্টার্নের পাশ দিয়ে। এখান থেকে আরও অনেকখানি চোখে পড়ছে রিজের পশ্চিম পাশটা। প্রাণপণে পানি কেটে চলল ও সেদিকে।
সাঁতরানোর মাঝে বিরতি নিল রানা ওয়াটারলাইন আর ঢালু পাড় থেকে শুরু করে উপরে জন্মানো গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে নজর বোলানোর জন্য। রাজ্যের আবর্জনা ছলাৎ-ছল ডুবছে-ভাসছে পাড়ের কাছে ফেনিয়ে ওঠা পানিতে। পুরু হয়ে জমে থাকা লতাপাতা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না ওয়াটারলাইনের উপর। নৈরাশ্যবাদী একটা কণ্ঠ চুপি চুপি বলল ওর কানে: ঠিকই বলেছে কোহেন। আশা করাটা বাতুলতা এখন।
কথাটা মনে আসতেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারল রানা, কখন জানি ওর মনের অনেকখানি জায়গা অধিকার করে নিয়েছে মহৎ মনের নিঃস্বার্থ মেয়েটা। ঘুরল ও পরাজয়ের বেদনা নিয়ে। হঠাৎ করেই অসীম ক্লান্তি যেন ছেঁকে ধরেছে ওকে। সাঁতার দূরের কথা, ভেসে থাকার বল পর্যন্ত পাচ্ছে না শরীরে।
কমতে শুরু করেছে পানি। সাগরের ডাকে ফিরে চলেছে যেন আগের ঠিকানায়।
স্রোতের টান অনুভব করছে রানা। উল্টোমুখী সাঁতরাতে হবে এখন ওকে।
শৈলশিরার কিনারা জুড়ে চোখের সামনে নেমে গেল পানির লেভেল। সাঁতার ছাড়াই এগোনো যাবে এখন।
জলের উপর থেকেই দেখতে পাচ্ছে রানা জমিনের উত্থান। কাদামাখা, ভাঙাচোরা জঞ্জালের ছড়াছড়ি চারদিকে।
নোংরা একটা আকৃতি নজরে এল চোখের কোনা দিয়ে। পাড়ে শুয়ে থাকা ওপড়ানো একটা গাছের আড়ালে ওটার অর্ধেকটা। পঁচিশ গজমত বাম দিকে।
ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ড। ঘুরেই পানি ভাঙতে শুরু করল রানা পাড়ের দিকে।
‘সেলেনা!’ পৌঁছে গেছে ও।
হ্যাঁ, মেয়েটাই। মড়ার মত পড়ে রয়েছে কাদার মধ্যে। ভেজা চুলগুলো প্রায় ঢেকে দিয়েছে মুখটা।
যেটুকু স্বস্তি নিয়ে ওর উদ্দেশে সাঁতরাচ্ছিল রানা, শরীরে রক্ত দেখে এক লহমায় তা মিলিয়ে গিয়ে নতুন করে দুর্ভাবনা গেড়ে বসল মনে।
‘সেলেনা!’
না, এক চুল নড়ছে না ও!