শকওয়েভ – ৭৩

তিয়াত্তর

একই দিন।

সময়টা ভোরের ঠিক আগে আগে।

স্থান: এস্তোনিয়ার উপকূল।

ঠাণ্ডা আবহাওয়া।

আকাশের রং কলঙ্কের চেয়েও কালো।

অন্ধকারের আড়াল নিয়ে তীরবেগে উপসাগরের পানি কেটে ছুটে চলেছে শক্ত ধাতের একখানা হাই-পারফর্মেন্স ইনফ্লেটেবল বোট। যাত্রীদের প্রত্যেকের পরনে কালো পোশাক।

কোনও আলো নেই নৌকায়।

দিগন্তে ভাসমান জাহাজটার কালচে অবয়বের দিকে চেয়ে রয়েছে কঠোর চেহারার আরোহীরা।

যতই সামনে এগোচ্ছে নৌকা, ততই আকারে বড় হচ্ছে পসাইডন। বিশাল কোনও সচল পাহাড় দৃশ্যমান হচ্ছে যেন ঊষার ঠিক আগমুহূর্তের আলো-আঁধারি ভেদ করে।

কার্গো জাহাজটার খানিকটা সামনে এগিয়ে মোটর বন্ধ করে দিল বোটটা। পসাইডনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় নিঃশব্দে ভাসতে লাগল ঢেউয়ের বুকে।

কাছিয়ে আসছে… আরও কাছে… বিপজ্জনকভাবে জাহাজটার সম্মুখ-ঢেউয়ের উপর উঠে পাশের দিকে চলে এল বোট। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার দূরত্বে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে জাহাজ, খাটো এক ম্যাগনেটিক মুরিং কেইবল ছুঁড়ল রানা ডেকের উদ্দেশে।

অকস্মাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে পসাইডনের সঙ্গে সঙ্গে চলতে আরম্ভ করল ডিঙি নৌকাটা। মহাকায় নীল তিমির পাশে ক্ষুদ্র একটা সাকারফিশ যেন। শক্তভাবে এঁটে রয়েছে জাহাজটার গায়ে। ডেকের কিনার থেকে নিচে কেউ উঁকি দিলে দেখতে পাবে না নৌকাটাকে।

সফল হয়েছে পরিকল্পনার প্রথম অংশ। ঘুরল রানা হার্ডির দিকে।

ডাইভিং মাস্কের পিছনে কান পর্যন্ত হেসে বুড়ো আঙুল দেখাল ওর বন্ধু। পিঠে অক্সিজেন বোতল আটকাতে সাহায্য করছে ওকে ফুলজেন্স।

পরের কাজটার জন্য প্রাক্তন নেভি ডাইভার টমাস হার্ডির চাইতে যোগ্যতর লোক আর নেই এই দলে। অপারেশনের দ্বিতীয় এই পর্যায়টির সাফল্য নির্ভর করছে ওর উপর।

নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে একটা ব্যাগ তুলল রানা। ডিনার প্লেটের সমান, ভারি একটা গোলাকার জিনিস বের করে আনল ভিতর থেকে। ধাতব জিনিসটা কয়েক ইঞ্চি পুরু।

এক জোড়া ক্যারাবাইনার ক্লিপের সাহায্যে লাইফ- লাইনের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হলো ওটা হার্ডির হারনেসে। তলায় যাওয়ার সময় জাহাজটার সঙ্গে থাকতে সাহায্য করবে লাইফ- লাইন।

অনায়াস দক্ষতায় পানিতে শরীর ছেড়ে দিল প্রাক্তন এসবিএস কমাণ্ডো। অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তে।

কেউ কোনও কথা বলছে না। রিস্টওয়াচের উজ্জ্বল ডায়ালের দিকে তাকিয়ে ক্ষণ গুনছে রানা। সেকেণ্ডগুলো ঢাকের বাড়ি মারছে বুকে।

ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ ভেঙে পড়ছে জাহাজের গায়ে। বাতাসের বেগ একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। চাপা দীর্ঘশ্বাসের মত শোনাচ্ছে এখন। বহু দূর থেকে ভেসে এল কোনও জাহাজের বাঁশির শব্দ।

দু’মিনিটেরও কম সময়ে ভেসে উঠল হার্ডি। লাইফ- লাইনের সাহায্যে উঠে এল ডিঙিতে। জাহাজের গায়ে কয়েক কেজি ওজনের হাই-এক্সপ্লোসিভ লিমপেট মাইনটা ঠিকঠাক মত লাগিয়ে দিতে পেরে বিশাল ভার নেমে গেছে যেন মাথা থেকে। দূর থেকে যখন ঘটানো হবে বিস্ফোরণ, পসাইডনের গায়ে তৈরি কদর্য গহ্বরটা কয়েক মিনিটের মধ্যে ডুবিয়ে দেবে ওটাকে।

তবে কার্গো জাহাজ ডুবিয়ে দেয়াটা পরিকল্পনার মূল অংশ নয়।

ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ডাইভারের গিয়ার, মাস্ক, ফ্লিপার খুলল হার্ডি। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল অ্যাসল্ট ভেস্ট, ট্রাউযার, বুট জোড়া।

একটা ব্যাকপ্যাক ছুঁড়ে দিল রানা ওর দিকে, আর-সবাই যেটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে।

এবার পরিকল্পনার তৃতীয় অংশে প্রবেশ করার প্রস্তুতি।

.

পসাইডনের কমাণ্ড সেন্টারে, নিজের সিট থেকে লাফিয়ে উঠল এক রেইডার অপারেটর। এই মাত্র একটা অসঙ্গতি আবিষ্কার করেছে।

চিফের রাইটহ্যাণ্ডের কাছে পৌঁছে গেল তার মেসেজ। ভীষণ দুশ্চিন্তা নিয়ে মেইন কন্ট্রোল রুমে চলল সামসা চিফকে জানাতে।

‘কাছেই একটা সিগনাল ধরতে পেরেছে আমাদের রেইডার!’ কোনও ভূমিকা না করেই বলল গ্রেগর সামসা। ‘ছোটখাটো কোনও জাহাজ বলে মনে হচ্ছে, স্যর!’

‘ব্যস্ত জলপথ এটা, গ্রেগর।’ অসন্তুষ্টিতে ভুরু কুঁচকে উঠেছে বৃদ্ধের। ‘এ ধরনের জাহাজ থাকাটা কি অস্বাভাবিক?’

‘তবে এটা একটু অন্য রকম, স্যর!’ বলল সামসা। ‘একদম কাছে এসে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে জিনিসটা।’

কী একটা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখল নিকলসন। ‘ওরকমভাবে তো গায়েব হওয়া সম্ভব নয়… যদি না…

‘জি, স্যর।’ নড করল সামসা। ‘যদি না আমাদের জাহাজে নোঙর করে ওটা। এভাবেই শুধু রেইডারকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব।’

কোঁচকানো ভুরু দুটো আর সোজা হলো না চিফের।

সত্যিই যদি তা-ই হয়ে থাকে ব্যাপারটা, কারা ওরা তবে?

সবার অলক্ষে কী করে উঠে পড়ল জাহাজে?

ড্রাগ শিপমেন্ট আটকের জন্য ফিনিস কাস্টমস কর্মকর্তাদের আকস্মিক রেইডের সঙ্গে পরিচিত ওরা। কিন্তু কেমন জানি বিসদৃশ মনে হচ্ছে সম্ভাবনাটা।

‘ইনভেস্টিগেশন টিম পাঠাও তাড়াতাড়ি!’ কর্কশ সুরে নির্দেশ দিল চিফ।

ত্বরিত বেরিয়ে গেল সামসা সিকিউরিটির লোকজনকে সতর্ক করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *