শকওয়েভ – ৫৭

সাতান্ন

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর, এয়ার ফোর্স বেইসের কাঁটাতারের ঘেরের মধ্যে পৌঁছুল মিলিটারি পিউমা। শোঁ শোঁ আওয়াজে নেমে এল হেলিপ্যাডে।

প্রায় সারাটা পথই নিজেদের মধ্যে হাসি-তামাশায় মশগুল ছিল সৈনিকরা। বন্দিদের দিকে দৃকপাত করেনি বললেই চলে।

আগের চাইতে এখন আরও নিশ্চিত রানা—রুটিন ইন্টারোগেশনের বাইরেও বেশ কিছু প্রশ্ন ফেস করতে হবে, হয়তো তার পরই ছেড়ে দেয়া হবে ওদের। কিছু পয়সা যাবে এমার্জেন্সি ভিসার জন্য। জরিমানাও গুনতে হতে পারে। সঙ্গে পই পই করে নিষেধ করা হবে: পারমিশন ছাড়া ভুলেও যেন আর কখনও না আসে ইন্দোনেশিয়ার আকাশসীমায়।

লুকা ব্রেযনেভের ধার দেয়া বিমানটা লেক টোবায় তলিয়ে যাওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা পালনের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারে এখন রানা। এখনও ওর মাথায় আসছে না, কী জবাব দেবে বিলিয়নেয়ারকে। এই পরিস্থিতিতে ‘টাকা দিয়ে দেব’ বলাটা অশ্লীল শোনাবে রীতিমত।

ল্যাণ্ডিঙের পর তিনজনকে নামানো হলো হেলিকপ্টার থেকে। কমপাউণ্ড ঘিরে থাকা মিলিটারি বিল্ডিংগুলোর দিকে নিরুদ্বেগে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল ওদের সৈন্যরা তপ্ত অ্যাসফল্টের উপর দিয়ে।

ভাপসা গরম এক অ্যান্টি-রুমে অপেক্ষা করানোর পর একখানা অফিস-কামরায় ঢুকিয়ে দেয়া হলো রানাদের। মুখোমুখি হলো ওরা ডেস্কের পিছনে বসা গম্ভীর চেহারার নন- কমিশনড অফিসারের। লোগান বালবোয়ার পাসপোর্ট এনসিও-র হাতে, ওর লোকেরা পেয়েছে ওটা রানার ব্যাগে।

ঘোরতর সন্দেহ নিয়ে পাসপোর্টটা পরীক্ষা করার পর ঘেউ ঘেউ করে উঠল অফিসার। ভুলভাল ইংরেজিতে থেকে থেকে ছুঁড়তে লাগল প্রশ্নের তীর।

কোত্থেকে এসেছে ওরা?

আগমনের হেতু কী এই দেশে?

কার জিনিস এয়ারক্রাফটটা?

পাইলট কে ওদের মধ্যে?

সব শেষে সন্দেহ আরেকটু ঘনীভূত হলো লোকটার দুই চোখে। জানতে চাইল: এত টাকা কেন ওদের সঙ্গে?

ধৈর্যের সঙ্গে ব্যাখ্যা দিল রানা। পয়সাঅলা টুরিস্ট ওরা। কুয়ালা লামপুর যাচ্ছিল এয়ারক্রাফটে গড়বড় দেখা দেয়ার আগে। দুঃখের কথা হলো, বাকি সব জিনিসপত্রের সঙ্গে মালয়েশিয়ান ভিসা আর পাসপোর্টও হারিয়ে গেছে লেক টোবার জলে।

রহস্যময় আধো-হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে গল্পটা শুনল ছোটখাটো চেহারার এনসিও। তার পর জানাল, একটু বাদেই পদধূলি দিচ্ছে এখানে ওর সিনিয়র অফিসার। ততক্ষণ পর্যন্ত আরাম করতে পারে ওরা বিশেষ হসপিটালিটি লাউঞ্জে।

রানাকে অতিশয় উৎকণ্ঠায় ডুবিয়ে; এক সার স্টিলের দরজাঅলা হাজত-কামরা নিয়ে সঙ্কীর্ণ, নোংরা করিডোরে আনা হলো ওদের। এটারই নাম হসপিটালিটি লাউঞ্জ।

‘এ কেমন ব্যবহার!’ প্রতিবাদ করল ও। ‘অন্যায় কিছু তো করিনি আমরা।’ কিন্তু ও জানে, কোনও ফল হবে না আপত্তিতে।

আলাদা আলাদা কারাপ্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে দেয়া হলো ওদের তিনজনকে। সেলে ঢোকার আগে হাসল সেলেনা রানার দিকে তাকিয়ে। ভরসা খুঁজতে চাইছে। পরক্ষণে ‘খটাং’ শব্দে লেগে গেল ইস্পাতের দরজা।

অতি ধীরে বয়ে চলল ক্ষণ। ছোট্ট প্রকোষ্ঠে অস্থির পায়চারি করছে রানা। স্যাঁতসেঁতে, বাতাস আর জানালা- বিহীন ঘরটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে স্রেফ সাত আর ছয় কদম। ধাতব বাঙ্ক আটকানো দেয়ালের সঙ্গে। পূতিগন্ধময় টয়লেট ও মরচে পড়া, লালচে পানির কল নিয়ে বেসিন রয়েছে এক কোনায়।

অক্লেশে আটতিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর হবে কামরার তাপমাত্রা। আরশোলার জন্য আদর্শ পরিবেশ। টয়লেট আর সেলের মেঝেতে ছোটার উপর রয়েছে ঘিনঘিনে প্রাণীগুলো।

এত সময় লাগছে কেন ঊর্ধ্বতন অফিসার এসে হাজির হতে? ব্যাপার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না রানার।

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল আধঘণ্টা। পাল্লা দিয়ে মাত্রা ছাড়াল হতাশা। দরজায় দমাদম ঘুসি মেরে একটু পর পর চিৎকার করে ডাকতে লাগল ও প্রহরীদের।

সাড়া দিল না কেউ।

দরজায় থাবা দেয়া আর ডাকাডাকি বন্ধ করল না রানা। কিন্তু একটা সময় পর হাল ছাড়তে হলো ওকে। আক্রোশে টগবগ করে ফুটতে লাগল বাঙ্কের কিনারে বসে।

আরও আধঘণ্টা পর আচম্বিতে ‘ঠং’ করে খুলে গেল স্টিলের সেল ডোর। এক-দু’জন নয়, চার-চারজন সশস্ত্র সৈন্য হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়ল খুদে কামরাটায়।

আগে দেখা চেহারাগুলো চিনতে পারল রানা। সোজা ওর মাথা বরাবর তাক করা হলো অ্যাসল্ট রাইফেলগুলো। ট্রিগারে অঙুল। অফ করা সেফটি ক্যাচ। এআর-ফিফটিন আর কালাশনিকভ ডিজাইনের জবড়জং

জগাখিচুড়ি পিনড্যাডগুলো। লড়াইয়ের সময় এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা মাথাতেও আনবে না রানা। কিন্তু এই রেঞ্জ থেকে সেলের নোংরা দেয়াল আরও নোংরা করার কাজে যথেষ্ট কার্যকর অস্ত্র ওগুলো।

হাওয়াবদলের গন্ধ পেল রানা। ব্যাপার কী! পুরোপুরি বদলে গেছে এখন সৈন্যদের চালচলন। এর আগে উদাসীন আর নিরুদ্বিগ্ন ছিল ওরা তিন বন্দির ব্যাপারে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এখন, রানা যেন গুরুতর হুমকি ওদের জন্য। এক সেকেণ্ডের জন্য চোখ সরালেই এক তুড়িতে ঘায়েল করে ফেলবে সশস্ত্র চারজনকে।

সত্যি কথা হলো—এক তুড়িতে না হলেও, রানার পক্ষে একেবারে অসাধ্য নয় কাজটা। সেলেনার নিরাপত্তার চিন্তা করতে না হলে, হয়তো চেষ্টা করে দেখা যেত।

তার বদলে, ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল ও বাঙ্কবেড ছেড়ে। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে রয়েছে রাইফেলের মাযলগুলো।

জনাকীর্ণ সেলটায় পা রাখল এবার এনসিও। ট্রুপারদের মতই সাংঘাতিক উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। এমন এক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে রানার দিকে, চার-চারটে মিলিটারি রাইফেলও যেন যথেষ্ট নয় ওকে সামলাতে। সেজন্যই বোধ হয় নাইন এমএম পিস্তল বের করে ঠেসে ধরল রানার কপালে।

তেরছা চোখে তাকাল রানা পিস্তলের ব্যারেলের দিকে। মৃদু কাঁপছে ওটা অফিসারের হাতে।

ঠেলাধাক্কা দিয়ে কামরা থেকে বের করা হলো ওকে অফিসারের আদেশে। নিয়ে চলেছে করিডোর দিয়ে।

কয়েকটা প্রকোষ্ঠ পেরিয়ে সেলেনার সেলটার কাছে আসতেই ডেকে উঠল রানা ওর নাম ধরে। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল ব্যারেলের তীক্ষ্ণ খোঁচা খেল পিঠে।

‘রানা?’ স্টিলের দরজার ওপাশে চাপা শোনাল মেয়েলি কণ্ঠস্বরটা

ঠিক আছে সেলেনা, এটুকু নিশ্চিত হলো রানা। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে চলল ও। এখনও জানা নেই, কীভাবে মুক্ত হবে এ অবস্থা থেকে।

আস্তরবিহীন যে-কক্ষটায় নিয়ে আসা হলো ওকে, কংক্রিটের মেঝের মাঝামাঝি একটা মাত্র কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই সেখানে। কালিঝুলি মাখা একমাত্র জানালার গরাদে দিয়ে চুইয়ে ঢুকছে আলো।

এনসিও-র নির্দেশে বাহু ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হলো রানাকে। রাইফেলের একটা মাযল কপালের কাছে ধরে রেখে ব্যাকরেস্টের পিছনে নিয়ে যাওয়া হলো হাত দুটো।

ইস্পাতের হাতকড়ার ঠাণ্ডা স্পর্শ পেল রানা কবজিতে। আঁটসাঁট কড়া দুটো কামড় বসিয়েছে চামড়ায়।

‘শুরু হলো খেলা।’ মনে মনে হাসন ও দুঃখের হাসি।

কোনও ধরনের প্রশ্ন-টশ করা হলো না ওকে। আগেই হয়ে গেছে ওটা। সৈন্যদের মধ্যে লম্বা তাগড়াজনকে দেয়া হয়েছে পরবর্তী দায়িত্ব। হাসিমুখে এক সহকর্মীর হাতে ভুলে দিল নিজের রাইফেল। পরনের ইউনিফর্ম জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়াল চেয়ারের পাশে। কাজে নামার জন্য প্রস্তুত। বলিষ্ঠ হাত দুটোতে প্রকট হয়ে ফুটে রয়েছে শিরা-উপশিরা। আঙুলের গাঁটগুলোতে পুরানো জখম দেখে বুঝতে পারল রানা, আগেও এ ‘দায়িত্ব পালন করেছে লোকটা।

এবং আগেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে রানা। অনেক বার। অকথ্য নির্যাতনের মুখে কী করে অটল থাকতে হয়, শেখানো হয়েছে ওকে। সাধারণ যে-কোনও লোকের চাইতে সহ্যশক্তি অনেক বেশি এর। ভাঙবে, তবু মচকারে না। মরে যাবে, তবু একটা কথাও বের করা যাবে না ওর পেট থেকে।

পাঁচ-পাঁচটা জবরদস্ত ঘুসির পর রক্তের স্বাদ পেল ও জিভে। দুরমুশ করে রীতিমত হাতের সুখ মিটিয়ে নিচ্ছে তাগড়া ইন্দোনেশিয়ান।

থু করে লাল টকটকে এক দলা থুতু ছুঁড়ল রানা সৈনিকটির মুখ লক্ষ্য করে। লাগল না অবশ্য।

‘ব্যস, এ-ই?’ জানতে চাইল মুখ ভেঙচে।

ইংরেজি বোঝে না লোকটা। তবে কিছু একটা আঁচ করে নিল বেপরোয়া ধরনের সুরটা থেকে। পরবর্তী মারটা মারার জন্য পিছিয়ে আনল মুঠো।

সোলার প্লেক্সাসে মুষ্ট্যাঘাত খেয়ে বুক থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেল রানার। সম্ভবত বিচক্ষণের কাজ হলো না লোকটাকে উত্ত্যক্ত করা, ভাবল ও হাত বাঁধা অবস্থায় মারের ধকল সইতে সইতে। শ্বাস নিচ্ছে বোয়াল মাছের মত মুখ হাঁ করে।

অনেকক্ষণ ধরে চলল এই প্রহার। স্থান-কাল থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে রানা। আঘাত অনুভব করছে, যন্ত্রণা নয়। একের পর এক ছাড়া ছাড়া ভাবনা আর স্মৃতির তোড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে নিজেকে। কেবল আবছাভাবে সচেতন রয়েছে, ক্লান্ত হতে শুরু করেছে নির্যাতনকারী; ঘুসির জোর কমে গেছে অনেকখানি।

এক পর্যায়ে খুলে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফ। টেনে তোলা হলো ওকে বসা থেকে।

ঘামে চকচক করছে নির্যাতনকারীর সারা শরীরে। শ্বাস নিচ্ছে সশব্দে। হাত দুটোর পরিচর্যা করতে লাগল কামরার কোনায় গিয়ে। এক তাল কাঁচা মাংসের মত দেখাচ্ছে ও- দুটোকে।

কিছুটা হাঁটিয়ে, কিছুটা চ্যাংদোলা করে আবার সেলে ঢোকানোর জন্য নিয়ে চলল ওরা রানাকে।

নিজেকে নিয়ে ভাবছে না রানা। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে, মোটামুটি প্রস্তুত ছিল সেজন্য। ওর একমাত্র চিন্তা সেলেনাকে নিয়ে।

সেলেনার কামরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আবারও ডাকার চেষ্টা করল নাম ধরে। কিন্তু এতটাই কাবু যে, স্বর ফুটল না কণ্ঠে।

মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা হলো ওকে দরজা খুলে।

অনেক, অনেকক্ষণ কুকুর-কুণ্ডলী হয়ে পড়ে রইল রানা। নিজের রক্তের মধ্যে মুখ গোঁজা অবস্থায় মন ভেসে চলেছে অজানা কোথায়!

ধীরে, খুব ধীরে ফিরে পেল সংবিৎ। সেই সঙ্গে যন্ত্রণার বোধটাও। আর, যন্ত্রণার সঙ্গে এল চণ্ডাল ক্রোধ। রাগটা সাহায্য করল ওকে সুস্থিরভাবে চিন্তা করতে।

মাথা তুলল রানা কংক্রিট থেকে। বার কয়েক মিটমিট করল চোখ দুটো। অসহ্য যন্ত্রণায় খুলিটা মনে হচ্ছে বিস্ফোরিত হবে। যন্ত্রণা প্রশমন করার জন্য নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করল শ্বাসপ্রশ্বাসে।

বার কয়েক চেষ্টার পর ভর দিতে পারল এক কনুইয়ে। এর পর বসল ও হাঁটু গেড়ে।

বুকে হেঁটে কোনও রকমে পৌঁছল রানা নোংরা সিঙ্কের কাছে। শক্ত করে বেসিনের কিনারা আঁকড়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে টেনে তুলতে লাগল নিজেকে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে অবশেষে দাঁড়াতে পারল নিজের পায়ে।

ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে ছাড়ল রানা কলটা। ফোয়ারার মত ছিটকে বেরোনো লালচে, নোনতা পানি আঁজলা ভরে নিয়ে ছিটাল নিজের মুখে। চোখ থেকে রক্ত ধুয়ে যাওয়ার পর পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল আবার।

মুখ ধোয়া শেষে সরে এল ও সিঙ্কের কাছ থেকে। যন্ত্রণাকাতর শরীরের নীরব আর্তনাদকে পাত্তা না দিয়ে বুকডন দিল দশ বার।

তার পর আরও দশ বার।

আরও দশ বার!

আরও দশ…

বিসিআই চিফের চেহারাটা ভাসছে চোখের সামনে। কাঁচাপাকা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। শাসনের সুরে বলছেন: ফোকাস করো, রানা… সারভাইভ করো! লড়ো এবং জেতো!

দ্বিতীয় বারের মত যখন ঠাস করে খুলে গেল সেলের দরজা, রানা তখন অঘোর ঘুমে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *