শকওয়েভ – ৫৫

পঞ্চান্ন

সুমাত্রা কোস্টলাইনের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওরা, ঢেউ খেলানো সবুজ ল্যাণ্ডস্কেপ পাড়ি দিয়ে চলেছে ইনল্যাণ্ডের দিকে। মিনিটের পর মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে… কেউ কোন ও কথা বলছে না। ছোট্ট এসটি-ওয়ান আর ওটার প্রকাণ্ড দুই দিশারীর নিচ দিয়ে পিছে পড়ছে ইতস্তত গড়ে ওঠা শহর, দালানকোঠা, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল স্থাপনা আর কেটে উজাড় করা ট্রপিকাল ফরেস্টের ছোট-বড় ফালি।

‘কিছু একটা করতেই হবে আমাদের!’ কম্পিত কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠল গুস্তাফ।

‘দিস ইজ সিয়েরা ইনডিগো ফোর-টু-নাইন-ওহ।’ আবার রেডিয়ো সচল করেছে রানা। ‘ফিউল শর্ট আমাদের। সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি কাছের ল্যাণ্ডিং সাইটে কোর্স ডাইভার্ট করার। ওভার।’

ফিরতি বার্তা এল কয়েক সেকেণ্ড পর। ‘নেগেটিভ, সিয়েরা ইনডিগো ফোর-টু-নাইন-ওহ। যেভাবে চলেছেন, চলুন। ওভার।’

‘বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়, ভ্রাতা,’ বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে, নিম্নমুখী ফিউল গজ দেখল রানা।

দীর্ঘক্ষণ স্নায়ুবিনাশী টান টান নীরবতা বিরাজ করল ককপিটে। প্যাসেঞ্জার আইলে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে, আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে গুস্তাফ।

কো-পাইলট সিটের আর্মরেস্ট দুটো এতটাই জোরে আঁকড়ে ধরেছে সেলেনা, রক্ত সরে গিয়ে সাদা দেখাচ্ছে আঙুলগুলো।

ঠায় তাকিয়ে রানা সামনের দিকে। পাগলা ঘোড়ার দৌড় চলছে মনের মধ্যে।

পুরোটা সময় ওদের দু’পাশে আঠার মত লেগে রইল এফসিক্সটিন। সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মূল ফ্লাইট পাথ থেকে।

আরও আধঘণ্টা পর, দৃষ্টিসীমার বহু দূর দিয়ে মেডান ছাড়িয়ে গেল ওরা। কয়েক মাইল উত্তর-পুবে ওটা।

রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে এল রানার। পুরোপুরি সঠিক ছিল ওর ফিউল. ক্যালকুলেশন। প্রতি মিনিটেই গজ নামতে নামতে এগিয়ে যাচ্ছে ডেঞ্জার জোনের দিকে। হিসাব ভুল হওয়ার শেষ সম্ভাবনাটাও বিদায় নিয়েছে ইতোমধ্যে।

নাহ, পারবে না ওরা!

‘গন্তব্যে পৌঁছুতে অপারগ আমরা,’ আরেক বার রেডিয়োতে চেষ্টা করল রানা। ‘আবার বলছি, অপারগ আমরা গন্তব্যে পৌঁছুতে। পরিস্থিতি গুরুতর। বিকল্প ল্যাণ্ডিং প্রয়োজন…’ ফিউল রিড-আউট দেখে নিল ও চট করে। ‘বিকল্প ল্যাণ্ডিং প্রয়োজন দশ মাইলের মধ্যে। ওভার।

‘সিয়েরা ইনডিগো ফোর-টু-নাইন–ওহ, সতর্ক করা হচ্ছে আপনাদের!’ অনমনীয় কণ্ঠটা আরও একবার খরখর করে উঠল রানার এয়ারপিসে। ‘কোর্সের সামান্য বিচ্যুতি দেখলেই পরিণতি হবে মারাত্মক। ওভার।’

‘এবার?’ শ্বাসরুদ্ধ স্বরে জানতে চাইল সেলেনা।

না-বাচক মাথা নাড়ল রানা। ‘কো-অপারেট করবে না ওরা। ভাবছে, কোনও চাল চালছি আমরা। জানে, এমন সব জায়গায় নামতে পারব আমরা, যেটা ওরা পারবে না। পান থেকে চুন খসলেই ধরে নেবে ওরা, কোনও ধরনের ছলচাতুরি করছি। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে গোলাগুলি।’

খ্রিস্টনাম জপল সেলেনা। ‘কিছু একটা উপায় নিশ্চয়ই রয়েছে! বিপ-বিপ আওয়াজটা কীসের, রানা?’

কিছুক্ষণ ধরে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে ঝলসাতে থাকা হলদে- বাদামি ওয়ার্নিং লাইটটা টকটকে লালে রূপ নিয়েছে এখন।

‘ক্রিটিকাল ফিউল অ্যালার্ট’ বোঝাল রানা। ‘মিস্টার সিকান্দার! ধুরো… মিস্টার ভিকান্দার!’ ডাকল ও চিৎকার করে। ‘এবার সিটবেল্টটা বেঁধে নিয়ে বসুন দয়া করে!’

‘রানা’ ভয়ে পানি চলে এসেছে সেলেনার চোখে।

‘কিচ্ছু হবে না!’ বুশ-ফায়ারের মত বাড়তে থাকা উদ্বেগটাকে কণ্ঠে ফুটতে দিল না রানা। চোখ রাখল ককপিটের জানালায়। নিবিড় সবুজ পাতার চাঁদোয়া ঝাপসা দৃশ্যের মত ছুটে যাচ্ছে নিচ দিয়ে। জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকা আর পাহাড়ের গলিঘুঁজি সবখানে। হারিয়ে যেতে পারে ও এই গোলকধাঁধার মধ্যে। কিন্তু না, নিরাপদ নয় সেটা… উঁহু, একদমই না!

শুরু হলো পোর্ট ইঞ্জিনের তোতলামি। বুড়ো মানুষের মত খক্কর-খক্কর কাশতে কাশতে শেষে একদমই চুপ হয়ে গেল।

এবং সবাইকে চমকে দিয়ে স্থির হয়ে গেল ডান দিকের প্রপেলার। তীক্ষ্ণ বিপ বিপ আওয়াজটা পরিণত হয়েছে এখন জেদি বাচ্চার চিল-চিৎকারে। মহাবিপদসঙ্কেত ঘোষণা করছে লাল বাতি।

কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে বিকলাঙ্গ এয়ারক্রাফটের বুকের কাঁপুনি অনুভব করল রানা হাড্ডি-মজ্জায়। ডান দিকের ডানার নিচের দিকে কাত হয়ে যাওয়া ঠেকাতে যুঝছে ও প্রাণপণে।

‘বাঁচাও, ঈশ্বর!’ খাবি খাচ্ছে সেলেনা।

দূরের সিট থেকে ভেসে এল বেকায়দাভাবে আড়ষ্ট হয়ে থাকা গুস্তাফ ভিকান্দারের আতঙ্কিত চিৎকার।

‘কিচ্ছু হবে না!’ আবার আওড়াল রানা দাঁতের ফাঁক দিয়ে। জানে, মিছেই অভয় দিচ্ছে ও। পাগলা হয়ে গেছে ফিউল গজ। আলটিচ্যুড হারাচ্ছে এসটি-ওয়ান। পৃথিবীর কোনও শক্তিই তেরছাভাবে ডাইভ দেয়া ঠেকাতে পারবে না ওটার।

কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা অ্যালার্মের বিদারিত আওয়াজে। ঘুসি মেরে লাল বাতি নিভিয়ে দিল রানা। তাতেও বন্ধ হলো না গা রি-রি করা বিপিং।

তার পর ইন্তেকাল করল স্টারবোর্ড ইঞ্জিনও। ভয়ানক আতঙ্ক নিয়ে তাকাল রানা অচল হয়ে যাওয়া প্রপেলারের দিকে।

ভীতিকর নীরবতার মাঝে নিচের দিকে রওনা হয়েছে এয়ারক্রাফট!

সঙ্গে সঙ্গে রেডিয়ো এয়ারপিসে লাগাতার আসতে লাগল কোর্স অক্ষুণ্ণ রাখার সতর্ক-নির্দেশ।

কান থেকে হেডসেট খুলে ছুঁড়ে ফেলল রানা। কিছুই আর করার রইল না ওর! শক্ত হয়ে উঠেছে শরীরের সমস্ত মাংসপেশি। বরফের মত জমাট বেঁধে যেতে চাইছে কলজের পানি।

অনিবার্য পতন শুরু হয়েছে ওদের!

খাড়া ডাইভ দিয়ে জঙ্গলের মাথায় আছড়ে পড়ল পঙ্গু এয়ারক্রাফট। এমন ভয়াবহ মড়মড় আওয়াজ উঠল ডালপালা চুরমার হওয়ার, ফেড়ে ফেলা হচ্ছে যেন ফিউযেলাজের পেট। তার পর আচমকাই; যেখানে ভেবেছিল, খণ্ডবিখণ্ড হতে চলেছে ওরা অ্যাভিয়েশন ফিউলের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে; ফুড়ত করে সেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল সবুজ চাঁদোয়া। জমিনের বদলে সাঁই সাঁই করে উঠে আসতে লাগল সুপ্রশস্ত জলবিস্তার। রৌদ্রালোকে ঝিকমিক করছে ছোট ছোট দ্বীপের মালা গলায় পরে।

পলকে বুঝে ফেলল রানা, কোথায় নামছে ওরা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভলকানিক লেক এটা। এক শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ, আর তিরিশ আর তিরিশ কিলোমিটার চওড়া এই হ্রদটার নাম—টোবা; সত্তর হাজার বছর আগেকার প্রলয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এর জন্ম।

কস্মিনকালেও ভাবেনি রানা, বিমান নিয়ে কখনও ঝাঁপ দিতে হবে এই হ্রদের মধ্যে! কিন্তু এটাই ওদের একমাত্র সুযোগ। অকিঞ্চিৎকর হলেও, বেঁচে যাওয়ার সম্ভাব্য সুযোগ!

‘কিছু একটা ধরে বসো!’ চিৎকার করে বলল ও গলার রগ ফুলিয়ে।

বন্দি বিমানকে কোর্স থেকে সরতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে গেল এফসিক্সটিন। বিদ্যুদ্‌গতি আর কান ফাটানো আওয়াজ তুলে সাঁই করে আকাশের দিকে উঠে গেল ফাইটার জেট দুটো। উপরে উঠে বাতাসে ফাঁস রচনা করে ছুটে এল আবার টার্বোপ্রপের দিকে। ককপিটের ভিতর অস্ত্র প্রস্তুত করছে পাইলট দু’জন, ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে অবাধ্য চড়ুই পাখির সমতুল্য শিকারকে।

এসব কিছুই বলতে গেলে জানে না রানা। ও কেবল দেখছে, অবিশ্বাস্য গতিতে শীতল আলিঙ্গনে বাঁধতে ছুটে আসছে রোদ-ঝলমল হ্রদ।

সংঘর্ষের প্রচণ্ডতা কমাবার জন্য ডাইভের অ্যাঙ্গেলটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে রানা।

কাছিয়ে আসছে… দ্রুত বেগে কাছিয়ে আসছে লেক টোবা! আরও কাছে… আরও!

তীব্র ঝাঁকুনির জন্য প্রস্তুত হলো ওর দেহ।

বুকের অতল তল থেকে উঠে এল সেলেনার আর্ত- চিৎকার।

বোবা হয়ে গেছে গুস্তাফ ভিকান্দার।

সশব্দে আছড়ে পড়ল ওরা ধাবমান স্রোতের বুকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *