শকওয়েভ – ৭৪

চুয়াত্তর

লঞ্চারের মাযল দিয়ে ‘ফোঁস’ করে বেরিয়ে এল গ্র্যাপলিং আয়ার্ন। ইনফ্লেটেবল বোটের তলায় রাখা কুণ্ডলী থেকে সরসর করে দড়ির হালকা মই খুলে নিল জাহাজের পাশ দিয়ে উপরদিকে ছুটে যাওয়া কেইবল।

রাবার-মোড়ানো গ্র্যাপলিং হুক ডেকের ধার ঘেরা রেইলিং টপকে মৃদু আওয়াজে আছড়ে পড়ল উপরে। শক্ত কোনও কিছুতে আটকানোর আগে পিছলে গেল কিছু দূর।

কয়েক বার টান দিয়ে মইটা পরীক্ষা করল রানা। না, খুলে আসার সম্ভাবনা নেই। অন্যদের ওকে সঙ্কেত দিয়ে টিকটিকির মত দ্রুত উঠে যেতে আরম্ভ করল মই বেয়ে। কোহেন, হার্ডি আর ফুলজেন্স এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে ঝাপসা হয়ে যেতে দেখল কালো অবয়বটিকে। জাহাজের গতির কারণে হালের গায়ে মৃদু ঠোকর লাগছে পায়ের।

রেইলের উপর দিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে নিচে আরেক বার সিগনাল দিল রানা।

এর পর হুতোম পেঁচার পালা। তরতর করে রোপ ল্যাডার ধরে উপরে উঠতে লাগল ফুলজেন্স।

একের পর এক ডেকে উঠে জড়ো হলো দলটা। কনটেইনারের গাদার ছায়ায় অদৃশ্য। নিঃশব্দে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাকপ্যাক খুলে বের করে নিল ভিতরের ইকুইপমেণ্ট।

প্রথমে বেরোল এমপিফাইভ সাব-মেশিন গান। লোডেড ম্যাগাজিন ‘খুট’ করে লেগে গেল রিসিভারে। মাযলে সাইলেন্সার পেঁচিয়ে, বোল্ট ক করে গুলি ঢোকানো হলো চেম্বারে। আপাতত অফ রাখা হয়েছে লেয়ার আর ট্যাকটিকাল লাইট।

এর পর অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিয়ে যে-যার হোলস্টারে পুরল প্রত্যেকে। সেই সঙ্গে ক্লিপে আটকাল গ্রেনেড।

পুবের আকাশে সবে দেখা দিতে শুরু করেছে রক্তিম ঊষার আভাস।

শুরু হলো অপারেশনের তৃতীয় চ্যাপটার।

.

কয়েক মিনিট বাদে ছয়জনের একটা প্রহরীদলকে ডেক-এ পাঠানো হলো সম্ভাব্য বোর্ডিং পার্টির খোঁজে। তিরিশ রাউণ্ডের ম্যাগাজিন সহ যার যার এমফোর কারবাইন রয়েছে সঙ্গে।

কিছুই পেল না ওরা সন্দেহ করার মত। ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বাজন রেইলের উপর দিয়ে যতখানি সম্ভব, নিচে ঝুঁকল সাহস করে। কোমরের বেল্ট টেনে ধরে রেখেছে দুই সহকর্মী।

জাহাজের পাশটা আর স্লেট পাথরের মত ধূসর, তরঙ্গোত্তাল সাগর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না গার্ডের।

মাথা নাড়ল সে আনমনে। অন্যদের মত সে-ও বুঝতে পারছে না, এ অবস্থায় কী করে কারও পক্ষে জাহাজে ওঠা সম্ভব। কিন্তু কঠোর নির্দেশ রয়েছে, এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা খোঁজাও বাদ দেয়া চলবে না।

কনটেইনারের উঁচু দুই কলামের মাঝের আইল ধরে টহল দিচ্ছে ওরা, ছায়ার ভিতর থেকে শিকারি চিতার মত পিছনে উদয় হলো চার অনুপ্রবেশকারী। ভোরের লাল আভা ঠিকরে যাচ্ছে একখানা ফেয়ারবেয়ার্ন-সাইকস কমাণ্ডো ড্যাগারের ফলায়।

আক্রান্ত হতেই পিলে চমকে গেল প্রহরীদের। চাপা গোঙানি আর ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ হলো না লোকগুলোর।

একটু পরেই আবছা ‘ছলাৎ’ আওয়াজ শোনা গেল পর পর ছয় বার। সাগরের অতল জলরাশির বুকে ঠাঁই হয়েছে লাশগুলোর। তার আগে অবশ্য আলাদা করা হয়েছে অস্ত্র আর অ্যামিউনিশন।

আবারও ছায়ার আড়ালে নিজেদের গোপন করল দলটা। কনটেইনারের এক স্তম্ভ থেকে অন্য স্তম্ভ পর্যন্ত এগিয়ে চলেছে চুপিসারে। লক্ষ্য: অত্যুচ্চ সুপারস্ট্রাকচার।

আগে আগে চলেছে রানা। ওর পিছনে কোহেন। তার পর ফুলজেন্স। সবার শেষে টম হার্ডি।

.

টার্গেটের প্রায় রেঞ্জের মধ্যে চলে এসেছে পসাইডন।

তুঙ্গে পৌঁছেছে কমাণ্ড সেন্টারের উত্তেজনা। সম্পন্ন হয়েছে টার্গেটিং সিকিউয়েন্স। কো-অর্ডিনেট দেয়ার পর স্যাটেলাইটেরও আইডেন্টিফাই করা সারা।

দেয়ালে লটকানো অ্যাটমিক ক্লকের দিকে নজর রেখেছে নিকলসন। সামনের কমপিউটার স্ক্রিনের ডিজিটাল কাউণ্ট- ডাউনের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করা ওটার সময়।

ঠিক বাইশ মিনিট পর আসবে সেই মাহেন্দ্ৰক্ষণ।

নিজেকে তুলল বৃদ্ধ চেয়ার থেকে। ছড়ি দুটো হাতে নিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে হেঁটে গেল আরেকটা কমপিউটারের দিকে। তৃতীয় বারের মত চেক করল কো-অর্ডিনেট। সাবধানের মার নেই!

তক্ষুণি ঠাস করে খুলে গেল কন্ট্রোল রুমের দরজা। লাল হয়ে রয়েছে গ্রেগর সামসার চেহারা। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল চিফের সামনে।

‘হ্যাঁ, বলো…’

‘প্রবলেম, স্যর। যে-দলটাকে ইনভেস্টিগেশনে পাঠানো হয়েছিল—’

‘পাওয়া গেছে কিছু?’

‘সেটাই সমস্যা, স্যর। রেডিয়োতে সাড়া দিচ্ছে না ওরা।’

‘একজনও না?’

‘না, স্যর!’

থমকাল চিফ জবাবটা শুনে। কলজের উপর হাত দিল যেন কেউ।

‘আরেকটা টিম পাঠাও তা হলে!’ নির্দেশ দিল উত্তেজনা চেপে।

‘অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছি, স্যর। একই হাল ওদেরও।’

‘জবাব দিচ্ছে না?’

‘একদমই না!’

কড়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল নিকলসন, বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে মুখেই রয়ে গেল কথাগুলো। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল কার্গো শিপ ভয়ানক রকম দুলে উঠে টলিয়ে দিল বৃদ্ধ লোকটাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *